#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৫||
০৮।
দরজায় কড়ার নাড়ার শব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো আহি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে রাদের অনেকগুলো মিসড কল আর মেসেজ। আহি মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। কারণ রাতেই রাদের ঢাকায় আসার কথা ছিল। আহি মেসেজগুলো দেখতে লাগলো। মেসেজে কোনো কিছু লেখা নেই, শুধু রাগের ইমোজি পাঠিয়েছে। ছেলেটার মাথাটা এখন চরম খারাপ হয়ে আছে, তা আহি নিশ্চিত। দরজায় এবার খুব জোরেই ধাক্কা পড়লো। আহি থতমত খেয়ে গেলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল কড়ার নাড়ার শব্দে তার ঘুম ভেঙেছিল। আজকাল মাথাটা ঠিকভাবে কাজই করছে না তার৷ আহি তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলে দিতেই রাদের রাগী মুখটা তার সামনে দৃশ্যমান হলো। রাদের কপাল ছুঁইয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশে দু’একজন লোক জড়ো হয়েছে। হোটেলের ম্যানেজারও দাঁড়িয়ে আছেন। রাদ এদিক-সেদিক না তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কি মরার ঘুম ঘুমাচ্ছিলি তুই? আমি তো ভেবে ফেলেছি তুই ফ্যানের সাথে ঝুলে আছিস। আরেকবার দরজা ধাক্কা দেওয়ার পরও যদি না খুলতি এই দরজাটা আজ ভাঙা লাগতো।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ পেছন ফিরে ম্যানেজারকে বলল,
“এখন আসুন আপনার। নাটক শেষ হয়ে গেছে।”
রাদ আহিকে সরিয়ে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো। আহি ম্যানেজারের দিকে এক নজর তাকিয়ে কাচুমাচু মুখে দুঃখ প্রকাশ করতে যাবে তখনই রাদ হাত ধরে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিলো। আহি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী স্বরে বলল,
“পাগল হয়ে গেলি না-কি?”
রাদ কোনো উত্তর না দিয়ে রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। আহি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“কি খুঁজছিস?”
“মরার চেষ্টা করছিলি কি-না দেখছি।”
রাদ বিছানার নিচে উঁকিঝুঁকি দিয়ে মাথা তুলে বলল,
“রশি কই?”
“কিসের রশি?”
“যেটা দিয়ে ঝুলতে যাচ্ছিলি?”
“ফাজলামো করছিস আমার সাথে?”
“মোটেও না। তুই আমার জান বের করে দিয়েছিলি।”
“তোর কি মনে হয় আমি চার বছর আগের ঘটনার জন্য এখন স্যুসাইড করবো? তাও আবার দেশে এসে?”
“বলা তো যায় না। হয়তো তাই। দেশে তো খবরের অভাব আছে। তাই খবর হওয়ার জন্য এসেছিস। যাতে ওই ব্যাটার নজরে আসে।”
“তুই বাড়াবাড়ি করিস না তো। এখন বল, রাতে কোথায় ছিলি?”
“তোর পাশের রুমেই ছিলাম। ভাগ্যক্রমে ওই রুমটা খালি ছিল। নয়তো সারারাত তোর রুমের বাইরে মশা মারতে হতো। আর হোটেলের যা অবস্থা দেখছি, যে-কোনো ঋতুতেই রুম খালি পাওয়া যাবে।”
আহি চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,
“ক’টায় এসেছিস?”
“সাড়ে বারোটায়। আর তুই তো নিশাচরী, তাহলে কাল রাতে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলি কেন?”
“সরি রে। মাথায় ভীষণ ব্যথা ছিল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম। তাই খেয়াল ছিল না।”
“রাতে তোকে ডাকিনি লোকে আবার কি-না কি ভাববে তাই। সকাল ছয়টায় ঘুম ভেঙেছিল আমার। ভদ্রতার খাতিরে ন’টা পর্যন্ত বসেছিলাম। ফোনের উপর ফোন দিচ্ছি, তুই মদন ফোনটাও ধরলি না। শেষে অধৈর্য হয়ে রুমের দরজায় ঠোকা দিলাম। আর তোর যে মরার ওষুধের সাইড ইফেক্ট। ঠেলা দিয়েও উঠানো যায় না। আরেকটু হলে পুলিশ, মিডিয়া এসে হাজির হতো। তখন তো তোর সেলেব্রিটি বাবাও সুড়সুড় করে চলে আসতো।”
“এসব কথা বাদ দে৷ নাস্তা খাবি চল। হাত-মুখ ধুয়ে নে। চেহারার যা অবস্থা!”
“জ্বি, আমার চেহারা তোমার জন্য ক্লান্ত হয়েছে। তুমি আছো তেলাপোকার শোকে, আর আমি আছি মৌমাছির চিন্তায়।”
আহি হেসে বলল, “তুই কি তাহলে মশা?”
“আমি কি তোর রক্ত খাইছি? নাকি ওই তেলাপোকার রক্ত খাইছি? মশা তোর বাবা। আমি এসব যেমন-তেমন কীটপতঙ্গদের দলভুক্ত নই। আমি বুদ্ধিমান পতঙ্গ।”
“পতঙ্গ আবার বুদ্ধিমান হয়?”
“পিপীলিকা বুদ্ধিমান হয়, বুঝেছিস? আর তুই এসব বুঝবিও না। তুই আছিস তেলাপোকা নিয়ে ব্যস্ত। এখন চল। না-কি মুখে তুলে দিতে হবে? নিজ হাতে খেতে পারবি তো?”
আহি মুখ বাঁকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
(***)
নাস্তা খাওয়া শেষে রাদ আহির দিকে তাকালো। আহি এখনো খাচ্ছে। ঠোঁট বন্ধ করে মুখ ঘুরাচ্ছে। রাদ ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“এখানে কি কেউ তোর ভিডিও করছে?”
আহি চকিত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। তারপর রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোথায়? কাউকে তো দেখছি না!”
“তাহলে এমন ঢং করে খাচ্ছিস কেন? তাড়াতাড়ি খেয়ে, উঠ না।”
আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুই সকাল থেকে আমার উপর চেঁচাচ্ছিস! এখানে কি চেঁচামেচি করতে এসেছিস?”
“হ্যাঁ। তোর মগজের স্ক্রুগুলো একটু শক্ত করতে হবে তো! আবার যদি খুলে পড়ে যায়? তাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্ক্রুগুলো নিজেদের জায়গায় সেট করাচ্ছি।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি যেই কাজে এখানে এসেছি সেটাই বলি।”
“হুম, বল। স্ক্রু তাহলে একটু শক্ত হয়েছে।”
আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আতাউল গণির নাম শুনেছিস?”
“না। কে সে?”
“নামকরা উকিল। উনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“তোর বাবা জানে?”
“না। পাগল তুই? বাবা জানলে আমাকে একা ছাড়তোই না।”
“আংকেল জিজ্ঞেস করে নি ঢাকায় কেন এসেছিস?”
“হুম, লাবীবের দাদা মারা গিয়েছিল বলেছিলাম। ওর বাড়িতে যাবো বলেছি।”
“মাই গড। কোথায় খুলনা, আর কোথায় ঢাকা। আংকেল যদি তোর সাথে লাবীবের বাড়ি যেতে চাইতো?”
“বাবাকে তুই চিনিস না। আমার সাথে দেখা করবে এই আশা করাও আমার জন্য আকাশ-কুসুম ছিল। লাবীবের বাড়ি নিয়ে যাবে সেটা তো সোনার পাথর বাটি। বাবা এতো পজেজিভ না। আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে। শুধু একটা জায়গায় আমার সব স্বাধীনতা কেঁড়ে নিয়েছে।”
“আর ওটাই মৌলিক স্বাধীনতা। এগুলো স্বাধীনতা না। এগুলোকে বলে মাথায় উঠিয়ে আছাড় মারা।”
আহি দ্বিরুক্তি করলো না। নিশ্চুপ বসে রইলো। রাদ ধীর কন্ঠে বলল,
“চল, উকিলটার কাছে যাই। তোকে মুক্ত করার দায়িত্ব আমার।”
আহি রাদের হাত ধরে মলিন মুখে বললো,
“আমি বের হতে পারবো তো!”
“চেষ্টা করে দেখ। পারতেও পারিস। তুই এখন এডাল্ট। এখন তোর উপর জোরাজুরি খাটাতে পারবে না।”
“মা যে বললো আমি ফেরাউনের গর্তে পড়েছি। মৃত্যু ছাড়া আমার রেহাই নেই।”
রাদ আহির হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“এই ফেরাউনকে কর্ণফুলীতে ভাসিয়ে দেবো।”
“বাবা কিন্তু সাঁতার জানে।”
রাদ আহির কথায় শব্দ করে হাসলো। রাদের হাসি দেখে আহিও নীরবে হাসলো৷ রাদ নিজের হাসি আটকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহির হাসি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহির দুই গাল ঈষৎ লাল হয়ে গেছে। নয়ন পল্লব চোখের নিচের অংশ ঢেকে দিয়েছে। নাকের দুই পাশে ভাঁজ পড়েছে। ভীষণ সুন্দর লাগছে আহিকে। রাদ আনমনে বলল,
“এভাবে হাসতে জানলে অনেক আগেই আমাদের প্রেম শুরু হতো, আহি। আর তুই আছিস শুধু ওই তেলাপোকার ভাবনায়।”
০৯।
এডভোকেট আতাউল গণির অফিসের বাইরে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর আহি আর রাদ তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেলো। আহি তার ফাইলগুলো এগিয়ে দিয়ে নিজের সমস্যার কথাগুলো গণি সাহেবকে জানালো। আতাউল গণি ফাইলটি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখলেন। তারপর কৌতূকময় হাসি ফেরত দিয়ে বললেন,
“মিস্টার রিজওয়ান কবিরের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি আমি কোনো কেইস নেই, তাহলে কারোই লাভ হবে না। বরং আমার ক্ষতি হবে। আমার সামনে তার একমাত্র মেয়ে বসে আছে, আর এই কথা যদি তিনি জেনেও যান তাহলে হয়তো পত্রিকায় কোনো খারাপ সংবাদ আসবে না। কারণ সমস্যা তো চার দেয়ালের
মধ্যেই চুকে যাবে। কিন্তু মিস ওয়াসিকা কবির, আপনার পাশের জনের গুম হয়ে যাওয়ার খবরটা তড়িৎ গতিতে নিউজ চ্যানেলে প্রচার হতে পারে।”
গণি সাহেব রাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,
“সাবধান মিস্টার এক্স, ওয়াই, জেড।”
রাদ আর আহি চকিত দৃষ্টিতে আতাউল গণির দিকে তাকিয়ে রইলো। গণি সাহেব টেবিলে হাত রেখে রাদের দিকে ঝুঁকে বললেন,
“শীঘ্রই এই মেয়ের সঙ্গ ত্যাগ করো। নয়তো তোমার বাবা-মা নিজের সন্তান হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যাবেন।”
আহি তার ফাইলগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলাম, আর আপনি আমাদের হুমকি দিচ্ছেন?”
গণি সাহেব দুই গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে জিহ্বায় হালকা কামড় বসিয়ে মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন,
“উপদেশ যদি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমার কিছুই করার নেই। আর আমার চেয়ে তুমি তোমার বাবাকে ভালোই চেনো। নিজের জীবনের মায়া কার না থাকে? এখন তুমি তোমার প্রেমিকের জীবন ভিক্ষা দাও।”
রাদ হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই আহি তাকে থামিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“চল রাদ। আমার সমস্যার কোনো সমাধান নেই।”
রাদ আহির হাত ধরে তাকে নিয়ে আতাউল গণির রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। গণি সাহেবের অফিসের বাইরে এসেই আহি ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়লো। রাদ আহির হাত ধরে তার পাশে বসে বলল,
“তুই এতো ভাবিস না তো। দেখিস, এর চেয়ে ভালো কোনো উকিল আমাদের সাহায্য করবেন।”
আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“না, রাদ। আমাকে হয়তো এটাই মেনে নিতে হবে। দিনশেষে ক্ষমতার কাছে সবাই হেরে যায়।”
“যে যতোই ক্ষমতাবান হোক, সন্তানের খুশি সবার আগে। চার বছর আগে তুই হয়তো আংকেলের কাছে ছোট ছিলি। এখন তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। দেখিস, আংকেল তোর ইচ্ছের গুরুত্ব দেবে।”
(***)
আহি ব্যাগপত্র নিয়ে টিকেট কাউন্টারে বসে আছে। আধাঘন্টা পর বাস ছাড়বে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। রাদ একটা চিপসের প্যাকেট খুলতে খুলতে তার পাশে বসে বলল,
“এখনো মুখ ভার করে বসে থাকবি?”
আহি মলিন হেসে বলল, “উহুম। আমি ঠিক আছি।”
রাদ আহির দিকে নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের চাহনি দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহির প্রশ্নবিদ্ধ নয়নের প্রতিত্তোরে রাদ বলল,
“এই যে একটু আগে হাসলি, এই হাসিটার নাম কি জানিস?”
“কী নাম?”
“নীল হাসি।”
আহি ভ্রূ কুঁচকালো। রাদ বলল,
“শুনেছি নীল রং কষ্টের, হতাশার। তোর মুখে নীল হাসি মানায় না, আহি। তোর মুখে হলুদ হাসি মানায়।”
আহি নিঃশব্দে হাসলো। রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহি রাদের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“আর তোর মুখে এমন গম্ভীর কথাবার্তা মানায় না, দোস্ত।”
রাদ আহির কথা উপেক্ষা করেই বলতে লাগলো,
“হাস্যরত একজন মানুষের মুখে তার মনের ছায়া দেখা যায়।”
“আচ্ছা!”
“এটা আমার কথা নয়। হুমায়ুন স্যারের কথা।”
“তুই বইও পড়িস না-কি?”
“একটু-আধটু।”
“এতো বছর এই কথা জানলাম না!”
“আমাকে জানার চেষ্টা করেছিস কখনো?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ আহির চোখে হাত রেখে বলল,
“চোখ বন্ধ করে হাসার চেষ্টা কর। দেখবি মনের সব কষ্ট চুটকির মধ্যে মিলিয়ে গেছে।”
আহি মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো। রাদ বলল,
“কল্পনা কর, হাসলে মানুষকে কতো সুন্দর লাগে।”
আহি কল্পনা করতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আফিফের সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
………………………
সেদিন চারুশিল্পের ক্লাস শেষে স্যারের সাথে সাবলীলভাবে হেসে কথা বলছিল আফিফ। যেই হাসিতে কোনো জড়তা নেই, কোনো জড়িমা নেই। ভীষণ চমৎকার সেই হাসি! আহি ইচ্ছে করে ধীর গতিতে ব্যাগে খাতা-কলম ঢোকাচ্ছিল। যাতে একটু বেশি সময় ধরে ক্লাসে থাকা যায়, আর আফিফের চমৎকার হাসিটা দেখা যায়। আহির লোভ চড়েছিল ভীষণ। সেই হাসিটা মুখস্থ করতে বাসায় এসে স্কেচ বানিয়েছিল সে। একদম হুবহু সেই হাসির স্কেচ। যে-কেউ দেখলে বুঝে ফেলবে এটাই আফিফ। আহির এআর। ততোদিনে নিঁখুত স্কেচ করা শিখে ফেলেছিল আহি। তবে আহির এই নিঁখুত অংকন সম্পর্কে একমাত্র সে ছাড়া আর কেউই অবগত ছিল না। ক্লাসে সে ঠিকই কোনো না কোনো ভুল করতো, যাতে তাকে উপরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া না হয়। কারণ আফিফকে সে এখনই হারাতে চায় না।
………………………
মচমচ শব্দ কানে আসতেই আহি চোখ খুলে দেখলো রাদ গম্ভীরমুখে আহির দিকে তাকিয়ে চিপস খাচ্ছে। আহি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“চল, বাসে উঠে বসি।”
রাদ কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে নিতে নিতে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম হাসি কল্পনা করতে গিয়ে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিস।”
আহি চোখ ছোট করে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজেই উদ্ভট সব কাজ করতে বলবে, আবার এখন নিজেই মজা নিবে।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৬||
১০।
কার্তিকের মাঝামাঝি দিনগুলো ভীষণ সুন্দর। শীতের আগমনে উত্তরের সমীকরণ প্রকৃতিতে ঊষ্ণ ও আরামপ্রদ বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। আকস্মিক বাদল ধারায় পথঘাট ভিজে না অনেকদিন। ধুলো জমা রাস্তা দেখলে মনে হবে মরুভূমিতে এই মাত্র ধূলিঝড় হলো। শরতের রেশ এখনো রাস্তার ধারে রয়ে গেছে। এখানে সেখানে এখনো কাশফুল দেখা যাচ্ছে। তবে কাশবনের শুভ্র রঙ ধূলি কণায় মলিন হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট তৃষাতুর কাক হয়ে বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটার অপেক্ষায় আছে। তবে জন সাধারণ বেশ সন্তুষ্ট। এমন আরামদায়ক বাতাবরণই সবার পছন্দের। আর আহির কাছে হেমন্তের এই রূপটা ভীষণ প্রিয়। প্রায়ই সে হেমন্তের দুপুরে ইজেল-ক্যানভাস নিয়ে নদীর ধারে চলে আসে।
নদীর পাড়ে ছবি আঁকাটা খুবই সাধারণ ঘটনা। যেকোনো চিত্রশিল্পী জীবনে একবার হলেও নদীর দৃশ্য এঁকেছে। কিন্তু আহি অনন্য। সে নদীর পাড়ে বসে সব বিষয়ের ছবি আঁকে, কিন্তু কখনো নদীর ছবি ক্যানভাসে উঠায় নি। কারণ আহি মনে করে এই নদীর ধীর বহমান স্রোত তাকে রঙ-তুলির ব্যবহার শিখিয়েছে। আর এই ক্ষুদ্র শিক্ষাটা সে কারো কাছেই উন্মুক্ত করতে চায় না৷ নদীর ছবি আঁকলে যদি তার অনুপ্রেরণার উৎসটা হালকা হয়ে যায়? কিছু সৌন্দর্য মনে গেঁথে যাওয়ায় ভালো। সৃষ্টিকর্মে প্রকাশিত হলে এর মাধুর্যতা হারিয়ে যায়। আর এতো চমৎকার দৃশ্য হয়তো আহি কখনোই আঁকতে পারবে না। তাই নদীর পাড়ে গিয়েও সে কখনো নদীর ছবি আঁকে নি। তবে সে হেমন্তের মধ্যাহ্ন দুপুরে নদীর বহমান স্রোতকে সাক্ষী রেখে তার গোপন প্রেমের গল্প করেছে।
(***)
আজ বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতি, শুক্র এই দু’দিন চারুশিল্পে ক্লাস থাকে। কিন্তু আজ নেই। দেশের দুই দলীয় রেষারেষির দরুন আজ হরতাল চলছে। আহির বাবা-মা দু’জনই বাসায় উপস্থিত। তারা একই ছাদের নিচে আছেন মানেই বাসায় ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। তাই আহি চুপচাপ নিজের ছবি আঁকার জিনিসপত্র গুছিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। বাসায় যা হওয়ার হোক, অন্তত তার হেমন্ত বিলাসে বাঁধা না আসুক।
রিজওয়ান কবিরের মন-মেজাজ সকাল থেকেই চড়াও হয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া যতোবারই তার সামনে পড়ছেন তার কপালে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠছে। যে-কোনো মুহূর্তে কবির সাহেব আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন। আহি বাবা-মার ঝগড়াঝাঁটিতে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই দেখছে মায়ের মতো শক্ত মহিলাটাও তার বাবার মার খেয়ে নীরবে তার সংসার গুছিয়ে সেই স্বামীর ঘরেই ঘুমোতে যায়। আহি মায়ের আত্মসম্মানবোধের অধঃপতনে মোটামুটি বিরক্ত। তবে বাবার বিশেষ ভালোবাসায় সিক্ত থাকায় বাবা-মার মারামারিতে আহি সবসময় নিরপেক্ষ থাকতো। যা হচ্ছে হোক, তাতে তার কি? মা মার খেতে না চাইলে চলে যাক। কি দরকার বাবার সাথে থাকার? তবে আহি আজ বুঝতে পারছে মা কেন এতো নির্যাতন সহ্য করেও সেই বাড়িতে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে নিজের নিরপেক্ষতা আহিকে আজ ভাবতে বাধ্য করছে, সে ভীষণ স্বার্থপর ছিল। তার স্বার্থপর মানসিকতার ফলাফল আজ সে নিজেই ভোগ করছে।
(***)
আহি হরতালের দিনে মধ্যাহ্ন দুপুরকেই বেছে নিয়েছে হেমন্ত বিলাসের জন্য। আঁকছে পাহাড়ের গায়ে জন্মানো কিছু ফুলের দৃশ্য। আহি নিজেও কখনো এই ফুল দেখেনি। এটা তার সৃষ্ট কাল্পনিক ফুল। ফুলের রঙ ধূসর-লাল। ছবি আঁকা শেষ হতেই আহি উঠে দাঁড়ালো। নদীর পাড়ে তরুণ-তরুণীদের প্রেমলীলা চলছে। কেউ চমৎকার ভাবে একে অপরের হাত ধরে রেখে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ কেউ ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। তারা একে-অপরের মাঝেই ডুবে যাচ্ছে। আশেপাশের মানুষেরা যে তাদের দেখছে, তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আহি সেই প্রেম লীলায় মত্ত থাকা প্রেমিক-প্রেমিকাদের ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নিলো। ইজেল থেকে সদ্য আঁকা ছবিটি নামাতেই তার সাথে থাকা ড্রাইভারটি দৌঁড়ে এসে বলল, মিসেস সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আহি সব ফেলে ড্রাইভারের সাথে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পুরো রাস্তায় সে ভেবে যাচ্ছিল, তার বাবা কি তার মাকে মেরে ফেলেছে? তার কি মাকে একা বাসায় রেখে বের হওয়া উচিত হয়েছিল?
হরতাল হলেও শহরের ভেতরে হালকা-পাতলা রিক্সা আর গাড়ি চলাচল করছে। আর রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকায় গাড়ি দ্রুত হাসপাতালের সামনে পৌঁছে গেলো। সরকারি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করানো হয়েছে। হাসপাতালে ঢুকতেই দেখলো মুনিয়া খালা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। আহি তার কাছে আসতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
“তোমার ভাইটারে বাঁচানো যায় নাই, ছোড আফা। স্যার যে লাথিটাই না মারলো ম্যাডাম রে!”
আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কি ভাই-বোন আসার কথা ছিল? সে তো এই বিষয়ে কিছুই জানতো না। মায়ের সাথে কি অদ্ভুত সম্পর্ক তার? শুনেছে মায়ের সাতমাস শেষ হয়েছিল। এতোদিন ভেবেছে, মা বোধহয় মোটা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ সে এতো বড় সুসংবাদ পেলো তো পেলো, সেটা দুঃসংবাদে পরিণত হওয়ার পরই পেলো।
দারোয়ান চাচা ভালো মানুষ। নাম মোজাম্মেল। তিনিই সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। আর এখন রক্তের জন্য এদিক-ওদিক ছুটছেন। কিন্তু আহির বাবার কোনো হদিসই নেই। তিনি কি পালিয়েছেন না-কি? রিজওয়ান কবির পালানোর মতো মানুষ নন। তিনি দাপটের সাথে চলাফেরা করেন। দেশের নামকরা ব্যবসায়ী। ভালোই প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে তার। দেশের সব দলের নেতাদের সাথে তার সখ্যতা। যে-কোনো পরিস্থিতিতে তিনি নিরাপদ।
(***)
আহি সেদিনই প্রথম বাবার আসল রূপ দেখেছিল। বাবা যে প্রয়োজনে খুনীও হতে পারেন, সেদিনই প্রথম জেনেছিল সে। সেদিন সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পর বাবার কাছে প্রশ্ন করতে গিয়েছিল আহি। কেন তার ভাইকে মেরে ফেলেছে? সাত মাসের অস্তিত্বটাকে কেন মিটিয়ে দিয়েছে? কিন্তু আহি তার বাবার মুখশ্রী দেখে কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। রিজওয়ান কবির এমন এক ভয়ংকর অপরাধ করেও নির্দ্বিধায় ফোনে কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। বাবার হাসিটা ছিল মারাত্মক কুৎসিত! তাকে দেখতে হিংস্র দানবের মতোই মনে হচ্ছিল। সেদিনের পর থেকেই আহি নীরবে বাবার সাথে সখ্যতা কমিয়ে দিয়েছে। সালমা ফাওজিয়াও সেই যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিলেন। কিন্তু সন্তান হারিয়ে তিনি নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন। তার দেহটাই যেন অক্ষত ছিল, আত্মাটা তো সেই কবেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিল। এদিকে ডাক্তারও জানিয়ে দিয়েছে তিনি আর কোনোদিন মা হতে পারবেন না। এতো বড় দুঃসংবাদ যেন রিজওয়ান কবিরকে একটুও স্পর্শ করলো না। বরং তিনি এই দুঃসংবাদকে সুসংবাদ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
……………………..
রাদের কন্ঠে আহির ঘোর কাটলো। বাস ঢাকা ছেড়েছে অনেক আগে। জানালার বাইরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহি। মায়ের কান্না মাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বুকটা হুহু করে উঠলো তার। তখন যদি একটু সচেতন হতো, তার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৭||
১১।
বাসের জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা এসে জমছে। আহি হাতটা বাইরে নিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করতে যাবে তখনই রাদ তার হাত টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে রাদের দিকে তাকালো। রাদ বিরক্ত মুখে বলল,
“তোর কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
আহি বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
“তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?”
“তোর সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলার মতো তো তুই কিছুই করছিস না। চলন্ত বাসে কেউ জানালার বাইরে বৃষ্টি ধরার জন্য হাত বের করে দেয়? এটা তো বোকামি।”
রাদ নিজের কপালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“কি যা-তা বলছি! বোকারাও এতো বোকা হয় না। কান্ড জ্ঞানহীনরাই এমন কাজ করে। যাদের হুশ জ্ঞান ভালো না, তারাই এমন ঢিলার মতো কাজ করে। আর তুই তো পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে যাওয়া পলস।”
আহি চোখ ছোট করে রাগী স্বরে বলল,
“বেশি বেশি বলছিস!”
“হ্যাঁ, আমি তো একটু বেশি বেশিই বলি। আর যারা বলে না, তারা নিঃশব্দে ধুয়ে দিয়ে যায়।”
“আমার অতীত নিয়ে কথা বলবি না।”
“আগে তুই নিজে সেই অতীত থেকে বের হয়ে আয়। তারপর আর কারো বাপের সাধ্য নেই তোকে খোঁচা দেওয়ার। আর শোন, এটা মেইন রোড। এখানে বাস ঘেষাঘেষি করে চলে। পেছন থেকে একটা বাস এসে তোর হাত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন হাত খুঁজতে থাকবি। পাবিও না আর। আর তুই কি এটা তোর বাসার জানালা ভেবেছিস যে মাথার উপর দিয়ে যাবে?”
“আমার বাসার উপর দিয়ে বাস চলাচল করে?”
“হেলিকপ্টার তো যায়। তোর বাবার সেই পারসোনাল হেলিকপ্টার তো ছাদেই ল্যান্ড করে। বড়লোকি হাবভাব।”
আহি রাদকে আর কিছু বললো না। সে যাই বলুক, আহির খারাপ সময়ে মানসিক শক্তি হয়ে তার পাশে ছিল। তাই সে রাদের কথায় মন খারাপ করে না।
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার জানালার বাইরে তাকালো। জানালার কাচ এবার পুরোপুরি ভিজে গেছে। কাচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কোনো ঠিক নেই। একটু আগে সে গরমে হাসফাস করছিল, আর এখন বৃষ্টির ঝাপটায় পুরো বাতাবরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফোনে গুগল ম্যাপ দেখে বুঝলো তারা এখন যাত্রাবাড়ি পার করছে। হয়তো ঢাকা শহর আর যাত্রাবাড়ির আবহাওয়ায় পার্থক্য আছে, তাই এই হঠাৎ বৃষ্টির আবির্ভাব।
আহি জানালা খুলে দিতেই রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“অন্তত আমার সামনে মরতে যাবি না। আমি রক্তারক্তি সহ্য করতে পারি না।”
আহি হেসে বলল,
“প্রমিস, হাত বের করবো না। একটু বৃষ্টির ঝাপটা আসুক। এভাবে জানালা বন্ধ করে রাখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।”
রাদ আহির দিকে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আহি রাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে জানালার বাইরে চোখ রাখলো।
(***)
যাত্রাবাড়ীতে বোধহয় কয়েক ঘন্টা ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আশেপাশে সব ভেজা। রাস্তায় কাঁদা জমে আছে। মাঝে মাঝে কাঁচা রাস্তা চোখে পড়ছে আহির। সেগুলো কাঁদায় পুরো ডুবে আছে। সেই কাঁদায় মাখামাখি হয়ে রাস্তাগুলো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতেই আহির চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার জীবনের সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির কথা।
…………………….
দিনটি ছিল শরতের বৃষ্টিস্নাত দুপুর। প্রতিবারের মতো চারুশিল্পের ক্লাস শেষ হতেই আহি আফিফের পিছু নিয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার আফিফ ক্লাস শেষে বাসে উঠে পড়ে, আর শুক্রবার মসজিদে ঢুকে যায়। আজ বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ আফিফ বাসে উঠবে। আহি ভাবলো সেও আজ আফিফের সাথে বাসে উঠবে। লোকাল বাসে কখনোই চড়া হয় নি তার। বাবার গাড়িতে করেই দীর্ঘ দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়েছিল। তাই আজ নতুন অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যই সে আফিফের পিছু পিছু বাসে উঠে পড়লো। বাসে যাত্রীদের ভীড়। মেয়েদের সিট সব ভর্তি। আহির বসার কোনো জায়গা নেই। তাই সে আফিফকেই অনুসরণ করলো। আফিফ ভীড় ঠেলে পেছনে গিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ালো। আহিও চুপচাপ পেছনে চলে গেলো। সবাই আহির দিকে একনজর তাকাচ্ছে। সবাই হয়তো ভাবছে, সে আফিফের সাথেই এসেছে। কারণ দু’জনই একসাথে উঠেছে, এখন দু’জনই এক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু মেয়েদের সিট যেহেতু সামনে, তাই তারা সামনেই দাঁড়ায়। এখন আহির এভাবে ছেলেদের ভীড় ঠেলে পেছনে এসে দাঁড়ানোটাই সবার বিষ্ময়ের কারণ। কিন্তু আহি তো এই নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তাই সে আফিফের পাশে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু আফিফের দৃষ্টি একবারো আহির দিকে পড়লো না। সে আছে নিজের ঘোরে ব্যস্ত।
বাস চলছে ভাঙা পথ পাড়ি দিয়ে। বাসের ঝাঁকুনিতে আফিফের সাথে হালকা ধাক্কা লাগছে আহির। আহি চোখ বন্ধ করে আছে। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে তার। এভাবে অজান্তেই আফিফের স্পর্শ তার হাত-পা কাঁপাচ্ছে। ধীরে ধীরে তার গাল গরম হয়ে যাচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠ কপালে ঠেকালো আহি। খুশিতে তার জ্বর উঠে গেছে কি-না দেখে নিলো। কিন্তু হাতটা বরফের ন্যায় জমে গেছে। আহি তার ঠান্ডা হাত দিয়ে নিজের গাল ছুঁয়ে দিলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তার। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে লাগলো,
“শরীর জুড়ে এমন নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা ছড়াচ্ছে কেন? গাল গরম, হাত ঠান্ডা। শরীরের তাপমাত্রার এই অদ্ভুত কম্বিনেশন কখন হয়?”
আহি নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসলো। মনে মনে উত্তর দিলো, “প্রেমে পড়লে হয়।”
আফিফ উলটো দিকে ফিরে দাঁড়ানো। আহি তার ঠিক পেছনে। আহির দৃষ্টি আফিফের চুলের দিকে। তার ঘন চুল। আহির ইচ্ছে করছে হাত ডুবিয়ে দিতে। সে নিজের ইচ্ছে পূরণ করার আশায় হাত বাড়াতেই থমকে গেলো। আফিফ বুঝতে পারলে তাকে মারাত্মক লজ্জায় পড়তে হবে। বাবাকে অভিযোগ করে বসলে তার চারুশিল্পে যাওয়া বন্ধ।
না, ধীরে ধীরে আগানো ভালো। কোনো সম্পর্ক শুরুর পূর্বে তাড়াহুড়ো ভালো না। বিশেষত ভালোবাসায় তাড়াহুড়ো না করাই ভালো। ভালোবাসা ধীরগতিতে জীবনে আসলে দীর্ঘস্থায়ী হয়। আহি চায় আফিফ তার জীবনের দীর্ঘস্থায়ী অংশ হোক। এতো সহজে সে আফিফকে হারাতে চায় না।
(***)
বাস থেকে একজন নামতেই আহি সেই সিটে বসে পড়লো। একদম আফিফের পাশের সিট। আফিফ বসতে চেয়েছিল, কিন্তু পাশে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে সরে দাঁড়ালো। আফিফের এই ভদ্রতা দেখে আবার প্রেমে পড়ে গেলো আহি। দিনে ক’বার যে সে আফিফের প্রেমে পড়ে তার ইয়েত্তা নেই। আফিফের সামনে বসে বেশ ভালোই হয়েছে। তার দিকে তাকানোর ভালোই সুযোগ পাচ্ছে আহি। কিন্তু মাথা উপরে তুলে তাকানোটা অভদ্রতা। তাই আহি ব্যাগ ঘেঁটে তার ছোট আয়নাটা বের করলো। আফিফের শ্রান্ত মুখ দেখা যায় মতো আয়নাটা ধরলো।
এদিকে আফিফের চোখ ব্যস্ত রাস্তার দিকে। উদাস চাহনি তার। কারো উদাস চাহনি কি এতো চমৎকার হতে পারে? আহি যখন মন খারাপ করে থাকে, তখন তার নাক-মুখ ফুলে যায়। ভীষণ রকম বিশ্রী লাগে দেখতে। কিন্তু এই প্রথম কারো উদাস চাহনি দেখে আহির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে স্ট্যাচু বলে সব থামিয়ে দিয়ে আফিফের মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে থাকতে। ডোরেমনের গেজেটটা পেলে ভালোই হতো। আফিফকে পাওয়ার জন্য এতোদিনে সে সব গেজেট ব্যবহার করে ফেলতো।
আফিফের কন্ঠে ঘোর কাটলো আহির।
“দাঁড়ান, এখানে নামবো।”
আহির কানে বাক্যটা কয়েকবার গুঞ্জন করে উঠলো। আহিও উঠে দাঁড়ালো। আহি উঠে দাঁড়াতেই আফিফের গায়ের গন্ধটা তার নাকে এসে ঠেকলো। অনেকটা কাছাকাছি ঘেঁষে পড়েছিল আহি। এদিকে আফিফ ব্যস্ত বাস থেকে নামায়। সে সেকেন্ডের মধ্যেই দূরত্ব রেখে সরে গেলো। আহি বুঝলো, সে বেশি হুড়োহুড়ি করে ফেলেছে। আফিফ যদি বুঝে যায়, আহি তার পিছু নিচ্ছে?
(***)
বাসের হেল্পারকে বারো টাকা দিয়ে নেমে গেলো আফিফ। আহিও একটা বিশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে নেমে হেলো। হেল্পার বলল,
“আপনের আট টাকা লইয়া যান।”
আহি তার কথাটা কানেই নিলো না। আট টাকা দিয়ে সে কি করবে যদি আফিফকেই হারিয়ে ফেলে?
আহি নিজেই জানে না কোথায় এসে বাস থেমেছে। আফিফ বাম পাশের একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লো। আহিও তার পিছু পিছু যাচ্ছে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর আফিফ একটা গলির ভেতর ঢুকলো। গলিতে ঢুকতেই দেখলো রাস্তায় কাঁদা জমে আছে। হয়তো কাল রাতের বৃষ্টিতে ড্রেন উপচে ময়লা পানি রাস্তায় উঠে এসেছিল। এখন পানি নেমে সব ময়লা ভেসে উঠেছে। বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে লাগতেই আহির গা গুলিয়ে এলো। আফিফ এমন জায়গায় থাকে? আহি দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছে। এই রাস্তায় পা রাখলে যদি পিছলে পড়ে? অনেক ভাবার পর আহি সন্তপর্ণে রাস্তায় পা রাখলো। আর যাই হোক, বিয়ের পর তো তাকে রোজ এই রাস্তায় আসতে হবে। এমন ভাবনা মনে আসতেই আহির মনে হিম সমীরণ বয়ে গেলো। আহি লাজুক হেসে মনে মনে বলল,
“তখন মিস্টার এআরকে বলবো কোলে করে রাস্তা পার করিয়ে দিতে।”
আহি অর্ধেক পথ যেতেই কাঁদায় তার স্যান্ডেল আটকে গেলো। কোনোভাবেই সে টেনেও বের করতে পারছে না। আহি এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখলো আফিফ একটা বাড়িতে ঢুকে গেছে। এক তলা সেমি পাকা বাড়ি। দেয়াল থেকে সিমেন্ট খসে পড়ছে। আহি উদাস চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে তার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হলো,
“বাবা কি এই জায়গায় তাকে বিয়ে দেবেন?”
পরক্ষণেই সে এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো যে বাবা না মানলে সে পালিয়ে চলে আসবে। তবুও সে আফিফকে ছাড়বে না।
(***)
আহিকে অনেকক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা লোক তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। তিনি যত্নের সাথে কাঁদার ভেতর থেকে আহির পা উঠিয়ে আনলেন। কিন্তু স্যান্ডেলটা কাঁদায় তলিয়ে গেছে। সেটা নেওয়া সম্ভব না। আহি খালি পায়ে আবার পিছু ফিরে শুকনো রাস্তায় চলে এলো। ফর্সা পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে আছে। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করে বাবাকে কল করতে গিয়েও করলো না। সে কোথায় আছে নিজেও জানে না।
পাশের একটা দোকানের বাইরে বালতি ভর্তি পানি। হয়তো দোকানদার বৃষ্টির পানি জমিয়েছেন। আহি সেই পানি দিয়েই পা ধুয়ে নিলো। এরপর দারোয়ান চাচাকে ফোন করে বলল, সে এক বান্ধবীর সাথে তার বাসায় এসেছে। এখন পথ চিনছে না। পাশের দোকানদারকে ফোন এগিয়ে দিতেই তিনি মোজাম্মেল চাচাকে ঠিকানা বললেন। প্রায় একঘন্টা পর মোজাম্মেল চাচা আহিকে নিতে এলেন। এরপর তিনি রাস্তার ভ্যান থেকে আহিকে এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনে দিলেন। তারপর সিএনজি নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলেন। আহি ঘরে ঢোকার আগেই পেছন ফিরে চাচাকে বললো, বাবাকে যাতে আজকের ঘটনা না জানায়। দারোয়ান চাচা আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“সব কথা স্যারকে বলা যায় না, মা। আমি সেটা জানি।”
(***)
আহি নিজের ঘরে এসে গোসল সেরে ডায়েরী হাতে নিয়ে বসলো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। কলম হাতে নিয়ে লিখলো,
“আজ আমি তোমার পিছু নিয়েছি। তোমার জন্য বাসে চড়েছি, কাঁদায় স্যান্ডেল হারিয়ে এসেছি। আর তুমি? একবারো আমার দিকে তাকাও নি। এআর, সত্যিই কি আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি? আমার না তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। তুমি পাশে থাকলে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। আজকে যতোক্ষণ তুমি আমার কাছে ছিলে, আমি ততোক্ষণ শুধু হেসেছি। এই হাসি মনের হাসি। আমার মনটা চমৎকার ভাবে হাসে, জানো? তোমাকে দেখলে আমার মন হাসে। তোমাকে কিন্তু সারাজীবন আমার মনকে হাসাতে হবে।”
আহি কলম তুলতেই সালমা ফাওজিয়া দরজায় কড়া নাড়লেন। দুপুরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। বিকেলও গড়িয়ে যাচ্ছে। আহি এখনো ঘর বন্ধ করে বসে আছে। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে খেতে ডাকছেন। আহি মাথা ব্যথা করছে বলে কানে হেডফোন গুঁজে পেন্সিল হাতে নিলো। আজকের দিনটি স্কেচ করবেই সে। এই দিনটা তার জন্য বিশেষ একটা দিন।
বাসের ভেতরে অনেক যাত্রী। যাত্রীদের ভীড়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার পেছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
স্কেচ শেষ করেই আহি স্কেচটির নিচে লিখলো,
“প্রথম স্পর্শ পেয়েছি তোমার, আর এই স্পর্শ আমার আত্মাকে স্পর্শ করে ফেলেছে।”
…………………………
অতীত মনে পড়তেই আহির চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণা স্পর্শ করতেই রাদ তার দিকে ঝুঁকে তাকালো। আহি রাদের তাকানো দেখে তার দিকে ফিরে বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”
“কাঁদছিস?”
“পানির ঝাপটা লেগেছে।”
“চোখ লাল হয়ে গেছে তোর।”
আহি জানালা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“ঝাপটা চোখের ভেতরে লেগেছে তাই।”
রাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “মিথ্যুক।”
আহি মলিন মুখে রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুখ ফিরিয়ে নিলো। আহি সিটে হেলান দিয়ে ধরা কন্ঠে বলল,
“সেই দিনও এমন বৃষ্টি ছিল। রাস্তায় কাঁদা ছিল। আমি সব উপেক্ষা করে তার পিছু পিছু অচেনা পথ ধরেছি। স্বপ্ন দেখেছি, সেই অচেনা পথ একদিন আমার পরিচিত পথ হবে। কিন্তু মানুষটা আমার দিকে তখনও ফিরে তাকায় নি, এখনো ফিরে তাকায় না। আমাকে একটুও অনুভব করতে পারে নি সে। আমি এক তরফা ভালোবেসেছি। আমি বোকা, আমি পাগল। তুই ঠিকই বলিস। আমার মাথায় কিছু নেই।”
রাদ আহির মাথাটা নিজের কাঁধে ফেলে দিয়ে বলল,
“তুই বোকা না। তুই একটা বোকা ছেলের প্রেমে পড়েছিস। তুই পাগল না, ছেলেটা পাগল ছিল বলেই তোকে অনুভব করতে পারে নি।”
“না রাদ, ওর কী দোষ? আমি ভালোবেসেছি বলে তারও যে আমাকে ভালোবাসতে হবে, এমন তো নয়। ভালোবাসায় জোর চলে না, রাদ। ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়। কিন্তু ভালোবেসে ফেলার পর অনেককেই দেখেছি সেই মানুষকে ভুলে যেতে। আর আমার সমস্যা কোথায় আমি নিজেও জানি না। আমি আজও তাকে ভুলতে পারি না। আমি আসক্ত হয়ে গেছি। নেশা যেমন কাটানো সহজ না, আমার এই আসক্তিও তেমন কাটছে না। শুনেছি আসক্ত মানুষকে সুস্থ করার জন্য তার প্রিয় নেশাদ্রব্য তাকে কিছুদিন খেতে দেওয়া হয়, আর আমি তো আমার আসক্তিটা ছুঁয়েও দেখতে পারলাম না। আমি কি তাহলে সারাজীবন এআর আসক্ত থেকে যাবো?”
রাদ চুপচাপ বসে আছে আর আহির কাঁপা কন্ঠের আক্ষেপ শুনছে। আফিফের প্রতি ক্ষোভ যেন রাদের বুকটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আহি রাদের হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার ব্রেনটা খুলে আফিফের স্মৃতিগুলো মুছে দেওয়া যায় না? যতো টাকা খরচ হবে, আমি করবো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, রাদ। আমার গলা কাঁপছে। আমি গত চার বছর ধরে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারি না, খেতে পারি না। আমি প্রাণ খুলে হাসতেও পারি না। আমাকে একটু বাঁচা, রাদ। বাঁচা আমাকে।”
রাদ আহির হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“তুই যা বলছিস তা তো সম্ভব নয়। তবে একটা কাজ করা যায়। আফিফের সাথে দেখা করে তোর সমস্যার কথাটা খুলে বল। ও যদি তোকে বুঝে, তাহলে সমাধান পেয়ে যাবি।”
আহি রাদের হাত ছেড়ে দিলো। রাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি কখনোই এই কাজ করবে না তা রাদ ভালো করেই জানে। তাই ইচ্ছে করে আহিকে চুপ করানোর জন্য এই কথা বললো। নয়তো এই সমস্যার দ্বিতীয় কোনো সমাধান তার কাছে নেই।
চলবে-