উষ্ণতা পর্ব-০১

0
124

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
সূচনা পর্ব:

স্টেশনে পা রাখার জায়গা নেই। মালিহা বোঝে না জায়গাটা সবসময় কেনো সরগরম থাকে। বাস স্ট্যান্ডে তো সবসময় এতো লোক থাকে না। তাহলে এখানে কেনো? দুই বছর ধরে যাতায়াত করলেও এই কেনো উত্তর মালিহা আজও পায়নি। ভিড় ঠেলে বের হতে মালিহার দম আটকে যাবার জোগাড় হলো। এমনিতেই দম আটকে বুকটা যেনো ভার হয়ে আছে। দুপুরে হঠাৎ পাওয়া ফোনটা তার নিত্য পার করা সরল সূত্রের মতো অঙ্ককে জ্যামিতির জটিল চৌহদ্দিতে ফেলে দিয়েছে। কঠিন উপপাদ্যের মতো লাগছে সময়টা। না পারছে শেষ নামাতে নাই বা পারছে ছেড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে।

দুটো ক্লাস শেষ করে যখন মালিহা ফোন হাতে নিলো তখন তার স্ক্রিনে ভাসছে চৌদ্দটা মিস হয়ে যাওয়া কলের নোটিফিকেশন। তড়িঘড়ি করে মায়ের নাম্বারে ব্যাক করতেই শুনতে পেলো রাবেয়া ফুপুর গলা। বলা ভালো ভাঙ্গা গলা। কেনো গলা ভেঙেছে, মায়ের ফোন কেনো রাবেয়া ফুপু ধরেছে কোনো প্রশ্নই করা হলো না। ফুপুর একটা কথাতেই মালিহা অস্থির হয়ে উঠলো। ফুপু জানালেন মতিয়ার সাহেব ছোটো একটা এক্সিডেন্ট করেছেন। মালিহা যেনো একটু আসে। মালিহা ছোটো ভাই মিতুলকে ফোন দিলো। সে ধরলো না। অস্থির মালিহা আবার মায়ের ফোনে ফোন করলো। কেউ ধরলো না। মালিহাকে আশঙ্কার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যেনো তার পরিবার ভারী মজা পেয়েছে। সবাই এক মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।

হল থেকে আসার সময় নীতি এসেছে তার সাথে। নীতি তার রুমমেট। চারজনের রুমে বাকি দুইজন সিনিয়র হলেও নীতি তার ব্যাচের এমনকি তার সাবজেক্টের। মেয়েটা অনবরত বকবক করে চলেছে।
“মালিহা! তুই খামাখা টেনশন করছিস। আমার টেনশন হচ্ছে অন্য বিষয়ে। কি বিষয় বল তো?”
মালিহার মন চাইছিল নীতিকে চুপ করতে বলতে। কিন্তু বলা হলো না। সবসময় সবকিছু বলা যায় না। বিরস মুখে তাকে বলতে হলো, “কি বিষয়ে?”
“সচরাচর এমন ক্ষেত্রে কি হয় জানিস? বাবা মা ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়। আঙ্কেল বলবে “মা মালিহা! দেখো আমার শরীরের অবস্থা! তোমাকে নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। সৎ পাত্রে তোমাকে দিয়ে যেতে পারলে সেই চিন্তাটা কমতো।” শোন বিয়ে থা যাই করিস একটা খবর অন্তত দিস। প্লিজ মালিহা না বলে বিয়ে করে নিস না।”
পেছন পেছন আসছিল এহসান। সে আতকে উঠে বলল, “এসব কি কথা?”
তার কথার জোরে নীতি ভয় পেয়ে মালিহাকে আঁকড়ে ধরলো। হিজাবে টান লেগে পিন বোরখার ভেতর দিয়ে চামড়ায় ঢুকে গেলো। ব্যথায় মুখ কুঁচকে নিলো মালিহা। সেটা খেয়াল করে নীতি বলল, “সরি সরি দোস্ত! এহসানের বাচ্চা এমন করে হালুম করলো যে ভয় পেয়ে গেলাম।”
বুকে ফু দিলো নীতি। বোরখার হাতায় মুখের ঘাম মুছলো মালিহা। এহসান বলল, “বিয়ে টিয়ের মা-মলা নাকি মালিহা?”
নীতি খ্যাক করে উঠলো। “এতো গাধা কেনো তুই? ওকে কেউ কিছু বলেছে যে ও জানবে? ও বললো না? তুই শুনিসনি?” একপাশে সরে মালিহার দিকে এসে নীতি বিড়বিড়িয়ে বলল, “ছাগলটা কেনো লেজ ধরেছে কে জানে।”
মালিহার সব কিছু বিরক্ত লাগছিল। বড় করে দম নিয়ে সে বলল, “এহসান তুমি চলে যেতে পারো। নীতি তুইও চলে যা। এতো সময় কষ্ট করার জন্য..”
“ফালতু আলাপ করবি তো ট্রেন লাইনে তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো মালিহা। তোর এই রসকষ ছাড়া ধন্যবাদ নিতে আমি আসিনি। তোকে ট্রেনের সিটে বসিয়ে দিয়ে তারপরেই আমি যাবো। এহসান তুই যা।”
“দুইজন মেয়েকে এভাবে এক রেখে যাওয়া কি ঠিক কাজ? মালিহা উঠুক তারপর তোকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যাবো।”
মালিহা দম ছাড়লো। আর বোঝানোর চেষ্টা করলো না। হাতঘড়ির দিকে তাকালো সে। দুপুর তিনটা। ট্রেনের সময় সাড়ে তিনটা। তবে ঠিক সময়ে আসলে হয়। দেরি করে স্টেশনে পৌঁছানো এদেশের ট্রেনের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। বাড়ি যেতে অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে। ক্রসিং হলে তো কথাই নেই।
নীতি আশপাশে তাকালো। এহসানকে দেখে বিরক্তিতে তার মাথার তালু গরম হয়ে যাচ্ছে। নীতির ধারণা অনুযায়ী এহসান হাফ লেডিস ধরনের ছেলে। তাই তাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে। অথচ এমন লাগার কোনো কারণ নেই। এহসান কখনও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। একটু দূরে একটা বেঞ্চে এক ভদ্রলোক বসে আছে। তার পাশে দুই জন মহিলা। আরেকজন বসলে চারজনকে ঠাসাঠাসি করে বসতে হবে। নীতি মনে মনে দোয়া করলো, “আল্লাহ ঐ ব্যাটাকে উঠিয়ে দাও আল্লাহ! আমার অসহায় বান্ধবীটাকে বসার সুযোগ করে দাও। প্লিজ!”
হঠাৎ করেই লোকটা উঠে কোনদিকে চলে গেলো। নীতি যারপরনাই আনন্দে লাফিয়ে উঠে হাততালি দিলো। এহসান অবাক হয়ে বলল, “লাফালাফি করছিস কেন?”
নীতি সেই কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। এক হাতে মালিহার ব্যাগ আরেক হাতে মালিহাকে টেনে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো। মালিহাকে বসিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলো। এহসানের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করলো। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। এহসান তাদের সাহায্য করার জন্য থাকলেও সেটার কিছুই করতে পারল না। করলো নীতি। এহসান অপমানিত বোধ করলো কি না বোঝা গেলো না। তবে মালিহার দিকে এগিয়ে যেয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “মালিহা তুমি কি চিপস টিপস কিছু খাবে? নাকি জুস আনবো?”
নীতি মুখ ভেঙ্গালো। “মালিহা তুমি কি চিপস টিপস কিছু খাবে? আহা চান্দু আমার! তুমি তুমি করছিস কেনো? আমাকে তুই বলিস ওকেও বলবি।”
এহসান সে কথা শুনেও শুনলো না। মালিহা বলল, “কিছু খাবো না। জার্নিতে আমি কিছু খেতে পারি না।”
“আচ্ছা।”
মুখ গোমড়া করে নীতির পাশে এসে দাঁড়ালো এহসান। নীতি বলল, “ঠিক হয়েছে। বেশি আহ্লাদ দেখাতে গেছিস কেনো? ও যে কি জিনিস তাতো তুমি জানো না মামা!”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না জানলেও জানছি।”

হঠাৎ নীতি দেখলো বেঞ্চে বসে থাকা সেই লোকটা আসছে। এসে কি বলবে আমা জায়গায় কেনো বসলেন? এহসানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “স্টেশনে কি জায়গা ধরার সিস্টেম আছে নাকি?”
“কি?”
“গাধা! কথা শুনিস না কেনো? কানে সমস্যা?”
“এতো কথা না বলে কি বললি সেটা বললেই তো হয়।”
এহসান বিরক্ত হলো।
“বলছি স্টেশনের বেঞ্চে কি জায়গা ধরার সিস্টেম আছে?”
“আরে না! কি সব ফালতু প্রশ্ন।”
নীতিকে এভাবে বলতে পারে এহসান যেনো শান্তি পেলো। নীতি কটমট করে তাকালো। পারলে মনে হয় মটর ভাজার মতো চিবিয়ে খেতো। আফসোস পারলো না। নীতি দেখলো লোকটা হন্তদন্ত হয়ে ফোন কানে নিয়ে আরেক দিকে ছুটে যাচ্ছে। নীতি স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ক্লাসে একদিন জায়গা ধরার কারণে তার ব্যাগ এক মেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সেই ভয়টাই এখানে কাজ করেছে।
মালিহা ফোন বের করলো। অজানা আশঙ্কা মনটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। বাবার সাথে কথা হয়েছে দিন দুই আগে। মায়ের সাথে বলতে না পারা কথাগুলো বাবার সাথে বলে মনে ভার কমায় মালিহা। কাজেই মতিয়ার আলীর জায়গা তার কাছে মা তৌহিদার থেকে অনেক বেশি স্বস্তির। সেই স্বস্তিমাখা মানুষটার হঠাৎ বিপদ মালিহাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাবেয়া ফুপুর কণ্ঠ ইঙ্গিত করছিলো তিনি অনেক কেঁদেছেন। কেনো? এতো কান্নার কি হয়েছে?

কোনো এক বিচিত্র কারণে আজ ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশন ছুঁয়েছে। নীতি যারপরনাই অবাক।
“কি রে! কাহিনী কি? কি মনে করে ট্রেন এতো তাড়াতাড়ি এলো? ডাল মে কুছ কালা হ্যা!”
“তোর সবকিছুতে সন্দেহ নীতি। মালিহাকে ট্রেনে তোল।”
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ। মালিহা পানির বোতলটা নে।”
মালিহা বোতল নিলো। তড়িঘড়ি করে ছুটতে যেয়ে হাতের পার্স পড়ে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো ভেতরের সব জিনিস। নীতি, এহসান তুলতে সাহায্য করলো। মালিহার হাত ঠান্ডা হয়ে আসছে। ট্রেন চলে যাবে না তো? সাইরেন বাজলো। নীতি ব্যাগ হাতে দিলে মালিহা ছুটতে যেয়ে পড়ে গেলো। নীতি তুলে ধরলো মালিহাকে। নরম কণ্ঠে বলল, “প্যানিক করিস না মালিহা। ট্রেন আছে। তুই হাঁট।”
নীতির কথা অনুযায়ী ট্রেন থামলো না। আস্তে আস্তে ছুটতে শুরু করলো। ছুটলো মালিহাও। তবে হাতলের নাগাল পেলো না। তার মনে হচ্ছে যেনো বাবাকে আর দেখা হবে না। মতিয়ার আলী যেনো তার থেকে অনেক দূরে হলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কেঁদে ফেলল মালিহা। ট্রেন কি একটু থামতে পারে না?
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রোদের মতো একট হাত বেরিয়ে এলো দরজার ওপাশ থেকে। হাতের মালিককে মালিহা দেখলো না। তবে হাতটাকে তার মনে হলো খড়কুটো, যে ডুবন্ত মালিহাকে বাঁচাতে এসেছে। খুব কষ্টে হাতটা ছুঁতে পারলো মালিহা। বাকি কাজটুকু হাতের মালিক করে নিলো। এক টানে তাকে তুলে নিলো ট্রেনের ভেতরে। মালিহা যেয়ে পড়লো লোকটার বাহুতে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়েছে। সেই শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে নীতি। পেছনে দাঁড়িয়ে এহসান। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকালো মালিহা। দেখলো একটি অতি পরিচিত মুখ খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে।

ধাতস্থ হয়ে সরে এলো মালিহা।
“তুমি এখানে?”
ইতমিনান বলল, “তোর সিট কোথায়?”
“ঘ ৫৪।”
“চল।”
ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে গেলো ইতমিনান। মালিহার মনে হলো এই ইতমিনানকে সে চেনে না। কয়েক বছর আগে দেখা বন্ধুসম ইতমিনানের সাথে এই মানুষটার কোনো মিল নেই। তার চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। মুখে এটে থাকা দাঁড়ি সেই গাম্ভীর্যে আরো একটু রোশনাই ছড়িয়েছে। এই মানুষটাকে দেখলে হঠাৎ করেই প্রাণখোলা হওয়া যায় না। বরঞ্চ এক অপরিচিত সম্মান এসে মনের কোণে জায়গা করে নেয়।
মালিহাকে বসিয়ে ইতমিনান বলল, “এখানেই চাকরি পেয়েছি। এক মাসও হয়নি এসেছি।”
যে মানুষটার সাথে দিনে দুইবার দেখা হতো সেই মানুষটার জীবনের খবর আজ মালিহা জানে না। জীবন বুঝি এমনই?
“কোথায় যাচ্ছো?”
ইতমিনান প্রথমেই অবাক হয়েছিল। মালিহার শান্ত মুখশ্রী থেকে নিঃসৃত প্রশ্ন তাকে বুঝতে সাহায্য করলো যে মালিহা কিছুই জানে না। জানাতেও চাইলো না ইতমিনান। দুঃখের চৌম্বকীয় জাল থেকে যতো দূরে সরে থাকা যায়।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “বাড়িতে।”
“ওহ। জানো ভাইয়া বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।”
ইতমিনান তাকালো। তার কাছে মনে হলো ক্লাস নাইনে পড়া মালিহা কথা বলছে। মালিহা বদলায়নি। সেই আগের মতোই আছে। চার বছর আগের মতো। যে সহজ ভাষায় সহজ কথা বলতে পারে। কিন্তু ইতমিনান জানে আজকের পর মালিহা আর এমন সহজ সরল থাকতে পারবে না। বাস্তবতা তাকে এমন থাকতে দেবে না। ইতমিনান বুঝলো না তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ। পরের যেটুকু মালিহা জানেনা সেটুকুও সে জানে। সেই জানাটুকু তার গলা আঁকড়ে ধরেছে। কথা বলতে দিচ্ছে না ঠিকমতো। ইতমিনান কোনমতে বলল, “ওহ।”
মালিহার মনে হলো ইতমিনানের বাহ্যিক অবয়বের সাথে তার অন্তঃকরণও পাল্টে গেছে।
“আমি পাশের বগিতে আছি। কিছু দরকার হলে বলিস।”
ইতমিনান দ্রুত পায়ে চলে গেলো। মালিহা আবার সঙ্কট সাগরে চিন্তার ঢেউয়ে আবর্তিত হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেনের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

আসনে বসতেই ইতমিনানের মনে হলো বড় বেশি গরম লাগছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলেও লাভ হলো না। কপালের ঘাম মুছলো ইতমিনান। মালিহার শান্ত মুখটা চোখে ভাসছে। যোগাযোগের সুতো ঢিল হলেও কি সে মালিহাকে কখনও ভুলেছিলো? রক্তের বাঁধন ভোলা কি এতোই সহজ? যেই বাঁধন সৃষ্টিকর্তা বেঁধে দিয়েছেন কার সাধ্য তা ছিন্ন করে? ছটফট করতে করতে ইতমিনান বেশ কয়েকবার মালিহাকে দেখে এলো। প্রত্যেকবারই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো। যেভাবে মালিহা ঘুমোচ্ছে তাতে তার ব্যাগসহ পুরো মানুষটাকে তুলে নিয়ে গেলেও সে ঠিক পাবে না। ফলে ইতমিনানের আনাগোনা আরো বাড়লো। তার পাশের আসনের লোকটা বিরক্ত হলো বারবার এমন ওঠাতে। ইতমিনান পাত্তা দিলো না। তার কেনো যেনো মনে হলো আসন্ন ঝড় থেকে মালিহাকে বাঁচানোর দায়িত্ব তার। একমাত্র সেই পারবে কাজটা করতে।

আঁকাবাকা মাঠ, হাজার রকম পরিবেশ, অনেকগুলো ক্রসিং পেরিয়ে ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ইতমিনান মালিহার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শেষ আধা ঘণ্টা সে এখানে দাঁড়িয়েই কাঁটিয়েছে। নামার সময় মালিহাকে সে ডেকে বলল, “মালিহা ওঠ। নামতে হবে।”
কাজ হলো না। হাতের ব্যাগ দিয়ে মালিহাকে ধাক্কা দিলো ইতমিনান। মালিহা হুড়মুড়িয়ে উঠলো। তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় না দিয়েই টেনে সঙ্গে নামালো ইতমিনান। তারা নামতেই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেলো। মালিহা যখন বুঝলো তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে তখন মনে হলো আকাশটা থমথম করছে। পরিবেশটা ভয়ানক কিছুর জানান দিচ্ছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২

প্রতিবার মতিয়ার আলী এবং মিতুল স্টেশনে অপেক্ষা করে। এবার কেউ নেই। মালিহার বুকটা কামড়ে উঠলো। বাবার অনুপস্থিতি এখন থেকেই চোখে কাঁটার মতো বিধছে। সামনে এগিয়ে যেতেই ইতমিনান ডেকে উঠলো, “মালিহা দাঁড়া। রিকশা ডাকি।”
ফোন বাজলে পার্স থেকে বের করে দেখলো নীতি। কানে ধরতে না ধরতেই হড়বড় করে মেয়েটা বলল, “দোস্ত পৌছাইসছিস? আমি এসেই ঘুমায় গেছিলাম। এজন্য ফোন দিতে পারিনি। তোর ব্যাগ মোবাইল সব ঠিক আছে? কিছু চুরি হয়নি তো?”
“নীতি আমি আমার ফোন দিয়েই তোর সাথে কথা বলছি।”
“ওহ হ্যাঁ! তাইতো!”
“মাত্র ট্রেন থেকে নামলাম। অনেকগুলো ক্রসিং ছিলো তাই দেরি হলো।”
“সাবধানে যা দোস্ত। মিতুল আসছে?”
“না। আমার এক কাজিন আছে।”
“আচ্ছা। আংকেলের খবর বলিস।”
“ঠিকাছে।” ফোন রেখে কাপড়ের ব্যাগের কথা মনে পড়তেই হায়হায় করে উঠলো মালিহা।
“আমার ব্যাগ ট্রেনে ফেলে এসেছি।”
“তাহলে এটা কার?” হাত উঁচু করলো ইতমিনান।
“ওহ।” মালিহা নিভে গেলো।
“এই মনোযোগ নিয়ে তুই দুই বছর ভার্সিটিতে কিভাবে পড়লি আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”
মালিহা উত্তর দিলো না।
“ভাইয়া, বাবার সাথে তোমার কথা হয়?”
ইতমিনান রিকশা খুঁজতে খুঁজতে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলো, “হতো।”
মালিহা উদগ্রীব হয়ে বলল, “এখন আর হয় না? তুমিও বাবার সাথে রাগ করে আছো?”
থমকে গেলো ইতমিনান। মালিহাকে তাড়া দিয়ে বলল, “এটায় তুই ওঠ। আমি পরেরটায় আসছি।”
“কোথায় আসছো?”
ইতমিনান সময় নিয়ে বলল, “তোদের বাড়িতে।”
“সত্যি!”
মালিহার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাদের দাদা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। তখন থেকেই বন্ধনে ঢিল পড়েছে। সম্পর্কের সুদৃশ্য জ্বাল ছিঁড়েছে সম্পত্তি নামক কীট। শুরু হলো রেষারেষির। নিশিরাতে দাদীর ভূতের গল্প শুনে জড়াজড়ি করা ভাইবোনগুলোরও কালে ভদ্রে দেখা হয় না। আগুনে ঘি ঢেলেছেন মালিহা এবং ইতমিনানের মা। তাদের ফুপু রাবেয়া নিজ উদ্যোগে সব মিটমাট করতে চাইলেও ইতমিনানের মা আয়েশা জিইয়ে রাখলেন রাগ। বাজার সদাই করতে গেলে যখন মতিয়ার আলীর সাথে বড় ভাই মকবুল আলীর দেখা হয় দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। ফলাফল স্বরূপ কমে গেলো আসা যাওয়া। সম্পর্কের রঙিন ঘরে ধুলো জমলো, মাকড়সার জাল ঘর বুনে সংসার পাততে শুরু করলো। আসল মানুষগুলো ভুলে গেলো তাদের মাঝে কি শক্তিশালী এক সম্পর্ক ছিল।

রিকশা বাড়ির যতো কাছে যাচ্ছে কোনো এক তীক্ষ্ম আওয়াজ মালিহার কানে বাড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন উদয় হলো। এতো বছর পর হুট করে আজই কেনো ইতমিনান তাদের বাড়িতে যাচ্ছে? মনের ইতিবাচক সত্ত্বা বলল নিশ্চয়ই অসুস্থ চাচাকে দেখতে যাচ্ছে। মালিহা মানতে চাইলো। তবে সেই সময়টুকু পেলো না। রিকশা বাড়ির সামনে আসতেই ভেতর বাড়ি থেকে নাজিয়া বেগমের চিৎকার শোনা গেলো। মালিহা দিক ভুলে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলো। পেছনের রিকশা থেকে ধীরে সুস্থে নেমে ভাড়া মেটালো ইতমিনান। রিকশা দুটো চলে গেলেও সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে জাপটে ধরলো তাকে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দেহটা আঁকড়ে ধরলো ইতমিনান। বৃদ্ধ বাবাকে বুকে নিয়ে মনে হলো এর চেয়ে বেশি ভারী দুনিয়ায় আর কিছু হতে পারে না। মকবুল আলীর কি এতই কষ্ট? কষ্ট মাপার কোনো যন্ত্র কেনো নেই? যেই অনুভূতি থেকে সৃষ্ট রোগ নির্ণয়ের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্র সেই অনুভূতিকেই কেনো এতো হেলাফেলা?

মালিহার মনে হচ্ছে তার কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পারলে তার এমন লাগে। তখন খুব করে বাবাকে মন পড়ে। মনটা চায় বাবার বুকে যেয়ে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু মালিহা মতিয়ার আলীর বুক খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা সামনে পেছনে প্যাঁচানো সাদা গজ কাপড়ে। আবক্ষ কাফনে ঢাকা দেহটা মতিয়ার আলীর, এই খবরটা তার মস্তিষ্ক যখনই তার মনে পাঠাচ্ছে তখনই এক যু-দ্ধ বেঁধে যাচ্ছে। মন মননের দ্বিমুখী যু-দ্ধ মালিহা সইতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো ছাউনি দেয়া উঠোনে। আশপাশের মানুষ হাহাকার করে উঠলো।
“আহাগো! মাইয়াডা শোক সামলাইতে না পাইরা জ্ঞান হারাইসে। ধরো ওরে ধরো কেউ।”

নাজিয়া বেগম বুক চাপড়ে কাঁদছেন। বৃদ্ধা রাশেদা বেগম পুত্র হারানোর শোক ভুলে পুত্র বধূর কাছে এগিয়ে গেলেন। তার শক্ত কণ্ঠ এবং স্পষ্ট উচ্চারণ যে কাউকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
“কান্না থামাও বউমা। আশপাশে পুরুষ মানুষ আছে। নিজের দিকে খেয়াল করো। মেয়ে এসেছে। ওকে দেখো।”
রাশেদা বেগমের ভগ্ন কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালেন নাজিয়া। বিগত দিনের সকল মন কষাকষি ভুলে হুমড়ি খেয়ে বৃদ্ধা শাশুড়ির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আহাজারি করে বললেন, “আমার কি হবে মা? আমার ছেলেমেয়ের কি হবে? আমার সব শেষ হয়ে গেলো।”
রাশেদা বেগম সন্তর্পনে নাজিয়ার শাড়ির আঁচল তুলে দিলেন। আশপাশের মহিলাদের নির্দেশ দিলেন তাকে ঘিরে ধরতে। পাশেই মালিহা শুয়ে আছে। একজন তাকে ধরে নাজিয়ার বুকে দিলেন। নাজিয়ার কান্না থামলো না। কান্নার গতি বেড়ে গেলো।
“ও মালিহা রে! তুই তো এতিম হয়ে গেলি রে! আল্লাহ তুমি কি করলা?”
“আহা মালিহার মা! এসব কোন ধরনের কথা? হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। মরণ আজ হোক কাল হোক আসবে। তাই বলে তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলে নিজের ঈমান আমল নষ্ট করবা কেনো?”
আশপাশের অনেকে রাশেদা বেগমকে চেনে না। তারা কিছুটা অবাক হলো। ছেলে হারিয়ে এমনভাবে শক্ত থাকতে কাউকে বোধহয় তারা দেখেনি। কণ্ঠের কি তেজ! সম্মান যেনো আপনাতেই চলে আসে।

মালিহার জ্ঞান ফিরলে কিছুক্ষণের জন্য তার স্মৃতি ভ্রম হলো। আশপাশ বুঝতে সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারল ততক্ষণে সে এতিম। নাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে মা বলে ডাকতেই তিনি আবার হাউমাউ করা কান্না শুরু করলেন। কিন্তু মালিহার মুখ তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেলো। যখন সে বুঝল তার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটা ইহলোক ত্যাগ করেছে, তার সাথে শেষ সাক্ষাৎটুকু মালিহা করতে পারেনি তখন অশ্রু তার গাল ভেজালেও কন্ঠরোধ হয়ে গেলো। চোখের পাতায় ফেলে আসা একুশ বছরের স্মৃতি নিজ উদ্যোগে তাদের মেলে ধরলো। হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ সবটাই জীবন্ত। শুধু মানুষটাই প্রাণহীন।

ইতমিনান মিতুলকে খুঁজলো। ছেলেটা আশপাশে কোথাও নেই। আয়েশা ছেলের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কাকে খুঁজছিস আব্বা?”
“মিতুল কই?”
“জানিনা। আমিও অনেকক্ষণ দেখিনি।”
ইতমিনান মাকে লক্ষ্য করলো। কথাটা বলা উচিত হবে কি না ভাবতে ভাবতেই মকবুল আলী এলেন। ইতমিনান কথাটা গিলে নিলো। বলা হলো না।
“ইতমিনান লা-শ সকাল পর্যন্ত রাখা কি ঠিক হবে?”
ইতমিনান বিড়বিড় করলো। “লা-শ! লা-শ!” এক মুহূর্তের মাঝেই একটা প্রাণবন্ত দেহ কেমন করে লা-শে পরিণত হয়। রুহের কি মাহাত্ম্য!
“মালিহার নানা বাড়ি থেকে সবাই এসেছে?”
“ওর মামার সাথে দেখা হয়েছে। আর কেউ তো আসার নেই।”
“মিতুল কোথায়?”
“তোর দাদির ঘরে। তখন থেকে কান্নাকাটি করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”
“রাস্তা পার হতে যেয়ে প্রাইভেট ধাক্কা দিয়েছে। উল্টে পড়ে একদম মাথায় আঘাত লেগেছে। দুইদিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। তখন যদি একটু কথা বলতাম..”
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মকবুল আলী। জমিয়ে রাখা অভিমানটুকু এখন কেবল তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
ইতমিনান বলল, “আমি মিতুলের সাথে দেখা করে আসি। তুমি কবর খুঁড়তে বলো।”

রাশেদা বেগমের ঘর অন্ধকার। দেয়ালের সাথে খুলতে থাকা তাসবীহর দানাগুলো চকচক করছে। ইতমিনানের কাছে এই জিনিসটা রহস্যময় লাগে। জ্বলজ্বল করে অন্ধকারের গভীরতা বুঝিয়ে যেনো গা ছমছম করে দেয়া এর কাজ।
“মিতুল!”
ডাকার সাথেই লাইট জ্বালিয়ে দিলো ইতমিনান। মতিয়ার আলীর বাড়িতে এলে রাশেদা বেগম এই ঘরেই থাকেন। সেই হিসেবে ঘরের আনাচে কানাচে ইতমিনানের চেনা। তাদের যাওয়া আসা কমে গেলেও রাশেদা বেগম নিয়ম করে ছেলেদের বাড়িতে থাকেন।
মিতুল মাথা ওঠালো না। হাঁটুতে ভর দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখে ঢেকে রেখেছে সে। পিঠ ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছে।
“মিতুল?”
মিতুল নিজের ঘাড়ে রাখা ইতমিনানের হাত ঝাড়া দিলো। লাল চোখ দুটো তার দিকে তাক করে গলায় আক্রোশ নিয়ে বলল, “কিসের জন্য এসেছো?”
ইতমিনান চুপ করে ক্রোধটুকু গলাধঃকরণ করলো। তার দোষ অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্পত্তির জের ধরে মালিহা, মিতুলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো কারণই তার ছিলো না। বংশের বড় সন্তান হিসেবে তার উচিত ছিল বাবা মাকে বোঝানো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া। সেটা না করে সে উল্টো তাদের কথায় সায় দিয়েছে। কাজেই শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু সে কি শাস্তি পাচ্ছে না? পিতৃতুল্য চাচার মরদেহ কি শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট নয়?
“আমার বাবার লাশ দেখতে এসেছো? যাও দেখো। বাইরে আছে। আমাকে বিরক্ত করো না।”
ইতমিনান নির্নিমেষে মিরুলকে দেখলো। ছোট্ট ছেলেটা দেখতে দেখতে এইটে উঠে গেছে। রাগ দেখাতে শিখে গেছে।
“মালিহা এসেছে।”
নরম কণ্ঠটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে যতোটা সময় লাগে ততটুকু সময়ই মিতুল স্থির ছিলো। তারপর ছুটে চলে গেলো বাইরে। মিতুলের জায়গায় মাথা নিচু করে বসলো ইতমিনান। নিজের কাছে নিজে অপরাধী হলে বিচারক হবে কে?

মিতুল বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তবে মালিহার নড়চড় নেই। যেনো একটা প্রাণহীন জড়ো পদার্থ। একে একে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। আফসোসের সুর শোনালো, স্বান্তনা দিলো। মালিহা টু শব্দ করলো না। কিন্তু যখনই খাটিয়া কাঁধে ইতমিনান তার সামনে এসে বলল, “মালিহা, চাচাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
মালিহা কেঁদে ফেললো। বুকভাঙ্গা কান্নার শব্দ গিলতে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে রাখলো। মালিহার মনে হলো কেউ তার কলিজাটা দুই ভাগ করে নিয়ে যাচ্ছে।

চলমান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে