উষ্ণতা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
74

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৩

সাইকেলের বেহাল দশা। সিটের দিকে তাকিয়ে মিতুলের কাঁদতে মন চাইলো। কিন্তু কান্নাকাটি করা যাবে না। নাইনে পড়া ছেলে কান্নাকাটি করলে মানুষ আগে হাসবে। মন ভরে হাসবে। কেউ তার কারণ খুঁজবে কি না সন্দেহ।

“দেখছো? সাইকেল একদম পোক্ত আছে না? তোমার সমস্যা পানি পানি হয়া গেলো। সাই করে যাবা আর সাই করে আসবা।”
মিতুল দেখলো তার মামা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। মিতুলের সে হাসিটা একটুও পছন্দ হলো না। এই সাইকেলে বসে গেলে তার পশ্চাৎদেশ যে সুস্থ থাকবে না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সন্দেহের বিষয় হলো এই জিনিসটা কেনো আর কারো নজরে পড়ছে না।
স্কুল ড্রেস পড়ে মিতুল খেতে বসলো। প্লেটের এক কোণায় ঢেঁড়স ভাজি। মুখে দিতেই বুঝলো গত রাতের বাসি। ঠান্ডা হয়ে আছে। নিশ্চয়ই ফ্রিজে ছিল। মিতুল মুখ কুঁচকে নিতে পারল না। এজন্য গতদিন মায়ের কাছে “নবাবজাদা” বলে বকা খেয়েছে। নিঃশব্দে খেয়ে উঠলো বটে। কিন্তু উঠতেই মনে হলো পেটে পাক দিচ্ছে। ঘরে গেলো ব্যাগ নিতে। এক ঘরেই মা ছেলে থাকছে। নাজিয়া খাটে থাকেন আর মিতুল নিচে। নাজিয়া নিচে থাকতে চেয়েছিলেন। মা’কে নিচে শুইয়ে নিজে উপরে থাকার কথা ভাবতেই পারে না মিতুল। এটাও ভাবতে পারে না কেনো তাদের নিজেদের বাড়ি রেখে মা এখানে থাকতে চায়। শুধু তিন বেলা খাওয়ার জন্য? চিন্তাটা মিতুলের মনে বিতৃষ্ণা এনে দেয়।

“মা আমি যাচ্ছি।”
নাজিয়া কোনো একটা বই পড়ছিলেন। চশমার ফাঁকা দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। মুখের ভাব দেখেই বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে।
“কি হয়েছে?”
“কি হবে? কিছু না।”
“বল আমাকে।”
“তোমাকে বলে কি করবো? শুধু শুধু বকা খেতে হবে। তার চেয়ে ঠান্ডা, বাসি ঢেঁড়স ভাজি খাওয়াই ভালো।”
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিতুল বলল, “তোমার ভাস্তির মার্কা মা-রা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি। আমার চিন্তা তো তোমার নেই, অন্তত এই দোয়া করো যেনো ঐ ভাঙ্গা সাইকেল ওরকম ভাঙ্গা অবস্থাতেই তোমার ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পারি।”
কণ্ঠের রেষটুকু লুকাতে পারলো না মিতুল। নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের অসন্তুষ্টি তিনি বোঝেন। কিন্তু এর প্রতিকার তার জানা নেই। স্বামীর বাড়িতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে ভাসুরের দয়ায় থাকতে হতো। সেটা তার পক্ষে সম্ভব না। আবার এখানে ভাইয়ের বউয়ের মুখে সদা সর্বদা মেঘ ঘনিয়ে থাকে। কোনো উপায় খুঁজে পান না নাজিয়া। খুঁজতে চেষ্টাও আর করেন না।

আজ প্রথমবার কোচিংয়ে যাচ্ছে মালিহা। ইতমিনান খোঁজ খবর নিয়ে জানিয়েছে কোচিংয়ের হিস্ট্রি নাকি ভালো। আঁখি এগিয়ে দিতে চেয়েছিল। মালিহা বিনয়ের সাথে নিষেধ করেছে। মানুষটা তার জন্য অনেক করেছে। এরপরও তার থেকে অযাচিত সুবিধা নিতে থাকলে মালিহার নিজের কাছেই খারাপ লাগবে। সেকেন্ড গেটের একটু আগে এহসানের সাথে দেখা হলো। এহসান সম্ভবত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল। মালিহাকে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“হেই মালিহা!”
মালিহা তাকালো। অন্য যেকোনো সময় দেখা হলে হালকা একটা সৌজন্যের হাসি ছুঁড়ে দেয়। এবার সেটা না দেখে এহসান বলল, “তুমি কি এখনো আমার ওপরে রেগে আছো?”
“না, তুই তো কাল ক্ষমা চেয়েছিস। তাহলে আর রাগ কিসের?”
মালিহার মুখে তুই শুনে এহসান যেনো চমকে গেলো। হাঁটা থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মালিহার দিকে। মালিহা পিছু ঘুর বলল, “কোনো সমস্যা?”
“তু..তুমি আমাকে তুই বলছো!”
“হ্যাঁ। তোর ভালো লাগছে না?” মালিহার নিষ্পাপ প্রশ্ন।
এহসান বুঝলো না কি বলবে। ডান হাত দিয়ে মুখ মুছে উপরের দিকে তাকিয়ে মুখ গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো। মালিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাসায় কি এখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো যাবে?”
মুহূর্তেই মালিহার মুখ শক্ত হয়ে গেলো। শক্ত কণ্ঠে সে বলল, “কি বলতে চাও?”
“এই যে! তোমার তুমিটাই ন্যাচারাল। তুই বললে অদ্ভুত লাগে।”
“এর সাথে প্রস্তাবের কি সম্পর্ক?”
“এই যে আমি তোমার আগে পিছে ঘুরি, এমনি না নিশ্চয়ই? তুমি সম্ভবত আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছো না। বাট আমি এক্ষেত্রে একদম সিরিয়াস। আন্টির নাম্বারটা দাও। তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না।”
এহসান পকেট থেকে ফোন বের করলো। মালিহা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম কণ্ঠে বলল, “আমার কথাটা শোনো এহসান।”
“শুনবো, সেজন্যই নাম্বার চাচ্ছি। সারা জীবন ধরেই তোমার কথা শুনবো।” মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দিলো এহসান। কিন্তু হাসিটা মালিহার যাচ্ছে মোটেও মিষ্টি লাগলো না।
“এহসান, জীবন সঙ্গীর সাথে মানসিকতার মিল হওয়া আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা তোমার সাথে আমার নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। চিন্তা চেতনায় বিস্তর ফারাক। এই গ্যাপ নিয়ে দুর থেকে একে অপরকে ভালো লাগতে পারে কিন্তু জীবন কাটানো সম্ভব না।”
“আমার কোন জিনিসটা তোমার পছন্দ না বলো। আমি এখুনি চেঞ্জ করে ফেলবো।” আকুল হয়ে বলল এহসান।
“এই যে! এটাই পছন্দ না। তোমার ব্যক্তিত্ব কি এতোটাই ঠুনকো যে কারো পছন্দ না হলেই পাল্টে ফেলবে? এভাবে ভাবতে গেলে জনে জনে চিন্তা করে তোমার সব বদল করতে হবে। সেই বদলে মাঝে তুমি নিজেই হারিয়ে যাবে।” হাতঘড়ি দেখলো মালিহা। আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে চেয়েছিল। হলো না। ঠিক সময়ে যাওয়া যায় নাকি সেটাই চিন্তা।
“আমি তো সবার চিন্তা করছি না। শুধু তোমার..”
“এহসান তুমি কি চাও অ্যাকাডেমিক লাইফের বাকিটুকু আমরা অপরিচিতের মতো কাটাই?”
এহসান থমকে গেলো। এক দলা কষ্ট বুক থেকে গলায় উঠে ঘূর্ণি পাকাতে লাগলো।
“মালিহা তুমি কি আমাকে নিয়ে একটু ভেবে দেখতে পারো না?”
এবার মালিহার সত্যিই মায়া হলো।
“আমাকে ভুল বুঝো না। কিন্তু এই অ্যাপ্রচের কারণে তোমার সাথে আগামীতে আমি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবো না। আর মানসিকতার বিষয়টা খুব ডিফিকাল্ট। এটা সহসাই চেঞ্জ করা যায় না।”
এহসান কিছু বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টির সামনে মালিহার নিজেকে অসহায় লাগলো। অস্বস্তি হলো।
“এহসান, আই অ্যাম সরি। তুমি যথেষ্ট ভালো একজন ছেলে। কিন্তু..”
এহসান ডান হাত ওঠালো। মুখ ঘুরিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে মালিহার দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল, “আমি কোনো ধরনের সিম্প্যাথি চাই না। যেটা চেয়েছিল সেটা যখন দিতে পারোনি আর..” কথা শেষ করলো না এহসান। দৃষ্টি আড়াল করে বলল, “আমি সম্ভবত তোমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছি। সরি। সরি ফর এভরিথিং।” এহসান ঘুরে দাঁড়ালো। চলে গেলো মুহূর্তের মাঝেই। মালিহা ফোস করে নিশ্বাস ছাড়ল। খারাপ লাগলেও তার কিছু করার নেই। কিছু জিনিসে মানুষের হাত পা বাঁধা থাকে। তবে এহসানের জন্য সে মন থেকে দোয়া করলো। এহসান যেনো তার নিজের মতোই ভালো একজন জীবনসঙ্গিনী পায়।
দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো মালিহা। আর দেরি করা যাবে না। তার দ্রুত পদ চারণায় রাতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো মর্মর করে উঠলো। যেগুলো সৌন্দর্য ছড়িয়েছিল গতকালও।

অফিস রুমটা বেশ ছোট। কেমন আটসাট একটা ভাব। মিনিট পনের হবে মালিহা এখানে বসে আছে। এর মাঝে ছেলেমেয়েরা যাওয়া আসা শুরু করে দিয়েছে। এটাই সম্ভবত যাওয়া আসার একমাত্র দরজা। মালিহা ধারণা করলো। আসার পর একটি মেয়ে তাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েটিও সম্ভবত এখানকার টিচার।
গলা খাকারি দিলো কেউ। মালিহা ঘুরে তাকালো। একজন যুবক প্রবেশ করতেই দাঁড়িয়ে দিলাম দিলো মালিহা। ছেলেটি হেসে সালামের উত্তর নিলো। মালিহার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল, “বসো বসে। তুমিই মালিহা?”
“জি ভাইয়া।” ইতস্তত করে বলল মালিহা। “আঁখি আপু..”
“হ্যাঁ আঁখি আমাকে ফোন করেছিল কাল রাতে। আমি তো ভেবেছিলাম ওর মতোই কেউ। কিন্তু এখন দেখছি..”
মালিহার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল ছেলেটি। সেই নজর অবশ্য মালিহা খেয়াল করলো না।
“বাই দ্যা ওয়ে! আমি তুষার। তুষার আবদুল্লাহ। মাস্টার্স,ডিপার্টমেন্ট অফ বায়ো টেকনোলজি।”
মালিহা হেসে বলল, “ইন্ট্রো তো আমার দেয়ার কথা ভাইয়া।”
তুষার মাথা নেড়ে বলল, “আঁখি আমাকে তোমার ইন্ট্রো গুলিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। তোমার থেকে ওটা নেয়া যাবে না। নাহলে আঁখি আবার বলবে ওর রুমমেটকে আমি র‍্যাগ দিয়েছি। আমি এসবে নেই।” হাত তুলে সমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল তুষার। মালিহা হেসে ফেলল। তুষার এক পলক সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বলল, “চা অর কফি?”
“কিছু না ভাইয়া। থ্যাংকস।”
“আরে শুধু আজকের জন্যই। রোজ রোজ খাওয়ানোর মতো পয়সা আমার নেই। অন্যদিন শুকনো কথা হবে। আজ একটু গলা ভেজাও।”
“বেশ। রং চা, দেড় চামচ চিনি।”
“ওকে।”
তুষার উঠে গেলো। মালিহার মনে হলো তুষার মানুষটা বেশ সহযোগী মনোভাবাপন্ন। কাজ করে শান্তি পাওয়া যাবে। মিনিট পাঁচেকের মাঝে তুষার ফিরে এলো। মালিহার দিকে কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আঁখির কাছে আমি তোমার ব্যাপারে মোটামুটি সবই শুনেছি। এরপরও তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।”
এক চুমুক চা খেলো মালিহা।
“আমার তেমন কিছু বলার নেই।”
“আচ্ছা। তাহলে আজ সিক্স আর সেভেনে একটা ইন্ট্রো দাও। চাইলে একটা ডেমো ক্লাস নিতে পারো। আউট অফ রুটিন। তাহলে স্টুডেন্ট তোমার সম্পর্কে জানবে। আগামী ক্লাসে আগ্রহী হবে।”
“ঠিকাছে।”
“আপাতত তুমি সিক্স আর সেভেনে মেজর সাব্জেক্টের অ্যাসিস্টেন্ট হিশেবে থাকো। ওগুলো তদারকি করছে আমার আরেক ক্লাসমেট, নিতু। চেনো ওকে?”
মালিহা মাথা নাড়ল। চেনে না সে।
“সমস্যা নেই। একই জায়গায় কাজ করতে গেলে চেনা পরিচয় হয়ে যাবে। কি বলো?”
“জি।”
“আচ্ছা। আর স্যালারির বিষয়টা ক্লিয়ার করি। তুমি আসার আগে একটা ছেলে ছিলো এই পোস্টে। কলেজ পড়ুয়া। সামনে একজ্যাম তাই লিভ নিয়েছে। ওর স্যালারি ছিলো পাঁচ। কিন্তু যোগ্যতার দিক দিয়ে তুমি ওর থেকে এগিয়ে আছো তাই পাঁচ দিলে সেটা না ইনসাফি হবে। আপাতত সাত দিয়ে শুরু হোক। বাকিটা সময় এবং কাজ বলে দেবে। ওকে?”
“ইয়েস।”
মালিহার ভালো লাগলো। সুন্দর একটা সময় পার করলো ছোটো ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে। এর মাঝে নিতুর সাথেও দেখা হয়ে গেলো। এই মেয়েটাই প্রথমে তাকে অফিস রুমে বসিয়েছিল।

“দোস্ত তুই আর আমি বাদে ক্লাসের সবাই মিঙ্গেল হয়ে গেসে।”
মালিহা চুলে তেল দিচ্ছিল। নীতি উপুর হয়ে শুয়ে বিলাপ করছে। মালিহা বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই আগে সোজা হয়ে শো। একটু পর বুকে ব্যাথা করছে বলে প্যা পু করলে আমার হাতের চড় খাবি।”
তড়াক করে উঠে বসে নীতি বলল, “ধাই কিলো চড় কি কিমাত তুম ক্যায়া জানো গে রাজাবাবু!”
“নাটক কম কর।”
“মালিহা রে! তোর মতো একটা ষন্ডা মার্কা কাজিন থাকলেও মনডারে একটু স্বান্তনা দিতে পারতাম।”
“থাপ্পড় খাবি নীতি!”
“তাই দে! সবার একজন আছে রে!”
“সবার আছে মানে কি? নাজিফাও ঐ পার্টির নাকি?”
“আরে না! ও হইলো হুজুর মানুষ। নাক মুখ যেমনে ঢেকে রাখে কে ওরে গুতাইতে আসবে।”
“ওইরকম করে ক্লাসে তো আরও অনেকে যায়।” চুলগুলো বেনি করতে শুরু করলো মালিহা। নীতি তার কাছে গিয়ে নিজে বেনি করা শুরু করলো।
“ছাই যায়। হলে এসে ক্যাটরিনা কাইফ সেজে যে ছবি স্টোরি দেয় সেগুলা কি ছেলেরা দেখে না ভাবছিস?”
“তাহলে মুখ ঢেকে ক্লাসে যেয়ে লাভ কি?”
“ওদের কাছে যেয়ে তুই শুনিস। একেকটা দুনিয়ার ফাতরা।” নিজের মতো করেই নীতি বলতে লাগলো, “ক্লাসের ভিতর ছেলেমেয়েগুলোর পারলে একটা আরেকটার কোলে উঠে পড়ে। এমন জায়গায় কেউ সিঙ্গেল থাকে নাকি? অবশ্য তোর মতো রসকষ ছাড়া হইলে সম্ভব।”
“নীতি।”
“বল।”
“আজকে এহসানের সাথে দেখা হয়েছিল।”
“আমারও হইসিলো।”
বিরক্তি নিয়ে নীতির দিকে তাকালো মালিহা। তারপর সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। নীতি কতক্ষন হা করে তাকিয়ে ছিল। শেষমেষ বলল, “বইন তোর জীবনে আমি তো বিয়ার বাত্তি দেখি না! এমন ক্যা তুই?”

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৪

“তুই সত্যিই যাবি না?” কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো নীতি।
“না। পাগল নাকি? এখন যেতে হলে আবার কতগুলো টাকার দরকার। তুই যা না! ক্লাসের অনেক মেয়েই তো যাচ্ছে।”
“তো? ওদের সাথে কি আমার ইন্টুবিন্টু চলে নাকি যে ওদের লেজ ধরবো আমি? আমার সবকিছুই তো তোমার সাথে মালিহা।” দুঃখী মুখ করে বলল নীতি।
মালিহা বিরক্তির স্বরে বলল, “তাহলে যাইস না। ঐদিন তোরে ফ্রাইড রাইস খাওয়াবোনে যাহ।” বিছানা গুছিয়ে শেষ করলো মালিহা। নীতি চমকে বলল, “সত্যি!”
“ইনশাআল্লাহ্।”
নীতি ঠাস করে শুয়ে আবার কল্পনায় হারিয়ে গেলো। আহা! কতদিন ফ্রাইড রাইস খাওয়া হয় না! আবার কি মনে হতেই ঝট করে উঠে বলল, “এই জানিস ইরিনা ট্যুরে যাচ্ছে।”
“ওর বাবা না অসুস্থ?” মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“সেইটাই তো। এই মেয়ের মতিগতি আমি বুঝি না ছাই।”
“তুই কিভাবে জানলি ও যাবে? ও তো ক্লাসেই আসে না।”
“ওর জিগরি দোস্ত বলসে।” কাঁধ শ্রাগ করে বলল নীতি।
“তোর কাছে ওর নাম্বার আছে?”
“কার? ইরিনার? না নাই।”
“ওর কাছে ফোন দিলে জানা যেত ওর বাবার কি অবস্থা।”
“ধুর! তুই এই চিন্তা বাদ দে তো। ও কবে নিয়মিত ভার্সিটি করসে?” টেবিলে যেয়ে বসলো নীতি। কিছু অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে।
মালিহা চিন্তায় পড়ে গেলো। তার শুধু ইরিনার বাবাকে নিয়ে চিন্তে হচ্ছে না। তার চিন্তার বড় একটা কারণ ঐ চার হাজার টাকা।

লতার সাত মাস চলছে। উঁচু পেটটা নিয়ে চলাচল করতে বেশ কষ্ট হয়। তবুও পেটের দায়ে ছুটতে হয় এদিক থেকে ওদিক। হাতের ফাইলটা শেষবার চেক করে বসের কাছে পাঠিয়ে দিলো লতা। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। পিঠটা যেনো ছিঁড়ে যেতে চাইছে। তাও ভালো ইতমিনান এই ডেস্ক তার সাথে অদল বদল করেছে। নয়তো কোনার ডেস্কে থাকলে গরমেই সিদ্ধ হতে হতো।

ইতমিনান লতার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় পড়লো। এই মাসে সবাইকেই ছোটখাট ফিল্ড ট্রিপ দিতে হবে। পোস্টপন্ড করা সম্ভব না। লতা কিভাবে এই কাজ করবে? ঘড়ির দিকে তাকালো ইতমিনান। টিফিন ব্রেক শুরু হয়েছে। ফাইল খোলা রেখেই লতার ডেস্কের সামনে দাঁড়ালো। শব্দ শুনে চোখ খুললো লতা। তাকে দেখে হাসলো খানিক।
“কি অবস্থা তোর?”
“আপা আপনি ফিল্ড ট্রিপে যেতে পারবেন?” চিন্তিত স্বরে বলল ইতমিনান।
“না পেরে তো উপায় নেই ভাই।” সোজা হয়ে বসলো লতা।
“আপনি একবার বসের কাছে একটা দরখাস্ত দিন। উনিও তো মানুষ। বুঝবেন নিশ্চয়ই।”
“বস মানুষ কি না জানিনা তবে তার ম্যানেজার বিশাল বড় মাপের মানুষ। আমাকে বলেছে অসুবিধা হলে যেনো চাকরি ছেড়ে দিই। কোনো ছুটি ফুটি হবে না।”
বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেলো ইতমিনানের মুখ। কিছু না বলে নিজের ডেস্কে চলে গেলো সে। টিফিন বক্স নিয়ে ফেরত এলো লতার কাছে।
“এটা খান।”
লতার মাঝে কৌতূহল দেখা গেলো, “কি এনেছিস?”
“আলুর পরোটা।” মুখ গোজ করে বলল ইতমিনান। এক টুকরো মুখে দিয়ে লতা বলল, “তুই কি খাবি?”
“চা খাবো। আপনি খাবেন?”
“না। চা খেলে আমার গরম লাগে। তোর শেফ হওয়া উচিত ছিল রে ইতমিনান। অবশ্য সমস্যা নেই। বউকে রেধেবেড়ে খাওয়াবি। দেখবি তোর বউ তোকে মাথায় করে রাখবে।”
ইতমিনান কিছু বলল না। লতার হাসি হাসি মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চলে গেলো ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতেই শুনলো আশপাশের ডেস্কের মানুষ ফুসুর ফুসুর করছে। সে জানে এই গোপন আলাপের বিষয়বস্তু সে এবং লতা আপা। গা করে না ইতমিনান। এই কাজ ছাড়া ওরা আর পারেই বা কি?

ইতমিনান এখানে জয়েন করেছে দুই মাসের কাছাকাছি হবে। যখন সে এখানে আসে তখন লতার পাঁচ মাস। বয়সে এবং পদে দুই দিক থেকেই লতা ইতমিনানের চেয়ে অনেক উপরে। প্রথম দিকে সে অবাক হতো। লতার যে চলতে ফিরতে খুব অসুবিধা হয় এটা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইতমিনান ভাবতো তাহলে এই সময়টায় বাহিরে অফিস করার কি দরকার? ঘরে বসে বিশ্রাম করাটাই বেশি জরুরি। উত্তর পেতে বেশিদিন লাগলো না। লতা বিধবা। তার স্বামী মা’রা গেছে প্রেগন্যান্সির প্রথম মাসেই। বেচারা জানতেও পারেনি অনাগত সন্তানের বাবা হিশেবে তার নাম লেখা হয়ে গেছে। অফিসের কম বেশি অনেকেই লতাকে দেখতে গিয়েছিলো। লতা এখানে কাজ করে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। সেই হিসেবে অনেকের ঘনিষ্ঠ ছিলো। স্বামী হারিয়ে লতা তখন অকূল পাথারে। তার দুঃখের কলস পূর্ণ করতেই যেনো তার ভাই দুইজন তার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিলো। মা-বাবা ছাড়া যেই ভাইদের হাতে মানুষ হয়েছে লতা, সেই ভাইয়েরাই দায়িত্বের ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তবে লতার বয়স্ক শশুর শাশুড়ি তার পাশে রইলেন অভিভাবকের মতো। লতার না ছিলো কোনো ননদ, না ছিলো কোনো দেবর। তিনজন মানুষের পরিবারে সেই রইলো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শ্বশুর বা শাশুড়ি কারো পক্ষে সম্ভব নয় নতুন করে রোজগার করা। কাজেই বুকে পাথর বেঁধে পেট চালানোর চিন্তা করতে হলো লতাকে।
প্রথম দিকে একবার ছুটির সময় লতা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। সকলেই আতঙ্কিত হলো। কিন্তু ইতমিনান দেখেছিল, একটা মানুষও সেদিন এগিয়ে যায়নি। নিজের ডেস্কের চেয়ারেই পড়ে ছিল লতা। ইতমিনান যেতে ইতস্তত বোধ করছিল। মহিলা মানুষ। হাসপাতালে নিতে চাইলে আগলে ধরতে হবে। অন্তত গাড়ি পর্যন্ত তো ওঠাতে হবে। ইতমিনানের অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু কেউ যখন এগিয়ে গেলো না তখন অস্বস্তিকে দূরে থেকে ইতমিনান এগিয়ে গিয়েছিল। মিলি এভাবে পড়ে থাকলে সে কি নিশ্চিন্তে থাকতে পারতো?
পানি ছিটিয়ে দেয়ার পরও লতার জ্ঞান ফিরল না। অগত্যা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলো। সাহায্য করলো অফিসের রান্নার কাজে নিয়োজিত এক মহিলা। সেদিন থেকেই লতা ইতমিনানকে ভাই বলে ডাকে। তাকে ম্যামের বদলে আপা ডাকতে বলেছে। আর সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে তাদের নিয়ে মুখরোচক সব গল্প। ইতমিনান দেখে মেয়েরাই এই গল্পে সবচেয়ে এগিয়ে। অথচ এই আগানোটা যদি সেদিন আগাতো তাহলে ইতমিনানের সাহায্যের প্রয়োজন হতো না।
খালি কাপের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইতমিনান। মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী।

মিতুল কানে হাত দিতে চাইছে। পারছে না। নাজিয়া তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন। প্রেশার কুকারের সিটির মতো বেজে চলেছে তার চেয়ে এক বছরের ছোট মামাতো ভাই।
“আমার কতো শখের সাইকেল! এবার এটা নিয়ে আমি বাইরে যাবো কিভাবে? এটা চালাবো কিভাবে? আপনি বলেন ফুপু। আব্বু কি আমারে আরেকটা সাইকেল কিনে দিবে? দিবে না। আমি জানি। মিতুল ভাই ইচ্ছা করে এমন করছে। আমার সাথে মিতুল ভাইয়ের যত রাগ।”
মিতুল ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো। বিছানায় বসতেও ভয় লাগছে। পেছনে কিছুর সাথে স্পর্শ লাগলেই ছ্যাঁত করে উঠছে।
“কি করেছিস তুই সাইকেলটার অবস্থা?” গরম কণ্ঠে বললেন নাজিয়া।
“সকালেই তোমাকে বলে গিয়েছি, ঐ সাইকেলের মুমূর্ষু অবস্থা। আমি আহামরি কিছুই করিনি।” বিছানায় বসে মুখ কুঁচকে নিলো মিতুল।
“তুই করিসনি তো কে করেছে?” নাজিয়া বেগমের রাগ যেনো কমছে না। ভাইয়ের বউ মুখ কালো করে তাকে কিছু না বললেও সযতনে এড়িয়ে গেছে। সেই চাহনি যেনো তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
“আমি আগেই বলেছি মা, সাইকেলের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। সিটের কভার আগে থেকেই ছেড়া ছিলো। আমি বসার পর আর এক ইঞ্চি হয়তো ছিঁড়েছে। এছাড়া আর কিছু হয়নি। তোমার ভাস্তি যেনো আজকেই তার সাইকেল প্রথম দেখছে বলে মনে হচ্ছে।” বিদ্রুপ করে বলল মিতুল। তখনই বাইরে থেকে চিৎকারের আওয়াজ এলো।
“দিছস ক্যান? সাইকেল দেওয়ার সময় মনে ছিল না? ভাতের সাথে সাইকেলে গিলা শুরু করসে!” সাথে মা-রের শব্দ। পরপর কান্নার আওয়াজ। নাজিয়া বেগমের মাথায় আগুন ধরে গেল। সশব্দে মিতুলের গালে চড় দিলেন। মিতুল পূর্বের চাইতেও অধিক শান্ত অবস্থায় বসে রইলো। টু শব্দটাও করলো না।

খাওয়ার সময় মামাতো ভাইয়ের পাশেই বসলো মিতুল। খাবার দিতে এসে মিতুলের সামনে প্লেট এক প্রকার ছুঁড়ে দিলো মামী। মিতুল ঠান্ডা চোখে একবার প্লেটের দিকে তাকালো, একবার মামীর দিকে। নিঃশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে সোজা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

.

দুপুরের তপ্ত রোদ চারদিকে রাজত্ব করছে। ধীরে সুস্থে হেঁটে যাচ্ছে মিতুল। মামা বাড়ি থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব ভালোই। সাইকেলে যেতেই আধা ঘণ্টা লাগে। হেঁটে নিশ্চয়ই এক ঘণ্টা লাগবে। মিতুল জানে না। এর আগে কখনো সে হেঁটে যায়নি।

মিতুলের কাছে ঘড়ি নেই। তবে তার মনে হলো এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বড় করে একটা দম ছাড়লো মিতুল। বুক,পিঠ ঘেমে চটচট করছে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ওপাশে উঠান দেখা যাচ্ছে। কিছু দড়ি বাধা। দড়িতে কাপড় ঝুলছে। পানি শুকিয়ে নিতে রোদ গায়ে মাখছে। নিজের গায়ে রোদ মেখে অভাবের পানি এভাবে নিংড়ে ফেলে দিতে পারবে না? মিতুল ভাবলো। কোনো সদুত্তর পেলো না।

“মিতুল তুই!”
মকবুল আলীর চোখে মুখে অবাক ভাব। মিতুল শান্ত কণ্ঠে সালাম দিল। বাবার ভাই। অসম্মান করার প্রশ্নই ওঠে না। সে কোনোদিন তার চাচাকে অসম্মান করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোর কি অবস্থা আব্বা? কেমন আছিস?” মিতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মকবুল আলী। তার ঘাম চটচটে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মিতুলের মনে হলো তার ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুনে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ করেই মনে হলো এই যেনো বাবা। তার মৃ’ত বাবা। ধীর কণ্ঠে মিতুল বলল, “পিপাসা লাগছে চাচা। পানি খাবো।” অথচ সে ভেবে এসেছিল শুধু দাদির সাথে দেখা করবে। আর কারো সাথে কোনো কথা বলবে না।
মকবুল আলী মিতুলকে সযতনে ঘরে নিয়ে গেলেন। আয়েশা তখন ঘুমে। নিজ উদ্যোগে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি মিশিয়ে ভাস্তিকে দিলেন। পুরো পানিটুকু এক নিশ্বাসে শেষ করলো মিতুল। মকবুল হা হা করে উঠলেন।
“একবারে খায় না আব্বা! গলায় বাঁধবে। তিনবারে খাবা। পানি তিনবারে খাওয়া সুন্নত।”
মিতুল বলল, “দাদি ঘরে আছে না?”
“আছে আছে। চলো যাই।”
রাশেদা সুপুরি কাটছিলেন। মকবুল অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকলে নাতিকে দেখলেন রাশেদা। কঠিন চোখ ছলছল করে উঠলো। মিতুল দাদির খোঁজ খবর নিয়ে বলল, “আমাকে কিছু টাকা ধার দিবা দাদি?”

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৫

মকবুল আলীর জোরাজুরিতে মিতুল বলতে বাধ্য হলো টাকা তার কেনো লাগবে।
“একটা সাইকেল কিনবো চাচা।”
“ইতুর সাইকেলটা বাড়িতে পড়ে আছে। ঐটাই নিয়ে যা।”
“না। দাদি তুমি চার পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারবা?”
“চার পাঁচ হাজার টাকায় সাইকেল হয় রে পাগল?” মকবুল স্নেহের সুরে শাসন করলেন।
“সেকেন্ড হ্যান্ড হয় না?”
“তুই সেকেন্ড হ্যান্ড নিবি কেনো? আমি তোকে নতুন সাইকেল কিনে দিতে পারি। সেই সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দিয়েছে।”
মিতুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর নতুন কোনো ঝামেলার দরকার নাই চাচা। আপনি আমাকে একটা কাজ ঠিক করে দেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেনো করতে পারি।”
রাশেদা চমকে উঠলেন। “তুমি কাজ খুঁজছো কেনো ভাই?”
মিতুল জবাবহীন বসে রইলো। কিছুই বলল না। মকবুল আলী হতাশ নিশ্বাস ফেললেন।
“বাজারে একটা সারের দোকান আছে। ঐটায় কাজ করবি?”
“আপনার পরিচিত?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আপনি একটু কথা বলে দিয়েন।”
“বলব।”
রাশেদা টাকা দিলে মিতুল তার হাত ধরে বলল, “দাদি তুমি দোয়া করো এই টাকা যেনো তোমাকে ফেরত দিয়ে দিতে পারি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।” রাশেদা নাতির মাথায় হাত বোলান। ছোট্ট ছেলেটা কেমন এক নিমিষে বড় হয়ে গেছে।
বেরিয়ে আসার সময় আয়েশার সাথে দেখা হলো। আয়েশা যেনো ভূত দেখলেন। মিতুল হেসে বলল, “চাচী ভালো আছেন? দাদিকে দেখতে এসেছিলাম।”
সদ্য ঘুম ভাঙ্গা আয়েশা বেশি কিছু বুঝলেন না। বলা ভালো বুঝতে চাইলেন না। আজকাল তিনি অন্য এক চিন্তায় মগ্ন থাকেন। সবসময়।
পার্ট টাইম কাজ হিশেবে সময়টা মিলল না। দোকানির কথা মিতুলকে দোকান বন্ধ করা পর্যন্ত থাকতে হবে। জিজ্ঞেস করে জানা গেলো এশার আযান দিলেই তিনি দোকান বন্ধ করে দেন। মিতুল রাজি হয়ে গেলো। সে বাড়ি থেকে দূরে থাকতে চায়। যে বাড়িতে সম্মানের সাথে বাস করা যায় না, সেই বাড়ি থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে চায়।
দোকানে কথা শেষ করে মামা বাড়ি গেলো মিতুল। এবার রিকশা নিলো। হাতে বেশ কিছু টাকা আছে। বাড়ি পৌঁছে কোনদিকে না তাকিয়ে ভাঙ্গা সাইকেলটা নিয়ে আবার বের হয়ে গেলো। পেছন থেকে নাজিয়ার গলা শোনা যাচ্ছে। মিতুল ফিরে তাকালো না। সাইকেল ঠিক করতে নিয়ে গেলো। সেটার দৈন্য দশা। মেরামত করার চাইতে আরেকটা কিনে ফেলা ভালো। দোকানের লোকটা সেই পরামর্শই দিলো। মিতুল বলল, “আপনি ঠিক করে দেন। কতো লাগবে সারতে?”
“তাও ধরেন পনেরশ তো লাগবেই।”
মিতুল হিশাব কষলো। পাঁচ হাজার থেকে পনেরশ বাদ দিলে থাকে সাড়ে তিন হাজার।
“আপনাদের এখানে সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল পাওয়া যাবে?”
“যাবে।”
“তিন হাজার টাকার ভেতরে কেমন সাইকেল আছে?”
“একটা দাম বললেন ভাই? পাঁচ ছয় হইলে একটা ভালো সাইকেল নিতে পারবেন।”
“পাঁচ ছয় হইলে আমি একটা নতুন সাইকেলই নিয়ে নিতাম। আছে নাকি আপনি বলেন।”
লোকটা থতমত খেয়ে সাইকেল দেখালো। অপর পাশে ভাঙ্গা সাইকেলের সার্ভিসিং চলছে। বেশ দেখে টেখে মিতুল সাড়ে তিন হাজারের মাঝেই একটা সাইকেল নিয়ে নিলো। পুরোনো সাইকেল ঠিক করে ভ্যানে তুলে নিজের সাইকেলে চেপে বাড়ির পথ ধরলো। নিজের সাইকেলে বসে একটা শুকনো ঢোক গিললো মিতুল। বুকটা একটু ঠান্ডা লাগছে।

ভালো মন্দ খোঁজ নিয়ে মালিহা বলল, “ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই তুমি ঐ বাড়িতে কেনো গেলে মা?”
নাজিয়া ছ্যাঁত করে উঠলেন যেনো।
“তোরা গুষ্ঠি মিলে আমার পিছে লাগছিস কেনো? নিজের ভাইয়ের বাড়িও আমি আসতে পারবো না?” মালিহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। খোলা করিডোর মোটামুটি শূন্য। আশপাশে তাকিয়ে বলল, “অবশ্যই যাবে মা। কিন্তু ইদ্দত শেষ না করে জরুরী কাজ ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়াই ভালো।”
“খুব হুজুর হয়েছিস দেখছি।”
“মা!” আহত স্বরে বলল মালিহা। “এভাবে বলছো কেনো? ইদ্দতের নিয়ম তুমি জানো না?”
“তোরা যা শুরু করেছিস মনে হচ্ছে আমি কিছুই জানিনা।”
মালিহা এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না। চলেই যখন গেছে কি আর করার।
“তুমি কি একেবারে ওখানে গেছো?”
“হ্যাঁ।”
“কেনো? মিতুলের তো স্কুলে যাতায়াতে সমস্যা হবে। তাছাড়া নিজেদের বাড়ি থাকতে অন্য কারোর বাড়িতে থাকার কি দরকার?”
নাজিয়া বিরক্ত হলেন। শাশুড়ি, ভাসুর, ছেলে, মেয়ে সবাই এক গান গাইছে। তার রাগ হলো। বিধবা হয়েছে বলে সবাই তার উপরে খবরদারি করতে শুরু করেছে। কেনো? সে কি অসহায় হয়ে পড়ে আছে নাকি?
“তোর বাপও জীবনে আমার কাছে এতো কৈফিয়ত চায়নি যতো তোরা চাচ্ছিস। স্বামী ম’রে গেছে এখন তো ছেলেমেয়ের ইশারাতেই চলতে হবে। বল, কতো পারিস বল।”
মালিহা হাল ছাড়লো। কোনোভাবেই মা’কে সে বোঝাতে পারছে না। প্রসঙ্গ পালিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “মা! জানো একটা কোচিংয়ে চাকরি পেয়েছি। ওরা বলেছে সাত হাজার টাকা দেবে। আরেকটা টিউশনি পেয়েছি। ওখানে তিন হাজার। এবার আস্তে আস্তে বাড়ি খুঁজতে শুরু করবো। কি বলো?”
“হুম।” বাইরে থেকে কথাবার্তার আওয়াজ আসতেই নাজিয়া বললেন, “রাখলাম। পরে আবার কথা বলব।”
নাজিয়াকে ততোটা আনন্দিত মনে হলো না। ভাইয়ের কাছে আছেন সেখানেই মেয়ে তার উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য যেনো মুখিয়ে আছে। দুর দেশে পাড়ি জমালে তো উঠতে বসতে তাদের মর্জি লাগবে।
মালিহা ফোন রাখলো। তার কোনো অনুভূতিই নাজিয়াকে ছুঁতে পারছে না। কষ্ট পেলো মালিহা। স্বামীর অনুপস্থিতিতে নাজিয়া কি এতটাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? কাউকেই কেনো বিশ্বাস করতে পারছে না?

বাড়ি পৌঁছে সাইফের সাইকেল নামিয়ে ঘরের দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখলো। অন্ধকার তখন জেঁকে বসেছে। টুং টাং শব্দ শুনে মামী ঘরের ভেতর থেকে উঁকি দিলো। দুটো সাইকেল সহ মিতুলকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। ভ্যান চলে যেতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
“এই সাইকেল কার?”
“সাইফের।” ছোট্ট করে উত্তর দিলো মিতুল। পুরো সাইকেল রং বদলে অন্যরকম হয়ে গেছে। এটা যে পুরোনো ভাঙ্গা সাইকেল সেটা চেনাই যাচ্ছে না।
কথা বার্তার শব্দ শুনে নাজিয়া এবং সাইফ বের হয়ে এলো। ছেলেকে দেখে নাজিয়ার বুকটা কামড়ে উঠলো। মুখটা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে আছে।
“তুমি সাইকেল সারায় নিয়ে আসছো?” মামীর কণ্ঠে বিস্ময়। মিতুল বলল, “ভাইয়ের জিনিস নষ্ট করে ফেলেছি। ঠিক করে দিতে হবে না? নাহলে ছোট ভাই আমার থেকে কি শিখবে?” মিতুলের কণ্ঠে না আছে কোনো ক্ষোভ, না আছে কোনো খোঁচা। শান্ত, নির্মল ভঙ্গিতে কথা বলে অপর পক্ষের বুক জ্বা-লিয়ে দিচ্ছে সে। বুকটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মিতুলের।
সাইফ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। আনন্দের আতিশয্যে মিতুলের কাছে যেয়ে বলল, “কবে থেকে সাইকেলটা ঐভাবে পড়ে ছিল! আব্বু ঠিকই করে দিত না। থ্যাংক ইউ মিতুল ভাই।” মায়ের প্রশস্ত চোখ সাইফের নজরে এলো না। সাইকেলের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করায় মামী তখন ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। মিতুল হেসে সাইফের চুল নেড়ে দিলো। আয়েশা এতক্ষণে কথা বললেন, “ঐ সাইকেল কার?”
“আমার।”
“টাকা কোথায় পেয়েছিস তুই?”
“সাইফ এবার কিন্তু সাইকেল যত্ন করে রাখতে হবে। বুঝেছিস?”
“হু।”
“টাকা কোথায় পেয়েছিস?”
“মামী আমার সাইকেল কি ঘরের ভেতরে রাখতে পারি?” স্পষ্ট উপেক্ষা। নাজিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
মামী চমকে বললেন, “হ্ হ্যাঁ হ্যাঁ! রাখো রাখো।”
ঘরের ভেতরে সাইকেল উঠিয়ে রাখতে রাখতে মিতুল হেসে বলল, “বুঝলেন মামী? একজন সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিলো। সাইফের সাইকেল কি আমি রোজ নিতে পারবো? ওর নিজেরও তো লাগবে। ভালো হলো না?”
“হ্যাঁ ভালোই তো।” মামী আসলে বুঝতে পারছেন না তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। ছেলেটা কি তাকে অপমান করছে? নাকি অন্য কিছু?
সাইফ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সাইকেল দেখছে। সেদিকে একবার দেখে নিজের ঘরে চলে গেলো মিতুল। বিছানায় বসতেই নাজিয়া ঘরে এসে দোর দিলেন। মিতুল শান্ত চোখে দেখলো। সকালে চড়টার কথা মনে পড়লো। খোলা দরজার ওপাশ থেকে পুরো ঘটনা দেখেছিল তার মামী।
“কে টাকা দিয়েছে তোকে?”
“আমি একজনের থেকে ধার নিয়েছি। একেবারে কেউ দিয়ে দেয়নি।” ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল মিতুল।
“কে দিয়েছে?” নাজিয়ার গলা চড়াও হলো। উত্তেজিত হয়ে উঠছেন তিনি। মিতুল উত্তর না দেয়ায় নাজিয়া আবার বললেন, “এই টাকা ফেরত দিবি কিভাবে তুই?”
“কাজ করে।”
“কে দেবে তোকে কাজ?” তাচ্ছিল্য করে বলেলন নাজিয়া।
“কাজ ঠিক করে এসেছি।”
নাজিয়ার মাথায় যেনো বাজ পড়লো। ছেলের কাছে এসে হাত ঝাকিয়ে বললেন, “সব তোর চাচার বুদ্ধি তাই না? মানুষের সামনে আমার ভাইকে ছোট করার কি চমৎকার চিন্তা!” মিতুল ঢোক গিললো। ভেতর থেকে আসা চিৎকারটুকু গিলে নিলো।
“কারো বুদ্ধি না। আমার নিজের বুদ্ধি।”
“টাকা দিয়ে কি প্রমাণ করতে চায় তারা? আমার ভাই ফকির? খাওয়াইতে পারে না? কাজ করবি তুই আর মানুষ থু থু করবে আমার ভাইরে। এই! আমার ভাইয়ের সাথে তোর শত্রুতা কিসের? তোর কোন ভাতে ছাই দিসে?”
মিতুল বলতে চাইলো তোমার ভাই আমাকে ভাত দেয় না। ছাইই দিয়েছে। কিন্তু বলল অন্য কথা, “এসব কথা রাখো মা।”
“রাখবো কেনো? কোন নবাবের ছেলে তুই? কি একটা বলসে কি বলে নাই ছ্যাঁত করে উঠে চাচার কাছে নালিশ দিতে চলে গেসিশ। ওখানে যেয়ে টাকা চাইতে লজ্জা লাগলো না?”
“ভাইয়ের বাড়ির এতো সুন্দর আপ্যায়ন যদি তোমার খারাপ না লাগে তাহলে আমার চাচার থেকে আমি টাকা নিলে সেটা খারাপ লাগার কিছু দেখি না। এইটা যেমন তোমার র’ক্ত ঐটা আমার র’ক্ত। মতিয়ার আলীর ছেলে ভাইস্যা আসে নাই যে মানুষের লাত্থি ঝাটা খাবে। আমার বাপরে কবর দিসি, তার মান সম্মান আমি কবর দেই নাই।”
না চাইতেও কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে ফেললো মিতুল। নাজিয়া যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সংবিৎ ফিরতেই বললেন, “এতদিনে রক্ত কথা বলসে! ভালোই তো! বংশের ধারা বলে কথা!”
মিতুল শুয়ে পড়ল। নিজের জন্মদাত্রীর সাথে তর্কে জেতার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।

“তোর মা তো তোর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”
ক্লান্তির নিশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান, “আমি কি বলেছি বিয়ে করব না? বলিনি তো। আরেকটু ভালো স্যালারির একটা চাকরি পেয়ে নিই। তোমার টাকায় সংসার চলছে তো তাই টের পাচ্ছি না। আমার এই বেতন দিয়ে বাঁচতে হলে নাকানি চুবানি খেতে হবে।”
মকবুল আলী হাসলেন। সহসাই সেই হাসি আবার বন্ধ হয়ে গেলো।
“মিতুলটা ভালো নেই রে। মানুষের বাড়ি যেয়ে রাত কাটানোর ছেলে ও না। অথচ মামা বাড়ি যেয়ে থাকতে হচ্ছে।”
“কিছু হয়েছে বাবা?”
আজকের পুরো ঘটনা শোনালেন মকবুল আলী। ইতমিনান চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাবা হারা ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য পরিস্থিতি এতো জটিল হয়ে পড়ছে কেনো?

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মালিহা। মেঘের চাদর গায়ে মেখে ঘুম দিয়েছে চাঁদ। সেই মেঘ ঝরিয়ে দিচ্ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বারান্দার এই অংশে কোনো ছাদ নেই। চোখ বন্ধ করতেই বন্ধ পাতার উপর এক ফোঁটা বৃষ্টি টুপ করে পড়লো। যেনো তার চোখকে আরেক বৃষ্টি ঝরানোর জন্য আশকারা দিলো। মালিহার বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। আজ খুব করে বাবাকে মনে পড়ছে। তার যেকোনো আনন্দে এই মানুষটা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। মায়ের সাথে তার সম্পর্ক সবসময়ই শীতল। বাবার অনুপস্থিতিতে যেনো তাতে বরফ জমেছে। তার আনন্দগুলো মা’কে ছোয় না, তার দুঃখগুলো মা’কে ভাবায় না। কেনো? মালিহা জানে না। তবে তার মনে হয় মা যেনো তাকে আপন ভাবতে পারে না। নিজেকে একা মনে হলো মালিহার। খুব একা।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে