উষ্ণতা পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
65

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৬

এশার আযান দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। একদিন খুতবায় ইতমিনান শুনেছে, আযানের পর দোয়া করলে নাকি সেই দোয়া কবুল হয়। আজ খুব মনোযোগ দিয়ে আযান শুনে তারপর দোয়া করেছে সে। আর কিছুক্ষণ পর জামাআত শুরু হবে। ওযু করে ফোন হাতে নিলো ইতমিনান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিলো। বিড়বিড় করে বলল, “আল্লাহ প্লিজ!”
কল যাচ্ছে। অদ্ভুত এক শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এক নারী কণ্ঠে শোনা গেলো “আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন! ধন্যবাদ।”
ইতমিনানের কপালে ভাঁজ পড়লো। ইংরেজিতে একই জিনিস শোনার আগে কল কেঁটে দিলো সে। আবার কল দিলো। ইতমিনান ভেবে পায় না সবসময় নারী কণ্ঠই কেনো শোনা যায়। কোনো পুরুষ কি ওখানে কাজ করে না নাকি নারীদের জন্য জায়গাটা সংরক্ষিত? তার অদ্ভুত ইচ্ছা এই শব্দগুলো কোনো একদিন কোনো পুরুষ কণ্ঠে শুনবে। আচ্ছা, কেমন লাগবে? খুব বেশি অদ্ভুত?

এবার কল ঢুকলো। মায়ের স্নেহময়ী কণ্ঠে ইতমিনানের ধ্যান ভাঙলো।
“কেমন আছো আব্বা?”
“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ আব্বা। ভালো আছি। কি করো?”
“ওযু করে আসলাম। নামাজে যাবো। মা!”
“বলো আব্বা।”
ইতমিনানের বুকটা ঠান্ডা হয়ে যায় যখন আয়েশা তাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকেন। কেমন একটা স্নেহ মাখা পরশ আছে ডাকটায়।
ইতমিনান চেষ্টা করলো কণ্ঠ সর্বোচ্চ নরম করতে, “আমি তোমার কেমন ছেলে মা?”
আয়েশা হেসে ফেললেন, “তুই আমার বিয়ের বয়স হওয়া অবিবাহিত ছেলে।”
হেসে ফেললো ইতমিনান নিজেও।
“বলো মা।”
“তুই আমার বাধ্য ছেলে। কেনো? কি হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি। শুনলাম আমার মা আমাকে কেমন ভাবে। মা তুমি অনুমতি দিলে একটা কথা বলব।”
“কি আশ্চর্য! অনুমতির কি আছে? বল।”
“আচ্ছা। আমি যা বলব তুমি আগে মন দিয়ে শুনবে। অপছন্দ হলে আগেই রাগ করবে না। আগে ভাববে। আমাকে প্রশ্ন করবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। ঠিকাছে?”
আয়েশার মনটা খচখচ করতে লাগলো। কি এমন বলবে ইতমিনান?
“ঠিকাছে বল।”
“বলো তো রিজিকের মালিক কে?” ইতমিনান যেনো ছোট বাচ্চা। আয়েশার কাছে তাই মনে হলো।
“আল্লাহ। আবার কে।”
“ঠিক বলেছো। এখন আল্লাহ আমাদের যেই রিজিক দেবে তার বাইরে কিছু ভোগ করার সাধ্য তো আমাদের নেই। আবার যেটা আমাদের জন্য আল্লাহ বরাদ্দ করে রেখেছেন সেটা কেড়ে নেবে এমন সাধ্যও কারো নেই। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমরা যদি স্বার্থপর চিন্তাভাবনা করে শুধুমাত্র নিজের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করি, অন্যকে বিপদে ফেলতে দুইবার না ভাবি তাহলে কি আমাদের জন্য বরাদ্দ থাকা রিজিক বরকত থাকবে মা?”
“না। অন্যের কথা চিন্তা না করলে আল্লাহ আমাদের কথা চিন্তা করবে কেনো?”
“এটাই তো। আমার মা আমাকে ছোট থেকে অন্যের চিন্তা করতে শিখিয়েছে। নিজের সুযোগ সুবিধার আগে আরেকজনের সুবিধা দেখতে শিখিয়েছে। এখন সেই শিক্ষা আমি কি করে ভুলি বলো তো?”
ইতমিনানের সুরে সম্মান। মায়ের শিক্ষার প্রতি ভক্তি। আয়েশার ভালো লাগার সাথে সাথে কপালে ভাঁজ পড়ল।
“ভুলতে বলছে কে তোকে?”
“তোমরাই তো।”
“আমি কবে বললাম?”
“তুমিই তো বললে মালিহাদের চিন্তা না করে নিজেদের চিন্তা করতে।”
আয়েশা চুপ করে গেলেন। ইতমিনান আবার বলল, “জানো মা মালিহা সকালে প্রায় দুই আড়াই ঘণ্টা একটা কোচিংয়ে পড়ায়। তারপর ক্লাস করে। ক্লাস শেষ করে যে বিশ্রাম নেবে সেই সুযোগও নেই। বিকেলেও একটা টিউশনি করছে। সেটা আবার ওর ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে। আমার অফিসের সামনে দিয়ে যায়। পুরোটা রাস্তা হেঁটে যায় হেঁটে আসে।” ইতমিনান চুপ করলো। কথাগুলো যেনো আয়েশার কর্ণকুহরে ভেদ করে সোজা বুকে যেয়ে লাগলো। ঐটুকুনি মেয়ে এতো কষ্ট করছে!
“কেনো?” হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করলেন আয়েশা।
“ও তো চাচী আর মিতুলকে এখানে নিয়ে আসতে চায়। সেজন্য বাসা ভাড়া নিতে হবে না? একটা সংসার চালাতে গেলে কতো রকম খরচ আছে। তুমি তো জানোই।”
আয়েশার এবার বিরক্ত লাগলো, “আমি বুঝি না নিজের বাড়ি থাকতে কেনো অন্য জায়গায় যাওয়া লাগবে।”
“চাচী কিন্তু বাপের বাড়ি চলে গেছে মা।”
“ওর মাথায় ঘিলু আছে? ভাইয়ের বাড়ির মজা কয়দিন থাকবে? বুদ্ধি তো নেবে না। ভাববে তার ভালো আমরা দেখতে পারি না। তোর বাপ গিয়েছিলো না বোঝাতে? এক গাদা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা মুখ শুকনো করে চলে গেল। আজকে বাড়ি এসেছিল। কি অবস্থা চেহারার!” শেষ কথায় যেনো মায়া ঝরে পড়ল। ইতমিনান স্বস্তি পেলো। সে জানতো তার মায়ের মনে মায়া আছে। সেটা যে কিসের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল সেটাই বুঝতে পারছিলো না।
“ঐ জন্যেই মনে হয় মালিহা ওদের নিয়ে আসতে চাচ্ছে। আচ্ছা মা এবার বলো তো আমি যে পুকুর আর ফসলি জমিটা ওদের দেয়ার কথা বলেছি সেটা তোমার কেনো অপছন্দ হয়েছে?”
আয়েশা চুপ করে রইলেন। এই মুহূর্তে আগের সেই রাগ বা ক্ষোভ কোনোটাই নেই। উল্টো মালিহা আর মিতুলের জন্য কেমন মায়া লাগছে।
“আমার আর মিলির অবস্থা যদি ওদের মতো হতো তাহলে তুমি কি বলতে বলো।”
“তুই তোর বাবার সাথে কথা বল। আর পুকুর ঐ মতিনের কাছে আর যেনো না রাখে। ব্যাটা এক নম্বরের চোর।”
ইতমিনানের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। চকচক করে উঠলো পুরো চেহারা। মন চাইলো আয়েশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।
“মা তোমাকে তো এখন আমার জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে।” উৎফুল্ল স্বরে বলল ইতমিনান।
আয়েশা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন, “বাড়ি এসে যতক্ষন ইচ্ছা জড়িয়ে ধরে থাকিস। কবে আসবি বাপ?”
“জানিনা। কিন্তু তোমাকে একবার আমার এখানে নিয়ে আসবো। কেমন জায়গায় থাকি দেখে যাবা।”
আয়েশা সম্মতি জানালেন। ফোন রাখার পর তার মনে হলো বুকটা হালকা হয়ে গেছে। যেনো কোনো ভারী বোঝা সেখান থেকে নেমে গেছে।
ফোন রেখে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলো ইতমিনান। চট করে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালো। খাটের এক কোনায় রাখা টুপিটা মাথায় দিয়ে দ্রুত ঘর ছাড়লো। যে তার দোয়া এক বলাতেই কবুল করে নিয়েছে তাঁর দরবারে হাজিরা না দিয়ে কি থাকা যায়!

করিডোরের এই অংশটা কখনও ফাঁকা থাকে না। কেউ না কেউ সবসময়ই থাকে। কিন্তু এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির কারণে এখন জায়গাটা ফাঁকা। মালিহা চুপচাপ বসে ছিল। একা থাকলে রাজ্যের চিন্তা এসে মস্তিষ্কে মিছিল শুরু করে। একটার পর একটা চিন্তায় মালিহা যখন হাঁপিয়ে উঠলো তখনই তাকে কেউ ডাকলো।
“এই মালিহা! ভিজছো কেনো?”
মালিহা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। নাজিফা দাঁড়িয়ে আছে। নাজিফা অপজিট ব্লকে থাকে। এই করিডোর ব্লক দুটোর মাঝে যেনো একটা সেতুবন্ধন।
মালিহার উত্তর না পেয়ে নাজিফা এগিয়ে এসে তার কাছে দাঁড়ালো।
“ভিজছো কেনো মালিহা? জ্বর আসবে তো। এদিকে এসো।”
উঠে এলো মালিহা। না করতে ইচ্ছা করলো না তার। কেউ এমন যত্ন নিয়ে ডাকলে কি তার ডাক উপেক্ষা করা যায়?
“তোমার কি মনে খারাপ মালিহা?”
“নাহ।” মালিহা মলিন হাসলো।
“আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ।”
“তেমন কিছু না। বাবার কথা মনে পড়ছিল।”
নাজিফার মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো। মালিহার হাত ধরে বলল, “এই দুঃখের কোনো স্বান্তনা হয় না মালিহা। তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি।”
“বলো।”
“আংকেলের জন্য তোমার মনে যেই ভালোবাসা সেই ভালোবাসা কিন্তু অন্য কারো মনে এভাবে নেই। প্রত্যেকটা সম্পর্কের দাবি আলাদা। সেই দাবি থেকে ভালবাসাগুলোও ভিন্ন রকম হয়। কিন্তু আমরা বোকা এই নির্মল ভালোবাসার অনুভূতিকে পেছনে ফেলে ভাড়া করা অনুভূতি কাজে লাগাই।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল। বিষয়টা যে তার কাছে স্পষ্ট না সেটা বুঝতে পারল নাজিফা।
“আংকেলের মৃ’ত্যুর পর নিশ্চয়ই খাওয়া দাওয়া হয়েছে?”
“হ্যাঁ তিন দিনের দিন মিলাদ হয়েছে।”
“দোয়া হয়েছে না?”
“হ্যাঁ।”
“অথচ দেখো ওদের মনে কি আংকেলের জন্য এমন আবেগ আছে? ওদের দোয়ার গভীরতা শুধু বাঁধা ধরা কিছু কথার মাঝেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তোমারটা? এটা একদম খাঁটি।”
মালিহা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল, “তাহলে আমি কি করবো?”
“শেষরাতে আল্লাহ অপেক্ষা করেন জানো? কে তাঁকে ডাকবে সেই অপেক্ষা। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তাঁর বান্দা তাঁর কাছে কি চাইবে। তিনি কবুল করে নেবেন। সেই সময়ে তোমার কষ্ট, ভালোবাসা, আবেগ সবটা তাঁর দরবারে হাজির করে তুমি আংকেলের হয়ে ক্ষমা চাইবে। তার কবর জীবনটা যেনো কষ্টদায়ক না হয় সেই আকুতি করবে। আংকেলের জন্য এভাবে আর কে দোয়া করবে বলো? তোমরাই তো তার শেষ সম্বল।”

মালিহার মনটা যেনো কেঁদে উঠলো। নিজের জন্য তার বাবার আর কিছুই করার নেই। কিচ্ছু না!
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর নাজিফা বলল, “ট্যুরে যাচ্ছো না?”
মালিহা গলা খাঁকারি দিলো, “নাহ। তুমি?”
“আমিও যাবো না। নীতি যাবে?”
“না। আমি বলেছিলাম যেতে। আমাকে ছাড়া যাবে না।” মালিহা হাসলো। বন্ধুর অকারণ জেদে খুশির হাসি।
“তাহলে ঐদিন দুপুরে আমার সাথে খাবে। ঠিকাছে? আমি স্পেশাল খিচুড়ি খাওয়াবো তোমাদের। না করবে না মালিহা।”
নাজিফা উৎফুল্ল হয়ে বলল। মালিহা ইতস্তত করলো। ঐদিন যে নীতিকে ফ্রাইড রাইস খাওয়াতে চেয়েছে। কিন্তু নাজিফা কখনও বলে না। তাকে নিষেধ করাটা কেমন দেখায়। অনেকক্ষণ ভেবে-টেবে বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে।”
নাজিফা খুশি হলো, “ইনশাআল্লাহ!”

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৭

নীতি পড়ছিল। মালিহা পেছন থেকে কতক্ষন উঁকিঝুঁকি দিলো। মনিকা ঘুমাচ্ছে। একটু পরে উঠে পুরো রাত জাগবে। আঁখি রুমে নেই। সম্ভবত নিচ তলায় গেছে।
“কি সমস্যা? উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস কেনো?”
মালিহা থতমত খেয়ে গেল, “কয়টা চোখ তোর?”
“উপরের দুটোই তো শুধু দেখো। অন্তরের চোখের কি খবর রাখো হে বালিকা!” নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল নীতি। মালিহা ধপ করে নীতির বিছানায় বসে পড়ল। তার মুখে অন্ধকার। নীতি ভুরু কুঁচকে বলল, “কাহিনী কি? ফটাফট ঝেড়ে কাশ।”
“নীতি!”
“বলো সোনা!”
মালিহা বিরক্ত হলো। এই মেয়েটা কখনও সিরিয়াস হবে না।
“তোকে ট্যুরের দিন ফ্রাইড রাইস খাওয়াতে চেয়েছিলাম না?”
“প্ল্যান ক্যানসেল করলে তোর সাথে আমার দুই মিনিটের ব্রেকাপ মালিহা!” আঙুল তুলে শাসালো নীতি। নীতির আঙুল মুঠোয় পুরে মালিহা বলল, “আগে শুনবি তো! নাজিফা ঐদিন দুপুরে আমাদের দুজনকে দাওয়াত দিয়েছে।”
“হঠাৎ?”
“ট্যুরে তো নাজিফাও যাবে না। তাই বলল। আর তাছাড়া ও কখনও বলে না। এমন করে ধরলো যে না করতে পারলাম না। তোকে পরের শুক্রবার ফ্রাইড রাইস খাওয়াবো দোস্ত ইনশাআল্লাহ। পাক্কা প্রমিস!”
মালিহার চেহারার দিকে তাকিয়ে নীতি বলল, “এতো করে বলছিস তাই মেনে নিলাম। আমার আবার দয়ার শরীর।”
মালিহা হাসলো। “ঘুমিয়ে গেলাম।”
নীতি অবাক হয়ে বলল, “এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাবি! মাত্র বাজে সাড়ে দশটা।”
“সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠবো। তাই।”
“আচ্ছা। আমাকে ফজরের সময় একটু ডেকে দিস তো। পরপর চারদিন ফজর কাজা হয়ে গেসে। ভাবতেই অশান্তি লাগসে। ম’রার ঘুম!”
“আচ্ছা ডাকব ইনশাআল্লাহ।”

বেডের চার কোণায় চারটা স্ট্যান্ড। ছোট্ট মশারিটা একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়। ভেতরে ঢুকে মশারির চারপাশে গুঁজে নিজের লাইট বন্ধ করলো মালিহা। বালিশে মাথা রাখলো। সাথে সাথেই মনিকার পার্সোনাল লাইটটা জ্বে’লে উঠলো। প্রত্যেকের বেডের কোণায় টেবিলের উপর একটা করে পার্সোনাল রিডিং লাইট। রুমের মাঝ বরাবর একটা বড় রড লাইট। তবে রিডিং লাইটের আলো মেইন লাইটের চেয়ে কিছু কম নয়। মনিকার বেড মালিহার কোনাকুনি। কাজেই লাইট জ্বা’লালে সেটা সরাসরি মালিহার বিছানায় এসে পড়ে। সেই লাইটের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বুকের ওড়না মুখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মালিহা। পৃথিবীটা এমনই। কারো জীবনে অন্ধকার তো কারো জীবন আলোয় ভরপুর।

°
চারদিকে শুনশান নীরবতা। হলের কিছু ঘরে তখনও বাতি জ্ব’লছে। তবে তেমন সাড়াশব্দ নেই। সারাদিনের ক্লান্তি মাখা শরীর বিশ্রামের কাঁথা গায়ে জড়িয়ে রাতের কোলে ঘুমুচ্ছে। মনিকা ঘুমে বিভোর । তার মাথার কাছের জানালা খোলা। সেই জানালা গলিয়ে হলদেটে নরম আলো ঢুকে পড়ছে ছাত্রী হলের দোতলার এক রুমে। বাহিরে জোৎস্নার ফিনিক ফুটেছে। সম্ভবত চন্দ্র মাসের চৌদ্দ অথবা পনেরো তারিখ। চাঁদ তার পূর্ণযৌবনা রূপ দিয়ে পৃথীবির সকল প্রাণকে সম্মোহিত করে চলেছে। সম্মোহিত প্রাণীরা সেই সৌন্দর্যে বশীভূত হয়ে ভুলে গেছে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে।

ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের অস্পষ্ট শব্দ মাড়িয়ে নতুন একটা শব্দ হলো। “বিপ বিপ।” এদিক ওদিক হাতড়ে বালিশের নিচে মোবাইলটা খুঁজে পেলো মালিহা। এক ক্লিকে বন্ধ করে দিলো নতুন সেট করা অ্যালার্ম। উঠে বসে কতক্ষন ঝিম ধরে রইলো। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কানের কাছ দিয়ে একটা মশা চলে যেতেই ঘুমটা পাতলা হয়ে গেলো। চোখ টেনেটুনে দেখলো মশারি নিজেকে তোশকের ভার থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে ঝুলছে। হাত দিয়ে মশাটা তাড়িয়ে দিতে চাইলো মালিহা। মশারির স্বাধীনতায় তার সুখের সমাপ্তি। বিছানা থেকে নেমে সন্তর্পনে দরজার ছিটকিনি খুললো। দরজার সাথেই তার বিছানা। অপর দিকে নীতি। সেও গভীর ঘুমে মগ্ন। বারান্দায় যেতেই জোৎস্নার মোলায়েম রোশনাই তার শরীর ছুঁয়ে দিলো। নিজের হাত উঠিয়ে দেখলো মালিহা। কি অদ্ভুত! দিনে সূর্যের যেই আলো শরীর টাটিয়ে দেয় সেই একই আলো চাঁদ নিয়ে উষ্ণতা ছড়ায়। মোলায়েম উষ্ণতা। ওয়াশরুমের দিকে গেলো মালিহা। এই রাতে কষ্ট করে ওঠার লক্ষ্য পূরণের পালা।

পুরো একটা মানব সমাজ যখন মগ্ন ঘুমে, বিভোর কোনো এক সুখ স্বপ্নে ঠিক সেই সময় মুখে বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে জায়নামাজে দাঁড়ালো মালিহা। নাজিফা বলেছিলো আল্লাহ এই সময় অপেক্ষা করেন। তার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। আল্লাহ তার জন্য অপেক্ষা করছেন! কি আশ্চর্য!
তখনও রাত জাগ্রত, সাক্ষী আকাশের তারা। চাঁদ প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদায় জানানোর। ঠিক সেসময় মাটির বুকে মাথা রেখে আসমানে চিঠি পাঠালো মালিহা। ছোট্ট একটা চিঠি।
“আমার জীবনে জোৎস্নার মতো মোলায়েম উষ্ণতা দান কারো ইয়া রব!”

ইতমিনান এই কুকুরটাকে এখানে আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছে। লক্ষ্য করার বিশেষ কারণও অবশ্য আছে। কুকুরের চেহারায় বিশেষ কিছু নেই। তবে কুকুরটা যেনো ইতমিনানকে ফলো করে। ভোর সকালে উঠে সে যখন মসজিদের দিকে যায় তখন পিছু পিছু কুকুরটাও যায়। প্রথম কয়েকদিন ইতমিনান বিষয়টা ধরতে পারেনি। একদিন খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো। কিন্তু কুকুরের এই আচরণের রহস্য কি? ইতমিনান কুকুরের সাইকোলজি জানে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার পাখির সাইকোলজি জানার ঝোঁক উঠলো। লাইব্রেরি থেকে ম্যাগাজিন। কিছুই বাদ রাখেনি সে। সেই হিসেবে পাখি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকলেও কুকুর বিষয়ে সে অজ্ঞ। রাস্তায় রাতে চলে কিছু রিকশা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এছাড়া শহর এখনও ঘুমন্ত। শুধু জেগেছে মুয়াজ্জিন। ইতমিনান আড়চোখে কুকুরটাকে একবার দেখলো। কেমন হেলেদুলে তার পিছু পিছু আসছে।
কি মনে হতেই মসজিদের সামনে এসে আর না এগিয়ে বিপরীত রাস্তায় গেলো ইতমিনান। কুকুরটা মনে হলো বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে লাগলো। একবার মসজিদের দিকে তাকায় তো একবার ইতমিনানের দিকে। ইতমিনান বুঝে গেলো এই কুকুর তার গন্তব্য জানে। ফিরতি পথ ধরে মসজিদের ভেতর ঢুকলে কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে ঘেউ করে উঠলো। ইতমিনানের মনে হলো কুকুরটা বলছে, “আমাকে এভাবে বিভ্রান্ত করার মানে কি?”
“তুমি কি কোনো গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য?” ভুরু কুচকে বলল ইতমিনান। তার কন্ঠ গম্ভীর। কুকুর আবার শব্দ করলো, “ঘেউ!” ইতমিনান আশপাশে দেখে মসজিদের ভেতরে ঢুকে গেলো। কেউ এভাবে কথা বলতে দেখলে সমস্যা। তখন মসজিদের বদলে হেমায়েতপুরে যেতে হবে।

°

নামাজ শেষে বের হয়ে ইতমিনান দেখলো কুকুরটা তখনও রাস্তায় বসে আছে। ইতমিনান খেয়াল করলো ঠিক তার জুতো বরাবর সামনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে কুকুরটা। পাহারা দিচ্ছে নাকি? ইতমিনান জুতো পড়ে সামনের চায়ের দোকানে গেলো। এই স্নিগ্ধ সকালে এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। ইতমিনান দেখলো কুকুরটা লেজ নাড়িয়ে তার পিছু পিছু আসছে।
একটা দুধ চা দিতে বলে পুরোনো কালচে পড়া একটা বেঞ্চে বসলো ইতমিনান। কুকুরটা তার পাশেই বসেছে। জিহ্বা বের করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চা নিয়ে কুকুরটার দিকে তাকালো ইতমিনান। কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখো! লোভী কুকুর! মুখ ঘুরিয়ে চায়ে চুমুক দিলো সে। এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায় নাকি। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো কুকুরটা এখনও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ তো মহা জ্বা’লা!
“চাচা একটা পাউরুটি দিন।”
চায়ের সাথে পোড়া পাউরুটি অনেকের প্রিয় খাবার। দোকানী বলল, “পোড়ায়া দিমু?”
“না। এমনিই দিন।”
বেশ বড় গোলগাল একটা পাউরুটি নিলো ইতমিনান। কুকুরটার সামনে হাতে পাউরুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“চাচা পাউরুটি কি কুকুরের লিগা?”
ইতস্তত করে ইতমিনান বলল, “জি চাচা।”
“তাইলে সামনে দিয়া দেন। খাড়ায়া রইলেন ক্যান?”
ইতমিনানের কাছে বিষয়টা ভালো লাগলো না। বলল, “পেপার আছে চাচা? ছোট একটা টুকরা দিন তো।”
“কুকুরে খাইবো। হ্যার কি আর এইসবের চিন্তা আছে নি?” হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ দিলো দোকানী। ইতমিনান কিছু বলল না। কাগজের উপর পাউরুটি রেখে কুকুরটার সামনে দিলো। দোকানে থাকা আরেকজন বয়স্ক লোক বলল, “মানুষের মন বুঝো? ইনি কাগজে পাউরুটি দেয়। আরেকজন গরম চা গায়ে ঢাইলা দিব। দুনিয়া বড়ই আজব জায়গা হে!”
কুকুরটা একবার ইতমিনানের মুখের দিকে তাকিয়ে পাউরুটির দিকে তাকালো। পরপরই “ঘেউ ঘেউ” করে উঠলো। ইতমিনান কুকুরের ভাষা জানে না। না জানে প্রতিক্রিয়ার অর্থ। তবে তার মনে হলো কুকুরের চোখটা চিকচিক করছে। রোদ উঠলো নাকি?

নামাজ পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মালিহা। মুয়াজ্জিনের আযান শুনে তারপর ঘরে ঢুকেছে। নীতিকে ডেকে নামাজ পড়েছে। হু হা করে নীতি আবার ঘুমিয়ে গেলে আবার ডেকেছে মালিহা। এক পর্যায়ে নীতি উঠেছে। বই খাতা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো মালিহা। খোলা জায়গাটায় বসে পড়তে শুরু করলো। ভোর শেষ হলো। সূর্য উঠলো। দিনের কুসুমের মতো সুরজ যখন দাপট দিয়ে আলো ছড়াতে শুরু করলো তখন ঘরে এলো মালিহা। ফোন হাতে নিতেই দেখলো তখন মাত্র সাড়ে ছয়টা। অবাক হলো সে। কতো কাজ করলো। মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে! হেলেদুলে কোচিংয়ে যাওয়া যাবে। বোরখা টোরখা পড়ে হল থেকে বের হলো। মনটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে ডানা থাকলে প্রজাপতির মতো একটু উড়ে বেড়াতো।

সাতটা বাজার দশ মিনিট আগেই কোচিংয়ে ঢুকলো মালিহা। সেখানকার পরিবেশ তখন থমথমে। তুষারের মুখের দিকে তাকিয়ে মালিহার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই।

স্কুলের জন্য বের হওয়ার আগে মামার মুখোমুখি হলো মিতুল। মামার মুখে তখন স্বভাবসুলভ হাসিটা নেই। মিতুলের মনে হলো কোনো কারণে মামার মন খারাপ।
“তুমি নাকি কোথায় কাজ নিসো?”
মিতুল বুঝলো প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে।
“জি মামা।”
“এটা কেমন কথা মিতুল? আমার বাড়ি থেকে তোমার কাজ করা লাগবে কেনো?” মামার মুখ থমথম করছে। মুখের ভাত গিলে মিতুল বলল, “তেমন কিছু না মামা। বাড়ি থাকলে তো খেলাধুলা করতে পারতাম। এখানে তো বন্ধু বান্ধব নাই। ঘরে সারাদিন ভালো লাগে না। তাই ভাবলাম বসে না থেকে কিছু করি। আপনি কষ্ট পেয়েছেন মামা? তাহলে আমি আর যাবো না।”
সাইফের প্লেটে ডিম ভাজা তুলে দিয়ে স্বামীর কনুইয়ে গুতো দিলেন সাইফের মা। ভদ্রলোক তাকাতেই চোখ রাঙালেন। মিতুল হাসি লুকিয়ে পানি খেলো। মামা আমতা আমতা করে বললেন, “তোমার যদি ভালো লাগে তাহলে আমি কষ্ট পাবো কেনো। তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি।”
মিতুল মাথা নাড়িয়ে উঠে পড়ল। হাত ধুয়ে মায়ের আঁচলে মুছে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “তোমার ভাই এতো ভালো কেন মা?” মিতুলের ঠোঁটের কোণায় তখন খেলা করছে ছোট্ট একটা হাসি।”

চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৮

নিতু থমথমে মুখে ক্লাস নিচ্ছে। তার সাথে আছে মালিহা। এক সপ্তাহের জন্য নিতুর সাথে সাথে তাকে থাকতে হবে। কিছুটা ট্রেনিংয়ের মতো। তারপর মালিহা ক্লাস নিতে পারবে। আপাতত অন্য ক্লাস যেনো খালি না হয় সেজন্য তুষার ক্লাস নিচ্ছে।
নিতু অকারণ ধমকাধমকি করছে। মালিহার কাছে অন্তত তাই মনে হলো। তারা এখন ক্লাস সেভেনে। সেভেনের বাচ্চারা নিশ্চয়ই অনার্স পড়ুয়া ছাত্রদের মতো ব্যবহার করবে না? কিন্তু নিতু তাদের থেকে তেমন ব্যবহার আশা করছে। আশা ভঙ্গ হওয়ার দরুন তার মেজাজ চটে গেছে। মালিহা বুঝতে পারছে না এটা নিতুর নিত্যকার স্বভাব নাকি আজই সে এমন করছে। বাচ্চাগুলো দিকে তাকিয়ে তার মায়া হলো। ভয়ে সবাই শুকনো মুখে বসে আছে। না বুঝলে যে প্রশ্ন করবে সেটাও পারছে না।
ক্লাস শেষ করে নিতু আগে আগে বের হয়ে গেলো। সে যেতেই ছেলেমেয়েরা ফিসফিস করে শুরু করে দিলো। সেটা ক্রমান্বয়ে চেঁচামেচিতে পরিণত হলো। এর মাঝেই কয়েকজন ছেলের কথা শুনল মালিহা। বিস্ময়ে, লজ্জায়, অপমানে তার কান বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। নিতু একটা টাইট জিন্স এবং হাঁটু অবধি লম্বা শার্ট পড়েছিল। ক্লাসে মেজাজ দেখানোর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছু ছেলে নিতুর ড্রেসআপ নিয়ে কথা বলছে। তাদের পাস করা কমেন্টগুলো পোশাক থেকে দেহ পর্যন্ত যেয়ে যখন সীমারেখার সীমানা ছাড়িয়ে গেলো তখন বোর্ড মোছা ডাস্টার দিয়ে টেবিলের উপর জোরে শব্দ করলো মালিহা। হঠাৎ এমন শব্দে পুরো ক্লাস থমকে গেলো। মালিহা অগ্নিচোখে সেই ছেলেদের দলটার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই হনহন করে ক্লাস থেকে বের করে গেলো।

অপমানে মালিহার গলা বুঝে এলো। নারীদেহের অপমান কি তার অপমান নয়? কতটুকুই বা বয়স এই ছেলেগুলোর? বড়জোর তের চৌদ্দ। এর মাঝেই এমন মানসিকতা কিভাবে তৈরি হলো তাদের? হঠাৎ করেই ভয় পেলো মালিহা। মিতুলও কি এমন চিন্তাধারা নিয়ে বেড়ে উঠছে। কে রাখে তার খোঁজ?

°

অফিসরুমে আসতেই তুষার তাকে ইশারায় বসতে বলল। নিতু তার পাশের চেয়ারে। হঠাৎ করেই টেবিলে চাপড় মে’রে ক্ষুব্ধ কন্ঠে নিতু বলল, “তোর এই থার্ড ক্লাস কোচিংয়ে আমি আর থাকবো না।”
অভিজ্ঞ শিক্ষক হারানোর স্পষ্ট হুমকি। তুষারের ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও তার মুখ দেখে মনে হলো না সেখানে ভয়ের ছিটেফোঁটা আছে। একপেশে হাসি হেসে সে বলল, “কেনো ফার্স্ট ক্লাস কোচিংয়ে অফার পেয়েছিস নাকি?”
“আমার সাথে একদম ফাজলামি করবি না তুষারের বাচ্চা!”
“আহা! বউ বাচ্চা তুলে কথা বলবি না নিতু। ইট হার্টস!” বুকে হাত দিয়ে আহত স্বরে বলল তুষার। মালিহা অবাক হলো। তুষার বিবাহিত?
মালিহার দিকে আঙুল তাক করে নিতু বলল, “ওকে এখানে ডেকেছিস কেনো? ওর সামনে আমাকে অপমান করবি এজন্য? মজা নিচ্ছিস? তোর ঐ তিন আঙুল টিচারের পিন্ডি চটকে আমি ভর্তা বানাবো।”
“একজন শিক্ষিকার মুখে এ কেমন ভাষা হে বিধাতা!” উপরের দিকে তাকিয়ে বলল তুষার। নিতুর ধৈর্যের বাঁধ যেনো ভেঙে গেলো, “বেয়াদব! আজকেই এখানে আমার শেষ দিন। এরপর যদি আমাকে এখানে দেখিস নিজের নাম আমি পাল্টে ফেলবো।” ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো নিতু। হঠাৎ করেই যেন ঝড় থেমে গেলো। মালিহা অবাক হয়ে তখনও দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তুষার তুড়ি দিলো, “হেই মালিহা!”
চটপট সামনে তাকালো মালিহা। তুষারের মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেশ।
“এসব নরমাল বুঝলে? যতো তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারবে ততোই ভালো।”
মালিহা বলল, “কোনো সমস্যা ভাইয়া? আপু এভাবে রিয়্যাক্ট করলো..”
“সমস্যা? তা একটু আছে বলতে পারো। নিতুর ক্লাস নেয়ার কিছু স্টাইল স্টুডেন্টদের পছন্দ না। ও পড়িয়ে টপিক ক্লিয়ার করে দিত পারে। এবং সেটা দারুণভাবে। কিন্তু কখনও কোনো কোয়েশ্চেন নিতে চায় না।”
“কিন্তু কোয়েশ্চেন না করলে ছেলেমেয়েরা বুঝবে কিভাবে?” মালিহা অবাক হয়ে বলল।
“ঐ যে বললাম ও দারুণভাবে টপিক ক্লিয়ার করে দেয়। ওর নিজের ওপর এতোই কনফিডেন্ট যে ওর মনেই হয় না এরপরও কারো প্রশ্ন থাকতে পারে। কেউ যদি কোনো প্রশ্ন করেও ফেলে তাহলে ওর ইগো হার্ট হয়। একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা করে। আজকে সকালে টুটুল এসে বলল এভাবে চলতে থাকল স্টুডেন্ট কমতে বেশিদিন লাগবে না, কোচিংয়ের দুর্নাম হবে ব্লা ব্লা। এসব শুনেই নিতুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।” বড় করে দম নিলো তুষার।
“কিন্তু এটা তো সলিউশন হলো না। আপু এক্সপেরিয়েন্সড একজন। তার তো বোঝার কথা।”
“বোঝার কথা থাকলেও বোঝে না। যাক ও যাওয়াতে আজ একটা সুবিধা হলো। তোমাকে আজ আর ওর পিছু পিছু ঘুরতে হবে না। নিজের মতো করে পরের ক্লাসগুলো নিয়ে নাও।”
“কিন্তু আপু যে বললেন আর আসবেন না।” ইতস্তত করে বলল মালিহা। তুষার হেসে বলল, “ওটা তোমার আপু মাসের ভেতর চার পাঁচবার বলে। যখন ছুটি দরকার তখন নিজেই একটা ক্যাচাল লাগিয়ে নেয়। তারপর দুই তিনদিনের জন্য হাওয়া। অবশ্য এবার দুই তিনদিন থাকবে না। আমার অ্যাজাম্পশান বলে ও কাল সকলেই চলে আসবে। কারণ এতদিন লেডি টিচার হিসেবে ও একাই ছিলো। এবার তুমিও যোগ হয়েছ। কাজেই নিজের পজিশন টিকিয়ে রাখতে হলে নিতুকে আসতেই হবে। She is a tough girl, you know!” কথা শেষ করেই চোখ টিপ দিলো তুষার। মালিহা বিব্রত হলো। চোখ নামিয়ে আশপাশে তাকালো মালিহা। তুষার অপলক মালিহার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার এই নজর লুকানোটা মারাত্মক!”
চট করে তুষারের দিকে তাকালো মালিহা। তার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। তুষার তড়িঘড়ি করে বলল, “মাইন্ড করলে নাকি? আমি তো জানি ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েটা ফ্রি মাইন্ডের হয়। এটুকুতে রাগ করার কথা না। অন্তত আমার আশপাশের মেয়েদের দেখে এটাই মনে হয়।”
মালিহা শক্ত গলায় বলল, “সবাই এক না।” পরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “নেক্সট ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আমি উঠছি।”
মালিহার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো তুষার। টেবিলের ওপর হাত রেখে সেখানে গাল ঠেকিয়ে রাখলো।

অফিসে এসে ঝামেলায় করে গেছে ইতমিনান। তার ওয়ালেট পকেটে নেই। কিছু খুচরা টাকা পকেটে ছিল বলে রিকশা ভাড়া দিতে পেরেছে। নয়তো রাস্তায় মান সম্মান যেতো। কিন্তু অফিস গেটে এসে ঝামেলায় পড়েছে। আইডি কার্ড ওয়ালেটে ছিলো। সেটা মনিটরের সামনে শো না করলে অ্যাবসেন্ট দেখাবে। বাড়ির পথ ধরে যে ফেরত যাবে সেই উপায়ও নেই। অফিস টাইম শুরু হয়ে গেছে। এখন বের হলে সমস্যা। আবার ওয়ালেট পাওয়া যাবে কি না তাও নিশ্চিত না। হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান।
ম্যানেজার লোকটি ইতমিনানকে লক্ষ্য করছিলেন। কাছে এসে বললেন, “কি ব্যাপার ইতমিনান সাহেব? কোনো সমস্যা?”
ইতমিনান ইতস্তত করে বলল, “ওয়ালেটটা সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছি স্যার। খুঁজে পাচ্ছি না।”
“ভেরি স্যাড! এখানে কি ওয়ালেট খুঁজছেন?”
“না স্যার। আমার আইডি কার্ড ওয়ালেটে ছিলো। অ্যাটেনডেন্স দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। তখন খেয়াল করলাম ওয়ালেট নেই।”
“ওহ। তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেলো। কি করবেন এখন?”
“কোথাও পড়ে গেলেও তো এতক্ষণে কারো হাতে চলে গেছে। এখন ফেরত যাওয়া বোকামি হবে। আজ অফিস শেষে নতুন আইডি কার্ডের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে যাবো।”
ম্যানেজার লোকটা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ওয়ালেটে তিন হাজার টাকা ছিল। আরো কিছু খুচরা। সব গেলো। হঠাৎ মনে হলো এনআইডি কার্ডের অরিজিনাল কপিও ওখানেই ছিলো। মুখটা তেতো হয়ে এলো ইতমিনানের। নতুন করে এই কার্ড বানাতে গেলে এখন ঝামেলার এক শেষ হবে। উফফ!

অফিস শেষে বের হওয়ার আগে রেজিস্টার সেন্টারে গেলো ইতমিনান। আইডি কার্ডের জন্য অ্যাপ্লিকেশনের কথা বলতেই দায়িত্বরত লোকটা অবাক হয়ে বলল, “আপনার কার্ডের কি হয়েছে স্যার?”
“আজ সকালে ওয়ালেট হারিয়ে গেছে। তার সাথে ওটাও গেছে।”
“তাহলে আজ আপনি অ্যাটেনডেন্স দিলেন কিভাবে?”
“দিইনি তো।”
“কিন্তু এখানে যে আপনার অ্যাটেনডেন্স শো করছে।”
কম্পিউটার মনিটরে একটা ফাইল ওপেন করলো লোকটা। ইতমিনান ঝুঁকে দেখলো আসলেও তাই। চিন্তিত হয়ে বলল, “কিভাবে হলো?” হঠাৎ তার কপালের ভাঁজ সমান হয়ে গেলো। এই বিষয়ে অফিসে শুধু ম্যানেজার সাহেব জানেন। এবং তার এখতিয়ার আছে অ্যাটেনডেন্স মনিটরিং করার। কোনভাবে কি তিনিই? ইতমিনান অবাক হলো। ম্যানেজার লোকটার হাবভাবে দেখে মনেই হয়নি তিনি ইতমিনানের কার্ড হারিয়ে যাওয়ায় ব্যথিত হয়েছেন। সাহায্য যে করতে পারেন এটা ইতমিনানের মাথায়ই আসেনি। কি আশ্চর্য না? একটা মানুষের কয়েক লাইনের কিছু কথা দিয়ে আমরা তার সমগ্র সত্ত্বাকে এমন কাতারে ফেলে দিই যার সাথে সেই মানুষটার যোজন যোজনের দূরত্ব।
“আপনি একটা কার্ড ইস্যু করে দিন ভাই।”
লোকটা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম দিতেই ইতমিনান চটপট সেটা পূরণ করে ফেলল। মনটা শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ছে। মানুষের ভেতরটা পড়া কি কঠিন!

অফিস থেকে বের হতেই ইতমিনানের নিজেকে হিমু মনে হলো। কোনো টাকা পয়সা নেই। এমনকি ওয়ালেটও নেই। পরক্ষণেই মত পাল্টালো সে। হিমুদের পঞ্জাবীতে পকেট থাকে না, পায়ে জুতা থাকে না। তার প্যান্টে দুটো পকেট, শার্টে একটা বুকপকেট, পায়ে পালিশ করা কুচকুচে কালো শু। হিমু হওয়ার প্রাথমিক ধাপেই সে অসফল।
এবার নিজেকে উদাস সন্ন্যাসী ভাবলো ইতমিনান। টাকা পয়সা জীবনের সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ জিনিস। সেই ঝামেলা থেকে সে ভারমুক্ত। আহা! ভারহীন জীবনের সে কি স্বাদ! সন্ন্যাসী অনুভূতির মাঝেই মালিহার কথা মনে হলো। এখন তো সে টিউশনিতে। যাবে নাকি একবার? বাড়ি তো তার চেনাই। পরক্ষণেই সেই ভাবনাও ঘুচে গেলো। টাকা নেই, পয়সা নেই মালিহার কাছে যেয়ে করবে কি? তাকে রিকশায় উঠিয়ে নিয়েও আসতে পারবে না। গন্তব্যহীন পথিকের মতো হাঁটতে লাগলো সে। এদিক ওদিক অচেনা জায়গাগুলো ঘুরে দেখলো। মাগরিবের আযান দিলে কাছের একটা মসজিদে ঢুকে পড়ল।

ইতমিনান যখন বাড়ি ফিরল তখন অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। বাড়ির সামনে আসতেই অবাক হলো সে। কুকুরটা বসে আছে। ও কি নাইট ডিউটি করবে বলে মনস্থির করেছে?
কুকুরটার কাছে পৌঁছুতেই সে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। সেই শব্দ শুনে কোত্থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এলো। ইতমিনান অনুমান করলো নয় অথবা দশ বছর বয়স। পড়নে শুধু ময়লা, ছেড়া একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। ঊর্ধ্বাংশ উদাম। সেখানে জ্বলজ্বল করছে চামড়ার সাথে লেপ্টে থাকা বুকের খাঁচা।
“আপনে কে?”
ইতমিনান থতমত খেলো। এই প্রশ্ন তার করার কথা না? ইতমিনানের নীরবতায় ছেলেটা যেনো বিরক্ত হলো। সহসাই রোদপোড়া চেহারাটা কুঁচকে গেলো।
“এইডারে চিনেন?” কুকুরের দিকে ইশারা করে বলল ছেলেটা।
“চিনি। এটা তোমার কুকুর?”
ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলল, “জানিনা, কেউ দলিল কইরা দেয় নাই।”
“কুকুর দলিল করে দিতে হয়?” ইতনিনান হাসলো।
“কইতে পারি না। এই বাড়িতে আপনে থাকেন?”
সামনের বাড়ির দিকে ইশারা করলো ছেলেটা।
“হ্যাঁ।”
“কয় তলায়?”
“নিচ তলায়। কেনো বলো তো?”
ছেলেটা শক্ত গলায় বলল, “আপনার অতি মূল্যবান এক জিনিস আমার কাছে আছে। বলেন সেইটা কি।”
“আমার মূল্যবান জিনিস তোমার কাছে যাবে কিভাবে?”
“রাস্তায় ফালায় রাখলে যে কারুর কাছেই যাইতে পারে।” ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলল।
ইতমিনান বিস্মিত হয়ে বলল, “ওয়ালেট!”
পকেট থেকে ইতমিনানের ওয়ালেট বের করে ছেলেটা বলল, “আপনের মানিব্যাগ পাইসে এই কুত্তায়। সেই সকাল থিকা নিজে বইসা রইসে আমারেও বসায়া রাখসে।” ধপ করে কুকুরের গা ঘেষে বসে পড়ল ছেলেটা। ইতমিনানের দিকে ওয়ালেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তিন হাজার দুইশ পনের ট্যাকা আছিলো। পনের ট্যাকা দিয়া আমি আর অয় খাইসি। আপনে কুন সুমায় আইবেন তাতো জানতাম না তাই সারাদিন এইখানেই আছিলাম। কামে যাইতে পারি নাই। কাইল কাম শ্যাষ আইসা ট্যাকা দিয়া যামুনে। ন্যান ধরেন।”
ইতমিনান আপ্লুত হলো। ওয়ালেট হাতে নিয়ে বলল, “তোমার নাম কি?”
ছেলেটা গম্ভীর গলায় বলল, “মানিক মিয়া এভিনিউ।”
“মানিক মিয়া এভিনিউ কারো নাম হয় নাকি?”
“খালি মানিক হইলো কম দামী নাম। মিয়া এভিনিউ জোড়া লাইগা দামী নাম হইসে।”
“তুমি আমার অনেক বড় উপকার করলে। আমি তোমার জন্য কি করতে পারি বলো।”
“কিসুই না। সারাদিন এক জায়গায় বইসা থাইকা মাজা ব্যাকা হয়া গ্যাসে। অখন বাইত যামু। এই উঠ।”
কুকুরের গায়ে একটা লাথি দিলো মানিক। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করার বদলে কুঁই কুঁই করে ডাকলো আর লেজ নাড়ালো। ইতমিনান বুঝলো কুকুরটা এই ধরনের ব্যবহারে অভ্যস্ত। ক্ষণকালের মাঝেই আধারের গলির ভেতরে হারিয়ে গেলো মানিক এবং তার কুকুর। ইতমিনান অপলক তাকিয়ে রইলো। ঐ তো হিমু! নগ্ন পায়ের হিমু। ময়লা থ্রি কোয়ার্টার পড়া হিমু। ছেঁড়া ফাটা পকেট ওয়ালা হিমু।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে