উষ্ণতা পর্ব-০৩

0
66

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩

জানালার পাশে বিশাল বড় এক কড়ই গাছ। সন্ধ্যা হলেই গাছের পাতা গুলো কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। দিনের শুরু থেকে আবার শিরদাঁড়া টান টান করে বাতাসের সাথে দুলতে থাকে। দিনের আলোর সাথে সম্ভবত তাদের একটা অলিখিত চুক্তি আছে। যতক্ষন আলো থাকবে ততক্ষন পাতারা খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ প্রস্ফুটিত থাকবে। সেই কড়ই গাছটা রাতের নীরবতাকে যেনো আরো নিশ্ছিদ্র করেছে। দাফনের পর অনেকে চলে গেলেও প্রায় বারো চৌদ্দ জন খোলা উঠানে চেয়ার পেতে বসে আছে। অন্দরমহলে মহিলা সমাজও সজাগ। কারো চোখে ঘুম নেই। কারো নির্ঘুমতা শোকে তো কারো উদ্বিগ্নতায়।

রুমটা মালিহার। খুব বেশি বড় নয়। একটা খাট আর আলনা রেখেই যেনো ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। টেবিল রাখার কারণে ঘরটা ঠাসা ঠাসা দেখায়। সেই কাঁঠাল কাঠের টেবিলে একটা চার্জার লাইট জ্বলছে। দেয়ালের দিকে তার মুখ ঘোরানো। যেনো আলো জ্বেলে অন্ধকারকে পরিমাপ করার চেষ্টা।
মালিহা শোকের আবহ থেকে একটুখানি সময় একান্তই নিজের জন্য, মতিয়ার আলীর জন্য টেনে বের করেছে। আঁধার যখন দর্প ভরে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে তখন মালিহা আঁধারের দম্ভকে চূর্ণ করে সেই আঁধারের মালিকের দরবারে মাথা ঠুকে কাঁদছে। তার চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হয় ভিজে পাতলা জায়নামাজ। বুকের কাছের ওড়নাটা ভিজেছে সেই কখনই। থেকে থেকে তার পিঠ কেঁপে উঠছে। তার কান্নামাখা ভেজা বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে গুনগুন করা কিছু শব্দ।

“আমার বাবার অনেক পাপ আল্লাহ। আমার বাবা মাঝে মাঝে নামাজ মিস দিয়েছে। দাদির সাথে অনেক সময় জোরে কথা বলেছে, খারাপ ব্যবহার করেছে। বড় চাচার সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করেছে। তোমার সব হক ঠিকমতো আদায় করতে পারেনি। কিন্তু আমার বাবা তোমাকে ভালোবাসতো আল্লাহ। তার অন্তরের খবর তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালো জানো। আমার বাবা তো তোমারই বান্দা বলো! আমি না চাইতেই তুমি আমাকে হাত, পা সব দিয়েছো। বাবা, মা, ভাই, বোন দিয়েছো। আজকে আমি তোমার কাছে আমার বাবার জন্য শান্তি চাইতে এসেছি আল্লাহ। তুমি কি তোমার ভিখারী বান্দাকে ফিরিয়ে দেবে? তোমার কাছে তো কোনো কিছুর অভাব নেই। আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিলে তোমার কোনোই ক্ষতি হবে না। তুমি প্লিজ আমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও। প্লিজ!”

মালিহার মাথা ভার ভার লাগছে। নাকের ভেতরে শিরশির করছে। দ্রুত নামাজ শেষ করলো সে। নাকের কাছে হাত দিতেই তরল আঠালো পদার্থ হাতে ঠেকলো। আলোর সামনে এসে দেখলো জায়নামাজ, ওড়না দুটোই র-ক্তে মাখামাখি। ঠিক কতটা দিন পর নাক থেকে রক্ত বের হলো মালিহা জানে না। তবে মনে পড়ে শেষবার অ্যাডমিশনের সময়ে খুব ঘন ঘন নাক থেকে র-ক্ত পড়তো। শরীরের ওপর, মনের উপর যখনই চাপ পড়েছে তখনই এমন হয়েছে। সেসময়টা বাবা পাশে ছিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করে বলতো, “কোনো চিন্তা নেই মা। আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে। তাঁকে বেশি বেশি ডাকো।” ডুকরে কেঁদে উঠলো মালিহা। সেই মানুষটা আজ নেই। তার পাশে নেই। এই বাড়িতে নেই। এমনকি এই দুনিয়ায় নেই। কোত্থাও নেই। আজ তার অস্তিত্ব এই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়েছে। মায়া মাখিয়ে “মা” বলে আর কেউ তাকে বাবার মতো করে ডাকবে না। বুঝবে না। বিছানায় শুয়ে পড়ল মালিহা। বুকটা ব্যাথা করছে। মাথা টনটন করছে। নাক থেকে গড়িয়ে পড়ছে টকটকে লাল তরল। তাকে থামানোর কোনো চেষ্টাই মালিহার নেই।

ইতমিনান বাবার পাশে বসে আছে। মকবুল আলী স্তিমিত হয়ে আছেন। বায়ান্ন বছরের শক্তপোক্ত মানুষটা কেমন যেনো ঝিমিয়ে গেছে। ইতমিনানের মনে হলো বিষয়টা বোঝানোর এখনই মোক্ষম সময়। নরম মনে নিশ্চয়ই তিনি পুরোনো জেদ ধরে বসে থাকবেন না।
“বাবা।”
মকবুল আলী অপলক নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলের ডাক তিনি শুনলেন না।
“বাবা।”
“হু!”
মকবুল আলী যেনো ধ্যান ছেড়ে বের হলেন। ইতমিনান বলল, “কি ভাবছিলে?”
মলিন হাসলেন মকবুল আলী।
“মতির কথা ভাবছিলাম। একই মায়ের পেটের ভাই আমার। অথচ শেষ সময়টা কি বিশ্রীভাবে কাটলো।”
ইতমিনান কিছু বলল না। মকবুল আলী নিজেই বললেন, “তুই আর মিলি যেমন আপন ভাইবোন আমি, মতি, রাবেয়া এমনই ভাইবোন। আমরাও ছোটবেলায় এক থালায় ভাত খেয়েছি। এক বাপের কাঁধে চড়েছি। এক মায়ের হাতেই বড় হয়েছি। অথচ দেখ। মতি ম-রার আগে আমি ওর সাথে বিরোধ করলাম সম্পত্তির জন্য। জায়গা জমির জন্য। অথচ এই ভাইয়ের কান্না থামানোর জন্যই আমি নিজের ভাগের খাবার, নিজের খেলনা ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম। পৃথিবীটা খুব কঠিন আব্বা। মাঝে মাঝে খুব ভয়ানক। র-ক্ত দিয়ে জুড়ে দেয়া সম্পর্ক র-ক্তা-ক্ত করেই ছিন্ন করে।”
হৃদয় নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মকবুল আলী।
“বাবা। একটা কথা বলতাম।”
“বল।”
“আমি যতদুর শুনেছি চাচার অনেক ঋণ ছিলো। ব্যবসা থেকে যা আয় ছিল সব ঋণ মেটাতেই চলে যাওয়ার কথা। তাহলে ওদের এখন আর কোনো আয়ের উৎস থাকলো না। ধানী জমি আর পুকুরটা যদি ওদের ভাগে দিতে তাহলে অল্প হলেও একটা ইনকাম সোর্স হতো।”
মকবুল আলী চমকে ছেলের দিকে তাকালেন। আশপাশে তাকিয়ে ছেলের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, “আমিও কথাটা ভাবছিলাম আব্বা। কিন্তু তোর মা’র জন্য বলতে পারছি না। মহিলা শুনলেই হুলুস্থুল বাধাবে।”
ইতমিনান বিষয়টা জানে। আজ সন্ধ্যায় বরকে সাথে নিয়ে এসেছে তার ছোট বোন মিলি। আয়েশাকে ইন্ধন যোগানোর এক সূত্র।
“আমরা মা’কে বোঝাবো। নাহলে এটা জুলুম হবে বাবা। এতিম দুটো ছেলেমেয়ের সাথে এমন ব্যবহার আল্লাহ সহ্য করবেন না।”
“তুই তোর মা’কে বলবি? ও তো তোর কথা ফেলতে পারে না।”
“বলবো।” দৃঢ় গলায় বলল ইতমিনান।
“রাবেয়া ফুপু কিছু মনে করবে না তো?” ইতমিনান জিজ্ঞেস করলো।
“না আব্বা। তোর ফুপু এসব সাত পাঁচে নাই। তারে ভাগ না দিলেও সে রা করবে না।”
“রা না করলে সেটা তার মহত্ত্ব। কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে আমরা জালিম হতে পারি না। কাল সকালে সবার সামনে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে। তুমি পাশে থাকলে আমি সাহস পাবো।”
“আমি তোর পাশেই আছি আব্বা।”
মকবুল আলী চোখ মুছলেন। যখন মাফ চাওয়ার এবং পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই তখন অনুতাপ সম্ভবত পৃথীবির সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকরতম শাস্তি।

রাশেদা বেগমের শক্তপোক্ত রূপটা মিলি দেখতে পারে না। আহ্লাদ বিষয়টা তার মাঝে নেই। বংশের বড় মেয়ে হিসেবে বাড়তি কোনো খাতির সে দাদীর থেকে পায়নি। না পেয়েছে ইতমিনান। রাশেদা তার প্রত্যেক নাতি নাতনিদের সমান চোখে দেখেন। মনের গভীরে কারো প্রতি কোনো দুর্বলতা আছে নাকি সেটা কেউ জানে না। এটাই মিলির আশঙ্কা। মালিহার সাথে ন্যায়বিচার করতে যেয়ে মিলি নিজের সাথে নাইনসাফি করতে দেবে না। চারপাশ দেখে আয়েশার কাছে গেলো মিলি।
“মা! তুমি এখনো এখানে কি করছো?”
আয়েশা চা বানাচ্ছিলেন। হঠাৎ মিলি কথা বলায় চমকে গেলেন। বুকে হাত দিয়ে পেছন ঘুরে ধমক দিলেন।
“সর! এভাবে কেউ কথা বলে? শব্দ টব্দ করে আসবি তো নাকি? আমার বুক ধড়ফড় করছে।”
“এখন বুক ধড়ফড় করছে। একটু পর আরো কিছুর জন্য তৈরি হও।”
“এতো প্যাঁচানো কথা কোত্থেকে শিখেছিস তুই? সোজা কথা সোজা করে বলতে পারিস না?”
“রাখো তো তোমার চা। তোমার শাশুড়ির মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না।”
“কিসের মতিগতি?” আয়েশা ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
“মালিহা সকালে মিটিং ডেকেছে জানো?”
“জানি।”
“তোমার শাশুড়ি না ওখানে দয়ার সাগর হাতেম তাই হয়ে জমি সব মালিহাদের দিয়ে দেয়।”
“এহ! বললেই হলো? তোর বাবার ভাগ আছে, তোর ফুপুর ভাগ আছে।”
“বাবা কালকে থেকে ঝিম মেরে আছে। ঐ বুড়ি যা বলবে তাই শুনবে। আর ফুপু তো আলু। মালিহার জন্যে তার মায়ার শেষ নাই। রেডি থাকো। নাহলে ঝটকা একটা খাবা। এতকিছু আমি বুঝি না। তোমার জামাই আছে। তার সামনে ফকিরি মার্কা জমি নিয়ে আমার মান সম্মান নষ্ট করবা না। এবার যা পারো করো।”
মিলি চলে গেলো। আয়েশা ভাবনায় পড়লেন। মিলি তো অবাস্তব কিছু বলেনি। ইতুর বাপের মনে এখন ভাইয়ের ছেলেমেয়ের প্রতি দরদ উথলে উঠলে সমস্যা। কয়েক বাড়ি পরেই মতিয়ার আলীর বাড়ি। যাবেন নাকি একবার?

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে রাবেয়ার ছোটো ছেলে ফরিদের সাহায্যে উপস্থিত হলেন রাশেদা বেগম। তার উপস্থিতি যেনো পরিবেশের গাম্ভীর্য খানিকটা বাড়িয়ে দিলো। আশপাশের কৌতূহলী প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছে। বাদ যায়নি প্রয়াত মতিয়ার আলীর পরিবারও। অবশ্য মালিহার বাদ যাওয়ার কথা নয়। কারণ তার কথাতেই এই পরামর্শ সভা বসেছে। রাশেদা বেগম মালিহাকে ইশারা করলেন কথা বলতে। সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো মালিহা।
“আমার বাবা মতিয়ার আলী, গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। আপনারা সবাই সেই সম্পর্কে জানেন। আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। যদি আমার বাবা কোনোদিন আপনাদের কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকেন তাহলে তাকে মাফ করে দেবেন। মৃ-ত মানুষের সাথে আর কিসের বিরোধ? আর ব্যবসায়িক লেনাদেনায় যারা বাবার সাথে যুক্ত ছিলেন আমার বাবা যদি কারো কাছে আর্থিকভাবে ঋণী থাকেন তাহলে দয়া করে প্রমাণসহ আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। যতক্ষন না এই টাকা শোধ হচ্ছে ততক্ষন আমার বাবা কবরেও শান্তি পাবেন না। যারা বাবার পরিচিত তাদের কাছে দয়া করে কথাগুলো একটু পৌঁছে দেবেন। আমি আবারও আমার বাবার হয়ে ক্ষমা চাইছি। আশা করি তার উপরে আপনারা কেউ আর কোনো দাবি রাখবেন না।”
পিনপতন নীরবতা চেয়ে গেছে পুরো উঠান জুড়ে। সেই ক্ষণে রাশেদা বেগম তার বর্ষীয়ান গলায় বলতে শুরু করলেন, “মকবুলের বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে আগে থেকেই বেশ টানাপোড়েন চলছে। আজকে এখানে আমার তিন ছেলে মেয়েই উপস্থিত আছে। তাদের সামনেই আমি এই সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা করে দিতে চাই।”
মিলি কান খাড়া করে শুনছিল। এই পর্যায়ে এসে মায়ের হাতে চিমটি দিলো। আয়েশা বেগম তাকালে চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝালো, “মিললো তো আমার কথা?”
“প্রথমে আমি সবার দাবি দাওয়া শুনতে চাই। মকবুল বলো। কোন অংশটা তুমি নিয়ে চাও?”
“মা মতির শেষ সময়ে ওর সাথে আমার বিরোধ ছিলো এই সম্পত্তি নিয়ে। আমি নিজের জন্য বিশেষ করে কিছু চাই না। সবাই নিয়ে যেটা থাকবে তাই আমি নেবো।”
সবার মনেই যেনো একটা হাহাকার পড়ে গেলো। ঠিক এই কথাটাই মতিয়ার বেঁচে থাকতে বড় ভাই হিসেবে তিনি বলতে পারতেন না? তাহলে কি পাঁচ বছরের এই বিশাল বিচ্ছেদ হতো? হতো না। ঠেকে সবাই শিখেছে বটে। তবে মানুষকে হারিয়ে। কিন্তু এই সবার মাঝে আয়েশা নেই। তিনি ফুঁসে উঠলেন। ইশারায় স্বামীকে চোখ রাঙ্গালেন এই বেকুবি কথার জন্য। তবে মকবুল ভুলেও সেদিকে তাকালেন না। ইতমিনান বলল, “দাদি আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলতে চাই।”
“বলো ভাই। তুমি বংশের বড় ছেলে। তোমার কথা বলার অধিকার আছে।”
মালিহার দিকে এক পলক তাকালো ইতমিনান। তার দৃষ্টি আকাশে স্থির। কি দেখছে কে জানে?
“ধানী জমি আর পুকুরের ভাগটা মালিহাদের দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এই মুহূর্তে আমার বাবা আছে। তার উপার্জন আছে। আল্লাহর রহমতে আমিও চাকরি পেয়েছি। আরো ভালো চাকরির চেষ্টা করছি। ফুপাও নিজের জায়গায় স্বচ্ছল। কিন্তু চাচার পরিবারে উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি নেই। মালিহা, মিতুল দুজনেই ছোট। ইজারা দিয়ে হলেও তারা এখান থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য পাবে। যেটা এসময় ওদের সবচেয়ে বেশি দরকার।”
রাশেদা বেগমের চোখটা চকচক করে উঠলো। তবে তিনি কিছু বলার আগেই আয়েশা ভেতর থেকে হুড়মুড়িয়ে এসে জোর গলায় বললেন, “এসব কি বলছিস ইতু! দুটোই ওদের দিয়ে দিলে আর কি থাকে? আমরা কি পাবো তাহলে?”
ইতমিনান চোখ বন্ধ করলো। এক উঠান মানুষের সামনে তার মা জমির দাবিতে চিৎকার করছে। তার কাছ মনে হলো এর থেকে লজ্জার আর কিছু নেই। শান্ত গলায় সে বলল, “একটু ভেবে দেখো মা। ওদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো।”
“বুঝেছি অবস্থা। তাই বলে পুকুরও ওরা নেবে আবার ক্ষেতও ওরাই নেবে? বাকি ঐ ভাঙাচোরা জমি নিয়ে আমরা করবোটা কি?”
মিলি এসে যোগ দিলো ভেতর থেকে, “মা তো ঠিকই বলেছে ভাইয়া। আমাদের নিজের চিন্তাও তো একটু করতে হবে। সব ওদের দিয়ে দিলে হবে না।”
রাবেয়া এতক্ষণে কথা বললেন। তার ভাইয়ের কবরের মাটি এখনো শুকায়নি। এর মধ্যেই এটা জমি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করেছে। মনুষ্যত্ব কি কিছুই বাকি নেই?
“মিলি তুই চুপ কর। তোর বাপ ভাই এখানে আছে। তাদের বুঝতে দে।”
“তুমি কথা বইলো না ফুপি। তোমার বরের তো কাড়ি কাড়ি টাকা। জমি তোমার না পেলেও সমস্যা নাই। কিন্তু আমি আমার বাপের থেকে পাবোই এক ভাগ। তাও যদি জোড়াতালি মার্কা হয় তাহলে চলবে কিভাবে?”
মকবুল আলীর মন চাইলো মেয়ের গালে ঠাটিয়ে চড় দিতে। কিন্তু এতো মানুষে মাঝে সেটা পারলেন না। শীতল কণ্ঠে বললেন, “মিলি ঘরে যাও।”
মিলি বাবার কথার ধার ধারলো না। তার বর আছে। এখানে কথা বলে জমি আদায় করে নিতে পারলে সেই কথা শ্বশুর শাশুড়ির কানেও যাবে। ইজ্জত বাড়বে বই কমবে না।
“ফয়সালার সময় কোথায় যাবো? আমার ভাগ আমাকেই বুঝে নিতে হবে। নাহলে তো দাদি বাপ ম’রা মেয়েকে সব দিয়ে দিতে চায়। বুঝিনা নাকি? ম’রা বাপ নিয়েও কেউ যে চালবাজি করতে পারে সেটা এই বুঝলাম।”
মুখ ভেংচি দিয়ে বলল মিলি। ইতমিনান আর সহ্য করতে পারলো না। কঠোর স্বরে হুংকার ছেড়ে বলল, “মিলি! একদম চুপ কর।” সেই স্বরে কেঁপে উঠল প্রত্যেকটা মানুষ। বাদ গেলেন না নাজিয়া বেগম নিজেও। শুধু শান্ত কণ্ঠে মালিহা বলল, “ক্ষেত, পুকুর কোনোটাই আমরা নেবো না। একটাও না।”
“মালিহা!” নাজিয়া বেগম মোটামুটি একটা ধমক দিলেন। তবে সেটা ধমকের পর্যায়ে পড়লো না। সারারাত কান্নাকাটি করে তার গলার জোর কমে গেছে। মালিহা সেই ধমক গায়ে মাখলো না। সবাই তার দিকে তাকালো, “আমার বাবা আমাকে চালবাজি করা শেখায়নি। আর না আমার রিজিক কেউ কেড়ে নিতে পারবে। ক্ষেত, পুকুর কোনোটাই আমরা নেবো না। তোমরাই নাও। আমাদের একটুখানি শান্তি দাও।”
ইতমিনান দেখলো আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করা মালিহার নাক থেকে র-ক্ত পড়ছে।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে