উষ্ণতা পর্ব-০৪

0
109

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪

অনেকগুলো ছেলেমেয়ে বাড়ির দিকে আসছে। মিতুল খেয়াল করলো। দেখলো ইতমিনান তাদের আটকেছে। কথাবার্তা বলে ছেড়ে দিলো। মিতুল ইতমিনানকে সহ্য করতে পারছে না। ইতমিনানের সব কাজ তার কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। একটা মেয়ে এসে বলল, “তুমি মিতুল না?”
মিতুল তাকালো। বসা থেকে উঠে বলল, “জি। আপনাকে তো চিনলাম না।” নীতি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “আমি নীতি।” মিতুলের কপালের ভাঁজ সমান হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসুন।”
মালিহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। নীতিদের দেখতে পেয়ে বের হয়ে এলো। নীতি ঝাপিয়ে পড়লো মালিহার উপর। মালিহা তাকে আগলে নিলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো নীতির বাবা মা-রা গেছে এবং মালিহা তাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। এহসান একদৃষ্টে মালিহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। পেছনে আসা ইতমিনান সেটা লক্ষ্যও করলো।
“নীতি থাম।”
“আমার অনেক কষ্ট লাগছে দোস্ত।”
নীতি হেঁচকি তুলে বলল। মালিহা নিচু স্বরে বলল, “আবার পরে কাদিস। ওরা এতো দুর থেকে জার্নি ওর এসেছে ওদের বসার ব্যবস্থা করতে হবে।” নীতি নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
“আন্টি কোথায়? আমি আন্টির সাথে দেখা করে আসি।”
“ভেতরে আছে। মিতুল নীতিকে মা’র কাছে নিয়ে যা।”
ইতমিনান মালিহার কাছে এসে বলল, “সকালে কি খেয়েছিস?”
মালিহা এক পলক তাকিয়ে বলল, “কিছু না।”
ইতমিনান আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না। সামনের ছেলেদের দিকে তাকালো। বলল, “ভাই! আমি মালিহার চাচাতো ভাই। তোমরা আমার সাথে এসো। মেয়েরা এদিকে থাকুক।”
দুইজন মেয়ে মালিহার নির্দেশে নীতির পিছু পিছু গেলো। ইতমিনান যাওয়ার আগে ফিসফিসিয়ে বলল, “কিছু করতে হবে না। আমি ফুপুকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফুপুকে ডেকে দে।”
মালিহার প্রকৃত অর্থেই রান্না করতে ইচ্ছে করছিল না। তাই এক বাক্যে মেনে নিয়ে রাবেয়ার যেচে গেলো সে।

রাবেয়া বেজায় চিন্তিত। এতদিন দ্বন্দ সংঘাত ছিলো ভাইদের মাঝে। সেটা এখন স্থানান্তরিত হয়েছে ভাইয়ের বউদের মাঝে। অবশ্য এতদিন পেছন থেকে তারাই কলকাঠি নেড়ে আসছিলো। প্যাঁচে পড়েছিল ভাইয়ের ছেলেমেয়েগুলো। মালিহার কথা মনে হতেই বুকটা ভার হয়ে যায়। মতি তো গেছে। তার মেয়েকে বিপদে ফেলে গেছে। আহা! বাপের আদরের মেয়ে। মালিহা কি দিয়ে কি করবে ভেবে পান না রাবেয়া।
“আম্মা!”
রাবেয়া সামনে তাকালেন। রাফি ডাকছে। পাঁচ বছরের ছেলেটা তার শেষ বয়সের সন্তান। দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ একটা সময় তিনি নিঃসন্তান হিসেবে কাটিয়েছেন। স্বামীর মন মানসিকতা ভালো ছিল বলে শাশুড়ির কথা শুনেও টিকতে পেরেছেন। নয়তো তার পাশের বাড়ির ছোট্ট একটা মেয়ে, এই মালিহার সমান, বিয়ের দুই বছরের মাঝে কোনো ছেলেপিলে হলো না বলে মেয়েটাকে বাপের বাড়ি রেখে এলো। তিনি অবশ্য আফজাল সাহেবকে বলেছিলেন আরেকটা বিয়ে করতে। একজন ডিভোর্সী মহিলাকে বিয়ে করলে তারও আশ্রয় হয়। আফজাল সাহেব বলেছিলেন, “আমার জীবনে ঝামেলার কোনো শেষ নাই রাফির মা। ডাইকা ডাইকা আর ঝামেলা আনার কাম নাই।” এই মানুষটা আজব। বিয়ের পর থেকেই ডাকে রাফির মা। যখন রাফির কোনো খোঁজ খবর নেই তখন ডাকে রাফির মা। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার সফর শেষ করে তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। আজ রাবেয়া প্রকৃত অর্থেই রাফির মা।
ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন রাবেয়া। মনে চায় মানিকটাকে কলিজার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে। আহা! তার বুকের ধন।
“বলো বাপ। ক্ষুধা লাগছে? কিছু খাবা?”
“না। আম্মা মালিহা আপার কি হয়েছে?”
রাবেয়ার বুকটা ভরে যায়। ছেলেটা কি সুন্দর কেউ কথা বলে! একদম স্পষ্ট করে। মাঝে মাঝে তিনি নিজেকে নিয়েই শঙ্কায় পড়ে যান। কখন না নজর লাগিয়ে দেন।
“কি হবে বাপ? কিছুই হয় নাই।”
“মালিহা আপা এবার আমাকে একবারও কোলে নেয়নি। মালিহা আপার মন খারাপ। কেনো আম্মা?”
“তোমার ছোট মামা কালকে মারা গেছে না? তাই মালিহা আপার মন খারাপ।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন রাবেয়া।
রাফি গম্ভীর হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আম্মা আমি মালিহা আপাকে বিয়ে করব।”
চারদিকে দুঃখের জাল বিছানো। তার মাঝে থেকেই রাবেয়া ফিক করে হেসে দিলেন।
“কেনো আব্বা?”
“মালিহা আপার মন খারাপ দেখলে আমার ভালো লাগে না। আমার সাথে বিয়ে হলে আপার মন ভালো হয়ে যাবে।”
“এই কথা তোমাকে কে বলেছে?”
“কেউ না। আমি জানি।”
রাবেয়া হাসেন। রাফি বলে, “হাসছো কেনো মা? মালিহা আপা আমাকে অনেক পছন্দ করে। মিতুল ভাইয়ার থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে। আপা আমাকে বিয়ে করবে। তুমি আপাকে বলবা।”
“আচ্ছা। বলবো।”
রাফি মায়ের কোল থেকে নেমে গেলো। তার অনেক কাজ।
রাবেয়া বানু মায়ের কাছে গেলেন। একটা শলা পরামর্শ করা দরকার। মালিহা সেখানেই ছিলো। তিনি আশপাশে দেখে নাজিয়াকে ডেকে আনলেন।
“তুই এখন মিটিং বসালি কেনো?” রাশেদা বিরক্ত হলেন। আরেকটু পরেই এশার ওয়াক্ত হবে। রাবেয়া এখন কথা শুরু করলে থামবে না।
“দরকার আছে মা। এই মালিহা ওঠ।”
মালিহা চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে ছিল। উঠে বসতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। ফুপুর দিকে তাকালো। রাবেয়া প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন।
“কি বলবা ফুপু?”
রাবেয়া নাজিয়ার দিকে তাকালেন। এক দিনের মাঝেই যেনো নাজিয়ার চেহারা অর্ধেক হয়ে গেছে। ভাইয়ের বউয়ের মাথায় হাত রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে না মা? মতির ছেলেমেয়েদের এখন কে দেখে রাখবে?”
রাশেদা বেগম যে এই বিষয়ে চিন্তা করেননি তা না তবে ভেবেছিলেন বড় ছেলেকে নিয়ে আলোচনায় বসবেন।
নাজিয়া চুপ করে ছিলেন। রাবেয়া বললেন, “তোমার ভাই কি বলে নাজিয়া?”
“তেমন কিছু বলে নাই আপা।”
নাজিয়ার বড় ভাই চলে গেছেন আজ বিকালে। যাওয়ার আগে অবশ্য স্বান্তনা দিয়ে গেছেন। নাজিয়া বললেন, “আমার মিতুল বড় হয়েছে। ওকে নিয়েই আমি থাকতে পারবো। কারো ঘাড়ের বোঝা হতে চাই না আপা।”
“মাথার উপরে একটা ছায়া লাগে না? মালিহা থাকবে ভার্সিটিতে। তুমি মিতুলরে নিয়ে এক কিভাবে থাকবা? ছেলে তো তোমার ঘরেই থাকে না।”
বেশ কিছুক্ষণের জন্য ঘরে নীরবতা নেমে এলো। হঠাৎ মালিহা বলল, “মা আর মিতুলকে আমি আমার ওখানে নিয়ে যাব।”
সবাই মালিহার দিকে তাকালো। এমন কথা কেউ চিন্তা করেনি।
“তোর ওখানে মানে?”
“আমার ভার্সিটির এলাকায়।”
“কোথায় থাকবি?” প্রশ্ন করলেন রাশেদা।
“বাড়ি ভাড়া নিবো।”
“আর চলবি কিভাবে?”
মালিহা সরাসরি মায়ের দিকে তাকালো। এবারের প্রশ্নটা তার ছিলো। নাজিয়ার চোখে একটা চাপা আক্রোশ দেখা যাচ্ছে। মালিহা জানে সেটা কেনো। নাজিয়া আবার বললেন, “সব তো দিয়ে দিয়েছিস তোর চাচাদের। ভাগে যেই জমি আসবে সেই জমি বিক্রি ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই।”
মালিহা শান্ত কণ্ঠে বলল, “টিউশনি করবো। ছোটখাট চাকরি পাই নাকি দেখবো।”
“সারা দেশে ভুঁড়ি ভুঁড়ি শিক্ষিত ছেলে ঘুরছে। তোরে চাকরি কে দিবে?”
“কে দিবে সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমার কাজ চেষ্টা করা। সেটাই আমি করবো।”
এমন সময় ঘরের দরজায় কাশির শব্দ শোনা গেলো। রাশেদা বেগম বললেন, “কে?”
“আমি মা।”
রাশেদা মেয়ে, বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আয়।”
মকবুল এলেন। সাথে ইতমিনান।
“আলোচনা কতদূর?”
মালিহা চাচার দিকে তাকালো। মকবুল এবং মতিয়ার আলীর কপাল একদম এক। মালিহার বুকটা খা খা করে উঠলো।
“কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই এখনো। আপনি আসছেন ভালো হয়েছে ভাইজান।”
“তুমি কি চিন্তা ভাবনা করছো? তোমার ভাই কি বলে?”
নাজিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মকবুল আলী।
“ভাইজান! মালিহা তো বলে অন্য কথা। ও নাকি নাজিয়া আর মিতুলরে নিয়ে ভার্সিটিতে যাইতে চায়।”
“ভার্সিটিতে কোথায়?”
ইতমিনান মালিহার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল। রাবেয়া বললেন, “বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে চায়। টিউশনি করতে চায়।”
রাশেদা বেগম মেয়েকে ধমক দিলেন, “আহ রাবেয়া! তুই থাম। নাজিয়ারে বলতে দে।”
“মালিহা! তুই কি চিন্তা করছিস?”
“মা আর মিতুলকে ওখানে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।”
“এখন তো সম্ভব না।” ইতমিনান বলল।
“এখন নিয়েও যেতে চাই না। আগে আমি যেয়ে টিউশনি ঠিক করি। বাসা দেখি। ব্যবস্থা হলে তারপর নয় যাবো। ততদিনে ইদ্দত শেষ হোক।”
আনুষাঙ্গিক আরো কিছু বিষয় আলোচনা হলো। ইতমিনান যাওয়ার আগে মালিহাকে বলে গেলো, “মালিহা আমার উপর তোর রাগ আছে কি না জানিনা। থাকলে সেটা জায়েজ না থাকলে তোর অনুগ্রহ। কিন্তু তোর কাছে আমার রিকোয়েস্ট থাকবে, আগের ঘটনার রেশ ধরে রাখিস না। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ডাকিস। নাহলে আমি নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।” মালিহা কোনো উত্তর দেয়নি। নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে।
নাজিয়া মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ হলেন। মেয়ে এবং মেয়ের চাচা কারো কথাই তার পছন্দ হলো না। মালিহাকে একা ঘরে পেতেই জেঁকে ধরলেন, “আমি তোর ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো না।”
“কেনো?”
“ওখানে কে আছে আমার? বিপদ আপদে কে আসবে? তার থেকে তোর নানাবাড়ি যেয়ে থাকবো। তোর মামা কখনও আমাদের অবহেলা করেছে?”
“মা! বোঝার চেষ্টা করো। এটা দুদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া নয়। তুমি এখনো খামাখা ওখান যেয়ে থাকবে? নানা নানী কেউ নেই। মামী তোমাকে দুই কথা শোনালে তুমি উত্তর দিতে পারবে? কি দরকার?”
নাজিয়া মুখ গোজ করে থাকলেন। কোনো যুক্তিই তার পছন্দ হচ্ছে না। মালিহা মায়ের মনে কথা বুঝতে পেরে শান্ত স্বরে বলল, “মামা যদি তোমাকে নিয়েই যেতে চাইতো তাহলে যাওয়ার আগে কিছু বলে যেতো না? বলেছে কিছু?”
নাজিয়া বেগম ধমকে উঠে বললেন, “তুই আমার ভাইকে কি বলতে চাচ্ছিস? তোর চাচার মতো স্বার্থপর না সবাই।”
মালিহা বলতে চাইলো, “আজ সকালে তোমাকে জমি কে দিতে চেয়েছিল? আজ সন্ধ্যায় তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কে চিন্তা করে গেলো?” বলল না। এখন নাজিয়া কথা বোঝার মতো অবস্থায় নেই।

ঘরে যেতেই নীতি খপ করে মালিহার হাত ধরলো।
“কি হয়েছে?”
“ভয় পাচ্ছিলাম।” নীতি এদিক ওদিক তাকালো।
মালিহা বিছানা গোছাতে গোছাতে বলল, “এহসানরা চলে গেছে?”
“হু। সবাই ক্যাম্পাসে চলে গেছে। মালিহা।”
“বল।”
নীতি মালিহার দিকে তাকালো। কথাটা এখন বলা কি ঠিক হবে? না থাক। মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হোক। মালিহা শুনতেও চাইলো না নীতি কেনো তাকে ডাকলো।
“নীতি তুই কবে যাবি?”
“তোর সাথে।”
মালিহা দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকে ফিরে যেতে হবে। সেই একই রুটিনের আবর্তে ঘুরপাক খেতে হবে। কিন্তু বুকে শূন্যতা নিয়ে। এই শূন্যতা আর কখনই কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবে না।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে