উধয়রনী পর্ব-৫২+৫৩ + বোনাস পর্ব

0
388

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫২||

১০৮।
ধুমধাম আয়োজন করে চুনিকে দিদার বারেকের হাতে তুলে দেওয়া হলো। আহি বিয়েতে কোনো কমতি রাখে নি। চুনির ইচ্ছাতেই ঘোড়া গাড়ির ব্যবস্থা করেছে সে। এখন ঘোড়া গাড়িতে চড়ে শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছে চুনি। মেয়ের বিদায়ে মুনিয়া খালা কাঁদছেন। সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়া তাকে মৃদু সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আহি রুমে এসে এলোমেলো জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো লিনাশা। লিনাশাকে আপাদমস্তক দেখে সে বলল,
“তুই কখন এলি?”

লিনাশা হেসে আহির বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বলল,
“যখন আমার বেস্টু ঘটকালি শেষে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।”

আহি হেসে বলল, “নায়ীব ভাইয়া আসেন নি?”

“সে তো মহা ব্যস্ত। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো চেম্বারে। তার না-কি ভিআইপি পেশেন্ট এসেছে।”

“আচ্ছা, ভালো তো।”

“হ্যাঁ সবই তো ভালো। এখন বল, তোর ভালো কখন হবে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার আবার কি ভালো হবে?”

লিনাশা এবার গম্ভীরমুখে বলল, “বিয়ে করবি?”

আহি থমকে গেলো। লিনাশার পাশে বসে বলল,
“তুই জানিস, আমি আগ্রহী না।”

“পরে করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু করবি তো!”

“দেখা যাক। তুই হঠাৎ এতো রাতে বাসায় এসে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিস!”

“হ্যাঁ। কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আগে বল, তুই কি রাদকে ভালোবাসিস?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে আমি বন্ধুর মতো ভালোবাসি।”

“আমি জানতাম, তোদের সম্পর্কটা কাইন্ড অব, ইউ এন্ড মি, রাইট?”

“ইয়েস।”

লিনাশা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“উজ্জ্বলকে কেমন লাগে তোর!”

আহি এবার চোখ বড় বড় করে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আহির চোখ দেখে বলল,
“ওয়েট, ওয়েট, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। উজ্জ্বলের আম্মু, মানে আমাদের ম্যাডাম আর পুষ্পের চাচি, মাকে এসে তোর কথা বলেছেন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কী বললেন?”

“বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। মা কাল না-কি আন্টির সাথে কথা বলতে আসবে। এখন বিয়ে না করলেও সমস্যা নেই। এট লিস্ট কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাক।”

আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে চেঁচিয়ে বলল,
“বাঁচতে দিবি আমাকে তোরা? এতোদিন তাজওয়ার মাথার উপর ঘ্যানঘ্যান করছিল। এখন রাদ ওর অনুভূতি নিয়ে আমার দিন-রাত অস্থির করে তুলছে। এদিকে তুই এসেছিস বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! তোরা কি অন্ধ? তোরা কি আমাকে দেখছিস না? আমার মন কী চাই, একবার জানতে চেয়েছিস? আমি কি চাই, কেউ জানে?”

লিনাশা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আহির হাত ধরে বলল,
“আমি জানি তোর মন কী চায়। কিন্তু যেটা তুই চাস, ওটা কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?”

আহি থেমে গেলো। গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। লিনাশা আহির চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“আফিফ তোর ভাগ্যে নেই।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“আফিফ আমার ভাগ্যে না থাকুক, ওকে ভালোবাসা আমার ভাগ্যে আছে। হ্যাঁ, আজ আমি স্বীকার করে নিলাম না হয়, আমি এখনো ভুলতে পারি নি আফিফকে। ওকে ভুলে যাওয়ার সুযোগটাই তো ভাগ্য আমাকে দিলো না। আর বিয়ে জীবনের একমাত্র সমাধান নয়। আমার মনে হয়, নিজের মনকে ভালোবাসা, নিজের আত্মাকে ভালোবাসা, নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দেওয়ায় মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি আফিফকে চাই না। আমি একা থাকতে চাই। কারণ এখন আমি নিজেকে ভালোবাসতে চাইছি। জানিস, আমি কখন সুখে থাকবো?”

“কখন?”

“একা থাকলে।”

“সারাজীবন কি একা থাকা সম্ভব, আহি?”

“মা তো থাকছে। মা কি আর বিয়ে করেছে?”

“আন্টির জন্য তো তুই আছিস? কিন্তু তোর কে আছে?”

আহি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো লিনাশার দিকে। লিনাশা আহির দুই গালে হাত রেখে বলল,
“নায়ীব বলেছে আমাকে, আফিফ অনেক ভালো একটা ছেলে। ও যদি তোর হতো, আমি অনেক খুশি হতাম। পদ্মের চেয়ে আমি তোকে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু পদ্ম তো এক্জিস্ট করে।”

আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“এনাফ ম্যাচিউর আমি। নিজের ভালোটা বুঝি। পদ্ম আফিফের স্ত্রী, আমি জানি। এটাও জানি, আফিফ আমার হবে না। তার মানে এই না যে, তোরা বললি আর আমি হুট করে বিয়ে করে নিলাম, নতুন জীবন শুরু করলাম? তুই নায়ীব ভাইয়াকে ভালোবেসেছিস, পদ্ম আফিফকে ভালোবেসেছে, পুষ্প লাবীবকে ভালোবেসেছে। কিন্তু আমি আফিফকে ভালোবাসি নি। আমি আমার হৃদয়টাই দিয়ে দিয়েছি৷ তোরা কি কেউ পারবি, আমার মতো করে তোদের প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে? এক তরফা, কোনো ইশারা, কোনো আশা, কোনো ফলাফল ছাড়া, পারবি ভালোবাসতে? কেউ পারবে? আমি স্পেশাল। তাই আমি পেরেছি। এটা আমার অহংকার। আর এটাতেই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবি। জানিস লিনু, আহি কেন সবার চেয়ে ভিন্ন? কারণ আহি আফিফকে ভালোবাসে। আমি যদি ভালোবাসাই ছেড়ে দেই, তাহলে আমার স্পেশালিটি আর থাকবে না। দেবদাস হয়েছে কতো জন, এবার না হয় আহির জন্ম হোক।”

“দেবদাস হওয়া সহজ। কিন্তু আহি হওয়া না। কারণ তুই একটা মেয়ে। আর দেবদাস মরে প্রমাণ করে দিয়েছে, সে তার শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি পার্বতীকে ভালোবেসেছিল।”

“আমি আহি। কোনো দেবদাসী নই। আমি নিজেকে শেষ করে দেবো না। আমি বাঁচবো নিজের জন্য। স্বপ্ন দেখবো নিজের জন্য৷ শুধু ভালোবাসাটা হৃদয়ে দাফন হয়ে থাকবে। যেই অদৃশ্য মাটিতে আমার কয়েক বছরের পাগলামো, আমার স্বপ্ন, হাতে আঁকা প্রিয় ছবিগুলো, চারুশিল্প, সেই পথ সব, সবটাই দম ছাড়বে। আর সেই মৃত স্মৃতিগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“তোর বর আমার জীবনে এসে অনেক বড় উপকার করেছে।”

“কী?”

“আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে আবেগ ধরে রাখতে হয়। আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে অলকানন্দাকে ভালোবেসে কাঠগোলাপকে আগলে রাখতে হয়। শিখিয়েছে কীভাবে সাদার ভীড়ে ধূসর বেগুনিকে খুঁজতে হয়।”

“আর?”

“আর রাদ, ও তো আমার মেডিসিন। আমাকে সাপোর্ট করেছে অনেক। এখন বল, আমি কি করবো? মেডিসিন তো রোগ সারায়৷ যেমন বন্ধুত্ব হতাশা কাটায়। রাদও আমার এলোমেলো জীবনটাতে একটু গতি এনেছে। বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে। তুই তো ছিলি না পাশে। জানিস, অতিরিক্ত সবকিছুই মান হারায়। আমার অতি ভালোবাসাও মান হারিয়েছে। তবে এবার আমি ভুল করছি না। আমার যদি নিতেই হয়, আমি মেডিসিন নিবো। তবে এতো বেশি না, যেটা আমার মনে সাইড ইফেক্ট করবে। আর যেখানে আমি রাদকেই ভালোবাসতে পারছি না, সেখানে উজ্জ্বল বা পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষ দাঁড়ানোর যোগ্যতায় রাখে না।”

(***)

আজ শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিতে রাদ, লাবীব, পুষ্প আর আহি ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছে। মাস্টার্সের সার্টিফিকেট তুলতে ক্যাম্পাসে এসেছে তারা। ক্যান্টিনে বসে তারা অনেক আড্ডাও দিলো। আড্ডার বিষয় লাবীব আর পুষ্পের বিয়ে। আড্ডা শেষে রাদ উঠে দাঁড়ালো। আহির হাত ধরে বলল,
“তোকে একটা জিনিস দেবো।”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কি?”

রাদ আহিকে একপাশে টেনে এনে বলল,
“আগে একটা সুখবর শোন।”

“হুম, বল।”

“আহি, আমার চাকরি হয়েছিল একটা।”

আহি আনন্দিত কণ্ঠে বলল,”সত্যি? কখন?”

“হ্যাঁ, একমাস আগেই হয়েছে। ভেবেছি আজই তোকে বলবো। আর তোকে সেই গিফটটাও দেবো।”

“রিয়েলি, গিফট! দেখি তো কি সেটা?”

রাদ ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আহির হাতে দিলো। আহি প্যাকেটটা খুলে দেখলো একটা ধূসর বেগুনি রঙের সুতির শাড়ি। সাথে সোনালী রঙের ব্লাউজ। আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তোকে ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়িতে খুব মানায়। আমার জন্য পরবি কিন্তু একদিন।”

“আমার তো ছিলোই শাড়ি।”

“সব শাড়ি, আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার প্রথম সাফল্যের স্মৃতি। অনেক বছর পর যখনই তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটির কথা।”

আহি হতাশ দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। ছলছল করে উঠলো আহির চোখ দু’টি। রাদ তা দেখে বলল,
“চল, তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। এতো আবেগী হতে হবে না তোকে।”

রাদ আহির হাত ধরলো। সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো কয়েক ধাপ। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আহির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো সে। পুরো মাঠ খালি। আজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী কম। মাঠের মাঝখানে এক আকাশস্পর্শী স্বপ্ন দেখা যুবক, আর তার হাতে আবদ্ধ তার প্রেয়সীর হাত। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”

রাদ কথাটি বলেই সামনে তাকালো। আহিও সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। ক্যাম্পাস গেটের সামনে তাজওয়ার দাঁড়ানো। আহি অবাক কন্ঠে বলল,
“তাজওয়ার এখানে?”

মুহূর্তেই ঠা ঠা শব্দ ধ্বনিত হলো নিরব ক্যাম্পাস জুড়ে। আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঢিলে হয়ে এলো তার হাতটি। তার চোখের সামনে এই মাত্র হাসিমাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ক্যাম্পাসের ইটের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। সাথে সাথেই আহির পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাজওয়ার আহির দিকে বন্দুক তাক করে বলল,
“আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক থাকতে পারবে না।”

আহি অস্থির হয়ে রাদের হাত হাতড়াতে লাগলো। ঝাঁকাতে লাগলো তার নিথর শরীর। ঠা ঠা শব্দে ক্যাম্পাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো অনেকেই। লাবীব ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সামনে এগুতেই পুষ্প তার হাত চেপে ধরলো। তাদের চোখের সামনে ঝড়ে গেলো এক প্রেমিক, যেই প্রেমিক শুধু ভালোবাসার অপরাধে প্রাণ দিয়েছে। তাজওয়ার দৃপ্ত পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আহি রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“রাদ, এই রাদ। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, একটু চোখটা খোল। আমি তোকে এক্ষুণি হস্পিটালে নিয়ে যাবো।”

লাবীব দৌঁড়ে এলো। আহি লাবীবকে দেখেই গাড়ির জন্য উঠে দাঁড়াতে, ক্যাম্পাসের কয়েকটা ছেলে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত এম্বুল্যান্সের জন্য পরিবহন কমিটির সাথে দেখা করতে বললো। আহি দৌঁড়ে গেলো সেদিকে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে রাদকে তুললো স্ট্রেচারে। আহির শরীর যেন চলছেই না। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেই পুষ্প তাকে শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ও..ওর কিছুই হবে না। আমি পাগল হয়ে যাবো ওর কিছু হলে। পাগল হয়ে যাবো আমি। কি.. কি করবো আমি? রা.. রাদ আসবে। ঠিক হয়ে যাবে ও।”

পুষ্প আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই পুষ্প ভীত কন্ঠে বললো,
“আহি? এই আহি?”

আহি জ্ঞান হারিয়েছে। এরপর আহিকে ক্যাম্পাসের মেডিকেল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।

(***)

অনিশ্চিত জীবন। হুট করে যে কীভাবে সব এলোমেলো হয়ে যায়! রাদের হঠাৎ মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এদিকে আহি ব্রেইন স্ট্রোক করে দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি। এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো আহি স্ট্রোক করেছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, প্রথম বারের স্ট্রোকের সাথে দ্বিতীয় বারের স্ট্রোক করার সময় ব্যবধান অনেক বছর হওয়ায় আহি মোটামুটি আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি আবার স্ট্রোক করে, তাহলে আহির মৃত্যুও হতে পারে, আর বেঁচে গেলে পঙ্গু হয়ে যাবে। আহি এখনো জানে না, রাদের মৃত্যু হয়েছে। সে ধরে নিয়েছে রাদ বেঁচে আছে। আহিকে রাদের মৃত্যুর সংবাদ দেয় নি কেউই। দেওয়ার ক্ষমতাও নেই কারো।

(***)

রাদের কুলখানি আজ। আহিকেও হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হলো। আজ বেশ শান্ত দেখাচ্ছে আহিকে। সালমা ফাওজিয়ার দিকে তাকিয়ে সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“রাদ কোথায়?”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ওর সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে।”

“মা, আমি দেখেছি, ওর কপালে গুলি লেগেছে। ও বেঁচে আছে তো?”

সালমা ফাওজিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “হ্যাঁ।”

“চিন্তা করো না, মা। আমি মরবো না। আমি তো আগে থেকেই মৃত ছিলাম। আমাকে একটু বলো তো, তাজওয়ার জেল থেকে পালালো কীভাবে? ও কোথায় এখন?”

“পুলিশ ধরতে পারে নি ওকে।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল,
“জানোয়ারটা আমাকে শেষ করে দিয়ে গেছে, মা। কোন অলুক্ষণে দিনে আমি তার সামনে এসে পড়েছি জানি না। সে কখন আমাকে দেখে এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেলো যে আমার জন্য সে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মার‍তে এলো! ও তো জানোয়ার না। তাহলে ও কি, মা? ও কি সাইকো? হ্যাঁ, ও একটা সাইকো কিলার।”

“শান্ত হো, আহি।”

আহি শান্ত হলো। চোখ বন্ধ করলো সে। সেকেন্ড খানিক পর মায়ের দিকে তাকালো। বলল, “তাজওয়ারকে কে পালাতে সাহায্য করেছে আমি জানি। এখন তাজওয়ার কোথায় আছে, আমি সেটাও জানি।”

আহি উঠে দাঁড়ালো। এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
“কি খুঁজছিস?”

“আমার ফোন!”

সালমা ফাওজিয়া আহির ফোনটা এনে দিলেন। আহি ফোন পেয়ে সাথে সাথেই উজ্জ্বলের নম্বরে ডায়াল করলো। উজ্জ্বল ওপাশ থেকে কিছু একটা বললো। আর আহিও কল কেটে দিয়ে মাকে বলল,
“মা, আমাকে যেতে হবে।”

“তুই এই কাজটা করিস না, আহি।”

“এই দেশে কোনো আইন নেই। কোনো বিচার নেই। রাদের বিচার আমি করবো। এবার যা হওয়ার হোক। দেখবো আমি, আইন আমাকে কি শাস্তি দেই।”

“পাপ হবে, আহি।”

“পাপ! সিরিয়াসলি? ঠিক আছে, যদি পাপ হয়৷ হোক। এমন পাপ আমি করবোই করবো।”

আহি বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া এদিকে অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে ফোন হাতে নিলেন। কিছু একটা ভেবে একটা নম্বরে ডায়াল করলেন।
রিং যাচ্ছে। সেকেন্ড খানিক পর ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দ শোনা যেতেই সালমা ফাওজিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলেন সবটাই।

চলবে-

(পরের পর্বে সব ক্লাইমেক্স শেষ হবে। আর এরপর সমাপ্তি অংশগুলো আসবে।)ভ#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫২||

১০৮।
ধুমধাম আয়োজন করে চুনিকে দিদার বারেকের হাতে তুলে দেওয়া হলো। আহি বিয়েতে কোনো কমতি রাখে নি। চুনির ইচ্ছাতেই ঘোড়া গাড়ির ব্যবস্থা করেছে সে। এখন ঘোড়া গাড়িতে চড়ে শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছে চুনি। মেয়ের বিদায়ে মুনিয়া খালা কাঁদছেন। সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়া তাকে মৃদু সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আহি রুমে এসে এলোমেলো জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো লিনাশা। লিনাশাকে আপাদমস্তক দেখে সে বলল,
“তুই কখন এলি?”

লিনাশা হেসে আহির বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বলল,
“যখন আমার বেস্টু ঘটকালি শেষে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।”

আহি হেসে বলল, “নায়ীব ভাইয়া আসেন নি?”

“সে তো মহা ব্যস্ত। আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো চেম্বারে। তার না-কি ভিআইপি পেশেন্ট এসেছে।”

“আচ্ছা, ভালো তো।”

“হ্যাঁ সবই তো ভালো। এখন বল, তোর ভালো কখন হবে?”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার আবার কি ভালো হবে?”

লিনাশা এবার গম্ভীরমুখে বলল, “বিয়ে করবি?”

আহি থমকে গেলো। লিনাশার পাশে বসে বলল,
“তুই জানিস, আমি আগ্রহী না।”

“পরে করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু করবি তো!”

“দেখা যাক। তুই হঠাৎ এতো রাতে বাসায় এসে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিস!”

“হ্যাঁ। কীভাবে বলবো, বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আগে বল, তুই কি রাদকে ভালোবাসিস?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে আমি বন্ধুর মতো ভালোবাসি।”

“আমি জানতাম, তোদের সম্পর্কটা কাইন্ড অব, ইউ এন্ড মি, রাইট?”

“ইয়েস।”

লিনাশা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“উজ্জ্বলকে কেমন লাগে তোর!”

আহি এবার চোখ বড় বড় করে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আহির চোখ দেখে বলল,
“ওয়েট, ওয়েট, এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। উজ্জ্বলের আম্মু, মানে আমাদের ম্যাডাম আর পুষ্পের চাচি, মাকে এসে তোর কথা বলেছেন।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কী বললেন?”

“বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। মা কাল না-কি আন্টির সাথে কথা বলতে আসবে। এখন বিয়ে না করলেও সমস্যা নেই। এট লিস্ট কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাক।”

আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে চেঁচিয়ে বলল,
“বাঁচতে দিবি আমাকে তোরা? এতোদিন তাজওয়ার মাথার উপর ঘ্যানঘ্যান করছিল। এখন রাদ ওর অনুভূতি নিয়ে আমার দিন-রাত অস্থির করে তুলছে। এদিকে তুই এসেছিস বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! তোরা কি অন্ধ? তোরা কি আমাকে দেখছিস না? আমার মন কী চাই, একবার জানতে চেয়েছিস? আমি কি চাই, কেউ জানে?”

লিনাশা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আহির হাত ধরে বলল,
“আমি জানি তোর মন কী চায়। কিন্তু যেটা তুই চাস, ওটা কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?”

আহি থেমে গেলো। গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। লিনাশা আহির চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“আফিফ তোর ভাগ্যে নেই।”

আহি মলিন হেসে বলল,
“আফিফ আমার ভাগ্যে না থাকুক, ওকে ভালোবাসা আমার ভাগ্যে আছে। হ্যাঁ, আজ আমি স্বীকার করে নিলাম না হয়, আমি এখনো ভুলতে পারি নি আফিফকে। ওকে ভুলে যাওয়ার সুযোগটাই তো ভাগ্য আমাকে দিলো না। আর বিয়ে জীবনের একমাত্র সমাধান নয়। আমার মনে হয়, নিজের মনকে ভালোবাসা, নিজের আত্মাকে ভালোবাসা, নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দেওয়ায় মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি আফিফকে চাই না। আমি একা থাকতে চাই। কারণ এখন আমি নিজেকে ভালোবাসতে চাইছি। জানিস, আমি কখন সুখে থাকবো?”

“কখন?”

“একা থাকলে।”

“সারাজীবন কি একা থাকা সম্ভব, আহি?”

“মা তো থাকছে। মা কি আর বিয়ে করেছে?”

“আন্টির জন্য তো তুই আছিস? কিন্তু তোর কে আছে?”

আহি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো লিনাশার দিকে। লিনাশা আহির দুই গালে হাত রেখে বলল,
“নায়ীব বলেছে আমাকে, আফিফ অনেক ভালো একটা ছেলে। ও যদি তোর হতো, আমি অনেক খুশি হতাম। পদ্মের চেয়ে আমি তোকে বেশি ভালোবাসি। কিন্তু পদ্ম তো এক্জিস্ট করে।”

আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“এনাফ ম্যাচিউর আমি। নিজের ভালোটা বুঝি। পদ্ম আফিফের স্ত্রী, আমি জানি। এটাও জানি, আফিফ আমার হবে না। তার মানে এই না যে, তোরা বললি আর আমি হুট করে বিয়ে করে নিলাম, নতুন জীবন শুরু করলাম? তুই নায়ীব ভাইয়াকে ভালোবেসেছিস, পদ্ম আফিফকে ভালোবেসেছে, পুষ্প লাবীবকে ভালোবেসেছে। কিন্তু আমি আফিফকে ভালোবাসি নি। আমি আমার হৃদয়টাই দিয়ে দিয়েছি৷ তোরা কি কেউ পারবি, আমার মতো করে তোদের প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে? এক তরফা, কোনো ইশারা, কোনো আশা, কোনো ফলাফল ছাড়া, পারবি ভালোবাসতে? কেউ পারবে? আমি স্পেশাল। তাই আমি পেরেছি। এটা আমার অহংকার। আর এটাতেই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবি। জানিস লিনু, আহি কেন সবার চেয়ে ভিন্ন? কারণ আহি আফিফকে ভালোবাসে। আমি যদি ভালোবাসাই ছেড়ে দেই, তাহলে আমার স্পেশালিটি আর থাকবে না। দেবদাস হয়েছে কতো জন, এবার না হয় আহির জন্ম হোক।”

“দেবদাস হওয়া সহজ। কিন্তু আহি হওয়া না। কারণ তুই একটা মেয়ে। আর দেবদাস মরে প্রমাণ করে দিয়েছে, সে তার শেষ নিঃশ্বাস অব্ধি পার্বতীকে ভালোবেসেছিল।”

“আমি আহি। কোনো দেবদাসী নই। আমি নিজেকে শেষ করে দেবো না। আমি বাঁচবো নিজের জন্য। স্বপ্ন দেখবো নিজের জন্য৷ শুধু ভালোবাসাটা হৃদয়ে দাফন হয়ে থাকবে। যেই অদৃশ্য মাটিতে আমার কয়েক বছরের পাগলামো, আমার স্বপ্ন, হাতে আঁকা প্রিয় ছবিগুলো, চারুশিল্প, সেই পথ সব, সবটাই দম ছাড়বে। আর সেই মৃত স্মৃতিগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি মুচকি হেসে বলল,
“তোর বর আমার জীবনে এসে অনেক বড় উপকার করেছে।”

“কী?”

“আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে আবেগ ধরে রাখতে হয়। আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে অলকানন্দাকে ভালোবেসে কাঠগোলাপকে আগলে রাখতে হয়। শিখিয়েছে কীভাবে সাদার ভীড়ে ধূসর বেগুনিকে খুঁজতে হয়।”

“আর?”

“আর রাদ, ও তো আমার মেডিসিন। আমাকে সাপোর্ট করেছে অনেক। এখন বল, আমি কি করবো? মেডিসিন তো রোগ সারায়৷ যেমন বন্ধুত্ব হতাশা কাটায়। রাদও আমার এলোমেলো জীবনটাতে একটু গতি এনেছে। বন্ধুর মতো পাশে থেকেছে। তুই তো ছিলি না পাশে। জানিস, অতিরিক্ত সবকিছুই মান হারায়। আমার অতি ভালোবাসাও মান হারিয়েছে। তবে এবার আমি ভুল করছি না। আমার যদি নিতেই হয়, আমি মেডিসিন নিবো। তবে এতো বেশি না, যেটা আমার মনে সাইড ইফেক্ট করবে। আর যেখানে আমি রাদকেই ভালোবাসতে পারছি না, সেখানে উজ্জ্বল বা পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষ দাঁড়ানোর যোগ্যতায় রাখে না।”

(***)

আজ শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিতে রাদ, লাবীব, পুষ্প আর আহি ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছে। মাস্টার্সের সার্টিফিকেট তুলতে ক্যাম্পাসে এসেছে তারা। ক্যান্টিনে বসে তারা অনেক আড্ডাও দিলো। আড্ডার বিষয় লাবীব আর পুষ্পের বিয়ে। আড্ডা শেষে রাদ উঠে দাঁড়ালো। আহির হাত ধরে বলল,
“তোকে একটা জিনিস দেবো।”

আহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কি?”

রাদ আহিকে একপাশে টেনে এনে বলল,
“আগে একটা সুখবর শোন।”

“হুম, বল।”

“আহি, আমার চাকরি হয়েছিল একটা।”

আহি আনন্দিত কণ্ঠে বলল,”সত্যি? কখন?”

“হ্যাঁ, একমাস আগেই হয়েছে। ভেবেছি আজই তোকে বলবো। আর তোকে সেই গিফটটাও দেবো।”

“রিয়েলি, গিফট! দেখি তো কি সেটা?”

রাদ ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আহির হাতে দিলো। আহি প্যাকেটটা খুলে দেখলো একটা ধূসর বেগুনি রঙের সুতির শাড়ি। সাথে সোনালী রঙের ব্লাউজ। আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“তোকে ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়িতে খুব মানায়। আমার জন্য পরবি কিন্তু একদিন।”

“আমার তো ছিলোই শাড়ি।”

“সব শাড়ি, আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার প্রথম সাফল্যের স্মৃতি। অনেক বছর পর যখনই তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটির কথা।”

আহি হতাশ দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। ছলছল করে উঠলো আহির চোখ দু’টি। রাদ তা দেখে বলল,
“চল, তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। এতো আবেগী হতে হবে না তোকে।”

রাদ আহির হাত ধরলো। সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো কয়েক ধাপ। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আহির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো সে। পুরো মাঠ খালি। আজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী কম। মাঠের মাঝখানে এক আকাশস্পর্শী স্বপ্ন দেখা যুবক, আর তার হাতে আবদ্ধ তার প্রেয়সীর হাত। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”

রাদ কথাটি বলেই সামনে তাকালো। আহিও সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। ক্যাম্পাস গেটের সামনে তাজওয়ার দাঁড়ানো। আহি অবাক কন্ঠে বলল,
“তাজওয়ার এখানে?”

মুহূর্তেই ঠা ঠা শব্দ ধ্বনিত হলো নিরব ক্যাম্পাস জুড়ে। আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঢিলে হয়ে এলো তার হাতটি। তার চোখের সামনে এই মাত্র হাসিমাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ক্যাম্পাসের ইটের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। সাথে সাথেই আহির পুরো শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। তাজওয়ার আহির দিকে বন্দুক তাক করে বলল,
“আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক থাকতে পারবে না।”

আহি অস্থির হয়ে রাদের হাত হাতড়াতে লাগলো। ঝাঁকাতে লাগলো তার নিথর শরীর। ঠা ঠা শব্দে ক্যাম্পাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো অনেকেই। লাবীব ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সামনে এগুতেই পুষ্প তার হাত চেপে ধরলো। তাদের চোখের সামনে ঝড়ে গেলো এক প্রেমিক, যেই প্রেমিক শুধু ভালোবাসার অপরাধে প্রাণ দিয়েছে। তাজওয়ার দৃপ্ত পায়ে হেঁটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আহি রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“রাদ, এই রাদ। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, একটু চোখটা খোল। আমি তোকে এক্ষুণি হস্পিটালে নিয়ে যাবো।”

লাবীব দৌঁড়ে এলো। আহি লাবীবকে দেখেই গাড়ির জন্য উঠে দাঁড়াতে, ক্যাম্পাসের কয়েকটা ছেলে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত এম্বুল্যান্সের জন্য পরিবহন কমিটির সাথে দেখা করতে বললো। আহি দৌঁড়ে গেলো সেদিকে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে রাদকে তুললো স্ট্রেচারে। আহির শরীর যেন চলছেই না। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেই পুষ্প তাকে শক্ত করে ধরলো। আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ও..ওর কিছুই হবে না। আমি পাগল হয়ে যাবো ওর কিছু হলে। পাগল হয়ে যাবো আমি। কি.. কি করবো আমি? রা.. রাদ আসবে। ঠিক হয়ে যাবে ও।”

পুষ্প আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই পুষ্প ভীত কন্ঠে বললো,
“আহি? এই আহি?”

আহি জ্ঞান হারিয়েছে। এরপর আহিকে ক্যাম্পাসের মেডিকেল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।

(***)

অনিশ্চিত জীবন। হুট করে যে কীভাবে সব এলোমেলো হয়ে যায়! রাদের হঠাৎ মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এদিকে আহি ব্রেইন স্ট্রোক করে দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি। এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো আহি স্ট্রোক করেছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, প্রথম বারের স্ট্রোকের সাথে দ্বিতীয় বারের স্ট্রোক করার সময় ব্যবধান অনেক বছর হওয়ায় আহি মোটামুটি আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি আবার স্ট্রোক করে, তাহলে আহির মৃত্যুও হতে পারে, আর বেঁচে গেলে পঙ্গু হয়ে যাবে। আহি এখনো জানে না, রাদের মৃত্যু হয়েছে। সে ধরে নিয়েছে রাদ বেঁচে আছে। আহিকে রাদের মৃত্যুর সংবাদ দেয় নি কেউই। দেওয়ার ক্ষমতাও নেই কারো।

(***)

রাদের কুলখানি আজ। আহিকেও হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হলো। আজ বেশ শান্ত দেখাচ্ছে আহিকে। সালমা ফাওজিয়ার দিকে তাকিয়ে সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“রাদ কোথায়?”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ওর সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে।”

“মা, আমি দেখেছি, ওর কপালে গুলি লেগেছে। ও বেঁচে আছে তো?”

সালমা ফাওজিয়া ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, “হ্যাঁ।”

“চিন্তা করো না, মা। আমি মরবো না। আমি তো আগে থেকেই মৃত ছিলাম। আমাকে একটু বলো তো, তাজওয়ার জেল থেকে পালালো কীভাবে? ও কোথায় এখন?”

“পুলিশ ধরতে পারে নি ওকে।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বলল,
“জানোয়ারটা আমাকে শেষ করে দিয়ে গেছে, মা। কোন অলুক্ষণে দিনে আমি তার সামনে এসে পড়েছি জানি না। সে কখন আমাকে দেখে এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেলো যে আমার জন্য সে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মার‍তে এলো! ও তো জানোয়ার না। তাহলে ও কি, মা? ও কি সাইকো? হ্যাঁ, ও একটা সাইকো কিলার।”

“শান্ত হো, আহি।”

আহি শান্ত হলো। চোখ বন্ধ করলো সে। সেকেন্ড খানিক পর মায়ের দিকে তাকালো। বলল, “তাজওয়ারকে কে পালাতে সাহায্য করেছে আমি জানি। এখন তাজওয়ার কোথায় আছে, আমি সেটাও জানি।”

আহি উঠে দাঁড়ালো। এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
“কি খুঁজছিস?”

“আমার ফোন!”

সালমা ফাওজিয়া আহির ফোনটা এনে দিলেন। আহি ফোন পেয়ে সাথে সাথেই উজ্জ্বলের নম্বরে ডায়াল করলো। উজ্জ্বল ওপাশ থেকে কিছু একটা বললো। আর আহিও কল কেটে দিয়ে মাকে বলল,
“মা, আমাকে যেতে হবে।”

“তুই এই কাজটা করিস না, আহি।”

“এই দেশে কোনো আইন নেই। কোনো বিচার নেই। রাদের বিচার আমি করবো। এবার যা হওয়ার হোক। দেখবো আমি, আইন আমাকে কি শাস্তি দেই।”

“পাপ হবে, আহি।”

“পাপ! সিরিয়াসলি? ঠিক আছে, যদি পাপ হয়৷ হোক। এমন পাপ আমি করবোই করবো।”

আহি বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া এদিকে অস্থির হয়ে গেলেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে ফোন হাতে নিলেন। কিছু একটা ভেবে একটা নম্বরে ডায়াল করলেন।
রিং যাচ্ছে। সেকেন্ড খানিক পর ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দ শোনা যেতেই সালমা ফাওজিয়া কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলেন সবটাই।

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৩||

১০৯।
রাগান্বিত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে আহি। আহিকে এর আগে কখনোই এতোটা রোষাগ্নি মেজাজে দেখে নি আফিফ। সে আহির হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল,
“কি করতে যাচ্ছো তুমি?”

আহি ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“কেন আটকাচ্ছো আমাকে? কাকে বাঁচাতে চাইছো? ওই ফেরাউনকে?”

“তোমাকে বাঁচাতে এসেছি আমি।”

“আমার জন্য এতো ভাবতে হবে না তোমার।”

“আহি, আন্টি আমাকে কল দিয়েছিলেন। আন্টির সাথে কথা বলে আমি উজ্জ্বলকে কল দিয়েছি। তারপর জানলাম তুমি এদিকে এসেছো। শুনো আহি, তুমি হুট করে এমন ডিসিশন নিয়ে তোমার জীবনটা এলোমেলো করে দিও না।”

আহি করুণ দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তাজওয়ার রাদের উপর কেন গুলি চালালো, জানো?”

আফিফ চুপ করে রইলো। আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“কারণ রাদ আমাকে ভালোবাসে। দেখেছো, আমি একটা অভিশপ্ত মেয়ে। আর কতোবার প্রমাণিত হবে, আমিই সবার পথের কাঁটা? আমার জন্য লিনাশার বাবা মারা গিয়েছিল। আমার জন্য পদ্মের সাথে এতো বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে, আর এখন রাদ!”

আফিফ আহির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“পদ্মের সাথে যা হয়েছে, তার জন্য তুমি নিজেকে দায়ী করছো?”

“আমার জন্যই তো হয়েছে সব।”

“মোটেও না। তোমার জন্য পদ্মের কিছুই হয় নি। ও তো নিজের কাজের শাস্তি পেয়েছে।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ বলল,
“তুমি পদ্মকে যতোটা ভালোবাসো, মেয়েটা ঠিক সেভাবে তোমাকে ভালোবাসে না, আহি।”

“কি বলছো তুমি?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উজ্জ্বলের গাড়ি সেখানে এসে পৌঁছালো। উজ্জ্বলকে দেখে আফিফ থেমে গেলো। এদিকে উজ্জ্বল গাড়ি থেকে নেমে আহির দিকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে। এতো সহজে তুমি এমন একটা ডিসিশন নিয়ে নিলে? পুলিশ তাজওয়ারকে খুঁজছে। তার উপর ও এখন একটা খুন করেছে।”

কথাটি বলেই উজ্জ্বল থমকে গেলো। আহি মলিন মুখে বলল,
“খুন! রাদ বেঁচে আছে। মা বলেছে, ও হাসপাতালে ভর্তি।”

উজ্জ্বল আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, খুন করার চেষ্টা করেছে, ওটাই বোঝাতে চেয়েছি।”

আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই আহি তড়িৎ গতিতে তা মুছে ফেললো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“রাদ নেই, এটা আমি মানতেই পারবো না। আর তাজওয়ারকে আমি আর জীবিত দেখতে চাই না। আমি ওকে নিজের হাতে শেষ করে দেবো।”

“তুমি জানো তাজওয়ার খান এই মুহূর্তে কোথায়?”

“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে তাজওয়ারের আপনজন তো একজনই আছে। লাবণি মেহেরা। তাজওয়ার এরেস্ট হওয়ার পরই ওর বড় ভাই সরওয়ার খান, নিজের ওয়াইফ আর মাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছে। কারণ সে নিজেও এমন ক্যারেক্টারের লোক। এরপর এখনো তারা দেশে ফিরে নি। আর তাজওয়ারের মতো লোকের কোনো বন্ধু হয় না। সজিব আর জিলান তাজওয়ারকে জেল থেকে বের করার কোনো চেষ্টায় করবে না। করবে শুধু একজনই। লাবণি মেহেরা। কারণ তার আর কোনো পথই খোলা নেই। বাবা উনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। এখন উনার তো তাজওয়ার খানই একমাত্র ভরসা।”

“সব বুঝলাম, কিন্তু লাবণি মেহেরার তো কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতা তোমার বাবার ছিল। ক্ষমতা ছাড়া তাজওয়ারকে জেল থেকে বের করাটা অসম্ভব।”

আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“তাজওয়ারকে যেই কারাগারে রাখা হয়েছে, ওখানের দায়িত্বরত কারারক্ষীদের মধ্যে যে প্রধান তাকে আমি চিনি। মঈনুল বাগ। লোকটার ক্যারেক্টর সম্পর্কে আমার ভালোই ধারণা আছে। লোকটা বাবার এমপ্লয়ির ভাই। অনেক বার অফিসে এসেছিল। নোংরা দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকাতো। আর লাবণি মেহেরা এমন লোকেদের ভালোই হ্যান্ডেল করতে পারেন। উনার ক্যারেক্টারের সাথে মঈনুল একদম ফিট বসে।”

উজ্জ্বল বলল, “এটা তোমার ধারণাও হতে পারে।”

“আপনি কি ভাবছেন, তাজওয়ার এই মুহূর্তে লাবণির সাথে থাকবে না?”

“যদি থাকে, তাহলে তো আমরা তাকে এরেস্ট করাতে পারবো৷”

“এরেস্ট? আবার পালানোর সুযোগ দিয়ে দেবো? নো ওয়ে। আই উইল কিল হিম।”

এবার আফিফ বলল,
“ওকে ফাইন। কিন্তু তাজওয়ারকে মেরে তুমি আইন যদি নিজের হাতে তুলে নাও, তোমারই তো শাস্তি হবে। তাজওয়ারকে এমন ভাবে মারতে হবে, যাতে ওর মৃত্যুর জন্য তোমাকে দায়ী করা না যায়।”

আহি আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“লাবণি মেহেরা। উনাকে তো ফাঁসানো যাবে। এক তীরে দু’জনই মরলো।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“লাবণি মেহেরা তাজওয়ারকে ছাড়ানোর পর তাজওয়ারকে খুন করবে এটা ভাবা যায়? এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে?”

“অবশ্যই করবে। কারণ প্ল্যানটাই আমাদের ওরকম হবে।”

আহি তার পরিকল্পনাটা উজ্জ্বল আর আফিফকে শোনালো। আহির পরিকল্পনা শুনে উজ্জ্বল বলল,
“আমার একদিন সময় নিতে হবে।”

আফিফ উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি তাহলে সাক্ষী জোগাড় করো। আমরা কল রেকর্ডটা বের করবো।”

আফিফ এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বাবা কি তোমাকে এই কাজে সাহায্য করবেন?”

আহি বলল,
“লাবণির বিরুদ্ধে বাবা যে-কোনো কিছুই করবেন। তবে আমাকে এক্ষুণি গিয়েই বাবার সাথে কথা বলতে হবে। আর বাবার একটা ফোন কলেই কাজ হয়ে যাবে। আমি এতো বড় কোনো দায়িত্ব তো দিচ্ছি না বাবাকে।”

(***)

মোজাম্মেল চাচা গেট খুলে আহিকে দেখে অবাক হলেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“ছোট মা, তুমি এইখানে? কোনো সমস্যা হইছে?”

আহি বলল,
“বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

মোজাম্মেল চাচা উপরের তলায় এক নজর তাকিয়ে বললেন,
“স্যার কেমন যেন হইয়া গেছে, মা। দেহো তো কেমন আছে। কথাটথাও কয় না।”

আহি বাসায় ঢুকলো। অনেক দিন পর আবার এই বাড়িতে পা রেখেছে আহি। অস্থির লাগছে তার। নিচে বড় একটা ডায়নিং। এই ডায়নিংয়ে বসে বাবার সাথে সকালের নাস্তা সেরে স্কুলে যেতো সে। ডায়নিংয়ের একপাশে রান্নাঘর, অন্যপাশে বসার ঘর। আহির কেন যেন মনে হলো রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মা আর মুনিয়া খালার ব্যস্ততা। আর বসার ঘরের কার্পেটে বসে চুনি হিন্দি সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সেখান থেকে চুনির হাততালির শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয় চুনির মন মতো কিছু একটা ঘটছে। কোণার ঘরটি চুনি আর মুনিয়া খালার। ও ঘরটি থেকে ভেসে আসছে মা-মেয়ের খুঁনসুঁটি। আহি সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠলো। দু’তলার ডানপাশে আহির ঘর। মাঝখানে বিশাল বড় একটা লাইব্রেরি আর বামপাশে বাবা-মায়ের রুম। আহির মনে হলো সেই রুমে হয়তো এখনো কিশোরী আহি একটা ক্যানভাসে তার প্রিয় অলকানন্দের ছবি আঁকছে। লাইব্রেরীতে হয়তো মা বসে বই পড়ছে। আর বাবা হয়তো রুমে বসে টিভি দেখছে, হয়তো-বা অফিসের কাজ করছে। এই মুহূর্তে সবটাই আহির কল্পনা। বর্তমান শুধু পুরো ঘরের নিস্তব্ধতা। আহি নিরবতা কাটিয়ে মৃদু পদ শব্দ তুলে বাবার ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো। কটকট শব্দ হতেই ভেতর থেকে হালকা শব্দ করলেন রিজওয়ান কবির। আহি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে মদের বোতল। আর রিজওয়ান কবির রকিং চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আহিকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়াতেই ভারসাম্য হারিয়ে রকিং চেয়ারে বসে পড়লেন। আহি রিজওয়ান কবিরের পাশে এসে বসলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি অবস্থা করে রেখেছো নিজের?”

রিজওয়ান কবির আহির দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন। আহি বলল,
“বাবা, কি করছো এসব? তুমি এখন মন্ত্রী। এখন তো অন্তত এসব ছাড়ো।”

রিজওয়ান কবির ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
“এখন খুব দেরী হয়ে গেছে। এখন এসবই আমার সংসার, আমার সঙ্গী।”

আহি নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো রিজওয়ান কবিরের দিকে। রিজওয়ান কবির আহিকে নীরব দেখে বললেন,
“তুমি এখানে কেন এসেছো?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই মুহূর্তে তোমার সাহায্যের খুব প্রয়োজন।”

আহি রিজওয়ান কবিরকে সবটা খুলে বললো। সব শুনে রিজওয়ান কবির বললেন,
“লাবণি যে তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য মঈনুলের সাথে রাত কাটিয়েছে, এটা আমি অবিশ্বাস করবো না। কারণ মঈনুলের হাবভাবে বোঝা যায়, সে আমার চেয়ে বেশি লাবণিকে চেনে। যতোবার দেখেছি, ততোবারই আমাকে বুঝিয়েছে, সে লাবণিকে কতোটা চেনে। আমিই বুঝি নি তখন। মোহগ্রস্ত ছিলাম। এখন তো সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেদিন তাজওয়ারকে যে লাবণিই সিডিউস কর‍তে চেয়েছিল, সেটাও এখন বুঝতে পারছি।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিজওয়ান কবির আবার বললেন,
“আমি আমার কাছের মানুষদেরই ভুল বুঝেছি। অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি।”

আহি বাবার হাত ধরে বলল, “সময় তো এখনো আছে।”

রিজওয়ান কবির কথা কাটিয়ে বললেন,
“আমাকে কি করতে হবে বলো।”

আহি লাবণির কল রেকর্ডগুলো বের করার জন্য রিজওয়ান কবিরের সাহায্য চাইলো। কারণ কোনো সিম কোম্পানিই সাধারণ কারো হাতে কল রেকর্ড দেবে না। আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে এই বিষয়ে যুক্ত করলে আহির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে যাবে।

এদিকে রিজওয়ান কবির লাবণির সিমের কল রেকর্ডগুলো বের করতে আহিকে সাহায্য করলেন। এরপর সালমা ফাওজিয়ার বাসায় আফিফ, আহি, উজ্জ্বল, সালমা ফাওজিয়া, লিনাশা, নায়ীব, লাবীব এবং পুষ্প একসাথে গোল হয়ে বসে এক একটা রেকর্ড শুনতে লাগলো। কয়েক ঘন্টার পরিশ্রমের পর কাঙ্খিত রেকর্ডটি পাওয়া গেলো। আহি রেকর্ডটি নিয়ে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে পেন ড্রাইভে সেইভ করে নিলো। কাজ শেষে উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কীভাবে জানলে লাবণি মেহেরা ফোনে এমন কিছু বলেছিল?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“ভাগ্যক্রমে সেদিন আমি তার আশেপাশেই ছিলাম।আমার কানে এসেছিল তার প্রতিটা কথা। হয়তো আল্লাহ আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, আজকের এই দিনটার জন্য।”

১১০।

কালো হেলমেট পরে আহির সামনে এসে দাঁড়ালো আফিফ। আহি আপাদমস্তক আফিফকে দেখে নিয়ে বলল,
“সেদিন তাজওয়ারের উপর তুমিই আক্রমণ করেছিলে?”

আফিফ হেলমেটের উপরিভাগ উন্মুক্ত করে বলল, “হ্যাঁ।”

“কেন?”

আফিফ মোটর সাইকেলে উঠতে উঠতে বলল,
“একটু মেরে আসতে ইচ্ছে হলো। এসিস্ট্যান্ট বানিয়ে প্রচুর অত্যাচার করেছে। তাই সব শোধ তুলে নিতে গিয়েছি।”

আহি আফিফের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে বলল,
“তোমার এতো সাহস কখন হলো?”

“তোমার কি আমাকে ভীতু মনে হয়?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সাহসীও মনে হয় নি।”

আফিফ মোটর সাইকেল জোরে টান দিতেই আহি আফিফের সাথে ধাক্কা খেলো। আহি শক্ত করে আফিফের শার্ট খামচে ধরলো। আফিফ বলল,
“সরি, ঠিকভাবে বসো।”

আহি আফিফকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। এরপর আফিফ মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে এলো আহির দেখানো ঠিকানায়।
শহরের বাইরে একটা দু’তলা বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল থামালো আফিফ। আহি মোটর সাইকেল থেকে নেমেই গেটের কাছে চলে এলো। গেট খোলা। আহি গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আফিফও পিছু পিছু এলো।
পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো শ্যাওলা জমে আছে দেয়ালে। আহি সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে নিচ তলা থেকে। আহির গা গুলিয়ে এলো। মুখ চেপে পেছনে ঘুরতেই আফিফের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো সে।
আফিফ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো?”

আহি বলল, “বিদঘুটে গন্ধ!”

আফিফ পকেট থেকে তার রুমাল বের করে আহিকে দিয়ে বলল,
“নাক বেঁধে ফেলো।”

আহি রুমালটি নিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “চলো।”

আহি রুমালটি নাকের কাছে আনতেই থেমে গেলো। আফিফের শরীরের গন্ধ লেগে আছে এই রুমালে। আহির সাহস হলো না আর। সে আবার আফিফকে রুমালটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“লাগবে না আমার।”

আহি রুমালটি দিয়েই দ্রুত পায়ে উপরে উঠে গেলো। আফিফ রুমালটির দিকে এক নজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

দু’তলায় এসে কড়া নাড়লো আহি। পীপহোল বাইরে থেকে চেপে ধরে রেখেছে সে। যাতে ভেতর থেকে কেউ না দেখে। অনেকক্ষণ পর ওপাশ থেকে ভেসে এলো লাবণির কন্ঠ, “কে? কে?”

আহি কোনো উত্তর দিলো না। দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। আহি ধীরে ধীরে গ্লাভসটা পরে হাতে একটা পিস্তল নিলো। লাবণি দরজা খুলতেই আহি ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পিস্তল ঠেকালো লাবণির কপালে। লাবণি চেঁচিয়ে উঠলো। আফিফ ভেতরে ঢুকলো। দু’রুম পর একটা ঘরের দরজা খুলতেই আহির কথা সত্য প্রমাণিত হলো। তাজওয়ার, সজিব আর জিলান একটা রুমে বসে সিগারেট খাচ্ছে আর নেশাদ্রব্য পান করছে। তাজওয়ার আফিফকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুই এখানে?”

তাজওয়ারের কন্ঠ শুনে আহি দরজাটা বন্ধ করে লাবণির গালে কষে একটা চড় বসিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। এদিকে তাজওয়ার আফিফকে মারার জন্য এগিয়ে আসতে যাবে তখনই আহি রুমে ঢুকলো। আহিকে দেখে তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি এখানে?”

আহি তাজওয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সশব্দে তার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আই উইল কিল ইউ।”

তাজওয়ার গালে হাত বোলাতে বোলাতে আহির দিকে তাকালো। ভীষণ রেগে গেছে সে। আহির গালে হাত চেপে ধরতে যাবে তার আগেই আফিফ তাজওয়ারের হাত ধরে বলল,
“এই সাহস নেই তোর।”

তাজওয়ার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোর এতো সাহস!”

আফিফ বাঁকা হেসে বলল,
“আমার এখন অনেক সাহস।”

তাজওয়ার হাসলো। আহি তাজওয়ারের কপালে পিস্তল ঠেকাতেই তাজওয়ারের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ পিস্তলটির দিকে তাকিয়ে আরো দ্বিগুন জোরে হাসতে লাগলো। তাজওয়ারের দেখাদেখি সজিব আর জিলানও হাসতে লাগলো। তাজওয়ার হাসি থামিয়ে সজিব আর জিলানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখ, দেখ কে এসেছে! আফিফ রাফাত এসেছে। কে এই আফিফ?”

সজিব বলল,
“বোনের ভিডিও দেখে মায়ের আঁচলে লুকিয়ে যাওয়া অবোধ বালক।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে সজিবের দিকে তাকালো। এদিকে আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। তাজওয়ার তা দেখে বলল,
“এতো রাগ কেন, আফিফ? তোর বোনের সাথে কি করেছি মনে নেই?”

আহি আফিফের দিকে তাকালো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে আফিফের বোনের?”

“কেন সুইটহার্ট? তুমি জানো না কি হয়েছে? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে শহীদ হয়েছে আফিফের বোন। যেমন রাদ হয়েছে কিছুদিন আগে।”

আহি অবাক হয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ এক দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”

তাজওয়ার বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি জানো আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। সেই শুরু থেকে, যখন থেকে তোমাকে দেখেছি। আর তুমি কি করছিলে? এই ক্ষ্যাতটার পেছনে সময় নষ্ট করছিলে। আমি একবার ওয়ার্ন করেছিলাম, বলেছিলাম আহি শুধু আমার। কিন্তু এই বোকা তো বুঝে নি। তার বড় আপা বারণ করার পরও সে তোমার চিঠিগুলো নিতো। তোমাকে আরো সুযোগ দিতো। এখন সোজা আঙ্গুলে যেহেতু ঘি উঠে নি, আঙ্গুল তো বাঁকাতে হবে। ব্যস, আমি আমার জিনিস কেঁড়ে নিয়েছি, বিনিময়ে আফিফ তার বোনকে হারিয়েছে।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আফিফ সেদিন বাধ্য হয়ে তোমার দেওয়া সেই কার্ডটি ফেলে গিয়েছিল, সুইটহার্ট। কারণ সে এই কাজ না করলে, আমি তার ছোট বোনের সাথেও একই কাজ করতাম।”

আহির চোখ ভারী হয়ে এলো অশ্রুতে। সে আফিফের দিকে তাকালো। কিন্তু আফিফ তার দিকে তাকালো না। তাজওয়ার এবার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি যদি চুপচাপ আমার হয়ে যেতে, আজ এতোগুলো মানুষের জীবন এলোমেলো হতো না।”

আহি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। সজোরে ধাক্কা দিলো তাজওয়ারকে। হঠাৎ ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে তাজওয়ার মেঝেতে পড়ে গেলো। আহি তাজওয়ারের বুকের উপর পা রেখে বলল,
“সেদিন কি বলেছিলে তুমি, গল্পটার সমাপ্তি তুমিই করবে, তাই না? হ্যাঁ, তাজওয়ার খান, আমার এলোমেলো জীবনের গল্পটার সমাপ্তি তুমিই করবে। তোমার মৃত্যুতে শেষ হবে এই গল্প।”

আহি পিস্তলের চারটা গুলি তাজওয়ারের বুকে আর কপালে চালিয়ে দিলো, ঠিক যেভাবে রাদের উপর গুলি চালিয়েছিল তাজওয়ার। গুলির শব্দ হতেই সজিব আর জিলান ঘাবড়ে গেলো। লাবণি মেহেরাও একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আফিফ সজিবের কলার চেপে ধরলো। দেয়ালে ঠেকালো তাকে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে সজিবের মাথাটা দেয়ালের সাথে বার-বার ঠুকাতে লাগলো। জিলান আফিফকে ঝেঁকে ধরেছে। আফিফ হাতের কনুই দিয়ে ইচ্ছেমতো মারলো জিলানকেও। সজিবের মাথা ফেঁটে দেয়াল রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো। লাবণি চেঁচিয়ে পালাতে যাবে তার আগেই আহি লাবণির হাত ধরে বলল,
“তুমি কোথায় পালাচ্ছো? তোমার পালানোর দিন শেষ।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই উজ্জ্বল কিছু পুলিশ সদস্য নিয়ে ঢুকলো সেই বাড়িতে। আহত অবস্থায় জিলান আর সজিবকে উদ্ধার করলো তারা৷ তাজওয়ারের মৃত শরীরটা বের করে মরদেহ পরিবহনে উঠানো হলো। আর লাবণিকে গ্রেফতার করা হলো। লাবণি চেঁচিয়ে বলল,
“আমি কিছুই করি নি। তাজওয়ারকে আহি মেরেছে।”

একজন সিনিয়র পুলিশ আহির হাত থেকে পিস্তলটি নিয়ে বলল,
“মিস লাবণি মেহেরা, এটা আপনারই লাইসেন্স গান। আর তাজওয়ারকে আপনিই খুন করেছেন। আর এর চাক্ষুষ সাক্ষী আমরা। আপনি তাজওয়ারকে মারার জন্য মঈনুল বাগের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এরপর তাজওয়ারকে এখানে এনেছেন, যাতে তাকে খুন করতে পারেন। কারণ সে আর তার বন্ধুরা আপনার সাথে প্রতারণা করেছে। আপনাকে ব্যবহার করেছে। আপনার কল রেকর্ড আছে আমাদের কাছে, যেখানে স্পষ্ট আছে, আপনি তাজওয়ারকে মারার থ্রেট দিচ্ছিলেন। যেখানে আপনি বলেছিলেন, তাজওয়ার যদি আপনাকে বিয়ে না করে, আপনি তাকে খুন করবেন। এমনকি তার বন্ধুদেরও আপনি খুন করার হুমকি দিয়েছেন, কারণ তারা আপনার সু্যোগ নিয়েছিল।”

লাবণি অবাক কন্ঠে বলল,
“এসব আমি তাজওয়ারকে এমনিই বলেছি। আমার কোনো ক্ষমতা নেই তাজওয়ারকে মারার। তাজওয়ারকে আহি মেরেছে। মিথ্যে সাক্ষী কেন দিচ্ছেন, ইন্সপেক্টর?”

সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাটি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। উজ্জ্বল লাবণির দিকে তাকিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাটিকে বলল,
“ধন্যবাদ বন্ধু।”

লাবণি অবাক হয়ে বলল, “মিথ্যে সব।”

উজ্জ্বল হেসে বলল,
“কেন মিস লাবণি মেহেরা, পাওয়ার কি সব একা তোমার? আমরা কি ঘাস কাটার জন্য জন্ম নিয়েছি? ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হয়। তুমি তো অন্যের ঘাড়ে চড়ে, নিজের সম্মান বিক্রি করে ক্ষমতা কিনে নিয়েছো। আর আমরা সম্মানের সাথে নিজেদের মগজ খাটিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছি।”

এরপর লাবণিকে ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ। শেষ হলো এক ফেরাউনের গল্প।
তাজওয়ার খান প্রেমিকা লাবণি মেহেরার গুলিতে মারা গেলো। শিরোনাম জুড়ে শুধু এই একটাই খবর। আহত সজিবের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বেঁচে ফিরলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এদিকে জিলান সুস্থ, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা থাকায় সে ছাড়া পেলো না। খবরে এই শিরোনামটি দেখেই টিভি বন্ধ করলো পদ্ম। ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। অস্থির লাগছে তার। অন্যদিকে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে আফিফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। আফিফ এসবের উত্তর দেবে না জানে। তাই আহি জিজ্ঞেস করলো না। শুধু কয়েক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। এই জল জিজ্ঞেস করছে,
“তবে কি তুমিও আমায় ভালোবেসেছিলে, এআর? আমার মতো করে আমাকে অনুভব কর‍তে?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

১১১।
আদালতে লাবণির শাস্তির রায় দেওয়া হলো, সাত বছরের কারাদন্ড। সজিবের মাথায় আঘাত লাগায় তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়, যার ফলে তাকে মেডিক্যালি মৃত ঘোষণা করা হয়। জিলানকে দশ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজের জন্য। এদিকে তাজওয়ার খানের দাফনের জন্য তার মা আর বড় ভাই-ভাবী দেশে এসেছে। কিন্তু তাকে দাফন করা সম্ভব হয় নি। রাদের বন্ধু আর কাজিনসহ কিছু সাধারণ মানুষ ঘেরাও করে ফেলে তাজওয়ারের মরদেহ পরিবহনটি। পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় পরিবহনে। তাদের একটাই দাবী, এমন পাপীর স্থান মাটিতেও নেই। পুলিশ কাউকেই চিহ্নিত করতে পারে নি। সবার মুখেই রুমাল বাঁধা ছিল। সবাই আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তাজওয়ারের বিলাসবহুল বাড়ির সামনে তাজওয়ারের মরদেহ পরিবহনটি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। শত শত প্রহরী, দেহরক্ষী কেউ এসে আজ এই মৃত শরীরটা বাঁচাতে পারে নি। প্রাসাদের মতো বাড়ি, রাজার বেশে চলা, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবটাই মুছে গেছে সেকেন্ডেই। আহি টিভি বন্ধ করে সালমা ফাওজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছো মা, আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাজওয়ার সেই হিসেবে অনেক ছাড় পেয়েছে। তাকে ছেড়ে দিলেই অন্যায় হতো। ইতিহাস সাক্ষী ফেরাউনকে মাটি, পানি কোনো কিছুই গ্রহণ করে নি। আর আজ আমার জীবনে আসা এই ফেরাউনের ভাগ্যেও মাটি ছিল না। ছাই হয়ে গেছে সে। তার অস্তিত্ব, তার দেহ সবটাই মিশে গেছে।”

সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তাজওয়ার খানকে খুন করার অপরাধে লাবণি যেই শাস্তিটা পেয়েছে, ওটা তো তোমারই পাওয়ার কথা ছিল। সাত বছরের জেল! কিন্তু তুমি ওকে ফাঁসালে কীভাবে? শুধুমাত্র কল রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে কারো রায় হয় না।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“লাইসেন্স গানটি লাবণি মেহেরার ছিল। বাবা যেদিন তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল, সেদিন তিনি সেটা সাথে নিয়ে যান নি। পিস্তলটি বাবার কাছেই ছিল। সেদিন বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আর তখনই বাবা আমাকে সেটা দিয়ে বলেছিল, যাতে পিস্তলটি কাজে লাগায়। সেই মুহূর্তে আমার মাথায় এই বুদ্ধিটা এলো। এরপর উজ্জ্বলের পুলিশ বন্ধুটিও তো সাহায্য করলেন। প্রমাণ মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু সাক্ষী মিথ্যে হয় না।”

“কিন্তু জিলানের কনফেশন?”

“পদ্ম, ফার্জিয়া, ফার্সাসহ অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে জিলান, সজিব, হ্যারি আর অর্ণব। বাকিরা তো তাদের শাস্তি পেয়েই গেছে। এখন আইন শুধু জিলানকে শাস্তি দিচ্ছে। আর তাজওয়ার তো এসবের মাস্টারমাইন্ড ছিল। ও যদি বেঁচে থাকতো, কোনো না কোনো একদিন জেল থেকে বের হয়েই যেতো। ওর ফাঁসি কখনো হতোই না। কারণ ও অনেক নামি-দামি উকিল হায়ার করার ক্ষমতা রাখে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এই কেইস পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওর শাস্তি কমে যেতো। তার চেয়ে মৃত্যুই ওর জন্য সবচেয়ে ভালো শাস্তি। এই পৃথিবীতে সে ক্ষমতাবান হতে পারে, সৃষ্টিকর্তার সামনে তাজওয়ার খান কিছুই না।”

(***)

বারান্দার মেঝেতে বসে আছে আফিফ। নতুন চাকরির জন্য চেষ্টা করছে সে। খানস গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক মাস হচ্ছে। সংসার চালানোর মতো কোনো টাকা নেই তার হাতে। তার উপর সে রেনুকে নিয়ে এসেছে নিয়াজীর বাড়ি থেকে। বোনকে আর ওই বাড়িতে রাখবে না আফিফ। এদিকে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা রেনু। তার বড় দুই ছেলে বাবার সাথেই থাকবে। নিয়াজী ছেলেদের রেনুর সাথে আসতে দেয় নি। আইনগত ভাবে ছেলেদের নিজের কাছে রাখার আবেদন করেছে নিয়াজী। রেনু অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তালাকের আবেদন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাচ্চা হওয়ার পরই তালাকের কার্যক্রম শুরু করবে। আফিফের উপর এখন সংসার চালানোর চাপ বেড়েছে। রেনু ও তার অনাগত সন্তানটির দায়িত্ব এখন আফিফের উপর। আবার কাঁধে চেপেছে অনেক ঋণ। সে তার বন্ধু নিলয়ের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল। যদিও নিলয় বলেছে, সময় নিয়ে দিলেও সমস্যা নেই। কিন্তু টাকা পরিশোধের জন্য টাকা আয় তো করতে হবে। তবে সে বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি পাঠিয়েছে। ইন্টারভিউ দিয়েছে দু’একটা। চাকরিটাও ঠিক পেয়ে যাবে একদিন।

আফিফকে বারান্দায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে পদ্ম তার পাশে এসে বসলো। পদ্মের উপস্থিতিতেই আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পদ্ম আফিফের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“আমার শরীরে এখন কলঙ্ক লেগে আছে, তাই আমাকে সহ্য হয় না আপনার, আমি জানি।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কলঙ্ক তো লেগেই গেছে। যে স্বেচ্ছায় কলঙ্ক লাগায়, তাদের কলঙ্ক তো লেগেই থাকে। কখনো মুছে যায় না।”

“আমার এই বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, আমি মরে যাবো। আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।”

“চিন্তা করো না। বাসা এমনিতেই চেঞ্জ করতে হবে।”

পদ্ম ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার তো এই শহরেই ভালো লাগছে না।”

আফিফ শীতল দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“প্লিজ, আফিফ। আমরা এই শহরটা ছেড়ে দেই? আফিফ, আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। আমি জানি, আমি অপরাধ করেছি। কিন্তু তার শাস্তি কি মৃত্যু? আমি যদি এই শহরে আরো কয়েক সপ্তাহ থাকি, নিশ্চিত আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। আমি বেরুতে পারি না। আমার ভয় হয়। আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়।”

পদ্ম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আফিফ পদ্মের দিকে ঘুরে বসলো। পদ্ম হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? আপনি তো আমাকে আর আগের মতো নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নেন না।”

আফিফের কোনো হেলদোল না দেখে পদ্ম আফিফের বুকে হাত রেখে বলল,
“এই বুকে কি এখন অন্য কেউ মাথা রাখে?”

আফিফ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পদ্মও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার জন্য কয়েক পাতা ঘুমের ওষুধ নিয়ে এলেই হবে, আমি চুপচাপ ঘুমিয়ে যাবো। আপনাকে একদম বিরক্ত করবো না।”

আফিফ চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি এই শহর ছেড়ে দেবো। কিন্তু তুমি যাওয়ার আগে আহিকে সব সত্য বলে দেবে। আমি চাই না, আহি তোমার জন্য আফসোস করুক। মেয়েটা তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য নিজেকে দায়ী করছে। এতো বোঝা ওর উপর চাপিয়ে দিয়ে আমি যাবো না। তুমি ওকে সত্যটা জানাবে।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“আমি আহিকে সব জানাবো। বলবো, আমি খারাপ, আমি সব করেছি। কিন্তু আপনাকে কসম করতে হবে, আপনি আমাকে ছাড়বেন না। আর আহির কাছে যাবেন না।”

আফিফ পদ্মের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম আফিফের হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“ওয়াদা দিন।”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যেই মেয়েটাকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। যাকে আমি ভালোবেসেছি। সেই মেয়েটা তুমি ছিলে। তোমাকে পদ্মফুল নাম কেন দিয়েছি, জানো? ফুল যেমন নিষ্পাপ, স্নিগ্ধ, মায়াবি হয়, তোমার মধ্যেও আমি সেসব গুণ দেখেছি। কিন্তু আমি মিথ্যের মাঝে আবদ্ধ ছিলাম। তুমি তো ফুল ছিলেই না। কাঁটা ছিলে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাঁটা।”

পদ্ম শুকনো হেসে বলল,
“এই কাঁটার সাথেই আপনাকে থাকতে হবে। আহি কি কখনো পদ্মের সংসার ভাঙবে, বলুন? ও কি কখনো বিশ্বাস করবে, আমি ওর সাথে এমন করেছি? ও ভাববে, আমি ধর্ষিতা, তাই আপনি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। আর তাজওয়ার তো বেঁচে নেই। আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই নেই। শুধু আপনি আছেন। আর আপনি আহিকে গিয়ে এসব বললেও লাভ হবে না। আপনি ওর যোগ্য না, আফিফ। আহি কখনো আপনার এই সংসারে থাকতে পারবে না। আপনার সেই সামর্থ নেই। রিজওয়ান কবিরের একমাত্র বংশধর আহি। ওর দাদা ওর নামে সব লিখে দিয়েছে। ও এখন চট্টগ্রামের ধনী নারী। গাড়ি, বাড়ি কোনো কিছুর অভাব নেই। আপনিই বলুন, আপনি কি ওর যোগ্য? বামুন হয়ে চাঁদ ধরার জন্য হাত বাড়াবেন? লোকে আপনার ভালোবাসা দেখবে না। আহির সম্পদের লোভে আপনি আহির কাছে এসেছেন, এটাই দেখবে। কেউ জানে না আপনার হৃদয়ে কি আছে। সবাই দেখবে আহির আর আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স।”

পদ্ম কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি আপনার সাথে আছি, আফিফ। আমি তো পারছি থাকতে। সারাজীবন পারবো। আমার কষ্ট হচ্ছে না। কারণ আমি শুধু ভালোবাসি না, আমি আপনার যোগ্যও। শুধু ভালোবাসলে হয় না, যোগ্যতাও লাগে। সালমা আন্টি কি তার মেয়ের হাত এমন এক পুরুষের হাতে দেবেন, যার আগে বিয়ে হয়েছে, যার কিচ্ছু নেই? যার নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা?”

আফিফের চোখ লাল হয়ে এলো। আহিকে পাওয়ার স্বপ্ন সে কখনোই দেখে নি। কিন্তু এভাবে আঙ্গুল দিয়ে তার অবস্থা দেখিয়ে দিয়ে, পদ্ম আফিফের অনুভূতিগুলোকেই মূল্যহীন করে দিয়েছে। আফিফ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আফিফের লাল হয়ে যাওয়া চোখ দু’টি রেনুর দৃষ্টির আড়াল হলো না। সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পদ্মের বলা কথাগুলো। পদ্ম এভাবে কেন তার ভাইয়াকে আহির ব্যাপারে বললো? নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

(***)

সন্ধ্যায় পদ্ম কয়েকটা খালি পৃষ্ঠা নিয়ে বসলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো আহিকে সব জানাবে, যেহেতু আফিফ সেটাই চায়। আর আহি জানলেও কোনো সমস্যা নেই। তার মনে হয় না সে আফিফকে এতো কিছু বলার পর আফিফ আর আহির দিকে আগানোর সাহস পাবে। আর আহিকেও সে এমনভাবে বলবে, যাতে আহি নিজেও আফিফের কাছে না আসে। পদ্ম কলম হাতে নিয়ে চিঠি লেখা শুরু করলো।

“তোর জীবনের অপ্রিয় মুহূর্তের সাক্ষী আমি। সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলতে পারবো না, তাই চিঠিতে লিখছি।”

ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। পদ্ম চিঠি লিখছে। চিঠিতে স্থান পাচ্ছে অতীতের সেই মুহূর্তগুলো।

“আহি, মনে আছে বিয়ের দিন তোকে কি বলেছিলাম? তোর এআরের সাথে আমার বরের বন্ধুত্ব করিয়ে দেবো। মিথ্যে বলেছিলাম আমি। তাদের বন্ধুত্ব তো সম্ভবই না। তারা তো একজনই ছিল। আর আমি সেটা অনেক আগেই জেনেছিলাম। সেদিন তোর হাত ধরে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম স্টেজে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো তোর, তাই না? আমি ইচ্ছে করে তোকে কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না। আমি আফিফকে ভালোবাসতাম। তাই আমি তোকে বোঝাতে চেয়েছি, উনি আমাকে কতোটা ভালোবাসেন। সেদিন ইচ্ছে করে আফিফের সামনে এআরের কথা উঠিয়েছি। উনাকে জানাতে চেয়েছি, মেয়েটা তুই। কেন জানিস? কারণ উনি জেনে যাওয়ার পর তোকে যেই অবহেলাটা ফেরত দিতো, সেই অবহেলা তোর জন্য খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তোকে চিনতে না পেরে, তোর আসল পরিচয় না জেনে যদি তোর সাথে কথা বলতো, তোর মায়া আরো বাড়তো। এখন আফিফের অবহেলা দেখে তুই আর সাহস করেও আফিফের কাছে আসবি না। এজন্যই সেদিন এআরের কথা তুলেছিলাম। এরপর চার বছর পর হুট করে আবার চলে এলি আমাদের জীবনে। তোকে একটা কথা বলা হয় নি।”

পদ্ম এইটুকু লিখে কলম হাত থেকে রাখলো। রুমের দেয়ালে আফিফের আঁকা আহির ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেদিন লাগেজ থেকে বইটি বের করতেই আফিফ আমার হাত থেকে নিয়ে ফেলেছিলেন। আমিও আগ্রহ হীন স্ত্রীর মতো বইটি আবার লাগেজে তুলে রেখেছিলাম। আফিফ ভেবেছে, তার পদ্মফুল কতো ভালো। স্বামীর জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করে না। আমি তো সেই বইটি আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। তাই সেদিন আর পড়ি নি।”

পদ্ম আবার কলম চালালো সাদা পৃষ্ঠায়। লিখলো তাজওয়ারের সাথে মিলে কীভাবে আফিফকে বাধ্য করেছে বিয়ে করার জন্য। রেনুর সাথে ঘটা সব ঘটনা লিখলো। কারণ রেনুই ছিল পদ্মের একমাত্র হাতিয়ার। রেনুকে নিয়াজীর সংসারে আটকে রেখে আফিফকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছিল সে।

“আহি, কক্সবাজারে যাওয়ার মুহূর্তগুলো মনে আছে? স্টেশনে এসে তোকে বলেছিলাম, উনার কক্সবাজার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমরা আগেও গিয়েছি ওখানে। আসলে আমি তোকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আফিফ আমার যত্ন নেয়। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যায়। কিন্তু সত্য তো এটাই আফিফের মনে তুই কোথাও না কোথাও তখনও বেঁচে ছিলি। তুই যখন বলেছিলি, শুধু আমাকে পাঠিয়ে দিলেই হতো, উনি কেন এসেছেন। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন আফিফ। তবে আমার ভালোই লেগেছিল। কারণ আমি চাইতাম, তোর কথায় উনি কষ্ট পেয়ে আমার কাছে আসুক। আমার কাঁধে মাথা রাখুক। আফসোস করুক, কেন তোকে ভালোবেসেছিলো। সেদিন বাসে উঠার সময় শাড়ি সামলাতে না পেরে তুই পড়ে যাচ্ছিলি। উনি খুব যত্ন নিয়ে ধরেছিলো তোকে। আর তুই শুনিয়ে দিলি ইচ্ছে মতো। উনার কষ্টটা সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম, তাই তো বাসে এআরের ব্যাপারে কথা উঠিয়ে আফিফের সামনে তোকে অপমান করেছি, আর তোকে বুঝিয়ে দিয়েছি, আফিফ শুধু আমার। তুই আমাদের কক্সবাজার নিয়ে গিয়ে ভালোই করেছিস। আফিফ ওখান গিয়ে বুঝে গিয়েছেন, তোর জন্য রাদ আছে।
রাদের সাথে তোকে দেখে আফিফের দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। আর আফিফের সাথে আমাকে দেখে তোরও একই অনুভূত হচ্ছিল, আমি জানি। জানিস, আফিফ আমার যত্ন নেয় ঠিক। কিন্তু নিজ থেকে কখনো আমাকে কাছে টেনে নেয় নি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরে উনি আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে বোঝান নি, আমি তার প্রেয়সী। কিন্তু উনি কক্সবাজার যাওয়ার পর তোকে দেখানোর জন্য আমাকে স্পর্শ করেছিলেন, আমার যত্ন নিয়েছিলেন। আফিফকে আমি খুবই আনরোমান্টিক ভাবতাম। মূলত উনি আমাকে কাছে টেনে নেওয়াটাও দায়িত্বের মধ্যে রেখেছিলেন। মুখে তো বলেন, ভালোবাসি। তাহলে আমি কেন বুঝি নি সেই ভালোবাসা? এবার বলি কেন মনে হয় নি। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার গেইমসে উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একটা ছবি সম্পর্কে। ছবিটা তোর ছিল। উনি এক্সিভিশনে এঁকেছিল সেই ছবি। আমাদের বিয়ের পরও সেই ছবি উনি দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছেন। আবার কবিতাও লিখেছেন। তোর চিরকুটগুলোর উত্তর লিখেছিলেন, একটা ডায়েরীতে। সেই ডায়েরী বই আকারে বাঁধিয়েছেন। এতো কিছু কেন আহি? তোর জন্য। আমার জন্য একটা কবিতা লিখেন নি, কখনো আমার একটা ছবি আঁকেন নি। তাহলে তো আমি বুঝেই নিবো, আফিফ আমাকে ভালোবাসে নি। শেষ দিন তোকে বাসায় এনে আফিফের শার্ট দিয়েছিলাম পরার জন্য। আফিফ সেটা লুকিয়ে রেখেছে। ফেলে দেয় নি। দেখেছিস, এখনো কতো ভালোবাসে তোকে। কিন্তু সামনা-সামনি তোকে ঠিকই অপমান করেছে। আসলে উনি চেয়েছেন উনাকে ভুলে তুই রাদের সাথে ভালো থাক। আমিও তাই চেয়েছি। এখনো তাই চাচ্ছি। আহি, প্লিজ আসিস না আমার সংসারে। প্লিজ আহি। এই চিঠি উনার অনুরোধে আমি লিখেছি। উনি বলেছেন তোকে সত্যটা জানানো উচিত। তোর জানা উচিত আমি কতোটা স্বার্থপর। হ্যাঁ, আমি স্বার্থপর, আহি। কিন্তু আমি তো ভালোবাসি আফিফকে। আমি উনাকে ভালো রাখবো। আসিস না আর আমাদের সামনে। চলে যা। তুই আমাদের জীবনে এলে, আমার মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হবে। তুই কি চাস, আবার কেউ তোর জন্য মারা যাক?”

পদ্ম চিঠিটা ভাঁজ করে একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। সেই প্যাকেটে আহির জন্য একটা ক্যালিগ্রাফি ছিল, আফিফের আঁকা। পদ্ম মনে মনে বলল,
“আমি তোকে ভালোবাসি, আহি। তাই তো তোকে জানিয়েছি, আফিফও তোকে ভালোবাসে। এখন এই সত্য নিয়ে তুই আরো ভালোভাবে বাঁচতে পারবি। তোর কষ্ট কম হবে।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে