সজলের সাথে আমার বিয়ের বয়স সাত বছর পেরুলো। আমার কাছে মনে হয় এইতো সেদিন আমাদের বিয়ে হলো। কিন্তু অন্য লোক মানে আত্মীয় পরিজন, বন্ধু মহলে সাত যেন একটা বিশাল সংখ্যা। হবে না ই বা কেন, সাত বছরে আমার অন্তত পক্ষে দুটো গ্যাদা বাচ্চা তা না হলে নিদেনপক্ষ একটা বাচ্চাতো কোল জুড়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার কোনটিই না থাকা যেন বিশাল অপরাধ এবং তাতে করে যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান, হঠাৎ মুখোমুখি দেখা বা আমার বাড়ি বয়ে এসে আমাদের ঐ বিষয়ে খুঁচিয়ে না গেলে যেন লোকের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছিল। প্রথমদিকে কারণ বলার চেষ্টা করতাম। এখন হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি কারণ লোকে আসলে বোঝার বা জানার জন্য প্রশ্ন করে খুব কম বরং অকারণে খোঁচা দিয়ে একটু সুখানুভূতি নিয়ে নেয়। মতান্তরে বুঝিয়ে দেয় এতো পড়ালেখা, ক্যারিয়ার করেও তোমার প্রাপ্তির কোঠা শূন্য যখন তোমার কোলে কোন সন্তান নেই।
বিয়ের প্রথম চার বছর চলে যায় নিজের পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিতে। সজলও পড়াশোনার মাঝে এভাবে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে আমি ঝামেলায় পরি তা চায়নি। চার বছরের মাথায় আমি প্রথম প্রেগন্যান্ট হই। পুরো পরিবার জুড়ে একটা আনন্দের সাথে স্বস্তিও বয়ে যায়। কারণ আমাদের বাচ্চা না হওয়াতে যাদের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিলো তারা আমাদের সবসময় নাগালে না পাওয়ার কারণে আমাদের জন্য বরাদ্দ কথার হুলটুকু আমার বাবা মা বা শ্বশুর শাশুড়িকে ফোঁটাতে দেরী করতো না। গর্ভধারনের ঠিক তেইশ সপ্তাহের মাথায় আমার হঠাৎ করে প্রসব বেদনার মতো ওঠে। কি হলো বুঝে উঠতে উঠতেই অনেক সময় চলে যায়। হাসপাতালে থাকতে হয় প্রায় এক সপ্তাহ ব্লাড প্রেসার, স্ট্রেস জনিত কারণে, কোনভাবেই আমাকে সেটল করা যাচ্ছিলো না যে। আমার ডিসচার্জ নোটে লেখা হয় ‘আইইউডি ফর ইডিওপ্যাথিক রিজন’। সোজা বাংলায় আমার বাচ্চাটা কোন এক অজানা কারণে পেটে মরে যায়। আহা আমার বাচ্চাটা, আলোকিত পৃথিবীর আলোর ছোঁয়াটুকু পেলো মৃত্যুর নীল চাদরে ঢেকে। জানতে পারলো না কতোটা ভালবাসা আর মায়া নিয়ে দুজন মানুষ তার প্রতীক্ষায় একেকটা রাত কাটিয়েছে।
ডাক্তারের নির্দেশেই কেটে গেছে আরো কয়েকটা মাস কোন বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করা ছাড়া। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি চারপাশের কথার হুল ফোঁটানো মানুষগুলো কিন্তু পাল্টায়নি। হয়েছে তো মরা বাচ্চা আবার কেন চেষ্টা করছিনা সেটাই তাদের মাথাব্যথার কারণ। কি অদ্ভুত একটা সমাজব্যবস্থায় আমরা জীবন কাটাই, যেখানে অন্যের খুঁত নিয়ে কথা বলেই আনন্দ পায় বেশীর ভাগ লোকে। একবারও ভাবেনা আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ হারিয়ে আমরা কতোটা শোকে মূহ্যমান। ‘আহা বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেলো, আবারো চেষ্টা করো তাড়াতাড়ি’ এই দুটো লাইন যেন আমাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করা শুরু করলো প্রতিটা রাতে। সজল আমাকে বোঝায়, কিন্তু আমিতো জানি ওর ও কতোটা কষ্ট হয়।
তারপর আবারো একবার সৃষ্টিকর্তা সদয় হয় আমাদের প্রতি। কিন্তু ছয় সপ্তাহ যেতে না যেতেই একদিন তলপেটে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। অফিস থেকে হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে আমি তখন প্রায় অচেতন। জরুরী ভিত্তিতে আমার অপারেশন করতে হলো। দেখা গেল যাকে সৃষ্টিকর্তার দয়ার উপহার ভেবেছিলাম সেটা আসলে জীবনের আরো একটা কঠিন পরীক্ষা ছিল। আমার বাচ্চাটা এ বেলা জরায়ু পর্যন্ত না আসতে পেরে টিউবেই বসেছিল। ডাক্তাররা নাকি একে বলে একটোপিক প্রেগন্যান্সি। আরেকটু দেরীতে অপারেশন হলে নাকি আমি মারাও যেতে পারতাম। আহারে আমার ছোট্ট বাবুটা আর একটু এগিয়ে আসার সুযোগ পেলেই তো তার মায়ের জন্য এতো বড় ঝুঁকির কারণ হতোনা। তার নিজেরও হয়তো এতো সুন্দর পৃথিবীটা দেখার সৌভাগ্য হতো।
ডাক্তার জানিয়ে দিল আর একবার যদি এরকম কিছু হয় তাহলে আমার জীবন বাঁচানোই দায় হবে হয়তো। মানুষ সবচেয়ে বেশী কষ্ট পায় কিসে জানেন? কোন কিছু অর্জনে নিজের অক্ষমতায়। এমনও হয়তো না যে ঐ জিনিসটা না পেলে তার জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। তবু অক্ষমতার ঘুনপোঁকা বড় ধ্বংসাত্মক হয়। প্রতি মূহুর্তে সে মগজের প্রতিটি কোষে কোষে জানান দেয় তোমার ক্ষমতা নেই। নাওয়া খাওয়া শরীরের যত্ন ভুলে, সজল সংসারের কথা ভুলে দিনে দিনে হতাশার আমি গভীরে চলে যাচ্ছিলাম শুধু একটা বাচ্চার জন্য।
তেমনি এক গভীর রাতে সজল আমায় ঘুম থেকে তুলে দেয়।
– আঁখি তুমি ঘুমের মধ্যে কাঁদছিলে তাই তুলে দিলাম।
‘ওহ সরি’ বলে আবার শুয়ে পরলাম।
– আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। তুমি কি মনোযোগ দিয়ে শুনবে, আঁখি।
হুম বলো, শুনছি।
– আচ্ছা মানুষ পৃথিবীতে এমন বাচ্চা বাচ্চা করে কেন জানো? কারণ এটা একটা প্রকৃতিগত ব্যাপার। সব প্রাণী চায় তার বংশধর রেখে যেতে। নিজের শরীরের একটু অংশ রেখে গেলেই কি বংশধর রেখে যাওয়া হয়? পৃথিবীতে এই যে এতো এতো এতিম শিশু আছে তারা তবে কাদের বংশধর? আমরা যদি এরকম কোন এতিম শিশুর বাবা মা হই সে তো ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের অংশ হয়েই রইবে, শরীরের না হোক আমাদের আত্মার অংশ হয়ে।
এভাবে বলা অনেক সহজ সজল। কিন্তু জীবনের কোন এক পর্যায়ে যেয়ে তোমার হয়তো মনে হতেও পারে তুমি ঠকে গেছো, নিজের জিনবাহী কাউকে রেখে যেতে পারছোনা বলে।
– আঁখি, আমি তোমাকে দুই দুইবার হারাতে বসেছিলাম আমার জীবন থেকে। একজন মানুষ হিসাবে আমি তোমাকে আর কতোবার মৃত্যুর মুখোমুখি করবো বলতে পার? যদি কোনদিন আমার মনে ভুল করেও ওরকম কোন চিন্তা আসে তুমি খুব করে আমাকে বকে দিও। আমি ঠিক ঠিক শুধরে নেব নিজেকে, বিশ্বাস করো। তবু তুমি প্লিজ হতাশার কালো ছায়া থেকে বেরিয়ে আসো। শুধু নিজের বাচ্চা পয়দা করাটাই জীবনের মূল লক্ষ্য না। আরেকটা অসহায় মানুষকে জীবনের আলোকিত দিক দেখাতে পারাটাই তো জীবনের সার্থকতা।
………………….
আনিকার স্কুলে আজ বার্ষিক পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান। এ বছর থেকে ওদের স্কুলে নতুন একটা পুরস্কার চালু হয়েছে। আচার, আচরণ, মানবিকতা ও পরোপকারী একজন বাচ্চাকে সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ভোটে এই পুরস্কার দেয়া হবে ফি বছর। বাচ্চাদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের নিমিত্তে এই স্বীকৃতিমূলক পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা। পুরস্কারের নাম দেয়া হয়েছে বছরের সেরা সাদা মনের শিশু। পুরো স্কুলের সব অভিভাবক অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে কে পায় সেই পুরস্কার।
‘আনিকা রহমানের বাবা সজল রহমান আর মা আঁখি রহমানকে মঞ্চে এসে মেয়ের সাথে পুরস্কার নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে’ চোখের জল মুছে সজলের হাত ধরে মঞ্চের দিকে হেঁটে যেতে যেতে আমার সে রাতের কথা মনে হয়। যে রাতে সজল আমায় বোঝাতে পেরেছিল শুধু শরীরের অংশ দিয়েই নয় আত্মার অংশ দিয়েও পৃথিবীতে যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যাওয়া যায়।
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস