#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৮||
৯৭।
বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে আহি। তার দৃষ্টি আটকে আছে ফোনের স্ক্রিনে। আহির হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সালমা ফাওজিয়া। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে?”
আহি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে অবিশ্বাস্য হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মা, তুমি ভাবতেই পারবে না কি হয়েছে!”
“কি হয়েছে, বলো!”
“তাজওয়ার আর একটা মেয়ের….”
আহি কিছুক্ষণ থেমে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তাজওয়ারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এখন ওর মান-সম্মান সব শেষ। আমার খুব শান্তি লাগছে।”
তখনই আহির ফোনে উজ্জ্বলের কল এলো। আহি সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে বলল,
“নিউজ দেখেছেন!”
উজ্জ্বল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু এই কাজটা করলো কে?”
“ওর কি শত্রুর অভাব আছে?”
“আর যাই বলো! যে করেছে, তার খুব সাহস আছে। তাজওয়ারের মতো কঠোরভাবে প্রাইভেসি মেইনটেইন করা ছেলের ভিডিও ভাইরাল হওয়া সহজ কথা না। ওর বাসা, এক্সট্রা ফ্ল্যাট, বাংলো বাড়ি সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। বাইরের কেউ এই কাজ কখনোই করতে পারবে না। ওর কাছের কেউ এই ভিডিও করেছে।”
আহি হেসে বলল,
“যেই করেছে, ভালো করেছে। এখন অন্তত ওর দাম্ভিকতা কমবে। খুব তো অহংকার তার! আমাকে সবার সামনে নিজের ফিয়োন্সে হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য মিডিয়া নিয়ে এসেছিলো। এখন সেই মিডিয়া থেকেই পালাবে।”
(***)
রুমের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে তাজওয়ার। কোনোভাবেই তাকে আটকানো যাচ্ছে না। চাকর-বাকর জড়োসড়ো হয়ে তার রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রেহানা খান ছেলের হাত ধরে রেখেছেন। তাজওয়ার মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“কেউ আমাকে থামানোর চেষ্টা করবে না।”
রেহানা খান ছেলের চিৎকারে কেঁপে উঠলেন। দোয়েল ভেতরে ঢুকে রেহানা খানকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। রাগের মাথায় তাজওয়ার কি না কি করে বসে, বলা তো যায় না। কারণ তাজওয়ার আজ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। নিজের পরাজয় মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এতো বছর সে মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলেছে, আর আজ তার সম্মানে এতো বড় প্রশ্ন! যদিও এটা কয়েক বছর পর সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু সাময়িক সময়ের জন্য সে দশজনের সামনে দাপট দেখিয়ে চলতে পারবে না। তাকে মিডিয়ার আড়ালে থাকতে হবে। তাজওয়ার গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“যে এই কাজ করেছে, আজ তার শেষ দিন।”
তাজওয়ার ড্রেসিংয়ের ভাঙা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাঙা কাচ তাজওয়ারের চেহারা ধারণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত, আর তাজওয়ারের মস্তিষ্ক ব্যস্ত সেই মানুষটিকে খুঁজতে যে তার এতো বড় ক্ষতি করেছে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তিনটি মুখ। আফিফ, লাবীব অথবা রাদ। নিশ্চয় এদের তিনজনের মধ্যে কেউ এই কাজ করেছে। তাজওয়ার চেয়ারে শান্ত হয়ে বসলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
“সেই কালো হেলমেট পরা ছেলেটিই এই কাজ করেছে। আর সে আফিফ ছাড়া কেউ না।”
তাজওয়ারের ভাবনার মাঝে তার রুমের দরজায় কড়া নাড়লো আফিফ। তাজওয়ার রুমের দরজার কাছে আফিফকে দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আফিফ বিনয়ের সুরে বলল,
“আসতে পারি, স্যার?”
তাজওয়ার তেড়ে এসে আফিফের কলার ধরে তাকে রুমে ঢুকিয়ে তার নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। আফিফ সেকেন্ড খানিক মেঝেতে অচেতন হয়ে ছিল। সেকেন্ড খানিক পর আফিফ মাথা তুলে বলল,
“স্যার, আই এম সরি। আজ আমার ডিউটি ছিল, তাই এসেছি।”
তাজওয়ার আফিফের বুকে লাথি মেরে তাকে আবার মেঝেতে শুইয়ে দিলো। এবার সে আফিফের বুকে পা রেখে বলল,
“আমার সাথে এমন কেন করেছিস? প্রতিশোধ নিয়েছিস, তাই না?”
আফিফ ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
“স্যার, আপনার মতো দুঃসাহস আমার নেই। তবে আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য বিন্দুমাত্র আফসোস নেই আমার। হয়তো আল্লাহ আপনাকে শাস্তি দিয়েছেন।”
তাজওয়ার কথাটি শুনেই আফিফের মুখ সজোরে একটা লাথি দিলো। এরপর আফিফকে ছেড়ে আলমারি খুলে তার পিস্তলটি বের করল। আফিফ কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে সন্দেহ হওয়ার কারণ কি, স্যার?”
তাজওয়ার পিস্তলে গুলি ভরে আফিফের দিকে পিস্তল তাক করে বলল,
“কারণ তুই আমার প্রথম শত্রু।”
আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
“শত্রু তো আপনি। আপনি আমার আপার ক্ষতি করেছেন, আমার ছোট বোনের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছেন। আর আমার…..”
আফিফ থেমে গেলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তোর কি? হুম, বল? ডোন্ট সে, আহি তোর ভালোবাসা। আহি শুধু আমার। আর শোন, আমি তোকে আহির কাছে যেতে দেই নি, এটা ঠিক। কিন্তু তুই চাইলে আহির কাছে যেতে পারতি। তুই কি জানতি আহি তোকে কতোটা ভালোবাসতো? শুধু চিরকুট পড়েছিস। বাকিটা জানিস? এক তরফা ভালোবাসার সব সীমা অতিক্রম করেছে আহি, শুধু তোকে ভালোবেসে। ও তোর জন্য কি কি করেছে, তা আমি দেখেছি। আর যতোবার দেখেছি, ঠিক ততোবার তোকে খুন করতে ইচ্ছে করেছিল। কারণ আহির ভালোবাসা শুধু আমি ডিজার্ভ করি। আর কেউ না।”
আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। তাজওয়ার আফিফের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল,
“তুই যদি জানতি, নিশ্চয় আহিকে ফিরিয়ে দিতি না। তুই কি জানতি তোর ফিরিয়ে দেওয়ার পরও আহি তোর অপেক্ষায় ছিল?”
তাজওয়ার কথাটি বলে হাসলো। আফিফের কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সে আরো শব্দ করে হাসছে। হাসতে হাসতে জোরে জোরে তালি দিচ্ছে। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার দুই হাতের উপর ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মুখ ঘুরিয়ে নিতেই তাজওয়ার বলল,
“পদ্মকে ভালোবেসেছিলি?”
পদ্মের নাম শুনে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হেসে বলল,
“যদি বলি, তোর পদ্মফুল সব জানতো।”
আফিফ অবাক দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হেসে বলল,
“পদ্মফুল নামটা কেন দিয়েছিস বল তো? ফুলের মতো পবিত্র, তাই?”
তাজওয়ার কথাটি বলে আবারও হাসতে লাগলো। আফিফ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“পদ্ম এই বিষয়ে কেন আসছে?”
তাজওয়ার উঠে বসে বলল,
“পদ্ম আসবে না? পদ্মই তো আমাকে…..”
তাজওয়ার থেমে গেলো। উঠে আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়া’র। আহি আফিফকে ভালোবাসে। কিন্তু তাজওয়ার ভালোবাসে আহিকে। পদ্ম আফিফকে ভালোবাসে, কিন্তু আফিফ ভালোবাসে… কাকে? হুম?”
আফিফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্ম কি করেছে?”
“ইউজ ইউর ব্রেইন, আফিফ।”
তাজওয়ার সেকেন্ড খানিক থেমে বলল,
“ওপস, তুই বাঁচলেই তো ব্রেইন ইউজ করবি। তুই আমার এতো বড় ক্ষতি করে পার পেয়ে যাবি?”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ইউজ ইউর ব্রেইন ঠু। যেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেই ভিডিওটা রেকর্ড করার জন্য, বা ক্যামেরা সেট করার জন্য কি একবারো আমি আপনার সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম?”
তাজওয়ার থেমে গেলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো হ্যারির মুখটি। হ্যারি গিয়েছিল সেদিন রাতে। আবার সকালেই এসেছিল নাস্তা নিয়ে। অর্থাৎ এসব হ্যারি করেছে? তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ বলল,
“আপনি সিসিটিভি ফুটেজ দেখুন, আমি ওই বাড়ির আশেপাশেও যাই নি।”
তাজওয়ার কিছুই বললো না। তার পিস্তলটি বিছানা থেকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাজওয়ার চলে যেতেই আফিফ হালকা হাসলো। কিন্তু তার হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। তার মাথায় এই মুহূর্তে শুধু একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সেটা হলো,
“পদ্ম কি করেছে, যার জন্য তাজওয়ার ওর নাম নিলো? পদ্ম কী জানতো?”
৯৮।
মেঝেতে শুয়ে আছে পদ্ম। শরীর-মন কিছুই চলছে না তার। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে আহির নম্বর। পদ্ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই নামটির দিকে। তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, একটি নাম। খেয়ালী। না, ভাবতে পারছে না পদ্ম। ফোনটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে। ধাক্কা খেয়ে ফোনটি দরজার কাছে গিয়ে থামলো। তখনই রুমে ঢুকলো আফিফ। আফিফকে দেখে পদ্ম উঠে বসলো। ব্যস্ত হাতে চোখ মুছলো। মেঝেতে পড়ে থাকা পদ্মের ফোনটি হাতে নিলো আফিফ। স্ক্রিনে আহির নাম দেখে সে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম আমতা-আমতা করে বলল,
“মাথা ব্যথা করছিল তাই।”
আফিফ নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলো। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে পদ্মের সামনে এসে দাঁড়ালো। পদ্ম উঠে দাঁড়াতে যাবে, তখনই আফিফ তাকে বসতে বললো। সে নিজেও পদ্মের সামনে পা গুটিয়ে বসলো। পদ্ম ভীত চোখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ পদ্মের চোখের দিকে তাকালো। পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
আফিফ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আহির ফোন ধরছিলে না কেন?”
“খেয়াল করি নি।”
“পদ্ম, তুমি হয়তো কিছু জানো, যা আমি জানি না। আমাকে বলো প্লিজ।”
পদ্মের চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার কি আফিফকে সব জানিয়ে দিয়েছে? আফিফ পদ্মের হাত স্পর্শ করে বলল,
“আমি তোমাকে চিনতে ভুল করি নি তো!”
পদ্ম আফিফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি, আফিফ। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
“ভালো তো সবাই বাসে। কারো ভালোবাসা সুন্দর, আর কারোটা কুৎসিত।”
পদ্ম উঠে দাঁড়াতে যাবে তখনই আফিফ পদ্মকে শক্ত করে চেপে ধরলো। পদ্ম বলল,
“আমাকে মেরে ফেলুন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”
“এজন্যই এই কয়েকদিন বেশ ভয়ে ছিলে, তাই না? যখন জানতে পারলে আহি আর তাজওয়ারের বিয়ে হবে না, তখন থেকেই তুমি খুব চিন্তিত। নিজের বান্ধবীর ক্ষতি করার মতো মেয়ে তো তুমি নও, পদ্ম।”
“আমি আহির কোনো ক্ষতি করি নি।”
“তাহলে কেন তুমি তাজওয়ারকে ভয় পাচ্ছো? লিনাশা, পুষ্প ওদের চোখে তো সেই ভীতি নেই। তাহলে তোমার চোখে কেন এতো ভয়?”
পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ পদ্মকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“আমি চাইলে নিজেই সব তথ্য বের করতে পারতাম। কিন্তু তখন আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যেতো। এখন নিজেই সত্যটা বলো। তোমার মুখ থেকেই সব জানতে চাচ্ছি। বলো, প্লিজ।”
পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“ভালোবাসি আপনাকে। ভীষণ ভালোবাসি। আমি কিছু করি নি।”
“পদ্ম প্লিজ।”
পদ্ম কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি জানতাম আহি আপনাকে ভালোবাসে। আপনিও আহিকে ভালোবাসতেন, তাই না?”
আফিফ চুপ করে রইলো। পদ্ম দেয়ালে লাগানো আহির সেই ছবিটির দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“এক্সিভিশনে যেই মেয়ের ছবি এঁকেছেন, মেয়েটা আহি ছিল। আপনাকে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল ও। আমার বান্ধবীর ছবি আমি চিনবো না? পড়েছি আপনার সেই নামহীন বইটা। বিয়ের আগেই পড়েছিলাম। যেদিন জানলাম, আহির সেই এআর আপনি, সেদিন আমার কেমন লেগেছে আপনাকে বোঝাতে পারবো না। কতোবার আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আপনার দৃষ্টি শুধু এই দেয়ালের ফ্রেমে আটকে থাকতো। আহিকে ভালোবাসতেন আপনি। এই সত্যটা সহ্য হয় নি আমার। বিয়ের আগেই আমি অনেকবার আপনার ঘরে এসেছিলাম। মিষ্টি, নাস্তা এসব দেওয়ার বাহানায় আপনাদের বাসায় চলে আসতাম। ভীষণ ভালোবাসতাম আপনাকে। যেদিন টেবিলে আপনার সেই বইটি পেলাম, দম বন্ধ হয়ে এসেছিল আমার। আমি জানতাম, আপনি আমাকে কখনোই খুঁজবেন না। এই ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখটিকেই খুঁজবেন। তাই আমি আপনাকে আহির ব্যাপারে জানাই নি। আহি প্রতিদিন ক্লাস শেষে আপনার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার খুব অস্থির লাগতো। যদি আপনি আহিকে দেখে ফেলেন? যদি জেনে যান, মেয়েটা কে? যাকে না দেখে এতোটা ভালোবাসলেন, তাকে জেনে গেলে কি পাগলের মতো ভালোবাসতেন না?”
আফিফের চোখ লাল হয়ে আসছে। সে এক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“বইটি পড়ে জেনেছি, আপনার আপার সাথে যা হয়েছে সেসবের জন্য কোনো না কোনো অংশে আহি দায়ী। তাজওয়ার খানই এসব করেছে। রেনুকেও নিয়াজীর সাথে বিয়ে দেওয়ায় তার হাত ছিল। তাজওয়ার খান ভেবেছিল, রেনুকে হাতে রাখলে আপনি আর আহির কাছে যাওয়ার সাহস পাবেন না। কিন্তু আমি তো জেনে গেছি সব। আমি জানতাম, আপনি আহিকে পাওয়ার জন্য, রেনুকে সেই সম্পর্ক থেকে বের করে আনতে চাইছিলেন। আমি ভয় পেয়ে যাই। যদি একবার রেনু নিয়াজীর বাড়ি থেকে চলে আসে, আর আপনি যদি জেনে যান, আহি তখনো আপনার অপেক্ষায় ছিল, আমার হয়তো আপনাকে আর পাওয়ায় হবে না।”
আফিফ থমথমে কন্ঠে বলল,
“তাই তুমি মাকে বুঝিয়েছো, রেনুর উপর হওয়া অন্যায়ের কথা আমাকে জানালে, আমি রেনুকে নিয়ে আসবো। তুমি আমার বোনটাকে সেই জাহান্নামে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস থাকতে বাধ্য করেছিলে?
পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
” না, না। মা নিজেই আপনার উপর এতো চাপ ফেলতে চান নি। আমি তো নিষেধ করি নি। শুধু এইটুকু বলেছি, আমাদের সংসার তো চলছে না। রেনুর তিনটা সন্তান, আফিফ কীভাবে চালাবে? যদি রেনু সন্তান রেখে আসে, তাহলে তো সহজ হবে।”
“আর তুমি জানো, রেনু কখনো নিজের সন্তানদের ওই বাড়িতে রেখে আসবে না।”
পদ্ম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
“এজন্যই হয়তো আমি কখনো মা হতে পারবো না। আমার পাপের শাস্তি আমি পেয়ে গেছি, আফিফ। আমাকে ছেড়ে দিবেন না। আমি সহ্য করতে পারবো না।”
“তাজওয়ারকে তুমি কি বলেছিলে?”
“আপনি এখনো আহিকে ভালোবাসেন। বইটাতে যা ছিল, সব বলেছি।”
“কি লাভ হলো এসব করে?”
“এরপরই তাজওয়ার আপনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলো। বললো, যদি আপনি একমাসের মধ্যে কাউকে বিয়ে না করেন, তাহলে আহির সাথে সেই একই কাজ করবে, যেটা আপনার আপার সাথে করেছিল। আপনিও ভয় পেয়ে গেলেন। বিয়ের জন্য মাকে বোঝালেন। আমিও সুযোগ পেলাম। আপনার সামনে বার-বার চলে আসতাম। কথা বলতে চাইতাম। আগেও এমনটা করতাম। কিন্তু তখন আপনি বুঝেন নি। শুধু প্রতিবেশীই বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তাজওয়ার আপনাকে চাপ দেওয়ার পর, আপনি আমাকে খেয়াল করলেন। আপনার মনে হলো, আমি আপনার যোগ্য। আপনার শূণ্য হাত ধরার ক্ষমতা আমার আছে। আপনার ভেঙে যাওয়া মনটা জোড়া লাগানোর ক্ষমতাটাও আমার হাতে। এরপর কি সুন্দর করেই না আপনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এরপর মাকে বোঝালেন। কিন্তু মা রাজী হলেন না। তিনি তো সেই ফোন কলের ওপাড়ে থাকা মেয়েটিকেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছিলেন। তবে তাতে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এতো ভালোবাসার পরও আপনাকে পাওয়ার ক্ষমতা আহির ছিল না, অথচ আমার হলো। আর এর চেয়ে বড় জয় তো কোনো কিছুতেই নেই। আর এরপর তো আপনি তাজওয়ারকে দেখানোর জন্য কাজী অফিসে গিয়ে আমাকে বিয়ে করলেন। আর এরপর ধীরে ধীরে আমি আপনার মন থেকে আহিকে বের করে নিজের জায়গাটা করে নিলাম।”
(***)
আফিফ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। পদ্ম তার সামনে বসা। আফিফের চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। পদ্ম তা মুছে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আফিফ তার হাত আটকে দিয়ে বলল,
“ভালোবেসে বিয়ে করি নি। কিন্তু তোমাকে ভালো মেয়ে ভেবেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। আমি তো ঠকে গেছি, পদ্ম।”
“না, আফিফ। আমি এতোটাও খারাপ না।”
“তুমি রেনু আর আহির কথা ভাবলে না? এটা কেমন সম্পর্ক!”
“আমার চেয়ে কি এখন আহি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো? আমি আপনার স্ত্রী। আহি কেউ না।”
“রেনু আমার বোন। আহি কেউ হোক না হোক। অন্যায় তো করেছো তুমি। আমার বিশ্বাসটা ভেঙে দিয়েছো।”
“আমি আপনাকে সত্য বলেছি। আপনি একটু আগে কি বললেন, আমি সত্য বললে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে না।”
আফিফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল,
“তুমি আমাকে ঠকিয়েছো। পদ্মফুল নাম দিয়েছি তোমার! ফুল ভেবেছি তোমাকে। আর তুমি অপমান করেছো আমাকে।”
আফিফ উঠে দাঁড়াতেই পদ্ম আফিফের পা ধরে বলল,
“আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে, আমি নিজের প্রাণ নিয়ে নেবো।”
“নীরবে নীরবে তো তুমি অনেকের প্রাণ নিয়ে নিয়েছো। তুমি তো তাজওয়ারের চেয়েও ভয়ংকর।”
(***)
হ্যারির কপালে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে তাজওয়ার। হ্যারি ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার তা দেখে বলল,
“আ’র ইউ রেডি টু গো টু হেল?”
“ইউ কিল্ড মাই ফ্রেন্ড। আই হ্যাভ এক্সপোসড ইউ।”
“এন্ড আই উইল কিল ইউ, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড হ্যারি।”
“আই ডোন্ট কেয়া’র।”
হ্যারি কথাটি বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, আর তখনই তাজওয়ার তার পিস্তল চালালো।
পরদিন সন্ধ্যায় হ্যারির মৃত শরীরটা হোটেল রুম থেকে বের করলো পুলিশ। স্পষ্ট তাজওয়ারই এই খুন করেছে। কারণ সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ডে তাজওয়ারই শেষবার হ্যারির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা দেওয়ায় তারা রেকর্ডটা ডিলিট করে দেয়৷ আর শেষমেশ পুলিশও ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে মিডিয়াতে চালিয়ে দেয়। হ্যারির পক্ষে তাজওয়ার ছাড়া কেউই ছিল না। অজ্ঞাত আমেরিকান যুবক হ্যারি। বাবা-মার কোনো পরিচয় নেই। তাজওয়ারের সাথে আমেরিকায় একসাথে পড়াশুনা করেছিল। সেই সূত্রেই তাদের বন্ধুত্ব। এরপর দেশে আসা। তাজওয়ার পোস্টমর্টেমের সুযোগ দেয় নি। মিডিয়ার হুড়োহুড়ির জন্য ঘর থেকে বের হতে পারে নি সে। তার উপর হ্যারির মৃত্যুটাও তাজওয়ারকে কয়েক সপ্তাহ প্রতিটি গণমাধ্যমে আলোচনায় রাখবে। তাই গোপনেই কয়েক সপ্তাহের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো তাজওয়ার।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯ (১ম ভাগ)||
৯৯।
শেষমেশ রিজওয়ান কবিরের স্বপ্ন পূরণ হলো। গতকাল মন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। আর আজ চট্টগ্রাম ফিরে একটা সভার আয়োজন করবেন। এই সুযোগ ব্যবহার করে তিনি সহজে আহিকে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবেন। লাবণি বিকেলে বারান্দায় বসে আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তখনই তার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে এলো একটি নাম। চুনি সেই মুহূর্তে এসে নামটি আর সেই নামের পেছনের ছবিটি দেখে ফেললো। লাবণি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তড়িৎ গতিতে পাশ ফিরলেন। চুনি চোখ সরিয়ে নিলো আরো সেকেন্ড খানিক আগেই। সে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার ভান ধরেছে। লাবণি কফির কাপটা রেখে ফোন হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। লাবণি চলে যেতেই চুনি দুই গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বলল,
“তওবা, তওবা, এই কথা তো ছোট আফারে কইতেই অইবো। এতো মজার নিউজ পাইলেই আফা আমারে অস্কার দিবো।”
দুই দিন পর সভা অনুষ্ঠিত হলো। রিজওয়ান কবিরকে নতুন মন্ত্রী হওয়ার শুভকামনা দিচ্ছে সবাই। রিজওয়ান কবির সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে দেশের উন্নতির জন্য কি করবেন, সেই বিষয়ে কিছু নীতিমালা পড়ে শোনালেন। হঠাৎ রিজওয়ান কবিরের মাইক্রোফোন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তিনি কিছুক্ষণ পর পর মাইক্রোফোনটির উপর ঠোকা দিচ্ছেন। কিন্তু তার কথা উপস্থিত কেউই শুনতে পারছে না। রিজওয়ান কবির বিরক্ত হলেন। ব্যবস্থাপকদের মনে মনে ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু ঠোঁটে তার সরল হাসি। তবে তার হাসিটা স্থায়ী হলো না। তাকে ভীষণভাবে ধাক্কা দিলো হুট করে মাইকে ছড়িয়ে পড়া বাক্যগুলো। রিজওয়ান কবির থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লাবণি বসার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সভায় উপস্থিত মানুষজন একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মাইকে ছড়িয়ে পড়ছে আহি আর রিজওয়ান কবিরের কথোপকথন। যেখানে রিজওয়ান কবির বলেছিলেন,
“তুমি যদি ইলেকশনের পর পর আমার কাছে ফিরে না আসো, তাহলে তোমার মাকে আর জীবিত দেখবে না।”
“আপনি যদি মন্ত্রী হয়েও যান, তবুও আপনাকে ভয় পাই না। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ অসৎ মানুষদের জয়ী হতে দেয় না।”
“এতো বছর তো আমিই জয়ী হয়েছি। তোমার নানাকে সিরাজ খানের সাহায্যে গুম করিয়ে ফেলেছিলাম। জানতে চাও না, কোথায় তিনি? তোমার মাকে বলো, তার বাবার লাশটা যাতে তার বিয়ের কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে থাকা জঙ্গল থেকে তুলে আনে। এতোদিনে হয়তো কঙ্কালটা পাওয়া যাবে।”
রিজওয়ান কবির চমকে উঠলেন। চেঁচিয়ে বললেন,
“বন্ধ করো। মাইকটা বন্ধ করো।”
লাবণি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি তিনিও কখন ফেঁসে যান। রেকর্ডিংটা আরো কিছুক্ষণ চলার আগেই মাইক বন্ধ করে দেওয়া হলো। ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে যে ছিল সে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রাদ আর লাবীব মিলেই তাকে বেধড়ক পিটিয়ে মাটিতে ফেলে রেখেছে। রিজওয়ান কবিরের সহচররা গিয়ে তাকে উঠালো। আর তারাই মাইকটা বন্ধ করলো।
রিজওয়ান কবির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সভার দুই পাশে চেয়ার রাখা। মাঝখানে লাল কার্পেটের রাস্তা। কার্পেটে ফুলের পাপড়ি ছিটানো। আহি দৃঢ় পা ফেলে কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। পেছনে সালমা ফাওজিয়া দাঁড়ানো। আহি সভার মঞ্চে উঠে উপস্থিত জনসাধারণের দিকে তাকালো। রাদ একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আহিকে দিলো, আর তার হাতে একটা ছোট মাইক। অন্তত সভায় উপস্থিত মানুষদের কানে যাতে আহির বলা শব্দগুলো পৌঁছায়। আহি বলল,
“এই হলো, আপনাদের পছন্দে নির্বাচিত হওয়া দেশের রক্ষক। আদৌ কি এই লোকটা দেশের রক্ষক হতে পারে?”
রিজওয়ান কবির আহির বাহু চেপে ধরে বললেন,
“তোমাকে আজকের কাজটার জন্য অনেক কিছু দেখতে হবে।”
আহি মাইক্রোফোন রাদের হাতে দিয়ে বলল,
“আপনার মতো বোকা, আমি এই জীবনে দ্বিতীয়টা দেখি নি। আপনি অতীতে যা করেছেন, আমার সাথে, মায়ের সাথে, সব আপনার ইগো হার্ট হয়েছে বলে করেছেন। দাদার সাথে রাগ করে আপনি এতোগুলো জীবন নষ্ট করেছেন। একটা মানুষ ভালোবাসা ছাড়া থাকতে পারে না। আপনি কাউকে ভালোবাসেন না, এমন তো নয়।”
আহি লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসেন। কিন্তু যেদিন বুঝবেন, আপনার ভালোবাসা আপনাকে কতোটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, কতোটা হিংস্র বানিয়েছে, সেদিন নিজের ভালোবাসায় ঘৃণা জন্মাবে। আপনি আমার মাকে ঠকিয়েছেন। ঠকিয়ে অন্তত একজনকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসেছেন। কিন্তু যারা ঠকায়, তাদের শাস্তি ঠকেই হয়। আপনাকে আইন শাস্তি দেবে না। আপনি নিজেই নিজেকে সেই শাস্তি দেবেন।”
রিজওয়ান কবির রাদের কাছ থেকে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“এই কণ্ঠ আমার এর প্রমাণ কি? আজকাল প্রযুক্তি এতো উন্নত হয়েছে, এসব মিথ্যে ভয়েস রেকর্ডে কোনো কাজ হবে না।”
আহি মাইক্রোফোনটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“যদি আমি সবাইকে সেই ভয়েসের আড়ালে থাকা ভিডিওটা দেখাই?”
রিজওয়ান কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“তুমি ভিডিও বানিয়েছো!”
“আমাকে কি এখনো সেই ভীত-সন্ত্রস্ত আহি ভেবেই বসে আছেন? আমি আপনার কাছ থেকে এতো বড় ধাক্কা খেয়ে উঠেছি, মৃত্যুর মতো ভয়ংকর মুহূর্তকে এতোটা কাছ থেকে দেখেছি, আপনি তো তার সামনে কিছুই না। আপনার মতো শ’খানেক রিজওয়ান কবির আসুক, এখন আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”
রিজওয়ান কবির হনহনিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে সালমা ফাওজিয়ার মুখোমুখি হলেন। সালমা ফাওজিয়া রাগী স্বরে বললেন,
“আমার বাবার হত্যাকারীকে আমি ছাড়বো না।”
রিজওয়ান কবির তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“একটা রেকর্ডিং, আর একটা ভিডিও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি এখন মন্ত্রী।”
কথাটি বলেই তিনি চলে গেলেন। এদিকে রাদ আহির পাশে এসে বলল,
“আন্টি তো কেইস করবেই।”
“হুম, কিন্তু কিছু হবে না। বাবার দুর্বলতা লাবণি মেহেরা। আগে ওটাকে শিক্ষা দিবো, তারপর বাবা আপনা-আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারবে।”
“বাবা বলছিস?”
আহি রাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এই মানুষটাই আমার কাছে একটা সময় হিরো ছিলো। খুব কম সময়ই তো হলো তার রূপ পরিবর্তন হয়েছে। আমার জীবনের আঠারো বছরে একবারো মনে হয় নি, আমার বাবা আমাকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে। শেষ কয়েকটা বছর কি আঠারো বছরের ভালোবাসার কাছে হেরে যাবে? আমি সত্যিই তাকে ভালোবাসি। বাবার সাথে আমি যুদ্ধ করছি না। উনার ভেতরের নিকৃষ্ট আত্মাটার সাথে আমার যুদ্ধ। একবার সেই আত্মা মুক্তি নিক। ভালো আত্মাটা জেগে উঠুক। আমি আমার পরিবার ফিরে পাবো। বাবা, আমি আর মা।”
“আংকেল-আন্টির ডিভোর্স হয়ে গেছে, আহি।”
“আমার বাবা-মা হয়ে থাকার পরিচয়টা তো হারিয়ে যায় নি।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯ (২য় ভাগ)||
১০০।
বেশ কয়েকদিন ধরেই আফিফ দেরীতে বাসায় ফিরছে। চুপচাপ হয়ে গেছে সে। পদ্মের সাথে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলছে না। পদ্মের এসব সহ্য হচ্ছে না। যাকে পাওয়ার জন্য সে এতো বড় দুঃসাহসিক কাজ করেছে, আজ সেই মানুষটাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আহির ক্ষতি করার কথা সে জীবনেও ভাবে নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল, আফিফকে না পেলে সে সুখী হবে না। এজন্যই তাজওয়ারকে সাহায্য করেছিল পদ্ম।
আফিফ রান্নাঘরে এসে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে পদ্ম দৌঁড়ে গেলো। দেখলো আফিফ কিছু একটা খুঁজছে। পদ্ম আফিফের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে বলুন না, কি লাগবে। আমি খুঁজে দিচ্ছি।”
আফিফ চুপ করে রইল। পদ্ম আফিফের হাত স্পর্শ করার আগেই আফিফ সরে দাঁড়ালো। তখনই তারা দেখলো রান্নাঘরের বাইরে আফিফা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। আফিফা বেগমকে দেখে আফিফ বলল,
“মা, তুমি? চা খাবে?”
আফিফা বেগম বললেন,
“তুই এখানে কি করছিস?”
“চা বানাতে এসেছি।”
“তুই কেন চা বানাবি? পদ্ম আছে না?”
“আমার বানাতে ইচ্ছে করছিল।”
আফিফা বেগম পদ্মের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি আমার ছেলেকে রান্নাঘরে কেন ঢুকতে দিলে? সারাদিন কাজ করে এসে ক্লান্ত হয়ে যায় আমার ছেলেটা। যাও, আফিফ আর আমার জন্য কড়া করে দুই কাপ চা বানিয়ে আনো।”
পদ্ম মাথা নেড়ে বলল, “জ্বি, আচ্ছা।”
পদ্ম যেন এই সুযোগটাই চাচ্ছিলো। সে ক্ষিপ্র গতিতে দুই কাপ চা বানিয়ে আফিফের সামনে এনে রাখলো। আফিফ এক কাপ মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। পদ্ম আফিফের চলে যাওয়া দেখে সেও তার পিছু পিছু গেলো। আফিফা বেগম পদ্ম আর আফিফের মধ্যে চলা শীতল সম্পর্ক আন্দাজ করতে পেরে মনে মনে খুশি হলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“এবার অন্তত আমার ছেলেটা একটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিক।”
এদিকে আফিফ বারান্দায় গিয়ে বসতেই পদ্ম তার পাশে এসে বসলো। আফিফ চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“আপনি বলেছিলেন, সত্যটা স্বীকার করলে আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”
আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“আহিকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আপনার চেয়ে বেশি না। আপনারও কি উচিত না, আমাকে আহির চেয়ে বেশি ভালোবাসা।”
আফিফ এবার ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আমি আপনার স্ত্রী।”
“তুমি আমার স্ত্রী কীভাবে হয়েছো? আমাকে ঠকিয়ে, আমার সাথে প্রতারণা করে। এখন আমাদের সম্পর্কটাই তো মিথ্যে হয়ে গেছে।”
“কিন্তু তবুও আমি আপনার স্ত্রী।”
আফিফ কাপটা ধপ করে বারান্দার মেঝেতে রাখলো। পদ্ম কেঁপে উঠে বলল, “মা শুনবে।”
আফিফ রুমের ভেতরে যেতে চাইলেই পদ্ম তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
“তুমি যদি আমাকে সেই দিনটা ফিরিয়ে দিতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো।”
পদ্ম আফিফকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“সেই দিনটা মানে? কোন দিনটা? আপনি কি আবার আহিকে ফেরত চাচ্ছেন?”
“আমি আহিকে চাচ্ছি না। আমি সেই দিনটা চাই, যেদিন তোমার চোখ, তোমার হাসি, তোমার কথাবার্তা দেখে মনে করেছিলাম, তোমার মতো ইনোসেন্ট মেয়ে হয়তো আল্লাহ খুব কম বানিয়েছেন। কিন্তু এখন যদি সেই দিনটা ফিরে পাই, আমি আবার ভালোভাবে তোমাকে দেখতে চাই। জানতে চাই, কি এমন ভুল ছিল আমার চোখে যে আমি তোমার অভিনয়টাই ধরতে পারলাম না।”
পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ বলল,
“তুমি তো আগে থেকেই সব জানতে! তাহলে অজ্ঞ থাকার জন্য তুমি ঠিক কি কি অভিনয় করেছিলে, বলবে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তোমার মধ্যে কোন সত্তাটা সত্য, কোনটা মিথ্যে। তোমাকে আমি চিনতেই পারছি না, পদ্ম। আমাদের সংসারটাই তুমি মিথ্যে দিয়ে শুরু করেছো। পাঁচ বছরের সংসার আমার কাছে এক মুহূর্তেই মিথ্যে হয়ে গেছে। আমি এই সম্পর্কে আর কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না।”
“আপনি বলেছিলেন, আপনি আমাকে ছাড়বেন না।”
“ছাড়বো না বলেছিলাম। কিন্তু তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। পারবোও না। বিশ্বাস ছাড়া বাকি জীবন কাটানো খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। আর হয়তো এটাই আমার শাস্তি। তোমাদের দুই বান্ধবীর সাথে দেখা হওয়ার শাস্তি। বিনা অপরাধে তুমি আর ওই তাজওয়ার খান মিলে ইচ্ছেমতো কিছু মানুষকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছো। আমাদের জীবনটা কি তোমাদের বাবার নামে লেখা ছিল?”
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আগে তো কখনো এভাবে আমার সাথে কথা বলেন নি!”
“তখন কি জানতাম, তুমি কি কি করেছো আমার সাথে?”
“কি করেছি আমি? শুধু আপনার ডায়েরী পড়েছি। আহিকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য তাজওয়ারকে আপনার ভালোবাসার কথা জানিয়েছি। তাজওয়ার তো আহির কোনো ক্ষতি করতো না। ও শুধু আপনাকে ভয় দেখিয়েছিল। আর রেনুর ব্যাপারে আমার জায়গায় আহি থাকলে একই কাজটাই করতো।”
“কখনো না। আহি আর তোমার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মেয়েটা তোমার জন্য নিজের আবেগটা কীভাবে ধরে রেখেছে, তুমি ভাবতেও পারবে না। কি করে নি সে? একবারো আমাকে এসে বলে নি, পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাত ধরো। একবারো বলে নি। ও যদি সত্যটা জানে, ঘৃণা করবে তোমাকে। ইনফ্যাক্ট, আহি ঘৃণায় করতে জানে না। ও তো তোমাকে ক্ষমা করে দেবে। সে তো আবার মহানুভবতার জ্বলন্ত মূর্তি! তবে একটা কথা কি জানো, ওর মতো একটা মেয়েকে ফ্রেন্ড হিসেবে অন্তত তুমি ডিজার্ভ করো না। তোমার ভাগ্যটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ভালো, তাই আহির মতো একটা বান্ধবী পেয়েছো। আহির জায়গায় তুমি থাকলে আমার সংসার যেদিন মা ক্যাম্পাসে গিয়েছিল, সেদিনই ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। মেয়েটা তোমাকে ঊর্ধ্বে রাখার জন্য, মায়ের সামনে নিজেকে ছোট করেছে। মাকে বুঝিয়েছি, সে পদ্মের মতো নম্র, ভদ্র, শালীন ঘরের মেয়ে নয়। সে তোমার চরিত্রকে ফুলের মতো দেখানোর জন্য রাদকে জড়িয়ে ধরে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।”
“আর আপনার সেটা ভালো লাগে নি।”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ভালো লাগে নি। একদম ভালো লাগে নি। আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে সুখী দেখতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু উৎশৃঙ্খল দেখতে চাই না।”
“তার মানে আপনি আহিকে ভালোবাসেন?”
“তুমি না আমার ডায়েরী পড়েছিলে? তুমি তো সব জেনে গেছো। এখন আবার এমন অভিনয় করছো কেন?”
“আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“ভালোবাসতাম। এখন আমার দায়িত্ব তুমি, তাই আহির প্রতি ভালোবাসা দেখানোর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আমার ভালোবাসা নোংরা করতে চাই না। তোমাদের মতো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে নিচে নামানোর ইচ্ছে আমার নেই। যাকে পাওয়ার ক্ষমতা নেই৷ তাকে ধরে রাখি না আমি। আহির প্রতি মায়া আমার এখনো আছে। মায়া থাকার অর্থ এই না যে আমি ওর সাথে প্রেম করবো, নোংরামি করবো, তোমার আড়ালে গিয়ে ওর সাথে ঘুরাঘুরি করবো। মায়া মানে যত্ন করা, তার ভালো চাওয়া, তার বিপদে সাহায্য করা। তোমাকে কেন বলছি এসব? তুমি কি বুঝবে মায়া আর ভালোবাসা। তোমার আর তাজওয়ারের মধ্যে মায়া আর ভালোবাসা নেই। জেদ আছে। শুধুই পাওয়ার জেদ। আর ভালোবাসা মানে ত্যাগ করতে জানা।”
(***)
সুনেহরাহ লিনাশার হাতে লাবণির কিছু গোপন তথ্য দিয়ে বলল,
“এখানে সব আছে। ফাইলস, রেকর্ডিং সবটাই। লাবণি মেহেরা অনেক ছেলের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত ছিলো। আর এখন তার নতুন বয়ফ্রেন্ড তাজওয়ার খান।”
লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির সাথে তো তাজওয়ারের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।”
“হ্যাঁ, কিন্তু লাবণি মেহেরা তো বিয়ের করার জন্য কারো সাথে সম্পর্কে যায় নি। জাস্ট ইনজয়…”
লিনাশা সুনেহরাহকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাদের কাছে যেসব সম্পর্ক সো কল্ড ইনজয়মেন্ট, অনেকের কাছে সেই সম্পর্ক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তোমাদের মতো মেয়েরা ছেলেদের সিডিউস করে তাদের চরিত্র নষ্ট করবে আর তাদের সংসারও ভাঙবে। তবে আমি তাজওয়ারকে ভালো বলবো না। খারাপ হওয়ার থাকলে মেয়েদের এক ইশারায় ছেলেদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর যারা আলটিমেট ভালো, তাদের সামনে হাজার বার কোমড় দুলিয়ে গেলেও তোমাদের মতো চিপ ক্যারেক্টরের মেয়েদের দিকে তারা চোখ তুলে তাকাবে না। আর তোমরা পাবেও তোমাদের মতো চিপ ম্যান।”
সুনেহরাহ চোখ-মুখ শক্ত করে লিনাশার কথা হজম করে যাচ্ছে। লিনাশা ধমকের সুরে বলল,
“যাও। তোমার প্রেম লীলা আপতত আমাদের কাছেই থাকুক। যতোদিন লাবণিকে এই প্রমাণগুলো দ্বারা ফাঁসাতে না পেরেছি, তোমাকে তোমার কুকর্ম থেকে মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না। বলা তো যায় না, আমরা তোমার কুকর্মের সব তথ্য তোমাকে দিয়ে দিলাম, আর তুমি অনেস্ট চামচি হয়ে তোমার সো কল্ড ম্যাডামকে আমাদের কথা বলে দাও। যাও এবার। তোমার মুখটা দেখার রুচি চলে গেছে।”
সুনেহরাহ ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে সে পেছন ফিরে বলল,
“তাজওয়ার আর লাবণি ফিজিক্যালিও ইনভলভড।”
লিনাশা চমকে সুনেহরাহর দিকে তাকালো। সুনেহরাহ বলল,
“তাজওয়ার খান তার একটা বাংলো বাড়ি লাবণির নামে করে দিয়েছিলো। ওখানে তাদের প্রায়ই যাওয়া হয়। ক্লাবে যাচ্ছে বলে, লাবণি মেহেরা সেখানেই যায়।”
সুনেহরাহ কথাটি বলেই চলে গেলো। লিনাশা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। কেমন অস্থির লাগছে তার। লাবণির বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণগুলো টেবিলের উপর রেখে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি কখন থেকে এতো খারাপ হলে আপু? আমার আপু তো এতোটা খারাপ ছিল না। নিজেকে তোমার বোন বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করছে। আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা যখন জানবে, আমার বড় আপু এতো নীচ চরিত্রের, আমাকে কি একটুও কথা শুনতে হবে না? লোকে কি বলবে না, একই মায়ের সন্তানে এতো পার্থক্য কীভাবে? ওরা কি আমাকেও সন্দেহ করবে না? নায়ীব কি আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারবে? কখনো কি একটুও খোঁচা খেতে হবে না? তুমি শুধু নিজেকে কলঙ্কিত করো নি, আপু। আমাকে ডুবিয়েছো, বাবা-মার সম্মানও ডুবিয়েছো। কেন এমন পালটে গেলে তুমি?”
(***)
তাজওয়ারের দেশে আসার খবরটা আফিফ পেয়ে গেছে। দেশে এসে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। তাজওয়ার খুব বাজে একটা পরিকল্পনা করেই যে দেশে এসেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত আফিফ। যে করেই হোক এক সপ্তাহের মধ্যে তাজওয়ারকে গ্রেফতার করাতে হবে। নয়তো সে যে কারো ক্ষতি করতে পারে। আফিফ নিলয়ের সাহায্যে অনেক গবেষণার পর বের করলো তাজওয়ার তার নতুন বাংলো বাড়িতে উঠেছে। জায়গাটা কাপ্তাইয়ের কাছাকাছি। নিলয় বলল,
“পাশেই বিজিবি ক্যাম্প আছে। একটু রিস্কি হয়ে যাবে৷ তুই এই বাইক নিয়ে ওখানে যেতে পারবি না। কারণ তাজওয়ার কিন্তু আগেই সেই কালো বাইকারের উপর কেইস করে রেখেছে।”
“আমি জাস্ট যাবো, আর জেনে আসবো ও ওখানে কি ষড়যন্ত্র করছে।”
“অনেক সিকিউরিটি। ফেঁসে যাবি তুই।”
“কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। তাজওয়ার মুহূর্তেই যে কোনো কিছু করতে পারে। ওকে আগে থেকেই হাতে রাখতে হবে।”
“আর তোকে কে বলেছে ওখানে গেলেই তুই সব তথ্য পাবি?”
“অন্তত দেখে আসা যায়।”
“কি দেখবি গিয়ে?”
“আমার মনে হচ্ছে ও যেহেতু ওখানে গেছে, নিশ্চিত ওখানে কিছু একটা থাকবে যেটা অত্যন্ত গোপনীয়৷ আর বিজিবি ক্যাম্প পাশের রাস্তায়। ওর বাংলোটা আরো আগে। কিছু হবে না।”
“আর ওখানে ওর বডিগার্ডরা!”
“আগে যাই। এরপর বুঝবো ভেতরে কীভাবে ঢুকতে হবে। না গিয়ে তো আর আন্দাজ করতে পারছি না৷ আর ওই জায়গাটা সেইফ। তাজওয়ার হয়তো ওতো সিকিউরিটি রাখবে না। কারণ প্রটেকশন দরকার এমন জায়গায় ওর সিকিউরিটি খুব দুর্বল।”
“কেন? ও কি মনে করে কেউ ওর ক্ষতি করবে না?”
“ওভার কনফিডেন্স আছে তাজওয়ারের। ও মনে করে একমাত্র ওর মাথায় মগজ আছে। বাকিরা গরু।”
“তুই গরুই তো ছিলি। এতো বছর কিছু করিস নি।”
আফিফ চোখ ছোট করে নিলয়ের দিকে তাকালো। বলল,
“আমি দুর্বল ছিলাম। আমি স্বীকার করতে বাধ্য, আমার মনের জোর কম ছিল। কিন্তু আমি জানি না, সেদিন আহিকে দেখে আমার কি হয়েছিল। সেদিন ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে শুনেই আমার আমিটাই পরিবর্তন হয়ে গেলো। মনে অদ্ভুত রকমের সাহস জন্মালো। ভেবে নিয়েছি, এবার আমি মরে গিয়েও ওই তাজওয়ারের হাত থেকে আহিকে মুক্ত করে যাবো। আর কোনো কিছুর পরোয়া করবো না। কারণ আপার জায়গায় আমি আর কাউকে দেখতে চাই না।”
“আহিকে এখনো ভালোবাসিস?”
আফিফ নিলয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় তার একমাত্র বন্ধু, যাকে সে আহির ব্যাপারে হালকা জানিয়েছিলো। পুরোটা জানানোর আগেই সে আহিকে হারিয়ে ফেলেছিল। নিলয় এর অনেক পরেই আহির জন্য আফিফের জীবনে আসা ভয়ংকর অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জেনেছিল। ততোদিনে পদ্ম আফিফের স্ত্রী। পদ্মকে ভাবী হিসেবে বেশ পছন্দ নিলয়ের। তবে আফিফ এখনো পদ্মের সত্যটা কাউকে জানায় নি। জানাতে পারবেও না। কারণ শত খারাপ হলেও পদ্ম এখনো তার স্ত্রী।
(***)
রাদকে না বলে আহি একাই চলে এসেছে কাপ্তাই। রাদ ইদানীং একটু বেশিই আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে আহির উপর। দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে আহির পাশে থাকতে চাইছে। কিন্তু আহি রাদকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেই পারছে না। রাদের স্পর্শে শান্তি পাচ্ছে না সে। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দ্বিধাদ্বন্ধ বুঝতে পেরে বলেছিলেন, আপতত বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না তার। আগামী কয়েক বছরেও তিনি বিয়ের জন্য আহিকে চাপ দিবেন না। আহি প্রশান্তির হাসি হেসে সালমা ফাওজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই না। আমার মনটা এখন মৃত সাগর। এখানে শুধু ভাসা যায়৷ ডুবা যায় না। এই মনে একজনকে ডুবিয়েই তো এর মৃত্যু ঘটিয়েছি। কেউ চাইলেই কি সেই অনুভূতির গভীরতা স্পর্শ করতে পারবে? কিন্তু আমি রাদকে বন্ধু হিসেবে অনেক ভালোবাসি। আমার জন্য অনেক করেছে ছেলেটা। তাই আমি কি এই মনটা আরেকটু মেরে ফেলতে পারি না ওর জন্য? তুমি তো বাবার সাথে কম্প্রোমাইজ করে অনেক বছর সংসার করেছিল। আর রাদ তো মানুষ ভালো।”
কথাটি শুনেই আহির ভেতরের তীব্র দহন উপলব্ধি করলো সালমা ফাওজিয়া। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“একা থাকো। তবুও এমন কাউকে জীবনে এনো না, যাকে ভালোবাসা যায় না। তার চেয়ে একা থাকো, ভালো থাকো। মানসিক তৃপ্তি পাবে। আমি তো আছিই তোমার পাশে। আবার যদি সেই ভালোবাসা খুঁজে পাও, সেদিন আমিই তোমার বিয়ে দেবো। আহি, একদিন তুমি আবার ভালোবাসবে। নতুন করে ভালোবাসবে। তখন আর কেউ তোমাকে আটকাবে না। না তাজওয়ার খান, না তোমার বাবা।”
এদিকে লিনাশার কাছ থেকে তথ্য নিয়েই কাপ্তাই এসেছে আহি। কাপ্তাইয়ে তাজওয়ারের একটা বাংলো বাড়ি আছে। যেখানে সে লাবণিকে নিয়ে এসেছে। চুনিকে ফোন করে জেনে নিয়েছে লাবণি এখন বাসায় নেই। সে না-কি তার বান্ধবীদের নিয়ে তিন দিনের ভ্রমণে বের হয়েছে। কয়েক দিন আগে চুনি তাকে ফোন করে বলেছিল, লাবণির ফোনে না-কি তাজওয়ারের কল এসেছে। তাজওয়ারের নাম সেইভ করা ছিল হার্ট দিয়ে। ইংরেজিতে ছিল তাই চুনি পড়তে পারে নি। তবে আহি তাকে ইংরেজি বর্ণমালা চিনিয়েছিল। তা দেখেই সে আহিকে বলেছিল, সেই নামটিতে এইচ ই এ আর টি এই বর্ণগুলো ছিল। আর পেছনে তাজওয়ারের ছবি। আহি শুনেই লাবণি আর তাজওয়ারের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আর সুনেহরাহ বলার পর যেন মাত্রাতিরিক্ত নিশ্চিত হয়েছে। তাজওয়ার আর লাবণির সম্পর্ক যে এতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে সেটা ভাবতেই পারে নি আহি। আর যাই হোক, লাবণি আহির বাবার স্ত্রী। সেই সূত্রে তার সৎ মা। তার বাবার সম্মান। আহির এবার লাবণির সত্যটা তার বাবাকে দেখাতেই হবে। তাই সে কাপ্তাই চলে এসেছে, তাদের হাতেনাতে ধরে তার বাবার সামনে লাবণির মুখোশটা উঠানোর জন্য।
(***)
বিকেলেই বাংলো বাড়ির কাছে চলে এলো আহি। গাড়ি নিয়ে আসে নি। সিএনজি থেকে অর্ধেক রাস্তায় নেমে ড্রাইভারটির নম্বর নিয়ে নিয়েছিলো সে। প্রয়োজন হলে ফোন করবে বলে বিদায় করেছিল তাকে। এরপর হেঁটে হেঁটেই বাংলো বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো। পাশে ঘন জঙ্গল। গেট টপকে যাওয়া অসম্ভব। গেটের কাছেই পাহারাদার। তাদের হাতে বন্দুকও আছে। আহি পাশের জঙ্গলে ঢুকলো। সে জঙ্গল ঘুরে বাংলো বাড়ির সীমানায় এসে দাঁড়ালো। কয়েক ফুট উঁচু দেয়াল। এই দেয়াল টপকানোর জন্য পায়ের জুতো খুলে অনেক কারসাজি করে আহি দেয়ালের উপর উঠলো। দেয়ালের উপর সূচালো ফলার মতো গ্রিল লাগানো। আহি শক্ত করে ওইগুলো ধরে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নিজেকে সূচালো ফলা থেকে বাঁচিয়ে লাফিয়ে পড়লো অন্য সীমানায়। এদিকে পাহারা দেওয়ার কেউ নেই। আহি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সিসি ক্যামেরাও কোথাও লাগানো নেই। পাহারাদাররা পাহারা দিচ্ছে শুধু গেটের কাছেই। আহি ভালোভাবে নিজেকে ঝোপঝাড়ে আড়াল করে রাখলো। অন্ধকার হলেই ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে ঢুকবে। এদিকে কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো। সন্ধ্যা নামতেই আহি ভেতরে ঢুকলো। পেছনের জানালা হাতিয়ে হালকা ফাঁকা জায়গা পেয়েই বাড়ির ভেতরে চোখ দিলো আহি। ভেতরে তাকাতেই আহির লোম দাঁড়িয়ে গেলো। লাবণি মেহেরা একটু বেশিই খোলামেলা পোশাক পরেছেন। আহি চাইলে এখুনি ভিডিও করতে পারে। কিন্তু সে আশেপাশে তাজওয়ারকে দেখছে না। আর তাজওয়ার সহ ভিডিওতে না এলে তার বাবা কখনোই তার কথা বিশ্বাস করবে না। ভেতরে ঢুকার কোনো ব্যবস্থায় নেই। পাশে একটা পানির পাইপ আছে। ওটা বেয়ে বারান্দায় যাওয়া যাবে। আহি অনেক ভেবে সেই পাইপটা বেয়ে উপরে উঠলো। বারান্দায় উঁকি মারতেই বুঝলো এই রুমে কেউ থাকে না। আহি রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। সাবধানে রুমের দরজা খুললো। ধীরে ধীরে রুমের বাইরে মাথা বের করে দেখলো উপরের তলায় কেউ নেই। আহি হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এসে নিচে তাকালো। দেখলো তাজওয়ার বিশ্রীভাবে সোফায় শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে। লাবণি দু’টি কাপ হাতে নিয়ে তাজওয়ারের পাশে বসলো। তাজওয়ার লাবণির স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিচ্ছে। স্পষ্ট ভাবে লাবণির চেহারা বোঝা যাচ্ছে। আহি ক্যামেরা বের করে তাদের প্রেমলীলা রেকর্ড করে নিলো। মনে মনে হাসলো আহি আর বলল,
“তুমি তো গেছো লাবণি মেহেরা। এতো বড় ফিল্ম রিলিজ হলে, তুমি তো সুপারস্টার হয়ে যাবে। আর আমি আমার প্রথম হিট ফিল্মের জন্য এওয়ার্ড পাবো। ওয়াও।”
আহি ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর মুহূর্তেই লাবণির দৃষ্টি উপরে গেলো। আহির চেহারা না দেখলেও সে কারো হাত স্পষ্টভাবে খেয়াল করেছে। লাবণি অস্থির হয়ে পড়লো। ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কে ওখানে?”
তাজওয়ার তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। এদিকে আহি বুঝতে পারলো লাবণি তাকে দেখে ফেলেছে। সে ভয় পেয়ে গেলো। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে পাশের রুমে ঢুকে পড়লো। ভেতরে ঢুকে বারান্দার কাছে যেতেই খেয়াল করলো, রুমের দরজাটা সে বেখেয়ালিতে জোরে বন্ধ করে ফেলেছে। এদিকে রুমের দরজা জোরে বন্ধ হওয়ায় তাজওয়ার আর লাবণি বুঝে ফেললো উপরে কেউ আছে। তাজওয়ার দেরী না করে দ্রুত জামা গায়ে দিয়ে তার ড্রয়ার থেকে পিস্তল বের করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আর লাবণিকে বলল, উপরে উঠে দেখতে। আহি ততোক্ষণে লাফিয়ে নিচে নেমে এসেছে। লাফিয়ে পড়তেই পা মুচড়ে গেছে আহির। জোর পাচ্ছে না হাঁটার। এদিকে তাজওয়ার চেঁচিয়ে পাহারাদারদের বলল, বাড়িতে কেউ ঢুকেছে। আহির কানে সব শব্দ আসছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে তার। কোনোভাবে সে সরে জঙ্গলের দিকে যেতেই তাজওয়ার সেখানে চলে এলো। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় শুধু অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। তাজওয়ার পিস্তল তাক করে ইচ্ছেমতো গুলি ছুঁড়তে লাগলো। আহি দৌঁড়ে ঝোপঝাড়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। হঠাৎ কোমড়ে কারো স্পর্শ পেলো আহি। কিছু বলার আগেই সে অনুভব করলো তাকে কোলে নিয়ে কিছু একটা বেয়ে উঠে যাচ্ছে একটা মানুষ। আহি শব্দ করলো না। দেয়ালের এপাড়ে এসে অন্ধকারেই বেঁধে রাখা রশিটা টেনে তুললো হেলমেট পরা এক যুবক। আহি কিছু বলার আগেই গোলাগুলির শব্দ বাড়লো। জঙ্গলের দিকেই তাজওয়ারের পাহারাদারগুলো এগিয়ে আসছে। আহি কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশের যুবকটি তার হাত ধরে দৌঁড়াতে লাগলো। কিছুদূর গিয়েই ঢালু পথের কাছে এসেই দু’জনেরই পা ফসকে গেলো। আর তারা ঢালু অংশ বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আহির পা চলছে না। মুচড়ে যাওয়া পায়ের উপর জোর দিয়ে হাঁটায় হয়তো তার পা’টাই অসার হয়ে গেছে। এখন শরীরের কিছু অংশে যেন শুধু আঘাত পাচ্ছে। সে অনুভব করলো একটা হাত তার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে আনলো। আহির এবার শুধু পিঠেই আঘাত হচ্ছে। তার হাত দু’টি কারো বুকের সাথে সেঁটে আছে। হেলমেট থাকায় যুবকটি মাথায় আঘাত পাচ্ছে না। সে খুব শক্ত করে আহির মাথাটা তার হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। অনেক দূর গড়িয়ে পড়ার পর হেলমেট পরা যুবকটি নিজের ভারসাম্য ধরতে পারলো। আহি বুঝলো তারা অনেক ধাক্কা খেয়ে ঢালু পথ পার করতে পেরেছে। সে এবার মাথা তুলে যুবকটির দিকে তাকালো। হেলমেট পরা যুবকটি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এদিকে আহির শরীরে ভীষণ ব্যথা। তবুও সে কষ্ট করে যুবকটির বুকের উপর থেকে নেমে পাশে শুয়ে পড়লো। ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। নিভু নিভু দৃষ্টিতে পাশ ফিরে একবার আগন্তুকটির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
১০১।
শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। হাত-পা অসার হয়ে আছে। মাথাটা নরম কিছুর উপর রাখা। হাত হাতড়ে মাথার নিচে থাকা নরম বস্তুটি স্পর্শ করার শক্তিটুকুও নেই। চোখ খুলতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ দু’টি খুললো আহি। চোখ খুলতেই দৃশ্যমান হলো একটি পুরুষালী অবয়ব। আহি স্থির দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই মানুষটিও আহির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আহি মাথা তুলতেই অনুভব করলো তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। সে অস্ফুটস্বরে গোঙিয়ে উঠলো। আহির গোঙানির শব্দ শুনেই সেই মানুষটি ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“কোথাও ব্যথা লেগেছে তোমার?”
আফিফের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো আহি। অবয়বটির দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আফিফ তুমি!”
অবয়বটি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“হ্যাঁ। চিনতে পারো নি?”
“হুড়োহুড়িতে বুঝতে পারি নি। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো?”
“আমি একটা কাজে এসেছি। তুমি কেন এসেছো?”
আফিফের প্রশ্নে আহি অনুভব করলো, তার কাঁধে ব্যাগটি নেই। ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লো আহি। উঠে বসতেই আফিফ আহিকে ধরে বসিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
আহি উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “আমার ব্যাগটা!”
“তোমার ব্যাগটা আমার কাছে আছে। তোমার অস্বস্তি লাগবে ভেবে, আমি ব্যাগটা খুলে নিয়েছি।”
“আচ্ছা, দাও তো ব্যাগটা। ওখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস আছে।”
আফিফ তার হ্যালমেটের খোলা অংশে ঢুকিয়ে রাখা ব্যাগটি বের করে আহির হাতে নিতেই সে ব্যস্ত হাতে ব্যাগের চেইন খুলে ভেতর থেকে ক্যামেরাটি বের করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আফিফ বলল,
“কি ওখানে?”
“আমার মুক্তির স্বাদ।”
আফিফ কিছুক্ষণ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো, যদিও অন্ধকারে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও তাকিয়ে আছে। মিনিট খানিক পর আফিফ উঠে হেলমেট পরে বলল,
“আমাদের বের হতে হবে। এদিকটা ঘন জঙ্গল। আর বুনো হাতিও থাকতে পারে। ভোর হতে অনেক সময় লাগবে। এখন মাত্র এগারোটা ছুঁই ছুঁই। চলো।”
“এদিকে শুনলাম ডাকাত বেশি।”
“আমি আছি তো!”
আফিফ আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। অন্ধকারে হাতটি আন্দাজ করে আহি সেই হাত স্পর্শ করলো। আফিফ টেনে উঠালো আহিকে। ভালোভাবে দু’পায়ে ভর দিতে পারছে না সে। ঝুঁকে পড়লো আফিফের দিকে। আফিফের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আহির কপালে এসে পড়ছে। আহি সেই নিঃশ্বাসের স্পর্শে জমে গেলো। তার দম আটকে যাওয়ার উপক্রম। আফিফ বলল,
“হাঁটতে অসুবিধে হবে?”
আহি কিছু একটা ভেবে বলল,
“অসুবিধে হলেও তো হাঁটতে হবে।”
আফিফ সেকেন্ড খানিক নিরব থেকে আহিকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিলো। আহি শক্ত করে আফিফের কাঁধ জড়িয়ে রেখেছে। আফিফ সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“তাজওয়ার যদি তোমার উপর গুলি চালিয়ে দিতো?”
“দিলে দিতো।”
“তোমার তো আবার খুব সাহস। হাত কেঁটে প্রমাণ করে দিয়েছিলে।”
আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার কাছে সেদিন আর কোনো পথ খোলা ছিল না।”
“সরি।”
“সরি কেন?”
“সেদিন তোমাকে আটকাই নি।”
আহি হালকা হেসে বলল,
“আটকে রেখে কি করতে? আমার তো যাওয়ার ছিল। বান্ধবীর স্বামীর বাড়ি কি বেশিদিন থাকা যায়? এক রাতও যেন অনেক বেশি ছিল।”
আফিফের হাঁটার গতি কমে এলো। পদ্মের মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা ভারী হয়ে এলো তার। যেই মেয়েটা পদ্মকে এতো ভালোবাসে, সেই মেয়েটা যদি জানে তার প্রিয় বান্ধবী তার সাথে কি করেছে, ভীষণ কষ্ট পাবে। আফিফ নিরবতা কাটিয়ে বলল,
“থাক, যা হওয়ার ভালোই হয়েছে। তোমার সেদিনের সেই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া, আজ হয়তো তোমাকে অনেক কিছু ফিরিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ভুল সিদ্ধান্ত থেকে মানুষ শিখে, আবার মাঝে মাঝে হেরে যায়। আল্লাহ সহায় ছিলেন, তাই তুমি হেরে যাও নি।”
তারা রাস্তায় উঠে আসলো। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“একটা গাড়িও নেই।”
“থাকলেও কি নিরাপদ হতো? এই মুহূর্তে ড্রাইভারদেরও বিশ্বাস করা যাবে না। অনেকটা পথ এভাবেই পার করতে হবে।”
“তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”
“না।”
“হলে বলো, আমাকে নামিয়ে দাও।”
“তারপর?”
“আমি হেঁটে যাবো।”
“তুমি কচ্ছপের গতিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে, আর একটু পর খেয়াল করবে, আমরা অন্ধকার কক্ষে পৌঁছে গেছি।”
“মানে?”
“ডাকাতের দল তুলে নিয়ে যাবে।”
আহির হুট করে ভয় হলো। সে আফিফের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বলল,
“তাহলে কথা বলো না। চুপচাপ হাঁটো। তোমার কথা শুনে যদি আশেপাশের ডাকাত এদিকে চলে আসে?”
আফিফ চুপ হয়ে গেলো। আহি আঙ্গুল সরিয়ে নিলো। আফিফ আর কথা বললো না। প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর তারা লোকালয়ে প্রবেশ করলো। আশেপাশের সমভূমিতে কারো আনাগোনা নেই। পাহাড়েই বাড়ি। পাহাড়ের উপরে জ্বলছে সোডিয়াম বাতি। আফিফ বুঝলো ওদিকে হয়তো উপজাতিরা থাকে। সাহস করে সে পাহাড় কাঁটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। আহি বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“এখান থেকে পায়ে হেঁটে বের হওয়া অসম্ভব। আর আমাদের এতোক্ষণ কোনো ডাকাত পাই নি, এটাই সৌভাগ্য। গাড়ি ছাড়া আমরা দ্রুত এই রাস্তা ছাড়তে পারবো না। আমার বাইকটাও তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির অনেক সামনে রেখে এসেছি। ওদিকে গেলে তাজওয়ার ধরে ফেলবে। এতোক্ষণে হয়তো আমার বাইকটা দেখে ফেলেছে।”
“আরেহ, আমার জুতোগুলোও দেখে ফেলেছে হয়তো। লাবণি তো দেখেই চিনে ফেলবে।”
“বাদ দাও। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আগে আমরা নিরাপদে শহরে ফিরি।”
“এখন উপরে উঠছো কেন?”
“এদিকে যদি কেউ আমাদের সাহায্য করে! গাড়ি ঠিক করে দেয়, তাহলে তো আজই আমরা শহরে পৌঁছে যাবো। আর এক কাজ করো, তোমরা ক্যামেরাটা একটু আলাদাভাবে নাও। মানে লুকিয়ে রাখো। যদি ওরা আমাদের কাছ থেকে জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়, তোমার ক্যামেরাটা যাতে হাতছাড়া না হয়। তুমি না বললে, ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
“হুম।”
আহি ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল, কোথায় লুকাবে। ক্যামেরাটা ছোট হওয়ায় সহজেই যেকোনো জায়গায় আটকে থাকবে। আফিফ বলল,
“তোমার চুল তো বেশ ঘন। এক কাজ করো চুলে পেঁচিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকে দাও।”
“পড়ে গেলে?”
“পড়বে না। অন্য কোথাও রাখার উপায় নেই। রাখলেও তুমি কমফোর্ট ফিল করবে না। আর ওদের যদি সত্যিই আমাদের জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা থাকে। তাহলে তোমার অস্বস্তি দেখেই বুঝে ফেলবে, তুমি কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছো। তখন আরো সমস্যা হবে।”
“বেশি জানো দেখছি!”
“না একবার স্কুলে একটা মেয়ে নকল নিয়ে এসেছিল। স্যান্ডেলের নিচে স্কচটেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল কাগজটা। স্যার মেয়েটাকে হঠাৎ ডাকলো। মেয়েটা অস্বস্তি নিয়ে হাঁটছিল। স্যার দেখেই বুঝে গেলো, ও নকল করবে। ব্যস, ওকে আপাদমস্তক দেখে তার স্যান্ডেলের নিচ থেকে সেই কাগজটি বের করলো। আর আমার আরেক ফ্রেন্ড একই পরীক্ষায় প্যান্টের পকেটে কাগজ নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এমন জায়গায় রেখেছে, যেটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে নি। ভালোই পরীক্ষা দিয়েছে ও।”
আহি হাসলো।
(***)
আফিফ আহিকে নিয়ে পাহাড়ে উঠেই দেখলো এক মধ্যবয়সী মহিলা চাঁটাই বিছিয়ে কাঁথা সেলাই করছেন। আফিফ আর আহিকে দেখে মহিলাটি উঠে দাঁড়ালেন। আফিফ আহিকে নামিয়ে দিয়ে মহিলাটিকে বলল, তারা বিপদে পড়েছে। আর তাদের এই মুহূর্তে যাওয়ার কোনো পথ নেই। এরপর আহির আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলো দেখিয়ে বলল, অন্তত আহিকে যাতে থাকতে দেয়, বা পরিচিত কারো সাহায্য নিয়ে যাতে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়। মহিলাটি ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মহিলাটির স্বামী বেরিয়ে এলেন। তিনি আফিফকে আশ্বস্ত করে বললেন যে আজ রাতেই গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন। তার না-কি পরিচিত সিএনজি ড্রাইভার আছে। সে না আসা পর্যন্ত আফিফ আর আহিকে ভেতরে বসতে বললেন। তারা ভেতরে গেলো। মাটি ও কাঠের তৈরী বাড়ি। মেঝে মাটির, দেয়ালটা কাঠের। আহি আর আফিফ সামনের ঘরটিতে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। দু’জনের দৃষ্টি আটকালো পাশে রাখা কাঠের খাটের দিকে। খাটটিতে একটা মলিন কাঁথা বিছানো। আহির পায়ে এখনো বেশ ব্যথা। পায়ে ভর দিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। আফিফও অনেকক্ষণ হেঁটেছে। তাই তারও এই মুহূর্তে বসা উচিত। ঘরটিতে আর কোনো বসার ব্যবস্থা না থাকায় দু’জনই সেই খাটের উপর বসলো, আর ওমনি খাটটি উলটে দু’জনই ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। আফিফের বুকের উপর এসে পড়েছে আহি। ব্যথায় এমনিতে নড়াচড়া করতে পারছে না, তার উপর আবার উলটে পড়েছে। মনে হচ্ছে শরীরের কলকব্জা সব ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। আহি চোখ বন্ধ করে আফিফের বুকের উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে। আফিফ নিজেও বেশ ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। ঘরের কর্তা তাদের এই অবস্থায় দেখে বললেন,
“এটা বসার জন্য না। আমার বউ এটাতে মরিচ-মশলা শুকায়।”
আফিফ আহিকে উঠানোর জন্য হাত ধরতেই আহি মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
“হাতটা এতো শক্ত করে ধরেছো কেন? এমনিতেই ভেঙে গেছে।”
আফিফ আহিকে সরিয়ে কোনোভাবে উঠে আহিকেও উঠালো। ভদ্রলোক পাশের ঘরটি দেখিয়ে দিতেই আফিফ আহিকে ধরে সেদিকে নিয়ে গেলো। রুমটিতে আলো আঁধারীর খেলা। ছোট একটা টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। আহি আর আফিফ পাশাপাশি একটা খাটে বসে আছে। দু’জনই চুপ করে আছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ তাদের নিরবতাকে স্পষ্ট করে তুলছে। আহি পাশ ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
আফিফ খাট থেকে উঠে বসে বলল,
“তুমি ঘুমাও।”
আহি খাটে পা তুলতে গিয়েই আবার মৃদু আর্তনাদ করলো। আফিফ আহির কাছে এসে তার পা দু’টি আলতো হাতে ধরে খাটের উপরে উঠিয়ে দিলো। আহি নিজের ব্যাগটা মাথায় নিচে রাখলো। আফিফ বলল,
“বালিশটা নাও।”
আহি মুখ ছোট করে বলল,
“না, আমি অন্যের বালিশে ঘুমাতে পারি না।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। বালিশটির দিকে তাকিয়ে বুঝলো কেন আহি এই কথা বলেছে। আহি মাথাটা রাখতেই পারছিলো না। আফিফ খাটে বসে তার মাথাটা উঠিয়ে তার কোলের উপর রাখলো। আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ তা দেখে বলল,
“বিপদে পড়লে অনেক কিছু এডজাস্ট করে নিতে হয়।”
আহি আফিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলল,
“তুমি না বললে ঘুমাবে?”
আহি চোখ সরিয়ে নিলো। আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। অনুভব করার শক্তিটিও নেই তার মনে। ঘুমিয়ে পড়লো আহি। আফিফ ঘুমালো না। সে আহির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাগ্য তাদের এমন এক রাস্তায় নিয়ে এসেছে, যেই রাস্তার কোনো দিক নেই, কোনো সমাপ্তি নেই, কোনো নাম নেই। আফিফ আহির কপালে হাত ছোঁয়াতে গিয়েও ছোঁয়ালো না। একটা চুল লেপ্টে আছে আহির নাক বরাবর। সরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস পাচ্ছে না সে। যদি আহির ঘুম ভেঙে যায়!
ফোন ভাইব্রেট করতেই পকেট থেকে ফোন বের করলো আফিফ। স্ক্রিনে পদ্মের নাম। কল রিসিভ করতেই পদ্ম বলল,
“কোথায় আপনি?”
“একটা কাজে আটকে গেছি।”
“আহির সাথে?”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আহির সাথে এটা জিজ্ঞেস করার কারণ কি? তাজওয়ার নিশ্চয় কিছু বলেছে!”
“হ্যাঁ, আহি আর আপনি কাপ্তাই তাজওয়ারের বাংলো বাড়িতে গিয়েছিলেন।”
“তারপর?”
“আহির জুতা আর আপনার বাইক দেখেছে।”
“হ্যাঁ, তোমার প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম।”
“এতো রাতে আহির সাথে কি করছেন?”
“গাড়ি পাচ্ছি না। পেলে বাসায় চলে আসবো।”
পদ্ম চেঁচিয়ে বলল,
“আমার সহ্য হচ্ছে না আফিফ।”
“আমি তো খুব সহ্য করেছি এতোদিন। এখন তুমিও সহ্য করা শিখে ফেলো।”
“আহি নিশ্চয় আপনাকে খুব ভালোবাসা দিচ্ছে, তাই না? এতো রাতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কিইবা করতে পারে?”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমাকে আমি প্রতিদিন একটু নতুন করেই চিনছি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে না, আমি পদ্মের সাথে কথা বলছি। আরো আগে যদি তোমাকে চিনতে পারতাম?”
“চিনে ফেললে, কি হতো? সেদিন কক্সবাজারে রাতটা আহির সাথেই কাটাতেন।”
আফিফ ফোন কেটে দিলো। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যাকে স্ত্রী হিসেবে ভালোবেসেছে, যাকে ফুল ভেবে সম্মান করেছে, সেই মানুষটার এমন রূপ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। আফিফ আহির মাথাটা আস্তে করে সরিয়ে উঠে ঘরের বাইরে চলে এলো।
(***)
ঘুম ভাঙতেই নিজেকে হালকা অন্ধকার ঘরে আবিষ্কার করে ভয় পেয়ে গেল আহি। তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে উঠে বসলো সে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে ডাকলো,
“আফিফ, আফিফ!”
আহি খাট থেকে নামতেই শরীরের ভারসাম্য ধরতে না পেরে পড়ে যাওয়ার আগে আফিফ ঘরে ঢুকে আহিকে ধরে ফেললো। আহি আফিফকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ খেয়াল করলো আহির শরীর কাঁপছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় হয়তো ভয় পেয়েছে। আফিফ আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কি হয়েছে? ভয় পেয়েছো না-কি?”
আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমি ভেবেছি আমাকে ডাকাত তুলে নিয়ে গেছে।”
আফিফ নিঃশব্দে হাসলো। আহি এখন আফিফকে জড়িয়ে ধরে আছে। আফিফ বলল,
“আমরা এখনো আগের জায়গায় আছি। গাড়ি কাছাকাছি চলে এসেছে। গাড়ি চলে এলেই আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।”
আহি এবার আফিফকে ছেড়ে দিল। আফিফকে ছেড়ে দিয়েই তার চোখের দিকে তাকালো। আফিফ চোখ সরিয়ে নিল। এবার দু’জন দু’পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। যেই ভাগ্য তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তাদের কি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাছে আসা উচিত? প্রকৃতি যদি চায়, তবেই তারা একে অপরের দিকে উন্মাদ দৃষ্টিতে তাকাবে। যেই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলার কোন প্রয়োজন হবে না৷ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যাবে ঘন্টার পর ঘন্টা। যেই মুগ্ধতায় কোনো ভয়, কোনো সংশয় থাকবে না।
চলবে-