উষ্ণতা পর্ব-১০+১১+১২

0
84

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১০

আঁখি বাহির থেকে এসে যথারীতি সেই কাপড়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে। শুধু বিছানায় গড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি। জুতাসহ ঘরের ভেতরে ঢুকে পুরো ঘর একবার চক্কর কেটেছে। মনিকার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কতো কষ্ট হয় পুরোটা ঘর গোছাতে। বুঝবে কিভাবে? জীবনে কোনোদিন ঝাড়ু হাতে নিয়েছে নাকি সন্দেহ। তিক্ত গলায় মনিকা বলল, “আপু জুতো পড়ে হাঁটাহাঁটি করবেন না।”
আঁখি মনিকার বিরক্তি বুঝে আরেকবার চক্কর দিলো। কৌতুকের সুরে বলল, “খালি পায়ে হাটবো মনিকা? কাঁটা বিধবে তো।”
“কাঁটা বিধবে কেনো? ঘর আমি দিন কতবার ঝাড়ু দিই জানেন? সকাল বিকাল দুইবার। আজকে দুপুরে আবার মুছেছি। এরপরও যদি ঘরে কাঁটা পাওয়া যায় তাহলে আমি মাটি খাই।”
“আহা হা! মাটি খেও না। তাহলে আমার ক্লাসমেটের কি হবে বলো তো?”
মনিকার মুখ রাঙ্গা হলো। আঁখির ক্লাসমেট এক ছেলে তার পিছু ধরেছে প্রায় বছর হবে। কিন্তু মনিকার এতে সায় নেই। বছরের পর বছর ধরে সম্পর্ক করে যদি বিয়ে পর্যন্তই না গড়ায় তাহলে সেই সম্পর্কের মূল্য রইলো কোথায়? এসব খুচরো সম্পর্কে সে বিশ্বাসী না। সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে আগ্রহ থাকলে যেনো বাড়িতে যোগাযোগ করে। তবুও ছেলেটার দুই তিন দিনে একবার দেখতে আসা চাই। মনিকা বিরক্তির ভান করলেও বিষয়টা উপভোগ করে বটে।
মুখে মেকি বিরক্তির ভাব ধরে মনিকা বলল, “ওসব কথা বাদ দিন তো আপু। জুতো খুলুন। খুলে বাইরে রেখে আসুন।”
“যথা আজ্ঞা।”
আঁখির এই এক বিষয়। কারো কিছুতে যেনো মেয়েটার না নেই। মনিকা এই পর্যন্ত কতবার যে তার সাথে এসব খুঁটিনাটি তর্কে গিয়েছে তার হিসাব নেই। অবশ্য এটাকে তর্ক বল যায় না। আঁখি কখনই মনিকার বিপরীতে দুটো কথা বলেনি। মনিকা একাই কতক্ষন গজগজ করে থেমে যায়। প্রতিবার। এবারও থেমে গেলো মনিকা। নিজের বিছানার তোশকের নিচ থেকে ঝাড়ু নিয়ে আঁখির বিছানার সামনে গেলো। পুরো বিছানা এলোমেলো। চাদর ময়লা হয়ে কুঁচকে আছে। চার পাঁচটা বই এদিক সেদিক ছড়ানো। এক কোনায় মুড়ির কৌটা। মোবাইলের চার্জার আর ইয়ারফোন সম্ভবত নিয়েজদের ভেতরে প্রচুর ধস্তাধস্তি করেছে। কেনোনা এখন তারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মনিকা চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বলল, “এটা বিছানা নাকি গুলিস্তান? মানুষ এমন জায়গায় থাকে!”
আঁখি পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। মনিকা বিছানা গুছিয়ে চলে যেতেই ধপ করে শুয়ে পড়ল। মনিকা বিরক্তি লুকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলো। তবে পুরোপুরি সক্ষম হলো না।
“আপু আপনি বাইরের জামা কাপড় ছেড়ে শুতে পারেন না? চাদরটা এভাবেই নোংরা হয়েছে।”
“আলসি লাগে মনিকা।”
“আপনার যতো অকারণ আলসি। ভোর বেলায় পুরো ভার্সিটি দৌঁড়ে দৌঁড়ে চক্কর কাটেন তখন আলসি কোথায় থাকে?”
আঁখি হাসলো। মনিকা আর কিছু বলল না। সিনিয়র হিসেবে যথেষ্ট বলা হয়েছে।
মালিহা এবং নীতি রুমে এলো প্রায় আধা ঘণ্টা পর। নীতি কোনো রকমে ব্যাগ রেখেই বালতি আর জামা কাপড় নিয়ে ছুটলো। মালিহা বলল, “একটু জিরিয়ে নে।”
“সারা দুনিয়ার ধুলোবালি আমার শরীরে এসে কুড়কুড় করছে। এখন আমার প্রধান গন্তব্য বাথরুম।”
মালিহা বোরখা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান ছাড়লো। সারা শরীর ঘেমে চটচট করছে। ফোন বাজতেই দেখলো মিতুলের কল।
“কেমন আছিস?”
“আছি। তোর কি অবস্থা আপা? তুই কি ক্লাসে?”
“না মাত্রই রুমে আসলাম। কিছু বলবি?”
মালিহার মনে হলো মিতুল ইতস্তত করছে। কিছুটা গম্ভীর হয়ে মিতুল বলল, “আপা আমরা এখন মামা বাড়িতে।”
মালিহা চমকালো, “আমাকে তো মা কিছু বলল না।”
“বললে কি তুই আসতে দিতি?”
“মামা কি যেতে বলেছিল? এখন এভাবে কেনো গেলো?”
“বলেছে। নামের বলা। মা সব বেঁধেছেদে নিয়ে এসেছে আপা।”
মিতুলের কণ্ঠ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো।
“কি বলছিস!”
“সত্যি বলছি। মা বলেছে এখান থেকে স্কুলে যেতে। এতো দূর থেকে যাওয়া আসা করা যায় তুই বল? আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না আপা। তুই মা’কে বল আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে।”
মালিহা ভেবে পাচ্ছিল না সে কি বলবে। নাজিয়া এমন একটা কাজ তাকে না বলে কিভাবে করলেন সেটাই বুঝতে পারছিল না সে।
“আচ্ছা আমি কথা বলব। তুই মন খারাপ করিস না। দুপুরে খেয়েছিস?”
“না। আমরা আসার পর থেকে শুধু ভর্তা ভাত দিয়ে যাচ্ছে। মা তো বোঝে না। এসব কেনো দিচ্ছে আমি জানিনা মনে হয়! মনে হচ্ছে ভিক্ষা করতে এসেছি।”
“রাগ করে থাকে না সোনা। খাবারের সাথে কিসের রাগ? তোর রিজিকে যে খাবার ছিল সেটাই তো খাবি তাই না? দুটো বেজে গেছে। যা খেয়ে নে ভাই। আমি মায়ের সাথে কথা বলব। প্রমিস! আমার কথা শুনবি না?”
“যাচ্ছি।” একরোখা স্বরে বলল মিতুল। মালিহা চিন্তায় পড়ে গেলো। ইদ্দতের এই সময়ে কি এমন দরকারে ওখানে যেতে হলো। কেনো মালিহাকে একটুও জানালেন না নাজিয়া? মালিহা ভাবলো গোসল করে খেয়ে তারপর মায়ের সাথে কথা বলবে। মা কেনো মামাবাড়ি থাকতে চাচ্ছে সেটা জানা দরকার।

“কোচিং সেন্টারে পড়াবে নাকি মালিহা?”
“জি আপু?” ভাবনায় মশগুল থেকে আঁখির কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না মালিহা।
“আমার এক ক্লাসমেট একটা কোচিং চালায়। সিক্স টু টেন। সেকেন্ড গেটের সামনে। ওর সাথে কথা বলেছিলাম। সকালে দুই ঘণ্টা সময় দিতে পারলে মাসে হয়তো সাত আট পেতে পারো। ভেবে দেখো।”
“আমি পড়াবো আপু!” সাত আট হাজার! মালিহার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। মুহূর্তেই হিসাব করে ফেলল সে। কোচিং থেকে সাত আর তিশাকে পড়িয়ে তিন। এইতো দশ হাজার হয়ে গেলো! এবার একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবে না?
“ওকে। ওর নাম্বারটা নাও। আমি তোমার কথা বলেছি।”
মালিহা ভেবে পেলো না কিভাবে আঁখির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে। মনিকা বলল, “সকালে দুই ঘণ্টা, বিকালে আবার দুই ঘণ্টা। বুঝিস মালিহা!”
মালিহা হাসলো। আর্থিক সমস্যা মেটানোর সুবর্ণ সুযোগ লুফে নেয়ার হাসি।

গোসল সেরে এসে এসব শুনতেই নীতি মালিহাকে বলল, “তোর বিগ ব্রোরে ফোন দিয়ে বল।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল, “কি বলব?”
“কোচিংয়ের ব্যাপারে।”
“আমি তো ফোন দিয়ে কনফার্ম করে ফেলেছি। তাহলে ভাইয়াকে আর কি বলতে হবে?”
ইতমিনানের সাথে দেখা হওয়ার কথা নীতিকে জানিয়েছে মালিহা। সেই সুবাদে সবটাই তার জানা।
“দেখ মালিহা। শহরে একজন পরিচিত মানুষ থাকা অনেক বেনিফিটেড একটা বিষয়। আর সে শুধু তোর পরিচিত না, একেবারে আপন চাচাত ভাই। তার সাথে তুই প্রবলেম শেয়ার করলে, পরামর্শ চাইলে বিপদের সময় তাকে পাশে পাবি। নয়তো হুট করে যখন তোর দরকার হবে তখন সাহায্য চাইবি কিভাবে? আর তাছাড়া ব্যাটা এক্সপেক্ট করে তুমি তারে ফোন দিবা। একটু দাও না কেনো মালিহা? হু?”
নীতির মুখে কুশন ছুড়ে মারল মালিহা। চোখ রাঙিয়ে বলল, “বলেছি না এসব মজা করবি না?”
“মজা না দোস্ত। চোখ খুলে দেখলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি। বাদ দে। ক্যান্টিনে যাই চল।”
“গোসল করিনি তো!”
“পরে করিস। আমার খিদা লাগসে।”
মালিহার হাত টেনে ধরে নিয়ে গেলো নীতি।

সন্ধ্যার তখন কেবল শুরু। ইতমিনান আজ বেশ কয়েকটা উপন্যাসের বই কিনে এনেছে। রাতের সময়টুকু এগুলো পড়ে কাটালে একা একা লাগবে না বলে তার ধারণা। অবশ্য এই একা লাগাটা নতুন ধরনের। এ সময় পরিবারের কাউকে মনে পড়ে না। মন মস্তিষ্ক শুধু একটা নিজের মানুষ চায়। একা ফ্ল্যাটে চাওয়াগুলো যেনো শরীরের উপর হামলে পড়ে। বেশ বিব্রত হয় ইতমিনান যখন সেসময় পরিচিত মেয়েলি চেহারাটা চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে। যেনো শুধু ঐ মুখটা দেখলেই এই একা লাগাটা কেঁটে যাবে। এক আধবার ভাবে ভার্সিটিতে গিয়ে মেয়েটার সাথে একবার দেখা করে আসতে। কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক যুক্তির পাহাড় বানিয়ে আটকে দেয়। আজ সেসব মনে আসার আগেই একটা বই নিয়ে বসলো সে।

উপন্যাসের যখন এক তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে তখন ইতমিনানের মনে হলো আজকের সবচেয়ে বড় ভুল এই বই নিয়ে বসা। নায়িকার চরিত্রে থাকা মেয়েটা যেনো খোদ মালিহা। ক্ষণে ক্ষণে তার উক্তি, তার বর্ণনা ইতমিনানের মনকে আরো অস্থির করে তুলল। ইতমিনান অবাক হয়। এ কেমন অনুভূতি? মালিহাকে সে দেখছে সেই ছোট্ট বেলা থেকে। তার চোখের সামনেই মেয়েটা এক থেকে বাইশে এসেছে। তবে হঠাৎ কেনো এই অস্থির অনুভূতির জন্ম? এটা কি শুধু মায়া? বাবা হারা মেয়েটার প্রতি এক টুকরো সহানুভূতি? ইতমিনান জানে না। তবে ক্লান্ত মস্তিষ্ক আজ তাকে যুক্তি দিয়ে আটকে রাখতে পারে না। বই-টই ফেলে সে ছুটে যায় ভার্সিটির পথে।

হলের সামনে পৌঁছানোর পরই ইতমিনানের টনক নড়ে। চলে তো এসেছে। কিন্তু মালিহাকে কি বলবে? কেনো এসেছে দেখা করতে? আবার ফেরত যায় ক্যাম্পাসের দিকে। বেশ কয়েকটা দোকান তখনও খোলা। ছেলেরা চায়ের আড্ডায় দুরুহ, জটিল কোনো বিষয়ের মীমাংসা করতে ব্যস্ত। দোকানে ঢুকে আতিপাতি করে বাটার বান খুঁজলো ইতমিনান। চার পাঁচ বছর আগের মালিহার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে সে জানে। এখন কি মেয়েটার খাদ্যাভ্যাস বদলেছে? আর না ভেবে আগের ধারণা অনুযায়ী খাবার কিনলো ইতমিনান। পাঁচটা বাটার বান, এক হালি কলা, কয়েকটা কাপ নুডুলস, কফির প্যাকেট নিয়ে পলিথিন ভর্তি করে ফেলল। যাক! এবার দেখা করতে যাওয়া যাবে। চেনাজানা মানুষ তো খাবার নিয়ে দেখা করতে আসতেই পারে। তাই না? যেনো নিজেই নিজেকে বোঝাতে চাইলো ইতমিনান

হলের ওয়েটিং রুমে বসে মালিহাকে কল করলো সে। পাশেই হল প্রভোস্টের রুম। ইতমিনানের মনে হলো প্রভোস্ট যেনো নজরদারি করতে পারে এজন্যই এটাকে ওয়েটিং রুম বানানো। সে হোক! সে তো মেয়েটাকে এক নজর দেখেই চলে যাবে।

.

মালিহা ইতমিনানকে কল দেয়ার কথা চিন্তা করছিল। তার আগেই ইতমিনানের কল এলো। মালিহা হতাশ নিশ্বাস ফেলল। সে একবারও আগে কল দিতে পারে না।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো ভাইয়া?”
“এইতো আছি। তুই হলে না?”
“হ্যাঁ।”
“একটু নিচে আসতে পারবি? ওয়েটিং রুমে?”
“কেনো? তুমি কি এসেছো নাকি?”
“হ্যাঁ। ঐ.. মাত্রই এলাম।”
হঠাৎ উত্তেজনায় মালিহা দৌঁড়ে বারান্দায় চলে এসেছিল। আবার রুমে ফেরত যেয়ে ওড়না নিয়ে ভালো করে মাথায় দিলো। কি আজব কথা! ইতমিনান নাকি এখানে!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১১

ওয়েটিং রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মালিহা। দোতলা থেকে ছুটতে হয়েছে অল্পই। কিন্তু জং ধরা পা নিয়ে দৌঁড়াতে যেয়ে হাঁপিয়ে গেছে বেশ। বুকের উচাটন থামছে না। কোমরে এক হাত রেখে এক জিরিয়ে নিলো মালিহা। থাই গ্লাসের দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে বসা ইতমিনানকে দেখা যাচ্ছে। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে সে। মালিহার কেমন যেনো লাগলো। এর আগে যতবার মতিয়ার আলী এসেছেন প্রত্যেকবার মালিহাকে আগে থেকে জানিয়ে এসেছেন। এভাবে হুট করে এসে কেউ তাকে চমকে দেয়নি। মালিহা জানে না ইতমিনান তাকে চমকে দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছে নাকি। তবে তার ভালো লাগলো। অচেনা শহরে পরিচিত একটা মানুষ হুট করে তার খোঁজ নিতে এসেছে। খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই।
দরজা ডানে সরিয়ে ওয়েটিং রুমে ঢুকলো মালিহা। হালকা কাশি দিতেই ইতমিনান এদিকে ঘুরল। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দুজনার। মালিহার অস্বস্তি লাগলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। তবে ইতমিনান চোখ ভরে দেখে নিলো মালিহাকে। একটু দেখার জন্যই তো এই ছুটে আসা। নেভি ব্লু কালারের একটা ওড়না মালিহার মাথায়। তার মাঝে গোলগাল মুখটা যেনো ফুটে উঠেছে। এক গাছি চুল ওড়নার শাসন অমান্য করে বাহিরে উঁকি দিচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলো চোখেমুখে পড়ে লুকানো সৌন্দর্যের ঠিক কতখানি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে ইতমিনান জানে না। তবে তার অস্থিরতা যে কমে এসেছে, অন্তর্দ্বন্দ্ব থেমে যে বুকটা শান্ত হয়েছে এটুকু সে জানে। শুধু এটুকুই তো চেয়েছিল সে। এর বেশি কি?
“কেমন আছিস?”
“ভালো। তুমি হঠাৎ?”
“এদিকেই এসেছিলাম একটা কাজে।”
কথা শেষ করলো না ইতমিনান। অযথা মিথ্যা বলার কোনো মানে হয় না। হাতের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো মালিহার দিকে। মালিহা যেনো হকচকিয়ে গেলো।
“এগুলো কি?”
“তোর জন্য নিয়ে এলাম।”
ইতমিনান তার ডান হাত বাড়িয়ে আছে। মালিহার হঠাৎ মনে হলো তার স্মৃতিকুঠি থেকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ বের হয়ে চারপাশটা ঘিরে ফেলেছে। ঘ্রাণের আবহে সে হারিয়ে গেছে অনেক বছর আগে। যখন সে ফ্রক করে ঘুরে বেড়াতো। বাড়িতে এলেই ইতমিনান তার জন্য চকলেট নিয়ে আসতো। সেই কিশোর ইতমিনান যেনো তার সামনে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ তো!
“কি রে! নে?”
সুন্দর আবহ থেকে বের হলো মালিহা। হাত বাড়িয়ে পলিথিনটা ধরলো। তার সামনে কিশোর নয়, যুবক ইতমিনান দাঁড়িয়ে আছে।
“আমি আজ তোমাকে ফোন করতাম।”
“তাই?” যেনো মজার একটা কৌতুক শুনলো ইতমিনান। মালিহা রুষ্ট হলো।
“হ্যাঁ। কেনো? তোমাকে ফোন করা নিষেধ?”
“তোর ফোনের আশায় থাকতে থাকতে তো আমি বুড়ো হয়ে যাবো। তোর নাম্বার নিয়েছি কবে? এর মাঝে কতবার ফোন দিয়েছিস তুই?”
“তোমার নাম্বার আমার কাছে আছে কতো বছর ধরে জানো?” শান্ত কণ্ঠে বলল মালিহা।
ইতমিনান বিব্রত কণ্ঠে বলল, “কাউন্টার অ্যাটাক করা তো ভালোই শিখেছিস। এখানে ডিবেট করছিস নাকি?”
মালিহা দেখলো ইতমিনানের টি শার্টের গলার কাছটা ভিজে গেছে। সুইচ বোর্ডের কাছে যেয়ে ফ্যান অন করে সেখানে চেয়ার টেনে ইতমিনানকে উদ্দেশ্য ক্রি বলল, “বসো।”
ইতমিনান বসলো। মালিহা পলিথিন একপাশে রেখে বের হতে গেলে ইতমিনান বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“আসছি।”
পাশেই হলের ক্যান্টিন। আটটা বেজে গেছে কি? মালিহা ধারণা করলো এখন শেষ বেলার পাস্তাটুকু পাওয়া যেতে পারে। ধারণা সত্যি হলো। অল্প একটুই ছিলো। সাথে দুটো পেঁয়াজু নিলো মালিহা। একটা ঠান্ডা পানির বোতল।
“বিলটা পরে দিয়ে দেবো খালা। আর বাটি আমি দিয়ে যাচ্ছি।”
দোকানীকে কথা দিয়ে বের হয়ে এলো মালিহা। ওয়েটিং রুমে ঢুকে ইতমিনানের সামনে ধরলো সেগুলো।
ইতমিনান অবাক হলো বেশ। এখানে এসে আতিথেয়তা পাওয়ার কোনো আশাই তার ছিলো না। তবুও মালিহার বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে পানির বোতলটা নিলো আগে। আরেকটা চেয়ার টেনে মালিহা বসলো মুখোমুখি।
ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি খেয়ে ইতমিনান বলল, “অতিথি আপ্যায়ন করছিস?”
“হ্যাঁ। তুমি খাবার দাবার নিয়ে বেড়াতে আসতে পারো আমি আপ্যায়ন করলে কি দোষ?”
“দোষ দিচ্ছে কে? দে তোর হলের পাস্তা খেয়ে রিভিউ দিই।”
“রিভিউ দেয়া লাগবে না। ও আমি জানি।”
“আমাকে ফোন করতে চেয়েছিলি কেনো?”
এতক্ষণে নড়েচড়ে বসলো মালিহা।
“সেকেন্ড গেটের ওখানে এক বড় ভাইয়ের কোচিং আছে। সেখানে কাজ করার অফার পেয়েছি।”
মুখ নাড়ানো থামিয়ে এক পলক মালিহার মুখের দিকে তাকালো ইতমিনান। মেয়েটার মুখে একটা অপ্রকাশিত খুশির আভা।
“বড় ভাই বলতে?”
“আমাদের ভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে। আমার রুমমেট আপুর ক্লাসমেট।”
“কোন ক্লাস?”
“সিক্স থেকে টেন।”
“কথা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“বেতনের কথা কিছু বলেছে?”
“বলল প্রথমে সাত দেবে।”
“ভালোই তো।”
মালিহা ইতমিনানের মনের অবস্থা বুঝলো না। খুশি নাকি রাগ? মুখ এমন আটকে রাখলে কেউ বুঝবে কিভাবে?
“ইয়ে.. তুমি একটু খোঁজ নেবে?”
“কিসের খোঁজ?”
“এই.. কোচিং কেমন এসব।”
“আমার খোঁজ নেয়ার কি দরকার? তুই তো নিজেই সব কনফার্ম করেছিস।”
রেগে গেছে। এতক্ষণে বুঝলো মালিহা। কেনো এতো রাগ? অ্যাডমিশনের সময় তুমি সাথে ছিলে? যখন বাড়িঘর ছেড়ে এখানে চলে এলাম তখন ছিলে? এখন এতো রাগ কোত্থেকে আসছে? মনে ভাবলেও মুখে কিছু বলল না মালিহা। শুধু শুধু আর রাগানোর দরকার নেই।
“আমি তো শুধু একটু কথা বলেছি। তুমি খোঁজ নাও। ভালো না লাগলে আর আগাবো না।”
ইতমিনানের মুখের টানটান পেশীগুলো যেনো একটু নরম হলো। তেমনই মনে হলো মালিহার। কাজ হয়েছে নাকি?
“নাম্বার দে।”
ঝটপট ফোন থেকে নাম্বারটা দিলো মালিহা। তখনই মায়ের মামাবাড়ি চলে যাওয়ার কথাটা মনে পড়ল। বিকেলে ফোন দিলেও নাজিয়া ধরেননি। মুখটা মলিন হয়ে গেলো মালিহার। ইতমিনান সেটা খেয়াল করে বলল, “কেউ কি হুম-কি দিয়ে মেসেজ দিয়েছে?”
“আমাকে কেউ হুম-কি দেবে কেনো?”
“তাহলে মুখটা কালো করে ফেললি কেনো?”
ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল ইতমিনান। মালিহা মলিন কণ্ঠে বলল, “মা মিতুলকে নিয়ে মামাবাড়ি চলে গেছে।”
“জানি।”
“কিভাবে জানো?”
“বাবা বলেছে।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। “চাচী কখনোই আমাদের সাথে থাকতে চায় না রে মালিহা।”
মালিহার কষ্ট লাগলো। কষ্ট নিয়েই বলল ইতমিনান। বলেই মনে হলো একটা অতি জটিল বাস্তবতা নিজের সামনে প্রকাশিত হয়ে গেলো। যেই বাস্তবতা তাকে রুখে দেয়। তার অনুভূতিতে লাগাম টানতে বলে।

মিলির মেজাজ বিগড়ে আছে। তার ননদ এসেছে সপ্তাহের উপরে হয়ে গেলো কিন্তু যাওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। ভাইয়ের বাড়ি এসে থাক তাতে মিলির কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু রাতের বেলা নিজের সাত মাসের বাচ্চাটা তার বরের ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে নিজে শান্তির ঘুম ঘুমায়। একদিন দুইদিন ঠিক আছে। কিন্তু নিত্যকার রুটিন হয়ে যাওয়ার পর মিলি আর স্বস্তির ঘুম ঘুমাতে পারেনি। নিজের এখনও বাচ্চা কাচ্চা হয়নি। আনাড়ি হাতে ঐটুকু বাচ্চার দেখভাল করতে যেয়ে সে কাহিল হয়ে যায়। তার বরের আর কি? দুই তিনবার কোলে নিয়ে এসে সেই যে সটান হয়ে ঘুম দেয় বান্দা সকালের আগে আর কোনোভাবেই চোখ খোলে না। নির্ঘুম রাতগুলো যেনো মিলির মেজাজের পারদ আর এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বা-লিয়ে দিতে মন চাচ্ছে। কিন্তু তেমন কিছু করা যাবে না। তাহলে শাশুড়ি খ্যাচ খ্যাচ করার আরেকটা সুযোগ পাবে। মা মেয়ে মিলে ছেলেকে পুত্রবধূর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে। মিলি বোকার মতো কিছু করবে না। এতদিন খুব কৌশলে শাশুড়ির রোষানল বাঁচিয়ে চলেছে। তবে আজ কেনো তাড়াহুড়োয় ভুল করা?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো মিলি। চোখের নিচটা কালো হয়ে আছে। চট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আই শ্যাডোর বক্সটা বের করে নিপুণ হাতে চোখের নিচে আরেকটু ডার্ক সার্কেল এঁকে নিলো। মেকআপের কারসাজি দিয়ে মুখটা আরেকটু রুগ্ন করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় যেয়ে বসলো। হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো। মিনিট পাঁচেক পর গোসল করে বের হলো মিলিয়ে স্বামী আরিফ। মাথা মুছতে মুছতে বিছানার সামনে দাঁড়ালো। মিলি আর যাই করুক আরিফের খেয়াল রাখতে কখনও গাফিলতি করে না। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে তার জামা কাপড় নিজেই গুছিয়ে সামনে এনে দেয়। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ায় স্ত্রীর দিকে তাকালো আরিফ। তখনই আঁতকে উঠলো সে। মিলিকে কি ভীষণ রুগ্ন দেখাচ্ছে!
“অ্যাই! কি হয়েছে তোমার?”
মিলি অলস ভঙ্গিতে চোখ খুলল। আরিফকে এক পলক দেখে বলল, “রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মাথা ব্যাথা করছে।”
কথা সত্য। মিলির মাথা প্রকৃতই টনটন করছে। আরিফের মনটা অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো। ঘড়ির দিকে একবার দেখে মিলির কাছে যেয়ে মাথায় হাত রেখে বলল, “শুয়ে থাকো। একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি মা’কে বলে যাচ্ছি যেনো তোমাকে না ডাকে।”
“আরে না! শেলী ওর ছেলেকে নিয়ে একা পারে নাকি? তোমার বলার দরকার নেই। মা আবার কিছু মনে করলে আমার খারাপ লাগবে।”
“নিজের ছেলে রাখতে পারবে না কেনো? এতদিন তো তুমি রেখেছোই। অসুস্থ হলে কি করবে? মা যদি জানে তোমার শরীর খারাপ তাহলে কিছুই বলবে না।”
“ছাই জানো তুমি!” মনে মনে ভেংচি কেঁটে হাজার কথা বললেও মুখে কিছু বলল না মিলি। আলগোছে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। পিঠটা ব্যাথা করছে।
“টেবিলের ওপরে তোমার খাবার আর টিফিন রেখে দিয়েছি। একটু কষ্ট করে খেয়ে নিও।”
“ আমি খেয়ে নিবো। তুমি ঘুমাও তো।” পোশাক বদল করতে করতে উত্তর দিলো আরিফ। শেলীকে কিছু বলার দরকার। নিজের বাচ্চা মানুষ কতদিন রাখতে পারে? যখন মা নিজে সুস্থ সবল হয়ে আরামের ঘুম ঘুমায়।
আরিফ বেরিয়ে যেতেই হাই তুলল মিলি। ঘুমে চোখটা বুজে আসছে। কিন্তু আর একটা গুরুত্বপূর্ন কাজ বাকি। মাথায় এই পোকাটা কবে থেকেই ঘুরছে। সুযোগের অভাবে পোকাটা আরেকজনের মাথায় ট্রান্সফার করা হচ্ছে না।

.

মেয়ের ফোন পেয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন আয়েশা। গরমে গলা ঘেমে গেছে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ফ্যানের নিচে দাঁড়ালেন।
“হ্যালো! কেমন আছিস?”
“আমি আছি আমার মতো। এখন তুমি কি বলবে তার উপরে ভালো খারাপ বলতে পারবো।”
“কেনো আমি কি খবর পড়ি নাকি যে তোকে ভালো, খারাপ খবর দিতে পারবো?” কৌতুক করে বললেন আয়েশা। তবে মিলি মোটেও সেই মেজাজে নেই। একে শরীরের বেহাল দশা তার ওপর নতুন চিন্তা। বিরক্ত হয়ে সে বলল, “ইয়ার্কি রাখো। তোমার ছেলের খবর বলো।”
গরম কণ্ঠে আয়েশা বললেন, “তোর ভাই হয়। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”
“ভাই ওটা মিতুলের। তুমি তোমার কলিজার ছেলের খবর বলো।”
“আছে ভালোই।”
“আছে না গেছে?”
“তোর হেয়ালি কথা রাখ তো মিলি। সোজা করে বল। নাহলে আমি ফোন রাখলাম।”
“ইহ! আমার কথা এখনই ভালো লাগছে না।” ভেংচি কেঁটে বলল মিলি। “তোমার ছেলের ওদিকে যে মালিহা থাকে তা জানো?”
“জানি। ইতু নিজেই বলেছে মালিহার ভার্সিটির পাশেই ও থাকে।”
“একটু দেখে শুনে রেখো তোমার ছেলেকে। তার তো আবার দয়ার শরীর। সেই দয়ার মাঝে আবার তোমার জা মালিহাকে ডুবিয়ে না দেয়।”
“কি বলতে চাচ্ছিস বল তো?” আয়েশাকে চিন্তিত দেখালো।
“ভাইয়ার চোখে তো ন্যাবা। মালিহাদের কোনো দোষই সে দেখতে পায় না। তার উপর থাকেও আবার সেই মেয়ের পাশে। কখন কি হয়ে যায় তার ঠিক আছে?”
আয়েশা কিছুক্ষণ থমকে রইলেন। এই চিন্তা তো তার মাথায় আসেনি। মিলি ফোন রেখে দিলো বটে। তবে নিজের মাথার পোকা আয়েশার মাথায় ঢুকিয়ে। ফুটন্ত তরকারি সামনে আয়েশা দাঁড়িয়ে রইলেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। তার এখন কি করা উচিত?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১২

ইতমিনান খুব মন দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছে। বেশ অনেকদিন আগেই একটা প্রেশার কুকার কিনেছিল সে। মন ভালো থাকলেই খিচুড়ি খাওয়া তার শখের পর্যায়ে পড়ে। আজ তার মন ভালো। কেনো ভালো সেটাও তার জানা। তবে সেই জানা জিনিসটা নিয়ে সে ঘাটাঘাটি করতে চায় না। মস্তিষ্ককে এক রকম ফাঁকি দিতেই এই রান্না রান্না খেলা।

বেশ কয়েকটা সিটি হয়ে গেছে। আর একটা হলেই নামিয়ে ফেলবে। এমন সময় আয়েশা বেগমের কল এলো। হাত ধুয়ে কল রিসিভ করলো ইতমিনান। নরম স্বরে সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো।

“কি করো আব্বা?”
“খিচুড়ি রান্না করছিলাম।”
আয়েশা বেগম হাসেন। ছেলেটা কেমন একা একাই রান্না করে খায়।
“রান্না বান্না করতে কতো কষ্ট হয়! সারাদিন খাটাখাটনি করে এসে এই ঝামেলা ভালো লাগে? এই জন্যেই তো বিয়ে দিতে চাই।”
“বউ কি শুধু রান্না করে খাওয়ানোর মানুষ মা? একজন মানুষ মানে একটা দায়িত্ব। বউ মানে আরো বড় দায়িত্ব। এতো বড় দায়িত্ব নেয়ার মতো সামর্থ্য এখনও তোমার ছেলের হয়নি।”
শেষ সিটি বাজলো। চুলা বন্ধ করে ডিম নিলো ইতমিনান। এটা ভাজলেই এখন খেতে বসা যায়।
“তোর যতো আজগুবি কথা। রিকশা চালায় রাসেল, ওর ছেলেরে সেদিন বিয়ে দিলো না? আশপাশে মানুষ বিয়ে করছে না?”
“রাসেল চাচার ছেলের বউয়ের মতো ছেলের বউ চাও তুমি?” ইতমিনানের স্বরে কৌতুক। “তাহলে খোঁজো যাও।”
“ফাজলামি করবি না ইতু!” আয়েশা বেগম যেনো ধরা খেয়ে গেলেন।
ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে কড়াইয়ে তেল ঢাললো ইতমিনান। আয়েশা বললেন, “হ্যাঁ রে! মালিহা কেমন আছে?” আয়েশার বুক ধুকপুক করছে। ইতমিনান সেটা বুঝলো না। ডিম ফাঁটিয়ে কড়াইয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, “ভালোই আছে।” আয়েশার মনে হলো তেল নয়, তার কলিজাটা ছ্যাঁত করে উঠেছে। তার মানে ইতমিনান মালিহার নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছে?
কথা শুনতে না পাওয়ায় ফোন কানে ধরলো ইতমিনান, “মা?”
আয়েশার যেনো ধ্যান ভাঙলো, “হ্যাঁ?”
“কি হলো কথা বলছ না কেনো?”
আয়েশা চিন্তায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেকে আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
“আচ্ছা তুই খা। আমি আবার পরে ফোন করবো।”
“আচ্ছা।” ইতমিনান অতো শত বুঝলো না। ক্ষুধায় তার পেট মোচড় দেয়া শুরু করেছে। একটুখানি পাস্তা খেয়েছে সেই কখন!

.

রাশেদা বেগমের ঘরে বসে আছেন মকবুল আলী। মায়ের ওষুধ পত্র নিয়ে এসেছেন। কথা বার্তা বললেও কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে।
“কি এতো চিন্তা করো?” রাশেদা নরম সুরে প্রশ্ন করলেন। মকবুল আলী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “জমি জমার একটা সুরাহা না হলে শান্তি পাচ্ছি না মা। এর মধ্যে মালিহার মা চলে গেলো বাপের বাড়ি। আমার ভাইয়ের ভিটা এখন খালি পড়ে আছে।”
রাশেদার বুকটা হু হু করে উঠলো। যেই জমি নিয়ে এতো টালবাহানা সেই জমিওয়ালা আজ বাড়ি ছাড়া, দুনিয়া ছাড়া।
“বড় বউ তো রাজি না। এর মধ্যে আবার এসব কথা তুললে অশান্তি শুরু হবে। তুই আগে বউরে বোঝা। তারপর আবার কথা তুলিস।”
আয়েশা হন্তদন্ত হয়ে শাশুড়ির ঘরে ঢুকলেন। রাশেদার দিকে একবার তাকিয়ে স্বামীকে বললেন, “আপনি একটু এদিকে আসেন তো।”
রাশেদা ভয় পেলেন যেনো।
“কোনো সমস্যা বউ মা?”
“না মা। সমস্যা নাই। একটু দরকার।”
মকবুল আলী ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে গেলেন। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আয়েশা যেনো জেঁকে ধরলেন।
“ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেলো আপনি এখনও একটা সম্বন্ধ দেখেন না কেনো?”
হঠাৎ আলাপে মকবুলের কপালে ভাঁজ পড়ল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলেন।
“সম্বন্ধ তো আসেই। তোমার ছেলেই নিষেধ করে দেয়। পাত্র রাজি না থাকলে আমি কি করি পারি?”
“পাশের বাড়ির তালুইয়ের মতো কথা বলেন কেনো? ছেলে মেয়ের জিম্মা আমাদের না? বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন বসায় রাখবো কেনো? ছেলে না হয় বুঝতে পারছে না। আপনি কই বোঝাবেন সেসব না করে নিজেও তাল দিচ্ছেন।”
“তুমি আবার এখন এসব নিয়ে পড়লা কেন?” মকবুল বিরক্ত হলেন।
“এসব আবার কি? আপনার মতো সারাক্ষণ ভাইরে কিভাবে সব সম্পত্তি দিয়ে দেয়া যায় সেই চিন্তা করব নাকি?”
“উল্টাপাল্টা কথা বলবা না আয়েশা।”
“কিছু উল্টাপাল্টা বলি নাই। বাপ মরা মেয়ে নিয়ে চিন্তায় আপনি রাতে ঘুমান না। সেই মেয়ের গতি করতে যেয়ে আমার ছেলেমেয়ের কপাল পুড়লে আমি মানবো কেনো?”
আয়েশা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। মকবুল বুঝলেন না এতো রাগারাগির কারণ কি। বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তোমার এতো রাগের কি কারণ সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। আর এখানে ছেলেমেয়ের কথা আসছে কেনো? ওদের কোনো ক্ষতি আমি চাই?”
“অতো কিছু আমি বুঝি না। ওদের চিন্তা করতে যেয়ে ঐ মেয়েকে যদি আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দেন তাহলে সেদিন এই সংসারে আমার শেষ দিন।”
চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে আয়েশা নিজের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে ফেললেন। হনহনিয়ে চলে গেলেন ঘর ছেড়ে। মকবুল আলীর কপালের ভাঁজ সমান হলো। সহসাই ভাবলেন এই ভাবনাটা তার মাথায় আগে কেনো আসেনি? নিজের মাঝে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করলেন মকবুল আলী।

ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। সেই নিয়ে সবার উত্তেজনার শেষ নেই। মালিহা যাবে না। তাই নীতিও যাচ্ছে না। এহসান বিষয়টা মানতে পারলো না। ক্লাস গ্যাপের মাঝে নিজের আসন ছেড়ে উঠে এলো মালিহার কাছে। কণ্ঠে অধিকার নিয়ে বলল, “এই মালিহা! তুমি যাবে না কেনো? তোমার আর নীতির ট্যুর আমি স্পন্সর করবো। কোনো না শুনছি না। নীতি! গোছগাছ শুরু করে দে।”
শেষটুকু নীতিকে উদ্দেশ্য করে বলল এহসান। শিটের পাতা ওল্টানোর মাঝে এমন বাক্য মালিহা আশা করেনি। চুপচাপ সবটুকু শুনলো সে। এহসানের বলা শেষ হলে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এতো দয়া দেখানোর জন্য ধন্যবাদ এহসান। আমি তোমার অফার গ্রহণ করছি না। এবং আশা করব এমন করে ভবিষ্যতে আমাকে দয়া করতে আসবে না।”
নীতি ঢোক গিললো। মালিহা চটেছে। এহসানের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “খুব উপকার করেছিস! কে চেয়েছে তোর অফার বলদ?”
এহসান থতমত খেয়ে গেছে। মালিহার প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝতে পেরেছে বিষয়টা সে একদমই পছন্দ করেনি। এলোমেলো ভঙ্গিতে সে বলল, “মালিহা তুমি কি মাইন্ড করলে নাকি? এটা আমার পক্ষ থেকে জাস্ট একটা ট্রিট।”
“কি উপলক্ষ্যে?” মালিহার কণ্ঠ শান্ত। এহসান আমতা আমতা করে বলল, “আসলে আমি ভেবেছি তোমার মন খারাপ সেজন্য তুমি যেতে চাচ্ছো না। এছাড়া এই কিছু না। তোমাকে হার্ট করার কোনো ইন্টেনশন আমার ছিলো না। ট্রাস্ট মি!”
“আমি যেতে চাচ্ছি না এহসান। নীতি যাবে কি না সেটা ওর বিষয়।”
ক্লাস ছেড়ে চলে গেলো মালিহা। নীতি কটমটিয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে বান্ধবীর পিছু নিলো।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে