#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫০||
১০২।
ভোর পাঁচটা। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। আশেপাশে নিরবতা ছেয়ে আছে। আর এসবের মধ্যে সোফায় স্থির হয়ে বসে আছেন রিজওয়ান কবির। তার মুখোমুখি বসে হাঁসফাঁস করছে লাবণি। তার বুক ধড়ফড় করছে। হাত কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। আহি লাবণির পাশে বসে চাপা স্বরে বলল,
“মাম্মা, কেনাকাটা কি শুরু করে দেবো? চারদিন পর মনে হয়, আপনার কুলখানিটা খেতে হবে।”
লাবণি রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। সে উঠে রিজওয়ান কবিরের পায়ের কাছে বসে বলল,
“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না, রিজওয়ান?”
রিজওয়ান কবির তার হাত থেকে ক্যামেরাটি টেবিলের উপর রেখে বললেন,
“বিশ্বাস? তাজওয়ার আর তোমার নোংরামি দেখার পরও আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো? এতোটা অন্ধ ভেবেছো আমাকে?”
“আমি কিচ্ছু করি নি। সবটাই তোমার মেয়ের সাজানো নাটক।”
রিজওয়ান কবির উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে মুনিয়া খালাকে ডাকলেন। মুনিয়া খালা দৌঁড়ে বসার ঘরে এলো। রিজওয়ান কবির তাকে বললেন,
“এই অসভ্য মহিলাকে এক্ষুণি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করে দাও।”
লাবণি তা শুনে রিজওয়ান কবিরের হাত ধরতে যেতেই রিজওয়ান সশব্দে লাবণির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আহি তা দেখে চোখ বন্ধ করলো। ঠিক এভাবেই এক সকালে, দেরীতে টেবিলে নাস্তা আসায় বাবা তার মায়ের গায়ে হাত তুলেছিল। খুব আত্মসম্মানী নারী সালমা ফাওজিয়া। মুনিয়া খালা আর চুনির সামনে চড় খাওয়াটা সহ্য করতে পারেন নি তিনি। তবুও আহির জন্য সংসারটা ছাড়তে পারছিলেন না। কিন্তু আজ তার উপর হওয়া অন্যায়ের শোধ তুলেছে এই একটা চড়ের গুঞ্জন।
লাবণি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তোকে আমি তালাক দিলাম। তোকে আমি তালাক দিলাম। তোকে আমি তালাক দিলাম।”
লাবণি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহির ঠোঁটে বিজয়ের হাসি, আর চোখে অশ্রু টলমল করছে। যেই নারীর জন্য তার মায়ের সংসার ভেঙেছে, আজ সেই নারীর পরিণতি দেখার মতো সৌভাগ্য সৃষ্টিকর্তা আহিকে দিয়েছেন। তাই হয়তো সেদিন সে বেঁচে ফিরেছিল। এদিকে লাবণি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি কোথায় যাবো, রিজওয়ান?”
আহি বলল,
“কেন, তাজওয়ার খান তো আছেই। আপনি না হয় তার কাছেই ফিরে যান।”
আহি অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,
“ওপস, আমি তো ভুলেই গেছি। তাজওয়ার খান তো আপনাকে শুধু রক্ষিতা হিসেবেই রেখেছিল।”
“জাস্ট শাট আপ, আহি। সব তোমার জন্য হয়েছে। আমি তোমাকে ছাড়বো না।”
রিজওয়ান কবির লাবণির বাহু চেপে ধরে বললেন,
“কি করবে তুমি? তোমার কী ক্ষমতা আছে? আমার টাকায় তোমার যতো জোর ছিল। এখন সেসবও থাকবে না।”
লাবণি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি তোমার জন্য সব ছেড়ে এসেছি, রিজওয়ান। আর তুমিই আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো?”
আহি বলল,
“বাবার জন্য আপনি কিছুই ছাড়েন নি৷ ছেড়েছেন নিজের স্বার্থের জন্য। নিজের উচ্চাকাঙ্খা পূরণের লোভ চেপে বসেছিল আপনার মাথায়। তাই তো দু’টো সুন্দর সংসার আপনি ভেঙে দিয়েছিলেন। আমার জীবনটাও শেষ করে দিতে যাচ্ছিলেন।”
(***)
লাবণিকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলেন রিজওয়ান কবির। গতকাল রাতে দেড়টায় কাপ্তাই থেকে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল আহি আর আফিফ। ভোর চারটা নাগাদ আফিফ আহিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। বাসায় পৌঁছে লাবণিকে দেখে গা জ্বলে উঠলো আহির। লাবণি রাতেই বাসায় ফিরে এসেছিলো। এদিকে আহি জোরে জোরে চেঁচিয়ে বাবাকে ডাকলো। আর রিজওয়ান কবির বেরিয়ে আসতেই সেই ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওটা বাবাকে দেখালো আহি। লাবণি ভাবতেই পারে নি আহি কিছু ভিডিও করে রাখবে। সে ভেবেছিল, আহি শুধু তাকে আর তাজওয়ারকে একসাথে দেখে ফেলেছিল, আর বাসায় এসেই এসব রিজওয়ান কবিরকে বলবে। এজন্যই বাসায় ফিরে রিজওয়ান কবিরের ব্রেইন ওয়াশের জন্য কি কি বলবে তা গুছিয়ে নিয়েছিল লাবণি। কিন্তু এখন তো সব উলটো হয়ে গেছে। আহি লাবণির ক্লান্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বাবাকে ফাঁসিয়ে আমার মায়ের সংসার ভেঙেছিলে। আমার বাবার মাথা খেয়েছো তুমি। কি ভেবেছিলে? কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে? বাবা জেনে গিয়েছিল তুমি কেমন মহিলা! তোমার এর আগের দুই প্রেমিকের সাথে করা লটরপটরগুলোর ছবি আরো আগেই বাবাকে দেখিয়েছিলাম। বাবা সব জানতো। আমি চেয়েছি, তোমার আর তাজওয়ারের প্রেমলীলাটাও বাবার সামনে নিয়ে আসি। এজন্য সময় চেয়েছিলাম তার কাছে। আর দেখো, সেই সুযোগটা নিয়ে একদম হাতেনাতে তোমাদের লীলা ফাঁস করে দিয়েছি। ভিডিওটা তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। তুমি আর তাজওয়ার খান বসে পপকর্ন খেতে খেতে দেখো। বাই।”
আহি কথাটি বলেই লাবণির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।
(***)
রিজওয়ান কবির চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। মুনিয়া খালা আহিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“এহন এই ঘরে ফেরেশতারা আইবো। আমার মা’টাও থাকবো।”
আহি মুনিয়া খালার হাতে আলতো হাত রেখে বলল,
“খালা, আমি আর এখানে থাকবো না। আমি ছেড়ে দিচ্ছি এই বাসা। সকালে আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে আমি চলে যাবো।”
চুনি আহির কাছে এসে বলল,
“তুমি যাইয়ো না আফা। আমার এখানে ভালা লাগে না একা একা।”
আহি চুনির থুতনি ধরে বলল,
“চাঁদনি, আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আছি। বেশিদূর কোথায়? এই শহরেই থাকবো। শুধু এই বাসাটা ছাড়ছি। তোর বিয়ে দেবো আমি। তোর স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব আমার। একটু সময় লাগবে শুধু।”
আহি সকালেই তার জিনিসপত্র নিয়ে মায়ের বাসায় চলে এলো। জিনিসপত্র ফ্ল্যাটে উঠিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাবে তখনই তাজওয়ারের কল এলো। আহি কল রিসিভ করতেই তাজওয়ার বলল,
“তোমার খুব সাহস বেড়ে গেছে দেখছি। তুমি এমনটা কেন করেছো? তুমি কি ভেবেছিলে, তোমার বাবা আমার ব্যাপারে জেনে গেলে আমাদের বিয়েটা হবে না? দেখো আহি, আমি কিন্তু তোমার বাবাকে ভয় পাই না। আর তোমাকে আমি যেকোন মূল্যে নিজের করেই ছাড়বো।”
আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি আমার বাবাকে ভয় পাও না, আর আমি তোমাকে ভয় পাই না। তোমার যা ইচ্ছে করো। কিন্তু শুধু শুধু এমন মিথ্যে স্বপ্ন দেখো না। শোনো, তুমি আমাকে এই জন্মে তো আর পাচ্ছই না। আর পরের জন্মে তোমার ঠিকানা কোথায় হবে, সেটা তুমি নিজেও জানো না। দেখা যাবে, সেখানে তুমি নিজের পাপের ক্ষমা চাইতে চাইতেই আধমরা হয়ে গেছো।”
আহি এই বলে কলটা কেটে দিল। তাজওয়ার দাঁত কটমট করতে করতে এবার আফিফকে কল করলো। আফিফ তাজওয়ারের কল ধরলোই না। উলটো মেসেজ পাঠিয়ে বলল,
“আমি আর আপনার কোম্পানিতে কাজ করছি না। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে কাজ ছাড়ছি, তাই আপনি আমার কাছ থেকে বিশাল অংকের টাকা পাবেন। আমি সেই টাকাটাও আপনাকে দিতে পারছি না। কিন্তু সেই টাকা না দেওয়ার জন্য আপনি আমার উপর কোনো মামলা করতে পারবেন না। যদি করেন তাহলে আপনার মানি লন্ডারিংয়ের সব তথ্য আমি ফাঁস করে দেবো। আশা করবো, আমার মত অসহায় মানুষের কাছ থেকে এত টাকা নিয়ে আপনার তেমন কোনো লাভ হবে না। আপনি এমনিতেই কোটিপতি। কিন্তু আপনার মানি লন্ডারিংয়ের সব তথ্য যদি আমি ফাঁস করে দেই, আপনাকে পথে বসাতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আর পরিশেষে ধন্যবাদ, আমাকে আপনার এসিস্ট্যান্ট বানানোর জন্য।”
তাজওয়ার আফিফের মেসেজ থেকে তব্ধা খেয়ে গেলো। রাগে তার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়েছে। সে ফোনটা জোরে ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো তাজওয়ারের ফোনটি। সবকিছুই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে। এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। আজ পর্যন্ত সে যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। ভবিষ্যতেও তাজওয়ার সেটাই চায়। সে যদি আহিকে না পায়, তাহলে আহির জীবনে দ্বিতীয় কোন পুরুষকে সে জীবিত রাখবে না। আর আফিফকেও তার অতীত মনে করিয়ে দিতে হবে।
১০৩।
এক সপ্তাহ কেটে গেলো। আফিফ খুব সূক্ষ্মভাবে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে জমিয়ে রাখা সব প্রমাণ সাজিয়েছে। আহি গেল সপ্তাহে তাজওয়ারের নামে হয়রানীর মামলা করে এসেছিল। সেই মামলা এখনো চলছে। এখন এই তথ্যগুলো দিলে, তাজওয়ার আরো কিছু মামলায় ফেঁসে যাবে। অন্যদিকে উজ্জ্বলও তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের ফাইলটি এখনো কোর্টে জমা দেয় নি। তাজওয়ারকে অন্য মামলায় ফাঁসানোর জন্য সাক্ষী খুঁজছে উজ্জ্বল। সাক্ষী পাওয়ার পর প্রমাণগুলো রাখবে। সাক্ষী ছাড়া প্রমাণ ভিত্তিহীন। সমস্যা ওই এক জায়গায়। তাজওয়ারকে সবাই এতো ভয় পায় যে কেউ সাক্ষী দিতেই আসে না। এদিকে আফিফ সব প্রমাণ তার ফাইলে ঢুকিয়ে আহিকে কল করে বলল,
“আহি, সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আজ সবগুলো উজ্জ্বলকে দিয়ে দেবো।”
আহির সাথে তাজওয়ারের বিষয়ে আরো কিছু কথা বলে কল কেটে দিলো আফিফ। এরপর ফাইলটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। আফিফ চলে যাওয়ার পর পদ্ম রুমে এলো। ড্রয়ার খুলে ফাইলটা বের করলো। এতক্ষণ সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আফিফ আহিকে যা যা বলেছে সব শুনছিলো।
পদ্ম ফাইলটা হাতে নিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“যদি তাজওয়ার ফেঁসে যায়, তাহলে আহি আর আফিফের জীবন থেকে সে সরে যাবে। আফিফ যেই ভয়ে আহিকে ছেড়ে এসেছিলেন, সেই কারণটা তাদের জীবন থেকে চলে গেলে, তারা তো আবার এক হতে চাইবে। এখন আফিফ জেনে গেছেন, আমি তাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছিলাম। উনি আমাকে এখন আর ভালোবাসেন না। আহি তো খুব সহজেই সেই জায়গাটা নিয়ে নেবে। যাকে পাওয়ার জন্য এতোকিছু করলাম, সেই মানুষটা যদি আমার হয়েও না হয়, তাহলে আমি তো হেরে যাবো। হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি তো ভালোবেসেছিলাম। আফিফ আমার ভালোবাসাটা দেখছে না কেন? থাক, না দেখুক। আমি বসে থাকবো না। রাদ আহিকে ভালোবাসে। আমি চাই, আহি রাদের সাথে ভালো থাকুক। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যদি তাজওয়ারকে না বাঁচাই, তাহলে আমি আফিফকে হারিয়ে ফেলবো। এখন তাজওয়ার খানই আমাকে সাহায্য করবে।”
পদ্ম ফোন বের করে তাজওয়ারকে কল করে আফিফের সংগ্রহ করা প্রমাণের ব্যাপারে সবটা জানালো। তাজওয়ার বলল,
“আমি তোমাকে ঠিকানা দিচ্ছি। তুমি প্রমাণগুলো নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো। তুমি তো জানো, আমার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। আমি বাসা থেকে বের হতে পারছি না। তাই তোমাকে আসতে বলছি।”
পদ্ম খুব সাহস নিয়ে ফাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার আগে আফিফা বেগম কয়েকবার ডাক দিয়েছিলেন পদ্মকে। পদ্ম শুনলো না। সে চলে গেলো দ্রুত পদে। আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলো তাজওয়ারের ফ্ল্যাটে। পদ্ম বেল দিতেই দরজা খুলে দিলো একটা ছেলে। পদ্ম তার দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার খান আছেন?”
তাজওয়ার ভেতর থেকে ডেকে বলল,
“পদ্ম, আসো ভেতরে।”
পদ্ম ভেতরে এসে বসলো। ফাইলটা তাজওয়ারের সামনে রেখে বলল,
“আফিফের কোনো ক্ষতি করবেন না। আহিরও কোনো ক্ষতি করবেন না। আমি আহির ভালো চাই। ও যার সাথেই ভালো থাকে, থাকুক। কিন্তু ও কখনো আফিফের সাথে ভালো থাকবে না।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“যার সাথে ভালো থাকে! আহি তো শুধু আমার সাথেই ভালো থাকবে। ইনফ্যাক্ট, আমিই আহির সাথে ভালো থাকবো।”
পদ্ম চুপ করে রইলো। তখনই দরজা খুলে দেওয়া ছেলেটি বসার ঘরে এসে বসলো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“হাই, আমি সজিব।”
পদ্ম মাথা নিচু করে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আচ্ছা, আমি এখন যাই।”
পদ্ম উঠে দাঁড়ালো। সে দরজার দিকে পা বাড়াতেই সজিব আর জিলান সোফায় আয়েশ করে বসে বলল,
“তাজ, মেয়েটা কে?”
তাজওয়ার ফাইলটি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলল,
“আফিফের বউ।”
সজিব বলল, “সেই তো!”
জিলান বলল, “রেখে দে না।”
তাজওয়ার ফাইল দেখা বন্ধ করে পদ্মের দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,
“সুযোগ যদি পায়ে হেঁটে আমার কাছে চলে আসে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কি বলিস?”
সজিব হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেটাই তো।”
তাজওয়ার জিলানকে ইশারা করতেই সে পদ্মকে পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে ভালোভাবে দরজা বন্ধ করে দিলো। পদ্ম দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দরজা আটকে দিলেন যে!”
জিলান বিদঘুটে হাসি হেসে বলল,
“তোমাকে মিষ্টি না খাইয়ে যেতে দিচ্ছি না।”
পদ্ম কয়েক পা পিছিয়ে তাজওয়ারের কাছে গিয়ে বলল,
“আমাকে দরজাটা খুলে দিন।”
তাজওয়ার হেসে বলল,
“নো। আজ রাতটা না হয় এখানেই থাকো৷ কাল যেও। আই প্রমিজ, তোমার আফিফ কখনোই আমার আহির হবে না। আমি হতে দেবোও না।”
পদ্ম ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি।”
“আমার কাছে?”
তাজওয়ার অট্টহাসি হেসে বলল,
“আমার নিজেরই তো সাহায্যের প্রয়োজন। তোমার সাহায্য। আহি তো আমার কাছে আসছে না। আর তাই আমার অন্যদিকে চোখ পড়ছে। তুমি এই মুহূর্তে আমাকে শান্ত করতে পারবে।”
তাজওয়ার পদ্মের কোমড় ধরে তার কাছে আসার চেষ্টা করতেই পদ্ম তাকে ধাক্কা দিয়ে অন্য রুমের দিকে দৌঁড়ে গেলো। কিন্তু পারলো না। জিলান পদ্মের উড়না টেনে ধরে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। সজিব আর তাজওয়ার তাকে টেনে নিয়ে গেলো পাশের রুমে। এরপর তিন বন্ধু ভেতরে ঢুকেই ধড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। আর এরপর পদ্মের ক্রন্দন বেঁধে গেলো চার দেয়ালের ফাঁকে।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১ (১ম ভাগ)||
১০৪।
বাসায় ফিরে পদ্মকে আশেপাশে কোথাও না দেখে রান্নাঘরে গেলো আফিফ। আফিফকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখেই আফিফা বেগম বললেন,
“তোর বউ আজকাল বড্ড বেড়ে গেছে দেখছি। আমার অনুমতি না নিয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোথায় গেছে?”
“তুই জানিস না? তার মানে তোকেও বলে যায় নি? মেয়েটার মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। শোন, তুই ওকে নিয়ে এতো মাথা ঘামাস না তো!”
আফিফা বেগম এবার ছেলের কাছে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটা মেয়ে দেখেছি আমি। বেশ পছন্দ হয়েছে আমার।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মা, প্লিজ। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমি আরেকটা বিয়ে করতে পারবো না।”
“তোর কি বাবা হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই?”
“বাবা হওয়ার জন্য আমাকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে?”
“পদ্ম কি তোকে সন্তান দিতে পেরেছে?”
“না পারুক। ও আমার স্ত্রী। আমার দায়িত্ব। যদি আমার কোনো অপারগতা থাকতো পদ্ম কখনোই আমাকে ছেড়ে যেতো না। আমিও আমার দায়িত্ব ফেলে দিতে পারবো না।”
“কে বলেছে পদ্মকে ছেড়ে দিতে? দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে হয় না।”
“মা, আমার সমান অধিকার দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। তাই আমি পদ্মের বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবো না।”
আফিফ কথাটি বলেই নিজের ঘরে চলে এলো। আজ সন্ধ্যায় উজ্জ্বলকে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে বাকী প্রমাণগুলো দিতে হবে। এজন্যই সে বাসায় এসেছে সেই ফাইলটি নিতে, যেটিতে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ আছে। কিন্তু বাসায় এসে পদ্মকে না দেখে বেশ অবাক হলো আফিফ। পদ্ম সম্পর্কে সব সত্য জেনে যাওয়ার পর থেকেই আফিফ পদ্মের কাছ থেকে দূরত্ব রাখছে। কিন্তু পাঁচ বছরের এই সংসারটা মিথ্যে দিয়ে শুরু হলেও একটা দায়িত্ববোধ আর মায়া তো সৃষ্টি হয়েছেই। আফিফ যেই ড্রয়ারে ফাইলটি রেখেছিল, সেটা খুলতে খুলতেই পদ্মের নম্বরে ডায়াল করলো। পদ্মের ফোনে রিং হচ্ছে। কিন্তু আফিফের মনোযোগ আঁটকে গেলো শূন্য ড্রয়ারে। আফিফ ব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে দেখলো কোথাও সেই ফাইলটি নেই। বেশ অবাক হলো সে। আজ সকালেই ফাইলটি সে ড্রয়ারে রেখে বাসা থেকে বের হয়েছিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি ফাইলটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সম্ভব? আফিফ তার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো পদ্ম কল ধরে নি। রিং হয়ে কেটে গেছে। আফিফ আবার কল করলো পদ্মের নম্বরে। এবার সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হলো। আফিফ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে পদ্মের চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো। পদ্ম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমাকে বাঁচান, আফিফ। আমি মরে যাবো।”
আফিফ ব্যস্ত কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে? কোথায় তুমি!”
পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তাজ….”
কথাটা শেষ করার আগেই পদ্ম চেঁচিয়ে উঠলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষের কন্ঠ স্বর। আফিফ কন্ঠ শুনেই চিনে ফেলেছে ওপাশের কণ্ঠটি কার। আফিফ চেঁচিয়ে বলল,
“সজিব ওখানে কি করছে পদ্ম? কোথায় তুমি? হ্যালো। হ্যালো।”
আফিফ এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। দৌঁড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আফিফা বেগম ছেলেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কি যে হচ্ছে তার ঘরে, কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।
(***)
আহি ছাদে দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়ায় দোলায়মান ডায়ান্থাস ফুলগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। তখনই তার পাশে দু’কাপ চা নিয়ে এসে দাঁড়ালো রাদ। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। রাদ চায়ের কাপ দু’টি ছাদের কার্নিশে রেখে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু বলবি?”
রাদ আহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার উড়ন্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“আমাকে আর তুই করে ডাকিস না। আমি এখন এই ইনফরমাল সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।”
আহির গলা কাঁপছে। মায়ের কথা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
“অন্তত একা থাকো, তবুও এমন কাউকে তোমার জীবনে রেখো না, যাকে ভালোবাসো না।”
আহি রাদের দিকে তাকালো। এতো ভালোবাসে কেন ছেলেটা তাকে? এই ভালোবাসা উপেক্ষা করলে তো পাপ হবে তার। সৃষ্টিকর্তা কেন যে তাকে মন ভাঙার ক্ষমতা দেয় নি!
রাদ আহির আরেকটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। আহি কিছুটা দূরে সরে যেতেই রাদ আহির হাতটা ধরে তাকে আটকালো। আহি বলল,
“রাদ, আমি তোকে…”
রাদ আহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল,
“আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস না। কিন্তু আমি তো বাসি। আমাকে একটু ভালোবাসতে দে। আই প্রমিজ, তুই একদিন আমার প্রেমে পড়বি।”
আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। গলায় কথা আটকে গেছে তার। এদিকে রাদ আহির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। রাদের নিঃশ্বাসের ধাক্কা আহির বুক কাঁপিয়ে দিয়েছে। না, এমন অন্যায় সে করতে পারে না। যেখানে তার মন-মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে না, সেখানে সে কীভাবে নিজেকে ঠেলে দিবে? হোক কষ্ট, কিন্তু সারাজীবনের অপরাধবোধ নিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারবে না। আহি রাদকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু বন্ধুর মতো। এমন না যে আমি অন্য একজনকে ভালোবাসতাম দেখে তোকে ভালোবাসতে পারছি না। যাকে ভালোবাসতাম, তাকে পাওয়ার কোনো আশা নেই আমার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একটু নিজেকে ভালোবাসতে চাই। তুই তো আমাকে গত কয়েক বছর ধরে দেখেছিস। আমার উন্মাদনা দেখেছিস। আমার এক তরফা পাগলামো দেখেছিস। বল না রাদ, তোর কি মনে হয় নি, আফিফকে ভালোবাসতে বাসতে আমি নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছি?”
রাদ চুপ করে রইলো। আহি রাদের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো আর বলল,
“আমার তোকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এখন আমি বিয়ে করবো না। আমি কিছু বছর নিজেকে দিতে চাই। একান্ত নিজেকে। এরপর না হয় ভেবে দেখবো।”
“যদি তখন আমি না থাকি?”
আহি রাদের কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“তুই যদি মুভ অন করিস, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“আমি বেঁচে থাকতে এই মনে তোর জায়গা কাউকে দিতে পারবো না।”
আহি রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ বলল,
“আমি যদি না থাকি! যদি ততোদিন না বাঁচি?”
“কি বাজে কথা বলছিস? আমার লাইফ-লাইন তুই। প্রেমিক পুরুষকে ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি গভীর আর শক্ত একটা মনের মতো বন্ধুকে ভালোবাসা। তুই জানিস, তুই আমার মেডিসিন। আমার জীবনে যদি তুই আরো আগে আসতি, আমি নিজেকে এতোটা নিঃস্ব ভাবতাম না। তোর মতো প্রেমিক পুরুষ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার তোর মতো চমৎকার একজন পুরুষের প্রেমিকা হওয়ার জন্য নিজেকে চমৎকার ভাবে সাজাতে হবে। সময় দিস কিন্তু।”
(***)
আহি চায়ের কাপে চুমুক দিতে না দিতেই ফোনে টুংটাং মেসেজ আসতে লাগলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ারের একাউন্ট থেকে কিছু ছবি আর ভিডিও এসেছে। আহি চায়ের কাপ নামিয়ে স্ক্রিন অন করতেই ভিডিওটা চালু করলো। রাদ পাশেই দাঁড়ানো। ভিডিওতে চলমান শব্দ কানে আসতেই রাদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহির যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। তার মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। রাদ আহির কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিন বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“মেয়েটা কি পদ্ম?”
আহির চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। রাদ আহির হাত ধরলো। আহির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“আমি একটা জলজ্যান্ত অভিশাপ, রাদ। আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাজওয়ার পদ্মের এতো বড় ক্ষতি করেছে! আমার খুব অস্থির লাগছে, রাদ। তাজওয়ার ফার্সার সাথে যা করেছে, ঠিক একই কাজ যদি পদ্মের সাথে করে? আমার ওকে থামাতে হবে। ওরা আমার সব প্রিয় মানুষগুলোকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়েছে। আমার মানুষগুলো সব আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শুধু ওই তাজওয়ার খানের জন্য। আই উইল কিল হিম।”
আহি ফোন হাতে নিয়ে ছাদ থেকে নামতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যেতে নিবেই তখন রাদ পেছন থেকে আহিকে ধরে ফেললো আর বলল,
“আহি, শান্ত হো।”
আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আর বলল,
“আমি এই মুখ নিয়ে পদ্মের সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? আমি ওর অপরাধী।”
আহি এলোমেলো ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। রাদও আহির পাশে বসেছে। ড্রাইভারকে তাজওয়ারের ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিতেই তারা সেদিকে রওনা হলো। এদিকে আফিফ অস্থির হয়ে আছে। সে তাজওয়ারকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, কিন্তু তাজওয়ার কল ধরছে না। সে সোফায় পা তুলে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলতে লাগল,
“এক দেশে ছিল এক বাঘ। তার ছিল এক বাঘিনী। বাঘিনী পড়েছে এক শেয়ালের প্রেমে। আর শেয়ালের বউ গাভী ফন্দি করতে এসেছে বাঘের গর্তে। বাঘ ছিল বেশ ক্ষুধার্ত। সে গাভীকে খেয়ে ফেললো। তাই বউকে বাঁচাতে শেয়াল আসছে ছুটে। বাঘিনীও শশব্যস্ত। বাঘের গর্তে শীঘ্রই পড়বে শেয়াল-বাঘিনীর পা। বাহ, চমৎকার এক মিলনায়তন হবে বাঘের বাড়িতে। গাভীর চামড়া গুলো মাটিতে খসে পড়েছে। রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। এবার শেয়ালের সেই শুকনো মুখটা দেখবে বাঘ। আর বাঘিনী আমার ফিরে আসবে বিড়ালের বেশে৷”
সজিব হেসে বলল,
“আহিকে হাতে আনার এতো চমৎকার প্ল্যান!”
“এবার কাজি এনে বিয়ে পড়ানোর পরই ভিডিও ডিলিট করবো। একবার আহি আমার হোক, তারপর আমি আহিকে বুঝিয়ে দেবো, আমার সাথে বেইমানি করার শাস্তি কি!”
(***)
আহি আর রাদ তাজওয়ারের ফ্ল্যাট বাড়ির কাছে আসতেই দেখলো, আফিফ পুলিশ নিয়ে সেখানেই এসেছে। আফিফকে দেখে থমকে গেলো আহি। আফিফ আহির কাছে দৌঁড়ে এসে বলল,
“তাজওয়ার পদ্মকে এখানে নিয়ে এসেছো। ওর ফোনের লোকেশন এখানে দেখাচ্ছে। আমি পদ্মকে ফোন করেছিলাম। ওর কন্ঠ শুনে মনে হয়েছে, ও বিপদে আছে। আমি তাজওয়ার খানকে মেরে ফেলবো, যদি ও পদ্মের গায়ে হাতও লাগায়।”
আহি নির্বাক তাকিয়ে আছে আফিফের দিকে। পুলিশ কন্সটেবল বাড়িতে ঢুকলো। আফিফও তাদের পিছু পিছু গেলো। আহি আর পা বাড়াতে পারছে না। রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তুই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওই তাজওয়ার জানোয়ারটাকে জিতিয়ে দিবি? এবার কিছু একটা করতেই হবে।”
আহির শুকনো মুখটা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে তাজওয়ারের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ালো আহি।
(***)
ফ্ল্যাটের দরজায় বার-বার ধাক্কা দিচ্ছে পুলিশের লোকেরা। তাজওয়ার পীপহোল দিয়ে তাদের দেখে নিলো। সজিব আর জিলান ভীত কন্ঠে বললো,
“আমরা তো শেষ।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“রিল্যাক্স গাইস, এই সামান্য কন্সটেবল আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। এরা বেশি হলে আমাকে থানায় নিয়ে যেতে পারবে। আর ভেতরে ঢোকানোর আগেই আমি মুক্ত। আর আমি মুক্ত হলেই তোরাও মুক্ত। এসব বস্তিবাসীদের মামলায় রাজার সিংহাসন কাঁপে না।”
তাজওয়ার দরজা খুলে দিতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ তাজওয়ারের নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলল,
“পদ্মকে এখানে কেন এনেছিস?”
পুলিশের এক কন্সটেবল আফিফ আর তাজওয়ারের হাতাহাতি থামিয়ে দিতেই আহি আর রাদ উপরে উঠে এলো। তাজওয়ার আহিকে দেখে বলল,
“মাই সুইটহার্ট, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম।”
আহি তাজওয়ারের কথায় পাত্তা না দিয়ে দৌঁড়ে ভেতরের রুমে চলে গেলো। আফিফও আহির পিছু পিছু ভেতরে গেলো। শুধু রাদ সেখানে দাঁড়িয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাজওয়ারের দিকে।
১০৫।
আহি আর আফিফ একসাথেই সেই বন্ধ দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মেঝেতে বিবস্ত্র পড়ে আছে পদ্ম। আফিফের পৃথিবীটা যেন সেখানেই থমকে গেলো। সামনে এগুনোর সাহস হলো না তার। সে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো। আহি ছুটে গেলো পদ্মের কাছে। গায়ের উড়না খুলে পদ্মকে পেঁচিয়ে নিলো। উড়নাটা পদ্মের ত্যক্ত শরীরটা ঢাকতে ব্যর্থ হলো। আহি পাশের বেডশিটটা টেনে নিয়ে পদ্মের গায়ে জড়িয়ে দিলো। পদ্ম কারো স্পর্শ পেয়ে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো। আহির মুখখানা দেখে বুকের ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো পদ্মের। আহি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। দৃঢ় স্বরে বলল,
“আল্লাহর কসম, ওই শয়তানকে আমি খুন করে ফেলবো।”
পদ্মের দৃষ্টি আটকালো আফিফের শুকনো মুখের দিকে। মানুষটা নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পদ্মের কষ্ট হলো খুব। এদের ঠকানোর শাস্তি পেয়েছে সে। কান্না করার অধিকার নেই তার। এটা মেনে নিতে বাধ্য পদ্ম। আহি পদ্মকে ছেড়ে তার দুই গালে হাত রেখে বলল,
“তুই আমার স্ট্রং গার্ল। মনকে শক্ত কর। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আফিফও আছে।”
আহি পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফকে দেখে বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো তার৷ পদ্মকে শক্ত করে ধরে রাখলো সে। মেয়েটা যদি ভুল কিছু করে ফেলে?
প্রায় মিনিট খানিক পর রুমের দরজায় খট করে শব্দ হলো। পদ্ম আহিকে শক্ত করে চেপে ধরলো। আফিফ উঠে দরজা খুলতেই একজন কন্সটেবল রুমে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ বলল,
“একজন মহিলা কন্সটেবল লাগবে এখানে।”
পুরুষ কন্সটেবলটি ফোন করে একজন মহিলা কন্সটেবলকে তাজওয়ারের বাড়ির ঠিকানা দিলো। সে না আসা অব্ধি পদ্ম ভেতরেই থাকবে। এদিকে আফিফ রুম থেকে বের হয়েই তাজওয়ারকে জোরে একটা লাথি দিলো। পুলিশ কন্সটেবলের লোকগুলো আফিফকে ধরে বলল,
“এই কাজ তো আপনার না।”
রাদ আফিফকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
“আফিফ, প্লিজ শান্ত হও। ঠান্ডা মাথায় এই জানোয়ারটাকে শাস্তি দিতে হবে। তুমি দেখো ওর মুখের দিকে। বিন্দুমাত্র ভয় নেই। কারণ ওর কাছে পাওয়ার আছে। ও জানে ও বেরিয়ে আসবে।”
আফিফ শক্ত মুখে বলল,
“ও যদি বের হয়, আমি ওকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলবো।”
প্রায় ঘন্টাখানেক পর পুলিশ তাজওয়ার, জিলান আর সজিবকে থানায় নিয়ে গেলো। মহিলা কন্সটেবলটি পদ্মকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। পদ্ম থম মেরে বসে আছে। সে উত্তর দিতে পারছে না। আফিফ বসার ঘরে পায়চারি করছে। হঠাৎ তার চোখ আটকালো মেঝেতে পড়ে থাকা আধপোড়া একটি কাগজের দিকে। আফিফ মেঝে থেকে কাগজটি তুলতে গিয়ে দেখলো এটা তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সংগ্রহ করা প্রমাণগুলোর একটি পৃষ্ঠা। আফিফ পাশেই ডাস্টবিন দেখতে পেলো। সেদিকে গিয়ে দেখলো আশেপাশে ছাই। ভেতরে পুড়ে যাওয়া সেই ফাইলটি। আফিফ কাগজটি হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করলো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। তখনই মহিলা কন্সটেবলটি বেরিয়ে এসে আফিফকে বলল,
“আপনার ওয়াইফ কিছুই বলছে না। উনি এখানে কীভাবে এলেন জিজ্ঞেস করেছি, সেটাও বলছে না। আমাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে হবে। বাড়ির গেটে, সিঁড়িতে, লিফটে সবখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো। আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রী এখনে শকে আছে।”
আফিফ মিনমিনিয়ে বলল,
“আর এই শক থেকে পদ্ম জীবনেও বেরুতে পারবে না।”
(***)
পদ্মকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে আহি। আফিফা বেগম এসব জানলে আরো ঝামেলা বাড়বে, তাই পদ্মকে ওখানে যেতে দেয় নি সে। পদ্মকে একটা রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আহি তার পাশে বসে বলল,
“কিচ্ছুই হয় নি তোর। তুই রেস্ট নে। দেখবি, একটু ঘুমালে ভালো লাগবে।”
পদ্ম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আফিফ রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই আহি উঠে বেরিয়ে গেলো। আফিফ দরজাটা আটকে দিয়ে পদ্মের পায়ের কাছে মেঝেতে বসলো। পদ্ম আফিফের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আফিফ হতাশ কণ্ঠে বলল,
“একটু আগেও মনে হচ্ছিল, তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য হয়তো আমিই দায়ী। কিন্তু এখন কি মনে হচ্ছে জানো? তুমি স্বেচ্ছায় নিজেকে ধ্বংস করতে তাজওয়ারের বাড়িতে গিয়েছিলে।”
পদ্ম আফিফের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে নিলো। আফিফের গলা কাঁপছে। চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে। সে পদ্মের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“অতীত সবার থাকে। আমারও ছিল। তুমি আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছো, মানলাম। একদিন হয়তো সব ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু এতো বড় প্রতারণা! এটা তো আগের চেয়েও বেশি সাংঘাতিক। পাগল না-কি তুমি, পদ্ম? কাকে বিশ্বাস করেছো? তোমার ছোটবেলার বান্ধবীকে তুমি বিশ্বাস করতে পারলে না? তোমার কি মনে হয় মেয়েটা তোমার সংসার ভাঙবে? আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? যার সাথে পাঁচ বছর সংসার করেছো, সেই মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? কাকে বিশ্বাস করতে গেলে? ওই তাজওয়ার খানকে? কতো মানুষের প্রাক্তন থাকে! আহির সাথে তো আমার কোনো প্রেমের সম্পর্কই ছিল না। শুধু একটা অনুভূতি ছিল, যেটা তুমি আর তাজওয়ার খান মিলে শেষ করে দিয়েছো। আমি তো তোমার সাথে সুখী হতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে, পদ্ম?”
পদ্ম বিছানা ছেড়ে উঠে আফিফের সামনে এসে মেঝেতে বসে বলল,
“শাস্তি হয়ে গেছে আমার। আমাকে তালাক দিয়ে দিন। আমি চলে যাই আপনার জীবন থেকে। এক কাজ করুন, আমাকে বিষ এনে দিন। আমি খেয়ে মরে যাই। আপনাকে ভালোবাসার শাস্তি পেয়েছি আমি। আপনাকে বেঁধে রাখার শাস্তি পেয়েছি আমি। আহি যেমন আপনার ভালোবাসায় ছাই হয়ে গেছে, আমিও হয়ে গেছি। আমার পুরো শরীর থেকে এখন পোড়া গন্ধ বেরুবে। আহির মতো টাকা নেই আমার। বাবার গাড়ি-বাড়ি নেই। আপনি ছেড়ে দিলে আমার ঠিকানা হবে রাস্তায়।”
আফিফের দমবন্ধ হয়ে এলো। সে পদ্মের হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে ছাড়বো না, পদ্ম। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না আমি।”
(***)
তাজওয়ার নিজেকে এক ঘন্টার মধ্যে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার প্রমাণ করে দিলো সে কতো ক্ষমতাবান পুরুষ। আহি ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তাজওয়ার ছাড়া পেয়েই আহিকে মেসেজ লিখেছে,
“কবুল বলবে, না-কি ভিডিও ভাইরাল করবো? এখন তো শুধু গুটি কয়েক মানুষ জানে। তখন পুরো পৃথিবী জানবে। আমার কাছে চ্যানেল আছে কিন্তু। লাইভ টেলিকাস্ট করতেও সমস্যা হবে না।”
আহি আফিফকে মেসেজটা পাঠালো। আফিফ সাথে সাথেই আহিকে কল করে বলল,
“এই দেশে ওর শাস্তি হবে না। ওকে মেরে…”
আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার মাথায় এমন একটা বুদ্ধি এসেছে, যেটা তাজওয়ারকে ফাঁসাবেও, আর তার পাওয়ারটাও আর কাজ দেবে না।”
“কি বুদ্ধি?”
“দেখা করো। উজ্জ্বলও আসবেন। সেখানেই বলি।”
পরদিন আফিফ, উজ্জ্বল আর আহি একসাথে বসলো। আহি তার বুদ্ধিটা আফিফ আর উজ্জ্বলকে শোনালো। আফিফ বলল,
“তুমি এতো বড় রিস্ক নিবে?”
“নিতে হবে। আমি চাই না পদ্মের ব্যাপারে কেউ জানুক। তাই আমি এই কাজটা করবোই।”
আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে এই কাজ করতে দেবো না। তুমি জানো, এটা কতো বড় ডিসিশান? তোমার ভবিষ্যৎ থেমে যাবে।”
“কিছুই হবে না আমার। আমার ভবিষ্যৎ থেমে গেছে অনেক আগেই। এখন আমি আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। যা হওয়ার আজ হবে। আমার জীবনে আগামীকালের কোনো অস্তিত্বই নেই। আর আমি যা করছি পদ্মের জন্য না। আমার নিজের জন্য। তাজওয়ারের ফাঁদে ফেঁসে যাওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্য। ভবিষ্যতে ওর হাত থেকে আরো অনেক মেয়েকে বাঁচানোর জন্য।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১ (২য় ভাগ)||
১০৬।
উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আফিফ তার পথ আটকে ধরে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো, তুমি কি করতে যাচ্ছো?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমি বুঝেশুনেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“আমি পারবো না তোমাকে এই কাজে সাহায্য করতে।”
আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“ঠিক আছে। তোমাকে যেতে হবে না। উজ্জ্বল আমাকে সাহায্য করবেন।”
আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “মানে?”
“মানে! তুমি না করলে উজ্জ্বল করবেন।”
আফিফ ধমকের সুরে বলল, “আহি!”
আফিফ কপালে কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি বলল,
“তুমি কেন আমাকে বাঁধা দিচ্ছো? আমার জন্য তোমার এতো চিন্তা কেন? আমাদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? তুমি তো পদ্মের হাসবেন্ড। তোমার উচিত তোমার বউকে নিয়ে মাথা ঘামানো।”
আফিফ আর আহি এক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ চোখ সরিয়ে নিতেই আহি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। চোখ ছলছল করছে আহির। রাগও হচ্ছে বেশ। সাহায্য তো করবে না, আবার ধমকাচ্ছেও? আহি আফিফকে পাশ কেটে চলে যেতে নিবে তখনই আফিফ বলল,
“দাঁড়াও, আহি।”
আহি বলল, “যা বলার বলে ফেলো।”
“উজ্জ্বলকে কিছু বলো না। আমি থাকবো তোমার সাথে। কাজটা আমিই করবো।”
আহি আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যাবে, কখনোই ভাবি নি। কোথাও একটু শান্তি পাচ্ছি না।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যেখানে আমি আছি সেখানে শান্তি নেই। চিন্তা করো না, খুব শীঘ্রই তোমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাবো।”
কথাটি বলেই আহি চলে গেলো। আর আফিফ এখনো সেই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আহির কথাটা তার মনে ভীষণভাবে আঘাত করেছে। সে শূন্য দৃষ্টিতে আহিকে রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখছে। ভাগ্য এতোটা নির্মম বিচার কি করে করলো তার সাথে? এভাবে কি আক্ষেপে সারা জীবন কাটানো সম্ভব? এখনি দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বাকী জীবন কীভাবে কাটাবে?
পুরুষ মানুষের কোনো দমবন্ধ করা অনুভূতি থাকতে পারে না। অনুভূতি লুকিয়ে রাখা তাদের বৈশিষ্ট্য। আর আফিফ তো অনেক বছর আগেই অনুভূতি লুকোনো শিখে ফেলেছে।
(***)
বাসায় এসেই তাজওয়ারকে কল করলো আহি। তাজওয়ার ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। আহির নম্বরটি দেখে তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করে বলল,
“মাই ডিয়ার সুইটহার্ট, আমি তোমার কলের অপেক্ষায় ছিলাম।”
আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তুমি পদ্মের ভিডিওগুলো ডিলিট করে দাও।”
তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“এটা কোনো কথা হলো? আমি তোমার সামনে একটা শর্ত রেখেছি। ভুলে গেছো?”
“হ্যাঁ, মনে আছে। আর আমি রাজি আছি। আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”
তাজওয়ার নড়েচড়ে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে বিয়ে করবে, আহি?”
“হ্যাঁ, করবো। কিন্তু আমার ভালোবাসা তুমি কখনো পাবে না।”
তাজওয়ার হেসে বলল,
“তোমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। আমি তো তোমাকে চাই, আহি। ভীষণভাবে চাই।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বিয়েটা গোপনে হলে ভালো হবে। আমি মাকে এই ব্যাপারে কিছু জানালে, মা অনুমতি দেবে না। আর বাবা তো তোমাকে সহ্যই করতে পারে না।”
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। তুমি চিন্তা করো না। আমি কাউকে জানাচ্ছি না। একবার বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর না হয় ধীরেসুস্থে সবাইকে জানাবো।”
আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি যা করেছো, এরপর তোমার বাংলোতে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তুমি আমার ফ্ল্যাটে এসে সব ব্যবস্থা করো। আর তোমার সো কল্ড বন্ধুদের নিয়ে আসবে না, প্লিজ।”
“সাক্ষী তো লাগবে, তাই না?”
“তুমি অন্য কাউকে জোগাড় করো। তোমার বন্ধুদের মুখও দেখতে চাই না আমি।”
আহি এই বলে কল কেটে দিলো। এরপর ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“তাজওয়ার কি বিশ্বাস করতে পেরেছে, আমি ওকে বিয়ে করবো?”
(***)
পদ্ম সামনের বারান্দায় বসে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেদিনের মুহূর্তটি, যেদিন খানস গ্রুপে চাকরি পাওয়ার পর আফিফ তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। সেদিন আহিও সেই রেস্টুরেন্টে সালমা ফাওজিয়ার সাথে গিয়েছিলো। পদ্ম সেদিন আহিকে দেখেই বেশ অবাক হয়েছিলো। আফিফ বিয়ের পর পদ্মকে নিয়ে খুব একটা ঘুরতে বের হতো না। পদ্ম অভিমানী মুখে বসে থাকলে, আফিফ তাকে নিয়ে বের হতে বাধ্য হতো। সেদিনও পদ্ম অভিমান করে ছিল, তাই আফিফ তাকে নিয়ে বের হয়েছিল। একান্ত সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল তার আফিফের সাথে। বাসায় আফিফা বেগমের জন্য আফিফের পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আর এমনও তো নয় যে চার বছরের সংসারে আফিফ তাকে সময় দেয় নি। এটা শুধু দায়িত্বের জন্য কাছে আসা। সেই কাছে আসায় পদ্ম কখনোই ভালোবাসা খুঁজে পায় নি। পদ্মের এজন্যই আহির প্রতি নিরব ক্ষোভ ছিল। মুখে ভালোবাসি বললেও, সে কখনোই চায় নি আহি দেশে ফিরে আসুক। সংসারের অজুহাতে পুষ্প, লিনাশার সাথেও যোগাযোগ রাখে নি সে৷ শুধু আফিফকে হারানোর ভয়টাই ছিল তার মনে। অন্যদিকে তাজওয়ার আহি কি করে, কোথায় যায়, এসব খবরাখবর রাখার জন্য লোক নিয়োগ করেছিলো। তারাই আফিফ আর আহির একই সাথে মাস্টার্স করার খবরটা তাজওয়ারকে অনেক আগেই দিয়েছিল। আর তাজওয়ার এজন্যই আফিফকে তার কোম্পানিতে কাজ দিয়েছিল, যাতে কাজের চাপে আফিফ ক্লাসে যেতে না পারে। আর পদ্ম ছিল আহির জীবনের নীরব ঘাতক। সে আহিকে বার-বার আফিফের সামনেই এআরের কথা মনে করিয়ে দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল,
“যাকে তুই ভালোবেসেছিস, সে আমার স্বামী। আমার সংসার। যেখানে তোর ভালোবাসা ভিত্তিহীন।”
পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি, সেদিন রেস্টুরেন্টে তোর সাথে দেখা হওয়ার পর আমি ইচ্ছেকৃত ভাবেই তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই এআরের সাথে এসেছিস না-কি? আমি তো জানি এআর, আর আফিফ এক। আমি তোকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, তুই কতোটা একা। বোঝাতে চেয়েছি, তোর এআর আমার ভালোলাগার কতোটা গুরুত্ব দেয়। আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি অনেক। তুই যদি রাদকে ভালোবেসে ফেলতি, আমি তোকে কষ্ট দিতাম না। কেন আমি তোর চোখে আফিফের প্রতি ভালোবাসা দেখেছি? কেন দেখেছি? তোর স্মৃতি উনার মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলার জন্য আমি উনাকে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম স্ত্রীর অধিকার তোর উন্মাদ ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। হ্যাঁ, আহি। আমি ঠিক ছিলাম। অনেক বেশি শক্ত এই সম্পর্ক। কিন্তু এমন একটা সম্পর্ক, যেখানে শুধু দায়িত্ববোধ আছে। সেই অনুভূতি আমি খুঁজে পাই নি, যেই অনুভূতির কথা উনি বইয়ে তোর জন্য লিখেছিল। আমি জানি আফিফ তোকে ভালোবাসে। কিন্তু ওভাবে ভালোবাসে না, যেভাবে তুই ভালোবেসেছিস। তোরগুলো প্রকাশিত। তুই করেছিস। আমরা দেখেছি। সেই চারুশিল্পের প্রতিটি ইট-পাথর তোর ভালোবাসার সাক্ষী ছিল হয়তো। কিন্তু আফিফ কিছুই করে নি। শুধু অনুভব করেছে। আর তার প্রমাণ সেই বইটি। আমি খুব ভয় পেতে লাগলাম, যখন জানলাম তুই আর উনি একই সাথে মাস্টার্স করছিস। দিন-রাত অস্বস্তিতে কেটেছে আমার। ইচ্ছে করে খাবার নিয়ে তোদের ক্যাম্পাসে চলে আসতাম। উনাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম। তোকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, আফিফ শুধু আমার মানুষ। তুই এসব দেখে কাঁদতি। খুব কষ্ট পেতি। আর আফিফ কি করতো জানিস? মানুষটা মুষড়ে পড়তো। আমার হাতের খাবার গলা দিয়ে নামতো না তার। আমি জোর করে খাইয়ে দিতাম। ভীষণ কষ্ট পেতো তোর জন্য। আমি সহ্য করতে পারতাম না তার কষ্ট। চার বছরের সংসারে আমার প্রতি ভীষণ সম্মান ছিল তার। যত্ন নিতো আমার। সত্যিই মানুষটা অনেক ভালো রে। কিন্তু আমাকে ভালোবাসে নি। তোর ছবিটা দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। তোর জন্য কবিতা লিখেছে। কিন্তু সেই রঙ মাখিয়ে কখনো আমাকে তার ক্যানভাসে তুলে নি। কারণ তার মস্তিষ্কেই শুধু আমি ছিলাম। মনে তো তুই জায়গা করে নিয়েছিস। বিয়ের পর আমাকে কখনো হানিমুনে নিয়ে যায় নি। গিয়েছিল, তোর জন্য। আবার সেদিনের বাসরটাও কেন ছিল? শুধু তোকে বোঝানোর জন্য, যে তিনি আমার সাথে সুখে আছেন। তার মনে তো ঝড় বয়ে যাচ্ছিল সেদিন। রাদ আর তোকে একসাথে দেখে একদম ভেঙে পড়েছিলেন। কেন আহি? কেন এমন হলো আমার সাথে? তোর উন্মাদনা না জেনেই শুধু চিরকুট পড়ে উনি তোকে এতোটা ভালোবেসেছে। যদি কখনো জেনে যায়, তুই কি কি করেছিস, তখন তো আমাকে ফেলে চলে যাবে উনি। আমার কষ্ট হবে খুব। আমিও তো ভালোবেসেছিলাম। এখনো ভালোবাসি। হয়তো আমার ভালোবাসা আদায় করার ধরণটা ভুল ছিল। কিন্তু ভালো আমিও বেসেছিলাম।”
(***)
ঘর্মাক্ত শরীরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল বাজাচ্ছে আফিফ। প্রায় পাঁচ মিনিট পর দরজা খুলে গেলো। আফিফ সামনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আহি আফিফের চাহনি দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসো।”
আফিফ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“কি পরেছো এটা?”
আহি বিরক্ত মুখে বলল, “শাড়ি!”
“সেটা তো আমিও দেখতে পারছি, কিন্তু এটা কেমন শাড়ি?”
“তাজওয়ার দিয়েছে।”
“আহি, তুমি কোনো ভালো শাড়ি পরে এসো। এমন পাতলা শাড়ি পরে তুমি….”
আহি আফিফকে থামিয়ে দিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“আমি জানি আমাকে কি করতে হবে।”
আহি সোজা নিজের রুমে চলে এলো। আফিফও তার পিছু পিছু এলো। এরপর আহি সিঁড়ি বের করে আফিফকে ফলস স্লাবে উঠে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে উপরে উঠে গেলো। ফলস স্লাবের ভেতরে ঢুকে ক্যাটডোরটি হালকা খোলা রাখলো। আহি সিঁড়িটা সরিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর আবার কলিংবেল বেজে উঠলো। আহি দরজা খুলতেই উজ্জ্বল ঘরে ঢুকলো। উজ্জ্বল সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি এই শাড়িটা পরো না।”
আহি বলল, “তাজওয়ার পাঠিয়েছে।”
“ওর কথা শুনতে হচ্ছে কেন?”
আহি প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আপনি কেন এসেছেন? আপনার তো বাইরে অপেক্ষা করার কথা!”
“আমি বারান্দায় থাকবো। পাশের রুমের বারান্দাটা খুলে দাও। তোমাকে ওই শয়তানের সাথে একা ছাড়ার সাহস নেই আমার।”
“আফিফ তো আছেই।”
“ও যেখানে আছে, ওখান থেকে সরে গেলেই তো সমস্যা। ভিডিওটা তো ও-ই করবে।”
আহি উজ্জ্বলকে পাশের রুমের বারান্দাটা খুলে দিলো। এরপর বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে চাবিটা জানালা দিয়ে উজ্জ্বলের হাতে দিয়ে বলল,
“তাজওয়ার যদি বারান্দায় আসতে চায়? এই নিন, চাবিটা রাখুন। ওদিক থেকেও খোলা যাবে।”
“তোমার কাছে চাবি চাইলে?”
“বলবো, এটা মায়ের রুম। চাবিটা মায়ের কাছে।”
হঠাৎ বেল বেজে উঠলো। আহি রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে এসে পীপহোলে তাকিয়ে দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। আহি দরজা খুলে দিলো। তাজওয়ার আহিকে দেখে বাঁকা হেসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই লোকটা কে?”
তাজওয়ার পাশের লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরেহ, ইনি তো আমাদের বিয়ে পড়াবেন।”
আহি তাজওয়ারকে বলল,
“আগে তুমি আসো। উনাকে বাইরে দাঁড়াতে বলো।”
তাজওয়ার লোকটাকে ইশারায় বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে ঢুকে গেলো। তাজওয়ার ভেতরে ঢুকতেই আহি জোরে দরজা বন্ধ করে দিলো। তাজওয়ার আহির রাগ দেখে বাঁকা হাসি হেসে বলল,
“এতো রাগ!”
আহি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। তাজওয়ারও আহির পিছু পিছু এসেছে। আহি বলল,
“কি খাবে? শরবত না-কি কফি?”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আমার জন্য তুমি শরবত বা কফি বানাবে? ইন্টারেস্টিং!”
“দেখো এতো সাসপেন্স রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি আমাকে শর্ত দিয়েছো। তাই আমি তোমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে চাইছি। আর তোমার খেতে ইচ্ছে না করলে আমি কিছু বানাবো না। আমার কোনো ইচ্ছেও নেই।”
তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“কেন বানাবে না? অবশ্যই বানাবে। এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাবো।”
আহি তাজওয়ারের সামনেই শরবতটা বানালো। তাজওয়ার আহির সামনে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস শরবত শেষ করে ফেললো। আহি আগে থেকেই চিনির সাথে নেশাদায়ক ট্যাবলেট গুঁড়ো করে রেখেছিল। নায়ীব থেকেই নিয়েছে সে ট্যাবলটটি। তাজওয়ার যাতে তাকে সন্দেহ না করে, তাই আগে থেকেই এমন ব্যবস্থা করে তাজওয়ারের সামনেই শরবত বানিয়েছিল। এবার আহি বসার ঘরে এসে বলল,
“আমাকে ভিডিওগুলো দাও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তোমাকে আমি ভিডিওগুলো দিয়ে দেবো, আর তুমি আমাকে বিয়েই করবে না!”
আহি বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আমার উপর বিশ্বাসটা রাখো। কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমি জানো, আমি কেমন মেয়ে! আর আমিও জানি তুমি কেমন মানুষ। তুমি নিজেই ভেবে দেখো, কার প্রতারণা করার সম্ভাবনা বেশি।”
“যদি তুমি ভিডিওগুলো দেওয়ার পর আমাকে বিয়ে করতে না চাও?”
“তাহলে তুমি আমার জোরাজুরি করো। সেদিন যেই ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারো নি, তা করে নিও। আজ আমি মরতে যাবো না।”
তাজওয়ার হাসলো। আহির প্রস্তাবটা তার পছন্দ হলো। সে ঘরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। সব রুমে ঢুকলো, বারান্দায়ও উঁকি দিলো। আহির রুমের পাশের রুমটির বারান্দার সামনে গিয়ে বলল,
“দরজা বন্ধ!”
“হ্যাঁ, বারান্দার দরজা বন্ধ করেই তো গিয়েছি। আমরা তো এখনো এই ফ্ল্যাটে উঠি নি।”
“তোমার রুমেরটা তো খোলা!”
“কারণ আজ সারাদিন আমি রুমেই ছিলাম। বারান্দায় গিয়েছি। খোলা তো থাকবেই।”
“এই বারান্দার চাবি কোথায়?”
“মায়ের কাছে। এটা মায়ের রুম।”
“তাহলে রুমের দরজা খোলা কেন?”
“বারান্দার দরজা আটকে রাখি। যাতে কোনো অঘটন না ঘটে।! যাতে চোর-ডাকাত আসতে না পারে। রুমের দরজা কেন বন্ধ করবো? বারান্দা দিয়ে আসতে না পারলে, রুমে ঢুকবে কীভাবে?”
তাজওয়ার জানালা খুলে উঁকিঝুঁকি মারলো। উজ্জ্বল একপাশে পা তুলে বসে রইলো। তাজওয়ার তাকে দেখলো না। তাজওয়ার এবার আহির রুমে গেলো। জিনিসপত্র ঘাঁটতে লাগলো। আহি বলল,
“কি খুঁজছো?”
“দেখছি কোনো সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছো কি-না! তুমি তো আবার ক্যামেরা নিয়ে ঘুরো।”
আহি রাগী স্বরে বলল,
“যা করার করো, আগে আমাকে পদ্মের ভিডিওগুলো সব দাও।”
তাজওয়ার আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। আহি তাজওয়ারের ফোন থেকে পদ্মের ভিডিওগুলো ডিলিট করে ফেললো। আহি বলল,
“আর কোথায় আছে?”
“আমার ফোনেই ছিল, আহি। এই ফোন থেকেই ভিডিওটা রেকর্ড করেছিলাম। নতুন ফোন কিনেছিলাম। বেশ ভালো ভিডিও হয়। এই ভিডিও আর কোথাও নেই। আমি জানতাম, এই ভিডিও থাকলে তুমি আমার কাছে আসতে বাধ্য হবে। আমি তো এজন্যই পদ্মের ভিডিও করেছি। নয়তো তুমিই বলো, পদ্ম তো তোমার বান্ধবী, আমার বোনের মতো।”
আহি চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ। একদম চুপ। বোনের মতো বলে বোনদের অপমান করো না। তুমি কারো ভাই হওয়ার যোগ্য না। আর তোমার মতো অসভ্য মানুষকে আমি কখনো বিয়ে করবো না।”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“রিয়েলি? বাসায় কিন্তু কেউ নেই। আমি তোমাকে ছাড়বো না, আহি।”
“তোমার সেই সাহস নেই। তুমি আহিকে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখো না।”
“চ্যালেঞ্জ করছো আমাকে?”
আহি বাঁকা হেসে বলল, “চ্যালেঞ্জ করছি।”
(***)
তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তাজওয়ার আহিকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। আহি সরে যেতেই তাজওয়ার আরো হিংস্র হয়ে উঠলো। আহির শাড়ির আঁচল ধরে টেনে তাকে পেছন দিকে থেকে জড়িয়ে ধরলো। আহিকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল,
“আজকে তোমাকে আমি নিজের করেই ছাড়বো, আহি।”
আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো। তাজওয়ার আহির গলায় কামড় বসিয়ে দিতেই আহি চিৎকার করে উঠলো। উজ্জ্বল আহির চিৎকার শুনে চাবি ঘুরিয়ে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকলো। এদিকে আহি গলা চেপে ধরে রেখেছে। তাজওয়ার আহির শাড়ির আঁচল টেনে ধরতেই তার মাথায় জোরে টেবিল ঘড়ি ছুঁড়ে দিলো উজ্জ্বল। তাজওয়ার মাথায় হাত দিয়ে আহির উপর থেকে উঠে আসতেই ভিডিও করা বন্ধ করলো আফিফ৷ চোখ লাল হয়ে গেছে তার। চোখ বেয়ে গরম অশ্রুজল বেরিয়ে পড়লো নিঃশব্দেই। ঘামে ভিজে গেছে তার পুরো শরীর। ফলস স্লাবের দেয়ালে গাঁথা পেরেকের উপর সব রাগ ঝেড়েছে সে। তাই রক্ত বেয়ে পড়ছে তার হাত থেকে। আফিফকে ফলস স্লাবে উঠানো হয়েছে ভিডিওটা ভালোভাবে ধারণ করার জন্য৷ কারণ আহি জানে তাজওয়ার এমন কিছু করার আগে পুরো ঘরে ক্যামেরা আছে কি-না তা দেখে নেবে। তাই ক্যামেরা লাগানোটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আহি জানে এই ভিডিও ধারণ করার ক্ষমতা উজ্জ্বল বা আফিফের থাকবে। কারণ তারা খুবই ধৈর্যশীল। রাদকে এই কাজ দিলে ভিডিওটা কখনোই সম্পূর্ণ করা যেতো না। তাই সে তার পরিকল্পনাটা আফিফ আর উজ্জ্বলকেই শুনিয়েছে। যদিও আফিফ কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। কিন্তু আহির কথা শুনে বাধ্য হলো।
(***)
তাজওয়ার পেছনে ফিরে দেখলো পুষ্পের কাজিন, উজ্জ্বল দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার উজ্জ্বলকে দেখে কিছু বলতে যাবে উজ্জ্বল তার আগেই তাজওয়ারের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। ফলস স্লাবের দরজা খুলেই ক্যামেরাটা সেখানে রেখে লাফিয়ে নিচে নামলো আফিফ। মেঝেতে পড়ে থাকা তাজওয়ারকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো সে। উজ্জ্বল একনজর আহির দিকে তাকালো। আহি কোনোভাবে শাড়ি ঠিক করে উঠে বসলো। উজ্জ্বল তা দেখে তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে টেনে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে এলো। তাজওয়ারের নেশা চড়তে শুরু করেছে। শরীর দুর্বল হয়ে গেছে তার। শরবতের প্রতিক্রিয়া এখন ধীরে ধীরে হচ্ছে। তাই সে উঠে উজ্জ্বলের উপর পাল্টা আক্রমণ করতে পারলো না। এদিকে আহি বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই শাড়ির কুঁচি আটকে মেঝেতে পড়ে যাওয়ার আগেই আফিফ তাকে ধরে ফেললো। আহির উন্মুক্ত কোমড়ে আফিফের হাতের স্পর্শ লাগতেই আহির পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। এদিকে আহির চোখে জল দেখে আফিফের বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। আজ সব বাঁধা যেন আফিফ নিজেই কাটিয়ে দিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আহিকে। আফিফের এমন প্রতিক্রিয়া আহিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছে। আফিফের শরীরের কম্পন অনুভব করতে পারছে আহি। আহির খুব ইচ্ছে করছে আফিফকে জড়িয়ে ধরতে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,
“আমাকে কি এভাবে তোমার সাথে বেঁধে রাখা যায় না? তোমাকে একটুখানি স্পর্শ করার লোভে কতো রোদ-ঝড় উপেক্ষা করে তোমাকে ভালোবাসতে গিয়েছিলাম। তোমাকে স্পর্শ করার ব্যর্থতায় তোমার আদলে ভাস্কর্য বানিয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম। তুমি তো কখনো আমাকে ছুঁয়ে দাও নি। আমাকে সেই সুযোগটাও দাও নি। আজ কেন, এআর? কেন আমার হৃদয়ে ঝড় তুলছো? আমি তো তোমাকে ভালোবেসে বড্ড ভাবে কলঙ্কিত হয়েছি। এখন আমাকে স্পর্শ করে কেন আমার কলঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিচ্ছো? তোমার এই স্পর্শ হয়তো আরো কয়েক যুগ তোমাকে আমার মনে বেঁধে রাখবে।”
আফিফ আহিকে ছেড়ে দিলো। তার চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে। আহি দেখলো আফিফের হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে তোমার হাতে?”
আফিফ আহির গলায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া কামড়ের দাগটির দিকে তাকিয়ে আহির চোখের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“হাতে ব্যথা পেয়েছো কীভাবে?”
আফিফ আহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। আহি বলল,
“আফিফ..!”
আফিফ আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি শাড়িটা পালটে এসো। ক্যামেরাটা ফলস স্লাবে রেখে এসেছি।”
কথাটি বলেই আফিফ বেরিয়ে গেলো। আফিফ বেরুতেই আহি দরজা আটকে দিলো। বুকে হাত রাখলো সে। এরপর নিজের শরীর আঁকড়ে ধরলো সে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আহি। মিনমিনিয়ে বলল,
“মেঘ। তুমি আমার কাছে মেঘ হয়েই থেকে গেলে, আফিফ। তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়া মানেই হারিয়ে ফেলা। আর আজ আমি তোমাকে সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছে, আর মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর তোমাকে আমি আর কখনো দেখবো না। কেউ যদি একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতো আমার শেষ ইচ্ছে, আমি আমার প্রতিটা ইচ্ছেতেই তোমাকে চাইতাম। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো, আমার স্বপ্ন সম্পর্কে। আমি বলতাম, আমার সব স্বপ্ন তোমার মাঝেই এসে থেমে যায়।”
(***)
উজ্জ্বল পুলিশ ডেকে আনলো। তাজওয়ারকে আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। আহি সেদিনই তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করে এলো। প্রতিবারের মতো এবারও তাজওয়ার সুস্থ হয়ে থানায় এসে হাজির হলো। পুলিশকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো। আর এই সুযোগটার অপেক্ষায় ছিল আহি। সেদিন রাতেই আহি রুমের দরজা বন্ধ করলো। তার ফোনের ক্যামেরাটা স্থির ভাবে বসিয়ে লাইভে এলো। লাইভ অন হতেই জয়েন হতে লাগলো একজন, দুইজন করে প্রায় কয়েকশো জন। আহির অশ্রু, গলায় কালসিটে দাগ, ঠোঁটের ফোলা অংশ আর বিমর্ষ মুখখানা দেখে এই লাইভটি শেয়ার হলো কয়েকশো বার। ভিউয়ার্স বাড়তে লাগলো। কমেন্টে আসতে লাগলো একটাই বাক্য,
“তাজওয়ার খানের শাস্তি চাই।”
আহি আনমনে হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“যার বিচার আদালতে হয় না। যার বিচার আইন করে না। তার বিচার জনগণ করবে। মিস্টার তাজওয়ার খান, যেই ক্ষমতার বলে দিয়ে তুমি আইন কিনে নিয়েছো, আমি তোমার সেই ক্ষমতা মিডিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তোমার শাস্তি এবার হবেই। এখন কোনো আইন, কোনো শাসক, কোনো মন্ত্রী তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমি বলেছি না, আমি বেঁচে ফিরলে তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো। শুভ দিন এসে গেছে। আজ রাতেই তোমার পা চাঁটা অন্ধ ভক্তরাই তোমাকে বন্দি করবে।”
পরদিন সকালে রাদ আর লাবীব ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আহির ন্যায়বিচারের জন্য সমাবেশ করলো। লিনাশা-নায়ীব, পুষ্প বিভিন্ন পেশার মানুষকে নামিয়ে দিলো ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশে। মিডিয়ায় রাতারাতি ছড়িয়ে পড়লো ঘটনা। গণমাধ্যমের শিরোনামে এলো আহির সেই লাইভ ভিডিও। অস্পষ্টভাবে ছাড়া হলো সেই ভিডিওটি, যেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে তাজওয়ার আহিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। আদালতে উঠলো মামলা। তাজওয়ারকে গ্রেফতার করা হলো আরো আগেই। আহির পক্ষে উকিল হলো উজ্জ্বল। বিচারকের সামনে প্রমাণস্বরূপ রাখা হলো ভিডিও। সাথে দেওয়া হলো তাজওয়ারের অন্য সব অবৈধ কাজের প্রমাণ। কয়েক সপ্তাহ মামলা ঘুরে রায় হলো কয়েক বছরের কারাদণ্ডের। আহি আপিল করলো। তাজওয়ারের জন্য এই কারাদন্ড কিছুই না। তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হোক। এবার সাক্ষী হলো ফার্জিয়া, আর ফার্সার ভাইরাল ভিডিও, এবং আরো কিছু নির্যাতিত নারী। পদ্ম পরিচয় গোপন করে নিজের অত্যাচারের অংশটুকু কর্তৃপক্ষকে শোনালো। যদিও সে আফিফের চাপাচাপিতেই বাধ্য হয়ে এই কাজ করেছে। শেষমেশ কয়েক মাস মামলা চালিয়ে তাজওয়ারের মৃত্যুদন্ডের রায় দেওয়া হলো। এই পুরো সময়টা জুড়ে মিডিয়া আর সাধারণ মানুষ আহির পক্ষে আন্দোলন করে গেছে।
কোর্ট থেকে বের হয়ে আহি রাদের মুখোমুখি হলো। রাদ শক্ত করে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ সেখানেই দাঁড়ানো। রাদকে আহির কাছে আসতে দেখে শুকনো হাসলো সে। যেই হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না। শুধু সমঝোতা ছিল। বাস্তবতার সাথে সমঝোতা। উজ্জ্বল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আহির জয়ে অনেক খুশি সে। নিজের শেষ কেইসে জয়ের চেয়ে বেশি শান্তি পাচ্ছে আহির চোখে হাসি দেখে। অল্প সময়েই মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল মেয়েটা। এই মায়া কাটানো অসম্ভব। আহি সাধারণ মেয়েদের থেকে ভিন্ন। অসাধারণ একটা মেয়ে। ভাগ্যবান কেউই, আহিকে জীবনসঙ্গী করে পাবে। হয়তো সেই ভাগ্যবান পুরুষ রাদই হওয়ার ছিল।
তাজওয়ারকে কোর্ট থেকে বের করে আনা হলো। তাকে এখান থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। তাজওয়ার আহিকে দেখে থেমে গেলো। সে একনজর রাদ আর আহির আবদ্ধ হাতের দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,
“আমি ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোনো প্রেমিক পুরুষ থাকবে না, আহি। আমি তোমাকে ভালোবেসে কারাবন্দী হয়েছি। আমি অমর হয়ে যাবো। আমি ইতিহাস লিখবো। এক রাজা তার রানীর জন্য.. ওপস। গল্পটা এখনো শেষ হয় নি, আহি। এর শেষ অংশটা আমিই লিখবো।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||আংশিক পর্ব||
১০৭।
মিষ্টি রঙের শাড়ি পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো আহি। কপালে একটা কালো টিপ পরলো। তখনই তার রুমে ঢুকলো নীল জামদানি পরা চুনি। আহি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ভীষণ সুন্দর লাগছে চুনিকে। একদম চাঁদের মতো। তাই হয়তো মেয়েটা নিজেই নিজের নাম রেখেছে চাঁদনি।
এক সপ্তাহ হচ্ছে চুনি আর মুনিয়া খালা সালমা ফাওজিয়ার বাসায় এসেছে। এখন থেকে তারা এখানেই থাকবে। এখান থেকেই চুনিকে বিদায় দেবেন মুনিয়া খালা।
আজ চুনির আংটি বদল আর আক্দ অনুষ্ঠান। চুনির বিয়ে হচ্ছে আহিরদের বাড়ির দারোয়ান, মোজাম্মেল চাচার ভাইয়ের ছেলের সাথে। ছেলে বর্তমানে প্রবাসী। ওখানে ভালোই আয় হচ্ছে তার। চুনিকে বিয়ের কয়েক বছর পর নিয়ে যাবে বলছে। কয়েক মাস হলো ছেলেটা সেখানে গেছে। গিয়েই তিন মাসের ছুটিতে এসে বিয়ে করছে চুনিকে। চুনির বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই আহি নিজের খরচে জমকালো আয়োজনে চুনিকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আহির সামনে এসে দাঁড়ালো চুনি। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বলল,
“আফা, ভালা লাগতেছে আমারে?”
আহি চুনির গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ভীষণ ভালো লাগছে। শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে?”
“পছন্দ হইবো না? এত্তো সুন্দর একখান শাড়ি।”
চুনি আহির ড্রেসিংয়ের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“দেখছো আফা, সাজাইছে আমারে ভালা কইরা। কত্তো সুন্দর কইরাই না সাজাইছে! আমি আগে কখনো সাজি নাই এরকম কইরা।”
আহি চুনির চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“তুমি এখন থেকে খুব সাজবে। তোমার বর ভীষণ ভালো। আমি কথা বলেছি তার সাথে। মনে হচ্ছে, তোমাকে ভালো রাখবে। ছোট্ট সংসার হবে তোমার। তুমি ভালোই থাকবে। আর মোজাম্মেল চাচা বলেছেন, তোমার জন্য দিদারের চেয়ে ভালো কেউই হবে না।”
“আফা, আমার বরের নাম দিদার?”
“কেন তুমি জানো না?”
“বারেকই তো হুনছিলাম।”
“দিদার বারেক।”
চুনি এক গাল হেসে বলল,
“কি সুন্দর নাম আফা! আমি ছবি দেখছি শুধু। না, না, ছবি তো রোজ দেহি। আমি তো তারে দূর থেইকাও দেখছি। আমার দিকে তাকাইয়া হাসছিল। কি সুন্দর হাসি, আফা! আম্মা আমারে দেহা করতে দে নাই। কইছে বিয়ের পর করিস দেহা। তুমি কও আফা, একটু কথা হইলে ভালো হইতো না?”
“সমস্যা কোথায়? আজ না হয় বলবে।”
“আজ ক্যান? আগে ক্যান না? তুমি তো কথা কও ভাইজানের লগে! আমি কেন পারবো না?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ভাইজান!”
“ওই যে এখানে আহে, চিকন কইরা, শিং মাছের মতো শরীলডা।”
আহি হাসলো। শব্দ করেই হাসলো। হাসতে হাসতে বলল, “রাদ?”
“হ, আফা। ভাইজান রে কইয়ো না আবার এইডা। ভাইজান কিন্তু ওই শয়তানডার থেইকা ভালা আছে।”
“রাদ তো আমার বন্ধু।”
“ক্যান? তোমাদের বিয়ে হইবো না?”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চুনির প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই আহির কাছে। রাদকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু তার মনটাই তো সায় দিচ্ছে না এই সম্পর্কে। জোর করে একটা সম্পর্ক শুরু করলে আহি শুধু কষ্ট পাবে। রাদকেও কষ্ট দেবে। জীবনের সাথে অনেক সমঝোতা করেছে সে। বাস্তবতা মেনে অনেক কিছুই ত্যাগ করেছে। কখনো নিজের কথা ভাবে নি। এবার একটু মনের কথা শুনবে আহি। তার মন যেখানে আটকাবে, সেখানেই পা বাড়াবে সে। আর এই মুহূর্তে আহির মন-মস্তিষ্ক জুড়ে বিরাজ করছে জীবনের একটা গতি। তার নিজের জন্য কিছু করা। তার স্বপ্ন পূরণ করা। ভালোবাসা, বিয়ে এসব থেকে সে দূরত্ব রাখতে চাইছে আপতত। যখন সময় হবে তখন আবার না হয় ভেবে দেখবে।
(***)
সন্ধ্যায় চুনির আংটি বদল আর আক্দ সম্পন্ন হলো। ঘরোয়া ভাবেই আয়োজন হয়েছে। ছাদে ছেলে পক্ষের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এদিকে আজ লাবীবের বাবা-মা পুষ্পের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছেন। সেই প্রস্তাব কতোটুকু এগিয়েছে তা শোনার জন্য চুনির শ্বশুড় পরিবারের সবাইকে বিদায় দিয়েই আহি পুষ্পকে ফোন করলো। পুষ্প কল রিসিভ করেই মলিন মুখে বললো,
“আহি, গণ্ডগোল হয়ে গেছে।”
“কি? আংকেল-আন্টি রাজি হয় নি?”
“বাবা হয়েছিল। কিন্তু মা আবার উল্টে গেছে। লাবীবের বাবা-মার সামনে কতো সুইট ছিল। আর এখন?”
“সমস্যাটা কি!”
“সমস্যা একটাই, চাকরি! মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয় নি ওর। ও তো ওর আংকেলের বিজনেস ধরেছে আমাকে বিয়ে করার জন্য। মা বলছে এসব বিজনেসম্যান না-কি ভালো লাগে না তার।”
“এই মুহূর্তে চাকরি তো হবেও না। সময় তো লাগবে। ও তো ইন্টারভিউ দিচ্ছে।”
“হুম। আচ্ছা, তোর কোম্পানিতে একটা কাজ দিয়ে দে না, আহি।”
আহি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“আমি এখনো বাবার কাছ থেকে কোম্পানিটা নেই নি।”
“জানি। কিন্তু ওটা তোর কোম্পানি। আই মিন তোর দাদা তো সব কিছু তোর নামেই করে দিয়েছেন। লাবীবকে একটা পজিশন দিলে, হয়তো মা রাজি হয়ে যাবে। আফটার অল, তোর কোম্পানিটা বাংলাদেশের টপ কোম্পানির মধ্যে একটা। নাম আছে বেশ। ওই কোম্পানির এমপ্লয়ি হওয়াটাও অনেক বড় ব্যাপার।”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি এসবের কিছুই বুঝি না এখনো। আমাকে কিছুদিন সময় নিয়ে বুঝতে হবে। আমি তো মাত্র কয়েকদিন হলো ওখানে যাচ্ছি। বাবাও না-কি যায় না ওখানে। বাবা কোম্পানি থেকে নিজের অংশ সরিয়ে ফেলেছে। এখন কোম্পানি ডাউন পজিশনে আছে। তবে ম্যানেজার আংকেল খুব ভালো। আমি উনার সাথে কথা বলে লাবীবকে একটা কাজ দিয়ে দেবো। আর আমি যদি কোম্পানির পুরো দায়িত্বটা নেই, তাহলে লাবীবকে আরো ভালো পজিশন দিতে পারবো। ও তো অনার্সে ভালো গ্রেট পেয়েছে। ওর এক্সপেরিয়েন্সও ভালো। একটা কাজ কর। তুই সময় নে। কয়েক মাস তো অপেক্ষা করা যায়৷ মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হবে সামনে। এরপর তুই নিজেও তো চাকরি খুঁজবি। বাসায় বলে রাখ, আরেকটু সময় লাগবে।”
“হুম, আচ্ছা, তুই কি অন্য কিছু করবি না? শুধু কোম্পানির দায়িত্বটাই নিবি?”
“হুম, দেখি। আমার যদি ভাই থাকতো, তাহলে ও সামলাতে পারতো সব। এখন তো আমাকে বাধ্য হয়েই এসব দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার স্বপ্ন তো আর্টিস্ট হওয়া। সব গুছিয়ে আমি ওদিকেই মনোযোগ দেবো। আর তুই চিন্তা করিস না। আমি আন্টির সাথে কথা বলবো। লাবীব পড়াশোনায় অতো খারাপ ছিল না। ইউকে তো ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল ওর৷ পড়াশোনায় তো ও রাদের চেয়েও ভালো। দেখিস, আমি আন্টিকে রাজি করিয়ে ফেলবো।”
চলবে-