উধয়রনী পর্ব-৪৭ + বোনাস পর্ব ১+২

0
364

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৭||

৯১।
পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি। আহি বাইরে দাঁড়ানো ছিল। তাদের বের হতে দেখে সে সালমা ফাওজিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে ফিরে তাকালো। আহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে। বাইরে থেকে যে-কেউ দেখলে বুঝবে সে বেশ শক্ত মনের, কিন্তু আহির স্পর্শটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে ভেতর থেকে এখনো অনেকটাই দুর্বল। সে গতকাল সকালে এসেই বাবা, মিসেস লাবণি ও তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেফতার করে নি। উলটো তাদের বলে এসেছে, একবার নিজ থেকে থানায় এসে যাতে দেখা করে যায়৷ আর রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি আজই এলেন থানায়। লাবণি থানায় আসার আগে আহিকে ফোন করে বলল, এসে তাদের মুক্তি দেখে যেতে। আহিও মাকে নিয়ে চলে এসেছে। ভেবেছে অন্তত কয়েকদিন তারা ছাড়া পাবে না। কিন্তু এক ঘন্টার জন্যও যে তাদের আবদ্ধ করা হবে না, এটাই বেশ কষ্ট দিয়েছে আহিকে। যারা বছরের পর বছর আহিকে ব্ল্যাকমেইল করে মানসিকভাবে বন্দি করে রেখেছিল, তাদের এক ঘন্টার শাস্তিও হলো না? অন্যদিকে তাজওয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাকে ওসি সাহেব হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ফলমূল। কাল সন্ধ্যায় তার সহচর সোহাগ এসে সেই হেলমেট পরা আগন্তুকের বিরুদ্ধে মামলা করে গেছে। সাথে প্রমাণস্বরূপ দিয়ে গেছে তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড। এদিকে আহি তাজওয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুনে তাজওয়ার আহিকে ফোন করে আহত কণ্ঠে বলেছিল,
“সুইটহার্ট যদি এমন স্পাইসি কাজ করে জীবনটা একদম বেদনাদায়ক হয়ে যায়। আমার শরীরে এতো এতো আঘাত, শুধু মনটা অক্ষত ছিল। আর তুমি সেটাও ভেঙে দিলে। থাক, সমস্যা নেই। ভাঙা মনে কীভাবে মানুষকে রাখতে হয়, তা আমি জানি।”

আর আহি উত্তরে কিছু না বলেই কল কেটে দিয়েছিল।

(***)

রিজওয়ান কবির আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন। আহি শক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিজওয়ান কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সালমা ফাওজিয়ার দিকে একনজর তাকিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছো। বেশ বাড়াবাড়ি করছো মনে হচ্ছে।”

আহি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“বাবা শব্দের অর্থ জেনে আসবেন, তারপর না হয় বাবা হওয়ার অধিকার দেখাবেন৷ আমি বাবার বিরুদ্ধে মামলা করি নি। আমি একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছি, যে তার ব্যবসার লাভের জন্য একটা মেয়ের সম্মানে আঘাত করেছে।”

মিসেস লাবণি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“যা করেছো, তার জন্য তোমাকে আর তোমার মাকে অনেক কিছু দেখতে হবে।”

আহি হালকা হেসে বলল,
“দেখে তো ফেলেছি। সব দেখে ফেলেছি। এবার দেখাতে হবে। তবে আপনাদের দেখাবো না। পুরো পৃথিবীকে দেখাবো। সবাইকে জানাবো, বাবা সবসময় রক্ষক হয় না। কিছু বাবা ভক্ষকও হয়। সব বাবা আগলে রাখতে জানে না, কিছু বাবা ধ্বংস করে দিতে জানে। সতর্ক করতে হবে সবাইকে। হিংস্র মানুষদের আসল চেহারা সবাইকে দেখাতে হবে।”

লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তা, কীভাবে দেখাবে শুনি? কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”

আহি মাথা নিচু করে বলল, “প্রমাণ পেয়ে যাবো।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরের হাত টেনে ধরে বলল,
“বাসায় চলো। তোমার মেয়েকে কিছুদিন মুক্তির স্বাদ পেতে দাও। বন্দি থাকতে থাকতে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। না আছে কোনো প্রমাণ, আসছে আমাদের ধমকাতে।”

লাবণি রিজওয়ান কবিরকে নিয়ে সামনে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে গেলো। সে পেছন ফিরে আহিকে বলল,
“আহি, ফিরে তো তোমাকে আসতেই হবে। আর এবার ফিরে এলে, পেছনে কাউকে জীবিত দেখবে না। তোমার তিন বান্ধবী, তোমার প্রাণের দুই বন্ধু, তাদের পুরো পরিবার আর তোমার মা ও তার পরিবার, না জানি কার কার কাফনের কাপড় কিনতে হয়৷ এক কাজ করো, আজ থেকেই কেনাকাটা শুরু করে দাও। আর কুলখানির আয়োজন তো হবেই। আমরা না হয় তোমার হয়ে দান করে দেবো।”

কথাটি বলেই তারা গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের হাত ধরে বললেন,
“প্রমাণ কোথায় পাবি?”

আহি মায়ের হাতে আলতো হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
“প্রমাণ তো আমার কাছে আছেই। কিন্তু আমি এতো সহজে সেই প্রমাণ সবার সামনে আনবো না। অনেক বছর তারা আমাকে মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছে। আমি তাদের তিলে তিলে কষ্ট দেবো। রিজওয়ান কবিরের কাছে তার রেপুটেশন, বিজনেস, ইগো, আমার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তার রেপুটেশন, বিজনেস ইগো, সবকিছুই ধ্বংস করে দেবো। মিসেস লাবণি সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, একবার যদি সেটা সবার সামনে আনতে পারি, আমার কষ্টগুলো মুক্তি পাবে। আমি তো নিজেকে মুক্ত করে নেবোই। কিন্তু কয়েক বছর পর আমি আর শান্তি পাবো না। তাই আমার নিজের কষ্টগুলোকেও মুক্ত করতে হবে। তারপর আমি শান্তিতে বাঁচতে পারবো।”

(***)

তাজওয়ার কয়েক বার সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ড দেখে ফেলেছে। সে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না তাকে মারার সাহস কারো থাকতে পারে। সোহাগ তাজওয়ারকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল,
“স্যার, আপনার কাকে সন্দেহ হচ্ছে?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির সাথে জড়িত কেউ এই কাজ করেছে।”

“রাদ?”

তাজওয়ার কিছু একটা ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হুমম, রাদ। আমার বাংলো বাড়ি সম্পর্কে আহি ছাড়া আর কেউই জানে না। আহি রাদকে এই ইনফরমেশন দিয়েছে, আর রাদই এই কাজ করেছে।”

“স্যার, আপনি অনুমতি দিলে তাকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে আসছি।”

তাজওয়ার ফুটেজটা আবার দেখে বলল,
“না, না, না। রাদ হবে না। এই ছেলে রাদ নয়। রাদ অনেকবার আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। হেলমেট পরা এই ছেলেটা আমার সমান৷ আর রাদের হাইট আমার চেয়ে বেশি। হাইট জুতো পরে বাড়ানো যায়, কিন্তু কমানো যায় না। এই ছেলে রাদ হবেই না।”

“তাহলে কে?”

“আহির বন্ধু, কি যেন নাম?”

“লাবীব?”

“হ্যাঁ, লাবীব। ছেলেটার বাইকও আছে। বেশ ভালোই বাইক চালায়।”

“স্যার, আফিফও তো হতে পারে!”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর কথা আমার মাথায়ও আসে নি। ও এমন কাজ করতে পারবে? ওর কি সেই সাহস আছে?”

“আপনার বাংলো বাড়ি সম্পর্কে মিস আহির চেয়ে আফিফেরই ভালো জানার কথা। এখন তো সে আপনার এসিস্ট্যান্ট হিসেবেই কাজ করছে।”

তাজওয়ার চুপ করে রইলো। সোহাগ তাজওয়ারকে চুপচাপ দেখে বলল,
“কি ভাবছেন, স্যার?”

“আফিফকে আমি বোকা ভেবেছি। এখন ভাবছি, এই বোকাটা যদি সত্যিই চালাক হয়ে থাকে, তবে আমি ওকে আমার এসিস্ট্যান্ট বানিয়ে চরম ভুল করেছি। কারণ ওর কাছে আমার সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট ইনফরমেশন থাকার কথা। ও আমাকে যে-কোনো মুহূর্তে ফাঁসাতে পারে।”

“স্যার, চিন্তা করবেন না। আফিফ এই কাজ নাও করতে পারে। আমি তো শুধু ওর নামটা জানালাম আপনাকে। আপনি এর আগে ওর আপার সাথে যা করেছেন, তারপর তো সে কিছুই করে নি।”

“করে নি কারণ রেনুকে নিয়াজীর সাথে বিয়ে দিয়ে আমি ওকে হাতে রেখেছিলাম।”

“তাহলে এখনো তো সে হাতেই আছে।”

তাজওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নেই। মনে হচ্ছে নেই। আহি হুট করে নিয়াজীর বাড়িতে গিয়ে যেই কাজ করলো, এরপর নিয়াজী রেনুকে এখন আর কিছুই করবে না।”

“স্যার, আপনি ওকে মেরেছেন তাই কিছু করবে না। নিয়াজীকে বলে দিন, রেনুকে যাতে হাতছাড়া না করে। রেনু নিয়াজীর সাথে আটকে থাকলে আফিফ শান্ত থাকবে।”

“আর আফিফ দুর্বল থাকলে, আহি নেতিয়ে পড়বে।”

“হ্যাঁ, স্যার। মিস আহি অন্য কোনো ব্যাপারে ভয় পাক না পাক, আফিফের ব্যাপারে বেশ নরম।”

“ভালোবাসা। একেই তো বলে শুদ্ধ ভালোবাসা। এদের ভালোবাসা আমি কোনোভাবেই থামাতে পারি নি। আফিফকে আমি এতো কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু সে আহিকে ঘৃণায় করতে পারলো না। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি, আফিফ নিজেই পদ্মকে বিয়ে করে নিয়েছে।”

“মিস আহি এখনো সত্যটা জানে না।”

“আফিফ নিজেও এই সত্যটা জানে না। সবটাই তো আমার প্ল্যান ছিল।”

“কিন্তু আফিফ এখন পদ্মকে ভালোবাসে। সে কি আহির জন্য এমন কিছু কর‍তে পারে, যা তার পরিবারের জন্য ক্ষতিকর?”

“আরেহ এটা মায়া। এটা সেই ভালোবাসা না, যেটা আফিফের মনে এখনো গেঁথে আছে। আফিফ পদ্মকে ভালোবাসে, তবে সেটা তার স্ত্রী হিসেবে। তার দায়িত্ব হিসেবে। প্রেমিকা আর স্ত্রীর মধ্যে এটাই তো পার্থক্য। আর আহির প্রতি আফিফের অনুভূতি যদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, আমি কোনোভাবেই আহিকে নিজের করে নিতে পারবো না। আর আমার আহিকে চাই-ই চাই।”

“মিস আহির হয়তো আফিফের বোনের ব্যাপারে জানা উচিত। সত্যটা জানলে, সে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।”

তাজওয়ার ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, এই সত্য আহি জানলে পদ্মকে বিয়ে করার কারণটাও সে জেনে যাবে। আমার সুইটহার্ট অসম্ভব চালাক। দেখায় একদম শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ ধূর্ত। ওতো আমাকে ফাঁসানোর সব প্ল্যান করে ফেলেছে। এখন শুধু সেই প্ল্যানগুলো আমার জানতে হবে।”

৯২।

আহির মুখের সামনে একটা চিপস ধরলো রাদ। আহি রাদের দিকে ফিরতেই রাদ আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আহিও হালকা হেসে আবার মুখটা গম্ভীর করে ফেললো। রাদ তা দেখে বলল,
“সবসময় মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রাখিস কেন? এখন তো হাসতে পারিস। আন্টির সাথে আছিস, আমি আছি তোর পাশে। এখন কিসের কষ্ট?”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখনো অনেক কিছু করা বাকি। ভাবছি, শুরুটা কীভাবে করবো?”

“পরে ভাবিস। আগে খা।”

“তুই একটু বেশিই যত্ন নিচ্ছিস আমার!”

“আগে বন্ধু ছিলি, এখন প্রেমিকা। আর প্রেমিকাদের একটু বেশিই যত্ন নিতে হয়।”

আহি রাদের চোখের দিকে তাকালো। রাদের বাড়ন্ত অনুভূতিটা অনুভব করে খুশি হবে না-কি কষ্ট পাবে, সেটা বুঝতে পারছে না আহি। এভাবেই তো প্রিয় মানুষকে ভালোবাসতে হয়। আহি যেভাবে আফিফকে ভালোবেসেছিল, রাদ ঠিক সেভাবেই আহিকে ভালোবাসতে চায়ছে। আহি জানে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলা কতোটা কষ্টের৷ আহি রাদকে সেই কষ্ট দিতে পারবে না। অথচ তার মনে রাদের প্রতি ভালোবাসাটা শুধুই বন্ধুর মতো। আহির দম বন্ধ হয়ে আসছে। সারাজীবন বাস্তবতার সাথে কম্প্রোমাইজ করে গেছে সে৷ তাজওয়ারকে বিয়ে করার জন্য সম্মতি দেওয়া, মায়ের সাথে থাকতে চেয়েও থাকতে না পারা, আবার এখন রাদকে প্রেমিক হিসেবে মেনে নেওয়া। আর কতো কম্প্রোমাইজ করবে সে? রাদকে কষ্ট দিতে চায় না আহি। আর তাই রাদের অনুভূতিটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। এই মানুষটাই তো নিঃস্বার্থভাবে তাকে ভালোবেসেছে। তার জন্য কি আহি এতোটুকু করতে পারবে না? এসব ভাবতে ভাবতেই আহির চোখ ভিজে উঠলো। রাদ আহির চোখে পানি দেখে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছিস কেন তুই?”

আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার মনটা শান্ত হচ্ছে না, রাদ। আমি কোথায় একটু শান্তি পাবো, বলবি?”

রাদ আহিকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আছি, তাও ভালো লাগছে না?”

আহি এবার রাদকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো। আহির গভীর চোখ দু’টি উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। রাদ সেই চোখ দু’টি আলতোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
“আমি তোর পাশে আছি। পাশে থাকবো।”

আহি মলিন হাসলো। রাদের হাত ধরে বলল,
“খুব ভালোবাসিস আমাকে?”

“হ্যাঁ, খুব।”

আবার আহির অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাদ আবারও সেই চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন, বল? আমার ভালোবাসা কি তোকে কষ্ট দিচ্ছে, আহি?”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“না না, কি বলছিস? আমার তো ভালো লাগছে। ভালো লাগলেও কিন্তু মানুষ কাঁদতে পারে।”

“হ্যাঁ, তুই পারিস হয়তো৷ তোর অশ্রু গ্রন্থিতে অশ্রু একটু বেশিই।”

আহি মনে মনে বলল,
“হ্যাঁ রাদ, আমার চোখে একটু বেশিই অশ্রু। হাসতে চাই, কিন্তু এই অশ্রুগুলো হাসতে দেয় না। আর এবার হয়তো তোকে ভালোবাসতে না পারাটাই আমার অশ্রু হয়ে বের হচ্ছে। তোকে তোর মতো করে ভালোবাসতে পারবো না আমি। তোর সাথে অন্যায় করে ফেলছি হয়তো। কিন্তু তোকে আমি সত্যটা জানালে তুই আরো কষ্ট পাবি। তার চেয়ে ভালো, আমিই কষ্ট পাই৷ কষ্ট সহ্য করার অনেক ক্ষমতা দিয়েই আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। শুধু শুধু অন্যকে সেই কষ্টের ভাগ কেন দেবো আমি? তোর ভালোবাসা পাওয়া যে-কোনো মেয়ের জন্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর দেখ, আমি কতো সৌভাগ্যবতী। অথচ আমি সুখে নেই। আমি কোনো শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না। নিজের মতো করে বাঁচতেও পারছি না।”

(***)

পদ্ম থমথমে মুখে বসে আছে। আফিফ দু’কাপ চা বানিয়ে ঘরে ঢুকে পদ্মকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
“কি হলো? মন খারাপ না-কি?”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকালো। পদ্মের চোখ চিকচিক করছে। আফিফ তা দেখে চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে পদ্মের পাশে বসে বলল,
“কাঁদছো কেন? মা কিছু বলেছে?”

পদ্ম মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তাহলে মন খারাপের কারণ!”

পদ্ম শান্ত দৃষ্টিতে আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, আফিফ।”

আফিফ পদ্মের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“জানি, তো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।”

“আমি আহিকেও খুব ভালোবাসি।”

“জানি আমি। তুমি সবাইকে খুব বেশিই ভালোবাসো। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমার পদ্মফুল তুমি।”

“মোটেও না। আমি ভালো না, আফিফ। আমি অনেক খারাপ। আমি অনেক খারাপ।”

“কি বলছো তুমি?”

“জানি না, কিচ্ছু জানি না আমি। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব৷ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আহি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে, এটা যতোবার মনে পড়ছে, আমারই মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

“পদ্ম, এখন আহি ঠিক আছে।”

“আমিই হয়তো এসবের জন্য দায়ী।”

“কি যা তা বলছো? তুমি কেন দায়ী হবে?”

পদ্ম আফিফের চোখের দিকে তাকালো। নিজেকে শান্ত করে আফিফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। একনজর সামনের দেয়ালে থাকা ছবিটির দিকে তাকালো। বেশ কিছুক্ষণ সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমি আহিকে বাসায় রেখে দিলে, ওর সাথে ওমন ঘটনা ঘটতো না।”

আফিফ পদ্মের গা ঘেঁষে বসে বলল,
“এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। যার অপরাধ, সে শাস্তি পাবেই। এখন চা খাও। আমি তোমার জন্য নিজ হাতে চা বানিয়েছি।”

পদ্ম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আবার সেই ছবিটির দিকে তাকালো। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার মতো মানুষকে নিজের করে পাওয়াটা আমার ভাগ্যে ছিল না। আমি হয়তো কারো ভাগ্য চুরি করেছি।”

আফিফ থমকে গেলো। চায়ের কাপ হাত থেকে রেখে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?”

“এমনিতেই।”

আফিফ চুপসে গেলো। পদ্ম কি কোনো ভাবে সত্যটা জেনে গেছে? এমন মুহূর্তে সত্যটা জানলে যে আহির জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি হবে! আহি তার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। রাদ যেহেতু আহিকে ভালোবাসে, অন্তত তাদের এক হওয়ায় কোনো বাঁধা দিতে চায় না আফিফ। রাদের সাথে ভালো থাকুক আহি। এটাই চায় সে। কিন্তু পদ্ম যদি অতীতটা জেনে যায়, তাহলে আবার ঝামেলা হবে। আফিফকে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে।

(***)

সোহাগ লাবীব আর আফিফের মোটরসাইকেলের সম্পূর্ণ তথ্য বের করে তাজওয়ারের সামনে রাখলো। তাজওয়ারকে যে মোটরসাইকেল আরোহী মার‍তে এসেছিল, তার মোটর সাইকেলের সাথে লাবীব আর আফিফের মোটর সাইকেলের কোনো মিল নেই। লাবীবের মোটর সাইকেল মোটামুটি দামী। আর আফিফেরটা অনেক পুরোনো মডেলের। আর যেই আগন্তুক তাকে মেরেছে, তার মোটরসাইকেলটা অনেক বেশি দামী। যেই মোটর সাইকেল কেনা আফিফের সামর্থের বাইরে। তবে লাবীব চাইলে কিনতে পারে। তাজওয়ার সব দেখে অনেক ভেবে বলল,
“আহির টিম আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছে। এখনো আফিফ আর লাবীবের মধ্যেই আটকে আছি আমি। আফিফের এই বাইক কেনার কোনো সামর্থ নেই। আর লাবীবের জন্য এই বাইক কেনা একটা স্বপ্ন পূরণ করা। আর এতো দামী বাইক নিয়ে লাবীব অন্তত আমাকে মারতে আসবে না। ও নিজের বাইককে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। মনে হচ্ছে, এই কাজ আফিফই করেছে। আর যদি এটা তার কাজ হয়, তাহলে নিশ্চিত সে এই বাইক কারো কাছ থেকে ধার নিয়েছে। আফিফের বন্ধুদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যার বাইকের শো’রুম আছে? বা এমন কোথাও কাজ করে?”

সোহাগ বলল,
“স্যার, দু’একদিন সময় দিতে হবে৷ আমি সব ইনফরমেশন বের করে আপনাকে জানাচ্ছি।”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“এই কাজ যদি আফিফের হয়, তাহলে মিস্টার আফিফ রাফাতের কপালে তো দুঃখ নেই৷ তবে অন্য কারো কপালে দুঃখ ঠিকই আছে৷ এবার উলটো পথ ধরবো। আহির জীবনের সুতোটা এমনভাবে ঘুরিয়ে দেবো। আহি সেই সুতোর জট খুলতে আমার কাছেই আসবে।”

(***)

উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালো কালো হেলমেট পরা এক পুরুষ। উজ্জ্বল তাকে দেখেই বলল,
“আপনি কে? আমাকে এখানে কেন আসতে বলেছেন?”

হেলমেট পরা যুবকটি কিছু ফাইল উজ্জ্বলের দিকে এগিয়ে দিয়ে কোনো উত্তর না দিয়েই মোটরসাইকেলে উঠে চলে গেলো। উজ্জ্বল অবাক হয়ে আগন্তুকটির যাওয়া দেখছে। সে এবার নিজের গাড়িতে উঠে ফাইলটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা,

তাজওয়ারের অর্থপাচারের সব রেকর্ড এই ফাইলে আছে। আমি আহির শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনি আহির পক্ষে কেইস নিয়েছেন, তাই আপনাকে এই তথ্যগুলো দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

উজ্জ্বল ফাইলের ভেতরে থাকা সব তথ্য দেখে সাথে সাথেই আহিকে ফোন করলো। আহি কল রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“প্ল্যান ডি এক্সিকিউট করতে হবে।”

আহি সেই মুহূর্তে সালমা ফাওজিয়ার কোলে শুয়ে ছিল। সে উজ্জ্বলের কথা শুনে মাথা তুলে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“মানে? কিছু হয়েছে?”

“অনেক বড় কিছু হয়েছে। তুমি শুধু শুরু করো। আমি যা পেয়েছি, তা দিয়ে অন্তত চার বছর কাভার হবে। বেশি হলে দশ বছর। পুরো জীবন কাভার করার জন্য প্ল্যান ডি এর পাশাপাশি প্ল্যান সিতে মনোযোগ দিতে হবে। একসাথে দু’টো হলে, আমাদের বেশি সময় লাগবে না।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||

৯৩।
আফিফ মোটরসাইকেল নিয়ে তার বন্ধুর শো’রুমের কাছে আসতেই শো’রুমের সামনে তাজওয়ারের গাড়ি দেখে থেমে গেলো। সে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে একপাশে পার্ক করে শো’রুমটি থেকে কিছুটা দূরে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালো। এরপর ফোন বের করে তার বন্ধুকে কল করতেই, আফিফের সেই বন্ধু কল ধরে বলল, “তুই কোথায়?”

“শোন, আমার সাথে কানেক্ট থাক। এখন যে এসেছে তোর কাছে, সে কিন্তু সুবিধার না। আমি তোকে যা যা বলছি, তুই কিন্তু তাই বলবি। লাইনে থাক। আর কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখিস। হোয়াটসঅ্যাপে কল করছি আমি। তুই কলটা রিসিভ করে রাখবি শুধু। ওকে?”

“হ্যাঁ ঠিক আছে।”

“আর শোন, ফোনটা হাতে রাখিস। আমি যাতে কথা ভালোভাবে বুঝতে পারি। আর আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে সত্য কথায় বলবি। ভয় পাবি না। আর আরেকটা কথা। যদি তোকে সেই বাইকের ছবি দেখায়। ইনফরমেশন চায়, তুই কিন্তু বলিস না যে বাইকটা তোর শো’রুমের না। ওরা তথ্য নিয়েই এসেছে। তোকে বোঝাতে হবে, তুই এসবের কিছুই জানিস না। তাই তুই বলবি, বাইকটা হয়তো তোর শো’রুমেরই, কিন্তু অন্য ব্রাঞ্চের।”

আফিফের কথামতো তার বন্ধু নিলয় হোয়াটসঅ্যাপের কল রিসিভ করে, ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করে দিলো। এরপর সোহাগের সামনে এসে দাঁড়ালো। সোহাগ নিলয়ের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আফিফকে চেনো?”

নিলয় মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ। আফিফ আমার ক্লাসমেট ছিল। আপনি কি ওর পরিচিত?”

“হ্যাঁ, আমরা একই কোম্পানিতে কাজ করি।”

“ওহ আচ্ছা, বসুন বসুন। বাইক কিনতে এসেছেন না-কি?”

সোহাগ চেয়ারে বসেই টেবিলের উপর সেই কালো রঙের মোটর সাইকেলটির ছবি রেখে বলল,
“এই বাইকটা তোমার শো’রুমের?”

নিলয় ভালোভাবে বাইকটা দেখতে লাগলো। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবি তাই সে কাছে এনে দেখে বলল,
“ছবি তো পরিষ্কার না। কিন্তু মনে হচ্ছে এই বাইকটা আমার শো’রুমেই আছে। তবে এই ব্রাঞ্চে নেই।”

সোহাগ ঝুঁকে বসে বলল, “কোন ব্রাঞ্চে আছে?”

“অক্সিজেনে আমার আরেকটা শো’রুম আছে। ওখানেই থাকতে পারে।”

“আচ্ছা? যাও, তোমার কোম্পানির বেচা-কেনার রেকর্ডটা নিয়ে আসো।”

নিলয় ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“রেকর্ড দেখবেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

সোহাগ গম্ভীরমুখে বলল,
“হুম, বেশি কথা না বলে নিয়ে আসো।”

নিলয় ভেতরে চলে এলো। এরপর ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“আফিফ, কি করবো?”

“শোন, পাঁচ মিনিট পর বের হয়ে বলবি ফাইলটা অক্সিজেনেই। কাগজ-পত্রগুলো তুই ওখানে নিয়ে গেছিস। এরপর যদি তোকে সাথে নিয়ে অক্সিজেন যেতে চায়, তাহলে তুই মেইন রোড দিয়ে যাবি না। আরেকটা ছোট গলি আছে ওদিকে যাবি। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

নিলয় কল কেটে প্রায় দশ মিনিট পর বেরিয়ে এসে বলল,
“হয়তো ফাইলগুলো ওই ব্রাঞ্চে রেখে এসেছি।”

“ওখানে কেন?”

“একটা জরুরি কাজে নিয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো ওখানেই ফেলে এসেছি।”

“গাড়িতে উঠো। আমার সাথে চলো। ফাইলটা আমার আজই লাগবে।”

নিলয় সোহাগের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি শো’রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আফিফ তাড়াতাড়ি মোটর সাইকেলে উঠে বসে চাবি ঘোরালো। ধীরে ধীরে গতি বাড়াতে লাগলো আফিফ। আর সোহাগের চোখের আড়াল হয়েই মোটর সাইকেল চালাতে লাগলো। কিছুদূর গিয়ে আফিফ থামলো। সে সোহাগের নম্বরে কল করলো। এদিকে আফিফের কল দেখে সোহাগ গাড়ি থামালো। সে একনজর নিলয়কে দেখে নিলো। নিলয় তো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।এরপর সোহাগ কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আফিফ বলল,
“তোমাকে হুট করে কল দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমি একটা বিপদে পড়েছি। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে বিশ হাজার টাকা ধার দিতে পারবে? আমি এখন অক্সিজেনের এদিকটাই আছি।”

সোহাগ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “হোয়াট রাবিশ?”

“আসলে স্যারকে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুনলাম, স্যার অসুস্থ। তাই উনার কাছে খুঁজতে পারছি না। উনি যদি ক্ষেপে যান?”

সোহাগ ধমকের সুরে বলল,
“মশকরা করছিস আমার সাথে? আমি তোকে কোনো টাকা ধার দিতে পারবো না। আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি।”

“যদি দিতে বেশি উপকার হতো। আমার মা অসুস্থ।”

এরই মধ্যে আফিফ দেখলো একটা মালবাহী গাড়ি এদিকেই আসছে। আফিফ হাতের ইশারায় গাড়িটিকে পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দিলো। এরপর সোহাগকে বলল,
“একটু যদি সাহায্য করতে।”

সোহাগের মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে ছিল। সে আফিফকে অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে কল কেটে দিলো। আফিফ সোহাগের কথা শুনে মুচকি হাসলো। এরপর সে মোটর সাইকেল থেকে নেমে হেলমেট খুললো। পকেট থেকে আরেকটা ফোন বের করলো। এরপর দ্রুত হাতে একটা ফোন থেকে সিম খুলে অন্য ফোনে লাগিয়ে পাশের দোকানদারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল ফোনটা একটু পর এসে নিয়ে যাবো। আপনি মনে করবেন, আমি আপনার দোকানে বসে চা খাচ্ছি।”

দোকানদার হালকা হেসে বলল,
“তোমার জন্য এইটুকু করতে পারবো না? তোমার বাবা আমার বন্ধু মানুষ। তুমি আমার ছেলের মতোই।”

আফিফ হাসলো। সবকিছুই তার পরিকল্পনা মতোই হচ্ছে। চায়ের দোকানদার আফিফের গ্রামের চাচা। উনার সাথে আবার আফিফের বাবার ভালোই কথাবার্তা হতো। আফিফ এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি আনার মূল কারণ এটাই ছিল, যাতে ফোনটা চাচাকে দিয়ে যেতে পারে। এখন পুলিশ তাকে ট্র‍্যাক করলে লাস্ট লোকেশন এখানেই পাবে। আর সে সোহাগকে কলে ব্যস্ত রেখে কিছুক্ষণ থামিয়ে সেই মালবাহী গাড়িটিকেও সময়মত সেই জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এবার আফিফ নিশ্চিন্ত মনে আবার মোটরসাইকেলে উঠে বসলো।

(***)

নিলয় সোহাগকে আফিফের বলা রাস্তা দিয়েই গাড়িটা নিয়ে যেতে বললো। সোহাগও সেদিকে ঢুকলো। গাড়ি সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই আফিফ তার আগের গলি দিয়ে ঢুকে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে সেই গলির সামনে এনে দাঁড় করালো। এদিকে সেই কালো হেলমেট পরা আগন্তুকটিকে সামনে দাঁড়ানো দেখে সোহাগ বেশ অবাক হলো। সে গাড়ি থামালো। আফিফও হাতের ইশারায় সোহাগকে গাড়ি থেকে নামতে বললো। সোহাগ সাথে সাথে নামলো না। সে প্রথমে গাড়ির সামনের বক্স খুলে তার পিস্তলটা বের করলো। এদিকে নিলয় তো সোহাগের হাতে পিস্তল দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পর পিস্তল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো সোহাগ। সোহাগ গাড়ি থেকে নামতেই আফিফ হাত নাড়িয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“কেমন আছো, সোহাগ?”

সোহাগ আফিফের দিকে পিস্তল তাক করে বলল,
“বসের গায়ে হাত তুলেছিস, তোর সাহস তো খুব বেড়ে গেছে দেখছি।”

সোহাগ গাড়ির অন্য দরজা খুলে নিলয়ের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামালো। আফিফ মোটর সাইকেলের হাতলে হাত রেখে সোহাগের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহাগ বলল,
“তোর বন্ধুকে উপরে উঠিয়ে দিতে আমি দ্বিতীয় বার ভাববো না।”

আফিফ মোটর সাইকেল থেকে নেমে চাবি হাতে নিয়ে তা শূন্যে উঠিয়ে অন্য হাতে ধরে বলল,
“ওকে ডান। চালা গুলি। দেখি তোর সাহস কেমন!”

নিলয় চোখ বড় বড় করে আফিফের দিকে তাকালো। সোহাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে পিস্তল চালালো। একবার, দুইবার, তিনবার। পরপর তিনবার পিস্তল চালিয়েও কোনো শব্দ হলো না। সোহাগ ভ্রূ কুঁচকে পিস্তলটা এপাশ-ওপাশ ঘোরাতে লাগলো। আফিফ তার পকেট থেকে একটা ট্রান্সপারেন্ট প্যাকেট বের করে বলল,
“সবটাই তো আমার কাছে, চলবে কীভাবে? ওটা নিয়ে বরং তুই চোর-পুলিশ খেল। তুই হবি পুলিশ, আমি হবো চোর। ধরতে পারলে আমি আউট, ধরতে না পারলে তুই আউট।”

সোহাগ পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“কি চাস তুই? কেন করছিস এসব?”

আফিফ হাতের ইশারায় নিলয়কে চলে যেতে বললো। নিলয় ছাড়া পেয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। সে দ্বিতীয় বার আর পেছন ফিরে তাকালো না। নিলয় চলে যেতেই আফিফ সোহাগের সামনে এসে দাঁড়ালো।

সোহাগ গম্ভীরমুখে বলল, “প্ল্যান কি তোর?”

আফিফ হালকা হাসলো। সোহাগ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমাকে এখনো চিনতে পারিস নি। তুই হয়তো জানিস না, আমি কে?”

“কে তুই? দেখি বল না। একটু শুনি।”

সোহাগ হাসলো। আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমাদের কিন্তু তোকে চিনতে ভুল হয় নি। তুই-ই যে এই কাজ করেছিস তা আমরা ধরতে পেরেছিলাম। তবে এটা বিশ্বাস কর‍তে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো যে তুই এই কাজ কীভাবে করলি? তোর মতো বোকা, ভীতু এই কাজ… না, না, না। তুই কি আসলেই আফিফ রাফাত?”

আফিফ হেলমেট খুলে বলল,
“এখনো কি কোনো সন্দেহ আছে?”

“আরেহ, তুই ধরা খেয়ে নিজের পরিচয়টায় জানিয়ে দিলি? কি-রে ভয় পেয়ে গেছিস না-কি? হ্যাঁ, পেতেই পারিস। আফটার অল তোর ছোট বোনের ভবিষ্যৎ তোর হাতে।”

“তারপর?”

আফিফের এমন গা ছাড়া ভাব সোহাগের পছন্দ হলো না। সে আফিফের জ্যাকেট টেনে ধরে বলল,
“তোর বড় আপার সাথে কি হয়েছে ভুলে গেলি না-কি?”

“কি হয়েছে আপার সাথে?”

“তোর আপার প্রেমিককে আমিই মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলাম। তার নামে মিথ্যে কথা ছড়ানোর জন্য আমিই তার সহকর্মীদের বাধ্য করেছিলাম। আর সেই ভিডিওটা…”

সোহাগ এতোটুকু বলেই থামলো৷ এরপর বিশ্রীভাবে হেসে বলল,
“ভিডিওটাও আমিই বানিয়েছিলাম। তোর আপা…..”

সোহাগের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখেই পরবর্তী বাক্যটা আন্দাজ করে ফেলেছে আফিফ। সে আর সোহাগকে কথাটি সম্পূর্ণ কর‍তে দিলো না। সোহাগের নাক বরাবর ঘুষি মারলো সে। সোহাগ নাকে হাত দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। আফিফ তার হেলমেটটা হাতে নিয়ে পরপর কয়েক বার সোহাগের মাথায় আর ঘাড়ে আঘাত করলো। সোহাগ মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই আফিফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার চোখ দু’টি লাল হয়ে গেছে। সোহাগ জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে হালকা হাসলো। আর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবি না। তোর এই একটা দুইটা আঘাতে আমার কিছুই হবে না।”

আফিফ হাতের গ্লাভস ভালোভাবে আটকাতে আটকাতে বলল,
“আমি কিছুই কর‍তে পারবো না। আমি কিছু করবোও না। তবে সবটা চোখের পলকেই হয়ে যাবে। আমার স্পর্শ ছাড়াই।”

আফিফ সোহাগের কলার ধরে তাকে উঠালো। উঠিয়ে আবার মাটিতে ছেড়ে দিলো। সোহাগের নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই সে নাকে হাত দিয়ে বলল,
“তুই বাঁচবি না, আফিফ।”

আফিফ হাতের ইশারায় বলল,
“আয় না, উঠে আয়।”

সোহাগ উঠে দাঁড়ালো। আফিফ সজোরে সোহাগের পেটে লাথি মারলো। সোহাগ গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে আবার মাটিতে বসে পড়লো। সে এবার পা ঘুরিয়ে আফিফকে জোরে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। আফিফ পড়ে যেতেই সোহাগ কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ালো। সে আফিফের হেলমেটটা হাতে নিয়ে সেটা দিয়েই আফিফকে মার‍তে আসবে তখনই আফিফ দেরী না করে রাস্তায় পড়ে থাকা বালির কণা হাতে নিয়ে সোহাগের চোখের সামনে ছুঁড়ে দিলো। হালকা হাওয়ায় বালির কণা উড়ে এসে সোহাগের চোখে ঢুকতেই সে থেমে গেলো। সে ব্যস্ত হয়ে চোখ কচলাতে লাগলো। আফিফও এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। এরপর হেলমেটটা সোহাগের হাত থেকে নিয়ে বলল,
“আমার আপাকে মেরেছিস। আমি কিছু করতে পারি নি। তোর বস আহির সাথেও একই কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু এবার আমি চুপ থাকবো না।”

সোহাগ চেঁচিয়ে বলল,
“তোর সমস্যা কি এখানে? আহি কি তোর বউ না-কি? আমাদের বসের হবু স্ত্রী সে। বস যা চাইবে, তাই করবে।”

আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। সে আবার সোহাগের নাক বরাবর ঘুষি দিলো। সোহাগ এক ঘুষিতে আবার মাটিতে পড়ে গেলো। আফিফ তার বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আহি কোনো পুতুল না যে তোর বস যা ইচ্ছে তাই করবে। আর আহিকে প্রটেক্ট করার জন্য আমার কোনো নাম বা ওর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকার প্রয়োজন নেই। ওর জন্য আমি এমনিতেই সব করতে পারবো।”

সোহাগ কাঁপা কন্ঠে বলল, “ভালোবাসিস, তাই না?”

আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। সে সোহাগের কলার ধরে তাকে টেনে উঠিয়ে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তাজওয়ার খানের এসিস্ট্যান্ট হয়ে বেশ ভালোই হয়েছে। শান্তশিষ্ট আফিফ রাফাতের আড়ালে যেই ভয়ংকর মানুষটা ছিল, তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তাজওয়ার খানের দয়ায়। হি ইন্সপায়ারড মি আ লট। আরেহ, এই ভ্যাম্প আফিফের আইডল ম্যান তো তাজওয়ার খানই। এখন বসের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি আমার দ্বিতীয় মিশনটা কমপ্লিট করবো।”

“কি করবি তুই?”

আফিফ সোহাগকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে বলল,
“অর্ণবের এক্সিডেন্টটা আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছিল। ওটা না হয় খাদে পড়ে গিয়েছিল। ভাবছি তোকে খাদে ফেলে লাভ নেই। মাটির উপরে মরে, মাটির নিচে চলে যাবি।”

আফিফ এরপর তার পকেটে থাকা গুলি গুলো সোহাগের পিস্তলে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“গাড়ির আরেকটা চাবি আমার কাছে ছিল। এই গাড়ি তো বসের। আমিও তো চালিয়েছিলাম। এইটুকু বুদ্ধি নেই তোর? আর নিজের পিস্তল সামলে রাখবি না? থাক, ওপাড়ে গিয়ে অন্তত নিজের কর্ম সামলে রাখিস। বলা তো যায় না একটা ভালো কাজ ছুটে গেলেই তোর কপালে দুঃখ। খারাপ কাজের তো ডিগ্রি নিয়ে ফেলেছিস তুই।”

সোহাগ গাড়ি থেকে বের হতে চাইলেই আফিফ তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। সোহাগ চেঁচিয়ে বলল,
“কি করতে চাচ্ছিস তুই?”

আফিফ তার অন্য ফোনটি বের করে কাকে যেন কল করলো। এই ফোনের সিমটা অবশ্য আফিফের ছিল না। সে একজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছে। যার কাছ থেকে ধার নিয়েছে সে আফিফকে চেনে না। দেখেও নি। হেলমেট পরেই আফিফ তার সামনে গিয়েছিল। আফিফ অবশ্য সিম ধার দেওয়া লোকটিকে পেশাদার চোর হিসেবেই চেনে। বন্ধুর মাধ্যমেই সেই চোরের সন্ধান পেয়েছিলো আফিফ। এরপর চোরটিকে কিছু টাকা দিতেই সিমটা ধার দিলো সে।
এদিকে আফিফের কল করার পাঁচ মিনিট পর গলির ভেতরে সেই মালবাহী গাড়িটি ঢুকলো। বেশ দ্রুত গতিতেই গাড়িটা আসছে। আফিফ পিছু সরে সোহাগকে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলো। সোহাগ পেছনে ফিরে দেখার আগেই মালবাহী গাড়িটি সোহাগের গাড়িটিকে খুব জোরে ধাক্কা দিলো। লরির ড্রাইভার সোহাগের গাড়িটিকে ধাক্কা দিয়েই লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। লরিটির গতি বেশি থাকায় সেটা সোহাগের গাড়িটিকে অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলো। আফিফ ড্রাইভারটির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

ড্রাইভারটি বলল,
“ওই তাজওয়ার আর তার বন্ধুগুলো আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। আমার মেয়েটা তো বাঁচতে চেয়েছিল। তারা আমার মেয়েকে বাঁচতে দেয় নি। আমি তোমাকে সাহায্য করবো, বাবা। ও শয়তানটা যতোদিন বেঁচে থাকবে, আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে না।”

আফিফ মাথা নাড়লো। এরপর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাস্তা থেকে হেলমেটটা উঠিয়ে তার উপর পানি ঢেলে হালকা লেগে থাকা রক্তগুলো পরিষ্কার করলো। এরপর গ্লাভস ধুয়ে হেলমেটটা পরে পেছন ফিরে সেই বিধ্বস্ত গাড়িটির দিকে তাকালো। গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আফিফ বুঝতে পারলো, সোহাগের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। বেঁচে থাকলেও এতো সহজে সে আফিফের বিরুদ্ধে কিছু বলার জন্য দাঁড়াতে পারবে না। তার সেরে উঠতে বেশ সময় লাগবে। আর ততোদিনে আফিফ তার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করে ফেলবে। এই মুহূর্তে আফিফকে তার তৃতীয় মিশনে নামতে হবে। তাজওয়ারকে থামানোর জন্য শেষ একটা পথই খোলা আছে। যেই পথে গেলে তাজওয়ার ক্ষণিকের জন্য শান্ত হবে, আর এই শান্ত হওয়াটাই তাজওয়ারকে আরো এক ধাপ পিছনে ফেলে দেবে।

আফিফ মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে লরির ড্রাইভারটিকে নিয়ে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এদিকে সন্ধ্যায় খবর পাওয়া গেলো, সোহাগ এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সোহাগের মৃত্যুর খবর পাওয়াটা বেশ স্বাভাবিক ছিল। উলটো সে বেঁচে গেলে, আফিফকে হয়তো আরেকটু খাটতে হতো। সোহাগ মরে গিয়ে উদ্ধার করেছে তাকে।

(***)

দরজার ধাক্কাধাক্কি বাড়তেই পদ্ম এসে বাড়ির দরজা খুলে দিয়ে দেখলো তাজওয়ার খান ও তার পাশে দু’জন ফিটফাট যুবক দাঁড়ানো। তাজওয়ার পদ্মের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আফিফ কোথায়?”

পদ্ম ভীত কন্ঠে বলল, “উনি বাসায় নেই।”

তাজওয়ার পদ্মের গলা চেপে ধরে বলল,
“আমার সাথে মিথ্যে কথা?”

পদ্মের চোখে অশ্রু ভীড় করলো। তাজওয়ার পদ্মকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“আফিফকে খুব ভালোবাসিস, তাই না? এখন আবার আহির জন্যও মরিয়া হয়ে যাচ্ছিস। এসব অতিরিক্ত ভালোবাসা তোকে নিয়েই ডুববে। আমি যদি আফিফকে সত্যটা বলে দেই…..”

পদ্ম হাত জোড় করে মাথা নেড়ে বলল, “প্লিজ।”

তখনই আফিফ রুম থেকে বের হয়ে দেখলো তাজওয়ার পদ্মের গলা চেপে ধরে রেখেছে। আফিফ তেড়ে এসে তাজওয়ারের কলার চেপে ধরে বললো,
“আমার ওয়াইফের গায়ে হাত দিয়েছিস কোন সাহসে?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। এরপর সে আবার পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম তাড়াতাড়ি আফিফকে তাজওয়ারের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। এরইমধ্যে আফিফা বেগম বেরিয়ে এলেন। আফিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে পদ্মকে বলল,
“তুমি মাকে নিয়ে ভেতরে যাও।”

পদ্ম ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার তা দেখে বাঁকা হাসলো। তাজওয়ারকে হাসতে দেখে আফিফ বলল,
“এটা কিন্তু ঠিক হয় নি!”

“আর সোহাগের সাথে যা হয়েছে তা?”

“মানে?”

“মানে কিছুই বুঝতে পারছিস না?”

“সোহাগ! আমি শুনেছি সোহাগের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

“হ্যাঁ, আর ওর ফোনে লাস্ট কল তোর ছিল।”

আফিফ কিছুটা চিন্তিত সুরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি কল দিয়েছিলাম। আমি তো বিপদে পড়েই কল করেছি ওকে। আমি কল দেওয়ার পরই কি ওর এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে আফিফকে থানায় নিয়ে গেলো। আফিফ তার সমস্যার কথা দায়িত্বরত অফিসারকে জানালো। সে সোহাগের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে চেয়েছিল, কারণ তার মা অসুস্থ। ঢাকায় ভালো চিকিৎসা করাবে এই আশায় টাকা ধার চাওয়া। এক মাসের মধ্যেই সে টাকাটা ফেরত দিতো। মাসের শেষ দিনগুলো চলছে, তাই হাতে কোনো টাকা ছিল না তার।

এদিকে তাজওয়ারের পীড়াপীড়িতে কল রেকর্ড বের করা হলো। আফিফ আর সোহাগের কথোপকথন শুনে অফিসার তাজওয়ারকে বললেন,
“সোহাগের মৃত্যুটা একটা এক্সিডেন্ট। আপনি হুট করে কাউকে গ্রেফতার করাতে পারবেন না৷ কোনো ভালো প্রমাণ থাকলে ওকে আমরা ছাড়তাম না। আর ওর লোকেশন এক্সিডেন্ট স্পটে ছিল না। তবে আমরা এ নিয়ে ইনভেস্টিগেট করে আপনাকে জানাবো।”

আফিফ থানা থেকে বেরিয়ে এলো। ফোন হাতে পেতেই সে পদ্মকে কল করে বলল, সে ছাড়া পেয়েছে। এদিকে পদ্ম তো চিন্তায় অস্থির। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে মেঝেতে বসে আছে। আর বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছে,
“আমি আফিফকে হারাতে চাই না। আমি উনাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দাও, আল্লাহ। আমার ভুলের জন্য হয়তো আজ এতোগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমি আমার ভুলটা শুধরে নেবো। তার জন্য যদি আমাকে আমার জীবনটাই ত্যাগ দিতে হয় কোনো সমস্যা নেই। আমি দিয়ে দেবো। কিন্তু আফিফের সামনে সত্যটা যাতে না আসে। ও যদি কখনো জেনে যায়…. না, না। ভাবতেই পারছি না আমি। ওর সামনে সত্যটা আসা যাবে না।”

(***)

আফিফ রিকশায় উঠতেই তাজওয়ার তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ বলল,
“স্যার, আপনি আমাকে কেন ভুল বুঝছেন আমি জানি না।”

“লোকেশনে দেখা যাচ্ছে তুই সোহাগের আশেপাশেই ছিলি।”

“আমি তো বললামই। আমি এক কাজে ওদিকে গিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে যদি সোহাগও সেদিকে যায়, আমার তো কিছুই করার নেই।”

“কল রেকর্ডটা যদি না থাকতো, তুই আজকে ফেঁসে যেতি। ইচ্ছে করে ওভাবে কথা বলেছিস তুই, তাই না? যাতে তোকে ফাঁসাতে না পারি?”

আফিফ মুচকি হেসে বলল,
“স্যার, সত্যিই আমি সোহাগের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আর এতো দুঃসাহস আমার নেই।”

তাজওয়ার চুপ হয়ে গেলো। আফিফ রিক্সা আগাতে বলল। কিছুদূর গিয়ে আফিফ রিক্সা পালটে একটা গাড়ি নিয়ে নিলয়ের শো’রুমে গেলো। নিলয় আফিফকে বলল,
“বাঁচিয়েছিস আমাকে। তুই যদি আমাকে না বলতি আমি ফোনটা নিয়েই বের হতাম। ফোন রেখে যাওয়ায় আমি কোথায় এসে সোহাগের গাড়ি থেকে নামলাম, সেটা কেউ ধরতে পারলো না।”

আফিফ বলল,
“পারবে পারবে। আরেকটু চেষ্টা করলে ধরে ফেলবে।”

“মানে কি? ধরা খেয়ে যাবো না-কি?”

“চিন্তা করিস না। যে কেইস করেছে, সে-ই যদি বিপদে পড়ে, তাহলে আমরা এই জন্মে আর ধরা খাবো না।”

“কি করবি তুই?”

“তাজওয়ারের সব দুর্বল দিকগুলো আমি জেনে গেছি। এখন আজ রাতেই শেষ আঘাতটা দেবো। এরপর তাজওয়ার খান আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।”

“আচ্ছা, এসব আগে করিস নি কেন?”

“তখন কি তাজওয়ার খান আমাকে এসিস্ট্যান্ট বানিয়েছিলো না-কি?”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||

৯৪।
আহি আর উজ্জ্বলের মুখোমুখি বসে আছে ফার্জিয়া। তার দৃষ্টি নীচের দিকে। চোখে-মুখে ছেয়ে আছে মলিনতা। আহি ফার্জিয়ার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও, আর মনকে শক্ত করো।”

ফার্জিয়া ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে বলতে লাগলো,
“আমি কখনোই তাজকে ভালোবাসি নি। আমি ওর সাথে সম্পর্কে গিয়েছিলাম ওর টাকার জন্য। বাবার বেতন ভালো ছিল না। আর আমার শখ বেশি ছিল। শখ পূরণের লোভ চেপে বসেছিল মাথায়। তবে আমি ওকে প্রপোজ করি নি। তাজ নিজেই আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। আর সম্পর্কের প্রায় আড়াই মাস পর তাজ আমাকে ইন্টিমেট হওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। আমি প্রথমে রাজি হই নি। কারণ বাবা অনেক স্ট্রিক্ট আর সম্মানী মানুষ ছিলেন। কিন্তু লোভের সামনে নিজের পরিবারকেই খুব ছোট মনে হয়েছিল আমার। আমি ভাবতাম, সত্যিই হয়তো তাজ আমাকে ভালোবাসে। আর একদিন বিয়েও করে নেবে। অনেক বছর এভাবেই আমরা ইন্টিমেট হতে থাকি। আর ধীরে ধীরে আমি ভেঙে পড়ি। কারণ তাজের কাছে আসাটা আমাকে মানসিকভাবে আঘাত করছিলো। তখন মনে হচ্ছিলো, আমি একটা মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কারণ আমি সজিবকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সজিব!”

আহি বলল,
“তাজওয়ারের বন্ধু, সজিব। ওটাও একটা শয়তান।”

ফার্জিয়া মলিন মুখে বললো,
“হ্যাঁ, তা ঠিক। ওরা সবাই এমনই। সজিব, অর্ণব, জিলান কেউই ভালো ছিল না। কিন্তু সজিবের প্রতি কেন যেন আমার ভালো লাগা কাজ করতো। এরপর ওর সাথে কথাবার্তা বলার পর থেকেই আমি তাজ থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করি। তাজ এটা মেনে নিতে পারে নি। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। আমার কিছু পারসোনাল ছবি ওর কাছে ছিল। ও আমাকে না জানিয়েই আমার মাকে পাঠিয়ে দেয়। ভাগ্যিস বাবাকে পাঠায় নি। নয়তো সেদিনই আমাকে মেরে ফেলতো। মা অবশ্য অনেক মেরেছে। সেদিন আমার ছোট বোন ফার্সা আমাকে মায়ের মার থেকে বাঁচিয়েছিল। এর অনেকদিন পর আমি সজিবকে নিজের অনুভূতির কথা জানাই। তাজের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাহায্য চাই। ও আমাকে আশা দেয়। আর তারপর, আমাদের প্রেম শুরু হয়। এর মধ্যে সজিবের কথায় আমি তাজের সাথেও সম্পর্ক রেখেছিলাম। এরপর আহি দেশে এলো। তাজ কিন্তু আহি আসার পরও আমার সাথে সম্পর্ক রেখেছিল। এরপর সেই ভয়ংকর সত্যটা আমার সামনে এলো।”

উজ্জ্বল কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন সত্য?”

“আমি হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, আমার ছোট বোন ফার্সার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ও আগে হাসিখুশি থাকতো। হঠাৎ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করার পর, ও আমাকে সব বলে দেয়।”

উজ্জ্বল আগ্রহী সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলে দেয়?”

“একটা ছেলের সাথে তার প্রেমের ব্যাপারে। আমিও পুরুষ ঘটিত ব্যাপারে মায়ের কাছে মার খেয়েছি। ও মনে করেছে আমি বুঝবো, তাই বলেছিল।”

“এরপর!”

ফার্জিয়া খালি গ্লাসটা হাতে নিলো। আহি বোতল থেকে পানি ঢেলে দিতে দিতে বলল,
“তুমি রিল্যাক্স হয়েই বলো।”

ফার্জিয়া এবারও পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলো। একটু জোরেই গ্লাসটা রাখলো সে। আর ফার্জিয়ার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে উজ্জ্বল আর আহি কৌতুহলি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফার্জিয়া এবার ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার বোন ফার্সা যার সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল, সেই মানুষটা তাজই ছিল।”

উজ্জ্বল দুই আঙ্গুল দিয়ে কপালে চেপে ধরে বলল,
“মাই গড, এই তাজওয়ার খান তো আস্ত একটা ইবলিশ।”

আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“হ্যাঁ জানি সেটা। কিন্তু দুই বোনের সাথে একই সময়ে প্রেম করা, এতো বড় দুঃসাহস নিয়ে কীভাবে জন্মেছে সে!”

ফার্জিয়া বলল,
“ও পারে না এমন কোনো কাজই নেই। ফার্সার সাথেও সে ফিজিক্যালি ইনভলভ ছিল।”

আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“এতো ইমোশনাল তো আমিও ছিলাম না। একটা ছেলে বলল, আর তোমরা নিজেদের সম্মানের কথা একবারও ভাবলে না। এটা ভালোবাসা না। এটাকে ফাজলামো বলে।”

উজ্জ্বল আহির হাত ধরে আহিকে থামিয়ে দিলো। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীচের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“হ্যাঁ, তুমি বলো ফার্জিয়া। এরপর কি হয়েছে?”

ফার্জিয়া বলল,
“ফার্সা প্রেগন্যান্ট ছিল। তাজ বাচ্চাটা এক্সেপ্ট করতে চাচ্ছিলো না। ফার্সাকে খুনের হুমকি দিয়েছিল সে। আর এজন্যই ফার্সা ভয় পেয়ে এবরশন করিয়ে ফেলে। এরপর তাজ আবার ওর সাথে সম্পর্কে জড়ায়। ফার্সা তখন একটু শক্ত হয়েছিল। ও তাজকে বলেছিল, বিয়ে করলেই তার সাথে দেখা করবে। আর তাজও মেনে নিয়েছিল।”

আহি অবাক কন্ঠে বলল, “সিরিয়াসলি?”

ফার্জিয়া মলিন হেসে বলল,
“ধোঁকা দেওয়ার শেষ সুযোগটা নিয়েছিল।”

“মানে?”

“তাজ সেদিন ফার্সাকে একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল ওখানেই একজন উকিল এসে বিয়ে পড়াবে। কিন্তু সেদিন সেখানে কোনো উকিল আসে নি। এসেছিল তাজের বন্ধুরা। আমার বোনকে রেইপ করেছিল ওরা। সাথে ভিডিও বানিয়েছিল। আমার বোনটা একদম ভেঙে পড়েছিল। অদ্ভুত আচরণ করতো ও। আর এরপরই সে আমাকে সত্যটা জানালো। বাসায় আসার পরই না-কি ওর ভিডিওটা ভাইরাল করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল ওকে। আমি সব শুনে তাজের কাছে যাই। পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। সজিবেরও পায়ে ধরি। না, ওর মনটাও গলে নি। আমাকেও ওরা পণ্যের মতো ব্যবহার করেছে। অসহ্য লাগছিলো সব। বাজে বাজে গালি দিতো আমাকে। সহ্যের বাইরে চলে যেতেই আমি তোমাকে সব জানিয়ে দেই।”

আহি এবার ফার্জিয়ার পাশে এসে বসলো। বলল,
“রিল্যাক্স। কেঁদো না।”

ফার্জিয়া এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আর আহি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। উজ্জ্বল আরেক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। ফার্জিয়া এবার পানি খেলো না। সে আহির হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে বলে দিয়ে জীবনের শেষ ভুলটা করেছিলাম। তাজের কাছে ফার্সার যেই ভিডিওটা ছিল। তাজ ওটা ভাইরাল করে দেয়। আমার বোনটা মা-বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায় নি। রাতের আঁধারেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বোনটা আমার বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যায়। বাবা লাশ আনতে যায় নি। বাবা সবাইকে বলেছে, ফার্সা পালিয়ে গেছে। ওর মুখটাও দেখবে না। কিন্তু ফার্সা তো পালায় নি। ও তো আমাদের ছেড়ে আরো অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। ফার্সার মৃত্যুর পর আমরা শহর ছাড়ি। এই যুগে মিনিটের মধ্যেই এক শহর থেকে অন্য শহরে সব ছড়িয়ে যায়। ইন্টারনেট কতোটা ভয়াবহ, বাবা অন্য শহরে গিয়ে বুঝলেন। যদিও ফার্সাকে কেউ চিনতো না। ওই শহরে কেউ জানতোও না যে ভাইরাল হওয়া মেয়েটা আমার বাবার মেয়ে ছিল। আর ওই মানুষগুলো সেই ভাইরাল হওয়া মেয়েটির বাবার সামনেই তাকে গালি দিতো। ব্যস, বাবা এসব সহ্য করতে না পেরে মারা গেলেন। মা ফার্সার মৃত্যুর পর থেকে আমাকে কথা শোনাতো। কারণ আমার কিছু ব্যক্তিগত ছবি তাজ আগেই মাকে পাঠিয়েছিল। মায়ের ধারণা আমার কারণেই ফার্সা নষ্ট হয়ে গেছে। বাবাও আমার কারণেই মারা গেছেন। মা আমাকে তাড়িয়ে দিলো বাসা থেকে। অনেকদিন পর এক আত্মীয় ফোন করে বলল, মা না-কি অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। আমার মুখটাও না-কি দেখবে না। এখন না-কি বলছে, মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে কীভাবে দাঁড়াবে? আমাদের তো ঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারে নি।”

ফার্জিয়া ফুঁপাতে লাগলো। আহির সামনে হাত জোড় করে বলল,
“আমি ভালো হতে চাই। কিন্তু বাঁচার মতো মানসিক শক্তি আমার মধ্যে নেই। লোভ আমার দ্বারা এতো বড় পাপ করিয়েছে, যার শাস্তি আমি সারাজীবন পাবো। এখনো আমার বোনের ভিডিও শেয়ার হয়, সবাই লিংক খুঁজে। আমার সামনেই এসব চলে। আর আমি শুধু দেখেই থাকি। পরিচয় দিতে পারি না, যে ওই মেয়েটা আমার বোন। বলতে পারি না, আমার সামনে অন্তত এসব বন্ধ করো। এবার ভাবছি, দেশ ছাড়বো। এই দেশের মানুষগুলো আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে তারা। যতোক্ষণ তুমি অপরিচিত, ততোক্ষণ তুমি শান্তিতে থাকবে। যখনই ভাইরাল হবে সেটা ভালো হোক, বা খারাপ হোক, তোমাকে গালি দেওয়ার জন্য অনেকগুলো কাপুরুষ বসে থাকবে। আর তার সাথে মহান কিছু মহিলা।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ফার্জিয়া বলল,
“হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। সরি, ভুল না৷ পাপ করেছি। অনেক বড় পাপ। এর শাস্তি আমি এখনো পাচ্ছি। কিন্তু ওই মানুষগুলো পাচ্ছে না। তাজওয়ার খান, তার বন্ধু সজিব ওয়াহিদ, জিলান শেখ, অর্ণব পাল, জাস্টিন হ্যারি এরা কেউই শাস্তি পাচ্ছে না।”

উজ্জ্বল বলল, “অর্ণব তো মারা গেছে।”

“ওটা তো এক্সিডেন্টে।”

আহি বলল,
“এক্সিডেন্ট হয় নি, আমার ধারণা তাজওয়ার এই কাজ করেছে।”

“কেন?”

“এসব বাদ দাও। তোমার মনকে শক্ত করতে হবে। অতীত ভুলে যাও। অন্তত নিজের মায়ের জন্য বাঁচো। আমাকে দেখো, তোমার মতো অভিজ্ঞতা হয়তো আমার ছিল না। কিন্তু আমিও অদ্ভুত কিছু সম্পর্ক দেখেছি। প্রিয় মানুষগুলোকে হারিয়েছি। আমি তো অপরাধ না করেও শাস্তি পেয়েছি। পৃথিবীটা এমনই। হয়তো আল্লাহ তোমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলে, তোমাকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। প্লিজ, বেঁচে থেকো। আমি একটা স্টেপ নিয়েছিলাম, যেটা ভুল ছিল। মরতে গিয়েছিলাম। যদি মরে যেতাম, তাহলে হয়তো আমাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো জয়ী হতো। আল্লাহ চেয়েছে, আমি তাদের হারায়। তাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তোমাকেও বাঁচতে হবে, ফার্জিয়া। প্লিজ, তাজের পরিণতি দেখার জন্য বেঁচে থেকো।”

ফার্জিয়া আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি ভালো, তাই তাজের মতো নোংরা মানুষ তোমাকে স্পর্শ করতে পারে নি। তোমার মন, তোমার সৌন্দর্য স্পর্শ করার অধিকার একমাত্র তারই, যার মনটাও তোমার মতোই। আমি দোয়া করবো, যদিও আমার দোয়া কবুল হবে কি-না জানি না, আমি তো পাপী। তবুও মন থেকে দোয়া করলাম, তুমি তোমার মনের মানুষকে পাবে, ইনশাআল্লাহ।”

আহি ফার্জিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। আহির মনের মানুষ? কীভাবে সম্ভব?
আহি মলিন হেসে ফার্জিয়াকে বিদায় দিলো। ফার্জিয়া যেতেই উজ্জ্বল তার পেছনে লাগিয়ে রাখা ছোট ক্যামেরাটা বের করলো। এরপর সে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে ভিডিওটা শুরু থেকে চালালো। ফার্জিয়াকে ভিডিওতে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। উজ্জ্বল আহির কাছে এসে বলল,
“প্ল্যান ডি সাকসেসফুল। ফার্জিয়ার কথা রেকর্ড হয়ে গেছে। এখন যদি তাজওয়ার নিজের বিরুদ্ধে থাকা সব প্রমাণ শেষ করে দিতে চায়, ফার্জিয়াকে যদি মেরেও ফেলে, তবুও এই ভিডিওটা আমাদের কোর্টে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে৷”

আহি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “কিন্তু ওকে বাঁচতে হবে।”

“আহি, প্লিজ। আমরা তো গোয়েন্দাগিরি কর‍তে পারবো না। ও যদি বাই চান্স বেঁচে থাকে, ও আমাদের জন্য সাক্ষ্য দিতে কোর্টে আসবে। আর তাজওয়ার যদি ওকে ম্যানিপুলেট করে, তবুও ওর এই রেকর্ডটা সত্য কথা বলবে। তাই এই রেকর্ড সামলে রাখা তোমার দায়িত্ব।”

“হুম, আমি রাখবো।”

“এখন প্ল্যান সি এক্সিকিউট করতে হবে। কাজ শুরু করেছো?”

“না, ভীষণ অস্থির লাগছে।”

উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কেন?”

“আফটার অল, উনি আমার বাবা। বাবাকে কি কষ্ট দেওয়া যায়?”

উজ্জ্বল কপাল চুলকে বলল,
“বাড়াবাড়ি রকমের ইমোশনাল তুমি।”

আহি মুখ ছোট করে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল মুচকি হাসলো আর বলল,
“এখন চলো।”

(***)

কালো মোটরসাইকেল নিয়ে নিষিদ্ধ গলিতে ঢুকে পড়লো আফিফ। মোটরসাইকেল সামনে টানতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দু’একটা মেয়ে। আফিফ ধীর গতিতে মোটর সাইকেল চালিয়ে সেই নিষিদ্ধ বাড়িতে ঢুকে পড়লো। আফিফ মোটর সাইকেল থেকে নামতেই একটা মেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে নেশালো কণ্ঠে বলল,
“চেহারা দেখাতে কি লজ্জা করছে তোমার! আমার উড়নায় বেঁধে নিয়ে যাবো, না-কি? হুম, হুম?”

আফিফ মেয়েটির হাত সরিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই থেমে গেলো। সে ধীর পায়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। আফিফ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরাফাত তোমার সাথে দেখা করতে বলেছিল। তুমিই কি ঝুনু?”

মেয়েটি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“হ, আমিই ঝুনু, আরাফাতের ঝুনু।”

কথাটি বলেই মেয়েটি হাসতে লাগলো। আফিফের অসহ্য লাগছিলো এই হাসিটা৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তার এখানে আসা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা ছিল না। আফিফ এবার কাঁপা হাতে জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ঠিকানা বের করে তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দিলো। মেয়েটি আফিফের গ্লাভসবন্দী হাতটা ধরে বলল,
“এক্কেবারে পর্দা কইরা আইছেন।”

আফিফ মেয়েটির হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখো, আমার এই মুহূর্তে তোমাকে খুব প্রয়োজন, তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি। তুমি চাইলে আমার সাথে বাইরেও দেখা কর‍তে পারতে।”

“ইচ্ছা কইরা দেখা করি নাই। এই গলি আপনাদের জন্য না, এডাই বুঝাইতে চাইছি। দেখছেন এবার? এই গলিতে সভ্য পোলারা আইতে পারে না। আরাফাত আমারে কইছে, আপনার মাইয়া লাগবো, তাও আবার মহান কাজে। মহান কাজে আমগোরে দিয়া কি হইবো?”

“দেখো, আমি শুধু তোমাকে যার ঠিকানা দিয়েছি, তুমি তাকেই…”

আফিফ একটু থেমে বলল, “বুঝতে পারছো তো?”

“হ, হ, তার লগেই শুইতে হইবো। বেশি সাধু আপনে। সোজাসুজি কইতে পারেন না। শুনেন, ভাইজান এখানের মাইয়াগুলা বহুত ডেঞ্জারাস। তারা আপনের কাঁপা-কাঁপি দেইখায় তো ফিট হইয়া যাইবো। হেলমেট খুইল্লেন না আবার। আমি আপনের কাম কইরা দিমু। আর বেটারে এমন ফাঁসা ফাঁসামু, এই জন্মে আর মাইয়া মাইনসের মুখ দেখতে চাইবো না।”

আফিফ মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেই ঝুনু তার পথ আটকে বলল,
“আরাফাত কিন্তু আমার পুরোনো কাস্টমার। বিয়ে কইরা বেটা এখন ভদ্র সাজতাছে। আমারে বিয়া করবে কইছিলো। তার ফকিন্নি মা, আমারে গালি দিয়া বাইর কইরা দিছে। আরাফাত আমারে কি কইছে জানেন? কইছে, এই গলি থেকে বাইর হইয়া মাইনসের বাসায় কাম কইরা খাইতে।”

আফিফের ঝুনুর কথা শোনার কোনো আগ্রহ ছিলো না। হাত-পা ঘামছে তার। এমন একটা ভয়ংকর কাজ করতে এসেছে, যা করার কথা সে কোনোদিন কল্পনাও করে নি। ঝুনু বলল,
“আরাফাত কে হয় আপনের?”

“কলিগ!”

“কাম করেন একসাথে?”

“আগে করতাম।”

“কেমনে জানেন ও এই আকাম কর‍তে এখানে আইতো?”

“জানিয়েছে আমাকে।”

“বেটার বাচ্চা হইছে, না?”

“হ্যাঁ।”

“ভাইজান, আপনের কাজেই বেটা আমারে ফোন দিছে। আমি তার ফোন পাইয়া যে কি খুশিটাই না হইছি। কাইন্দা দিছি এক্কেবারে। ভাবছি লইয়া যাইবো আমারে৷ শালায় আমারে অন্য বেটার লগে শুইতে কয়।”

আফিফ এবার ঝুনুর দিকে তাকালো। এতোক্ষণ ঝুনুর দিকে ভালোভাবে তাকায় নি সে। একনজর তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এবার তাকাতে বাধ্য হলো। ঝুনুর গলা ভারী হয়ে গেছে। চোখ টলমল করছে। আফিফ তা দেখে বলল,
“তুমি এই কাজ করো, তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। তোমাকে যার ঠিকানা, আর ছবি দিয়েছি, সে একটা শয়তান। অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। ভবিষ্যতেও করবে। তোমার কাজ শুধু, তুমি যা করবে তা ভিডিও করে রাখবে। এই ভিডিও ভাইরাল করা হবে। আর এটা অনেক মানুষ দেখবে। আমি আরাফাতকে বলেছিলাম, তোমাকে এই কথাটা আগেই জানাতে। ভিডিও ভাইরাল না করলে এই শয়তানটাকে শাস্তি দিতে পারবো না৷ তোমার আপত্তি নেই জেনেই, আমি এখানে এসেছি।”

“ভিডিওতে আমারে দেখা যাইবো?”

“না, তোমার চেহারা বোঝা না যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।”

“আমার সমস্যা নাই। আমি এমন কাজ আগেও করছিলাম। আমারে দেখা গেলেও সমস্যা নেই। ওই বেটারে ভালোভাবে ফাঁসাইতে পারলেই, আমি শান্তি পামু।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে ঝুনুর দিকে তাকালো। মেয়েটির চোখে জল। হয়তো সে আরাফাতকে ভালোবাসতো। আর ভালোবাসার মানুষটিই তাকে এমন একটা কাজ দিয়েছে।
বেশ তো। ঝুনুদের কি ভালোবাসা যায়? যারা স্বেচ্ছায় কলঙ্কিত, তাদের ভালোবাসা গায়ে মাখাও কলঙ্ক।

(***)

আফিফ নিষিদ্ধ গলি থেকে বেরিয়ে এসেই হেলমেট খুলে মাটিতে ফেলে দিলো। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে মুখে পানি ছিটালো। অপরাধবোধ কাজ করছে তার। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাতে এই একটাই পথ খোলা ছিল। তাজওয়ারকে সে একই শাস্তি দেওয়া, যেই শাস্তি তাজওয়ার তার বোনকে দিয়েছিল। আফিফ ঘাসের উপর বসে পড়লো। বুকে হাত চেপে বলল,
“তুমি কেন নিজেকে শেষ করে দিতে গেলে, আপা? তোমাকে হারিয়ে আমি একদম ভেঙে পড়েছিলাম। আর দেখো, আহিকে ফিরে পেয়ে সব শক্তি আবার ফিরে পেয়েছি। তুমি যদি বেঁচে থাকতে, আমার জীবনটা অন্য রকম হতো। তোমার মৃত্যুর ভার ভীষণ ভারী ছিল। আহির কিছু হয়ে গেলে, আমি আরো ভেঙে পড়তাম। হ্যাঁ, আমি জানি ও আমার কেউ না। কেউই না। কিন্তু একটা সময় তো আমার জন্য কিছু একটা ছিল। হয়তো একটা অনুভূতি, একটা স্বপ্ন বা একটুখানি আশা। তাজওয়ার খান সব শেষ করে দিয়েছে। আমার আফসোস থাকতো না যদি আহি সুন্দর একটা জীবন পেতো। সত্যিই তখন আমার কোনো আফসোস থাকতো না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি সেদিন আহিকে ছেড়ে এসে, ওকে একদম নিঃস্ব করে দিয়েছিলাম। আপা, আমি তোমাকে হারিয়ে এতোটা ভেঙে পড়েছিলাম যে আমার রেনু আর মাকে হারানোর ক্ষমতা ছিলো না। আমি শুধু আহিকে অনুভব করেই আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ হারিয়েছি, আর ওর হাত ধরলেই তো নিঃস্ব হয়ে যেতাম। আমি তো তাকে খেয়ালে রেখেছিলাম। আমার প্রথম অনুভূতি, জানি না কি ছিল সেটা। কিন্তু যা ছিল, খুব সুন্দর ছিল। আর বিয়েটাও তো তার ভালোর জন্যই করেছিলাম। কিন্তু যাকে বিয়ে করেছি, সেই মেয়েটা যে তার বন্ধু হবে, এটা কখনো ভাবি নি। আমি পদ্মকে ভালোবাসি। হ্যাঁ, এখন আমি পদ্মকে ভালোবাসি। হয়তো বিয়ের পর ভালোবেসেছি। মায়া জমে গেছে ওর প্রতি। মেয়েটা ভালো। আমি ওকে ঠকাতে চাই না৷ কিন্তু আমার কষ্ট হয়। এটা আহিকে না পাওয়ার কষ্ট না। এটা আহির সামনে পদ্মকে ভালোবাসার কষ্ট। কি করবো আমি? ওর তো আমাকে ভুলতে হবে। আমাকে ভুলতে না পারলে, ও তো সেখানেই আটকে থাকবে, যেখানে আমি ওকে ফেলে এসেছিলাম। আমি আহিকে অতীত থেকে বের কর‍তে চাই। আমি চাই একটা সুন্দর জীবন হোক ওর। রাদের সাথে হোক, বা যার সাথেই হোক। অন্তত একটা চমৎকার মানুষ আহি ডিজার্ভ করে। অনেক বেশি ভালোবাসা ডিজার্ভ করে মেয়েটা। অনেক বেশিই ডিজার্ভ করে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||আংশিক পর্ব||

৯৬।
সুনেহরাহর সামনে বসে আছে লিনাশা আর পুষ্প। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা সুনেহরাহকে দেখছে। সুনেহরাহ ভীত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি হলো, হাবলার মতো বসে না থেকে, যা বলছি তাই করো। নয়তো তোমার বরকে গিয়ে তোমার রঙ্গলীলা জানিয়ে দিতে আমাদের দুই মিনিটও দেরী হবে না।”

সুনেহরাহ বলল,
“প্লিজ এমন করো না। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নি। আর আহি? আহিকে আমি খুব পছন্দ করি।”

লিনাশা বলল,
“পছন্দ-অপছন্দ আমাদের দেখার বিষয় না। তোমার একমাত্র পরিচয় তুমি লাবণি মেহেরার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। তুমি তার সাথে বিভিন্ন ক্লাবে যাও। ভালোই জানি আমি। এখন এতোটুকু তথ্য তো তোমার কাছে আছেই।”

সুনেহরাহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পুষ্প বলল,
“যদি আগামী চারদিনের মধ্যে লাবণির সব তথ্য আমাদের সামনে এনে না রেখেছো, মনে করবে পাঁচদিনের দিন ভোর হতেই তোমার সংসার খালাস।”

সুনেহরাহ করুণ দৃষ্টিতে পুষ্পের দিকে তাকালো। লিনাশা তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“তুমি তোমার হাসবেন্ডকে চিট করেছো। রিজওয়ান কবিরের কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে তোমার অবৈধ সম্পর্ক আছে। আর তোমাদের প্রেমলীলার লাইভ ভিডিও আমাদের কাছে আছে। মনে থাকে যেন!”

পুষ্প বলল,
“যদি আমরা একবার তোমার প্রেমলীলা টেলিকাস্ট করি, তাহলে তোমার সংসারটা তো ফ্লপ হবেই, কিন্তু আমাদের সিনেমাটা হবে সুপার হিট।”

সুনেহরাহ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমি লাবণি মেহেরার সব তথ্য বের করে দেবো। আমার হাসবেন্ডকে ওসব ব্যাপারে কিছু জানাবে না, প্লিজ।”

লিনাশা বলল,
“তোমার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো ঝামেলা নেই। সমস্যা লাবণি মেহেরার সাথে। তোমাকে যতোটুকু বলেছি ওতোটুকুই করো। এরপর তোমার যা করতে মন চায়, করো। আমাদের কিছুই আসে যায় না।”

কথাটি বলেই লিনাশা আর পুষ্প উঠে চলে গেলো। আর সুনেহরাহ মলিন মুখে তাদের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।

(***)

তাজওয়ারের বাংলো বাড়ির কাছাকাছি একটা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে ঝুনু। পরণে কটকটে লাল শাড়ি, হাত কাটা ব্লাউজ। শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে প্যাঁচানো। উদর দৃশ্যমান। ঝুনু আরো ভালোভাবেই সেটা উন্মুক্ত করে দিলো। এবার তার নাইমন্ডলটিও দৃশ্যমান হলো। আর তখনই গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলো তাজওয়ার খান। ঝুনু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর জন্য ইশারা করলো। তাজওয়ার ঝুনুকে দেখে অনেক আগেই গাড়ির গতি কমিয়েছিল। ঝুনুর ইশারা পেয়ে সে এবার গাড়ি থামালো। গ্লাস নামাতেই তার দৃষ্টি আটকালো ঝুনুর উন্মুক্ত দেহ ভাঁজের দিকে। ঝুনু তাজওয়ারের দৃষ্টি উপেক্ষা করে মুখ ছোট করে তার দিকে হালকা ঝুঁকে আহ্লাদী সুরে বলল,
“দেখুন না, আমার হিলটা ভেঙে গেছে। আশেপাশে গাড়িও দেখছি না। কোথায় যে এসেছি, সেটাও জানি না। আমি আবার খালি পায়ে হাঁটতে পারি না। এখন আশেপাশে কোথাও কি হোটেল আছে? যদি আজ রাতে থাকার ব্যবস্থা হতো।”

তাজওয়ার রাস্তায় পড়ে থাকা ঝুনুর ভাঙা হিলের দিকে এক নজর তাকিয়ে বাঁকা হাসি ফেরত দিলো। এরপর গাড়ির দরজা খুলে বের হলো। ঝুনু তাজওয়ারের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাল্প করবেন প্লিজ!”

তাজওয়ার কুৎসিত দৃষ্টিতে ঝুনুকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“সামনে আমার বাড়ি। চাইলে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ওটা তোমার স্বর্গ মনে হবে।”

“আই লাভ হ্যাভেন। অফকোর্স।”

তাজওয়ার গাড়ির দরজা খুলে দিতেই ঝুনু গাড়িতে উঠে গেলো। তাজওয়ার কামুক দৃষ্টিতে ঝুনুর দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুনুও বেশ খোলামেলা ভাবেই তাজওয়ারের সাথে কথা বলছে। তাজওয়ার ভালোভাবেই বুঝে গেছে, ঝুনু মেয়েটা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মতো না। তাজওয়ার একটু সাহস দেখিয়ে ঝুনুর হাঁটুতে হাত রাখলো। ঝুনু প্রতিবাদ করলো না। উলটো তাজওয়ারের হাতের উপর আলতো হাত রাখলো। তাজওয়ার ঝুনুর স্পর্শে মুচকি হেসে বলল,
“নাম কি তোমার?”

“জেনিফার।”

“সো কুল।”

গাড়ি বাংলো বাড়িতে ঢুকতেই তাজওয়ার ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে ঝুনুর জন্য দরজা খুলে দিলো। ঝুনু বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিউটিফুল হ্যাভেন।”

তাজওয়ার হাসলো। তখনই দেখলো ভেতর থেকে তাজওয়ারের বন্ধু হ্যারি বেরিয়ে আসছে। তাজওয়ার তাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“হ্যারি, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়া’র?”

“আই কেইম টু মিট ইউ।”

“হোয়াই? এনি প্রবলেম?”

হ্যারি মলিন সুরে বলল,
“একচুয়েলি, আই এম রিয়েলি মিসিং অর্ণব। ইউ নৌ, হি ইজ মাই বেস্ট বাডি।”

তাজওয়ার সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আই নৌ।”

“উই কেইম হেয়া’র। স্পেন্ডিড আ লট অব টাইম। দা’টস দা রিজন, আই কেইম হেয়া’র। আই ফিল হিম হেয়া’র।”

তাজওয়ার দুঃখ ভরা দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকালো। এদিকে হ্যারি ঝুনুকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,
“হো’জ দেট?”

তাজওয়ার ঝুনুর কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মাই বেবি গার্ল।”

হ্যারি হেসে বলল,
“ভেরি গরজিয়াস। ওকে ম্যান, ইনজয় ইউর নাইট।”

হ্যারি বেরিয়ে যেতেই তাজওয়ার ঝুনুর হাত ধরে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো। এদিকে হ্যারি গেট দিয়ে বের হতেই তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। হ্যারি সেই গাড়িতে উঠতেই গাড়িটি বাংলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। হ্যারি গাড়িতেই তার ব্রান্ডেড সিগারেট ধরালো। তার পাশেই একজন বসে আছে। তাকে চেনা যাচ্ছে না। সিগারেটের ধোঁয়া বের হতেই পাশে থাকা আগন্তুকটি গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলো। সড়ক বাতির আলো গাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দৃশ্যমান হলো আগন্তুকটির মুখ৷ আফিফ রাফাত৷ গ্লাস নামিয়ে দিতেই হ্যারি বলল,
“আই হেইট তাজওয়ার খান। আই হ্যাভ ডান দিস, অনলি ফর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। তাজওয়ার কিল্ড মাই ফ্রেন্ড। আই ওয়ান্ট টু সি হিম ডেস্ট্রয়েড।”

আফিফ বলল,
“ইয়েস, এন্ড ইট উইল হ্যাপেন।”

“আই হ্যাভ সেট ক্যামেরাস ইন এভ্রি রুম। হি ক্যান্ট সেইভ হিমসেল্ফ। এন্ড লিসেন আফিফ, আই এম হ্যাল্পিং ইউ টু টেইক মাই রিভেঞ্জ অনলি। নাথিং ইলস।”

আফিফ হাসলো। দৃষ্টি সরিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। এখন শুধু নতুন দিনের নতুন সূর্য উদয়ের অপেক্ষা। এরপর মুক্তি পাবে আফিফ। হালকা হবে তার মনের বোঝা। এবার অন্তত সে বলতে পারবে,
“হ্যাঁ, আমি ভাই হওয়ার দায়িত্ব কিছুটা হলেও পালন করতে পেরেছি।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে