উধয়রনী পর্ব-৮+৯+১০

0
406

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৮||

১২।
কলিংবেলের শব্দ শুনে শশব্যস্ততা নিয়ে ছুটে এলেন মুনিয়া খালা। দরজা খুলতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো চার বছর আগের সেই প্রিয় মুখখানা। মুনিয়া খালা অতি আনন্দে খাবি খাওয়ার উপক্রম। আহি ব্যাগপত্র টেনে ঢুকাতে গেলে তিনি চেঁচিয়ে চুনিকে ডাকলেন।

“চুনি, ও চুনি। তাড়াতাড়ি আয়। দেখ, দেখ কে আইছে। আমাদের ছোড আফামণি আইছে।”

মুনিয়া খালা চুনিকে ডাকতে ডাকতেই নিজে এগিয়ে এসে আহির ব্যাগপত্র তার হাত থেকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকাতে লাগলেন। আহি মুনিয়া খালার উৎকন্ঠা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। জগৎ সংসারে রাদ ব্যতীত তার জন্য উৎকন্ঠিত হওয়া মানুষ আরো একজন আছে দেখে তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মুনিয়া খালা ব্যাগপত্র ঢুকাতে ঢুকাতেই দ্বিতীয় তলা থেকে নুপুরের রুনঝুন শব্দ ভেসে এলো। আহি ঘাড় কাত করে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির দিকে তাকাতেই মুনিয়া খালা এক গাল হেসে বললেন,
“চুনি আইতাছে আফা। মাইয়াডা বড্ড বেয়াদব। কোনহান থেইকা ঝুনঝুনি ঝুলানো কি যে ফইরা থাহে। সারাদিন ঘরে ঝুনঝুনি বাজে।”

আহি মুনিয়া খালার কথায় বিস্তর হাসলো। একটু পরই চুনি নেমে এলো। চুনিকে দেখে আহি মুগ্ধ হলো। মেয়েটাকে শেষবার যখন দেখেছিল, তখন তার বয়স চৌদ্দ ছুঁইছুঁই। আর এখন সদ্য তারুণ্যের স্পর্শ তার সর্বাঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে। কোমল মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে গেছে। ঠোঁটে হাসির রেশ বেশ স্পষ্ট। কাপড়চোপড়েও সে যথেষ্ট যত্নবান মনে হচ্ছে। বেশ রুচিশীল পোশাক পরেছে চুনি।

আহি চুনিকে দেখে বলল, “কেমন আছো, চুনি?”

চুনি আহির কথা শুনে মুখটা কালো করে মায়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকালো। মুনিয়া খালা চোখ গরম করতেই চুনি মাথা নামিয়ে নিলো। আহি মুনিয়া খালার দিকে তাকাতেই তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
“ছোড আফা, কিছু মনে কইরো না। এই মাইয়া মেলা প্যাঁচাল করে। কি বলে চুনি ডাকলে তার কি জানি পাঞ্চার হইয়া যায়। কি কই এডারে?”

মুনিয়া খালা চুনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওই তুই ইংরাজিতে কি জানি কস?”

চুনি ক্ষীণ কন্ঠে বলল, “প্রেস্টিস।”

আহি চুনির কথায় মুখ চেপে হাসলো। মুনিয়া খালা বললেন,
“হ আফা, ওইডাই নাকি পাঞ্চার হইয়া যায়।”

চুনি লজ্জায় মাথাটা একেবারে নুইয়ে ফেলছিলো। আহি চুনির থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“তা প্রেস্টিজিয়াস তরুণীর কি নাম?”

চুনি ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে চোখ নামিয়ে বলল,
“আফা, আমার নাম চাঁদনি।”

“বাহ, কি সুন্দর নাম! একদম তোমার চেহারার মতো সুন্দর।”

চুনি বিষ্ময়ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আফা, আমি সুন্দর?”

“হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর।”

“আপনেও অনেক সুন্দর। এহন তো আগের থেইক্কা বেশি সুন্দর হইয়া গেছেন।”

আহি হাসলো। চুনি ব্যাগপত্র নিয়ে বলল,
“আফা, ব্যাগগুলা আমি আপনের রুমে রাইখা আসি।”

আহি মাথা নাড়লো। মুনিয়া খালা আহির হাত ছুঁয়ে দিয়ে বললেন,
“ছোড আফা, তুমি এহন আইছো ঘর আলো হইয়া গেছে। এতোদিন আঁধার ছিল।”

আহি মৃদু হেসে বলল,
“মোজাম্মেল চাচা কোথায়? উনাকে দেখলাম না!”

“কইয়ো না আফা, ম্যাডামরে নিয়া বাইরে গেছে। আর ম্যাডাম যে কি দৌঁড়ান দৌঁড়ায়। ঘরে বইয়াই থাহে না। কাল যে গেলো, এহনো আইলো না। রাত-বিরেতে বাইরে যায় গা। স্যার তো আন্ধা। তার দুনিয়ায় আছে খালি টাহা আর টাহা।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ আহির ফোন বেজে উঠতেই সে চকিত দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকালো। এরপর সে মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“খালা, তুমি আজকে একটু ভালো কিছু রান্না করো। আমার এক ফ্রেন্ড আমার সাথে এসেছে। ও এখন একটা কাজে গেছে। রাতে আসবে।”

“ঠিক আছে আফা। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি এহন ম্যাডামের থেইক্কাও ভালো রাঁধি।”

(***)

আহির ফোনে আবার কল এলো। আহি গম্ভীরমুখে কলটা ধরলো। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এলো।

“অদ্ভুত তো আহি! এতো বার কল দিচ্ছি, ধরছোই না।”

“মাত্র একবার দিয়েছেন। দ্বিতীয় বারেই ধরেছি।”

“ও, তাহলে তুমি আমার ফোনের হিসেব রাখছো?”

“এসব কথা বলার জন্য তো অবশ্যই আপনি কল দেন না। নিশ্চয় কোনো গুরুতর ব্যাপার আছে। যা বলার জন্য কল দিয়েছেন, তাই বলুন।”

নারী কণ্ঠটি তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো। আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি আমার সাথে যতোই বাজে ব্যবহার করবে, আমাকে তোমার সামনে ততোটাই ভয়ংকর রূপে দেখতে পাবে।”

আহি পাল্টা হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আপনার যেই ভয়ংকর রূপ দেখেছি, তাতে আমার ধারণা হয়ে গেছে, আপনি কেমন। আরো কোনো রূপ দেখানো বাকি থাকলে দেখিয়ে দিন। আমি সহ্য করতে পারবো। আপনাকে সহ্য করতে আমি বাধ্য। বাধ্য না হলে আপনার স্থান আপনাকে দেখিয়ে দিতাম।”

“খুব শীঘ্রই তুমি তোমার স্থান দেখবে। ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড, ডিয়ার ওয়াসিকা।”

(***)

চার বছর পর সেই চেনা-পরিচিত রুমে পা রাখলো আহি। ঘরটি ঠিক আগের মতোই আছে। দেয়ালে সেই রঙ, বিছানাটিও সেদিকেই বিছানো। পরিপাটি ঘরটির দেয়ালে বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটির দিকে চোখ পড়লো আহির। ছবিটির সামনে এসে দাঁড়াতেই চুনি বলল,
“আফা, তুমি যে ছবি আঁকছিলা, ওই ছবিগুলো ম্যাডাম ফেলাইয়া দিতে চাইছিলো। আম্মা ফেলাইতে দেয় নাই। তুমি যাওনের ফর, আম্মা ছবিগুলা দারোয়ান চাচারে দিয়া দিসে। চাচা ছবিগুলা গ্যারাজের পেছনে ছোড একখান ঘর আছে না,? ওইহানে রাখছে। তুমি কইলে, আমি এহনি সব নিয়া আসবো।”

আহি মৃদু হাসলো। চুনির দিকে তাকিয়ে বলল,
“থাকুক যেখানে আছে। ওসবে আমার আর কোনো অধিকার নেই।”

“কি কও আফা? তুমিই না ছবিগুলা আঁকছিলা?”

“চাঁদনি, তুমি এখন যাও। আমি ফ্রেশ হবো।”

চুনি দরজার কাছে এসে পেছন ফিরে বলল,
“আফা তুমি ইংরেজি দেশে ছিলা না?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “হুম।”

“আমারে ইংরেজি শিখাইবা? আমি এক আধখান বলতে পারি। হুনবা?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“পরে শুনবো। সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনবো। তুমি এখন যাও।”

চুনি চলে যেতেই আহি দরজা আঁটকে দিলো। পেছন ফিরতেই আবার সেই ছবির দিকে চোখ পড়লো। বড় ফ্রেমে হাস্যোজ্জ্বল পদ্ম, লিনাশা, পুষ্প আর আহি। ছবিটির দিকে তাকাতেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। মনে পড়ে গেলো সেই দিনগুলোর কথা যেদিন তারা একসাথে ছিল। প্রতিদিন লিনাশার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, এক বেঞ্চে গাদাগাদি করে চারজনের বসা, ক্লাসে টিচারের উপস্থিতিতে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে খাতায় লিখে গানের কলি খেলা, চারজনের সেই বৃষ্টি বিলাস, একজন বই না আনলে বাকিরা একসাথে শাস্তি ভাগ করে নেওয়া আর টিফিন ছুটিতে চারজনের ভাগাভাগি করে পদ্মের হাতে বানানো পিঠা খাওয়া। খুব চমৎকার সম্পর্ক ছিল তাদের। কিন্তু সব হুট করেই শেষ হয়ে গেলো।

আহি ছবিটা দেয়াল থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিলো। ফেলা আসা মানুষগুলোকে সে আর তার জীবনে চায় না। তারা যেখানেই আছে, ভালোই আছে। শুধু ভালো নেই আহি।

(***)

ঘরের জানালাটা খুলে দিলো আহি। বিছানায় শুয়ে আগের মতোই চুলগুলো জানালা দিয়ে বের করে দিলো। ফ্যান ঘুরছে দ্রুত গতিতে। আহির দৃষ্টি সেদিকেই। পলকহীনভাবে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের কোণে জল ভারী হলো। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে গিয়েও মুছলো না। থাক, কাঁদুক। তার কান্না করা উচিত। এই ঘরেই তো সে কান্নাকাটি করে স্বস্তি পায়। শেষবার এই ঘরের মেঝেতে বসে পাগলের মতো কেঁদেছিল সে। সবাই ভেবেছিল, সেটাই আহির প্রথম ও শেষ কান্না। কিন্তু সবাই ভুল ছিল। আহি এখনো কাঁদে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই সেই অশ্রু এখন আর কেউ দেখে না। আহি তার ভেজা চোখ দু’টি বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে ভেসে এলো কান্না ভেজা সেই প্রিয় মুখটি।

………………………..

মেঘলা আকাশ। মেঘেদের ঘর্ষণে গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ হচ্ছে। আহি আকাশের দিকে তাকিয়ে চারুশিল্পের গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যদি গেট দিয়ে বের হতেই খুব জোরে বজ্রপাত হয় আর সেই বিদ্যুতের ঝলকানি তাকে ছাই করে দিয়ে যায়? সে শুনেছে বজ্রপাতের ফলে যেই পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়, তা দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎ শক্তির তুলনায় অনেক বেশি। বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করা বৈদ্যুতিক খুঁটি ঠিক করতে গিয়ে কতো লোকের প্রাণ গেছে তার ইয়াত্তা নেই। আর বজ্রপাত তো তাকে ধরাশায়ী করে, একেবারে ছাই করে দেবে। সেই ভয়ে আহি গেট ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো মাঠের একপাশে বেঞ্চে বসে থাকা আফিফের দিকে। আফিফকে দেখে সে একটু অবাক হলো। সে ভেবেছিল, আফিফ চলে গেছে। কিন্তু সে তো মাঠের একপাশে বসে আছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“আজ বৃহস্পতিবার। আজ তো ওর বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু এভাবে এখানে বসে আছে কেন? বাসায় কি মায়ের বকা খেয়েছে নাকি?”

আহি গেট ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মাঠের কাছাকাছি গেলো। খোলা মাঠে বজ্রপাত হলে আহি মুহূর্তেই অক্কা পাবে, তবুও তার ভীতি আফিফকে দেখেই কেটে গেলো। আফিফ উদাস মুখে বেঞ্চে একা একা বসে আছে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে। এভাবে মানুষ কখন বসে থাকে? যখন তার মন ভীষণ খারাপ হয়। আহি আফিফের কাছে যেতেই থমকে গেলো। দেখলো আফিফ তার শার্টের হাতা দিয়ে তার চোখ আড়াল করে রেখেছে। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর আফিফ হাত সরালো। পকেট থেকে মলিন রঙের একটা রুমাল বের করে চোখ-নাক মুছলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। ধীর পায়ে বেঞ্চ থেকে উঠে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। আহি স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আর আফিফ তাকে অতিক্রম করে চলে গেলো। সেদিন বাসায় ফিরে প্রতিদিনের মতো আবার সেই ডায়েরী বের করে আহি লিখলো,

“কেন কেঁদেছো তুমি? কি এমন কষ্ট তোমার? আমাকে দিয়ে দাও তোমার কষ্ট। আমি আমার সুখগুলো তোমার সাথে ভাগ করে নেবো।”

এই লেখাটির পাশেই একটি স্কেচ করলো আহি।

খোলা মাঠে একটি বেঞ্চ। বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি ছেলে।

………………………..

আহি বিছানা ছেড়ে উঠে সেই ডায়েরীটা বের করলো। তারপর পৃষ্ঠা উলটে সেই স্কেচটি খুঁজে বের করলো। লেখাটিতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“স্বার্থপর মানুষ, কষ্ট দিয়ে গেছো, আবার সুখটাও কেঁড়ে নিয়েছো।”

১৩।

ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই রাদের মুখোমুখি বসা মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলো আহি। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “বাবা!”

রিজওয়ান কবির আহিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“বসো, বসো। তোমার বন্ধু এসেছে। কথা বলো ওর সাথে।”

আহি রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি আহিকে পাশ কেটে উপরে চলে গেলেন। আহি এক ধ্যানে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ আহির হাত ধরে তাকে পাশে বসালো। আহি শুকনো হেসে বলল,
“লাবীবকে নিয়ে আসিস নি কেন?”

রাদ হেসে বলল,
“ভুলে গেছিস আংকেলকে কি মিথ্যে কথা বলেছিস? লাবীব কি এখানে নাকি? লাবীব তো ঢাকায়। বেচারা দাদা একবার মারা গিয়েছেন, তুই উনাকে দ্বিতীয় বার মারলি।”

“যাহ, রাদ। এসব কথা রাখ। চল খাবি।”

“তোর বাবা তার গুরুগম্ভীর কথায় আমার পেট ভরিয়ে দিয়েছে। আমি এখন যাই।”

“কি বলছিস? খালাকে বলেছি তোর জন্য রান্না করতে।”

“আহি, আমরা কাল দেখা করবো। তখন না হয় একসাথে খাওয়া-দাওয়া হবে। আংকেলকে বলিস আমার কাজ আছে।”

“বাবা তোকে কি বলেছে, বল?”

“এমন কিছু না। প্লিজ আমি যাই।”

রাদ আহির কাছ থেকে জোরপূর্বক বিদায় নিয়ে চলে গেলো। কিছু একটা যে হয়েছে তা আহি বুঝতে পারলো।

(***)

রাতে খাবারের টেবিলে একসাথে বসে আছে রিজওয়ান কবির আর আহি। মুনিয়া খালা নিঃশব্দে তাদের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। চুনি রান্নাঘরের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখছে। রিজওয়ান কবির আর আহি উঠলেই তারা খাওয়া-দাওয়া করবে। এটাই এই বাড়ির নিয়ম।

রিজওয়ান কবির হাতের ইশারায় মুনিয়া খালাকে সরে যেতে বললেন। মুনিয়া খালা এক নজর আহির দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। খালা চলে যেতেই রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“আশা করি সেই ছেলের সাথে তোমার কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয় নি।”

রিজওয়ান কবিরের কথা শুনে আহির গলায় খাবার আটকে গেলে। রাগী দৃষ্টিতে সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসব কি বলছেন আপনি?”

“তোমার বন্ধু রাদের কথা বলছি। একসাথেই তো ছিলে।”

আহি খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,
“আমরা শুধু বন্ধু। এমন নোংরা সম্পর্ক আমার কারো সাথেই নেই। আর নিজের মেয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? চার বছরে একবারো আপনি আমার খবর নিয়েছেন? আজ এতো বছর পর দেখা হয়েছে, আর আপনার ব্যবহার দেখে আমি হতাশ।”

আহির চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগলো। মুনিয়া খালা রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে রেখেছেন। চুনি চাপা স্বরে মাকে বলল,
“এই ফেরাউন কহন মরবো, আম্মা?”

মুনিয়া খালা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই চুনি চুপ হয়ে গেলো। এদিকে আহি নীরবে অশ্রু ফেলছে। আর রিজওয়ান কবির নীরবে খেয়ে যাচ্ছেন। খাওয়া শেষ হতেই তিনি আহির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমার বাবা। আমার এমন প্রশ্নে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকাল ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এসব সাধারণ ব্যাপার। তুমি সত্যটা স্বীকার করলেও আমি তোমাকে শাস্তি দিতাম না। যাই হোক, তুমি এসেছো আমি তাজওয়ারকে বলেছি। ভালো হবে তুমি সেই ছেলের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে তাজওয়ারের সাথে সময় কাটাও।”

আহি ধরা কন্ঠে বললো,
“আমি আর রাদ বন্ধু। আপনি ভালো করেই জানেন ও আমার স্কুল ফ্রেন্ড। আমরা একসাথে পড়েছি। এর আগেও ও অনেকবার এই বাসায় এসেছে। রাদ আপনার দৃষ্টিতে নতুন কেউ নয়। আরেকটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তাজওয়ারের সাথে সময় কাটাতে চাই না। ছেলেটা ভালো না, আর আপনি সেটা ভালো করেই জানেন। আপনি আমাকে বাধ্য করলে আমি….”

রিজওয়ান কবির আহিকে থামিয়ে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,
“তোমার মায়ের কবর খোঁড়ার কাজে দু’একজনকে লাগিয়ে দেই। কালকের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।”

আহি ভীত চোখে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। এরপর অনুরোধের সুরে বলল,
“মায়ের ক্ষতি করবেন না, প্লিজ।”

“তাহলে তুমি তাজওয়ারের সাথে সময় কাটানো শুরু করো।”

রিজওয়ান কবির আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“মনে রেখো, আমি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছি এই প্রজেক্টে। আমার লাস্ট ইনভেস্টমেন্ট তুমি। তুমি যদি কাজেই না লাগো, তাহলে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি কেন?”

আহি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
“মেরেই ফেলুন না হয়। আমি ভীষণ খুশি হবো।”

“প্রফিট হাতছাড়া করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৯||

১৪।
ভোর হতেই ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো আহি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ নিস্তব্ধতা ভেঙে দেওয়ার খেলায় মত্ত। আর আহি ধীর পায়ে তার ভারী লাগেজ ব্যাগটি টেনে না নিয়ে হাতে নিয়েই নামছে, যাতে শব্দ শুনে রিজওয়ান কবির নিজের রুম থেকে বের না হোন। আহিকে দেখে মুনিয়া খালা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। তিনি ফজরের নামাজের পর আর ঘুমান না। আহি নিচে নেমে ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললো। মুনিয়া খালা চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“কই যাও, ছোড আফা?”

আহি ব্যাগটা নামিয়ে মুনিয়া খালার হাত ধরে বলল,
“মায়ের কাছে যাচ্ছি। বাবাকে বলো না। জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি যাওয়ার সময় বলেছি বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“তুমি তো স্যাররে কইয়া যাইতে পারো। মিছা কথা কইলে কি স্যার বুঝবো? স্যার তো তোমারে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে কিছু কইবো না।”

“খালা, কাল রাতেই বাবা আমাকে রাদের সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছে। রাদ আর লাবীব ছাড়া তো আমার আর কোনো বন্ধু নেই। তাহলে বাবাকে এই কথা কীভাবে বলবো?”

“স্যার যদি জানতে ফারে তুমি ম্যাডামের সাথে দেখা করতে যাইতাছো, মাইরা ফেলবো তোমারে।”

আহি করুণ দৃষ্টিতে মুনিয়া খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সপ্তাহে অন্তত একদিন মায়ের সাথে দেখা করার অনুমতি আছে। এই যুক্তিতে বাবা অবশ্যই হেরে যাবে। কিন্তু এখন বলে গেলে, কিছু একটা করে আমাকে আটকে রাখবে।”

আহি ব্যাগ নিয়ে বাড়ির মেইন গেট খুলতেই লাবণি মেহেরা তার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাবণিকে দেখে আহি চমকে উঠলো। লাবণি আহির হাতে ব্যাগ দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি কাল এসেছো, আর আজই পালিয়ে যাচ্ছো?”

আহি গম্ভীরমুখে বলল, “আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।”

“আচ্ছা! তাহলে ব্যাগপত্র নিয়ে চোরের মতো সকাল হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়ছো কেন? তোমার বাবা কি জানেন তুমি কোথাও যাচ্ছো?”

আহি দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি কারো কাছে অনুমতি নিতে বাধ্য নই।”

লাবণি বাসায় ঢুকেই মুনিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“যাও, তোমার স্যারকে ডাকো। বলো, ম্যাডাম চলে এসেছে।”

আহি লাবণির কথা উপেক্ষা করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাবে তখনই লাবণি তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। আহি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই লাবণি আরো জোরে তার হাত চেপে ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো।

(***)

দশ মিনিট পর রিজওয়ান কবির ঘুম ঘুম চোখে নিচে নেমে এলেন। মুনিয়া খালাও নিচে নেমে পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন। লাবণিকে দেখে রিজওয়ান কবির বললেন,
“তুমি চলে এসেছো তাহলে?”

লাবণি আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্যিস আমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছি। তা না হলে তোমার মেয়ে তো পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।”

রিজওয়ান কবির আহির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই আহি ক্ষেপে উঠলো। চেঁচিয়ে বলল,
“আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আইনগত ভাবে সপ্তাহে একদিন আমি মায়ের সাথে দেখা করতে পারবো।”

লাবণি চমকে উঠে বললেন,
“মা! তোমার মা তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তুমি ভুলে যেও না এখন একমাত্র আমিই তোমার মা। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

আহি কিছু বলতে যাবে তখনই রিজওয়ান কবির তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাকে এর আগে সেই কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করতে হবে। তোমাকে মেনে নিতে হবে তুমি তাজওয়ারের জন্য সৃষ্টি হয়েছো। তাজওয়ার তোমার ভবিষ্যৎ। ও তোমাকে যা-ই বলবে তুমি মানতে বাধ্য।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরের হাত ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
“দেটস লাইক মাই হাসবেন্ড।”

কথাটি বলেই তিনি আহির দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন। আহি তার হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
“আমি কোনো শয়তানের সামনে মাথা নত করবো না।”

রিজওয়ান কবির আহির কাছে এসে হুট করে তার গালে সশব্দে চড় বসিয়ে দিলেন। আহি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মুনিয়া খালা পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আহিকে আগলে ধরে বললেন,
“স্যার, ছোড আফা ভুলভাল বইলা ফেলছে। আপনে আফারে মাইরেন না। মেলা বছর পর দেশে ফিরছে তো তাই মারে দেখতে মন চাইতাছে।”

লাবণি মুনিয়া খালার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“বেশি বকবক করলে তোমার মেয়ের কপাল ভাঙবে। খুব সুন্দর তোমার মেয়ে! মাসে ভালোই ইনকাম করতে পারবে।”

আহি লাবণিকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“সবাইকে নিজের মতো মনে করবেন না, মিসেস লাবণি।”

রিজওয়ান কবির আহির কথায় আবার তার গায়ে হাত তুলতে যাবেন তখনই লাবণি তাকে আটকে দিয়ে বলল,
“তুমি ওর মুখ বন্ধ করতে পারবে না। ওকে ওর মতো বলতে দাও। সময় আসুক। আমি নিজেই ওকে দেখিয়ে দেবো, আমি কে?”

(***)

ধপ করে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো আহি। সে জানতো এমন কিছু হবে, তাই হয়তো বাবা তাকে দেশে আসতে বলেছিলেন। নয়তো আহি কখনোই দেশে ফিরতো না। কতো বার সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু লন্ডনেও তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বাবা লোক রেখেছিলেন। আর আহি পালিয়ে গেলেই সালমা ফাওজিয়াকে বন্দী করবেন রিজওয়ান কবির। চার বছর আগে রিজওয়ান কবির আহিকে নিজের কাছে রাখার জন্য যা করেছিলেন, তারপর আর আহির কোনো কিছুতেই সাহস হয় না। আহি যদিও জানে না তার মা সালমা ফাওজিয়া তাকে আদৌ ভালোবাসেন নাকি ঘৃণা করেন। কারণ আহির জন্যই তো তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল।

আহি মাথা তুলে নিজের গালে নিজেই কয়েকটা চড় মারলো। চড় মার‍তে মারতেই সে কাঁদতে লাগলো। আর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
“তুই একটা লুজার, আহি। তোর মতো ইঁদুর কপাল নিয়ে কেউ জন্ম নেয় নি।”

আহি চোখ মুছতেই তার দৃষ্টি আটকালো সামনে থাকা কাঠের স্ট্যান্ডের দিকে। আহি বিছানা ছেড়ে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো। কাঠের স্ট্যান্ডটি এখনো আছে, কিন্তু এই স্ট্যান্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটি আর নেই। এক ফুট উঁচু গোল কাঠের স্ট্যান্ডের উপর মাথা রাখলো আহি। বুকে হাত রেখে তার ভেজা চোখ জোড়া বন্ধ করলো সে। হারিয়ে গেলো অতীতের সেই সুখের দিনগুলোতে।

………………………..

আহিকে ঘিরে বসে আছে পুষ্প, পদ্ম আর লিনাশা। তারা গভীর দৃষ্টিতে আহিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোরা আমাকে এভাবে দেখছিস কেন?”

পদ্ম বলল, “এআর কে?”

আহি চোখ বড় বড় করে পদ্মের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“আজকের বিশেষ শিরোনাম, পলি আপু গ্রুপের বিশেষ সদস্য ওয়াসিকা কবির ভয়ংকরভাবে প্রেম রোগে ভুগছেন। জরুরী অবস্থায় তাকে আইসিউতে রাখা হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে তিনি লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে পারেন।”

পদ্ম পুষ্পের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“অশুভ কথাবার্তা বলিস না। এআর কি কোনো ভাইরাসের নাম না-কি আহিকে লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে হবে?”

লিনাশা পদ্ম আর পুষ্পকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল,
“সবাই চুপ। আহির কাছে লুকিয়ে আছে এআর ক্যারেটের গোল্ড। এখনই বের করে দে আহি। নয়তো সত্য গোপন করার অপরাধে মামলা টুকে দেবো।”

আহি হাত উঁচিয়ে বলল,
“তোরা চুপ কর। আমি বলছি, শোন।”

আফিফের সাথে তার প্রথম দেখা হওয়া, কীভাবে আফিফের প্রেমে পড়েছে সব তার বান্ধবীদের জানালো আহি। তবে আফিফের জন্য সে কি কি পাগলামো করেছিল, সেসব গোপন রাখলো। ডায়েরীর কথাটাও জানালো না। যদিও আহির এখন আফিফের কথা কাউকে জানানোর পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু খাতায় একটা ছেলের স্কেচের নিচে ভালোবাসি এআর দেখে পুষ্প আহির গোপন প্রেমের রহস্য সবার সামনে উন্মোচন করাই আহিকে বাধ্য হয়ে সব স্বীকার করতে হলো। যদিও আহি লিনাশাকে আফিফের কথা জানাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কারণ তার সাথেই আহি বেশি ঘনিষ্ঠ। কিন্তু লিনাশার সাথে একা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না আহি। এদিকে সবার আগে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিনাশা কেন পায় নি, তাই তার মন খারাপ। সে স্কুল ছুটি হতেই গেট দিয়ে একা একাই বেরিয়ে যাচ্ছিল। আহি ছুটে এসে পেছন থেকে লিনাশার ব্যাগ ধরে তাকে আটকালো। লিনাশা পেছন ফিরে রাগী স্বরে বলল,
“আমি তোর বেস্টু?”

আহি কান ধরে বলল,
“তোকেই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পদ্ম আর পুষ্পের সামনে জানাতে পারি নি। আমরা একা একা ফিসফিস করলে ওরা মন খারাপ করবে।”

“এখন তো সবাই জেনে গেছে।”

“পুষ্প স্কেচটা দেখে ফেললো, তাই।”

“আর আমি এতো দেরীতে জানলাম?”

“আচ্ছা, সরি। বল, কি খাবি তুই?”

“এই মেয়ে, লোভ দেখাবি না আমাকে।”

লিনাশা গাল ফুলিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আহি টেনে তাকে একপাশে এনে বলল,
“পুষ্পের কুখ্যাত চ্যানেলের শিরোনাম হওয়ার ইচ্ছা আছে তোর? দেখা যাবে কাল শিরোনাম হবে, বেস্ট ফ্রেন্ডের গোপন প্রেমের গল্প আগে শুনতে না পারায় গাড়ির নিচে স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে পড়লো একটি পাগল মেয়ে।”

লিনাশা ঝাঁকুনি দিয়ে আহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুই পাগল।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ইউ টু।”

লিনাশা চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “ইউ টু টু।”

আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ইউ টু টু টু।”

লিনাশা চেঁচিয়ে বলল, “ইউ টু ইনফিনিটি।”

দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ। এরপর তারা একসাথে হেসে উঠলো। এবার লিনাশা আহির কাঁধে হাত রাখলো আর রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। লিনাশা বলল,
“এআরকে জানিয়েছিস?”

আহি মাথা নেড়ে বলল, “উহুম।”

“কখন জানাবি?”

“সাহস হচ্ছে না।”

“সে তো কিছুই জানে না। অন্তত কিছু হিন্টস তো দে।”

“কেমন হিন্টস?”

লিনাশা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“ছেলেটার একটা স্কেচ করে ওকে গিফট কর। নাম-পরিচয় দিবি না। অজ্ঞাতনামা প্রেমিকা নামে চিরকুট লিখতে থাক। চিরকুট পেতে পেতে একসময় ও তোর প্রেমে পড়ে যাবে। তারপর হন্যে হয়ে তোকে খুঁজতে থাকবে। আর তুই একদিন তার সামনে গিয়ে সত্যটা জানাবি। ব্যস, হয়ে গেলো আহির প্রেম শুরু।”

“আইডিয়া ভালো দিয়েছিস। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।”

“কি সমস্যা?”

“চারুশিল্পে আমাদের মাঝে মাঝে তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েও পড়ায়। পরীক্ষাও নেয়। এখন ও আমার হাতের লেখা চিনে ফেললে?”

লিনাশা কিছুক্ষণ ভেবে দুষ্টু হেসে বলল,
“প্রেম করবি তুই, অনুভূতি হবে তোর। কিন্তু চিরকুটটা আমি লিখে দিবো।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“তোর হাতের লেখা তো অনেক সুন্দর। ও যদি তোর লেখার প্রেমে পড়ে যায়?”

“ধুর বোকা। এতো সহজ নাকি? কেউ আবার লেখার প্রেমে পড়ে? তোর অনুভূতিই ওকে আকর্ষণ করবে। তুই ওর জন্য স্কেচ করবি, ওটাই ওকে প্রেমে ফেলতে বাধ্য করবে। হাতের লেখা কোনো প্রেমে পড়ার জিনিস হলো?”

আহি লিনাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই বিকেলে বাসায় আসিস। তোকে আরো অনেক কথা বলার আছে।”

“আচ্ছা। আর তুই তো এআর এর আসল নাম বললি না।”

“ওটা সিক্রেট থাক। যখন ও আমার হবে তখন সবাইকে জানাবো।”

(***)

বিকেলে লিনাশা বাসায় আসার পর আহি আফিফের জন্য কি কি পাগলামো করেছে সবটা বললো। সব শুনে লিনাশা ডায়েরীটা দেখার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। কিন্তু আহি দেখালো না। শুধু আফিফের একটা ছবি দেখালো। চারুশিল্পে ভর্তির সময় আফিফ একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিয়েছিল। আহি অনেক কষ্ট করে সেটা সংগ্রহ করেছে। আফিফের ছবি দেখে লিনাশা বলল,
“ছেলেটা তো নায়কের মতো দেখতে।”

“হ্যাঁ।”

“আহি তাড়াতাড়ি জানিয়ে দে। ওর যদি অন্য কোথাও সম্পর্ক থাকে, তাহলে তোর প্রেমের বারোটা বেজে যাবে।”

এরপর লিনাশা অনেক ভেবে আহিকে একটা বুদ্ধি দিলো। আহিরও লিনাশার বুদ্ধিটা পছন্দ হলো। আহি তার কথামতো আফিফের স্কেচ করলো। আর পরের সপ্তাহের প্রথম ক্লাসেই স্কেচটি আফিফের খাতার মাঝখানে রেখে দিলো। আফিফ ক্লাসে এসেই টেবিলের উপর রাখা জমানো খাতাগুলো থেকে নিজের খাতাটা নিয়ে পাতা উল্টাতেই দেখলো সেই স্কেচ। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে স্কেচটির দিকে তাকিয়ে রইলো। স্কেচের নিচে লেখা,
“ধরে নাও এটা বেনামী চিরকুট। আমি তোমার এক অজ্ঞাতনামা ভক্ত। কি ভাবছো, তুমি কোনো সেলেব্রিটি? হুম, আসলেই তাই। তুমি শুধু আমার সেলেব্রিটি। আমি ভয়ংকরভাবে তোমার প্রেমে পড়েছি। ভাবছো আমি কে? আমার পরিচয় কি? তুমি আমার একটা নাম রাখতে পারো। তোমার যা ইচ্ছে হয়। তোমার দেওয়া নামেই আমার পরিচয় হোক।”

আহি দূর থেকে আফিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে আফিফ চিরকুটটি পড়ছে। চিরকুট পড়া শেষ হতেই সে একবার মুখ তুলে আশেপাশে তাকালো। আহির যেন তখনই আত্মা কেঁপে উঠলো। হাত-পা শিরশির করে উঠলো। লিনাশার কথাটা তাহলে সত্য হচ্ছে। আফিফ তাকে খোঁজা শুরু করেছে। আফিফ জেনে গেছে কেউ তাকে ভীষণ ভালোবাসে।

……………………….

আহি চোখ খুলেই কাঠের স্ট্যান্ডের উপর আলতোভাবে হাত রাখলো, আর বললো,
“আমার জীবনে যদি অনেক সুখ থাকতো, তাহলে হয়তো আমি তোমাকে নিয়ে ভাবার সময়টাও পেতাম না, এআর। কিন্তু এই বেহায়া মনে তুমি ছাড়া আর কোনো ভালো মানুষের জায়গা নেই। তাই তোমার কথা মনে করে নিজেকে বুঝায়, আমার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে। যে আমাকে ভালোবাসে আমার কল্পনায়। কল্পনায় ভালোবাসতে পারাটাও কিন্তু চমৎকার। তুমি নিজেও জানো না, আমি তোমাকে নিয়ে মিছেমিছি ভাবি। মনে করি তুমি আমার পাশে আছো, আমাকে বলছো, ‘আহি আমি কোনো তাজওয়ারকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দেবো না। তোমার মন-প্রাণ সব আমার দখলে। আমি তোমাকে প্রটেক্ট করবো। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমার পাশে আছি।’ এআর, তুমি কি আমার এই স্বপ্ন কখনো পূরণ করবে না? আমাকে প্রটেক্ট করতে আসবে না? আমি এখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাকে চাই। জানি, এটা অন্যায়। কিন্তু মন তো ন্যায়-অন্যায় বুঝে না। মন শুধু ভালোবাসা চায়।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১০||

১৫।
আহির হাতে একটা মলিন স্কেচ। স্কেচটি একটি ছেলের। স্কেচটিতে কোঁকড়ানো হালকা বাদামী বর্ণের চুল, ধূসর চোখ জোড়ায় স্বচ্ছ জল উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, আর ঠোঁটে শুকনো হাসি ফুটে উঠেছে। আফিফের পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখেই এই স্কেচটি করেছিল আহি। কি চমৎকার ছিল স্কেচটি! হুবহু আফিফের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আফিফ এই স্কেচটি যত্ন করে রাখতে পারলো না। যেদিন আহি প্রথম আফিফকে এই স্কেচ এঁকে দিয়েছিল, সেদিনই আফিফ সেটা হারিয়ে ফেলেছিল।
প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করে সেই স্কেচটি রেখে দিয়েছিল আফিফ। চারুশিল্প থেকে বের হয়েই প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে গিয়ে স্কেচটা মাটিতে পড়ে যায়। ভাগ্যিস আহি প্রতিদিন আফিফের পিছু নিতো। আর এই দৃশ্যটাও তার চোখে পড়ে গেলো। আফিফ সরে যেতেই আহি ভাঁজ করা স্কেচটি মাটি থেকে তুলে নিলো। ততোক্ষণে দু’একজন এর উপর পা মাড়িয়ে চলে গেছে। জুতোর ছাপ পড়ে স্কেচটি মলিন হয়ে গিয়েছিল। ভেজা মাটিতে পড়ায় সাদা পৃষ্ঠায় কেমন ছোঁপ ছোঁপ দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আহি বাসায় এসে চুলার সামনে কাগজটি ধরে রেখে তা শুকিয়ে তার বাদামি মলাটের ডায়েরীর ফাঁকেই রেখে দিয়েছিল। এখনো স্কেচটি সেই ভাঁজেই আছে। গত চার বছরে সে একবারো এই স্কেচটি খুলে দেখে নি। অন্য কিছুতে না হোক, অন্তত এই স্কেচে আফিফের স্পর্শ এখনো বর্তমান। তাই সে এই স্কেচটি ধরার সাহস পায় না। কিন্তু আজ তার মনটা ভীষণ খারাপ। তার ইচ্ছে করছে প্রিয় মানুষগুলোকে অনুভব করতে। তাই স্কেচটি খুলে তাতে হাত বুলিয়ে নিলো আহি।

……………………

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। আজকাল অল্প একটু বৃষ্টিতেই শহরের রাস্তায় পানি উঠে যায়। রিজওয়ান কবিরের অফিস উঁচু রাস্তায়। তাই তার গাড়ি কোনোদিনই ড্রেনের পানির সংস্পর্শে আসে নি। আহিরা যেই জায়গায় থাকে সেটা যথেষ্ট উঁচু স্থান। কিন্তু আহির আর্ট স্কুলের আশেপাশে পানির স্রোত বয়ে যায়। নালা উপচে পানি রাস্তায় চলে আসে।

এদিকে আহি রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে বৃষ্টি কমার জন্য দোয়া করেছিল। কারণ বৃষ্টির কারণে শহর পানিতে ভাসবে, আর তার বাবা তাকে বাসা থেকে বের হতে দেবেন না। সপ্তাহে মাত্র দু’দিন চারুশিল্পের ক্লাস থাকে। এখন একদিন না গেলে আফিফকে দেখার জন্য তার পুরো এক সপ্তাহ বসে থাকতে হবে। এটা সে কখনোই হতে দেবে না। কিন্তু তার দোয়া অপূর্ণ থেকে গেলো। বৃষ্টিও কমলো না, আর এখন পানিতে পুরো শহর থৈ থৈ করছে। আহি সকাল থেকে জেদ করছিল, সে চারুশিল্পে যাবেই যাবে। রিজওয়ান কবির শেষমেশ রাগী স্বরে বললেন,
“গেলে একা একাই যাও। পায়ে হেঁটে যাও। আমি তোমাকে রিক্সায় উঠার জন্যও টাকা দেবো না। আর আমার গাড়ি তো কখনোই পাবে না।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাতে দুইশো টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন,
“রিকশা করে যেও। হেঁটে যেও না।”

রিজওয়ান কবিরের বিরুদ্ধে গিয়ে টাকা দেওয়ায় তিনি রেগে গেলেন। হুট করে উঠে এসে তিনি সালমা ফাওজিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আহি সাথে সাথেই টাকাটা রেখে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো। পুরো রাস্তায় সে অন্যমনস্ক ছিল। আজ তার জেদের জন্যই তার মাকে চড় খেতে হলো।

(***)

হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে পানির স্রোত দেখে থমকে দাঁড়ালো আহি। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা রাস্তা নাকি কোনো স্রোতস্বিনী। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে পা বাড়ালো। হাঁটু ছুঁইছুঁই পানি। আহি ধীর গতিতে সামনে এগুচ্ছে। আফিফকে দেখার জন্য যেই প্রবল উৎসাহ নিয়ে সে বেরিয়েছিল, মাকে চড় খেতে দেখে তার সব ইচ্ছে উবে গেছে। তবুও কেন যে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছে তা নিজেই জানে না। আফিফ নামের মানুষটি যে তার মস্তিষ্ক দখল করে নিয়েছে, সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আহির। সে এই মানুষটার জন্য হয়তো সব সীমা ছাড়িয়ে যাবে।

(***)

অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ে কিছু একটা বেঁধে ভারসাম্য হারিয়ে বন্যার জলেই ধপ করে পড়ে গেলো আহি। গলা অব্ধি ডুবে গেছে তার। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে নাক চেপে ধরলো সে। সব ড্রেনের পানি, ভাবতেই গা গুলিয়ে এলো তার৷ এভাবে ময়লা ভেজা কাপড় নিয়ে সে চারুশিল্পে গেলে আফিফের নজরে পড়বে। আর এমনভাবে সে আফিফের চোখে পড়তে চায় না।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। আহি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো লিনাশা রিকশায় বসে তাকে ডাকছে। আহি লিনাশার কাছে যেতেই লিনাশা তাকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে বলল,
“কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছিস নাকি?”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার ক্লাস আছে আজকে।”

“একদিন মিস দিলে কি এমন ক্ষতি হতো?”

“এআরকে আর দেখা হতো না।”

“ও তোর মতো পাগল না যে এক কোমর পানির মধ্যে ক্লাস করতে আসবে।”

লিনাশা আহিকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে আহি ফ্রেশ হয়ে নিলো। লিনাশা তার পকেটমানির টাকা থেকে কিছু টাকা আহিকে দিয়ে বলল,
“রিকশা করে যা। হেঁটে যাবি না কিন্তু। তোর বাবাটা যে কেমন মানুষ! বাবা তো উনাকে একটুও…..”

লিনাশা কথাটা গিলে ফেললো। আহি বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে নিলো।

নার্সারিতেই লিনাশা আর আহির বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু শুরুতে আহির সাথে মেলামেশা করা লিনাশার বাবা-মা পছন্দ করতেন না। কারণ আহির বাবা একজন প্রভাবশালী মানুষ। আর লিনাশা একজন সাধারণ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আহির বাবা রিজওয়ান কবির দেশে পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে একজন। যার ফলে নৈতিক-অনৈতিক অনেক কথায় তার নামে এরই মধ্যে রটে গেছে। রাজনীতিবিদদের কাছে তিনি ফেরেশতা, আর সাধারণ মানুষের কাছে ফেরাউন। সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও মন্ত্রীদের সহায়তায় তিনি নিজের অবৈধ সম্পদ আর ব্যবসায় অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আর এমন একজন অসাধু লোকের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করাটা কোনো বাবা-মা’ই পছন্দ করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ধীরে ধীরে লিনাশার বাবা, ফখরুল হক আর লিনাশার মা মিসেস রূনা খানম আহির মায়ায় পড়ে যান। এখন লিনাশার বাবা আহিকে দেখলেই বলেন,
“বাবা যেমনই হোক, মেয়েটা ভীষণ লক্ষী।”

(***)

লিনাশার বাড়ি থেকে বের হয়ে আহি রিকশা নিয়ে চারুশিল্পে চলে গেলো। ক্লাসে আজকে মাত্র চারজন এসেছে। তাও আবার যাদের বাসা কাছে ছিল। আফিফকে ক্লাসে না দেখেই আহির চোখে জল ভীড় করতে লাগলো। এতো কষ্ট করে সে আফিফকে এক নজর দেখার জন্য চলে এসেছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। আনমনে খাতা খুলে সাদা পৃষ্ঠায় এবড়ো থেবড়ো দাগ কাটতে লাগলো আহি। হঠাৎ সুধাময় সুর আহির হৃদয় স্পর্শ করলো। আহি তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে দেখলো আফিফ ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। আফিফকে দেখেই স্যার জিজ্ঞেস করল,
“এতো ঝামেলা করে আসার কি দরকার ছিল, আফিফ?”

আহি স্যারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আর মনে মনে বলল,
“ও আমার জন্যই এসেছে।”

আফিফ মলিন মুখে নিজের সিটে বসে পড়লো। আহি এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফের চোখে-মুখে ইতস্ততভাব। সে পাশের সারিতে বসা একজনের দিকে তাকালো। ধীর গতিতে ব্যাগ থেকে খাতা, পেন্সিল বের করতে লাগলো। স্যারের প্রশ্নে সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে, তা আহি ঠিকই বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ পর পর আফিফ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। আফিফের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে করতেই ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। আফিফও নীরবে বেরিয়ে পড়লো। আফিফ প্রতিদিনই কোনো সাড়াশব্দ ছাড়া ক্লাস করে চলে যায়, ক্লাসের কারো সাথে একটা কথাও বলে না। ছেলেটা এমন কেন? আফিফ সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বাড়তে লাগলো আহির।

(***)

আজও আফিফের পিছু নিচ্ছে আহি। আরেকটু সামনে গেলে আবার হাঁটু অব্ধি পানিতে নামতে হবে আহিকে। আহি এসব তোয়াক্কা করলো না৷ সে আফিফের পিছু পিছু নেমে পড়লো হাঁটু ভর্তি পানিতে। কিছুদূর যেতেই আফিফ দাঁড়িয়ে গেলো। এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর হালকা ঝুঁকে পা থেকে এক পায়ের স্যান্ডেল খুলে নিলো। আহি বুঝতে পারলো, অন্য পায়ের স্যান্ডেলটা হয়তো পানিতেই ভেসে গেছে।

আফিফ কিছুদূর গিয়ে বাসের জন্য দাঁড়ালো। বাস আসতেই সে বাসে উঠার আগে হাতের স্যান্ডেলটা রাস্তায় ফেলে দিলো। বাস চলে যেতেই আহি সেই ফেলে দেওয়া মলিন স্যান্ডেলটি হাতে নিয়ে মনে মনে বলল,
“তোমার ফেলনাও আমার কাছে অনেক মূল্যবান, এআর।”

আহি বাসায় এসে ভালোভাবে আফিফের স্যান্ডেলটি পরিষ্কার করে পলিথিন পেপারে মুড়িয়ে রেখে দিলো। তারপর আজকের দিনের অভিজ্ঞতাটাও ডায়েরিতে তুললো। লেখার পাশে প্রতিদিনের মতো স্কেচ করলো। তবে আজ আফিফের ছবি আঁকলো না। আজ আঁকলো রাস্তার উপর একটা পরিত্যক্ত স্যান্ডেলের ছবি।

পরদিন চারুশিল্পে আফিফকে দেখে অবাক হলো আহি। আফিফ আজ ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে ক্লাসে এসেছে। স্যান্ডেলের তলাটিও খসে পড়ার উপক্রম। যার দরুন রাস্তায় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিলো তার। জুমার দিন তাই নামাজের জন্য পাশের মসজিদে ঢুকে পড়লো সে।

(***)

আজ দোকানপাট সবই বন্ধ। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে রাস্তায় একটা ভ্যানগাড়ি চোখে পড়লো আহির। ফেরিওয়ালা তার ভ্যানে করে জুতা বিক্রি করছেন। আহি একজোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনে নিলো। ভাগ্যিস কাল আফিফ তার স্যান্ডেলটা ফেলে গিয়েছিল। স্যান্ডেলের গায়ে সাইজ লেখা ছিল বলেই এই নতুন জোড়া কিনতে পেরেছে সে। স্যান্ডেল জোড়া কিনেই মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। পাশে একজন মহিলা ভিক্ষার জন্য বসে আছেন। আহি মহিলাটির হাতে দুইশো টাকার নোট দিয়ে বলল,
“আপনি আমার একটা কাজ করে দিলে আপনাকে আরো পাঁচশ টাকা দেবো।”

পাঁচশ টাকা পাওয়ার খুশিতে তিনি সানন্দে আহির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। আহির কথামতো নামাজ শেষ হতেই তিনি আফিফের কাছে গিয়ে নতুন স্যান্ডেল জোড়া তার হাতে দিয়ে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটা মাইয়া তোমারে দিতে কইছে।”

আফিফ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকালো। চিরকুটটি খুলে দেখলো সেখানে ইংরেজিতে লেখা,
“শোনো বালক,
নিজের খেয়াল রাখতে শিখো। এভাবে কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে ক্লাস করতে আসছো, আমি কিন্তু তোমার কপালের ভাঁজ সহ্য করতে পারছি না। এই স্যান্ডেল জোড়া তোমার জন্য। আমি নিজের পকেটমানি বাঁচিয়ে তোমার জন্য কিনলাম। যত্নে রাখবে কিন্তু।”

আফিফ চিরকুটটি পড়ে এদিক-ওদিক তাকালো। চিরকুটটি ইংরেজিতে লেখার কারণ যাতে আফিফ আহির লেখা বুঝতে না পারে। আর আহির বাংলা লেখা আফিফ সহজেই বুঝে ফেলবে। এই মুহূর্তে লিনাশাও পাশে নেই তাই ইংরেজিই তার একমাত্র ভরসা। আফিফ চিরকুটটি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো। এরপর প্যাকেট থেকে স্যান্ডেলটা বের করে ভিক্ষুক মহিলাটিকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো। ভিক্ষুক মহিলাটিও এদিক-ওদিক তাকিয়ে আহিকে খুঁজতে লাগলো। আফিফ কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আহির দেওয়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই চলে গেলো। আহি কিছুক্ষণ পর ভিক্ষুক মহিলাটিকে পাঁচশ টাকা দেওয়ার জন্য সামনে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“পোলাডারে তুমি চেনো?”

আহি বলল,
“ওভাবে না। আপনি দোয়া করে দিন, যাতে আরো ভালোভাবে জানতে পারি।”

মহিলাটি আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আহির সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, সত্যিই হয়তো তার ভাগ্য শুভ প্রমাণিত হবে। তবে মহিলাটির দোয়া সত্যিই কবুল হয়েছিল। সে আফিফকে অনেক ভালোভাবেই জানতে পেরেছিল। যতোটুকু সে আফিফ সম্পর্কে জেনেছে, ততোটুকু হয়তো আর কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়।

…………………………

অতীতের স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতেই পুরো বেলা কাটিয়ে দিলো আহি। এর মধ্যে একবারো কেউ তার রুমের দরজায় কড়া নাড়ে নি। সন্ধ্যার পর মুনিয়া খালা দরজার সামনে এসে আহিকে ডাকলেন। আহি দরজা খুলতেই তিনি মলিন মুখে বললেন,
“ছোড আফা, তাজওয়ার স্যার আইছেন।”

তাজওয়ার আসার খবর শুনে আহি মিইয়ে গেলো। সে ফোন হাতে নিয়ে রাদের নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই তাজওয়ার হুট করে তার রুমে ঢুকে পড়লো। আহি চমকে উঠে তাজওয়ারের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে আহির কাছে এসে বলল,
“তোমার কোমলতা দেখছি চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়েছে। তুমি তো দেখছি ছবির থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছো। এখন মনে হচ্ছে আমি বেশিদিন ওয়েট করতে পারবো না। আংকেলকে বলে শীগ্রই তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো। তুমি চাইলে এখনই নিয়ে যেতে পারি।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে