#উদাসীনী (৮)
#Ditipriya_Roy
প্রভাতের আলো ফুটতেই উদাসীর ঘুম ভেঙে যায়। কেউ তাকে আসটে-পিসটে জড়িয়ে আছে। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। মুখটা তুলে মানুষটাকে দেখতেই লজ্জায় মানুষটার বুকে মুখ গুঁজে দেয়। উঠতেই গেলেই জেগে যাবে, তাই ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে। জানালা ভেদ করে ফারহানের মুখে আলো পড়ছে। উদাসী নিজের হাত দিয়ে আলো টাকে ঢেকে রাখে।
ফারহানের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখ খুলে উদাসীর দিকে তাকায়। উদাসী লজ্জা পেয়ে মুখটা সরিয়ে নেয়।
ফারহান মৃদু হেসে উদাসীকে বলে, শুভসকাল বউ।” উদাসী শুভসকাল বলে উঠতে চাইলে ফারহান শক্ত করে ধরে রাখে। ” কি করছেন স্যার?
–আমি তোমার বর তুমি আমার বউ তাহলে স্যার কথাটা কই পেলে।” উদাসী বলে, আমি আপনাকে স্যার বলেই ডাকবো। ” তাহলে আমিও তোমাকে ছাড়বো না এই ভাবেই ধরে রাখবো।
— উদাসী রাগী ভঙ্গিতে বলে, এটা কিন্তু মোটেও ভালো হচ্ছে না স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন আপনার মা কি বলবে।”আমার মা কিছুই বলবে না নতুন বিয়ে বর বউয়ের তো প্রাইভেসি আছে তাই না। তাছাড়া সকাল সকাল নতুন বউয়ের কাছ থেকে মিষ্টি না পেলে হয়।
— প্রাইভেসি আপনার কাছে রাখুন। আমাকে উঠতে না দিলে আপনাকে মিষ্টি কি ভাবে দিব।” বউগো এটা এই মিষ্টি সেই মিষ্টি নয়।
— তাহলে কিসের মিষ্টি?” ফারহান টুপ করে উদাসীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দেয়। ” উদাসী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। ফারহান কে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। ক্ষীণ হেসে আবার শুয়ে পরে।”
— কিচেনে রান্না করছে নীলিমা। উদাসী গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। ” গুড মর্নিং উদাসী। উদাসী আলতো হেসে উত্তর দেয় গুড মর্নিং মা। মা আমি কি আপনাকে হেল্প করে দিব।
— না মা তুমি নতুন বউ, তাছাড়া আমি করে নিব।” মা টুকটাক কাজ থাকলে বলে দিন আমি করে দেই। “তুমি খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখো।
–আচ্ছা মা। ” উদাসী সুন্দর করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে। ” নাদিয়া উপর থেকে এসে উদাসী কে বলে, গুড মর্নিং ভাবি। ” গুড মর্নিং।
— ভাইয়া এখনো উঠে নি ভাবি?” না আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। “ওহ তা কাল রাতে তাহলে ঘুম হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। ” ফারহান এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
— হবে কি ভাবে, আকাশের চাঁদ যদি ঘরে থাকে তাহলে ঘুম তো এমনিতেও আসবে না।” ফারহানের কথা শুনে উদাসী কিচেনের দিকে যায়।
— খাওয়া শেষ হলে ফারহান রুমে যায়। উদাসী খাবারের প্লেট গুলো পরিস্কার করছিলো। নীলিমা এসে বলে, তুমি রুমে যাও আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।
— হাত ধুয়ে চলে যায় উদাসী। ” ফারহান কে রেডি হতে দেখে উদাসী বলে, আপনি কোথাও যাচ্ছেন?” হ্যাঁ একটু কাজ আছে।” আমার ঘড়ি টা একটু খুজে দেও তো। ” ডয়ারে খুঁজতে গিয়ে একটা এলবাম দেখতে পায়। এলবামমের সাথেই ছিলো ঘড়ি। এলবাম টা বের করে উল্টিয়ে দেখতেই অবাক হয়ে যায়। পারহানের সামনে গিয়ে এলবাম টা দেখিয়ে বলে,
— আপনি কি আগে পুলিশের চাকরি করতেন?” হ্যাঁ করতাম এক সময়। ” ছেড়ে দিলেন কেনো?
— অনেক কথা বউ পরে তোমাকে লম্বা একটা সময় নিয়ে বলবো।” উদাসী প্রত্যুত্তরে কিছু না বলেই এলবাম টা রেখে দেয়। ফারহান চলে যায় তার গন্তব্যে।
— সারাদিন নাদিয়া আর নীলিমা উদাসীকে একা রাখে নি। তাদের মাঝেই উদাসী সমস্ত কিছু ভুলে গেছে। মানুষ গুলো যে তাকে এই ভাবে আগলে রাখবে তার যে একটা সুন্দর সংসার হবে কখনো ভাবে নি।
— সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে উদাসী। পিনপিনে নিরাবতা চারিদিকে,বাগানে ঝিঝিপোকা ডাকছে, কয়েকটা জোনাকিও আছে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। উদাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা- মার কথা মনে পড়ছে। তারা বেঁচে থাকলে দেখতে পেতো তাদের মেয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। আঁখি দিয়ে অশ্রু পড়ছে।
— ঘারে কারো হাত পড়তেই চমকে উঠে উদাসী। পিছন ঘুরে তাকায় সে। ফারহান কে দেখে এক চিলতে হাসি ফুঠে মুখে। তারাতাড়ি অশ্রু মুছে নেয়।” ফারহান জড়িয়ে ধরে বলে, আমার বউটা কাঁদছে কেনো?
— না বাবা- মার কথা মনে পড়ছিলো। আপনি কখন এলেন? ” একটু আগে। উদাসী একটা কথা বলবো?
” হুম বলেন। ” আমাকে ভালোবাসো? ” উদাসী ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলে, জানি না। ” লজ্জা পাচ্ছো বউ, বলে দেও আমি তো তোমার স্বামী হই বলো।
— ফারহানের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে, হ্যাঁ ভালোবাসি আপনাকে। ” ফারহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, ইস রে আমার বউ আমাকে পাগল বানিয়ে দিবে। ফারহান উদাসীকে কোলে করে নিয়ে ভিতরে যায়। বেডে বসিয়ে দেয়। তারপর একটা বক্স এনে হাতে দেয়।
–উদাসী বিস্মিত কন্ঠে বলে, এটা কিসের বক্স। ” বক্সটা খুলতে খুলতে বলে, এখানে একটা ফোন আছে। এটা তোমার জন্য সব কিছুই সেট করে দিয়েছি। যখন ইচ্ছে আমাকে ফোন করতে পারবে।
উদাসী মৃদু হেসে বলে, একটা ছবি তুলে ওয়েলপেপার করে রাখি। ” ফারহান অনেক কয়টা ছবি তুলে দেয় ৷
— ফারহান ওয়াশরুমে চলে যায়। ফোনটা বেডে রেখে গেছে। উদাসী নিজের নতুন ফোন পেয়ে খুব খুশি হয়েছে, সেটাই দেখছে। মুহূর্তেই ফারহানের ফোন বেজে উঠে। নাম সেভ করা নেই, একটু দেখে রিসিভ করে নেয়। অপর পার্শ্বের ব্যক্তিটি গম্ভীর গলায় বলে
— ফিরে এসেছি আমি তোর সুখের সংসার শেষ করে দিবো। ঠিক যেমন টা আমাকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, আমার এতো সাধনার ব্যবসা তোর কারণে নষ্ট হয়েছে। সেই প্রতিশোধ নিতে এসেছি। তোর বউকে বেলকনিতে দেখেছি, হেব্বি দেখতে সামলিয়ে রাখিস। শুধু তাই নয় তোকেও আমি নিজের হাতে মারবো। তবেই আমার ভিতরের জ্বালা মিটবে। কথা গুলো বলেই কেটে দেয়।
— লোকটির কথা শুনে উদাসীর ভিতরে ভয় জমিয়ে গেলো নিমিষেই। কোন ঝড় আসতে চলেছে তার জীবনে। তার কাছের মানুষ গুলোকে হারিয়েছে। তার স্বামীকে হারাতে পারবে না সে। তার এই মানুষটাই যে সব কিছু।” ফারহান ওয়াশরুম থেকে বের হলে উদাসী দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
— কি হলো উদাসী কাঁদছ কেনো? ” আমি আপনাকে হারাতে চাই না। আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। ওই লোকটা আাপনাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। আপনাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবো না। আল্লাহ আপনার আগে যেনো আমাকে তুলে নেয়।
— উদাসী শান্ত হও, কে কি বললো আর এই লোকটা কে?” আমি জানি না আপনার ফোনে কল দিয়েছিলো আমি রিসিভ করতেই অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দেয়। ” কী বলেছে লোকটা? ” লোকটির বলা সব কথা ফারহান কে বলে দেয়।
— ফারহান উদাসীর চোখের পানি মুছে জড়িয়ে নেয়। ” ফারহানের বুঝতে বাকি নেই লোকটি কে। কিন্তু উদাসী এসব কিছু জানাটাই ভুল। সে উদাসীকে এগুলোর সম্মুখে আনতে চায়না, ভয় বাড়াতে চায় না, সে টেনশন করুক সেটাও চায় না। তবে তার এই ভালোবাসার মানুষটির দিকে হাত বাড়ালে তাকে লাশ বানিয়ে দিবে।
— লোকটি কে ছিলো স্যার আর আপনি আমাকে সব কিছু বলুন আমি জানতে চাই? ” উদাসী তুমি ভয় পেয়েও না কিচ্ছু করতে পারবে না ওই লোক। লোকটি খুব বাজে ছিলো বাজে ব্যবসা করতো যখন আমি পুলিশের চাকরি করতাম তখন ওই লোকটির ব্যবসা নষ্ট করে দেই৷ ওই লোকটিকে ধরতে পারি নি অনেক খোঁজা হয়েছে। পুলিশের চাকরিটা মায়ের জন্যই ছেড়ে দেওয়া। অনেক ক্রিমিনাল এখন শত্রু হয়েছে এর জন্যই মা শিক্ষকতার পেশাটা হাতে ধরিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। ”
— প্রতিটা মুহূর্তে আমার সাথে বিপদ লেগে থাকে। ” ওই লোকটা আপনার ক্ষতি করে দেবে, চলুন আমরা গ্রামে চলে যাই। আমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাই না। এই পৃথিবীতে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।
আপনি তো এখন পুলিশের চাকরি করেন না। সব থেকে আপনার জীবনের ঝুঁকি বেশি।
— আমি স্যারের সাথে কথা বলছি উদাসী তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। আর আমি ইন্সপেক্টর ফারহান আমাকে সবাই চেনে। কিন্তু আমি পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি এটা কেউ জানে না। স্যার কাউকে বলতে দেই নি। সব থেকে বড় কথা আমি অন্যেয় সহ্য করতে পারি না।
— উদাসী একমনে ফারহানকে দেখেই যাচ্ছে। লোকটা যতই বলুক আমার এই মনের ভয় দূর হওয়ার নয়। আমি যে ঝড়ের আভাস পাচ্ছি, কি হবে এই ঝড়ে?
— বউ চলো এতো ভাবতে হবে না, সব কিছুই তোমার বর সামলে নিবে। আর খুব খিদে পেয়েছে খাবো আমি চলো আমার সাথে। নাদিয়া আর নীলিমা বসে টিভি দেখছে। উদাসী আর ফারহানের জন্য ওয়েট করছে। রুম থেকে দুজনে বেড়িয়ে আসে।
– উদাসীর মন টা বিষন্ন দেখে নীলিমা বলে, কি হয়েছে উদাসী তোমার মুখ টা কেনো এমন দেখাচ্ছে কেনো?
ফারহান বলে, ” কিছু হয়নি খেতে দেও আগে।
” খাবার খাওয়ার পর চুপ চাপ দুজনে চলে যায়। খাবার সময় উদাসী কোনো কথাও বলে নি। ঘুমাতে গিয়েও উদাসী চুপচাপ শুয়ে পরে। ফারহান উদাসী কে ঘুরিয়ে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।
#চলবে