#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(১ম ভাগ)||
৮৪।
আহি হাতে মেহেদি লাগিয়ে এক কোণায় বসে নাচ দেখছে। নায়ীব আর লিনাশা পাশাপাশি বসে আছে। দু’জনকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়তো অন্য কিছুতে নেই। লিনু আজ কতো খুশি!”
আহি এবার পাশ ফিরে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকালো। তাদের দেখে সে মুচকি হেসে আপন মনে বলল,
“ওরাও কতো সুখী! তাহলে আমি কেন সুখী হতে পারছি না? ইদানীং আফিফকে হারানোর কষ্ট আমাকে ওভাবে কাঁদায় না। তবুও নতুন করে সুখ খুঁজতে পারছি না কেন? আমি কি তাহলে ভয় পাচ্ছি? আবার কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার ভয় কি আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে বাঁধা দিচ্ছে? না-কি এখনো মনের কোথাও না কোথাও অতীতটাই বসে আছে!”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখনই তার পাশে এসে বসলো উজ্জ্বল। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল গাঢ় হাসি দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”
উজ্জ্বল মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু হয়েছে।”
“কি!”
“তুমি খুব বোরিং, আহি।”
আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো। উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি আবার উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি জানো, মানুষের চেহারা আর তার আত্মার চেহারা একই থাকা উচিত।”
“আত্মার আবার চেহারা আছে?”
“হুম, কখনো খুব সুন্দর, কখনো বা খুব কুৎসিত।”
“কীভাবে বোঝা যায় সেটা?”
“মানুষের চেহারায় আত্মার চেহারা ফুটে উঠে।”
“যেমন!”
“এই যে তুমি মেয়েটা, মাশাল্লাহ। কিন্তু তোমার আত্মাটা এতো নির্জীব হয়ে আছে যে, তোমার সৌন্দর্যটাই দাবিয়ে রেখেছে।”
আহি হাসলো। এবারের হাসিতে প্রাণ ছিল। উজ্জ্বল বলল,
“এই তো এটাই। আমি এটাই দেখতে চেয়েছি। মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি হাসি।”
আহি লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো। উজ্জ্বল আবার বলল,
“তোমাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না, তুমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”
“কেন?”
“তোমার মধ্যে সেই ঐশ্বর্যের অহংকার নেই। তোমার মনোভাব, আচরণ একদম সাধারণ মেয়েদের মতোই। এই জন্য বোধহয় তুমি অনেক স্পেশাল।”
“সাধারণ মেয়ে, আবার স্পেশাল?”
“সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়ে সাধারণ হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। ধনীর দুলালিদের উৎশৃঙ্খল হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আহি হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই তো তুমি স্পেশাল।”
আহি আবারও লাজুক হেসে মাথা নামালো। উজ্জ্বলের এই হাসিটাই বেশ সুন্দর লাগছে। মেয়েদের প্রশংসা করলে, মেয়েরা যে কতোটা খুশি হয়, তা আহির লাজুক হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। উজ্জ্বল আবার কিছু বলতে যাবে তখনই একটা হাত আহির দিকে এগিয়ে এলো। আহি মাথা তুলে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এখানে এসে বস।”
“চল ডান্স করি।”
আহি হাত দেখিয়ে বলল,
“হাতে মেহেদি। তোর পাঞ্জাবিটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
রাদ আহির বাহু ধরে ওকে টেনে উঠালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে, রাদ?”
“কিছু না। চল অন্যদিকে গিয়ে বসি।”
“তুই ঠিক আছিস তো?”
উজ্জ্বল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা বসো আমি আসছি।”
উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“আজকাল বেশ অদ্ভুত আচরণ করছিস?”
তখনই একটা টেবিলের উপর দুইটা চামচ নিয়ে গানের ধুন সৃষ্টি করলো উজ্জ্বল। আর সুরের সাথে গেয়ে উঠলো।
“লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা ।।”
সবার দৃষ্টি স্টেজের সামনে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে উজ্জ্বলকে দেখছে। আর উজ্জ্বলের দৃষ্টি আহির দিকে। উজ্জ্বল চামচ দু’টি টুলটির উপর রেখে একটা মাইক নিয়ে আহির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,
“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
এবার উজ্জ্বল আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। উজ্জ্বল মুচকি হেসে নিজেই আহির যেই হাতের মেহেদি শুকিয়ে গেছে, সেই হাতটি আলতোভাবে ধরে তাকে সবার সামনে নিয়ে এলো। এরপর আহির পাশে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল,
“যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
আহি পেছন ফিরে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা বেশ খুশি। সে নায়ীবকে বলল,
“ওদের বেশ মানিয়েছে, তাই না?”
নায়ীব কোনো উত্তর দিলো না। সে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে উজ্জ্বল হাতের ইশারায় সবাইকে গানের সাথে যোগ দিতে বলল আর নিজেও গাইতে লাগলো,
“যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
লিনাশা নায়ীবের হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। তারাও যোগ দিলো উজ্জ্বলের গানে। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে গেয়ে যেতে লাগলো,
“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। গান গাওয়া শেষে করতালি মুখর পরিবেশে সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে আহি আর উজ্জ্বল। কিন্তু কারো দৃষ্টি আটকালো না রাদ আর আফিফের দিকে। রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে, চোখে অশ্রু জমবে এমন অবস্থা। অন্যদিকে আফিফকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, তার খারাপ লাগার কারণ কি। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরলো। পদ্ম আফিফের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”
আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। পদ্ম বুঝলো না সেই হাসির অর্থ। সে আফিফের হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এদিকে রাদ ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর পিছিয়ে সে পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে নিতেই তার কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো। রাদ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লাবীব দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই রাদ বেরিয়ে গেলো। লাবীব এবার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে হাসি। অনেক বছর পর আহিকে এমন ভাবে হাসতে দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে আহি মুগ্ধ হচ্ছে উজ্জ্বলের গানের সুরে। এই মুগ্ধতা কি রাদের অনুভূতির জন্য থামিয়ে দেওয়া উচিত? যেই মেয়েটা এতো বছর পর কারো দৃষ্টিতে নিজেকে হারানোর সুযোগ পেয়েছে, তাকে কি সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত?
৮৫।
রাত বাড়তেই অতিথিরা বিদায় নিতে লাগলো। উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“পুষ্পের সাথে বাসায় এসো। তোমাকে কতো বছর পর দেখলাম।”
কথাটি বলেই তিনি উজ্জ্বলের দিকে তাকালেন। উজ্জ্বলের ঠোঁটে মৃদু হাসি। তা দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে ফিসফিস করে উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছিস কেন এতো?”
উজ্জ্বল হাসি গিলে ফেললো। বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই তোর কাজ কর।”
উজ্জ্বল ও মিসেস আমিনা চলে যেতেই পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“কি হলো এটা আজকে?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হলো?”
“উজ্জ্বল ভাইয়া আর তুই প্রেম-টেম করছিস না-কি?”
রাদ আর লাবীব তখনই আহি আর পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুষ্পের প্রশ্নটা রাদ আর লাবীব দু’জনেই শুনেছে। লাবীবও এবার পুষ্পের কথায় যোগ দিয়ে বলল,
“আহি, সত্যি না-কি?”
আহি অবাক কণ্ঠে বলল,
“পাগল তোরা! একদমই না। আমি প্রেম করবো, আর তোরা জানবি না?”
পুষ্প বলল,
“নাও জানাতে পারিস। আমাকে তো কিছুই জানাস না। লিনাশাকে হয়তো জানিয়েছিস।”
“যা, গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। ওকেও এমন কিছু বলি নি৷ কারণ এই মুহূর্তে আমার জীবনে কিছুই নেই।”
“হবে হয়তো।”
“তুই জানিস তাজওয়ারের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”
“তুই তো উনাকে পছন্দ করিস না। আর বিয়ে তো এখনো হয় নি।”
“হ্যাঁ, তাও এমন একটা সিচুয়েশনে আমি প্রেম করবো, এমন পাগল পাগল চিন্তা-ভাবনা তোদের মাথায় কীভাবে আসে?”
লাবীব জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তোকে দেখে যে অন্য কিছু মনে হলো!”
“কি মনে হলো?”
এবার রাদ বলল,
“তাকিয়ে ছিলি পুষ্পের সেই কাজিনের দিকে। হাসছিলি তাকে দেখে।”
আহি রাদের কথায় হালকা হেসে বলল,
“ধুর, কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে আর হাসলে কি প্রেম শুরু হয়ে যায়? আসলে উনার গানের গলা বেশ ভালোই ছিল। আর গানটার অর্থটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল। তাই শুনছিলাম। আর এভাবে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাওয়াতে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। মনে হয়েছিল, গানটা উনি আমার জন্য গেয়েছেন। নিজেকে ইম্পোরটেন্ট মানুষ হচ্ছিলো। তাই হাসি পেয়েছে। কেউ কখনো আমার জন্য গান গায় নি তো, তাই। এই প্রথম কেউ গেয়েছে।”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কখনো গান গাই নি?”
“তুই আর বাকিরা তো আলাদা!”
রাদ আহির কথায় অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
“আলাদা মানে?”
“তুই আমার ফ্রেন্ড।”
লাবীব রাদকে থামিয়ে দিলো। রাদের ভীষণ অস্থির লাগছে। আহির বন্ধু হয়ে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এখন এর মাশুল কি আহিকে হারিয়েই দিতে হবে?
(***)
রাদ বেরুতেই আহিও তার পিছু পিছু এলো। রাদ আহিকে আসতে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি তার মুখে একটা সন্দেশ পুরে দিলো। রাদ সন্দেশটা খেয়ে আহিকে বলল,
“আমাকে বিদায় দিতে এসেছিস?”
আহি মাথা নেড়ে বলল,
“উহুম, তোকে সন্দেশ খাওয়াতে এসেছি। ভেতরে শুধু দু’টো প্যাকেটে সন্দেশ ছিল। তুই তো অন্য মিষ্টি খাস না। তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”
রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“কিছু জিনিস ভালো লাগলেও সহজে পাওয়া যায় না। খুব করে চাইলেও, তা আমাদের স্পর্শের বাইরে থাকে।”
আহি হেসে বলল,
“সন্দেশ নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করছিস?”
রাদ মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
“তুই তো আমার কাছে সন্দেশই। সন্দেশ যেমন মিষ্টি। তুইও তেমন।”
আহি বলল, “কি হলো?”
“বলছি সন্দেশ যদি নিজ থেকেই আমার কাছে ধরা দেয়, তাহলে আমি তাকে যেতে দেবো না।”
আহি হেসে বলল,
“হ্যাঁ ধরা দিয়েছে তো। তাই তো খেয়ে ফেলেছিস।”
রাদ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে আহির দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে হাসছিস কেন?”
রাদ বলল,
“তুই নতুন করে কাউকে ভালোবাসবি না?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“বল না।”
“দেখা যাক।”
“যদি কেউ তোকে ভালোবাসে। তখন?”
“তখন কি?”
“ধর, কেউ একজন তোকে ভালোবাসে। কিন্তু সাহসের অভাবে বলতে পারছে না। কি করবি? সে যদি সাহস করে জানিয়ে দেয়, তখন কি না করে দিবি?”
“তাজওয়ার খানের ঝামেলা মিটলে ভেবে দেখবো।”
রাদ এক গাল হেসে বলল, “সত্যি?”
আহি রাদের হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“পাগল না-কি তুই? কে সেই প্রেমিকটা শুনি?”
“আমি তো অনুমান করছি। থাকতেও পারে। আমি শিউর হচ্ছিলাম। তুই কতোটুকু মুভ অন করেছিস ওটা জানার জন্য এমন প্রশ্ন করেছি।”
আহি মলিন হেসে বলল,
“মুভ অন তো আমি সেদিনই করেছি, যেদিন সমুদ্র তীরে নিজ হাতে পদ্ম আর সেই মানুষটার বাসর সাজিয়েছিলাম। কিন্তু মুভ অন বলতে কি বোঝায়, রাদ? নতুন কাউকে আসতে দেওয়া? পুরোনো মানুষটাকে স্মরণ না করা? আমি চাই এমন কেউ আসুক, যে অন্তত আমার মানুষ হোক। কিন্তু সেই মানুষটা চোখের সামনে থাকলে কীভাবে আমি মুভ অন করবো?”
“আফিফ তো এই শহরেই থাকবে। তাহলে কি করবি?”
“একবার মাস্টার্স শেষ হোক। এরপর তাজওয়ারের থেকে মুক্তি নেবো। বাবার কাছ থেকে মুক্তি নেবো। এরপর নতুন শহরে যাবো। নতুন স্বপ্ন দেখবো। এমন কিছু করবো, যাতে আফিফ মানুষটা কোনোদিনই আমার চোখের সামনে না আসে। মানুষ কতো সহজে বলে ফেলে মুভ অন করে ফেলেছি। আমার কাছে মুভ অন শব্দটার অর্থ, তাকে নিয়ে অশ্রু না ফেলা, রাত জেগে বালিশ না ভেজানো, তাকে চোখের সামনে কল্পনা না করা আর তার সাথে একা একা কথা না বলা। এতোটুকুতেই আমার মুভ অন। কিন্তু একা থাকলে ঠিকই অতীত নাড়া দেয়। তাই আমি মুভ অন নয়, আমি ভুলে থাকবো। আর এটা একদিনে হবে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই হবে।”
“আর আমি সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবো।”
(***)
কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে আহি। তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখানে?”
“কেন তোমাকে দেখতে আসতে পারি না?”
“আমি ব্যস্ত আছি। আমাকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।”
“আমিই তোমাকে নিয়ে যাবো।”
“তোমাকে কে বলেছে নিয়ে যেতে?”
“আহি, কি হয়েছে তোমার? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছো! তাহলে এখন এভাবে কথা বলছো কেন?”
তখনই লাবণি আহির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার লাবণির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“আমার হবু শাশুড়ী মা সেদিন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন। আমি না-কি তার পরীক্ষায় পাশ করেছি। তাই আমাকে ফোন করে বললো তোমার পাশের ফলস্বরূপ তোমার রানীকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। সে না-কি বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে। দু’জন একসাথে বিয়েও এটেন্ড করবে, এরপর একটা ভালো মুহূর্তও কাটাবে।”
আহি রাগী দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি রহস্যময় হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মাই ডিয়ার প্রিন্সেস, তোমার মিস্টার খানের সাথেই লিনাশার বিয়েতে যাওয়া উচিত। তাদেরও তোমার হবুও বরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে হবে। আফটার অল বেস্ট ফ্রেন্ড এর হাসবেন্ডরা অন্তত গুড ফ্রেন্ড তো হতেই পারে।”
আহি তাজওয়ারকে বলল,
“প্লিজ, তুমি যেও না। আমি বিয়ের প্রোগ্রাম শেষে তোমার সাথে দেখা করবো।”
তাজওয়ার বলল,
“আমি তো যাবোই। এমনকি সবাইকে জানাবো, তুমি আমার কে হও!”
তাজওয়ার কথাটি বলেই বেরিয়ে পড়লো। এবার লাবণি আহির মুখোমুখি এসে বলল,
“তোমার বাবা আর তাজওয়ার খানের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করতে চেয়েছিলে, তাই না?”
আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি হেসে বলল,
“তোমার প্ল্যান ফ্লপ। তোমার বাবাকে তো আমি একটা বুঝিয়ে দিয়েছি। তাজওয়ারকেও তোমার প্ল্যান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দিয়েছি। তুমি যে তাকে বিশ্বাস করার অভিনয় করে তাকেই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছো, এই সত্যটা তাজওয়ার জেনে গেছে। এখন যতোদিন তোমাদের বিয়ে হবে না, তুমি আর ইমোশনালি তাজওয়ারকে ফাঁসাতে পারবে না।”
“আপনাকে কে বলেছে, আমি তাজওয়ারকে বিশ্বাস করার অভিনয় করছি?”
“তুমি হুট করে তাজওয়ারকে এতো সম্মান দিচ্ছো! যাকে সহ্য করতে পারতে না, তাকে এতো সময় দিচ্ছো! তাহলে কে বিশ্বাস করবে তুমি তাকে বিশ্বাস করছো?”
আহি দমে গেলো। লাবণি আহির গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার পরিকল্পনা মোটেও খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মস্তিষ্কের মাঠে তুমি নতুন খেলোয়াড়। আমি অনেক আগেই নেমেছি। যাই হোক, আমাকে একটা ভালো আইডিয়া দিয়েছো তুমি। এখন তোমার বাবাও মন্ত্রী হয়ে যাবে। আমিও অনেক ক্ষমতা পাবো। আর তাজওয়ার আমার জন্য অপশনাল হয়েই থাকবে। কেমন হবে, যখন নিজের স্বামীকে আমার সাথে দেখবে?”
“তাজওয়ার আর আমার এখনো বিয়ে হয় নি। হবেও না।”
“মিস আহি, তোমাকে হারানোর জন্য তাজওয়ার আর তোমার বিয়ে না দেওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাবো না। এরপর তুমি যে ধোঁকা খাবে, সেই ধোঁকা থেকে তুমি চাইলেও মুক্তি পাবে না। এর জন্য যদি আমাকে সব সীমা অতিক্রম করতে হয়, আমি করবো।”
“মিসেস লাবণি মেহেরা, চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। তাজওয়ার আর আমার যদি বিয়ে হয়, তাহলে আমি সেদিনই নিজ হাতে নিজেকে শেষ করে দেবো। এতোটুকু কনফিডেন্স আমার আছে যে আমি তাজওয়ার খানের নাম শুনে কবুল না বলতে চাইলে, বিয়ের রেজিস্ট্রার পেপারে স্বাক্ষর না করতে চাইলে কেউ বাধ্য করে আমার কন্ঠে সে কবুল শব্দটা আনতে আর আমার সিগনেচার কাগজে জোর করতে তুলতে পারবে না।”
“এতোটা ডেস্পারেট তুমি?”
“আপনাকে চ্যালেঞ্জে হারানোর জন্য এটা আমার জীবনের শেষ সংগ্রাম। এই যুদ্ধে আমি যদি জিতে যাই, আল্লাহর কাছে আমার ওয়াদা আমি জীবনের সব বিলাসিতা ত্যাগ করবো। সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনে শান্তি এনে দিলে, আমি জগতের সব মোহ ত্যাগ করতে রাজি। তাহলে আমার নামে থাকা সম্পত্তি, আর তাজওয়ারের প্রাসাদে রানী হওয়ার মতো ঠুনকো ইচ্ছে আমার থাকার কথা নয়। আমার ইচ্ছে, আমি রানী হবো। কিন্তু তার রানী হবো, যে আমার রাজা হওয়ার যোগ্য। না থাকুক তার বাড়ি। আসল রাজাদের বাড়ি নয়, মন থাকতে হয়। আর সেই মনে আমি সম্রাজ্ঞী হয়ে বাস করবো। আর সেদিন আপনার জায়গাটা কোথাও থাকবে না। এই কয়েকদিনের সুখ নিয়ে সুখী হয়ে যান। সামনে চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। কষ্টের পরেই তো স্বস্তি। আল্লাহ যেই কথাটা জানিয়েছেন, সেটা অবিশ্বাস করা যায় না। তাহলে আমার এতো বছরের কষ্টের পর আমি কেন স্বস্তি পাবো না? অবশ্যই পাবো। আপনি নিজ চোখে আমার জয় দেখবেন। আর নিজেকে হারতে দেখবেন।”
লাবণি হেসে বলল, “কি করতে পারবে তুমি?”
“সময় বলে দেবে।”
চলবে-ভ#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(১ম ভাগ)||
৮৪।
আহি হাতে মেহেদি লাগিয়ে এক কোণায় বসে নাচ দেখছে। নায়ীব আর লিনাশা পাশাপাশি বসে আছে। দু’জনকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। আহি মনে মনে ভাবলো,
“ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়তো অন্য কিছুতে নেই। লিনু আজ কতো খুশি!”
আহি এবার পাশ ফিরে পদ্ম আর আফিফের দিকে তাকালো। তাদের দেখে সে মুচকি হেসে আপন মনে বলল,
“ওরাও কতো সুখী! তাহলে আমি কেন সুখী হতে পারছি না? ইদানীং আফিফকে হারানোর কষ্ট আমাকে ওভাবে কাঁদায় না। তবুও নতুন করে সুখ খুঁজতে পারছি না কেন? আমি কি তাহলে ভয় পাচ্ছি? আবার কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার ভয় কি আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখতে বাঁধা দিচ্ছে? না-কি এখনো মনের কোথাও না কোথাও অতীতটাই বসে আছে!”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখনই তার পাশে এসে বসলো উজ্জ্বল। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকাতেই উজ্জ্বল গাঢ় হাসি দিলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কিছু হয়েছে?”
উজ্জ্বল মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু হয়েছে।”
“কি!”
“তুমি খুব বোরিং, আহি।”
আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো। উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি আবার উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি জানো, মানুষের চেহারা আর তার আত্মার চেহারা একই থাকা উচিত।”
“আত্মার আবার চেহারা আছে?”
“হুম, কখনো খুব সুন্দর, কখনো বা খুব কুৎসিত।”
“কীভাবে বোঝা যায় সেটা?”
“মানুষের চেহারায় আত্মার চেহারা ফুটে উঠে।”
“যেমন!”
“এই যে তুমি মেয়েটা, মাশাল্লাহ। কিন্তু তোমার আত্মাটা এতো নির্জীব হয়ে আছে যে, তোমার সৌন্দর্যটাই দাবিয়ে রেখেছে।”
আহি হাসলো। এবারের হাসিতে প্রাণ ছিল। উজ্জ্বল বলল,
“এই তো এটাই। আমি এটাই দেখতে চেয়েছি। মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি হাসি।”
আহি লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো। উজ্জ্বল আবার বলল,
“তোমাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না, তুমি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে।”
“কেন?”
“তোমার মধ্যে সেই ঐশ্বর্যের অহংকার নেই। তোমার মনোভাব, আচরণ একদম সাধারণ মেয়েদের মতোই। এই জন্য বোধহয় তুমি অনেক স্পেশাল।”
“সাধারণ মেয়ে, আবার স্পেশাল?”
“সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়ে সাধারণ হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। ধনীর দুলালিদের উৎশৃঙ্খল হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আহি হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই তো তুমি স্পেশাল।”
আহি আবারও লাজুক হেসে মাথা নামালো। উজ্জ্বলের এই হাসিটাই বেশ সুন্দর লাগছে। মেয়েদের প্রশংসা করলে, মেয়েরা যে কতোটা খুশি হয়, তা আহির লাজুক হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। উজ্জ্বল আবার কিছু বলতে যাবে তখনই একটা হাত আহির দিকে এগিয়ে এলো। আহি মাথা তুলে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এখানে এসে বস।”
“চল ডান্স করি।”
আহি হাত দেখিয়ে বলল,
“হাতে মেহেদি। তোর পাঞ্জাবিটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
রাদ আহির বাহু ধরে ওকে টেনে উঠালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি হয়েছে, রাদ?”
“কিছু না। চল অন্যদিকে গিয়ে বসি।”
“তুই ঠিক আছিস তো?”
উজ্জ্বল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা বসো আমি আসছি।”
উজ্জ্বল চলে যেতেই আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“আজকাল বেশ অদ্ভুত আচরণ করছিস?”
তখনই একটা টেবিলের উপর দুইটা চামচ নিয়ে গানের ধুন সৃষ্টি করলো উজ্জ্বল। আর সুরের সাথে গেয়ে উঠলো।
“লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা ।।”
সবার দৃষ্টি স্টেজের সামনে গেলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে উজ্জ্বলকে দেখছে। আর উজ্জ্বলের দৃষ্টি আহির দিকে। উজ্জ্বল চামচ দু’টি টুলটির উপর রেখে একটা মাইক নিয়ে আহির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে গাইতে লাগলো,
“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
এবার উজ্জ্বল আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। উজ্জ্বল মুচকি হেসে নিজেই আহির যেই হাতের মেহেদি শুকিয়ে গেছে, সেই হাতটি আলতোভাবে ধরে তাকে সবার সামনে নিয়ে এলো। এরপর আহির পাশে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল,
“যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
আহি পেছন ফিরে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা বেশ খুশি। সে নায়ীবকে বলল,
“ওদের বেশ মানিয়েছে, তাই না?”
নায়ীব কোনো উত্তর দিলো না। সে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে উজ্জ্বল হাতের ইশারায় সবাইকে গানের সাথে যোগ দিতে বলল আর নিজেও গাইতে লাগলো,
“যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
লিনাশা নায়ীবের হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। তারাও যোগ দিলো উজ্জ্বলের গানে। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে গেয়ে যেতে লাগলো,
“যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!
.
লাললালালা
লালালালালা
লালালালালালালালালালালালালা।”
আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। গান গাওয়া শেষে করতালি মুখর পরিবেশে সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে আহি আর উজ্জ্বল। কিন্তু কারো দৃষ্টি আটকালো না রাদ আর আফিফের দিকে। রাদের হাত মুঠো হয়ে আছে, চোখে অশ্রু জমবে এমন অবস্থা। অন্যদিকে আফিফকে দেখে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, তার খারাপ লাগার কারণ কি। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরলো। পদ্ম আফিফের স্পর্শ পেয়ে তার দিকে তাকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে?”
আফিফ পদ্মের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি ফেরত দিলো। পদ্ম বুঝলো না সেই হাসির অর্থ। সে আফিফের হাত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এদিকে রাদ ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর পিছিয়ে সে পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে নিতেই তার কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো। রাদ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো লাবীব দাঁড়িয়ে আছে। লাবীব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই রাদ বেরিয়ে গেলো। লাবীব এবার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে হাসি। অনেক বছর পর আহিকে এমন ভাবে হাসতে দেখছে। দেখে মনে হচ্ছে আহি মুগ্ধ হচ্ছে উজ্জ্বলের গানের সুরে। এই মুগ্ধতা কি রাদের অনুভূতির জন্য থামিয়ে দেওয়া উচিত? যেই মেয়েটা এতো বছর পর কারো দৃষ্টিতে নিজেকে হারানোর সুযোগ পেয়েছে, তাকে কি সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত?
৮৫।
রাত বাড়তেই অতিথিরা বিদায় নিতে লাগলো। উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“পুষ্পের সাথে বাসায় এসো। তোমাকে কতো বছর পর দেখলাম।”
কথাটি বলেই তিনি উজ্জ্বলের দিকে তাকালেন। উজ্জ্বলের ঠোঁটে মৃদু হাসি। তা দেখে পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে ফিসফিস করে উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছিস কেন এতো?”
উজ্জ্বল হাসি গিলে ফেললো। বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই তোর কাজ কর।”
উজ্জ্বল ও মিসেস আমিনা চলে যেতেই পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“কি হলো এটা আজকে?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হলো?”
“উজ্জ্বল ভাইয়া আর তুই প্রেম-টেম করছিস না-কি?”
রাদ আর লাবীব তখনই আহি আর পুষ্পের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুষ্পের প্রশ্নটা রাদ আর লাবীব দু’জনেই শুনেছে। লাবীবও এবার পুষ্পের কথায় যোগ দিয়ে বলল,
“আহি, সত্যি না-কি?”
আহি অবাক কণ্ঠে বলল,
“পাগল তোরা! একদমই না। আমি প্রেম করবো, আর তোরা জানবি না?”
পুষ্প বলল,
“নাও জানাতে পারিস। আমাকে তো কিছুই জানাস না। লিনাশাকে হয়তো জানিয়েছিস।”
“যা, গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। ওকেও এমন কিছু বলি নি৷ কারণ এই মুহূর্তে আমার জীবনে কিছুই নেই।”
“হবে হয়তো।”
“তুই জানিস তাজওয়ারের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”
“তুই তো উনাকে পছন্দ করিস না। আর বিয়ে তো এখনো হয় নি।”
“হ্যাঁ, তাও এমন একটা সিচুয়েশনে আমি প্রেম করবো, এমন পাগল পাগল চিন্তা-ভাবনা তোদের মাথায় কীভাবে আসে?”
লাবীব জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তোকে দেখে যে অন্য কিছু মনে হলো!”
“কি মনে হলো?”
এবার রাদ বলল,
“তাকিয়ে ছিলি পুষ্পের সেই কাজিনের দিকে। হাসছিলি তাকে দেখে।”
আহি রাদের কথায় হালকা হেসে বলল,
“ধুর, কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে আর হাসলে কি প্রেম শুরু হয়ে যায়? আসলে উনার গানের গলা বেশ ভালোই ছিল। আর গানটার অর্থটা আমার অনেক ভালো লেগেছিল। তাই শুনছিলাম। আর এভাবে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাওয়াতে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। মনে হয়েছিল, গানটা উনি আমার জন্য গেয়েছেন। নিজেকে ইম্পোরটেন্ট মানুষ হচ্ছিলো। তাই হাসি পেয়েছে। কেউ কখনো আমার জন্য গান গায় নি তো, তাই। এই প্রথম কেউ গেয়েছে।”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কখনো গান গাই নি?”
“তুই আর বাকিরা তো আলাদা!”
রাদ আহির কথায় অবাক হলো। বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বলল,
“আলাদা মানে?”
“তুই আমার ফ্রেন্ড।”
লাবীব রাদকে থামিয়ে দিলো। রাদের ভীষণ অস্থির লাগছে। আহির বন্ধু হয়ে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এখন এর মাশুল কি আহিকে হারিয়েই দিতে হবে?
(***)
রাদ বেরুতেই আহিও তার পিছু পিছু এলো। রাদ আহিকে আসতে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি তার মুখে একটা সন্দেশ পুরে দিলো। রাদ সন্দেশটা খেয়ে আহিকে বলল,
“আমাকে বিদায় দিতে এসেছিস?”
আহি মাথা নেড়ে বলল,
“উহুম, তোকে সন্দেশ খাওয়াতে এসেছি। ভেতরে শুধু দু’টো প্যাকেটে সন্দেশ ছিল। তুই তো অন্য মিষ্টি খাস না। তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”
রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“কিছু জিনিস ভালো লাগলেও সহজে পাওয়া যায় না। খুব করে চাইলেও, তা আমাদের স্পর্শের বাইরে থাকে।”
আহি হেসে বলল,
“সন্দেশ নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করছিস?”
রাদ মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
“তুই তো আমার কাছে সন্দেশই। সন্দেশ যেমন মিষ্টি। তুইও তেমন।”
আহি বলল, “কি হলো?”
“বলছি সন্দেশ যদি নিজ থেকেই আমার কাছে ধরা দেয়, তাহলে আমি তাকে যেতে দেবো না।”
আহি হেসে বলল,
“হ্যাঁ ধরা দিয়েছে তো। তাই তো খেয়ে ফেলেছিস।”
রাদ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে আহির দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে হাসছিস কেন?”
রাদ বলল,
“তুই নতুন করে কাউকে ভালোবাসবি না?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“বল না।”
“দেখা যাক।”
“যদি কেউ তোকে ভালোবাসে। তখন?”
“তখন কি?”
“ধর, কেউ একজন তোকে ভালোবাসে। কিন্তু সাহসের অভাবে বলতে পারছে না। কি করবি? সে যদি সাহস করে জানিয়ে দেয়, তখন কি না করে দিবি?”
“তাজওয়ার খানের ঝামেলা মিটলে ভেবে দেখবো।”
রাদ এক গাল হেসে বলল, “সত্যি?”
আহি রাদের হাতে ঘুষি মেরে বলল,
“পাগল না-কি তুই? কে সেই প্রেমিকটা শুনি?”
“আমি তো অনুমান করছি। থাকতেও পারে। আমি শিউর হচ্ছিলাম। তুই কতোটুকু মুভ অন করেছিস ওটা জানার জন্য এমন প্রশ্ন করেছি।”
আহি মলিন হেসে বলল,
“মুভ অন তো আমি সেদিনই করেছি, যেদিন সমুদ্র তীরে নিজ হাতে পদ্ম আর সেই মানুষটার বাসর সাজিয়েছিলাম। কিন্তু মুভ অন বলতে কি বোঝায়, রাদ? নতুন কাউকে আসতে দেওয়া? পুরোনো মানুষটাকে স্মরণ না করা? আমি চাই এমন কেউ আসুক, যে অন্তত আমার মানুষ হোক। কিন্তু সেই মানুষটা চোখের সামনে থাকলে কীভাবে আমি মুভ অন করবো?”
“আফিফ তো এই শহরেই থাকবে। তাহলে কি করবি?”
“একবার মাস্টার্স শেষ হোক। এরপর তাজওয়ারের থেকে মুক্তি নেবো। বাবার কাছ থেকে মুক্তি নেবো। এরপর নতুন শহরে যাবো। নতুন স্বপ্ন দেখবো। এমন কিছু করবো, যাতে আফিফ মানুষটা কোনোদিনই আমার চোখের সামনে না আসে। মানুষ কতো সহজে বলে ফেলে মুভ অন করে ফেলেছি। আমার কাছে মুভ অন শব্দটার অর্থ, তাকে নিয়ে অশ্রু না ফেলা, রাত জেগে বালিশ না ভেজানো, তাকে চোখের সামনে কল্পনা না করা আর তার সাথে একা একা কথা না বলা। এতোটুকুতেই আমার মুভ অন। কিন্তু একা থাকলে ঠিকই অতীত নাড়া দেয়। তাই আমি মুভ অন নয়, আমি ভুলে থাকবো। আর এটা একদিনে হবে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই হবে।”
“আর আমি সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবো।”
(***)
কমলা রঙের লেহেঙ্গা পরে আয়নায় নিজেকে দেখছে আহি। তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখানে?”
“কেন তোমাকে দেখতে আসতে পারি না?”
“আমি ব্যস্ত আছি। আমাকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।”
“আমিই তোমাকে নিয়ে যাবো।”
“তোমাকে কে বলেছে নিয়ে যেতে?”
“আহি, কি হয়েছে তোমার? তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছো! তাহলে এখন এভাবে কথা বলছো কেন?”
তখনই লাবণি আহির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাজওয়ার লাবণির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“আমার হবু শাশুড়ী মা সেদিন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন। আমি না-কি তার পরীক্ষায় পাশ করেছি। তাই আমাকে ফোন করে বললো তোমার পাশের ফলস্বরূপ তোমার রানীকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। সে না-কি বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে। দু’জন একসাথে বিয়েও এটেন্ড করবে, এরপর একটা ভালো মুহূর্তও কাটাবে।”
আহি রাগী দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি রহস্যময় হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মাই ডিয়ার প্রিন্সেস, তোমার মিস্টার খানের সাথেই লিনাশার বিয়েতে যাওয়া উচিত। তাদেরও তোমার হবুও বরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেতে হবে। আফটার অল বেস্ট ফ্রেন্ড এর হাসবেন্ডরা অন্তত গুড ফ্রেন্ড তো হতেই পারে।”
আহি তাজওয়ারকে বলল,
“প্লিজ, তুমি যেও না। আমি বিয়ের প্রোগ্রাম শেষে তোমার সাথে দেখা করবো।”
তাজওয়ার বলল,
“আমি তো যাবোই। এমনকি সবাইকে জানাবো, তুমি আমার কে হও!”
তাজওয়ার কথাটি বলেই বেরিয়ে পড়লো। এবার লাবণি আহির মুখোমুখি এসে বলল,
“তোমার বাবা আর তাজওয়ার খানের মধ্যে ঝামেলা বাঁধিয়ে নিজের পথ পরিস্কার করতে চেয়েছিলে, তাই না?”
আহি অবাক দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি হেসে বলল,
“তোমার প্ল্যান ফ্লপ। তোমার বাবাকে তো আমি একটা বুঝিয়ে দিয়েছি। তাজওয়ারকেও তোমার প্ল্যান সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দিয়েছি। তুমি যে তাকে বিশ্বাস করার অভিনয় করে তাকেই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছো, এই সত্যটা তাজওয়ার জেনে গেছে। এখন যতোদিন তোমাদের বিয়ে হবে না, তুমি আর ইমোশনালি তাজওয়ারকে ফাঁসাতে পারবে না।”
“আপনাকে কে বলেছে, আমি তাজওয়ারকে বিশ্বাস করার অভিনয় করছি?”
“তুমি হুট করে তাজওয়ারকে এতো সম্মান দিচ্ছো! যাকে সহ্য করতে পারতে না, তাকে এতো সময় দিচ্ছো! তাহলে কে বিশ্বাস করবে তুমি তাকে বিশ্বাস করছো?”
আহি দমে গেলো। লাবণি আহির গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার পরিকল্পনা মোটেও খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মস্তিষ্কের মাঠে তুমি নতুন খেলোয়াড়। আমি অনেক আগেই নেমেছি। যাই হোক, আমাকে একটা ভালো আইডিয়া দিয়েছো তুমি। এখন তোমার বাবাও মন্ত্রী হয়ে যাবে। আমিও অনেক ক্ষমতা পাবো। আর তাজওয়ার আমার জন্য অপশনাল হয়েই থাকবে। কেমন হবে, যখন নিজের স্বামীকে আমার সাথে দেখবে?”
“তাজওয়ার আর আমার এখনো বিয়ে হয় নি। হবেও না।”
“মিস আহি, তোমাকে হারানোর জন্য তাজওয়ার আর তোমার বিয়ে না দেওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাবো না। এরপর তুমি যে ধোঁকা খাবে, সেই ধোঁকা থেকে তুমি চাইলেও মুক্তি পাবে না। এর জন্য যদি আমাকে সব সীমা অতিক্রম করতে হয়, আমি করবো।”
“মিসেস লাবণি মেহেরা, চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। তাজওয়ার আর আমার যদি বিয়ে হয়, তাহলে আমি সেদিনই নিজ হাতে নিজেকে শেষ করে দেবো। এতোটুকু কনফিডেন্স আমার আছে যে আমি তাজওয়ার খানের নাম শুনে কবুল না বলতে চাইলে, বিয়ের রেজিস্ট্রার পেপারে স্বাক্ষর না করতে চাইলে কেউ বাধ্য করে আমার কন্ঠে সে কবুল শব্দটা আনতে আর আমার সিগনেচার কাগজে জোর করতে তুলতে পারবে না।”
“এতোটা ডেস্পারেট তুমি?”
“আপনাকে চ্যালেঞ্জে হারানোর জন্য এটা আমার জীবনের শেষ সংগ্রাম। এই যুদ্ধে আমি যদি জিতে যাই, আল্লাহর কাছে আমার ওয়াদা আমি জীবনের সব বিলাসিতা ত্যাগ করবো। সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনে শান্তি এনে দিলে, আমি জগতের সব মোহ ত্যাগ করতে রাজি। তাহলে আমার নামে থাকা সম্পত্তি, আর তাজওয়ারের প্রাসাদে রানী হওয়ার মতো ঠুনকো ইচ্ছে আমার থাকার কথা নয়। আমার ইচ্ছে, আমি রানী হবো। কিন্তু তার রানী হবো, যে আমার রাজা হওয়ার যোগ্য। না থাকুক তার বাড়ি। আসল রাজাদের বাড়ি নয়, মন থাকতে হয়। আর সেই মনে আমি সম্রাজ্ঞী হয়ে বাস করবো। আর সেদিন আপনার জায়গাটা কোথাও থাকবে না। এই কয়েকদিনের সুখ নিয়ে সুখী হয়ে যান। সামনে চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। কষ্টের পরেই তো স্বস্তি। আল্লাহ যেই কথাটা জানিয়েছেন, সেটা অবিশ্বাস করা যায় না। তাহলে আমার এতো বছরের কষ্টের পর আমি কেন স্বস্তি পাবো না? অবশ্যই পাবো। আপনি নিজ চোখে আমার জয় দেখবেন। আর নিজেকে হারতে দেখবেন।”
লাবণি হেসে বলল, “কি করতে পারবে তুমি?”
“সময় বলে দেবে।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪২(২য় ভাগ)||
৮৬।
আহি মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে রেখেছে। আহি কিছুক্ষণ পর পর বিরক্ত হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তাজওয়ার এসবে পাত্তা দিচ্ছে না। সে তার মতোই আহির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে উজ্জ্বলের মা মিসেস আমিনা আহিকে খুব পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে এসে তাজওয়ার আর আহিকে একসাথে দেখে তিনি দমে গেলেন৷ অন্যদিকে উজ্জ্বল গম্ভীর দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল বেশ বুঝতে পারছে, আহি তাজওয়ারের এমন ব্যবহারে অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তাজওয়ারকে সরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো অধিকার তার নেই। এদিকে রাদেরও ভীষণ রাগ হচ্ছে। অথচ সে কিছুই করতে পারবে না। এই মুহূর্তে কারো কাছে আহির অস্থিরতা কমানোর কোনো সমাধান নেই। আহি নিজেই কয়েক বার তাজওয়ারের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ঘুরেফিরে তাজওয়ার তার কাছে এসে দাঁড়ায়। আহি এবার বিরক্ত হয়েই বলল,
“কেন এমন করছো?”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“সবাইকে জানাচ্ছি, তুমি আমার কে হও!”
“এখানে কেউ এসব দেখতে আগ্রহী নয়।”
“বেশ বিরক্ত হচ্ছো, মনে হচ্ছে! তার মানে এতোদিন সত্যিই সব অভিনয় ছিল? আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমন করেছো?”
আহি তাজওয়ারের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে আবার দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তাজওয়ার আবারও আহির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই পদ্ম সেখানে উপস্থিত হলো। সে আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। তাজওয়ার পিছু পিছু আসতে চায়লে পুষ্প তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, অন্তত আজকের জন্য আপনার মিসেসকে আমাদের সাথে থাকতে দিন। আমরা নতুন দুলাভাইয়ের খাতিরযত্ন করার কিছু প্ল্যান করছি। আপনার বারেও কিন্তু করবো।”
তাজওয়ার হালকা হেসে বলল, “হ্যাঁ অবশ্যই।”
কিন্তু মনে মনে বেশ বিরক্ত হলো সে। তারা যে ইচ্ছে করে আহিকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তা বেশ বুঝতে পারছে তাজওয়ার।
(***)
আহি পদ্মের সাথে একপাশে এসে দাঁড়ালো। পদ্ম বলল,
“কি হচ্ছে এসব, আহি?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি হয়েছে?”
“আমি আর আফিফ ছাড়াও বিয়েতে অনেক দম্পতি এসেছে। আর তোর সাথে মিস্টার তাজওয়ার খানের বিয়েই হয় নি। এভাবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা কতোটা বাজে দেখাচ্ছে, জানিস? এটা একটা ফ্যামিলি প্রোগ্রাম। তাও আবার লিনাশার বান্ধবী তুই। ওর আত্মীয়রা কী ভাববে?”
“এখানে আমার কি দোষ? আমি তাজওয়ারকে আনতে চাই নি। ও নিজেই এসেছে।”
“আমার উনাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না।”
“সুবিধার মানুষও না।”
তাদের কথার মাঝখানে আফিফ এসে দাঁড়ালো। আহি একনজর তার দিকে তাকালো৷ আফিফ পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এখন বাসায় চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে। রাতও অনেক হয়েছে৷”
পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“চল তোকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”
আহি পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিফও আহির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। তাজওয়ারের দৃষ্টি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলো। আফিফের রাগ উঠলো খুব। মানুষটা তাকে দিনদিন কোনঠাসা করে রাখছে।
আজ অজানা কারণেই আফিফের মেজাজ বেশ খিটখিটে হয়ে আছে। সে পদ্মের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। পদ্ম বলল,
“কি হয়েছে আপনার?”
“বাসায় চলো, প্লিজ। ভালো লাগছে না আমার।”
“হঠাৎ!”
আফিফ গম্ভীরমুখে বলল, “চলো, পদ্ম।”
পদ্ম বলল,
“আচ্ছা, একটু পর লিনাশাকে বিদায় দিয়ে দেবে। তারপর চলে যাবো।”
এদিকে লিনাশার বিদায় পর্ব শেষ হতেই তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে গাড়িতে উঠালো। রাদ আর লাবীব ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ তাজওয়ারকে আটকানোর জন্য তাদের গাড়ির কাছে এসে বলল,
“আহি তুই না আমার সাথে যাবি?”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আহি আমার সাথে যাচ্ছে।”
কথাটি বলেই গ্লাস টেনে দিলো তাজওয়ার। আহি বিরক্তমুখে বলল,
“তোমার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কি?”
তাজওয়ার গাড়ি ঘুরিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে চলে এলো। আহি বলল,
“সমস্যা কি?”
তাজওয়ার কিছুদূর এসে গাড়ি থামিয়ে আহির চুল টেনে ধরে তার ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরলো। আকস্মিক এমন আক্রমণে আহি থতমত খেয়ে গেলো। সে তাজওয়ারকে ছাড়ানোর জন্য তাকে ধাক্কা দিতেই তাজওয়ার আহির গলা চেপে ধরে বলল,
“তুই আমার সাথে অভিনয় করেছিলি? আমার ভালোবাসা তোর কাছে মশকারা ছিল?”
আহির ভীষণ রাগ উঠলো। সে সশব্দে তাজওয়ারের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। তাজওয়ারের রাগ যেন আরো বেড়ে গেলো। সে আহির লেহেঙ্গার ব্লাউজটা পেছন দিক দিয়ে টেনে ধরতেই পেছনের বোতামগুলো ছিঁড়ে গেলো। আহি বুঝতে পেরে সাথে সাথেই উড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে বলল,
“তুমি আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না, বলছি।”
তাজওয়ার আহির কাছে এসে বলল,
“তুই তো আমাকে বিয়ে করবি না। এখন তোকে বাধ্য করাও তো সম্ভব না। এই মুহূর্তে একটাই উপায় আছে। বিয়ের আগেই তোকে ধর্ষণ করবো।”
আহি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “ছি!”
তাজওয়ার আহির গাল চেপে ধরে বলল,
“ছি! আমাকে ছি করছিস? আর ওই আফিফ যখন তোকে স্পর্শ করে, ওটা কি তোর খুব ভালো লাগে?”
“পাগল তুমি? ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক করো তোমার। ও আমাকে কখন স্পর্শ করলো?”
“একটু আগে কি করছিলি তোরা?”
“ও পদ্মের সাথে কথা বলতে এসেছে। পদ্মকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল।”
“আচ্ছা? স্টেজে উঠে যখন ছবি উঠাচ্ছিলি, ও তোর হাত ধরলো কেন?”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আ’র ইউ ক্রেজি? তাজওয়ার, তুমি কি অন্ধ? ও আমার হাত ধরেছো দেখেছো। কিন্তু কেন ধরেছে বুঝো নি? লেহেঙ্গা ভারী ছিল আমার। কার্পেটে হিল আঁটকে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাই ও আমাকে জাস্ট নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে।”
“আর ও স্পর্শ করলো, তোরও ভালো লাগলো।”
“কি বলছো এসব?”
“তোর চোখে-মুখে ভালো লাগা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। ওকে এখনো ভালোবাসিস, তাই না?”
আহি স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাজওয়ার বলল,
“আই হেইট হিম। ও আমার ভালোবাসা কেঁড়ে নিয়েছে।”
তাজওয়ার চিৎকার করে উঠলো। বার কয়েক গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের উপর ঘুষি মারলো। আহি সুযোগ পেয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো। আহি নেমে যেতেই তাজওয়ারও নেমে পড়লো। আহি তার হিলগুলো খুলে উলটো দিকে দৌঁড়াতে লাগলো। তাজওয়ার গাড়িতে হেলান দিয়ে শব্দ করে হাসছে। আহি একবারো পিছু ফিরে দেখে নি।
(***)
অনেক দূর দৌঁড়ে এসে আহি হাঁপাতে লাগলো। পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার তার পিছু আসে নি। ব্যাগ, ফোন সব গাড়িতেই ফেলে এসেছে। কাউকে যে ফোন করে সাহায্য নেবে সেই সুযোগটাও নেই। এই মুহূর্তে ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। কোনোভাবে হাত হাতিয়ে ব্লাউজের পেছনের বোতামগুলো লাগানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। উড়নাটা দু’ভাজ করে এবার গায়ে জড়িয়ে নিলো সে। ভাগ্যটাই তার নির্মম। প্রতিবার বান্ধবীর বিয়েতেই তার সাথে ভয়ংকর কিছু ঘটে। পদ্মের বিয়েতেও অন্ধকার রাস্তায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। আজও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে। আহি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“আমি অশুভ। আমিই অশুভ। আমার মরে যাওয়া উচিত। আমার অসহ্য লাগছে এসব। আর ভালো লাগছে না আমার। আমি পারবো না আর এসব সহ্য করতে।”
হঠাৎ একটা সিএনজি সেই রাস্তা দিয়ে আসতে লাগলো। আহি তা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই সিএনজিটা থেমে গেলো। আহি আরো ভয় পেয়ে গেলো। সে উলটো দিকে ফিরে আবার দৌঁড়াতে যাবে তখনই পদ্মের কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালো। পদ্ম সিএনজি থেকে নেমে আহির দিকে দৌঁড়ে এলো। আর আহি পদ্মকে দেখে তাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আফিফও সিএনজি থেকে নেমে এলো। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এখানে?”
আহি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“তাজওয়ার আমার সাথে বাজে ব্যবহার করছিল। তাই আমি পালিয়ে এসেছি।”
এই কথা শুনে আফিফের হাত মুঠো হয়ে এলো। পদ্ম বলল,
“তুই চল, আমাদের সাথে চল।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”
পদ্ম বলল,
“না, ওই বাসা ওর জন্য নিরাপদ নয়। কয়েকদিন আহি আমাদের সাথেই থাকুক।”
আহি বলল,
“আমাকে মায়ের বাসায় নামিয়ে দিলেই হবে।”
“আন্টি তোকে এই অবস্থায় দেখে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবেন। বেশি কথা বলিস না তো। চল, আমাদের সাথে।”
পদ্ম আহিকে জোর করে সিএনজিতে বসালো। আহি এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি তাজওয়ার তাকে টেনে নিয়ে যাবে। সে পদ্মের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আফিফ তা দেখে বলল,
“তুমি চাইলে ওর বিরুদ্ধে কেইস করতে পারো।”
আহি ভেজা চোখে আফিফের দিকে তাকালো আর বলল,
“ওর বিরুদ্ধে কেইস করে কি হবে। ঠিকই কয়েকদিনের মধ্যে বের হয়ে যাবে। কেইস করার জন্য শক্ত প্রমাণ লাগবে, যা আমার কাছে নেই।”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি চাইলে তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।”
“কীভাবে?”
“আমি তো এখন তাজওয়ারের পিএ। ওর অনেক তথ্য আমার কাছে আছে। যদিও সরাসরি আমার হাতে নেই। কিন্তু আমি জোগাড় করতে পারবো।”
পদ্ম বলল,
“এরপর কি হবে? এসব দিয়ে কি তাজওয়ার খানকে ফাঁসানো যাবে?”
“খুব সেনসিটিভ কেইস। একবার ধরা খেলে দেশে থাকতে পারবে না। দুর্নীতি মামলায় কয়েক বছরের জেল হবে।”
আফিফ এবার মনে মনে বলল,
“এই শাস্তি তাজওয়ার খানের জন্য কিছুই না। তাজওয়ারকে এর চেয়ে ভভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে। তখনই মনকে বোঝাতে পারবো, আমার আপা ন্যায়বিচার পেয়েছে।”
(***)
পদ্ম আহিকে বাসায় নিয়ে এলো। আফিফা বেগম দরজা খুলে আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কে এই মেয়ে?”
পদ্ম বলল, “মা আমার বান্ধবী।”
আহি আফিফা বেগমকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পদ্ম আহিকে ভেতরে নিয়ে যেতেই আফিফা বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু হয়েছে?”
“মেয়েটা বিপদে পড়েছে। আজ রাতে এখানে থাকবে।”
“ওহ আচ্ছা।”
পদ্ম আহিকে নিয়ে তাদের রুমে চলে এলো। এরপর আহিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোর জন্য বিছানা করে দিচ্ছি। পাশে একটা ছোট রুম আছে। রেনু আসলে ওখানে থাকে। অনেকদিন আসে না তাই বিছানা গুটিয়ে রেখেছি। তুই এখানে বয়।”
পদ্ম চলে যেতেই আহি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। রুমে একটা খাট। পাশে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের উপর আফিফের হাতঘড়ি আর রুমাল। আহি বুঝলো এটা আফিফ আর পদ্মের বেডরুম। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে যাবে তখনই তার চোখ আটকে গেলো দেয়ালে বাঁধানো বড় ফ্রেমটিতে। আহি ধীর পায়ে সেই ফ্রেমটির দিকে এগিয়ে গেলো। তখনই রুমে আফিফ ঢুকলো। আহিকে দেখে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি এখানে?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“পদ্ম আমাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে রুম ঠিক করতে গেছে।”
আফিফ এবার দেয়ালে লাগানো ছবিটির দিকে তাকালো। আহিও আফিফের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। আহি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই আফিফ বলল,
“এটা আমার প্রথম এচিভমেন্ট। তাই দেয়ালে লাগিয়েছি। অন্য কিছু না।”
কথাটি বলেই আফিফ বের হয়ে গেলো। আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। সে ঝাপসা চোখে আবার সেই ছবিটির দিকে তাকালো। এক্সিভিশনের জন্য আফিফের আঁকা আহির সেই ছবিটি আফিফ আর পদ্মের বেডরুমের দেয়ালে ঝুলানো দেখে বেশ অবাক হয়েছিল আহি। কিন্তু খারাপ লাগছে আফিফ আর পদ্মের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে। আলনায় পাশাপাশি পদ্মের শাড়ি, উড়না আর আফিফের শার্ট ঝুলছে। এটাকেই তো সংসার বলে। তার মানুষটা সংসার করছে তার প্রিয় বান্ধবীর সাথে। আর আহি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের গোছানো সংসার দেখছে। এই দিনটিও হয়তো তার দেখার ছিল।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৩||
৮৭।
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রকৃতি নিস্তব্ধতায় মোড়া। নিরবতা ভেঙে মাঝে মাঝে মশকীদের গান ভেসে আসছে আহির কানে। মশারী টাঙানো ছোট্ট বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সে। পরিষ্কার কম্বল টেনে নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নিলো আহি। সে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। অসহ্য লাগছে তার। এবার উঠে বসলো সে। দেয়াল হাতিয়ে বাতি জ্বালালো। রুমে ছোট একটা আয়না আছে। নিজেকে সেই আয়নার সামনে দাঁড় করলো আহি। তার ঠোঁটে রক্ত জমাট বাঁধা। নিজের মুখটা দেখেই চোখে অশ্রু ভীড় করলো তার। গায়ের জামাটা পদ্মের। ঢিলেঢালা পোশাক। কিন্তু সেলোয়ার-কামিজ পরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই তার। সে এবার মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর পর চোখ ভিজে উঠছে তার। কামিজের হাতায় চোখ মুছছে। আর দরজার দিকে তার দৃষ্টি স্থির। হঠাৎ তার চোখ আটকালো খাটের পেছনে দাঁড় করানো ক্যানভাসের দিকে। আহি ক্যানভাসটি বের করে তার সামনে রাখলো। কাগজ দিয়ে মোড়ানো ক্যানভাস। আহি কাগজ সরিয়েই চমকে উঠলো। এটা তো সেই ছবি, যেই ছবি সে নদীর পাড়ে এঁকেছিল। সেই মধ্যাহ্ন বেলার আকাশ। সেই হেমন্তের রং। সে পাহাড়ের গায়ে জন্মানো ছোট ছোট ধূসর-লাল ফুল। আহি মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“আফিফের বাসায় আমার আঁকা ছবি?”
কিছুক্ষণ ভাবার পর আহির মনে পড়লো, সেদিন এই ছবিটা আঁকার পর সে সাথে করে নিয়ে আসে নি। নদীর পাড়েই ফেলে এসেছিল। কারণ ড্রাইভার এসে জানিয়েছিল তার মা সালমা ফাওজিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেদিনই আহি তার ভাইকে হারিয়েছিল। অতীত মনে পড়তেই গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। ছবিটি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আফিফ হয়তো জানতোই না, এটা আমার আঁকা ছবি। কিন্তু এতো বছর ধরে ও কতো যত্ন করে রেখেছে এই ছবিটা! পদ্ম খুব ভাগ্যবতী। এমন যত্নবান পুরুষ শুধু ভাগ্যবতীদের কপালেই থাকে। আমি তো অশুভ ছিলাম। তাই আমার ভাগ্যে আফিফ ছিল না।”
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি ক্যানভাসটি একপাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলতেই পদ্ম রুমে ঢুকলো। আহি পদ্মকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ঘুমাস নি এখনো?”
আহি মলিন মুখে বললো, “ঘুম আসছে না।”
“আমি জানি তুই এমন পরিবেশে অভ্যস্ত না।”
“মোটেও না। আমি ঠিকই অভ্যস্ত। আমার অনেক ভালো লাগছে এখানে। আসলে আমি কামিজ পরে ঘুমাই না। তাই ঘুম আসছে না। অস্বস্তি লাগছে।”
“আগেই বলতে পারতি। গেঞ্জি পরে ঘুমাস?”
“হ্যাঁ। একটু ঢিলেঢালা হলেই হবে। আছে?”
“থাকবে না কেন? দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি।”
পদ্ম কিছুক্ষণ পর ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট আহিকে দিয়ে বলল,
“এখন ঘুমিয়ে পড়। রুমে বাতি জ্বলছে দেখেই তোকে দেখতে এলাম। চিন্তা করিস না। আরাম করে ঘুমা। তোর কিচ্ছু হবে না। আর ওই তাজওয়ার খানকে তোর বিয়েই করতে হবে না। আমরা সবাই তোর পাশে আছি।”
আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরলো। আর পদ্ম আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
(***)
সকালে আহি রুম থেকে বের হয়েই আফিফের মুখোমুখি হলো। আফিফ আহিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আফিফের চাহনি দেখে আহিও ভ্রূ কুঁচকালো। তখনই পদ্ম এসে বলল,
“চল, নাস্তা খেয়ে নিবি।”
আফিফ এবার পদ্মের দিকে জিজ্ঞাসুক চোখে তাকালো। পদ্ম হালকা হেসে আহিকে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আফিফ পদ্মের কাছে এসে বলল,
“কি করলে এটা?”
পদ্ম চোখের ইশারায় আফিফকে থামিয়ে দিলো। আহি তাদের এমন ইশারায় কথা বলা দেখে বলল,
“কিছু হয়েছে?”
পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আরেহ না, তুই নাস্তা কর।”
আফিফ নিজেও আহির মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। আহি পদ্মকে জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি নাস্তা করবেন না?”
“মা নাস্তা করে ফেলেছেন। উনি তাড়াতাড়ি নাস্তা করেন। আফিফই শুধু দেরীতে করেন।”
“তুই করবি না?”
“তোরা খা।”
“তুইও বয়।”
“আমি আফিফ যাওয়ার পর নাস্তা করবো।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
আফিফ পদ্মের হাত ধরে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও।”
তখনই আফিফা বেগম ডাইনিংয়ে এলেন। পদ্ম আফিফা বেগমকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আহি অবাক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকালো। আফিফা বেগম এবার চেয়ার টেনে বসলেন। আহির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এমা তুমি এটা কি পরেছো?”
আহি ইতস্ততভাব নিয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আহি কামিজ পরে ঘুমাতে পারে না, তাই দিয়েছি।”
“তাই বলে স্বামীর জামা দিয়ে দেবে?”
আহি অবাক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা তোর না?”
পদ্ম কিছু বলবে তার আগেই আফিফা বেগম বললেন,
“পদ্মের কেন হবে? বউ মানুষরা কি এমন পোশাক-আশাক পরে?”
আহি এবার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ আপন মনে নাস্তা করছে। আশেপাশে কে কি বলছে কিছুই শুনছে না, এমন একটা ভাব নিয়েছে সে।
(***)
আহি মাথা নিচু করে নীরবে খাচ্ছে। আফিফা বেগম আহিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“পদ্ম হচ্ছে এখন বউ। বউদের অন্যভাবে চলতে হয়। তোমার যখন বিয়ে হবে, তুমিও বুঝবে।”
আহি একনজর পদ্মের দিকে তাকালো। আফিফা বেগম আবার বললেন,
“বউদের সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়। স্বামীর সাথে সকালে নাস্তা করা ভালো না। স্বামীকে খাইয়ে দিয়েই খাওয়া উচিত। আগে স্বামীর পেট ভরবে, তারপর বউয়ের। আর তোমরা যে জামা-কাপড় পরো, ওসব তো পরলে লোকে মন্দ কথা বলবে। বউদের বাইরের মানুষের সামনে মাথায় কাপড় দিতে হয়। আর স্বামী ছাড়া বাসা থেকে একা বের হওয়া উচিত না।”
আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ চুপচাপ খাচ্ছে। আহি এবার নিজেই উঠে পদ্মের হাত ধরে তাকে বসালো। তারপর পদ্মের প্লেটে একটা রুটি উঠিয়ে দিয়ে বলল,
“যেই মেয়ে সবার পরে ঘুমিয়ে সবার আগে উঠতে পারে, যেই মেয়ে স্বামীকে খাইয়ে নিজের ক্ষিধে ভুলে থাকতে পারে, যে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের স্বাধীনতা ভুলে এতোটা বাধ্য জীবন যাপন করতে পারে, তাকে রানীর মতো করে রাখতে জানতে হয়। যারা জানে না তাদের অন্তত পুরুষ বলা যায় না।”
শেষ কথাটি আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল। আফিফ আহির দিকে নির্বিণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আহি এবার আফিফা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সমাজ কি বলে, সংস্কার কি বলে জানি না। এতোটুকু জানি আইন বলে, ধর্ম বলে, অনুশাসন বলে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। এটা তার অধিকার। সকালে উঠুক তাড়াতাড়ি, সংসার করুক, এটা ওর দায়িত্ব। কিন্তু এভাবে অবহেলা করা উচিত না। ওর অধিকার আছে ওর স্বামীর সাথে এক প্লেটে খাওয়ার। আপনার ছেলে তাই এভাবে বলছেন। আপনার মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে একই কথা, আপনার সামনে আপনার মেয়েকে বললে বুঝতে পারতেন।”
আফিফা বেগম চুপ করে রইলেন। পদ্মও চুপচাপ বসে আছে। আফিফ পদ্মের হাত ধরে রেখেছে। সে পদ্মকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে দেবে না। এটাই ভালো সুযোগ, পদ্মের জীবনের কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার।
আফিফ তার মাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে। মায়ের কথা অমান্য করে না। আফিফা বেগম পদ্মকে পছন্দ করেন না। তাই তিনি নিজেই হয়তো পদ্মের জন্য বাড়তি নিয়ম যোগ করেছেন। আফিফ অনেক বার প্রতিবাদ করেছিল। ফলাফলস্বরূপ আফিফা বেগম কান্না জুড়ে দিতেন, কখনো বা দেয়ালে মাথা টুকতেন, কখনো কখনো না খেয়ে থাকতেন। ছেলের উপর অভিমান করে অনেক বার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই আফিফ মায়ের কথা ভেবেই আর প্রতিবাদ করে নি। কিন্তু আজ আহির জন্য সে সুযোগ পেয়ে গেছে। এখন মা অন্তত অভিমান করে থাকতে পারবেন না। ছেলের সাথে অভিমান করে থাকা যায়, বাইরের কারো সাথে অভিমান করে কি লাভ?
আফিফা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আচ্ছা, খাবে আর কি। এখন থেকে স্বামীর সাথেই খাবে।”
এরপর তিনি পদ্মের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“পদ্ম, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। এরপর সবজিগুলো রান্না করে ফেলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
আফিফা বেগম চলে যেতেই আহি পদ্মকে বলল,
“চুপ থাকিস কেন? কিছু বলতে পারিস না?”
আফিফ গম্ভীর সুরে বলল,
“আমার মায়ের মুখের উপর আমি নিজেই কথা বলি না। পদ্ম কেন বলবে?”
পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল, “আহি বুঝে নি।”
আফিফ আহিকে বলল,
“থ্যাংক্স, পদ্মের পক্ষ নেওয়ার জন্য। তবে আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি। আমি পদ্মকেও খুব ভালোবাসি। পদ্ম আমাকে বুঝে, তাই ও কোনো অভিযোগ করে না। মাঝে মাঝে শান্তির জন্য কিছু কথা মেনে নিতে হয়। এতে কোনো ভুল নেই। বরং বড়দের কথা মেনে নিলে, তাদের দোয়া পাওয়া যায়।”
আফিফ কথাটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। এরপর পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি বলল,
“আমার বাসায় ব্রিটিশ শাসন, আর তোর শ্বশুড়বাড়িতে পাকিস্তানি শাসন চলছে। আর তুই আমাকে আফিফের টি-শার্ট দিলি কেন?”
পদ্ম বলল, “তো কি হয়েছে?”
“যাহ, পাগল তুই? বরের জামা কি কেউ বাইরের মেয়েকে পরতে দেয়?”
“তুই আমার বান্ধবী।”
“আরেহ, বান্ধবী, বোন কাউকে দেয় না, পদ্ম। আমার বরের জামা তো আমি কোনো মেয়েকে ধরতেই দিতাম না।”
“আচ্ছা?”
“জ্বি।”
“এসবে কিছুই হয় না। আফিফ তো আমারই। উনার জামা কেউ পরুক না পরুক, উনার মনে তো আমিই আছি।”
আহি নিষ্কম্প চোখে সেকেন্ড খানিক পদ্মের দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাটা সত্য হলেও বেশ আঘাত করলো আহিকে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“তা ঠিক। তাও একটু আগলে রাখিস। বরটা তো তোরই। জিনিসপত্রগুলোতেও যেন তোর স্পর্শ থাকে।”
পদ্ম হেসে বলল,
“এসব তো জড়। আমি যতোদিন বেঁচে আছি, জীবন্ত মানুষটা তো আমারই অধিকারে। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তখন হয়তো সেই অধিকারটা হারিয়ে ফেলবো।”
“তোর কিছু কেন হবে? পাগল না-কি তুই?”
“না রে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মরে গিয়ে আফিফকে মুক্তি দিতে। উনাকে একটা সন্তান দিতে পারছি না। আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর হবে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে, আমি কখনোই মা হতে পারবো না। কোনো চিকিৎসা আমার ভাগ্যে মা হওয়ার সৌভাগ্য এনে দিতে পারবে না।”
“সন্তান নেওয়া কোনো লক্ষ্য না। একসাথে সুখে থাকা জীবনের লক্ষ্য। আফিফ তোকে ভালোবাসে, তুই আফিফকে ভালোবাসিস। আর দু’জন ভালোবাসার মানুষের জীবনে কোনো প্রতিকূলতা বাঁধা হয়ে আসে না। সন্তান দত্তক নিতে পারিস। কতো সন্তান বাবা-মার ভালোবাসা পাচ্ছে না। তাদের একটা নতুন জীবন দে। সেই সন্তান অনেক ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী হবে যার মা তুই হবি, যার বাবা আফিফ হবে।”
পদ্ম বলল,
“কিন্তু সে তো আফিফের রক্ত হবে না। ও তো চাইলে বিয়ে করে বাবা হতে পারবে।”
“কখনো না। বিয়ে করলে তোর আফিফ পাগল হয়ে যাবে। এক বউয়ের জন্য মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না, আরেক বউয়ের জন্য যাবে? দুই বউয়ের অভিমান সহ্য করার ক্ষমতা সব পুরুষের থাকে না। তাই এক নারীতেই আসক্ত হওয়া ভালো।”
পদ্ম মুচকি হাসলো। আহি পদ্মের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমি আফিফ নামক মানুষটাকে পাই নি। কিন্তু তার প্রতি অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধা আছে। তোর জায়গাটা একটা সন্তানের জন্য সে যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেয়, সেই শ্রদ্ধাটা আর থাকবে না। আমার ভালোবাসাটা মরে যাবে। কিছু ভালোবাসা শ্রদ্ধা হয়ে অন্তত বেঁচে থাকুক।”
(***)
বিকেলে আহি তৈরী হয়ে পদ্মের রুমে এসে দেখলো আফিফ ও পদ্ম ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত পার করছে। আহি তা দেখে তাড়াতাড়ি সরে গেলো। পুরো শরীর শিউরে উঠল তার। ডায়নিংয়ের চেয়ার টেনে বসে জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো। মনে মনে বলতে লাগলো,
“ওরা স্বামী-স্ত্রী। এটা একদম স্বাভাবিক। রিল্যাক্স আহি।”
অভিমানী সুরে আহি বিড়বিড় করে বলল,
“দরজাটা বন্ধ করতে পারলো না? আর আমি কি জানি বিকেলেই আফিফ বাসায় চলে আসবে? আমি ভেবেছি সন্ধ্যায় আসবে।”
আহি আবার রুমে চলে গেলো। অনেকক্ষণ পর পদ্ম আহির রুমে এলো। আহি পদ্মকে দেখে বলল,
“আমি চলে যাবো এখন।”
“তোকে না বলেছি কয়েকদিন থাকতে?”
“না, না। কি যে বলিস। বাসায় যাবো। বাবা হয়তো অনেক রেগে আছে।”
আহি টি-শার্টটা বিছানা থেকে নিয়ে পদ্মের হাতে দিয়ে বলল,
“আমি ধুয়ে দিয়েছি।”
আফিফ তখনই পদ্মকে ডাকার জন্য এলো। আর পদ্মের হাতে সেই শার্টটা দেখে বলল,
“এটা লাগবে না। তোমার কাছেই রেখে দাও।”
পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। আহি অবাক হয়ে বলল,
“না না। আমি কেন নেবো?”
“আমার বউ না বুঝে এমন বোকামি করে ফেলেছে। বরের শার্ট অন্য মেয়েকে দেয় না, এটা ওর বোঝা উচিত ছিল। এটা আমি আর পরবো না।”
আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ বলল,
“পদ্ম এক কাপ চা বানিয়ে দিও। আমার মাথা ব্যথা করছে।”
কথাটি বলেই আফিফ চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই পদ্ম আহির হাত ধরে বলল,
“উনার কথায় মন খারাপ করিস না।”
আহি হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কেন মন খারাপ করবো? উনি আমার কোনো আত্মীয় নন। তোর বর। আমার সাথে উনার কোনো সম্পর্ক নেই, তাই হয়তো উনার বিষয়টা ভালো লাগে নি। আর আমি যদি জানতাম এটা তোর না, আমি পরতামও না। কি বিশ্রী একটা কাজ করেছিস!”
পদ্ম মলিন মুখে বলল, “সরি রে।”
“বাদ দে। আমি রেখে যাচ্ছি। ইচ্ছে করলে ফেলে দিস। কতো কাজে লাগে এসব কাপড়। আমি কিন্তু ভালোভাবেই ধুয়ে দিয়েছি।”
আহি বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার আগে সে একবারও আফিফের দিকে তাকালো না। পদ্ম আফিফকে বলল,
“আহিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসুন না।”
আফিফ বের হতে যাবে তখনই আহি বলল,
“আমি একাই যেতে পারবো।”
আহি পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আর আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে আহির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৪||
৮৮।
ক্লান্ত শরীরে বাসায় পা রাখতেই মুনিয়া খালা হন্তদন্ত হয়ে আহির কাছে এলেন। আহি মুনিয়া খালার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, খালা?”
তিনি ভীত কন্ঠে বললেন,
“তুমি ঘরে কেন আইছো, মা। পালাইয়া যাও। ওদের মতলব ভালো লাগতেছে না।”
আহি কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মিসেস লাবণি দম্ভভরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে শয়তানি হাসি। আহি তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিসেস লাবণি আহির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“প্রেমিকের বাসায় রাত কাটিয়ে এসেছো?”
আহি রাগী স্বরে বলল,
“উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আপনি কি জানেন গতকাল রাতে আমার সাথে কি হয়েছিল?”
“কি আর হয়েছিল? তোমার হবু স্বামী তোমাকে একটু ভালোবাসতে চেয়েছিল, ব্যস।”
“জোর করতে চেয়েছে, ভালোবাসতে চায় নি। এটাকে ভালোবাসা বলে না।”
“তবে তোমার চোখে ভালোবাসা কি?”
এদিকে রিজওয়ান কবির আহির গলার স্বর শুনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তার চোখে মুখে ভয়ংকর রাগ। আহি বাবার রাগী চেহারা দেখে বলল,
“বাবা, আমি বিপদে পড়েছিলাম। তাই বাসায় আসতে পারি নি। রাতে পদ্মের বাসায় আশ্রয় নিতে হয়েছে।”
রিজওয়ান কবির গম্ভীরমুখে বললেন,
“এখন কেন এসেছো?”
আহি বাবার প্রশ্নে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই সে খেয়াল করলো তাজওয়ার খান সিঁড়ি বেয়ে নামছে। আহি তাজওয়ারকে বাসায় দেখে রাগী স্বরে বলল,
“এই মানুষটার জন্য আমি কাল রাতে বাসায় আসতে পারি নি।”
রিজওয়ান কবির বললেন,
“তাজওয়ার তোমার কি ক্ষতি করেছে?”
“কাল রাতে গাড়িতে ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে। আমি নিষেধ করার পরও আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল।”
রিজওয়ান কবির তাজওয়ারের দিকে তাকালেন। তাজওয়ার আহির কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“কাছে আসতে চেয়েছি। আর এর যথেষ্ট কারণ আছে। এর প্রধান কারণ এই মেয়ে আমাকে বিয়ে না করার জন্য তার বন্ধুদের সাথে মিলে আমার বিরুদ্ধে প্ল্যান করছে। আমাকে তো সে ভালোই বাসে না। কারণ তার মনে এখনো তার পুরোনো প্রেমিক।”
তাজওয়ার শেষ কথাটি বলেই আহির গাল চেপে ধরলো। আহি তাজওয়ারের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“ছাড়ো আমাকে। প্লিজ, ব্যথা লাগছে আমার।”
মুনিয়া খালা ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“স্যার ছাইড়া দেন। বুঝে নাই মাইয়াডা।”
তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে মুনিয়া খালার দিকে তাকালো। চুনি তা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো। তাজওয়ার এবার লাবণির দিকে তাকালো। ইশারায় কি যেন বললো। এরপর লাবণি মুনিয়া খালার হাত ধরে তাকে পাশের রুমে নিয়ে গেলেন। আহি তা দেখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সে বুঝতে পারলো, হয়তো আজ তার গায়ে হাত তুলবে সবাই। আহি প্রস্তুত ছিল বাবার মার খাওয়ার জন্য। এই কয়েক বছরে উল্টোপাল্টা কিছু হলেই সে বাবার চড় খেয়েছে। অনেক বছর আগে আফিফের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলায়, আহি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। তখন রিজওয়ান কবির মেয়ের পাগলামো দেখে তাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। আহি বাবার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“প্লিজ, বাবা। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি বিয়ে করবো না বলি নি। কিন্তু তাজওয়ারের সাথে স্বাভাবিক হতে আমার সময় লাগবে। আমাকে একটু তো সময় দেওয়া উচিত।”
রিজওয়ান কবির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
“তোমাকে আর কোনো সময় দেওয়া হবে না। এখন আমার দায়িত্ব তোমাকে মুক্তি দেওয়া।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”
“তাজওয়ারের সাথে তোমার বিয়ে হোক না হোক, এখন থেকে আমি তাজওয়ারকে সেই স্বাধীনতা দিচ্ছি। ও এখন থেকে তোমার সাথে যা চায়, তাই করতে পারবে।”
“তুমি বাবা হয়ে এ কথা বলছো? বাবা, ও আমার ক্ষতি করতে চায়ছে।”
এদিকে মিসেস লাবণি চুনি এবং মুনিয়া খালাকে পাশের ঘরে আটকে দিলেন। মুনিয়া খালা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। কারণ তিনি জেনে গেছেন, আজ আহির সাথে কি হতে যাচ্ছে।
(***)
আহি রিজওয়ান কবিরের সামনে হাতজোড় করে বলল,
“এভাবে বলো না, বাবা। তুমি আমার অভিভাবক। একটা মেয়ে তার বাবার কাছেই তো নিরাপদ থাকে।”
তখনই পেছন থেকে তাজওয়ার আহিকে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আজকের দিনটা আমার জন্য খুব স্পেশাল। কারণ আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে যাচ্ছি।”
আহি তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রিজওয়ান কবিরের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো। খুব ভরসা নিয়ে সে তার বাবার বাহু আঁকড়ে ধরে আছে। তার চোখ ভেজা। সে কাকুতি ভরা স্বরে বলল,
“বাবা, আমার সম্মান নষ্ট হতে দিও না, প্লিজ। তুমি কি আমাকে একটুও ভালোবাসো না?”
রিজওয়ান কবির আহির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“না, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তোমার মা, আর তোমাকে ঘৃণা করি।”
“কি বলছো এসব, বাবা?”
“হ্যাঁ। মিস্টার আফসার কবির, তোমার দাদা আমার সাথে প্রতারণা করেছিলেন। আর সেটা তোমার মায়ের জন্য হয়েছে। তোমার নানা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। তাই তো বাধ্য হয়ে তোমার মাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। এরপর তোমার দাদা, মৃত্যুর আগে সব সম্পদ তোমার মা আর তোমার নামে লিখে দিয়ে যায়। এই কাজ করে আমাকে অপমান করেছেন তিনি। আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না এই সম্পদের। কিন্তু সবার কাছে আমি ছোট হয়ে গিয়েছিলাম। মিস্টার আফসার কবির মৃত্যুর আগে তোমার মাকে বলে গিয়েছিলেন, আমার মতো শয়তানের হাত থেকে তিনি তার সম্পদ বাঁচাতে চান। আমি না-কি শয়তান। তিনি চেয়েছেন তোমার মা এই নরক থেকে সারাজীবনের জন্য মুক্তি পাক। তিনি তো জানতেন আমি কেমন? আফটার অল, বাবা-মার চেয়ে তার সন্তানদের আর কেউ ভালোভাবে চিনতে পারে না। আর আমিও তার ধারণা ভুল প্রমাণ করি নি। তিনি তো তোমার মাকে মুক্তি দিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছেন। আমার মতো শয়তানের সাথে বিয়ে দিয়ে তো বেশ অনুতপ্ত ছিলেন তিনি৷ আর আমি তার কবরের শান্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছি। তোমার মাকে তো মুক্তি দিয়েছি। তবে শারীরিক ভাবে দিলেও মানসিকভাবে দেই নি। তুমি আমার অপমানের শোধ তুলবে। তুমি আমার ইনভেস্টমেন্ট, আহি। তোমাকে তাজওয়ারের সাথে বিয়ে দিলে তোমার মা আর আমার পরলোকগত বাবার জীবনের চরম ব্যর্থতা আমাকে মানসিক শান্তি দেবে।”
রিজওয়ান কবিরের কথা শুনে আহির চোখ ভিজে উঠলো। সে বাবার হাত ধরে বলল,
“এসব মিথ্যে জেদের কারণে তুমি তোমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দেবে?”
“হ্যাঁ। তোমার মাকেই আমি আমার স্ত্রী মানি নি, তাহলে তার সন্তানকে আমি নিজের মেয়ে কেন মানবো? তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে নিজের কাছে কেন রেখেছি?”
“কেন রেখেছো?”
“তোমার মাকে মানসিক ভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।”
“তা যাই হোক, আমি তো তোমারই মেয়ে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
রিজওয়ান কবির এবার তাজওয়ারের দিকে তাকালেন। তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে জোর করে টেনে সিঁড়ি বেয়ে উঠাতে লাগলো। তাজওয়ারের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আহি রিজওয়ান কবিরের পা ধরে বসে বলল,
“বাবা, প্লিজ। তুমি আমার সাথে এমন অন্যায় করো না। আমি তোমার মেয়ে। তুমি আমাকে এভাবে কারো কাছে বিক্রি করে দিও না। আমি এই লোকটাকে বিয়ে করতে চাই না। যাকে আমি বিয়েই করবো না, সে আমাকে কেন স্পর্শ করবে? আর বিয়ে হোক না হোক, একটা মেয়ের সাথে জোরাজুরি করার অধিকার কারো নেই, তার স্বামীরও নেই।”
রিজওয়ান কবির আহির কথায় কান দিলেন না। তিনি আহিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। লাবণিও তার পিছু পিছু উপরে যেতে লাগলো। আর যাওয়ার আগে আহির দিকে তাকিয়ে তীর্যক হাসি হেসে বলল,
“তোমার চ্যালেঞ্জে তুমি হেরে গেছো।”
আহি স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির কাছে এসে তাকে পাঁজা কোলা করে তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। উঠতে উঠতেই বলল,
“কংগ্রাচুলেশনস, আজ তুমি পুরোপুরি আমার হতে যাচ্ছো। একবার আমার স্পর্শ পেলে, আর কোনো পুরুষের স্পর্শ সহ্য হবে না তোমার।”
আহি কথাটি শুনেই যেন মনে জোর ফিরে পেলো। সে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলো। তাজওয়ার তাকে টেনে উপরে এনে তারই বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। আহি উলটো দিকে ঘুরে তাজওয়ারের হিংস্র চেহারার দিকে ঘৃণাভরে তাকালো।
তাজওয়ারের ঠোঁটে বিশ্রী হাসি। সে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। তা দেখে আহির হাত মুঠো হয়ে এলো। সে নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুললো। তাজওয়ার আহিকে উঠতে দেখে তার হাত ধরে ফেললো। আর আহি তাজওয়ারের হাতে কামড় বসিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। তাজওয়ার দরজা চেপে ধরতেই আহি কাঁপা হাতে দরজাটা ভালোভাবে আটকে দিলো। তাজওয়ার জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। ওয়াশরুমের দরজা এতোটাও শক্ত না। এভাবে ধাক্কা দিতে থাকলে আজ আহির রক্ষা নেই। তাই সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কারো কাছে যে সাহায্য চায়বে, সেই উপায়ও নেই। আহি ক্লান্ত হয়ে ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে পড়লো৷ তাজওয়ার এবার আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। এবার দরজার লকটা আলগা হয়ে যাচ্ছে। আহি মুখে হাত চেপে কাঁদছে। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে তার। তার আপন বাবা তার সাথে এতো বড় ছল করেছে? তিনি একবারও নিজের মেয়ের সম্মানের কথা ভাবলেন না? এমন জঘন্য মানুষকে সে এতোদিন বাবা বলে ডেকেছে, ভাবতেই তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
আহি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। সে দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমি চ্যালেঞ্জে হারবো না। আমি মরে যাবো, তবুও ধর্ষিতা হবো না। আহি এতোটাও ফেলনা নই যে কেউ এসে আমাকে স্পর্শ করে দিয়ে যাবে। এটা আমার সম্মান, আমার শরীর। এখানে শুধু আমার অধিকার। তাই আমি আমার সাথে যা ইচ্ছে করবো, কিন্তু অন্যদের সেই সুযোগ দেবো না।”
আহি এবার এদিক-ওদিক তাকালো। দেয়ালের সাথে লাগানো তাকের উপর হাত হাতড়ে একটা ব্লেড খুঁজে পেলো। ব্লেডটা সে কিছুদিন আগেই সুতা কাঁটার জন্য রেখেছিল। ব্লেডটা হাতে নিয়েই সে চোখ বন্ধ করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে হাতের উপর চালালো। একবার নয়, দুইবার নয়, চার-পাঁচবার হাতের উপর ব্লেড চালালো সে। ততোক্ষণে তাজওয়ার দরজা ভেঙে ফেলেছে। সে ভেতরে ঢুকে আহির হাতে রক্ত দেখে তব্ধা খেয়ে গেলো। সেকেন্ড খানিক সে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল। আহি তাজওয়ারের কাছে এসে তার বুক পকেটে ব্লেডটা ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তোমার হিংস্র মন কি মৃত মানুষকে ছাড় দেয়?”
তাজওয়ার আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি করলে তুমি এটা?”
“তোমাকে হারিয়ে জিতে গেছি। আজ যদি আমি বেঁচে ফিরি, আল্লাহর কসম তোমাদের সবাইকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।”
তাজওয়ার আহিকে কোলে নিয়ে দ্রুত পদে নিচে নেমে এলো। তাজওয়ারের চেঁচামেচি শুনে মিসেস লাবণি ও রিজওয়ান কবির রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তারা বেরিয়েই দেখলেন মেঝেতে রক্ত। আহির হাত থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে মেঝেতে পড়ছে, আর মেঝে লাল হয়ে যাচ্ছে। আহির এখনো জ্ঞান আছে। কিন্তু বেশ ঘুম পাচ্ছে তার। নিভু নিভু দৃষ্টিতে সে আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“সরি, হয়তো মৃত্যুর পর আমার জন্য অনেক বড় শাস্তি লিখে রেখেছো তুমি। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাকে একটু যদি সাহায্য করতে তুমি! কতোবার তোমার কাছে কেঁদে কেঁদে চেয়েছি, মুক্তি দাও। মুক্তি দাও। তবে এটাই কি আমার জীবনের মুক্তি ছিল?”
চলবে-