#উদাসীনী (5)
লেখনীতে – Ditipriya Roy
ঘরে গিয়ে বিছানার দিকে দৃষ্টি যেতেই তার পৃথিবী যেনো থেমে গেলো। সামনে রক্তের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ,
মনে হচ্ছে কেউ কুপিয়ে মেরেছে। বাবা বলে বসে পরে উদাসীনী, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা কাজ করছে না, উচ্চ স্বরে কান্না করতে থাকে। উদাসীনীর চিৎকার শুনে শফিক তার বউ দৌড়ে চলে আসে। অলক এখনো দুটো বাড়ি পার হয়নি,সেও দৌড়ে চলে আসে। অলক এসে বলে, এই উদাসী কি হয়েছে তুই এভাবে কান্না করছিস কেনো?শফিক বলে, এই উদাসী মা কি হইলো তোর। উদাসীনী হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে দেয়।” উদাসীনীর বাবার দেহ দেখে সবাই যেন থ মেরে গেলো। বিশ্বাস হচ্ছে না কারোর, কেউ এভাবেও মারতে পারে একটা মানুষকে। অলক তারাতাড়ি ফারহান কে ফোন করে দেয়। ফারহান কথাটা শুনেই আজওয়াদকে সাথে নিয়ে উদাসীনীদের বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
— অল্প সময়ের মধ্যে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে যায়। সবাই বলা বলি করছে, উদাসীনীর বাবাকে কে মারতে পারে। মেয়েটার কি হবে, মেয়েটার এই পৃথিবীতে আর কেউ রইলো না। এর মাঝেই আজওয়াদ কে দেখে সবাই সরে যায়। সাথে তারা পুলিশকেও এনেছে। ফারহান উদাসীনীর বাবার দেহ দেখেই মাথায় হাত দেয়। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এটা কার কাজ৷ সে উদাসীনীর ঘরে গিয়ে উদাসীনীর পাশে দাঁড়ায়। ফারহান শান্ত কন্ঠে বলে, উদাসীনী।
— আসতে আসতে চোখ তুলে তাকায় ফারহানের দিকে। ফারহানকে দেখে উচ্চ সরে আবার কাঁদতে থাকে। ফারহান উদাসীনীকে জড়িয়ে ধরে, মেয়েটাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না। উদাসীনী ফারহান কে বলছে, আমি বাবার কাছে যাবো স্যার, আমার বাবা কে এনে দিন না। বাবা ছাড়া এই পৃথিবীতে যে আর কেউ নেই আমার। এই ভাবে কিছু ক্ষণ থাকার পর উদাসীনী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
–পুলিশ উদাসীনীর বাবার লাশ নিয়ে গেছে। যে খুন করেছে সে কোনো প্রমাণ রেখে যাই নি। খুব চালাক ছিলো, যে কারণেই প্রমাণ নেই। তবে পোস্টমর্টেম করতে হবে যদি কিছু পাওয়া যায়।
— উদাসীনীকে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। তার কাপর, বই, সব কিছুই গাড়িতে তোলা হয়েছে। আজওয়াদ গ্রামের লোকদের বলেছে, আজকের পর থেকে উদাসীনী চৌধুরী বাড়িতেই থাকবে। যেহেতু উদাসীনীর বর্তমান কেউ নেই, তাই গ্রাম বাসিকেই বলা হয়েছে।
— চৌধুরী বাড়িতে এসেই এক্সট্রা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তার কেউ ডাকা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, পেশেন্টের মেন্টাল কন্ডিশন খুব একটা ভালো না। তাকে ডিপ্রেশনে রাখা যাবে না। এতে বিপরীত কিছু হতে পারে যা রোগীর জন্য ঝুঁকি। আশা করি আপনারা বুঝবেন। এই ওষুধ গুলো নিয়ে আসুন, দরকার পরলে ফোন করে নিবেন।
— উদাসীনীর জ্ঞান ফিরতে অনেক দেড়ি আছে। ফারহান গিয়ে আজওয়াদ সাথে কথা বলছে। এখনো অব্দি আমান বা বাকি ছেলে গুলোর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো তারা পালিয়েছে, তাদের আস্তানা আজওয়াদের জানা আছে তাদের কে পাই নি।
— রাত ১০ টা বাজে ফারহান জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কি যেনো ভাবছে আবার কাকে ফোন করছে। উদাসী ঘুমের মাঝেও বলছে, বাবা বাবা।ফারহানের কর্ণকুহরে উদাসীনীর কথা পৌঁছাতেই তার কাছে আসে। একটুপর আবার চুপ করে যায়। উদাসীনীর দিকে চেয়ে আছে, মেয়েটার মুখে মায়া ছড়িয়ে আছে। এই বয়সে এই টুকুর মেয়ের জীবনে এতো ডিপ্রেশন। এই মেয়ের পাশে কেউ না থাকলে হয়তো মেয়েটা অঘটন ঘটে বসবে।
— সকালে সূর্যের আলো জানালা ভেদ করে উদাসীনীর মুখে পড়ছে। উদাসীনী পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। তারপর চারপাশ টা দেখে, উঠে বসে।” মদিনা দেখতে এসেছিলো উদাসীনী উঠেছে কি না। উদাসীনী কে বিছানার মাঝখানে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে যায় ডাইনিং রুমে। ” স্যার স্যার উদাসী উঠে গেছে।
–ফারহান মদিনাকে গরম দুধ নিয়ে আসতে বলে। তারপর উদাসীনীর কাছে যায়, সাথে নূরের মা আর নূর আসে। উদসীনীর মুখে মলিনতা ধরা দিয়েছে, চোখ গুলো ফুলে গেছে। নূরের মায়ের উদাসীনীকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। কি নিরীহ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। উদাসীনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, কেমন লাগছে উদাসী। ” উদাসীনী কোনো কথা বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে। মদিনা দুধ এনে দেয় নূরের মা ফারজানা কে। দুধ খেতে বললেও খাচ্ছে না চেয়ে আছে। ” উদাসী না খেলে যে অসুস্থ হয়ে পড়বে, খেতে হবে তো। ” উদাসীনী ফারজানা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে।
— পাগলি মেয়ে একটা,খেয়ে নেও মা। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।” আমার বাবা আর নেই আন্টি, এই পৃথিবীতে আর কেউ থাকলো না আমার। উদাসীনীর কান্না দেখে ফারজানা আর থাকতে পেলো না। সেও কান্না করে দেয় সাথে মদিনাও কান্না করে। নূর উদাসীনীর পাশে বসে বলে,
— মিষ্টি আপু প্লিজ তুমি কেঁদো না। তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। ও মিষ্টি আপু দুধ খেয়ে নেও।
ফারজানা খাইয়ে দিলে অল্প একটু খেয়ে নেয়। একটু পর সবাই চলে যায় থেকে যায় ফারহান।
— উদাসীনী করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উদাসীনীর এই ছলছল চোখ দেখলেই ফারহানের বুক কেঁপে উঠছে। পাশে গিয়ে বসে উদাসীনীর উদ্দেশ্য বলে, উদাসী জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই। তবে এটা ভেবো না তোমার পাশে কেউ নেই, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার বাবার খুনিকে আমি উচিৎ শিক্ষা দিব। সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন পথ চলা শুরু করো। তোমাকে আরো অনেকটা পথ পারি দিতে হবে। তোমার ভবিষ্যৎ সামনে পরে আছে। অন্ধকার কেটে গেলে আলোর দেখা পাবে। দুঃখ কি সব সময় থাকে, সুখ দুঃখ এই দুটো মিলেই তো জীবন।
— উদাসী চোখের জল গুলো মুছে নিয়ে বলে, সব কিছু ভুলতে চাইলে কি ভুলতে পারবো স্যার। কিছু স্মৃতি না চাইতেও চোখের সামনে ফুটে উঠে। দুঃখ টাকে সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছি। জীবনের চলার পথ টা বড্ড কঠিন। আমার বাবা তো এখনো ডাকছে, উদাসী মা কোথায় গেলি, কলেজ যাবি, আমাকে একটু পানি দিবি মা। ও বাবা আমাকে কেনো একা করে চলে গেলে। তোমার এই হতোভাগী মেয়ে টা কি দোষ করেছিলো। কেনো তাকে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে?
— কান্না করতে করতে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে উদাসী। ফারহান কথা গুলো শুনছিলো, হয়তো তার ভিতরের যন্ত্রণা কমবে। নিজেকে হালকা হালকা মনে হবে। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে ভাবে নি। তারাতাড়ি ডাক্তার কে ফোন করে। ”
— ফারহান সবাইকে ডাকলো। সবাই তারাতাড়ি রুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চলে আসলে উদাসী কে দেখে। উদাসীর অসুস্থতা বাড়ছে।” ডাক্তার ফারহান কে বলে, আপনি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই কিছু দিন থাকুক এটাই ভালো হবে। ওর মানসিক অবস্থা ভালো নেই। এখানে থাকলে ওর অবস্থা খারাপ হতে পারে। এর আগেও অনেক বড় একটা মানসিক চাপ পেয়েছিলো। যে কারণেই সে সামলে উঠতে পারছে না। ” আমরা আজকেই ওকে নিয়ে যাবো।
–উদাসীনীকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্য। মাঝ পথেই উদাসীনীর জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলে দেখে চলন্ত গাড়ির ভিতরে সে। পাশে বসেই আছে ফারহান।
উদাসীনীর শরীর খুব দুর্বল থাকার কারণে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। হাসপাতালের রুম এক্সট্রা বুক করে রেখেছে। সোজা সেখানেই চলে যায়। ডাক্তার ছিলো ফারহানের ফ্রেন্ড তন্ময় , তাই বেশ একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি।” উদাসীনীকে তন্ময়ের দ্বায়িত্বে রেখে বাসার দিকে রওনা দেয়।
— কলিং বেল বাজিয়ে প্রায় ৩ মিনিট পর দরজা খুলে দিলেন নীলিমা বেগম। ছেলেকে দেখে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।” নীলিমা ফারহানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, তুই হঠাৎ করে বাড়ি এলি যে, আবার ফোন করিস নি। ”
— মা আগে ভিতরে তো যেতে দেও।” হ্যাঁ বাবা আয়।
ফারহান সোজা রুমে চলে যায়। পিছন পিছন নীলিমা যায়, ছেলের ভাব গতি টা ভালো ঠেকছে না। চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।”
— কাপর নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ” নীলিমা বেগম কে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলোই না। আসলে ফারহান একটু চাপা সভাবের। কোনো কথাই তার মাকে বলতে চায় না, নীলিমা জোড় করার পর সে যে টুকু বলবে ওই টুকু। ”
— ছেলের জন্য কফি বানানোর জন্য বেসিনে চলে যায়। উপর থেকে নাদিয়া নিচে নামছে পানি খাবে বলে। বেসিনে এসে নীলিমাকে কফি বানাতে দেখে চোখ বড়ো বড়ে করে তাকায়। ফুফু তুমি কফি মানে পারহান ভাইয়া এসেছে।”
— হুম এসেছে।” কখন এলো,ফুফু তুমি আমাকে একটা বারো বললে না? ” তোকে কি বলবো আমি নিজেও জানি না। ” আমার যে একটা ভাই বা ভাইয়ের বউ আছে তারাও ফোন করে বলেনি। ”
— যাই হোক দেখা করে আসি তাহলে। ” মাত্রই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে ফারহান। এসে দেখে নাদিয়া বসে আছে, মুখে লেগে আছে দুষ্টুমি হাসি। বুঝতে আর বাকি রইলো না। ” তুই এখানে কি করিস পড়া নেই তোর?” আহ ভাইয়া শুধু পড়া পড়া করো কেনো? এর বাইরে কি মানুষের কোনো ইচ্ছে থাকে না?
— পড়াশোনা করতে এসেছিস এতো দূর থেকে। যা এখান থেকে নয় তো মামা কে ফোন করবো।” নাদিয়া ফারহানের কথা শুনে প্রত্যুত্তরে বলে, তোমার কপালে শাঁকচুন্নি জুটবে বলে দিলাম। কথায় কথায় ব্লাকমেইল করা আমাকে।” নীলিমা কপি নিয়ে এসে ফারহানের হাতে দেয়। নাদিয়া কে বলে, কেনো রে আমার ছেলে কি করেছে যে শাঁকচুন্নি জুটবে? তা না তো কি, তোমার ছেলে বাসায় ছিলো না সত্যি কতই না ভালো ছিলাম।” কথাটা বলেই নাদিয়া চলে যায়।
–ফোন বেজে উঠেই পরক্ষণেই, ফোনটা হাতে নিতেই মামা নাম টা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। রিসিভ করে বেলকনিতে চলে যায়৷ আজওয়াদের কথা গুলো ফারহানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে যায়। সে বিশ্বাস করতেই পাচ্ছে না এমন একটা ঘটনা ঘটবে যা ভাবনার বাইরে।
#চলবে