উষ্ণতা পর্ব-০৬

0
107

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৬

ট্রেন চলেছে। ঝিকঝিক করে। একের পর এক গ্রাম, ধান ক্ষেত, নদী, বিল কতো কিছুই না পাশ কাটিয়ে গেলো! মালিহা এক মনে দেখলো। গাড়িতে উঠলেই ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এবার তেমন হলো না। আগামীর চিন্তায় তার ঘুমটুকু তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। নীতি পাশ থেকে ধাক্কা দিলো। ফিসফিস করে বলল, “দোস্ত একটু বাথরুমে যাবো।”
“চল।”
ইতমিনান দুজনকে একসাথে উঠতে দেখে মালিহাকে ইশারা করলো। মালিহা সামনের দিকে চোখ দেখালে ইতমিনান না যাওয়াটাই সমীচীন মনে করলো। বগির শেষ মাথায় বাথরুম। তার সামনেই কয়েকজন অল্পবয়স্ক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের আশপাশে সবার বয়স। নীতি ভেতরে ঢুকলে মালিহা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো। একটা ছেলে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো। আরেকজন একধাপ এগিয়ে সিটি দিলো। মালিহা রাগ করার বদলে আশ্চর্য হলো। তার ছোট ভাইয়ের বয়সী একেকটা ছেলে কি শুরু করেছে! একজন অন্যদিকে তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে গেলে মালিহা চট করে সরে গেলো।
“এই যে ছোট ভাই! চোখ অন্যদিকে থাকলে তো দরজা থেকে পড়তে সময় লাগবে না। নাম্বারটা বলো এদিক ওদিক কিছু হলে বাড়িতে জানিয়ে দেবো।” ছেলেটার বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল ইতমিনান। তার হাত নিপুণভাবে ছেলেটার উঁচু হয়ে থাকা শার্টের কলার ঠিক করে দিচ্ছে। এক নজর দেখলে মনে হয় কি নরম ভাব। কিন্তু ইতমিনানের শক্ত চোয়াল মালিহার নজর এড়ালো না। ছেলেগুলো ভড়কে আরেকদিকে চলে গেলো। সম্ভবত আর কোনো মেয়ে একা আছে নাকি খোঁজ করতে। ইতমিনান কিছু না বলে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আগত ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় পড়লো মালিহা। তার সামনের পথগুলো এমন কাঁটায় ভরপুর। সে কি পারবে একা পুরোটা পথ পাড়ি দিতে? ঢোক গিলে নিজেকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো মালিহা। হলো না। তার কাছে মনে হলো ছাতাবিহীন একটা মানুষের কাছে শরতের স্বচ্ছ মেঘগুলোও জ্বালাময়ী রোদ হয়ে ওঠে।

নীতি বের হয়ে মালিহার হাত ধরে বলল, “দোস্ত! পেট ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা। যা তুই একবার রাউন্ড দিয়ে আয়। আমি এখানে দাঁড়াই।”
ইতমিনান দরজার পাশ থেকে ঢুকে ভেতরে চলে গেলো। নীতি বড় বড় চোখ করে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আবার মালিহার দিকে তাকালো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “দোস্ত! তোর ভাই কি সব শুনে ফেলসে? আমি কি এখন দরজা থেকে ঝাঁপ দিবো?” মালিহা কিছু না বলে সিটে ফিরে গেলো। নীতি কাঁধের ওড়না মাথায় তুলে বড়সর ঘোমটা দিয়ে সিটে বসে জানালার দিকে মুখ ফেরালো। মালিহা শুনতে পেলো নীতি বিড়বিড় করছে, “আল্লাহ! তুমি সম্মান দেয়ার মালিক। ট্রেনের ভিতরে আমার সম্মানটা রিস্কে ফালাইয়ো না।”

জংশনে ট্রেন বেশ কিছু সময় থামলো। ইতমিনান মালিহার কাছে এসে বলল, “কি খাবি?”
“কিছু না।”
“আমি এখন কিছু নিয়েই আসবো। তুই বললে তোরই লাভ। নাহলে আমি যেটা আনবো সেটাই খেতে হবে।”
নিশ্বাস ছেড়ে মালিহা বলল, “ইসপি।”
“আর?”
“চিপস।”
“তোর বান্ধবী কি খাবে?”
“অ্যাই নীতি। কি খাবি?”
নীতি মালিহার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। ইতমিনানের উপস্থিতি টের পেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকেছে শুরুতেই। এবার ফিসফিসিয়ে বলল, “এক প্লেট ভাত খাইতে পারলে জানডা ঠান্ডা হইতো।”
মালিহা ইতমিনানকে বলল, “ট্রেনে বিরিয়ানি পাওয়া যায় না?”
“যায়।”
“এক প্যাকেট দিয়েন।”
“আচ্ছা।”
ইতমিনান যেতেই উঠে সোজা হয়ে বসলো নীতি।
“দোস্ত তোর ভাই হয় দরবেশ নাহয় ভিজা বিড়াল।”
“কেনো?” বিরক্ত হয়ে তাকালো মালিহা।
“মেয়ে মানুষ পটানোর প্রথম টেকনিক হলো তার খেয়াল রাখা। তোর ভাই সেইটা এক্কেবারে খাপে খাপ করতেসে। আর মনের মধ্যে পটাপটির কাহিনী না থাকলে সে তো দরবেশ বাবা। নিজ উদ্যোগে এসে এসে তোর খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। ভালো না? ভালো তো।”
“র-ক্তের টান বড় টান।”
“র-ক্ত এই পাঁচ বছর কই ছিলো? হিমালয়ের পাদদেশে হিম হয়ে ছিল? যতসব ফালতু আলাপ!”
মুখ ঝামটা দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো নীতি। মালিহা তাকে ঘাটালো না। কিছুক্ষণ পর ইতমিনান চিপস, জুস, বিরিয়ানি, পানি নিয়ে এলো। মালিহার কোলের উপর সব রেখে বিনা বাক্য ব্যয়ে চলে গেলো নিজের আসনে। ট্রেন কিছুক্ষণের মাঝেই আবার চলতে শুরু করল।
মালিহার খাওয়া কিছুক্ষণের মাঝেই হয়ে গেলো। জুস আর চিপসের প্যাকেট ব্যাগের এক কোণে রাখলো। মুখ ঘোরাতেই দেখলো নীতি এক লোকমা বিরিয়ানি তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
“খাবো না নীতি।”
“তুই খাবি তোর ইয়ে মার্কা ভাইও খাবে।” বলেই মালিহার মুখে ঠুসে দিলো বিরিয়ানি। মুখে হাত রেখে খাবার চিবুতে চিবুতে মালিহা বলল, “ইয়ে মার্কা মানে?”
“উপরে ফিটফাট ভিতরে সদর ঘাট।”
মালিহা চোখ রাঙালো। নীতি তার থোড়াই কেয়ার করে।

পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে গেলো। আকাশ কমলা রঙের ঘোমটা কপালে ফেলে নতুন বধূ সেজেছে। মুয়াজ্জিনের আযান দুর থেকে ভেসে ভেসে আসছে। ইতমিনান কারো কাছে কিছু না শুনেই হলের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঠিক করলো। মালিহা অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাদের সাথে যাবে?”
“হ্যাঁ। তোদের পৌঁছে দিয়ে যাই।”
নীতি মুখ বাকালো। মালিহা বলল, “আমরা যেতে পারতাম।”
ইতমিনান উত্তর দিলো না। অটো রিকশার পেছনে দুজনকে বসিয়ে নিজে চালকের পাশে বসলো। বিশ মিনিটের মাথায় মালিহা নিজের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো। আঁধার ঘনিয়ে এলেও যুবক যুবতীরা সেদিকে মন দেয়নি। কারো ঘরে ফেরার তাড়া নেই। গুটিকয়েক ছাত্র একদিকের রাস্তা দিয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। বাকিরা সবাই আড্ডায় মশগুল। মালিহা সন্ধ্যার পর কখনও ক্যাম্পাসে থাকেনি। যত কাজই থাকুক, সূর্যের সাথে সাথে সেও নীড়ে ফিরে যায়। আজন্ম লালিত অভ্যাস পিছু ছাড়ে না। সেই কবে থেকে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার অভ্যাস করিয়েছেন নাজিয়া। এমনকি মতিয়ার আলী সন্ধ্যার পর অকারণে বাইরে থাকলে তিনি বেজায় রাগ করতেন। টুকরো স্মৃতি নিউরনে সংকেত পাঠাতেই হাসি খেলে যায় মালিহার ঠোঁটে।
“কি রে! নাম!” নীতির ধাক্কায় মালিহার হুশ ফিরল। সে নিজেদের ব্যাগ নিয়ে ইতোমধ্যেই হলের গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। ইতমিনান ভাড়া মিটিয়ে মালিহার কাছে এলো।
“তোর নাম্বারটা আমাকে দে। আমার নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“আছে। ফোন কেনার পর থেকেই আছে।”
ইতমিনান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। পরপর আবার তাড়া দিলো।
“কই দে!”
নাম্বার বলার পর মালিহা বলল, “আমি কারো অনুগ্রহ চাই না।”
ইতমিনান হতাশ সুরে বলল, “এগুলো তোর কাছে অনুগ্রহ মনে হচ্ছে? আমি কি তোর কেউ নই?”
“র-ক্ত সম্পর্কে কখনও জং ধরে না, সুতো ছিঁড়ে যায় না। আমাদের গেছে।”
ইতমিনান এই কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না। কিন্তু ধীর কণ্ঠে বলল, “আমি তোর পর নই মালিহা।”
এক পলক ইতমিনানের দিকে তাকালো মালিহা।
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তুমি কতদূর থাকো?”
“পাশেই। রিকশায় উঠলে পাঁচ মিনিট লাগবে।”
“বেশ। তাহলে এসো।”
“কোনো দরকার হলে আমাকে একটা ফোন করিস। প্লিজ!”
বেশ আকুতির সুরে বলল ইতমিনান।
“আচ্ছা। আসি।”
মালিহা চলে গেলো। যতক্ষন না সে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকলো ইতমিনান তাকিয়েই রইলো। এক সময় সে নিজেও প্রস্থান নিলো।

অনেকগুলো দিন পর নিজের রুমে মালিহা। দুইশ ছাব্বিশ নাম্বার এই রুমটাকে মালিহা নিজের বলেই ভাবে। না ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমের মানুষগুলোর সাথে তার কোনো মনোমালিন্য নেই। নীতি এবং কণিকা আপুর সাথে বেশ ভাব। কণিকা ফোর্থ ইয়ারে। আরেক কর্ণারের বেডে আঁখি, মাস্টার্সের ছাত্রী। এই মেয়েটা একটু গম্ভীর। নিজের মতো থাকতে ভালবাসে। কারো সাতে পাঁচে নেই। তবে মালিহা, নীতি বা কণিকার সাথে জুনিয়র বলে কখনও খারাপ ব্যবহার করেছে বলে তাদের মনে পড়ে না।
গোসল করে জানালা খুলে বালিশে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল মালিহা। শরীর বিশ্রাম নিতে চাইলেও মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না। কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর বুকে ব্যাথা হতে লাগলো। নাজিয়া কতো বকেন এভাবে না শোয়ার জন্য কিন্তু মালিহার খেয়ালই থাকে না। উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো মালিহা। বহু দূরের কোনো বাড়ি অথবা দোকানে আলো জ্বালানো হয়েছে। গাছের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ সেই আলোক বিন্দু দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জোনাকি নেচে বেড়াচ্ছে।
“মালিহা খিচুড়ি খা।”
মালিহা সামনে তাকালো। কণিকা হাতে খিচুড়ির ওকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“দ্রুত নে। আমার ক্ষুধা লেগেছে। খেতে বসবো।”
হাতে নিতেই মালিহা বুঝলো একদম গরম খিচুড়ি। অবাক হয়ে বলল, “গরম খিচুড়ি আপনি কোথায় পেলেন আপু?”
“রান্না করে আনলাম। তোর আমের আচারটা কোথায়?”
“শেষ হয়ে গিয়েছে। নীতির আছে। দাঁড়ান দিচ্ছি।”
নীতির টেবিলের শেলফ থেকে আমের আচারের কৌটা বের করলো মালিহা। মালিহার দিকে অপলক তাকিয়ে কণিকা বলল, “আন্টি কেমন আছে মালিহা?”
“আছে আপু।”
নিশ্বাস ছেড়ে বলল মালিহা। মেয়েটার মলিন মুখ দেখে কণিকার খেতে মন চাইলো না। কিন্তু ক্ষুধা লেগেছে ব্যাপক।
“আমার সাথে বস। একসাথে খাই।”
“নীতি গোসল করে আসুক।”
“আসতে থাকুক ও। তুই বস।”
এতবার বলার পর না করাটা বেমানান। মালিহা প্লেট নিয়ে বসলো। খিচুড়ি নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “আঁখি আপু কোথায়?”
“জানিনা। আপুর কি কোনো টাইম টেবিল আছে? এই আছে এই নেই।”
সেসময়ই রুমে ঢুকলো আঁখি। কণিকা যেনো একটুর জন্য বেঁচে গেলো। আঁখিকে তার বেজায় ভয়। কেমন হুম করে থাকে সবসময়।
“কেমন আছো মালিহা?”
“জি আপু ভালো।”
“শরীর সুস্থ?”
“জি আপু।”
বেশ কিছুক্ষণ পর মালিহা দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপু আপনাদের কাছে একটা আবদার আছে।”
আঁখি বাইরের পোশাকেই বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল। সেটা দেখে মুখ কুঁচকে খাচ্ছিল কণিকা। কণিকা চোখ তুলে মালিহার দিকে তাকালো। আঁখি বলল, “কি আবদার?”
“আমাকে কিছু টিউশনি খুঁজে দিতে পারবেন?”
চুপচাপ ঘরটায় কেবল কিছু দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে