উষ্ণতা পর্ব-০৯

0
106

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৯

মিতুল বেজায় বিরক্ত। মা’কে যথেষ্ট বোঝানো হয়েছে। মিতুল বুঝতে পারছে নাজিয়া জেদ ধরেছেন। কিন্তু জেদটা ঠিক কার উপরে? মালিহা নাকি মকবুল আলী? মকবুল আলীর সাথে জেদ ধরে তার লাভটা কি! দাদির ঘরে গেলো মিতুল। তিনি যদি অন্তত নাজিয়াকে বোঝাতে পারেন।
“দাদি?”
রাশেদা বেগম শুয়ে ছিলেন। নাতির ডাকে উঠে বসলেন।
“আসো। ভেতরে আসো।”
“তোমার শরীর কেমন এখন?” ভেতরে আসতে আসতে বলল মিতুল।
“আলহামদুলিল্লাহ। ভালো। কিছু বলতে চাও?” মিতুলকে উশখুশ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।
“দাদি মা মামাবাড়ি যেতে চায়।”
রাশেদার ভুরু কুঁচকে গেলো।
“ইদ্দত তো সে হয়নি। দুইদিন পরে গেলে কোনো সমস্যা?”
“উফ তুমি বুঝতে পারছ না। মা ওখানে থাকতে যাচ্ছে। বেড়াতে না।”
রাশেদা চমকে উঠলেন। “কেনো? এখানে কি সমস্যা?”
“আমি জানিনা। তুমি মা’কে আটকাও। আমি অন্য মানুষের বাড়ি যেয়ে থাকতে পারবো না।”
নিজের কথা শেষ করে চলে গেলো মিতুল। রাশেদা চিন্তিত মুখে ঘর ছাড়লেন। নাজিয়ার এমন কাজের কারণ কি?

“ছোট বউ?”
নাজিয়া হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলেন।
“জি মা?”
“তুমি কি ব্যস্ত?” কৌশলে কথাটা জানতে চাইলেন রাশেদা। মিতুলকে মাঝে আনতে চাইলেন না।
“একটু গোছগাছ করছিলাম।”
“কিসের গোছগাছ?”
“ভাইয়ের ওখানে যাবো কয়েকদিনের জন্য?”
“তা যেও। কিন্তু তোমার ইদ্দতটা অন্তত শেষ হোক। এ সময় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া স্বামীর ঘর থেকে বের না হওয়াই উত্তম।”
“আমার ভাই আমাকে যেতে বলেছে।” মুখ গোজ করে বললেন নাজিয়া।
“খুব বলেছে। যাওয়ার আগে একবার বলে নিয়ম রক্ষা করে গেছে। এতদিনে একবারও ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে? মা’কে বোঝাও দাদি। আমি ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো না।”
ছেলের দিকে গরম চোখে তাকালেন নাজিয়া।
“আমার বাপের বাড়ি নিয়ে তোর এতো অসুবিধা কেনো? দুটো দিন যেয়ে থাকবো তাতে এমন করছিস কেন হ্যাঁ?”
“দুটো দিন? চারটা পাঁচটা গাট্টি হয়েছে দুটো দিনের জন্য? আমাকে কি তোমার অবুঝ বাচ্চা মনে হয়? মানুষের বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না। আমার বাবার কি ঘরবাড়ি কিছু নেই?”
“আছে না! তোর বাপ তো জমিদার ছিলো। তোর জন্যে রাজ্য রেখে গেছে। খা! তুই আর তোর বোন মিলে ওগুলোই খা।”
রাশেদা ছেলেকে ডেকে আনলেন। কিন্তু নাজিয়া তাকে দেখে আরো ক্ষেপে উঠলেন যেনো। মকবুল আলী তাকে বোঝাতে গেলে কিছু তো শুনলেনই না। উল্টো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। এসব শুনে আয়েশা এসেও দুই কথা শুনিয়ে যেতে ভুললো না। মকবুল আলী হতাশ হয়ে রাশেদাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মিতুল অসহায় মুখে বসে রইলো। ক্রমেই তার চোখ ভিজে এলো। অতঃপর তাকে এক উদ্বাস্তুর জীবন পার করতে হবে? মা’কে তো সে একা ছাড়তে পারবে না। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো মিতুল। জীবনের সুতোয় যেনো একের পর এক গিট লেগেই চলেছে।

নিজের কাছে জমানো চার হাজার টাকা ইরিনার হাতে তুলে দিলো মালিহা। ইরিনা তাকে জড়িয়ে ধরলো। মালিহার যেনো দম আটকে গেলো। ইরিনা কান্না মাখা কণ্ঠে বলল, “আগামী মাসের শুরুতেই তোমার টাকাটা ফিরিয়ে দেবো মালিহা। আব্বুর বেতনটা ওঠাতে যতটুকু দেরি।”
“ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা সমস্যা নেই। এসব নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। তুমি এই কয়েকদিন বাড়িতে থাকবে তো?”
ইরিনা দ্রুত মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ বাড়িতেই থাকবো। ক্লাসের যে কি হবে!”
“আমার থেকে নোট নিও।”
“তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব মালিহা। আমার কতো বড় উপকার করলে তুমি নিজেও জানো না। তোমার কাছে শেষ একটা অনুরোধ।”
“এভাবে বলছো কেনো? নিঃসঙ্কোচে বলো।”
“এই টাকার বিষয়টা তুমি কাউকে জানিও না।”
“আরে না! পাগল নাকি!”
কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বিদায় নিল ইরিনা। রুমে আসতেই নীতি মালিহাকে জেঁকে ধরলো।
“তুই ওকে টাকা দিলি কেনো?”
মালিহা হকচকিয়ে গেল।
“তুই দেখলি কিভাবে?”
“তুই কি ওকে লুকিয়ে দিয়েছিস নাকি? বের হওয়ার সময়ই দেখেছি।”
মালিহা আমতা আমতা করলে নীতি আবার তাকে ধাক্কা দিলো।
“কথা বলিস না কেনো?”
মালিহা দোনামনা করলো। ইরিনা তাকে নিষেধ করে গেলো। কিন্তু নীতি তো নিজেই দেখেছে। বলতে গেলে জেনেই গেছে।
“ওর বাবা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। খুব খারাপ অবস্থা। ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।”
“তো?”
“তো মানে? এমন সময় টাকা পয়সার সংকট হয় না? তাই আর কি..”
“যাদের হিসাবের টাকা তাদের সংকট হয়। ওদের তো বেহিসাবি টাকা। ওর বাবার কি বিরাট ব্যবসা জানিস?”
“ব্যবসা? তাহলে আমাকে বেতন তোলার কথা বলল কেনো?”
“ওর বাপের এক্সিডেন্ট তাহলে ও হলে কি করছে? ওর বাড়ি তো হুলুস্থুল লেগে যাওয়ার কথা।”
“সব গুছিয়ে নিতে এসেছে মনে হয়। বাদ দে তো।”
মালিহা বললেও নীতি বাদ দিতে পারল না। ইরিনা তার বাবার ব্যবসার ব্যাপারে মিথ্যা বলল কেনো?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৯(বর্ধিতাংশ)

ফোন হাতে বসে আছে ইতমিনান। রনিকে কল করবে কি করবে না সেই সিদ্ধান্তটাই গত বিশ মিনিট ভেবে নিতে পারছে না সে। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে রনির সাথে বেশ সখ্যতা থাকলেও শেষদিকে তার সাথে বেশি যোগাযোগ করা হয়নি। ফোনও রনি নিজেই দিত। যোগাযোগ মূলত ওর জন্যই করা হয়েছে। ইতমিনান যখন এখানে নতুন জয়েন করলো তখন একদিন হঠাৎ রনির সাথে দেখা। সে নাকি এদিকেই থাকে। বেশ উৎফুল্ল হয়েছিল ছেলেটা। পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছিলো। কিন্তু ইতমিনান বরাবরই মুখচোরা। গল্পের আসরে সে শুধু শোভা বর্ধন করতে পারে। আসর জমাতে পারে না। ঠিক এই কারণেই চেনা বন্ধু কাছে থাকা সত্ত্বেও ছুটে যেয়ে তার সাথে গল্প করা হয় না। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে সেই অকৃত্রিম বন্ধুর কাছে ফোন দিতেও কেমন লাগছে। নিজে থেকে যোগাযোগ যা-ও করছে সেটাও প্রয়োজনের খাতিরে। নিজের উপরই বিরক্ত হলো ইতমিনান। একটু গরজ করে যোগাযোগ করলে এখন এই বিপাকে পড়তে হতো না।

“হ্যালো?”
চমকে উঠলো ইতমিনান। ফোনের দিকে নজর পড়তেই দেখলো রনির নাম্বারে কখন যেনো কল চলে গেছে। সে-ই ওপাশ থেকে কথা বলছে। রনির নাম্বার সামনে নিয়েই ভাবনা চিন্তা করছিলো সে। কখন যেনো চাপ লেগে কল চলে গেছে।
“হ্যালো রনি?”
“কিরে ইতমিনান? আজকে কি রাতের বেলায় সূর্য উঠেছে নাকি? তুই ফোন করলি! What a pleasant surprise!”
শেষটুকু বেশ নাটকীয় স্বরে বলল রনি। ইতমিনান বিব্রত হলো।
“লেগ পুল করা বাদ দে তো।”
“ওকে ওকে! তো বলুন! এই অধম আপনার কি কাজে আসতে পারি?”
“এভাবে বলছিস কেনো? আমি কি তোকে কাজ ছাড়া কখনও ডন দিই না?”
“না। ফোনই দিস না তার আবার কাজ!”
রনির স্বরে স্পষ্ট রগড়। ইতমিনান সিদ্ধান্ত নিলো আজ সেসব কিছু বলবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, “কেমন আছিস?”
“বউ ছাড়া যেমন থাকা যায় তেমনই আছি।”
“তুই কি সবসময় এই চিন্তাই করিস?”
“যতদিন বিয়ে না হচ্ছে ততদিন এটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট চিন্তার একটা। আমি তো তোর মতো রোবট না ভাই!”
ইতমিনান হেসে ফেলল, “আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে রোবট মনে হয়?”
“মানুষ মনে হওয়ার মতো কোনো অ্যাঙ্গেল নাই। চলতি ফিরতি রোবট। তোর বাড়ি বউ থাকলেও চিন্তা করতাম বউয়ের টানে বাইরে থাকতে চাস না। শালার একখান মানুষ বটে তুই!”
“আংকেল আন্টি কেমন আছে?”
“তুই কি কোনোভাবে আমার বোনের খবর জানতে চাচ্ছিস?” রনির কণ্ঠে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস।
“যাহ শালা!”
“আবার বলে শালা!”
“তুই নিজেও তো বলেছিস। আমি কিছু বলেছি?”
“তুই হলি বিয়াত্তা বোনের ভাই। তোরে শালা বললেই কি আর সম্বন্ধি বললেই কি? কিন্তু তুই আমারে বলবি ক্যান? আমার বোন কেবল নাইনে।”
“ভুল হইসে ভাই। মাফ কর আমারে।” স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল ইতমিনান। রবি হেসে ফেলল।
“কোনো সমস্যা ইতমিনান? কি বলতে চাচ্ছিস বলে ফেল। আমার কাছে একটা কথা বলবি তাও এতো ভাবতে হবে তোর?”
নিজের বড় ভাই নেই। বংশের বড় সন্তান সে। সবাইকে বড় ভাইয়ের মতো আগলে রাখলেও নিজে সেই অভিভাবকের ছায়া পায়নি ইতমিনান। এই ক্ষণে এসে তার মনে হলো রনি যেনো তার নিজের বড় ভাই। যে খুব ভরসা দিয়ে তার মনের কথা জানতে চাচ্ছে।
“আসলে একটা টিউশনি খুঁজছি। ভার্সিটি এরিয়ার আশপাশে হলে ভালো হয়।”
রনি গুরুতর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, “কোনো সমস্যা দোস্ত? তোর চাকরি তো ভালো পদে।”
“আমার জন্য না।”
“তাহলে?”
মালিহার বিষয়টা খুলে বলল ইতমিনান। রনি বলল, “আমার বড় আপা ভার্সিটির পাশেই থাকে। রিকশা করে গেলে এই ধর দশ পনের মিনিট লাগবে। আপার মেয়েটার বয়স পাঁচ সাড়ে পাঁচ। আপা দুলাভাই দুজনেই জব করে। ও থাকে বুয়ার কাছে। ওর জন্য একজন খুঁজছিল।”
ইতমিনান বলল, “বাচ্চা কাচ্চা হলে তো ঝামেলার বিষয়।”
“ঝামেলা তোর কাছে। মেয়েরা বাচ্চা সামলানোতে জন্মগতভাবে এক্সপার্ট। আর ওকে দুপুর, বিকাল এই সময়ের দিকে থাকতে হতে পারে। তুই বললে আমি আপার কাছে ডিটেইলস শুনবো।”
দোনামনা করে ইতমিনান বলল, “আচ্ছা শুনিস। একটা টিউশনি করে যদি হয়ে যায় তাহলে তো ভালই হবে।”
শেষ কথায় রনিকে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিলো ইতমিনান। টাকা পয়সার বিষিয়ে কথা বলতে তার খুবই বিব্রত লাগে। কিন্তু মালিহার একটা সদগতি না করে সে শান্তি পাচ্ছে না।

“এই গল্পটা কে লিখেছে তিশা?”
“আমি লিখেছি।”
মালিহা বিস্মিত হলো। ইংরেজিতে লেখা গল্পটার কোথাও কোনো বানান ভুল নেই। এমনকি বাক্য বিন্যাস হয়েছে চমৎকার ভাবে।
“সত্যি তুমি লিখেছো?”
“জি মিস।”
মালিহার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এই কয়েকদিনে মেয়েটার পড়াশোনার যে হাল দেখেছে তাতে এটা বিশ্বাস করা কষ্টই বটে। মেয়েটা কম বোঝে। সহজ পড়াগুলোও সহজে ধরতে পারে না। সেই মেয়ের খাতায় এমন ইংরেজি গল্প দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
“এতো সুন্দর করে লিখতে তুমি কোথায় শিখেছো?”
“গল্পের বই পড়ে।”
“তুমি ইংরেজি বই পড়?”
“জি।”
“তিশা তোমার এই গল্পটা আমি নিয়ে যাই?”
“কেনো মিস?” তিশার চোখে ভয় দেখা গেলো।
“আমার বান্ধবীকে দেখাবো। এত্তো দারুন লিখতে পারে আমার স্টুডেন্ট! এটা তো গর্ব করার মতো বিষয়।”
তিশার চোখ ভিজে এলো। ভিজে গেলো কণ্ঠও।
“জানেন মিস আম্মু আমাকে লিখতে দেখলে অনেক বকা দেয়।”
“কেনো?” মালিহার ভুরু কুঁচকে গেল।
“আম্মু বলে এগুলো লেখা ভালো না।” তারপর চারপাশে তাকালো। ফিসফিস করে তিশা বলল, “সেদিন এজন্য আম্মু আমাকে অন্ধকার ঘরে রেখে দিয়েছিল।”
মালিহাও ফিসফিস করো কথা বলল।
“তুমি অন্ধকার ভয় পাও?”
“অনেক। এজন্যই কথা না শুনলে আম্মু শুধু আমাকে অন্ধকারে রেখে আসে। মিস আপনি কি আম্মুকে বলবেন এমন যেনো না করে?”
“তিশা!”
ভেতর থেকে আজিজা বেগমের কণ্ঠ ভেসে আসতেই তিশা শব্দ করে পড়তে শুরু করলো। মালিহার কাছে বিষয়টা যেনো আর গোলমেলে ঠেকছে। মেয়েটা অন্ধকারে ভয় পায়। তাহলে ওকে এই শাস্তি দেয়ার মানে কি?

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে