#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০২||
০৩।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে আহি বিশেষ দু’টি দিনের অপেক্ষায় থাকে। সপ্তাহ শেষে ঝড়-বৃষ্টি, রোগ-শোক উপেক্ষা করে সে চারুশিল্পে চলে যায় শুধু এআরকে দেখার জন্য।
এআর, আফিফ রাফাত, আহির প্রথম প্রেম। প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে আহি তেমন কিছুই জানে না। কখনো ভাবেও নি যে সে প্রেমে পড়বে। তবে আফিফের আঁকা ছবি, তার নিগূঢ় চোখযুগল, তার এলোমেলো চুলগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আহির ভীষণ ভালো লাগে। এটাকে যদি প্রেম বলে, তাহলে আহি হয়তো প্রেমেই পড়েছে। প্রথম দুই সপ্তাহ আফিফের নাম জানতে পারে নি সে। বাসায় এসে শুধু নামহীন যুবকের নাম কি হতে পারে সেটা ভাবতেই ব্যস্ত ছিল আহি।
সপ্তাহ শেষ হতেই তার অস্থিরতা বেড়ে গেলো। চারুশিল্পে যেদিন ক্লাস থাকে সেদিন কোনো এলার্মের প্রয়োজন হয় না, কারো দরজায় কড়া নেড়ে আহিকে ডাকতেও হয় না। সে নিজ থেকে উঠে ভালো জামা পরে আগেভাগে নাস্তার টেবিলে এসে হাজির হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ায়ও যেন হুলুস্থুল কান্ড। আহির বাবা-মা মেয়ের আচরণে বরাবরই অবাক হোন। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেন না।
(***)
আজও আহির বাবা, রিজওয়ান কবির মেয়েকে আর্ট স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। আহিও দেরী না করে গাড়ি থেকে নেমে এক দৌঁড়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। ক্লাসে এখনো তেমন কেউ আসে নি। তার প্রিয় মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। তখনই আহির নজর পড়লো টেবিলের উপর রাখা খাতাগুলোর দিকে। আগের সপ্তাহে সবাই তাদের আঁকা ছবিগুলো জমা দিয়েই চলে গিয়েছিল। তাহলে এখানেই তার প্রিয়র খাতাটা থাকবে।
আহি খাতাগুলোর উপরে লেখা নামগুলো দেখে নিলো। এতোগুলো নামের মধ্যে তার প্রিয়র নাম কোনটা, সেটাই বোঝা মুশকিল। ক্লাসে চৌদ্দ জন ছেলে। এখানেও চৌদ্দটা নাম। তড়িঘড়ি করে সে সবগুলো নাম মুখস্থ করে নোট টুকে নিলো। স্যাররা আবার আইডি ডেকে খাতা দেন। নাম ধরে ডাকলে আহিকে এতো কাঠখড় পোড়াতে হতো না। আবার মাঝে মাঝে যার খাতা সে এসে নিয়ে যায়। আর তার প্রিয়র আইডিটাও তার মনে নেই। এখন কখন স্যার আইডি ধরে ডাকবেন, কখন সে তার প্রিয়র নাম জানতে পারবে, এতো ধৈর্য তার মধ্যে নেই। সে তো আজই তার প্রিয়র নাম জেনে ছাড়বে।
(***)
ক্লাসে যেই ছেলেগুলো উপস্থিত ছিল স্যার আসার আগে আহি তাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিলো। কিন্তু প্রিয়র কাছে গিয়ে তার সাথে পরিচিত হওয়ার সাহসটা সে পাচ্ছিলো না। কতো সহজই না হতো, একদম তার সাথেই কথা বলে নাম জেনে নেওয়া! কিন্তু এই সহজ কাজটা করতে যাওয়ার আগেই হাত-পা কাঁপছিল আহির। সে নিজেও বুঝতে পারছে না কেন তার সাথে এমন হচ্ছে।
স্যার আসার পর পরই তার প্রিয় পুরুষ ক্লাসে ঢুকে তার পাশের সারিতেই বসে পড়লো। আহি তা দেখে নীরবে হাসলো। ঘুরেফিরে আহির পাশের সারিটাই তার প্রিয় মানুষটার জন্য খালি থাকে। এটাই হয়তো নিয়তি।
(***)
আজকের স্কেচ একটা বটবৃক্ষ। আহি মুখ ছোট করে বটবৃক্ষটির দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে,
“এর চেয়ে ভালো আমি পাশের সারিতে বসে থাকা শান্ত চোখের যুবকটির ছবি আঁকি।”
এমন ভাবনা মাথায় আসতেই আহির ঠোঁটে বিস্তর হাসি ফুটে উঠলো। সে স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কেচবুকের একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে খাতার নিচে রাখলো। তারপর সটান হয়ে বসে ছেঁড়া পৃষ্ঠায় তার প্রিয়র ছবি আঁকতে লাগলো।
চারটা বেঞ্চ আগেপিছে। মাঝখানের সারিতে বসা একটা ছেলে। হাতে পেন্সিল। টেবিলে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রাখা বিভিন্ন মানের পেন্সিল আর রাবার। ছেলেটির খাতায় আঁচড় পড়ছে পেন্সিলের। সে ব্যস্ত বটবৃক্ষের শিকড়ে প্রাণ দিতে।
স্যার ঘুমকাতুরে মানুষ। চেয়ারে বসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। সময় ফুরাতেই তিনি চোখ খুললেন। এখন বিরতি। সবাই যতোটুকু এঁকেছে তা দেখেই তিনি সংশোধন করবেন। আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো। স্যার আহির খাতার সামনে এসে ভ্রূ কুঁচকালেন। খাতায় পেন্সিলের হালকা দাগও নাই। আঁকার চেষ্টা করেছে এরও কোনো প্রমাণ নেই। খাতা একদম পরিষ্কার। আহি মুখ ছোট করে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভীষণ শরীর খারাপ স্যার। চোখ বার-বার ঝাপসা হয়ে আসছে।”
স্যার মাথা নেড়ে বললেন,
“তুমি ছুটি নিয়ে চলে যাও। কাল ভালো লাগলে এসো।”
আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না স্যার। আমি এখানেই থাকি? আসলে বাসায় কেউ নেই। বাবা অফিসে গেছেন। মাও বাসায় নেই।”
“ফোন থাকলে কল দিয়ে বলো।”
“স্যার, শুধু শুধু টেনশন করবে। আমার ভালো লাগছে এখানে। আমি একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি?”
“হুম, যাও।”
আহি একনজর তার প্রিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে পড়লো। স্যারের সাথে সে এতো কথা বললো আর এই ছেলে একবারো তার দিকে তাকালো না। এদিকে স্যার কাকে কি বললো তা শোনার জন্য আহি ব্যস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। আর এই ছেলের একমাত্র লক্ষ্য যেন তার খাতা, আর তার আঁকা ছবি।
(***)
বিরতির মধ্যেই আরো কিছু ভাইয়ার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো আহি। এখন বাকি চার জন। এর মধ্যে তার প্রিয় মানুষটিও আছে। চারটা নাম সে আওড়াতে লাগলো। সোহেল, জয়, দেবাশীষ আর আফিফ। এর মধ্যে দু’জনের হাতে বাঁধা লাল সুতো দেখেই আহি ধরে নিয়েছে এরাই জয় আর দেবাশীষ। বাকী আছে সোহেল আর আফিফ। এর মধ্যে একজন আসেই নি। এখন কীভাবে সে বুঝবে, কে সোহেল, আর কে আফিফ! একটা নাম জানতে তার কতো কিছুই না করতে হচ্ছে। নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য তার পাগল মনে হচ্ছিল। তবুও এই পাগলামো করতেই তার ভীষণ ভালো লাগছে। ক্লাস শেষ হতেই তার ভাগ্য যেন শুভ প্রমাণ হলো। স্যার পেছন থেকে জোর গলায় ডাকলেন,
“আফিফ, এদিকে আসো।”
আহি পেছন ঘুরতেই দেখলো তার প্রিয়ই স্যারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাহলে প্রিয়র নাম আফিফ? আহি মনে মনে বলল,
“স্যার আগেই যদি নাম ধরে ডাকতেন, শুধু শুধু আমাকে মগজধোলাই করতে হতো না।”
এবার আহি তার টুকে নেওয়া নোটটি খুলে মুচকি হাসলো। এলোমেলো ভাবে লেখা, আফিফ রাফাত। এক রাশ ভালো লাগা ছেয়ে গেলো আহির মনে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই মনে করার চেষ্টা করছিল সকালে যখন এই নামটি হুড়োহুড়ি করে টুকে নিচ্ছিলো, তখন তার হাতটা কি একবারো কেঁপেছিল? ঠোঁট চেপে হাসছে আহি। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়েই উঠছিল। আহি তাকে দেখেই হাসি গিলে ফেললো। দুই সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মেরে বলল,
“তুমি আমাকে পাগল করে দেবে এআর৷”
০৪।
বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িতে মাত্র পাঁচজন মানুষের বাস। আহির বাবা-মা আর আহি, সাথে থাকেন মুনিয়া খালা ও তার মেয়ে চুনি। মুনিয়া খালা আহিদের বাসায় কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর আহির বাবা মুনিয়াকে তাদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে মুনিয়া তার মেয়ে চুনিকে নিয়ে এই বাড়িতেই আছে। সারাদিন এই বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত থাকে মুনিয়া। চুনি ছোট মানুষ, আট কি নয় বছর বয়স। এই বয়সেই সে বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখে সময় পার করে। আহির মা, মিসেস সালমা ফাওজিয়া বইপোকা। তিনি রান্না-বান্নার কাজ সেরে নিজের লাইব্রেরিতে গিয়ে সময় কাটান। আর আহির বাবা, রিজওয়ান কবির ব্যস্ত থাকেন নিজের ব্যবসার কাজে। আহি সারাদিন নিজের ঘরে বসে কি করে না করে তা কেউ দেখতে আসে না। রিজওয়ান কবির নিজেই মেয়েকে এই স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্রাইভেসি শব্দটার সাথে আহি ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। শিল্পপতি বাবার একমাত্র কন্যা অল্প বয়সেই ফোন, ল্যাপটপ সবই হাতে পেয়ে যায়। নিজের ঘরে নিজের মতো থাকতেই সে অভ্যস্ত। এমনকি স্কুলে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে সে তালা লাগিয়ে যায়। সেই ঘরে প্রবেশের অধিকার কারো নেই। উলটো কেউ যদি ভুলেও পা রাখে তাকে আহির রোষাগ্নিতে পড়তে হয়। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কাজে বিরক্ত হোন। কিন্তু মেয়ের বাবা যেখানে মেয়েকে আস্কারা দিয়ে রেখেছেন, সেখানে তিনি কিছু বললে উল্টো স্বামীর কাছ থেকেই তার বকা খেতে হয়। এমনিতেই স্বামীর সাথে তার বনিবনা হয় না। কিছু বলতে গেলেই হয়তো সংসার বাঁচানো দায় হয়ে যাবে। তাই তিনি চুপ করে থাকেন। কারণ তার মেয়ে আর যাই করুক, পড়াশুনা ঠিকই করছে। পরীক্ষায়ও ভালো করে। তাই তিনি মোটামুটি আহির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তামুক্ত আছেন।
(***)
আহি আর্ট স্কুল থেকে এসেই ব্যাগ থেকে সেই স্কেচটি বের করে তার ক্যানভাসের সাথে আটকে রাখলো। বার কয়েক সেই স্কেচটিতে হাত বুলিয়ে পেন্সিল হাতে নিয়ে নিচের অংশে লিখলো, “এআর।” নামটি লিখতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
প্রথম প্রেম হয়তো এমনই হয়। কোনো আশা নেই, কোনো হতাশা নেই, কোনো স্মৃতি নেই, শুধু ভালোবাসতেই ভালো লাগে।
আহির ঘরটি ভালোই বড়সড়। সেই ঘরে আসবাবপত্রের চেয়ে আহির শখের জিনিস বেশি। ঘরের একপাশ দখল করে নিয়েছে তিন-চারটি কাঠের ইজেল। ইজেলের উপর ক্যানভাস রাখা। অন্যপাশ দখল করে নিয়েছে পুরোনো পত্রিকা দিয়ে মোড়ানো আহির আঁকা ছবি। দক্ষিণের জানালা বরাবর খাট। পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো গ্রিল ছাড়া জানালা। আহি প্রতিদিনই খোলা চুল জানালার বাইরে বের করে দিয়ে ঘুমায়। তবে নিচেই দারোয়ান চাচার ঘর। আবার দিন-রাত সময় ভাগ করে পাহারাদাররা বাড়ি পাহারা দেন৷ আহির মনে ভূতের ভয় একদমই নেই। সে বিন্দাস থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছবি আঁকে, কখনো বা কমিক্সের বই পড়ে। আহিকে দেখলে যে-কেউ বলবে, আহির মতো সৌভাগ্যবতী হয় না। আহির বয়সী মেয়েদের যেখানে বাবা-মার বকুনি খেয়ে পড়তে বসতে হয়, সেখানে আহি বকাঝকার নমুনায় কখনো দেখে নি।
……………….
“দিনগুলো কতো চমৎকার ছিল! এখন ভাবছি কেন এতো বড় হলাম।”
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহির। চোখ বন্ধ করে অতীতের সুখ স্মৃতি হাতড়াতে ভালোই লাগছিল তার। বিমান অবতারণের ঘোষণা হতেই চোখ খুললো সে। পাশ ফিরে একনজর নায়ীবের দিকে তাকালো। তারও হয়তো এই মাত্র ঘুম ভেঙেছে। নিভু নিভু চোখে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এতোগুলো সময় কীভাবে যে কেটে গেলো!”
আহি নায়ীবের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এ লোকটার প্রশ্ন থেকে সে অন্তত বেঁচে গেছে।
(***)
বিমান থেকে নেমেই গটগট পায়ে বিমানবন্দরে ঢুকে গেলো আহি। জরুরি কাগজপত্র বের করে তা কাষ্টমস অফিসারকে দেখিয়ে কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। নায়ীবকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নায়ীব জরুরি কাগজপত্র দেখিয়ে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি ভ্রূকুঁটি মিশ্রিত চোখে নায়ীবের দিকে তাকাতেই নায়ীব বুক পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আহির দিকে এগিয়ে দিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহি কার্ডটি নিয়ে নিলো। নায়ীব বলল,
“আমি বেশ বুঝতে পেরেছি আপনি ডিপ্রেশনে আছেন। আর এটা ভয়াবহ সমস্যা। তার চেয়ে বড় সমস্যা, সমস্যার কথাটা কাউকে বলতে না পারা। আপনার সীমাবদ্ধতা কোথায় সেটা আমি জানি না। আপনার সাথে কি হয়েছে, তাও আমি জানি না। কিন্তু মিস ওয়াসিকা কবির, মানুষের মন কিন্তু জানালার মতো। জানালা খুলে দিলে যেমন মিষ্টি হাওয়া প্রবেশ করে, তেমনি বন্ধ রাখলে গুমোট বাতাবরণের সৃষ্টি হয়। জীবনটাও ঠিক তেমন। মনের জানালা খুলে দিবেন, সুখ-দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নিবেন, তবেই স্বস্তি পাবেন। আর বন্ধ রাখবেন তো নিজেকেই ধীরে ধীরে হত্যা করবেন।”
আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে কার্ডটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখার জন্য এতো চেষ্টা করছে সে, অথচ তার কষ্টটা আজ অপরিচিত একজন দেখেই বুঝে ফেললো। সে তো কঠিন হতে চায়ছে, তাহলে কেন এই ভালোবাসা তাকে বার-বার দুর্বল করে দিচ্ছে?
(***)
ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলো আহি। চারপাশে একবার চোখ বুলালো। তাকে নিতে কেউ আসে নি। আসার কথাও নয়। বাবা ঢাকাতেই আছেন। তিনি জানেন আজ আহি আসবে, সময়টাও আহি জানিয়েছিল। তবুও আসেন নি। তবে বাবার কাছ থেকে কোনো আশা রাখে না সে৷ গেল বছরগুলোতে তার যেই রূপ দেখেছে, আহির আশা-ভরসা সব হারিয়ে গেছে। জীবন যুদ্ধে সে নিজেকে পরিত্যক্ত মাঠে একাই আবিষ্কার করেছে। যার আগেপাছে কেউ নেই।
বিমানবন্দরের সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো আহি। গাড়িতে উঠেই ফোনে নতুন সিম ঢুকালো। ফোন চালু করেই বাবার নম্বরে ডায়াল করতে যাবে তখনই ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে পরিচিত নাম দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্নতায় ভরা ভারী পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
“কি রে ফোন বন্ধ কেন তোর?”
“মাত্রই তো ফোনে সিম লাগালাম।”
“মাত্র কেন? ল্যান্ড তো অনেক আগেই করেছিস।”
“ব্যাগপত্র নিতে গিয়েই তো সময় গেলো।”
“আর আমি এদিকে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তুই মানুষ নাকি গরু?”
আহি গাল ফুলিয়ে বলল, “গরু বলবি না আমাকে।”
“আচ্ছা, গাভীই বলবো।”
ওপাশ থেকে হাতাহাতির শব্দ কানে আসতেই আহি ফোন সরিয়ে নিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“পাগল ছাগলের দল।”
কল কেটে যেতেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রাদের সাথেই এতোক্ষণ কথা বলছিল আহি।
রিদমাম রাদ আহির ছোটবেলার বন্ধু। আর যার সাথে রাদের হাতাহাতি হচ্ছিল, সে লাবীব, আহির আরেক বন্ধু। তারা একই স্কুলে পড়েছিল। রাদ আর লাবীব এতোদিন আহির সাথে লন্ডনে ছিল। একই ইউনিভার্সিটি থেকে তারা পড়াশোনা শেষ করেছে। লাবীবের দাদা মারা যাওয়ায় লাবীব ও রাদ দেশে আগেভাগেই চলে এসেছিল।
(***)
রাদ ফোনের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে লাবীবকে বলল,
“দেখছিলি না কথা বলছিলাম? ফোনটা কেটে গেলো তো!”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আমারও কথা ছিল আহির সাথে।”
“দেখা হলে বলিস। আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করলে নিজের ফোন থেকে কল দে। আমার ফোনে কি?”
(***)
ব্যাগে ফোন রাখতে গিয়েই আহির চোখ পড়লো বাদামী মলাটের ডায়েরীটির দিকে। বেশ মোটা আর ভারী ডায়েরী। ব্যাগের ভারটা বোধহয় এই ডায়েরীর কারণেই একটু বেশি লেগেছিল। ভার হওয়ায় তো স্বাভাবিক। এই ডায়েরীতেই তো বাঁধা পড়ে আছে তার অতীত স্মৃতি। সে যেখানেই যায়, এই ডায়েরী তার সঙ্গী হয়। আহি ডায়েরীটা হাতে নিয়েই মলিন হাসলো। আলতো হাতে মলাটের উপর হাত বুলালো। চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে তাকাতেই তার মনে পড়ে গেলো এই ডায়েরীকে ঘিরে তার সৃষ্টি হওয়া সেই অদ্ভুত দিনটির কথা।
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৩||
০৫।
সূর্যকিরণ পিচঢালা রাস্তায় ঠিকরে পড়ছে। পিচের রাস্তা রোদের আলোয় চিকচিক করছে। আহির ঠোঁটে কোমল হাসি। শক্ত হাতে একটা মোটা ডায়েরী আঁকড়ে ধরে আছে সে। স্কুল ছুটি হতেই জমানো টিফিনের টাকা দিয়ে এই ডায়েরী কেনা। এক একটা দোকান, স্কুলের পাশের লাইব্রেরি, শপিংমল ঘেঁটে সে এই বিচিত্র ডায়েরী কিনেছে। মলিন সাদা পৃষ্ঠার বাদামী চামড়ার ডায়েরী। ডায়েরীর মলাটে আর পাতায় ক্লাসিকাল ছাপ। আহি ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“এআর, এক যুগ পর যখন তুমি এই ডায়েরী পাবে, তখন বুঝবে, এই আহি তোমাকে কতোটাই না ভালোবাসতো।”
অকস্মাৎ আহির এলোমেলো ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সামনে হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত মুখটি আহির গতিরোধ করলো। আফিফ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! এভাবে আফিফের সাথে দেখা হয়ে যাবে, আহি কল্পনাও করে নি।
আহি ঝটপট আশপাশ চোখ বুলিয়ে নিলো। তার চোখ পড়লো জীর্ণশীর্ণ দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সার দিকে। সে রিক্সার কাছে এসে তার কাঁধের ব্যাগটা রিকশার হাতলে ঝুলিয়ে দিলো। তারপর ব্যাগের সাইড পকেট থেকে একটা কলম আর পেন্সিল বের করলো। রিক্সার পাশেই ইটের স্তূপ। হয়তো ইটগুলো ভাঙার জন্য একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে। আহি চারটা ইট বসিয়ে বসার জায়গা করে নিলো। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে নতুন ডায়েরীটা খুলল। কোলের উপর রেখে সাদা পৃষ্ঠায় কলম চালালো।
“তোমার দিকে তাকিয়ে তোমার আমার প্রেমের গল্প লেখা শুরু করছি। বিষয়টা চমৎকার না? এমন উন্মাদ প্রেমিকা কি আগে দেখেছো? নিশ্চয় দেখো নি। জানো, আজই কিনলাম এই ডায়েরীটা। আর পথে দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, কথা বলছো কোনো এক অচেনা ছেলের সাথে। আর আমি রৌদ্রতাপ ভুলে রিকশার পাশে তোমাকে দেখা যায় এমন স্থানে বসে আছি। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি তোমাকে। আচ্ছা এআর, মেয়েরা কি এভাবে লুকিয়ে কারো দিকে তাকায়? মেয়েরাও কি এভাবে ভালোবাসে? জানি না, কিন্তু আমার তোমাকে এভাবে ভালোবাসতেই ভালো লাগে।”
লেখা শেষ করে আহি আফিফের দিকে তাকালো। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে আহি। রোদের তাপে মুখ জ্বালা করছে, তবুও ঠাঁই বসে আছে সে। পেন্সিল হাতে নিতেই দেখলো আফিফ ছেলেটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আহি দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটলো আফিফের পিছু। কিন্তু অর্ধেক পথ যেতেই আফিফকে হারিয়ে ফেললো। শেষমেশ শুকনো মুখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলো সে। এরপর বাসায় এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। সালমা ফাওজিয়া আহির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেকেন্ড খানিক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
(***)
বিকেলে আহি ডায়েরী খুলে তার লেখাটা একবার পড়ে নিলো। তারপর খালি স্থানগুলোতে গোলাপের পাপড়ি লাগিয়ে একপাশে আফিফের নাম লেখা নোটটি আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলো। আর নিচে লিখলো,
“প্রথম তোমার নাম জানার চেষ্টা। কি সুন্দর নাম! আফিফ রাফাত।”
তারপর একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে আজকের দৃশ্যটা স্কেচ করতে বসে গেলো।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আফিফ। সামনে একটা ছেলের অবয়ব। আহি বসে আছে ইটের উপর। পাশে একটা রিকশা৷
স্কেচ শেষে ডায়েরীটা বন্ধ করে আলমারীতে তুলে রাখলো আহি৷ এরপর ক্যানভাসে আটকানো সেই স্কেচটার দিকে তাকালো যেটা সেদিন বটবৃক্ষের পরিবর্তে এঁকেছিল। স্কেচটা বাঁধিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। যেই ভাবা সেই কাজ। স্কেচটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো আহি। সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে চপল পায়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভ্রূ কুঁচকালেন। আহি পাশের দোকানে গিয়ে স্কেচটা বাঁধাতে দিলো। একদিনের মধ্যেই আফিফ তার ঘরে শোভা পাবে, ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছিল আহির মনে।
………………………….
জানালার পর্দা দু’পাশে সরিয়ে দিতেই জানালা ভেদ করে রোদের আলোকচ্ছটা আহির মুখে এসে পড়লো। কড়া রোদে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। প্রকৃতি কেমন ভ্যাপসা গরম ছড়াচ্ছে। দেশে গরম বোধহয় একটু বেশি। তবে আহির তেমন খারাপ লাগছে না। সে তো অভ্যস্ত এসবে। প্রিয় মুখটা দেখার জন্য কিছু বছর আগেও সে রোদে পুড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
অতীত স্মৃতি থেকে বেরিয়ে শুকনো ঢুক গিললো আহি। বুকটা আবার জ্বালা করছে তার। ঠোঁট দু’টিও কাঁপছে। মাঝে মাঝেই প্যানিক এটাক আসে আহির৷ সেই চার বছর আগে প্রথম এসেছিল। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত এই সমস্যায় ভুগছে। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলো বার কয়েক। এরপর ভেজা মুখেই সে হোটেলের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। রোদের তাপে বারান্দার মেঝেতে পা রাখা যাচ্ছে না। রেলিঙে হাত রাখতেই বুঝলো, গরমের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। চার বছর আগেও প্রকৃতি এতো উত্তপ্ত ছিল না। দিন দিন আবহাওয়ার ভিন্ন রূপ সৃষ্টি হচ্ছে। আজ হয়তো দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর এদিকে সে নিম্ন মানের হোটেলে উঠেছে। রুমে এসির ব্যবস্থা নেই। ফ্যানটাও খুব আস্তে ঘুরছে। বাবাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল আহি, কিন্তু তিনি ধরলেন না। তাই বাধ্য হয়েই কাছের একটা হোটেলে উঠতে হলো তাকে। ক্রেডিট কার্ডে অল্প কিছু টাকা ছিল, তা উঠিয়ে নিয়েছিল। সেই টাকা দিয়েই ঢাকায় জরুরী কাজ সেরে চট্টগ্রাম যেতে হবে।
বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। আর আনমনে বলতে লাগলো,
“দেখো, কেমন পাগল হয়ে যাচ্ছি, এআর। তুমি হয়তো আমাকে মনেই রাখো নি৷ কিন্তু আমি এক পাগল, তোমাকে এতো চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না। আমি তো ভোলার অনেক চেষ্টা করেছি। নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। এর চেয়ে বেশি চেষ্টা করতে গেলে মস্তিষ্ক বের করে তোমার স্মৃতি ঘেরা অংশটা মুছে দিতে হবে৷ এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। কেন এতো ভালোবেসেছিলাম তোমাকে, বলো না এআর? ভালোবাসার সাগরে ফেলে দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু ভুলে যাওয়াটা শিখিয়ে দাও নি। এখন শুধু একটাই চাওয়া, দ্বিতীয় বার যাতে তোমার মুখোমুখি হতে না হয়। তোমার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই ফিরতে হলো। নয়তো কখনোই আসতাম না আমি। গ্রীষ্ম শেষ হলে আবার বর্ষার মাস আসবে। এমনই এক গ্রীষ্মে তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আর বর্ষা এসে তোমাকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেলো। সেদিন শুধু তোমাকে হারায় নি, অনেক মানুষকে একসাথে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি তো কাউকে কষ্ট দেই নি, এআর। তাহলে আমি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছি? আমি এতো অসহায় কেন? মাঝে মাঝে ভাবি, কেন বেঁচে আছি? আমার বেঁচে থাকা না থাকায় কারো কিছুই আসে যায় না। আমি শুধু কিছু মানুষের জন্য ইনভেস্টমেন্ট মাত্র।”
আহি দেয়াল ঘেঁষে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে৷ দেয়ালে ধীরগতিতে মাথার পেছন ভাগ টুকাতে লাগলো। এতে যদি মাথার চাপ একটু কমে। ভীষণ ভারী ভারী লাগছে মাথাটা।
০৬।
লিনাশা, পদ্ম, আহি আর পুষ্প। তারা মোট চার বন্ধু। স্কুল-কলেজ একসাথেই শেষ করেছিল তারা। কিন্তু অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর পরই তারা সবাই আলাদা হয়ে যায়। আর তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়ে। তারা তাদের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তাদের চারজনের এই ছোট বন্ধু মহলটির একটা নামও রেখেছিল, ‘পলি আপু’ নামে। সবাই এই নামটা শুনে হাসাহাসি করতো, আবার অবাক হতো চারজনের বন্ধুত্ব দেখে।
বন্ধু মহলে পদ্ম ছিল সবচেয়ে শান্ত। আর পুষ্প ছিল খুবই চঞ্চল। অন্যদিকে লিনাশা আর আহি ছিল অনেক মিশুক। তবে এই চারজনের মধ্যে লিনাশা আর আহির বন্ধুত্ব একটু বেশিই গভীর ছিল। কিন্তু হঠাৎ কি যেন হলো! আহি চার বছরের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলো। যেই লিনাশার সাথে আহির গলায় গলায় ভাব ছিল, তারা এখন একে অপরের নামও উচ্চারণ করে না। অন্যদিকে পদ্ম বিয়ের পর থেকে সংসার নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর পুষ্পের সাথে আহির খুব কমই যোগাযোগ হয়। কিন্তু আহির ফোনের ওয়ালে এখনো কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে চারজনের একসাথে তোলা শেষ ছবিটি শোভা পায়। ফোন হাতে নিয়ে সেই ছবিটিই দেখছিলো আহি। ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে আহি বলল,
“অন্তত তোরা আমার সাথে থাকলে, আমার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না। পরিবার, বন্ধু, ভালোবাসা সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এই বিস্বাদ জীবনে কোথাও ছিঁটেফোঁটা আনন্দও নেই।”
ফোনের স্ক্রিনে রাদের নামটা ভেসে উঠতেই আহি ভেজা চোখ মুছে নিলো। ফোন কানের কাছে আনতেই ওপাশ থেকে গম্ভীরমুখে রাদ বলল, “কাঁদছিস!”
রাদের কথায় কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে গেলো আহির। মুখে হাত চেপে নিজেকে সংবরণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো সে। রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“থাক কথা বলিস না। আমার কথা শোন। তোকে একটা গান শোনাই। চোখ বন্ধ করে রাখ। ভালো লাগবে।”
আহি চোখ বন্ধ করতেই অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। রাদ কন্ঠে গান ধরলো,
“খোলা জানালা দখিনের বাতাসে….
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে,
তখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার পাশে।
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা,
চলতে ভীষণ ভয়,
তুমি এসে বলে দাও আছি আমি পাশে
করো না কিছুতেই ভয়।
তখনও বুঝিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
তখনও বুঝিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।
অনেক পথের পথিক আমি ক্লান্ত সর্বশেষ,
তোমার পথের ঠিকানা খুঁজে, আমি আজ অবশেষ।
তুমি আমার প্রথম ও শেষ জীবনের ভালোবাসা,
তোমার মাঝে তাইতো আমার জীবনের শত আশা।
তখনও বুঝিনি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
তখনও বুঝিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।”
আহি ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিলি, রাদ।”
“তোর কষ্টগুলো ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া রে। শুনেছি মানুষ কষ্ট পেতে পেতে পাথর হয়ে যায়। আর তুই বরফ গলা নদী। কখনো শক্ত, কখন গড়িয়ে পড়িস। এভাবে চলবে না, আহি। শক্ত হ। এখন তো তোকে আরো শক্ত হতে হবে। আংকেলের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য তো অন্তত তোকে শক্ত হওয়া দরকার।”
আহি বিড়বিড় করে বলল,
“বাবার সাথে শক্তির জোরে আমি পারবো না। আমি হয়তো হেরে যাবো।”
রাদ এবার ধমকের সুরে বলল,
“আহিনি, তোকে সামনে পেলে রামধোলাই করবো আমি। মিনমিন করে কি বলছিস? হেরে গেলে মার খাবি। তোকে হারাতে হবে।”
“পারবো আমি?”
“কেন পারবি না? যথেষ্ট বড় হয়েছিস তুই। এখন তোর মতামতের একটা মূল্য আছে। আর এসব পরে ভাবিস। আগে চট্টগ্রাম গিয়ে দেখ, বাসার পরিবেশ কেমন। তারপর সুযোগ বুঝে নিজের মত রাখবি। আংকেলের সব অন্যায় কেন মেনে নিবি?”
“তুই বাবাকে চিনিস না। আমি এই চার বছরে তার যেই রূপ দেখেছি, মনে হচ্ছে না আমি তার হাত থেকে মুক্তি পাবো। মনে বলছে সামনে আরো ভয়ংকর কিছু দেখতে হবে।”
চলবে-
#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-০৪||
০৭।
ফোন বাজতেই কপালে ভাঁজ পড়লো আহির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো বিছানা ছেড়ে। ড্রেসিং টেবিলের পাশে ফোনটা রাখা। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে ফ্যানের দিকে তাকালো। ধীর গতিতে ফ্যান ঘুরছে। গরমে ঘেমে একাকার আহি। বিছানা ছেড়ে উঠেই ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এলো। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ফোনের কাছে এলো সে৷ বাবার কল দেখে ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠলো আহির। ফিরতি কল দিলো সেই নম্বরে৷ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠের স্বর ভেসে এলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা তো রিজওয়ান কবিরের নম্বর, তাই না?”
“জ্বি, স্যার এখন ব্যস্ত আছেন। আমি উনার ম্যানেজার বলছি।”
“বাবাকে একটু দেওয়া যাবে। আমি উনার মেয়ে ওয়াসিকা কবির।”
“জ্বি, স্যার এখন কথা বলতে পারবেন না। আপনার জন্য স্যার মেসেজ দিয়েছেন।”
“কি মেসেজ?”
“স্যার আপনার সাথে দেখা করতে পারছেন না। উনি জরুরি কাজে আজই সিলেট যাচ্ছেন। স্যার আপনাকে একাই চট্টগ্রাম যেতে বলেছেন।”
আহি নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার ঠোঁটের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো।
কাঁপা কন্ঠে বললো, “আচ্ছা।”
এরপর কল কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত দিয়ে নিজের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করলো আহি। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়েই পড়লো। সে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
“কারো কি আমার জন্য একটুও সময় নেই?”
পাশ ফিরতেই আহির নজর পড়লো বাদামী মলাটের সেই ডায়েরীটির দিকে। আহি ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে ডায়েরীটা হাতে নিলো। তারপর সেটা বুকের সাথে জড়িয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ধীর গতিতে ঘূর্ণনরত ফ্যানটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
…………………..
দিনটি ছিল শুক্রবার। চারুশিল্পে ক্লাস শেষ হতেই আফিফ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আহি আফিফের ব্যস্ততা দেখে হুড়োহুড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগে খাতা ঢুকানোর সময়টাও যেন পেলো না। খাতা-পেন্সিল হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়লো আহি। আফিফ সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে পড়লো। আহিও আফিফের পিছু নিয়েছে। কেন পিছু নিয়েছে তা আহি নিজেও জানে না। আফিফ দ্রুতপদে গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আহিও কিছুটা দূরত্ব রেখে আফিফের পিছু পিছু হাঁটছে।
ব্যস্ত রাস্তা, তবে আজ যান চলাচল হালকা। ছুটির দিন, তাই হয়তো। আজ জুমার দিন। মসজিদে তাড়াতাড়ি আযান দিচ্ছে। আফিফ হয়তো তাই এতো দ্রুত গতিতে হাঁটছে। ভাবতেই আহির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। আফিফ কি তাহলে নামাজ পড়বে? কিন্তু আহি তো নামাজ পড়ে না। সেই ছোট বয়সে মায়ের কাছে নামাজ শিখেছিল সে। কিন্তু এখন আর পড়া হয় না। সারাদিন সে এটা-সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মা প্রতিদিন নামাজের সময় হলে বলে যান। কিন্তু আহি মায়ের কথা শুনে না। বকাঝকা করলে আহির বাবা রিজওয়ান কবির মেয়েকে আস্কারা দিয়ে বলেন, মেয়ে এখনো ছোট। বড় হলে পড়বে। যদিও রিজওয়ান কবির নিজেও জুমার দিন ছাড়া মসজিদে দূরে থাক, বাসায়ও নামাজ পড়েন না। বাবার শিক্ষাটায় বোধহয় আহি পেয়েছে।
আফিফ রাস্তার ওপাড়ে। আহি অন্য পাড়ে। সমান্তরাল রাস্তা। যেন কখনোই মিলিত হবে না এই পথ। মাথা নিচু করে হাঁটছে আফিফ। গরমে ঘেমে গেছে সে। পরণের নীল শার্টটা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে সেঁটে আছে। কাঁধের একপাশে কালো ব্যাগ। হাতে একটা ধূসর বেল্টের ঘড়ি। পায়ে মলিন স্যান্ডেল। আহি দূর থেকে মুখস্থ করে নিচ্ছে আফিফের প্রতিটি পদচিহ্ন। পাশের একটা মসজিদে ঢুকে পড়লো আফিফ। আহি এপাশ-ওপাশ তাকালো। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আফিফের অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সে রাস্তা পার হয়ে মসজিদের কাছে আসতেই দেখলো অনেকে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে ঢুকছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভীষণ বেখাপ্পা লাগছে তার। তাই সে মসজিদের সামনে থেকেই একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই নিজের ঘরে চলে গেলো আহি।
(***)
মিসেস সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে এসেই দেখলেন আহির ঘরের দরজা খোলা। মিসেস সালমা এমন ঘটনায় ভীষণ অবাক হলেন। কারণ আহি সবসময় দরজা বন্ধ করে রাখে। মিসেস সালমা দরজা হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই চমকে উঠলেন। দেখলেন মেয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে মোনাজাত ধরে রেখেছে। রাতারাতি আহির এমন পরিবর্তন ভীষণ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার কাছে। আহির মোনাজাত শেষ হতেই তিনি ধীর কন্ঠে বললেন,
“ভেতরে আসবো, আহি?”
আহি মায়ের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,
“আসো মা।”
মিসেস সালমা ফাওজিয়া একনজর পুরো ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,
“তুমি আজ হঠাৎ নামাজে বসেছো!”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“আজ থেকে আমি নামাজ বাদ দেবো না, মা। আমি যা চাই, আল্লাহর কাছেই চাইবো।”
“বেশ তো! কিন্তু তোমার ঘরে নামাজ পড়লে তো নামাজ হবে না।”
“কেন?”
“এখানে এতো ছবি ঝুলছে! তুমি লাইব্রেরী রুমে গিয়ে নামাজ পড়ো। ওখানে একপাশে নামাজের ব্যবস্থা আছে।”
“মা, আমি নিরিবিলিতে নামাজ পড়বো। আল্লাহর সাথে আমি কিছু সিক্রেট কথা বলবো। ওখানে তো যে-কেউ এসে পড়বে।”
“তুমি যখন নামাজ পড়বে, তখন লাইব্রেরি রুম বন্ধ করে পড়তে পারবে। কেউ তোমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।”
“আচ্ছা।”
সালমা ফাওজিয়া মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আহির মাথায় চুমু খেলেন। আর আহির ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। সে মনে মনে বলল,
“এআর, এখন তুমি আমার হবেই হবে। আমি আল্লাহর কাছে তোমাকে চেয়ে নিচ্ছি।”
……………………
আহির গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে বালিশের উপর আছড়ে পড়লো। কান্নাভেজা কন্ঠে সে বলল,
“আমি সেদিন থেকে তোমাকে চেয়েছি, এআর। একটা রাত, একটা দিনও বাদ যায় নি, যেদিন আল্লাহর কাছে তোমাকে চাই নি। তাহলে তোমাকে কেন পেলাম না আমি? এআর, খুব ইচ্ছে হয় তোমার হাত ধরে হাঁটতে। খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে জড়িয়ে ধরতে। তুমি কেন আমার হলে না, এআর?”
আহি শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ডায়েরীটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে বালিশে মুখ গুঁজলো। হঠাৎ আহির ফোনটা বেজে উঠলো। চোখ মুছে ফোন হাতে নিতেই দেখলো রাদের কল। আহি বোতল থেকে অল্প কিছুটা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“দুপুরে খেয়েছিস?”
আহি নিঃশব্দে হাসলো। রাদ বলল,
“এই মুহূর্তে আমার কলটা করা খুব দরকার ছিল।”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“তুই না থাকলে আমাকে হয়তো অনেক আগেই পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হতো।”
“আউল-ফাউল কথা বলিস না। আমি আসছি ঢাকা।”
“তুই!”
“হ্যাঁ, আমি। বাসে উঠেছি। রাতে পৌঁছাবো। তোর হোটেলের ঠিকানা দে৷ আমার সাথেই চট্টগ্রাম যাবি। এমন সুন্দরী মেয়েকে আমি কি ঢাকা শহরে একা ছাড়বো না-কি?”
“বাবাদের মতো কথা বলছিস। বাবাও যদি তোর মতো করে ভাবতো!”
“এখন খেয়ে নে। এরপর কড়া এক কাপ চা খাবি। চা খেলে মাথায় যে পোকাটা ঘুরাঘুরি করছে, সে অন্তত কিছু সময়ের জন্য বের হবে।”
(***)
মধ্যাহ্নের শেষভাগ। আহি হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে হাঁটছে। রাস্তার পাশে খাবারের দোকানগুলো ভীষণ অপরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে তার। কিন্তু ক্ষিধেও পেয়েছে খুব। তাই একটা রেঁস্তোরায় ঢুকে পড়লো। অনুন্নত রেঁস্তোরা, একটা চাপা দুর্গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। মধ্যাহ্নের সময়, তাই রেঁস্তোরায় তেমন ভীড় নেই। যারা আছে, তারা চা-সিঙ্গারা খাচ্ছে। একটা আট-দশ বছর বয়সী ছেলে আহির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি খাইবেন, আফা?”
আহি ছেলেটিকে ভালোভাবে পরখ করে বলল,
“ভাত হবে?”
“না আফা। শেষ হইয়া গেছে।”
“এখন কী পাওয়া যাবে?”
“সিঙ্গারা, সমুচা, চিকেন রোল….”
আহি ছেলেটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এসব ছাড়া আর কিছু নেই?”
“ফরোটা আর ভাজি আছে। কিন্তু সময় লাগবো।”
“ওটাই নিয়ে আসো।”
“ফরোটা কইডা আনবো আফা?”
“দুইটা।”
আহি খাবার অর্ডার করে পাশ ফিরে তাকাতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। পাশের টেবিলে চার-পাঁচটা ওয়ান টাইম কাপ রাখা। আহি কাপগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনটি।
…………………….
চারুশিল্প থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মতো আজও আহি আফিফের পিছু নিয়েছে। রোদের উত্তাপ আজ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম। মৃদু সমীকরণে নির্মল বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। আফিফ রাস্তার পাশে টংয়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিও কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। আফিফ অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা হাওয়ায় আফিফের কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো দুলছে। আহির মন চায়ছে চুলগুলো আলতো হাতে স্পর্শ করতে আর যত্নের সাথে গুছিয়ে দিতে। টংয়ের দোকানদার একটা প্লাস্টিকের কাপ আফিফের দিকে এগিয়ে দিতেই সে টাকা এগিয়ে দিলো। এরপর সে পাশে থাকা ছোট একটা বেঞ্চে বসে চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আফিফ জানতেই পারলো না, তার চা খাওয়ার দৃশ্যটি কেউ মুগ্ধ চোখে দেখছিলো।
চা খাওয়া শেষ হতেই আফিফ কাপটি বেঞ্চের উপর রেখে চলে গেলো। আর আহি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই কাপটি উঠিয়ে নিলো। এরপর বাসায় এসে টেবিলের উপর কাপটি রেখেই ডায়েরী খুলে লিখতে বসলো।
“ক্লান্ত মুখ। নাকের ডগায় জমে ছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। হালকা হাওয়া তোমার ঘর্মাক্ত কপালটি শুকিয়ে দিয়ে গেলো। আর তোমার ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলোও মুক্ত হলো। তুমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা ভাঙা বেঞ্চে বসলে। কাপে চুমুক দিতেই তোমার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। চা নিশ্চিত গরম ছিল। কিন্তু তোমার কপালে একটুও ভাঁজ পড়লো না। শুধু চোখ দু’টোই সাড়া দিয়েছিল। আজ কেন যেন মনে হলো তুমি শুধু ক্লান্ত নও। বড্ড ক্লান্ত। তোমার মনে কি ভীষণ কষ্ট, এআর? আমাকে ভাগ দিবে সেই কষ্টের? আমি তোমার কষ্ট নিয়ে নেবো। দেখবে তুমি খুব সুখী হবে। অনেক সুখী হবে। কারণ তোমার জন্য আমি আছি।”
কলম উঠিয়ে নিলো আহি। টেবিলের উপর রাখা প্লাস্টিকের কাপটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে লেখার পাশেই আজকের দৃশ্যটা স্কেচ করতে লাগলো।
একটা ছেলে কাঠের ভেঙে বসে প্লাস্টিকের কাপ হাতে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। পাশে টংয়ের দোকান। আর দূরে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে সেই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।
স্কেচ শেষ করেই ডায়েরীটা আলমারিতে তুলে রাখলো আহি। আর কাপটাও ওভাবেই প্লাস্টিক পেপারে মুড়িয়ে একটা তালা দেওয়া বাক্সে রেখে দিলো। এই বাক্সটিতে আহি সবসময় তালা ঝুলিয়ে রাখে। খুব প্রয়োজন হলেই সে বাক্সটি খুলবে।
……………………
খাবার আসতেই আহির ঘোর কাটলো। তার চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। আট-দশ বছর বয়সী সেই বাচ্চা ছেলেটা কি বুঝলো কে জানে? সে হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
“আফা কারো কতা মনে ফরছে নি?”
আহি হালকা হেসে বলল,
“না, তো। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ নাকে লেগেছে। পাশেই তো রান্নাঘর তাই হয়তো।”
“আফা, আমি ওইখান থেইক্কা দেখতাছিলাম আপনারে। আগে কারো সাথে আইছিলেন মনে অয়।”
রেঁস্তোরার মালিক পাশেই ছিলেন। তিনি হয়তো ছেলেটার কথাগুলো শুনে ফেলেছিলেন। তিনি ধমকের সুরে বললেন,
“ওই মিন্টু, ওই টেবিলে চা দিয়া আয়। উনাদের এতোক্ষণ বসায় রাখছোস কেন?”
আহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। দোকানের মালিককে নীরবে ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে টাকা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতেই ভাবতে লাগলো,
“এআর সত্যিই কি তুমি তোমার সব কষ্ট আমাকে দিয়ে সুখী হয়েছো? দেখো না, আমি এমন একটা মিনিট যায় না, যখন তোমাকে নিয়ে ভাবি না। তুমি আমার রক্তের সাথে মিশে গেছো। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে তোমাকে হারানোর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এমন কোনো স্থান নেই, চেনা-অচেনা যেখানে তোমাকে আমি অনুভব করি না। এভাবে কাউকে ভালোবাসা কি খুব দরকার ছিল? তুমি কি কখনো আমার মতো করে ভালোবাসতে পারতে? পৃথিবীর কেউ কি কখনো এমন উন্মাদের মতো কাউকে ভালোবেসেছিল? এমন কেউ যদি থাকতো, আমি তার কাছে গিয়ে মুক্তির পথ খুঁজতাম। কার ভালো লাগে কষ্ট পেতে? কার ভালো লাগে চোখ ভেজাতে? শুনেছি কাঁদতে কাঁদতে না-কি চোখ শুকিয়ে যায়। কে বলেছে এই কথা? আমার চোখ তো আজও তোমার স্মৃতিতেই ভিজে উঠে। আমার অশ্রু বিরামহীন ভাবে গড়িয়ে পড়ছে। আর হৃদয়টা হয়ে যাচ্ছে বিরান মরুভূমি।”
চলবে-