উষ্ণতা পর্ব-০৮

0
68

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৮

মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। তবে তার সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় নেই মালিহার। চপল পায়ে সে চলেছে গন্তব্যে। গতকাল নীতির সাথে এসে জায়গাটা চিনে নিয়েছে। রিকশা করে যেতে লাগে বিশ টাকা। এক দিনে চল্লিশ, সপ্তাহে একশ বিশ, মাসে নয়শ। এই হিসাব গতকাল রিকশায় বসেই সে করেছে। আজিজা তিন হাজার টাকা বেতনে সমঝোতা করেছেন। তার মাঝে এক হাজার কোনোভাবেই মালিহা ভাড়ার পেছনে ঢালতে পারে না। আর পাঁচ মিনিট হাঁটলেই তিশার বাড়ি। হঠাৎ নিজের নাম শুনতে পেয়ে থেমে গেলো মালিহা। ঘাড় ঘোরালো না। ঐ তো! আবার কেউ ডাকছে। তাকেই? কে?

ইতমিনানের অফিস চারটায় ছুটি হয়। ব্যক্তিগত কাজ শেষ করতে পারায় সে চারটা বাজার আগেই বেরিয়ে আস্তে পেরেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। আগে কই? তিনটা সাতচল্লিশ বাজে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজলো ইতমিনান। তখনই নজরে পড়ল বোরখা পরিহিতা ছুটন্ত এক নারী। ইতমিনানের ভুরু কুঁচকে গেলো। মালিহার মতো লাগছে না? একটু এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলো সে। মেয়েটা থামলো তবে ঘুরে তাকালো না। আবার ডেকে ইতমিনান এগিয়ে গেলো।

মালিহা পিছু ফিরে দেখলো ইতমিনান। হঠাৎ দাঁড়ানোর কারণে মালিহার মনে হলো তার নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। ইতমিনান এগিয়ে এসে তাকে এমন করতে দেখে ভয় পেলো।
“মালিহা! কি হয়েছে তোর? বসবি কোথাও?”
মালিহা হাত নাড়িয়ে না করলো। এক হাত কোমরে রেখে আরেক হাত বুকে চাপ দিলো। ইতমিনান নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলে ঢকঢক করে পানি খেলো মালিহা। তাকে কিছুটা শান্ত দেখালো।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“স্টুডেন্ট পড়াতে।”
“তুই টিউশনি করাস?”
“গতকাল থেকে শুরু করেছি।”
“আমাকে তো বলিস নি।”
“তোমাকে বলার কথা ছিল?”
চুপ কর গেলো ইতমিনান। ধীর কণ্ঠে বলল, “বাসা কোথায়?”
“আর পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে।”
“রিকশা নিসনি কেনো?”
“তুমি এখানে কি করছো?”
মালিহা প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। ইতমিনান বুঝলো।
“আমার অফিস এখানেই।”
“চারটা থেকে পড়ানো শুরু। আমি যাই?”
“চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।।”
“আমি একাই যেতে পারবো।”
“চল।”
ইতমিনান মালিহার কথা শুনলো না। নিজের মতো এগিয়ে যেতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মালিহা বলল, “ঐদিকে না।”
ইতমিনান ঘুরে এলো। মালিহার পিছু নিলো।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর মালিহা বলল, “তুমি এখন আমাকে দয়া করছো ভাইয়া। আমার ভালো লাগছে না।”
“তোর কাছে দয়া মনে হচ্ছে কেনো?”
“বাবা বেঁচে থাকতে তো ঠিকঠাক যোগাযোগও করতে না। এখন এতো হেল্প করছো কেনো? নিশ্চয়ই দয়া করে।”
ইতমিনান বলল, “আমি যোগাযোগ করিনি। তুই কেনো করিসনি?”
মালিহা চুপ করে গেলো। বলল না ইতমিনানের খোঁজ করতে গেলেই চাচী আর মিলি আপা তাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে। পুরোনো ক্ষত খোঁচানোর কি দরকার?
ইতমিনান হাসলো। মালিহার কাছে মনে হলো তাচ্ছিল্যের হাসি। জ্বলে উঠলো সে, “হাসছো কেনো? আশ্চর্য!”
“আমরা সবাই সামনের গল্প পড়ি মালিহা। পেছনের পটভূমি আমাদের অজানাই থেকে যায়।”
মালিহা এক পলক ইতমিনানের দিকে তাকালো। তার পটভূমি ইতমিনান জানে? নাকি কখনও জানার চেষ্টা করেছে? হঠাৎ অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বুকটা ভার লাগলো মালিহার। ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়ার কারণে ইতমিনান এবং মিলি দুজনের প্রতি ছিলো তার অন্যরকম এক টান। শুধুমাত্র চাচাতো ভাইবোনের গন্ডিতে তা আটকে থাকেনি। মিলি বেশি আদর না করলেও কখনও খারাপ ব্যবহারও করেনি। কিন্তু ইতমিনান তার বন্ধু হয়ে উঠেছিল। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবসময় তাকে পাশে পাওয়া যেত। মতিয়ার আলীর সাথে ইতমিনানের সম্পর্ক কখনও বাবা ছেলের চাইতে ভিন্ন কিছু ছিল না। সেই সব ফুলে সাজানো সম্পর্কগুলো হঠাৎ সম্পত্তির কাঁটায় ভরপুর হয়ে গেলো। হাত বাড়ালেই ক্ষত। আর সব বাদ কিন্তু মতিয়ার সাহেবের সাথে ইতমিনান কিভাবে যোগাযোগ না করে থাকতে পারলো? তার একটুও খারাপ লাগলো না? মালিহার মনে আছে, বাড়িতে ইতমিনানের পছন্দের কোনো খাবার রান্না হলেই মতিয়ার আলী ইতমিনানকে ধরে আনতেন। বিশেষ কোনো দিন ইতমিনানকে ছাড়া পার করতেন না। মানুষ বলতো বাপের চেয়ে চাচার দরদ বেশি। আহা! সব দরদ কর্পূরের মতো উবে গেলো।

বাড়ির সামনে পৌছুলে ইতমিনান একটা কেকের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো। মালিহা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নিলো না।
“নে।”
“আমি কেক খাই না।”
“কেমন খাস না আমার জানা আছে। নে।”
“খাবো না।” মুখ গোজ করে বলল মালিহা।
“ধর!” মালিহা কেঁপে উঠল। এভাবে কেউ ধমক দেয়! খপ করে কেকটা নিয়ে বলল, “রাস্তাঘাটে একদম ধমকাধমকি করবে না।”
বলেই গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেলো মালিহা। ইতমিনানের ঠোঁটের কোণায় ক্ষীণ হাসির রেশ দেখা গেলো সাথে খেলে গেলো এক চিন্তা। মালিহা পুরোটা রাস্তা এভাবে হেঁটে যাতায়াত করবে? মুহূর্তেই ইতমিনানের কপালে ভাঁজ পড়ল।

মালিহা বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসে আছে। একজন মহিলা এসে চা বিস্কুট দিয়ে গেছে। এই গরমে ঘেমে নেয়ে মালিহার চা খেতে মোটেই ইচ্ছা করছে না। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হলে আরাম করে খাওয়া যেত। কিন্তু চাইতেও তার লজ্জা করছে।
টেবিলে কলম দিয়ে শব্দ করছিল মালিহা। সেসময় আজিজা এলে সে সোজা হয়ে বসলো। আজিজা চেয়ারে বসে বললেন, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“জি বলুন ফুপু।”
“তিশাকে কাল তোমার কেমন লাগলো?”
প্রশ্নের ধরনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো মালিহা। এটা কেমন প্রশ্ন? ইতস্তত করে বলল, “জি ভালো।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজিজা বললেন, “ওর কিছু সমস্যা আছে। সহজ জিনিস ও সহজে ক্যাচ করতে পারে না। অনেক সময় লাগে। এজন্যই ওর কোনো টিউটর বেশিদিন টেকে না। আর তাছাড়া..”
“তাছাড়া?”
“থাক এটা তুমি পড়াতে গেলেই বুঝবে। তোমার কাছে আশা থাকবে একটু সময় নিয়ে ওকে বোঝাবে।”
মালিহা মাথা নাড়লো। সে চেষ্টা করবে। আজিজা যাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝে তিশা এলো। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসছে। মালিহা তাকিয়ে দেখলো টকটকে লাল রঙের একটা ফ্রক পড়ে আছে তিশা। লাল রংটা কেনো যেনো মালিহার চোখে বাধে। আজও বাঁধলো। তিশার দিকে তাকাতেই মনে হলো চোখে ব্যাথা করছে। মালিহা শুধু তিশার মুখের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো।
“আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছো তিশা?”
হাসিমুখে সালাম দিলো মালিহা। তিশা তাকালো বটে কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মালিহা ভাবলো হয়তো অস্বস্তি হচ্ছে। সে নতুন মানুষ। অস্বস্তি হতেই পারে। তিশা বসলো না। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মালিহা চেয়ার এগিয়ে বলল, “বসো তিশা।”
তিশা বসলো। তবে তার বসার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। যেনো জড়সড় হয়ে বসতে চাচ্ছে। তিশার মাথায় হাত দিয়ে নরম কণ্ঠে মালিহা বলল, “তিশা কি আমাকে ভয় পাচ্ছে? আমি তো তিশার ফ্রেন্ড।”
তিশা মাথা উঠিয়ে তাকালো। তার চোখ চিকচিক করছে।
“ফ্রেন্ড?” এই প্রথম কথা বলল তিশা। মালিহা মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ। তোমার বন্ধু আছে না?”
“না।”
মালিহা অবাক হলো। কিন্তু উল্টো কোনো প্রশ্ন করলো না।
“তাহলে আমাকে তোমার ফ্রেন্ড বানিয়ে নাও। বানাবে?”
“ফ্রেন্ড হলে আপনি কি করবেন? বকবেন?”
“না। বকবো কেনো?” মালিহার কাছে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে।
“সবাই তো আমাকে বকে।”
“এতো কথা কিসের তিশা? বই বের করে পড়া শুরু কর।” হঠাৎ আজিজা ভেতরে এসে কড়া গলায় নির্দেশ দিলেন। তিশা তো তিশাই, মালিহা নিজেই ভয় পেয়ে গেলো। তিশা তড়িঘড়ি করে বই বের করলো। মালিহা কথা না বাড়িয়ে পড়ানো শুরু করলো। এর মাঝেই সে আবিষ্কার করলো মেয়েটা শুধু পড়া কম বোঝে এমন নয়, সাধারণ কথাবার্তাও সে খুব একটা বোঝে না। কারণটা ধরতে পারলো না মালিহা।

সন্ধ্যা থেকেই ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসে সেই পানির ঝাপটা এসে মুখে লাগছে। মালিহা ফোন কানে আরেকপাশে সরে গেলো। ফোনের ওপাশে রাশেদা বেগম।
“দুপুরে কি খেয়েছো?”
“আলু ভাজি আর ডাল।”
“খাওয়ার কষ্ট করছো কেনো মালিহা?”
মালিহা চুপ করে থাকলো।
“তোমার ওষুধ আছে দাদি?”
“আছে। তোমার বড় চাচা কিনে দিয়ে গেছে। খাওয়ার কষ্ট করবে না মালিহা। আমরা এখনো বেঁচে আছি।”
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথা বলা শেষে দেখলো ইরিনা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। নজর তার দিকেই। তাকে তাকাতে দেখে ইরিনা এগিয়ে এলো।

“কেমন আছো মালিহা?”
“ভালো। তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে?”
ইরিনা মলিন হাসলো। মালিহা বলল, “কি হয়েছে? আমাকে বলা যাবে?”
ইরিনা মালিহার হাত ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে