#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০(১ম ভাগ)||
৭৯।
আফিফকে রুম থেকে বের হতে দেখে আহি তার কাছে এসে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো অসুস্থ। তোমার এক্স-রে করা হয় নি এখনো।”
আফিফ সেকেন্ড খানিক আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”
আহি অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। রাদও সেই সময় বেরিয়ে এলো। সে আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“একা যেতে পারবেন? আমি আপনাকে গাড়ি ঠিক করে দেই?”
আফিফ বলল,
“না, এর প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারবো।”
আহি বলল,
“রাদ যাক না হয়। আর তুমি পদ্মকে কি বলবে? ও যদি তোমার মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে?”
আফিফ ক্ষীণ হেসে বলল,
“পদ্ম আমার ওয়াইফ। দেখি কি বলতে পারি।”
আফিফের খাপছাড়া উত্তর আর শীতল ব্যবহার আহির মনে আঘাত করলো। আহি মনে মনে ভাবলো,
“কি করলাম আমি? হঠাৎ আফিফ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন আমার সাথে?”
এদিকে সালমা ফাওজিয়া রুম থেকে বের হতেই আফিফ তাকে সালাম দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আন্টি, আমাকে সাহায্য করার জন্য। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। ভুল কিছু করলে ক্ষমা করবেন।”
সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“ধন্যবাদ দিতে হবে না। আর এখানে কষ্টের কি হলো? আহি যেমন, পদ্মও আমার কাছে তেমনই। আর পদ্মের স্বামী তো আমার মেয়ের জামাই হলো, তাই না।”
সালমা ফাওজিয়া খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বললেন। কিন্তু এই একটি বাক্যে আহির বুকটা কেঁপে উঠলো। সে আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আফিফ সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।
(***)
উত্তরের মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর কাঁপছে আফিফের। কিন্তু সে উদ্দেশ্যহীন পথে হেঁটে যাচ্ছে। মনটা ভারী হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে সব হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। অনেক কিছুই তো ছুটে গেছে। বাধ্য হয়েই অনেক স্বপ্ন অতীতের পাতায় ফেলে আসতে হয়েছে। বর্তমানের জন্যই অনেক মানুষকে জোর করে স্মৃতি থেকে বের করে ফেলতে হয়েছে। আজ যদি অন্য কারো ভালোর জন্য আফিফকে কিছু করতে হয়, তাহলে সে অবশ্যই করবে।
ঘন্টাখানেক আগেই রাদ আর আফিফের কথোপকথন হয়েছিল। কিছু জমানো কথা আফিফ অনেক বছর পর কারো সাথে ভাগ করে নিতে পেরেছে। এতো বছর ধরে চয়নের মৃত্যুর মূল কারণটা সে একাই নিজের মনে দাফন করে রেখেছিল। তাজওয়ার খানকে সামনে পেয়েও সে কিছু করতে পারে নি। কারণ তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই, আর তার বোন রেনুর জীবনটা সে এসব জটের মধ্যে ফেলতে চায় না। যে চলে গেছে তার জন্য, যে আছে তার কথা ভুলে যেতে পারবে না আফিফ। কিন্তু আজ তাকে কেউ আবদার করেছে, তার জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আফিফের সাধ্যের বাইরে কিছু চায় নি মানুষটা। তাহলে তো সে মানুষটির এতোটুকু ইচ্ছে পূরণ করতেই পারে।
শূণ্য রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই আফিফের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রাদের মলিন মুখটি ভেসে এলো চোখের সামনে। রাদ ঘন্টা খানেক আগে তার হাত ধরে বলেছিল,
“আপনি আহিকে পছন্দ করতেন, আপনার ওর প্রতি একটুও আগ্রহ ছিল, এই কথা যাতে ও কোনোদিনই জানতে না পারে। আর তাজওয়ার আহির জন্য আপনার বোনের ক্ষতি করেছে, এটা যদি আহি জানতে পারে, তাহলে ও আরো ভেঙে পড়বে। হয়তো আপনার কেউ একজন আছে, যাকে আপনি আগলে রাখতে পারছেন। আহি নেই তো কি হয়েছে, আপনি পদ্মকে পেয়েছেন। দিনশেষে আপনি হারেন নি। হেরেছে আহি। সে তো আপনাকে পায় নি। আর এখন, আমি হেরে যাচ্ছি। কারণ আহি আপনাকে ভুলতে পারে নি। আপনি আমাকে শুধু একটা সাহায্য করুন। মাস্টার্স শেষ না হওয়া অব্ধি আপনি আহির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবেন না। যদি পরিস্থিতি এমন হয়, আপনাকে আহির মুখোমুখি হতে হয়েছে, আপনি অবশ্যই ওকে ইগনোর করবেন। কষ্ট দিবেন। যেভাবে পারেন, ওকে বোঝাবেন, আহি কোনোদিনই আপনার কাছে স্পেশাল ছিল না। আমি জানি, আপনি এমন কিছু করলে আহি কষ্ট পাবে। কিন্তু ও আপনাকে অন্তত ভুলে যাক। যদি আপনার উপেক্ষা পেয়ে, আহি আপনাকে ভুলতে পারে, তাহলে আপনার সেটাই করা উচিত। আমি আহিকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি আহির মনে সেই জায়গাটা নিতে চাই, যেই জায়গাটা সে আপনাকে দিয়েছিল। আমি আপনার মতো আহিকে ছেড়ে যাবো না। আমি ওকে খুব ভালোবাসবো। যেই ভালোবাসা আহি ডিজার্ভ করে, এর চেয়ে বেশি ভালোবাসবো।”
আফিফ প্রতিত্তোরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়েছিলো শুধু। উপেক্ষা শব্দটা সেই মুহূর্তে এতো ভারী কেন মনে হয়েছিল, আফিফ নিজেও জানে না। আর সেই উপেক্ষার প্রয়োগে আহির সেই শুকনো মুখের গভীর চাহনি আফিফকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে, এটাও সে বুঝতে পারছে না। আফিফ হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে বসে পড়লো। মিনিট খানিক পর ফোন হাতে নিয়ে পদ্মকে কল করলো। পদ্ম কল ধরতেই আফিফ বলল,
“পদ্মফুল, ভালোবাসি।”
পদ্ম অবাক কন্ঠে বলল, “হঠাৎ!”
“এমনিতেই।”
পদ্ম হেসে বলল,
“নিশ্চয় কোনো মেয়ে আমার স্বামীকে আকর্ষণ করতে চায়ছে, তাই তিনি আমাকে ভালোবাসি বলে নিজেকে বোঝাচ্ছেন, আমার একটা পদ্মফুল আছে, তাই না?”
আফিফ হাসলো। বলল,
“তুমি থাকতে, আমাকে আর কেউ আকর্ষণ করতে পারবে না।”
“আর যদি আমি না থাকি?”
“তুমি কোথায় যাচ্ছো!”
“যদি কোথাও চলে যাই?”
“আমাকে ফেলে চলে যাবে?”
“এমন কোথাও, যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। আর গেলে একাই যেতে হয়!”
“এভাবে বলছো কেন, পদ্ম?”
“এমন হলে!”
“এসব কথা রাখো। আমি আসছি বাসায়। আমার অপেক্ষায় থেকো।”
(***)
আহি মলিন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আফিফের হুট করে এমন শীতল ব্যবহার আহিকে অস্থির করে তুলছে। রাদ আহির পাশে এসে দাঁড়াতেই আহি চমকে উঠলো। আহি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“তুই আমাকে কি যেন বলবি বলেছিস!”
রাদ মনে মনে বলল,
“বলবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার অন্তত আফিফের যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আফিফ বলেছে, মাস্টার্স শেষ করেই সে তোর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। তুই আর কখনোই ওকে খুঁজে পাবি না। আর যেদিন সত্যিই আফিফ হারিয়ে যাবে, আমি সেদিনই তোকে আমার মনের কথা জানাবো। অন্তত সেই মুহূর্তে আমার ভালোবাসা যাতে তোর কাছে বোঝা মনে না হয়।”
আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“তেমন কিছু না। আমার একমাত্র বান্ধবীর জন্য তাজওয়ার খানকে আমার উপযুক্ত মনে হচ্ছে না, তাই চিন্তায় ছিলাম।”
“তো এখন কি চিন্তা শেষ?”
“না। এখন ভাবছি চিন্তা না করে কিছু একটা করবো।”
“কি করবি?”
“তাজওয়ারকে একটা গণপিটুনি খাওয়াতে পারলে ভালো হতো।”
“এতো সাহস!”
“শোন না। আইডিয়া আছে একটা। মনটা শান্তি হবে।”
“কি আইডয়া?”
“কয়েক মাস পর তো ইলেকশন। এখন তো মিছিল-মিটিং কম হচ্ছে না। এমন একটা মিছিলে তাজওয়ারকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসবো। ব্যস, এরপর একটা মারামারি লাগিয়ে দেবো। মার-টার খেয়ে একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।”
আহি হাসলো। রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসছিস কেন?”
“তুই কি ভেবেছিস, তাজওয়ার তোর মতো বিন্দাস ঘুরে? ওর আগে-পিছে কিছু নাগ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ মারতে আসলেই সেই নাগগুলো দংশন করে দেবে।”
হঠাৎ সালমা ফাওজিয়া বারান্দায় এসে বললেন,
“আহি তোমার ফোনে লাবণির কল আসছে।”
আহি বিরক্ত মুখে ফোন হাতে নিয়ে বলল,
“বললাম আজকে পুষ্পের বাসায় থাকবো, তবুও শান্তি দিচ্ছে না।”
আহি কল রিসিভ করতেই লাবণি অস্থির কন্ঠে বলল,
“কোথায় তুমি? নিউজ দেখেছো?”
“কেন আপনাকে দেখাচ্ছে নিউজে?”
“তোমার ফিয়োন্সেকে দেখাচ্ছে।”
“তাজওয়ার!”
“এক্সিডেন্ট হয়েছে তাজওয়ারের। গাড়ি খাদে পড়ে আগুন ধরে গেছে।”
আহি মুখে হাত চেপে রাদের হাত ঝাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তাজওয়ার শেষ।”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”
“মানে তাজওয়ার মারা গেছে।”
রাদ খুশি হয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”
আহি এক গাল হেসে ফোন কানের কাছে আনতেই লাবণি বলল,
“হ্যালো, আহি। শুনছো?”
“হ্যাঁ, শুনে খারাপ লাগলো। দাফন কখন হবে?”
“ওর দাফনে যাবে তুমি? লাশই তো পুড়ে গেছে। ওটা বাদ দাও। তাজওয়ারকে একবার দেখে এসো।”
“পুড়ে যাওয়া লাশ দেখতে দেয়?”
“কি, বলছো এসব? তাজওয়ার কেন পুড়ে যাবে?”
“এই মাত্রই তো বললেন আপনি।”
“আমি তাজওয়ারের বন্ধু অর্ণবের কথা বলছি। তাজওয়ার তো হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরেছে ওর। হালকা ব্যথা পেয়েছে।”
আহি হাঁ করে রাদের দিকে তাকালো। রাদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আবার কি!”
আহি লাবণিকে বলল, “আচ্ছা, আমি আসছি।”
আহি কল কাটতেই রাদ বলল,
“তুই বেঁচে গেলি, আহি।”
“জ্বি না, তাজওয়ার বেঁচে গেছে। একটু আগে আমার কল্পনায় মারা গিয়েছিল।”
“মানে?”
“মানে কি! এক্সিডেন্টে ওর বন্ধু মারা গেছে, আর ওর তো কৈ মাছের প্রাণ।”
“কীভাবে ভাই?”
সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আহি এভাবে বলে না। যার হায়াত যতোটুকু, আল্লাহ এসব নির্ধারণ করে রেখেছেন। কারো মৃত্যু কামনা করা উচিত না। তার হেদায়েতের জন্য দোয়া করা যায়।”
আহি বলল,
“তাজওয়ার যেদিন হেদায়েত পাবে, সেদিন পৃথিবীর অর্ধেক পাপ কমে যাবে।”
এদিকে আহি রিজওয়ান কবিরের জোরাজুরিতে রাতে হাসপাতালে এলো তাজওয়ারকে দেখতে৷ তাজওয়ারের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছে, সে এখনো বেঁচে আছে কীভাবে? আর তার চোখ-মুখের উজ্জ্বল চাহনি দেখে আহির সন্দেহ হচ্ছে, এই ছেলের কি আদৌ এক্সিডেন্ট হয়েছে? তাজওয়ারকে দেখতে কেমন ফুরফুরে লাগছে! এক্সিডেন্ট করে মানুষের চেহারায় এতো সতেজতা আসে, তা তাজওয়ারকে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতো না আহি।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪০(২য় ভাগ)||
৮০।
লিনাশাকে দেখে মিসেস লাবণি বাকরুদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। আহি লাবণির সামনে এসে বলল,
“মাম্মা, কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? খালামণিকে বাসায় নিয়ে এসেছি।”
লিনাশা বুকে হাত গুঁজে লাবণির সামনে এসে দাঁড়ালো আর বলল,
“আপু, কেমন আছো?”
লাবণি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “তুই এখানে?”
“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“বিশ্বাস তো হচ্ছে না। নিশ্চয় এখানে আসার কোনো কারণ আছে।”
লিনাশা হাসলো। আহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই দু’জনে জোরে করতল স্পর্শ করে হাসলো। লাবণি বলল,
“ষড়যন্ত্র করছো তোমরা?”
আহি বলল,
“আরেহ, মাম্মা। খালামণি বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছে। আর সে প্রথম বার বোনের শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে, আর তুমি এমন রিয়েক্ট করছো?”
“কি মাম্মা, মাম্মা লাগিয়ে রেখেছো?”
“কেন আপনিই তো নিজেকে নিজের বয়সের চার বছরের ছোট একজনকে মেয়ে বলে দাবি করেন। ভাবতেই অবাক লাগছে আপনার যখন চার বছর বয়স তখনই আপনি মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।”
লিনাশা মুচকি হেসে বলল,
“আপু, তুমি এখনো যথেষ্ট স্মার্ট রয়ে গেছো। দুলাভাইয়ের সাথে বাইরে বের হলে নিজেকে কি বলে পরিচয় দাও?”
লাবণি চোখ পাকিয়ে বলল,
“রিজওয়ান আমার স্বামী।”
“আই নৌ। বাই দা ওয়ে, আমার হবু বরটা যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। তুমি ছবি দেখবে?”
লিনাশা ফোন বের করে নায়ীবের ছবি দেখালো। লাবণি ভ্রূ কুঁচকে লিনাশার ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি বলল,
“লিনু, তোর বিয়েতে তো সেই মজা করবো। এনগেজমেন্ট, হলুদ, মেহেদি, আক্দ, এরপর একটা গার্লস পার্টি, তারপর বিয়ে। আফটার অল বিয়ে নিয়ে সব মেয়েদেরই স্বপ্ন এমন থাকে।”
লিনাশা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, সবই হবে। ধুমধাম করে বিয়ে করবো আমি।”
লিনাশা এবার লাবণির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপু তোমারও তো সেই স্বপ্ন ছিল!”
লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আয়োজন করে বিয়ে হয় নি তো কি হয়েছে? চট্টগ্রামের নামকরা ব্যবসায়ীর স্ত্রী আমি। আমি চাইলে এর চেয়ে বেশি আয়োজন করে বিয়ে করতে পারি।”
আহি শব্দ করে হেসে উঠলো। লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, দিস ইজ নট ফেয়া’র। এভাবে হাসছিস কেন? আপু চাইলে দুলাভাইয়ের সাথে আবার বিয়ে করতে পারে। সমস্যা তো অন্যদিকে। দুলাভাইকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ কন্ট্রোভার্সি হবে। আর আপুকে শুনতে হবে সুগা…”
আহি লিনাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“খালামণি, দিস ইজ নট ফেয়া’র। ভালোবাসা কি বয়স মানে, বলো?”
“রাইট আহি, ভালোবাসা বয়স মানে না। কিন্তু লোকে বলে এসব ভালোবাসা নয়। এসব….টেকা”
এরপর লিনাশা গানের সুরে বলল,
“টেকা ও পাখি তুমি উইড়া উইড়া আসো,
উইড়া উইড়া আইস্সা তুমি আমার ডালে বসো।”
লাবণি চেঁচিয়ে বলল, “জাস্ট শাট আপ।”
লিনাশা আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,
“ওপস, ভয় পেয়েছি। কি হবে এখন আমার? গণপিটুনি দিয়ে আমাকে উপরে পাঠিয়ে দেবে?”
আহি বলল,
“থাম না লিনু, বাদ দে। টাকা কি শুধু বয়ষ্ক শিল্পপতির কাছেই থাকে? আমাকে দেখ। তাজওয়ার খান আমার ফিয়োন্সে। সে খানস গ্রুপের এমডি প্লাস হ্যান্ডসাম, ড্যাসিং, আর খুব রিচ। সে তো উল্টো আমার প্রেমে ডুবে মরছে। বিয়ের পর না-কি তার কোম্পানির অর্ধেক শেয়ার আমার নামে লিখে দেওয়া হবে। আমেরিকাতে বাড়ি কিনছে আমার জন্য। কষ্ট করে আর বুড়ো শিল্পপতির দিকে নজর দেওয়ার কি দরকার বল? আমি তো উলটো বিয়েই করতে চাচ্ছি না। কিন্তু বাবা আর বাবার মিসেস তো আমাকে জোর করেই বিয়ে দিচ্ছে। ভালোই হলো, তাজওয়ার আমাকে রানীর মতো করে রাখবে। আর সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, মিসেস লাবণি আমার সৎ মা হয়েও আমার জন্য একটা ইয়াং রাজা খুঁজে এনেছে।”
লিনাশা আহির হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,
“আপুর মন একটু বেশিই বড়। আমি আপুর জায়গায় হলে রিজওয়ান কবিরকে নয়, তাজওয়ার খানের মতোই একটা রিচ ছেলেকে খুঁজে নিতাম।”
আহি বলল,
“আরেহ কি যে বলিস! এটা তো ভালোবাসা। ভালোবাসা তো বয়স মানে না।”
আহি লিনাশাকে নিজের রুমে এনে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর দু’জনই গলা জড়িয়ে লাফাতে লাগলো। আহি লিনাশাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“মাম্মা, তো জ্বলে-পুড়ে ছাই ছাই হয়ে যাচ্ছে।”
লিনাশা হেসে বলল,
“এবার যদি মিসেস লাবণি একটু নড়েচড়ে বসে!”
“যদি বসে, সেদিন ব্রেকিং নিউজ আসবে। নিজের স্বামীকে তালাক দিয়ে, সৎ মেয়ের ফিয়োন্সেকে বিয়ে করে নিলো এক লোভী মহিলা। দুইটা আপদ থেকে মুক্ত হলো মিস ওয়াসিকা কবির আহি।”
“হিপ হিপ হুররে।”
“সিরিয়াসলি লিনু, কাল হুট করে আমার মাথায় এই উদ্ভট বুদ্ধিটা কীভাবে যে এলো! যদিও খুব খারাপ বুদ্ধি। কিন্তু এদের নিয়ে ভালো কোনো চিন্তায় আমার মাথায় আসে না। এরা সবাই স্বার্থপর। এবার আমি একটু স্বার্থপর হয়ে নিজেকে বাঁচাই। আর ওই তাজওয়ার খান এখনো আমার স্বামী হয় নি। এর আগেই যদি একটা সেট আপ করতে পারি, তাহলে আমি আমার বাবাকে ফিরে পাবো। আর ওই তাজওয়ার খানকেও আর বিয়ে করতে হবে না।”
“ইনশাআল্লাহ তোর ইচ্ছেটা যাতে পূরণ হয়। চিন্তা করিস না। আমি তোর পাশে আছি। ওই তাজওয়ারকে আমি আমার দুলাভাই বানাবো না। আমার দুলাভাই হবে সুইট।”
আহি হাসলো। বলল,
“দুলাভাই টুলাভাই হবে না। আমার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। মায়ের কাছে যেতে পারলে, আমি মায়ের সাথেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো।”
“বিয়ে না করে থাকা যায় না। বিয়ে তো সমাজেরই একটা নিয়ম। সমাজে থাকলে বিয়ে করতেই হবে। তোর কোনো পছন্দ নেই?”
আহি মলিন হাসলো আর বলল,
“আপতত তো নেই।”
লিনাশা আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি খুঁজে এনে দেবো। দেখিস, রাজকুমার আসবে আমার টুনুমুনুর জন্য।”
আহি চোখ বড় বড় করে বলল, “টুনুমুনু!”
“মনে আছে, আমাদের কলেজের আমিনা ম্যাম তোকে টুনুমুনু বলে ডাকতো! কিছুদিন আগে ম্যামের সাথে দেখা হয়েছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। আরো বলছিলো, উনার ছেলে না-কি বেশ নামকরা উকিল। বউ খুঁজছে ছেলের জন্য।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমিনা ম্যাম? পুষ্পের চাচী?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। উনিই। পুষ্পের কথাও জিজ্ঞেস করলো।”
“উনার ছেলেই হয়তো উজ্জ্বল। উজ্জ্বল পুষ্পের কাজিন। উনিই আমাকে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছেন। উনার কারণেই আমার কনফিডেন্স বেড়েছে।”
“তাই না-কি! ছেলেটা দেখতে কেমন রে?”
“আছে, ঠিকঠাক।”
“হুম হুম, তোর সাথে মানাবে তো?”
“লিনু, প্লিজ। আমি ওভাবে চিন্তা করি নি।”
“রাদকে নিয়ে কি চিন্তা করিস?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এখানে রাদ এলো কেন?”
“নায়ীব বললো, রাদ বেশ কেয়ার করে তোর।”
“রাদ আমার বন্ধু। শুধু বন্ধু না, খুব ভালো বন্ধু।”
“বন্ধুত্বে কি প্রেম হয় না? জ্ঞানী-গুণীদের মতে ছেলে-মেয়ে শুধু বন্ধু থাকতে পারে না। তারা প্রেমে পড়েই।”
“আমি তো পড়ি নি।”
“তোর মাথাটা ঘেঁটে আগের স্মৃতিগুলো বের করতে হবে। দেখিস, তারপর প্রেমে পড়বি।”
“না রে, প্রেমে আর পড়তে চাই না। এবার যদি কিছু হয় দায়িত্ববোধ থেকেই হোক। অনেকে তো দায়িত্ব নিয়েই মায়ায় জড়ায়। কিন্তু প্রেম বড্ড খারাপ রোগ। একবার প্রেমে পড়লে অনেক কষ্ট পেতে হয়। মানুষটার দেওয়া সব আঘাত মনে হয় পাহাড়ের চেয়েও ভারী, সমুদ্রের চেয়েও গভীর, পাথরের চেয়েও শক্ত। প্রেমে আর পড়তে চাই না। এবার কেউ অধিকার বোধ নিয়েই হাত এগিয়ে দিক। অন্তত প্রেম না থাকলেও বলতে পারবো, মানুষটা আমার। আমার মানুষ, আমার স্বামী, আমার বলতে যেই শান্তিটা অন্যদের পেতে দেখেছি, শুধু সেই শান্তিটা অনুভব করতে চাই। নয়তো দেখা যাবে, আবার প্রেমে পড়েছি, আর মানুষটা হাত ছেড়ে দিলো। সে অন্যের হাত ধরে সুখী হলো, আর আমি আবার সেই অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম।”
লিনাশা আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনমিনিয়ে বললো,
“আমার জীবনে আর কেউ প্রেম হয়ে না আসুক।”
(***)
পলি আপু আজ অনেক বছর পর একত্র হয়েছে। চারজনের চেঁচামেচিতে একপাশে চুপচাপ বসে আছে নায়ীব, রাদ, লাবীব আর আফিফ। আলাদা টেবিলে বসেছে তারা। লিনাশা, আহি, পদ্ম আর পুষ্প নিজেদের সাথে তাদের বসতে দেয় নি। পদ্মের শাশুড়ি আফিফা বেগম পুত্রবধূকে একা বের হতে দেওয়া পছন্দ করেন না। তিনি বেশ রক্ষণশীল মানুষ। তাই আফিফকে বাধ্য হয়ে পদ্মকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসতে হলো। এদিকে আফিফ আসবে শুনে লিনাশা নায়ীবকে সাথে নিয়ে এসেছে। আর পুষ্প তো লাবীবকে ছাড়া কোথাও যায় না। আর লাবীব আর আহি যেখানে যাচ্ছে রাদ তো যাবেই।
মোটামুটি হট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে চার বান্ধবী। পুষ্পের চঞ্চল স্বভাবটা তার হাঁটা-চলায় দৃশ্যমান। কিন্তু পদ্মকে এমন উচ্চস্বরে হাসতে দেখে আফিফ রীতিমতো ঘুরেফিরে দেখছে। তবে এসবের মধ্যে আহিকে অনেকটা শান্ত দেখাচ্ছে। বরাবরের মতোই তার চঞ্চলতা থামিয়ে দেওয়ার জন্য আফিফের এক দর্শনই যথেষ্ট ছিল। নায়ীবও আজ সামনা-সামনি তার রোগীকে আক্রমণ করা ভাইরাসটিকে আবিষ্কার করলো। সে একবার রাদের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার আফিফের দিকে। নায়ীবের এবার বেশ অস্বস্থি লাগছে। তার আশেপাশে এতো এতো মানসিক রোগী যে তার এই মুহূর্তে নিজেকেই রোগী মনে হচ্ছে। আফিফের চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ মানসিক চাপে আছে, রাদের চোখেমুখেও উদ্বেগ। একমাত্র লাবীবকে দেখেই দু’দণ্ড কথা বলার ইচ্ছে জাগলো নায়ীবের। কিন্তু লাবীব একটু বেশিই ফুরফুরে মেজাজে আছে। সে ব্যস্ত ফোনে গেইমস খেলায়। তা দেখে কৌতুহল নিয়ে নায়ীব রাদকে জিজ্ঞেস করল,
“রাদ, তুমিও কি ফোনে গেইমস খেলো?”
রাদ অবাক হয়ে নায়ীবের দিকে তাকালো। লাবীব নায়ীবের প্রশ্নে ফোন বন্ধ করে একপাশে রেখে দিলো। তার মনে হলো, নায়ীব তাকে খোঁচা মেরে বলেছে। কারণ রাদের কাছেই শুনেছে, নায়ীব একজন ডাক্তার। লাবীবের মনে হয়, ডাক্তাররা বেশিক্ষণ ফোন চালানো পছন্দ করে না। কারণ লাবীবের বাবাও একজন ডাক্তার। তিনি যখনই ঘরে আসেন, লাবীবকে ফোন না চালিয়ে বাইরে ঘুরে আসতে বলেন। লাবীবের কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে বাবার সামনে বসে আছে। সে মনে মনে বলল,
“আমাকে এ কোন গম্ভীর গোল টেবিল বৈঠকে বসিয়ে দিয়েছে, পুষ্প। মনে হচ্ছে আংকেলদের ভীড়ে বসে আছি। বেশি দেরী হলে হয়তো এখানেই ঘুমিয়ে যাবো।”
এদিকে নায়ীব রাদের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। রাদ লাবীবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আমিও খেলি।”
নায়ীব এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি খেলেন?”
আফিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “না!”
নায়ীব লাবীবকে ইঙ্গিত করে বলল,
“ওকে দেখে মনে হলো, বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। আর আমার দু’পাশে বসা বাকি দুই জন বেশ গম্ভীর। তাই জানার ইচ্ছে হলো, শুধু ফুরফুরে মেজাজের মানুষগুলো গেইমস খেলে না-কি গম্ভীর মানুষেরাও খেলে। রাদ যখন বললো, খেলে। তখনই বুঝলাম, গেইমস খেলা না খেলা নিয়ে কারো মনের অবস্থা বোঝা যায় না।”
আফিফ আর রাদ এবার স্বাভাবিক হয়ে বসলো। নায়ীব তা দেখে মুচকি হাসলো। আফিফ পরিচয় পর্ব দিয়েই কথাবার্তা শুরু করল। এবার রাদ আর লাবীব হাঁ করে অপর দুই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ আর নায়ীব বেশ জমিয়ে কথাবার্তা বলছে। পদ্ম সেটা খেয়াল করে বলল,
“আমাদের মতো ওদের মধ্যেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।”
লিনাশা এক বার আফিফের দিকে তাকালো। আরেকবার নায়ীবের দিকে। বেশ রাগ উঠলো তার। ইচ্ছে করছিলো নায়ীবের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিতে, আর আফিফের ঠোঁটে আলতারাপ লাগিয়ে দিয়ে বলতে,
“আমার বান্ধবীকে কাঁদিয়েছিস, খচ্চর পোলা। এখন আমার হবু বরের সাথে ভাব জমাচ্ছিস? তুই কখনো আমার বরের বন্ধু হতে পারবি না। শুধু আহির বরই আমার বরের বন্ধু হবে। ইচ্ছে তো করছে স্টেপলার দিয়ে মুখটা একদম বন্ধ করে দিতে।”
আহি লিনাশার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,
“মনে মনে কাকে গালি দিচ্ছিস?”
“তুই কীভাবে বুঝলি?”
“বাক্য উচ্চারণ না করলেও তোর এক্সপ্রেশন দেখলে যে কেউ বুঝবে।”
লিনাশা হেসে বলল,
“আমার মায়ের প্রথম সন্তানের বোনের দুলাভাইয়ের প্রাক্তন শাশুড়ির ছেলের বোনের মেয়ের জন্য দোয়া করছি, যাতে খারাপ দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায়।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে লিনাশার প্যাঁচানো সম্পর্কটা মেলানোর চেষ্টা করছে। যদিও আহি বুঝতে পেরেছে, মেয়েটা আহি নিজেই। কিন্তু সম্পর্কের সূত্রটা মেলানোর আগ্রহ দমাতে পারলো না সে। বেশ আগ্রহ নিয়েই সে সম্পর্ক মেলাচ্ছে। এর মধ্যে পদ্ম আর পুষ্পও যোগ দিয়েছে।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪১||
৮১।
ভাংচুরের শব্দে আহির ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে বিকেল তিনটা। দুপুরে নামাজ পড়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল সে। বেশিক্ষণ ঘুমোতেই পারলো না। মেঝেতে পা রাখতেই ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো।
“আল্লাহ গো, ও আল্লাহ গো,” বলতে বলতে চুনি আহির রুমের কাছে দৌঁড়ে এলো। আহির বুক কেঁপে উঠলো। সে দ্রুত দরজা খুলে দিতেই চুনি এসে আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি চুনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? এমন করছো কেন?”
“আফা, বাঁচান স্যার রে। খুন কইরা ফেলবো তারা। দুই জনের মাথায় গরম হইয়া আছে।”
আহি চুনিকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “নিচে হচ্ছেটা কি?”
চুনি কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তাজওয়ার ভাইজান আর স্যারের মধ্যে মারামারি লাগছে। ম্যাডাম, ইস, কি বিচ্ছিরি কামডাই না কইরলো। স্যারের মাথাটা গরম হইয়া আছে। তাজওয়ার ভাইজান রে মারতাছে। আর ভাইজান কি কম? হে-ও স্যারের মাথা ফাটাইয়া দিছে। রক্ত বাইর হইতাছে। তবুও কেউ কাউরে ছাড়ে না। আম্মাও ঘরে নাই। বাজার করতে গেছে চাচার লগে। ঘরে কেউ নাই, আফা। আমার ভয় করতাছে।”
আহি শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি আমার রুমে বসে থাকো। কিছু হবে না। এদের কাজই মারামারি করা। এরা কি আমাদের মতো ভালো? সবগুলোই হিংস্র পশু।”
আহি চুনিকে নিজের ঘরে রেখে নিচে নামতেই দেখলো মিসেস লাবণি অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। এলোমেলো চুল, শার্টের বোতামগুলোও খোলা। ভেতরের গেঞ্জিতে রক্তের দাগ। আহি নিচে নেমে মিসেস লাবণিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“কি হয়েছে? শার্ট-প্যান্ট পরে ইফতারের আগে কোথায় যাচ্ছিলেন? আর আপনার এমন অবস্থা কি করে হলো?”
লাবণির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে আহির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। কারণ শব্দগুলো ওই রুম থেকেই আসছিল। আহি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখলো তাজওয়ার আর তার বাবা দু’জন দুই সোফায় বসে আছে। তাজওয়ারের হাতে টিস্যু। সে নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত পরিষ্কার করছে। এদিকে তার বাবা রিজওয়ান কবিরের কপাল ফুলে গেছে। গালটাও লাল হয়ে আছে। আহি খুব শান্ত ভঙ্গিতে মাঝখানের সোফায় গিয়ে বসলো। তাজওয়ার আহির দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আহি বুঝতে পারছে তাজওয়ার এখনো বেশ রেগে আছে। এবার আহি রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখে-মুখে ভেসে উঠেছে অপমানবোধ। আহি বলল,
“কি হলো, তোমরা মারামারি করলে কেন? বাবা যদি বিয়ের আগেই মেয়ের জামাইয়ের গায়ে হাত তুলে, তাহলে কি বিষয়টা সুন্দর দেখায়?”
তাজওয়ার আহির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। আহি তার পক্ষ নিয়েছে, তাই তার বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু রিজওয়ান কবির ক্ষেপে গেলেন। রাগী স্বরে বললেন,
“তোমার ফিয়োন্সে আমার গায়ে হাত তুলেছে। তোমার বাবার গায়ে হাত তুলেছে। আর তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করছো?”
“ছেলেটা তো তোমার পছন্দের। আমাকে কেন এই প্রশ্ন করছ? সব জেনে-শুনেই তুমি আমাকে তার হাতে তুলে দিচ্ছো। মার খাওয়ার মতো অধিকার নিজেই আদায় করে নিচ্ছো।”
তাজওয়ার আহির পাশে এসে বসলো। রিজওয়ান কবির তা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
“তুমি আমার মেয়ের কাছে আসবে না। আমি আর এই বিয়ে হতে দেবো না।”
তাজওয়ার রাগী দৃষ্টিতে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি আর আমার বিয়েতে কেউ বাঁধা দিলে, আমি তাকেই আমার পথ থেকে সরিয়ে দেবো।”
আহি তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বেশ তো। মেরে ফেলো। আমার বাবাকে মারতে চাও তো? কিন্তু তার আগে আমাকে মেরে ফেলো। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। তাও মনে হচ্ছিলো, অন্তত আমার ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস, সেই বিশ্বাস থেকেই তোমাকে এই কয়েক সপ্তাহ ধরে বোঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি বার-বার আমাকে ভুল প্রমাণ করেছো। আর এখন তুমি আমার বাবার গায়ে হাত তুলে, আমার পাশে এসে বসার সাহস দেখাচ্ছো কীভাবে?”
“আহি, লিসেন।”
“এখনি আমার বাবার কাছে ক্ষমা চায়বে। এরপর আমি শুনবো, কি হয়েছে, আর কার কতোটা অপরাধ।”
“আগে শোনো। কারণ এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”
আহি শীতল কন্ঠে বলল,
“আমারও কোনো দোষ ছিল না, তবুও বাবা অনেক বার আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমার মায়েরও কোনো দোষ ছিল না, তবুও এই মানুষটাই আমার মাকে পিটিয়েছে। কিন্তু আমি তো কখনো আমার বাবার গায়ে হাত তুলি নি। এতো এতো অপরাধ করার পরও কখনো গলা উঁচু করে তাকে কিছু বলি নি। তাহলে তুমি কে, আমার বাবার গায়ে হাত তোলার?”
তাজওয়ার রিজওয়ান কবিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি। আমার কোনো অপরাধ ছিল না। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।”
রিজওয়ান কবির মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাজওয়ার আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“আমার কিছুই আসে যাই না, তোমার বাবা আমাকে বিশ্বাস করলো, কি করলো না। কিন্তু তোমার আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।”
“কি হয়েছে, সেটা বলো।”
তাজওয়ার পুরো ঘটনা আহিকে বলতে লাগলো।
(***)
দুপুরে আহির সাথে দেখা করার জন্য বাসায় এলো তাজওয়ার। বেল দিতেই চুনি দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। তাজওয়ার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। এরপর আহির রুমের দিকে পা বাড়াতেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো মিসেস লাবণি। লাবণিকে দেখে তাজওয়ার কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমার মিসেস এর সাথে দেখা করতে এসেছি। নিশ্চয় এর জন্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই!”
লাবণি খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এনি প্রবলেম?”
লাবণি তাজওয়ারের হাত ধরে তাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। তাজওয়ারও বিনাবাক্যে লাবণির সাথে চলে গেলো। রুমে ঢুকেই লাবণি তাজওয়ারকে তার বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“আহি তো তোমাকে পছন্দ করে না। হয়তো তোমার এমন কাউকে বেছে নেওয়া উচিত, যে তোমাকে পছন্দ করে।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“যে আমাকে পছন্দ করে, আমার তাকেই পছন্দ হয় না। তাজওয়ার খান ইউনিক জিনিস খুব পছন্দ করে। আর আমার কাছে আমাকে পছন্দ না করাটাই সবচেয়ে ইউনিক। কারণ সবাই আমাকে ভালোবাসতে চায়, আর আমি শুধু আহিকে ভালোবাসতে চায়।”
লাবণি তার শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়ে বলল,
“তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে পছন্দ করি?”
তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এক্সকিউজ মি। আপনাকে নিয়ে আমি এমন কিছুই ভাবি নি।”
তাজওয়ার কথাটি বলেই উঠে চলে যেতে নেবে তখনই লাবণি তাজওয়ারকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমি আহিকে বিয়ে করো, আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি চাই, আমাদেরও একটা সম্পর্ক হোক।”
তাজওয়ার লাবণির দিকে ফিরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি মানুষকে দেখেই বুঝে যায়, সে কেমন। আপনাকে দেখেও আমার এমন একটা ধারণা হয়েছিল। কিন্তু এতো বছর পর সেই ধারণা প্রমাণিত হবে, তা আমি ভাবি নি।”
“দেখো, তুমি চাও আহিকে। আর আমি চাই তোমাকে। তোমার আর আমার এখানে কোনো ক্ষতি নেই। আহির সাথে তোমার বিয়ে হলে, তুমি এমনিতেই আহিকে পাচ্ছো। আর তোমার বাবাও দু’টো বিয়ে করেছে। তুমিও চাইলে করতে পারো।”
“আপনি আহির মা।”
“আমি আহির আপন মা নই। আর আমি রিজওয়ানকে তালাক দিয়ে দেবো। ওর সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না।”
তাজওয়ার হেসে বলল,
“আমার রুচি এতোটাও খারাপ নয়। আমি কারো স্পর্শ করা জিনিসে হাত দেই না। আমার জীবনে আসা সব কিছুই নতুন।”
লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আহি কোনো নতুন মানুষ নয়। তুমি কি জানো, আহি অন্য একজনকে ভালোবাসে?”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“জানি। কিন্তু আমার তো আহির ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমিই ওকে ভালোবাসবো।”
লাবণি তাজওয়ারের কথায় বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি এতোটা ইমোশনাল হবে, সেটা আমি ভাবি নি।”
“লিসেন, মিসেস লাবণি। আহি সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করবেন না। আর আপনার সম্পর্কে তো কিছু জানারই বাকি নেই। আজ সবটাই খোলাসা হয়ে গেছে। আপনি আগ্রহী হলে আমি আমার বন্ধু হ্যারি, সজিব আর জিলানের সাথে কথা বলতে পারি। কিন্তু আমি আপনার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করতে পারবো না।”
লাবণি তাজওয়ারের হাত ধরতেই তাজওয়ার তাকে সরিয়ে দিলো। এরপর দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিবে তখনই লাবণি তাকে আবার পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো। আর তখনই রিজওয়ান কবির তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।
রিজওয়ান কবির ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণি তাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রিজওয়ান কবির তাজওয়ারের কলার ধরে তাকে রুম থেকে টেনে বের করে আনলো। তাজওয়ার কবির সাহেবের এমন ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে গেলো। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আহিকে ডাকতে যাবে, তখনই রিজওয়ান কবির তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে ফেলে দিলো। তাজওয়ার ভারসাম্য হারিয়ে একদম নিচে গিয়ে পড়লো। রিজওয়ান কবির এবার নিচে নেমে তাজওয়ারকে মারার জন্য এগিয়ে যেতেই লাবণি তার হাত ধরে বলল,
“আমাদের ভুল বুঝছো তুমি?”
রিজওয়ান কবির সশব্দে লাবণির গালে চড় বসিয়ে দিলেন। লাবণিও ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। রিজওয়ান কবির এবার তাজওয়ারকে ইচ্ছেমতো ঘুষি মারলেন। তাজওয়ারের রাগ এবার সীমা ছাড়িয়ে গেলো। সে পালটা আক্রমণ করে বসলো রিজওয়ান কবিরের উপর। দু’জন কেউ কাউকে ছাড়ছে না। লাবণি আটকাতে গেলে দু’জনই তার উপর চড়াও হয়ে যায়। তাই ভয়ে লাবণি সরে দাঁড়ালো। এদিকে চুনি এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে আহিকে ডাকতে চলে গেলো।
(***)
আহি তাজওয়ারের মুখে এমন কথা শুনে রিজওয়ান কবিরের দিকে তাকালো। তিনি চুপ করে বসে আছেন। ভালোবেসেই তো লাবণিকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। যেই নারীর প্রেমে অন্ধ হয়ে প্রথম স্ত্রী, সালমা ফাওজিয়াকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আহির ইচ্ছে করছে বাবার উপর পরিহাস করতে। কিন্তু আহি করলো না। সে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“বাবা, তোমার কি মনে হয়, তাজওয়ার মিথ্যে বলছে? তোমার সামনেই তো সব বললো। তুমি কি অন্য কিছু দেখেছিলে?”
রিজওয়ান কবির চুপ করে আছেন। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বাবার তো এখানে কোনো দোষ নেই। স্ত্রীর এমন কীর্তি-কাণ্ড দেখে কোনো স্বামীই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। আর এর জন্য তাজওয়ারকে ভুল বুঝে তার গায়ে হাত তোলাও রাগেরই প্রকাশ ছিল। কিন্তু তাজওয়ার, তুমি বাবার গায়ে হাত তুলে ভুল করেছো।”
তাজওয়ার রিজওয়ান কবিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে পড়লো। রিজওয়ান কবিরও চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। আহি ধীর পায়ে হেঁটে সিঁড়িতে বসে পড়লো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে সিঁড়ির হাতলে হাত রেখে বলল,
“কিছু বছর আগে, তোমাকে বাবা এভাবেই মেরেছিলো। জানো মা, আমি এতোটাই অবুঝ ছিলাম, এতোটাই দুর্বল ছিলাম যে তোমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে পারি নি৷ মানুষটা তোমাকে মেরে কি সুন্দর আবার স্যুট-কোট পরে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতো। কখনো তার গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে নি। কিন্তু আজ তাজওয়ার আমার মনটা শান্ত করে দিয়েছে। আমার আজ এতো ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে, আমি আমার মায়ের উপর অত্যাচার করার একটুখানি শোধ তো তুলতে পেরেছি। তাজওয়ারও শাস্তি পেয়েছে। সেদিন আফিফকে বিনা অপরাধে মারার শাস্তি। এভাবে পাপীগুলো নিজেদেরই যদি শেষ করে দেয়, তাহলে কোনো পাপীই আমার জীবনে থাকবে না।”
(***)
লাবণি থম মেরে রিজওয়ান কবিরের পাশে বসে আছে। রিজওয়ান কবির চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছেন। আজকের দৃশ্যটা ভুলতেই পারছেন না তিনি। লাবণি নিরবতা ভেঙে বলল,
“আমার নিয়ত খারাপ ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। এমন কিছু হয়ে যাবে আমি নিজেও ভাবতে পারি নি। আগে জানলে তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে এমন কিছু করতাম। ভেবেছি, আমার প্ল্যানটা তোমাকে রেজাল্ট আসার পর বলবো।”
রিজওয়ান কবির ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালেন। লাবণি বলল,
“আহি একদিন আমাকে এসে বলেছিল, তাজওয়ার না-কি সব মেয়েদের সাথেই অবৈধ সম্পর্ক রাখে। মনে আছে, সরওয়ার বাসায় এসে চুনির সাথে কেমন ব্যবহার করেছিল? আহিই বললো, বিয়ের পর তাজওয়ার যদি চুনি বা আমার সাথে এমন কিছু করতে চায়? তোমার এক সময় বয়স বাড়বে। তখন কি তুমি আর আমাকে প্রটেক্ট করতে পারবে? তাই আমি শিউর হওয়ার জন্য এই নাটক সাজিয়েছি। দেখতে চেয়েছি, আমাকে একা পেলে তাজওয়ার খারাপ কিছু করে কি-না।”
রিজওয়ান কবির উঠে বসলেন। লাবণি চোখের পানি মুছে বলল,
“আমার বুদ্ধিটা হয়তো খারাপ ছিল। কিন্তু ইন্টেনশন খারাপ ছিল না।”
রিজওয়ান কবির লাবণির হাত ধরে বললেন,
“তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন?”
“তুমি আমার কথা শুনছিলে? আমাকে চড় মারলে। তাজওয়ারকেও মারলে। ছেলেটা আমাকে এখন কি ভাববে? আমি ভেবেছি, ওর পরীক্ষা নেওয়ার পর, সত্যটা ওকে জানিয়ে দেবো। তোমার জন্য, ও আহির চোখে আরো খারাপ হয়ে গেলো। সাথে আমিও।”
রিজওয়ান কবির শান্ত কন্ঠে বললেন,
“সরি, লাবণি। তোমাকে ভুল বুঝেছি। আমি এক্ষুণি তাজওয়ারকে ফোন করে সত্যটা জানাচ্ছি।”
“জানাতে হবে না। পরে দেখা হলে বলো। এখন ওর মাথাটা খারাপই থাকবে। এসব শুনলে আরো রেগে যাবে। বলবে আহি ওকে বিশ্বাস করে না। আমাকে যা ভাবার ভাবুক, অন্তত আহির সাথে তাজওয়ারের সম্পর্ক ঠিক থাকুক।”
রিজওয়ান কবির লাবণিকে জড়িয়ে ধরলেন। লাবণি মনে মনে হাসলো আর বলল,
“অন্তত এই ওল্ড ফুলকে হাতে রাখা সহজ। কিন্তু তাজওয়ার যে এতোটা অনেস্ট হবে, এটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
(***)
আহি লিনাশাকে ফোন করে আজকের পুরো ঘটনা বলার পর বললো,
“লিনু, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তাজওয়ার এতোটা লয়াল হবে।”
“আমারও। আমার মনে হচ্ছে, ওর প্ল্যান তোকে বিয়ে করা। তাই হয়তো লাবণিকে পাত্তা দেয় নি। কারণ আর যাই হোক, তোর বাবার ওয়াইফ।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কি ভেবেছি, আর কি হয়ে গেলো। ভেবেছি লাবণি যদি তাজওয়ারকে ফাঁসিয়ে ফেলে। দু’জনই আমার পথ থেকে সরে যাবে। কিন্তু এই তাজওয়ার তো আমার পিছুই ছাড়ছে না। আমি না, তাজওয়ারকে বুঝতেই পারছি না। ওর এতোগুলো মুখোশ? কোনটা রিয়েল, কোনটা ফেইক, কীভাবে বুঝবো?”
“এসব বাদ দে। ফেইক আর রিয়েল যাই হোক, আমার সাজেশন, ওই ছেলেকে কোনোভাবেই বিয়ে করা যাবে না। ফার্জিয়া নামের যেই মেয়েটা তোকে তাজওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলো, ওই মেয়েটাই এর সবচেয়ে বড় কারণ। যে ছেলে নিজের স্বার্থের জন্য মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলছে, সে কখনোই পারফেক্ট লাইফ পার্টনার হতে পারে না।”
“এখন কি করবো?”
“আপতত চুপ থাক। দেখ কি হয়। মিসেস লাবণি ভীষণ চালাক। তোর বাবাকে এতোক্ষণে ভংচং বুঝিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাও দেখবি সব গিলে ফেলবে।”
“যাহ, হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পর, বাবা উনাকে বিশ্বাসই করবে না!”
“শোন, সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না। যারা ধূর্ত হয়, তারা যে-কোনো মূল্যে নিজের কথার জালে অন্যকে ফাঁসিয়ে ফেলতে পারে। যেটা লাবণির দ্বারা সম্ভব।”
লিনাশার কথায় আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যদি এবার পরিকল্পনাটা সফল না হয়, তাহলে অন্য কিছু করতে হবে তাকে।
(***)
দেখতে দেখতে ইদ চলে গেলো। ইদের এক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হলো লিনাশা আর নায়ীবের বিয়ের প্রস্তুতি। বিয়ের কার্ড পছন্দ করে এসেছিলো দুই পক্ষই। ছাপানো শেষ। কয়েকদিনের মধ্যে কার্ডও বিলি করা শেষ। দুই সপ্তাহ পর আনুষ্ঠানিকভাবে লিনাশাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। আজ তাদের আনুষ্ঠানিক এনগেজমেন্ট। একটা রেস্টুরেন্টে সব আয়োজন করা হয়েছে। দায়িত্ব আহি আর রাদ নিয়েছে। সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট৷ ডেকোরেশনের কাজ দেখে আহি একপাশে এসে বসলো। তার পাশে এসে বসলো রাদ।
খোলা ছাদ, অন্ধকার আকাশ, সাদা মেঘ, শীতল হাওয়া, মুহূর্তটা বেশ ভালো লাগছিল আহির। আহি চোখ বন্ধ করে কৃত্রিম সাজসজ্জার ভীড়ে প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা অনুভব করতে লাগলো। তখনই তার কাঁধে মাথা রাখলো রাদ। আহি পাশ ফিরতেই দেখলো রাদের চোখ বন্ধ। আহি বলল,
“ঘুমিয়ে গেলি না-কি!”
রাদ চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। এভাবেই সে শান্তি পাচ্ছে। আহির সাথে এমন মুহূর্ত কাটানো যদি তার ভাগ্যে বাকি জীবনের জন্যও লেখা হয়ে যেতো, তাহলে মন্দ হতো না।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
৮২।
গোলাপী বর্ণের লেহেঙ্গা পরে স্টেজে উঠে বসলো লিনাশা। লজ্জা মাখা দৃষ্টিতে সে একটু পর পর তার পাশে বসা নায়ীবকে দেখছে। সাদা শার্টের উপর গোলাপী কোট পরেছে নায়ীব। দু’জনের চোখে-মুখে লাজুকতা। পুষ্প স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“ডাক্তার সাহেবের মনের অবস্থা তো চরম! মনে হচ্ছে তিনি হবু বউকে দেখে অসুস্থ হয়ে গেছেন।”
পদ্ম পুষ্পের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“বেশি কথা বলিস তুই। চুপ কর।”
এদিকে আহি আজ গাউন পরেছে। সাদা রঙের নেট স্লিভের গাউন। চুলগুলো খোঁপা করেছে সে। আহিকে দেখে লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহিকে দেখে তো রানী এলিজাবেথের নাতনি মনে হচ্ছে।”
পুষ্প লাবীবের কথা শুনে চোখ ছোট করে বলল,
“আর আমাকে?”
“মিকি মাউস।”
“কি!”
“তুমি তো ডল, তাই ডলের সাথে তুলনা করলাম।”
“ওটা একটা কার্টুন!”
“তুমি কার্টুনই তো!”
পুষ্প নাক ফুলিয়ে হনহন করে অন্যপাশে চলে গেলো। এদিকে পদ্ম চুপচাপ একপাশে বসে আছে। আফিফের পছন্দমতো সাদা শাড়ি পরে এসেছে সে। কিন্তু আফিফকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পদ্ম এদিক-ওদিক আফিফকে খুঁজতে লাগলো।
(***)
আহি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই, কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে তার হাতে থাকা আংটির বক্সটা হাত ফসকে পড়ে গেলো। আহি মুখে হাত দিয়ে সিঁড়ি থেকে বক্সটা হাতে নিয়ে দেখলো ভেতরে কোনো আংটি নেই। আহি করুণ দৃষ্টিতে তার সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“সরি। আমি তোমাকে খেয়াল করি নি।”
আহি আর কিছু না বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লো। আফিফ আহিকে বসতে দেখে নিজেও বসে পড়লো আর জিজ্ঞেস করলো,
“কি করছো?”
আহি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“পাগল আপনি? নায়ীব ভাইয়ার আংটিটা হারিয়ে ফেলেছি আমি। আপনার সাথে ধাক্কা খেয়ে বক্স থেকে পড়ে গেছে আংটিটা। এই আংটির দায়িত্ব লিনাশা আমাকে দিয়েছে। যদি আংটি হারিয়ে যায়, কি হবে জানেন?”
আফিফ ব্যস্ত হয়ে আংটিটা খুঁজতে লাগল। আহিকেও বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন লিনাশার মা, রুনা খানম। তিনি আহিকে বললেন,
“নায়ীবের রিংটা দাও তো!”
আহি ভীত চোখে রুনা খানমের দিকে তাকালো। তিনি আহির হাতে বক্সটা দেখে সেটা হাতে নিয়ে নিলেন। আফিফ তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। তিনি আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে বক্সটি খুলে দেখলেন, সেখানে কোনো আংটি নেই। তিনি এবার রাগী দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালেন। এমনিতেই তিনি আহির উপর ক্ষ্যাপা। লাবণি রিজওয়ান কবিরের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি আহিকে অপছন্দ করেন। কারণ আহির বাবার জন্যই তার সংসারটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লিনাশা অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়েছে, আর আহির উপর রাগ না দেখাতে বলেছে। রুনা খানম মেয়ের জোরাজুরিতেই আহিকে সহ্য করছেন। কিন্তু আংটির দায়িত্ব আহিকে দেওয়াটা তার পছন্দ হয় নি। এই মুহূর্তে বক্সে আংটি না দেখে তিনি আর রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। রাগী স্বরে বললেন,
“আংটি কোথায়?”
আহি মাথা নিচু করে বলল,
“এখানেই কোথাও পরেছে। হাত ফস্কে বক্সটা নিচে পড়ে গিয়েছিল। আমি এক্ষুণি খুঁজে দিচ্ছি।”
“তুমি এতোটা কেয়ারলেস হবে, তা আমি ভাবি নি। আর তোমার কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশাও করা যায় না। আমার মেয়ের জীবনে আবার কেন এসেছো? ওর নতুন জীবন এলোমেলো করতে? আমার একটা মেয়েকে তো তোমার বাবা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আর একটাই মেয়ে আছে, তাকে তো অন্তত শান্তিতে বাঁচতে দাও।”
আহি কাঁপা কন্ঠে বলল, “সরি, আন্টি।”
রুনা খানম ধমকের সুরে বললেন,
“সবার জীবনের একমাত্র কাঁটা তুমি। তুমি যেখানে থাকবে, সেখানে শুভ কিছু হবেই না। আমি তো চাই নি তুমি বিয়েতে আসো। কিন্তু লিনাশা আমাকে জোর করেছিল, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে সহ্য করতে হচ্ছে।”
আহি ঠোঁট চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আফিফের সামনে আন্টি তাকে অপমান করেছে এটা আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে আহিকে। সে কিছু বলবে, তার আগেই আফিফ বলল,
“সরি আন্টি, আমার কারণেই বক্সটা ওর হাত থেকে পড়ে গেছে।”
“তুমি ওর সাফাই দিও না তো। সবার সিম্প্যাথি নিয়েই তো এখনো বেঁচে আছে।”
আফিফ আর কিছু বলতে পারলো না। লিনাশার মায়ের সাথে আজ তার প্রথম পরিচয়। এভাবে তাকে কিছু বলে দেওয়াটা অভদ্রতা। তাই সে বাধ্য হয়ে চুপ করে রইলো। রুনা খানম বক্সটা আহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আংটি খুঁজে এনে দাও। নয়তো এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যাও।”
আহি মাথা নেড়ে আংটি খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রুনা খানম চলে যেতেই আফিফ আহির সামনে বসে বলল,
“সরি, আহি।”
আহির চোখ ভিজে গেছে। আফিফ কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে আহির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে উঠে পদ্মের কাছে চলে গেলো। পদ্ম আফিফকে দেখে বলল,
“কোথায় ছিলেন আপনি?”
আফিফ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“একটা বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে।”
আফিফ পদ্মকে সবটা জানাতেই পদ্ম আহির কাছে এলো। পদ্ম এসে দেখলো আহি একপাশে বসে নিরবে চোখের জল মুছছে। তা দেখে পদ্মের ভীষণ খারাপ লাগলো। সে আহির পাশে বসে বলল,
“চল, চলে যাই আমরা।”
আহি চোখ মুছে বলল, “কোথায়?”
“তোকে অপমান করা মানে, আমাদের অপমান করা। আমরা ভালো বন্ধু, আহি। আফিফ আংটি খুঁজে এনে দেবে। এরপর আমরা এখানে আর থাকবো না।”
“যাহ কি বলছিস! লিনু, কষ্ট পাবে।”
“পাক কষ্ট। ওর কষ্ট তোর চেয়ে বেশি হবে না। ওর জানা উচিত ওর মা ওর বেস্ট ফ্রেন্ডকে কিভাবে অপমান করেছে।”
আহি পদ্মকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি সত্যিই অশুভ। আমার এখানে আসা উচিত ছিল না।”
তখনই আফিফ আংটিটা খুঁজে এনে আহির সামনে ধরলো। পদ্ম আংটিটা নিয়ে বলল,
“আমি পুষ্পকে দিয়ে আসছি।”
পদ্ম উঠে চলে যেতেই আফিফ আহির পাশে বসলো। আহি রাগী স্বরে বলল,
“যাও এখান থেকে। তোমার জন্য আমাকে কথা শুনতে হয়েছে। এখন আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে হবে না।”
আফিফ কিছু না বলে উঠে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি নিজেই উঠে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে এলো। এদিকে পুষ্প আর লাবীব আহির সাথে কি হয়েছে তা জানার পর আহিকে খুঁজতে লাগলো। রাদ লিনাশার কাজিনদের সাথে খাবারের আয়োজন দেখাশুনায় ব্যস্ত ছিল। উপরে উঠে সব শুনে সেও আহিকে খুঁজতে লাগলো। পদ্ম আফিফকে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি তো আপনার পাশেই ছিল।”
আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার কারণে আংটিটা নিচে পড়ে গিয়েছিল, তাই আহি আমার উপর রেগে ছিল। আমিও তাই আর ওকে বিরক্ত করি নি।”
পদ্ম কোমড়ে হাত রেখে বলল,
“ওকে শান্ত করার জন্য, ওর পাশে বসতে বলেছি, আর আপনি ওকে একা ছেড়ে এসেছেন? কোথায় গেছে এখন ও?”
“ফোন করে দেখো।”
পদ্ম ফোন করতেই দেখলো নম্বর ব্যস্ত। কারণ রাদও সেই মুহূর্তে আহিকে ফোন করছিল। এদিকে লিনাশা আর নায়ীবের আংটি বদল শুরু হবে। লিনাশা এদিক-ওদিক আহিকে খুঁজছে। আহি তো বহুদূর, তার কোনো বন্ধুদেরও সে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না।
(***)
অনেকক্ষণ পর আহির ফোনে রাদের কল ঢুকলো। আহি জানালো, সে বাসায় চলে এসেছে। আহি চলে গেছে শুনে লাবীব আর পুষ্প বাসায়ও চলে গেলো। রাদ, আফিফ আর পদ্মও বের হয়ে গেছে। এদিকে লিনাশা কাউকে না দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রুনা খানম মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“আহি, পুষ্প, পদ্ম কাউকে দেখছি না যে।”
রুনা খানম ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,
“চলে গেছে হয়তো।”
“মানে? চলে কেন যাবে?”
“তুই নায়ীবকে আংটি পরিয়ে দে৷ দেখ, কতো গেস্ট! এসব কথা পড়ে হবে।”
“একদমই না।”
লিনাশা ফোন বের করে আহিকে ফোন করলো। কিন্তু আহি ফোন ধরছে না। এবার সে পুষ্পকে কল দিলো। পুষ্প ফটফট করে সব লিনাশাকে জানিয়ে দিলো। সব শুনে লিনাশা স্টেজ থেকে নেমে নিচে চলে এলো। নায়ীব অবাক কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে? আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছো?”
“যারা আমার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমার মা যদি তাদেরই অপমান করে তাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমারও কোনো অধিকার নেই তাদের আয়োজনে আনন্দ করার।”
নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“দেখো, আমার ফ্যামিলিও আছে এখানে।”
রুনা খানম লিনাশার হাত ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে, মা। প্লিজ এমন জেদ করিস না। আমি আহির কাছে ক্ষমা চাইবো।”
“আহি তোমার সাথে রাগ করে নি, মা। কিন্তু ওর মনে যেই ক্ষতটা সৃষ্টি হয়েছে, তুমি ক্ষমা চাইলেও সেটা মুছে যাবে না।”
(***)
নায়ীবের জোরাজুরিতে অশান্ত মনে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান শেষ করলো লিনাশা। এরপর সে বাসায় এসে খুব কাঁদলো। আহি কষ্ট পেয়েছে, ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে। সারারাত ঘুমাতে পারে নি সে। কারণ আহির মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। তার উপর মা আফিফের সামনেই তাকে অপমান করেছে। রাগ হচ্ছে মায়ের উপর। শুধু একটা আংটি হারানোর জন্য এতো কথা বলার কি খুব প্রয়োজন ছিল?
(***)
আজ লিনাশার হলুদ অনুষ্ঠান৷ লিনাশা মলিন মুখে ছাদে বসে আছে। কাউকে দাওয়াত করে নি সে। সে একা একাই না-কি গায়ে হলুদ করবে। রুনা খানম মেয়ের এমন জেদ দেখে আহিকে ফোন করলেন, আহির কাছে ক্ষমা চায়লেন, বাসায় আসতে বললেন। আহি আসলো না। রাদ কোনোভাবেই আহিকে যেতে দেবে না। সে আহির মন ভোলানোর জন্য তাকে নিয়ে চলে গেলো ফুচকার দোকানে। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরে বাসায় ফিরলো আহি। বাসায় ঢুকেই ড্রয়িংরুমে লাবণির সামনে রুনা খানমকে দেখে বেশ অবাক হলো সে। রুনা খানম আহিকে দেখে তার কাছে এসে বললেন,
“দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। কোথায় ছিলে তুমি?”
“আন্টি, আপনি এখানে?”
“তোমাকে আসতে বলেছি, তারপরও কেন আসো নি?”
“আমি লিনাশার জীবনে কোনো ঝামেলা করতে চাই না।”
“দেখো আহি আমি যা বলেছি তা রাগ থেকে বলেছি। তুমি জানো, আমি স্বামী হারিয়েছি তোমার বাবার জন্য। তোমার উপর রাগ করে থাকাটা একদম স্বাভাবিক, তাই না? কিন্তু তোমাকে এমন করে বলাটা আমার ভুল হয়েছে। এখানে তোমার কোন দোষ নেই। কিন্তু আমি অতীতের সেই দিনগুলো এখনো ভুলতে পারি নি। যা আমি চাই নি, তা আজ আমাকে করতেই হলো। আমি অন্তত এই নির্লজ্জ মেয়ের মুখোমুখি হতে চাই না।”
রুনা খানম মিসেস লাবণির দিকে আঙ্গুল তাক করে কথাটি বললেন। মিসেস লাবনি হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন। রুনা খানম কাতর স্বরে বললেন,
“তোমাকে আমি খুব ভালবাসতাম, আহি। হয়তো তোমার বাবার জন্য তোমার প্রতি আমার একটা বিরক্ত চলে এসেছিল। আমাকে ক্ষমা করে দাও, মা। তুমিও যে ঠিক ততোটাই কষ্ট পাচ্ছো, যেমন কষ্ট আমরা পাচ্ছি, তা আমি বুঝতে পারি নি। আমার মেয়ের জন্যই তো তোমার বাবা তোমার মাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমার একবারও মাথায় আসে নি, আমার সেই নির্লজ্জ মেয়ের জন্য তুমি কি হারিয়েছিলে। নিজের কষ্টটা এত বেশি বড় করে দেখে ফেলেছি যে অন্যের কষ্ট চোখেই পড়ে নি। খুব স্বার্থপর হয়ে গেছি, তাই না?”
আহি রুনা খানমের হাত ধরে বলল,
“এভাবে বলবেন না, আন্টি। আমি সত্যিই সব ভুলে গেছি।”
“তাহলে কাল সকালে লিনাশার হলুদে এসো। এখন থেকে অতীতের সব তিক্ততা আমি ভুলে যেতে চাই।”
(***)
পরদিন সকালে আহি লিনাশার বাসায় গেলো। নিজ হাতে লিনাশার বাড়ির ছাদ ফুল দিয়ে সাজালো। আহিকে সাহায্য করেছিল পুষ্প আর পদ্ম। সাজানো শেষে তিন বান্ধবী আকাশি রঙের জামদানি শাড়ি পরলো। আর লিনাশাকে হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনা পরিয়ে ছাদে আনা হলো। লিনাশা আর নায়ীবের কাজিনরাও হলুদে ছিল। সবাই ছবি তুলছে আর লিনাশার গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ গান বেজে উঠলো। আর পুষ্প ও লিনাশার দু’জন কাজিন মিলে সেই গানের তালে তালে নাচ শুরু করলো।
“নাচেন ভাল সুন্দরী এই
বাঁধেন ভাল চুল…
.
হেলিয়া দুলিয়া পরে
নাগ কেশরের ফুল
.
সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি
নাচো তো দেখি
বালা নাচো তো দেখি
বালা নাচো তো দেখি।”
গান থেমে যেতেই আবার নতুন গান চালু হয়ে গেলো। এবার আহি আর লিনাশার আরো দু’জন কাজিন এসে নাচ শুরু করলো।
“আশ্বিন ও ফাগুন মাসে
পরান ঘাসে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে,
উথালি পাথালি মনে
আলতা কোণে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে।
হেই হো পিয়ালী রে
হেই হো দুলালী রে,
আশ্বিন ও ফাগুন মাসে
পরান ঘাসে নতুন বিয়ের ফুল ফুটিছে।”
এবার গান থামতে নতুন গান শুরু এলো। আহি আর পুষ্প একাই নাচ শুরু করলো। গানটা লিনাশার বেশ পছন্দ। তাই সেও উঠে এলো নাচার জন্য।
“লীলাবালি লীলাবালি
বর অযুবতি সইগো
বর অযুবতি সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
.
মাথা চাইয়া টিকা দিমু
জড়োয়া লাগাইয়া সইগো
জড়োয়া লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
.
পিন্দন চাইয়া শাড়ি দিমু
ওড়না লাগাইয়া সইগো
ওড়না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে?
.
কানো চাইয়া কানফুল দিমু
পান্না লাগাইয়া সইগো
পান্না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে
কানো চাইয়া কানফুল দিমু,
পান্না লাগাইয়া সইগো
পান্না লাগাইয়া সইগো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে।”
৮৩।
বিছানা ভর্তি ডালা সাজিয়ে রেখেছে পদ্ম, পুষ্প আর আহি। একপাশে নায়ীবের মেহেদির জন্য ডালা, অন্যপাশে বিয়ের ডালা। মাঝখানে নায়ীবের পছন্দের কেক নিজ হাতে বানিয়েছে লিনাশা। গামছা, লুঙ্গি, জুতো, ব্যবহারের জন্য যা যা প্রয়োজন সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যপাশে ফল-ফলান্তি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, হাতের পিঠা সাজিয়ে রাখা। একটু পর সব ছেলে পক্ষের বাড়িতে পৌঁছে যাবে।
আজ রাতে মেহেদি অনুষ্ঠান। পুরো বাড়ি রঙ-বেরঙের বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। লিনাশার বাসার একদম সামনেই কমিউনিটি সেন্টার। সেখানেই মেহেদি অনুষ্ঠান হবে। আহি হুড়োহুড়ি করে ক্লাবে ঢুকতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেবে, তখনই কেউ একজন আহির কোমড় আঁকড়ে ধরলো। আহি চোখ বন্ধ করে বলল,
“সবাই শুধু আমার সাথে কেন ধাক্কা খেতে আসে?”
“বেশি সুন্দরী যে তাই!”
আহি উজ্জ্বলের কন্ঠ শুনে চোখ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি এখানে?”
“কেন আসতে পারি না?”
“না মানে, এমনিই।”
উজ্জ্বল হাসলো। আহি সামনে এগুতেই পুষ্প উজ্জ্বলের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভাই, তুই এখানে?”
“তোর বান্ধবী বাসায় এসে তার ম্যাডামকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেছে। আমিও তাই বিয়ে খেতে চলে এসেছি।”
“বাহ, চেনো না জানো না, খাওয়ার জন্য চলে এসেছো?”
উজ্জ্বল পুষ্পের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“আহিকে তো চিনি।”
“আচ্ছা, আহিকে চেনো? আর আমি?”
“তুই কে?”
“আমি তোমার বোন।”
“চিনি না আমি।”
“চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ছবি তুলতে বলবো না।”
এদিকে উজ্জ্বল পুরো ক্লাব ঘুরে আবার আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি উজ্জ্বলকে দেখে বলল,
“খেয়েছেন?”
“হুম। তুমি?”
“পরে খাবো।”
উজ্জ্বল আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যদিকে রাদ ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে আছে। লাবীব রাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর মতো বোকা আমি একটাও দেখি নি। এভাবে গবলেটের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে, কখনো তাজওয়ার খান, কখনো কিং খান এসে তোর রানীকে নিয়ে যাবে। আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু পপকর্ণ খাবি।”
রাদ চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব বলল,
“আমার দিকে এভাবে না তাকিয়ে কাজের কাজ কর।”
রাদ মনে মনে বলল,
“কখনো জোঁক, কখনো তেলাপোকা, কখনো মাছি। এতো কীটপতঙ্গ সামনে কিলবিল করছে, আর আমি মানুষটা সামনে আগাতেই পারছি না।”
চলবে-