উড়ো ফোন পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
730

#উড়ো_ফোন (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

অফিস থেকে দুপুরে ছুটি নিয়ে আমার স্বামী বেলাল একেবারে লাপাত্তা, রাত আটটা পযর্ন্ত ওর ফোনটাও বন্ধ। সম্ভাব‍্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও ওর কোন হদিস পেলাম না। তার উপর আজ উড়ো এক ফোন কলে অন‍্য মহিলার সাথে ওর সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার গল্পটাও জানা হল। ব‍্যাংকে আমাদের সংসারের জমানো কষ্টের টাকার বড় একটা অংশ ও আমাকে না জানিয়েই তুলেও ফেলেছে। একই সাথে আজ এতকিছু গোপন কথা জানা, সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টিকে আর নিতে পারিনি। বিছানায় কলাপস করলাম। আমার ছেলে আর মেয়ে কখনোই আমাকে এভাবে অসুস্থ হতে দেখেনি, ভীষণ ভয় পেয়ে দ্রুতই প্রতিবেশীদের ডেকে আনে।

মাথায় পানি ঢালার পরপরই আমার জ্ঞান ফিরে। চোখ খুলতেই দেখি আমাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা তৈরী হয়েছে। এর মধ‍্যেই আমার চোখ বেলালকে খুঁজে যাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে একটানা “বেলাল, বেলাল” বলে গেলাম। মেয়েটা আমাকে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে, ভীষণ ভয় পেয়ে আমার হাতটা জোর করে ধরে রাখলো। ছেলেটাকে দেখলাম পানি ভর্তি মগ হাতে দাড়িয়ে আছে, আরেকদফা পানি ঢালার প্রস্তুতিতে। খুব অসহায় পারিবারিক এক মুহূর্ত।

ঠিক এমন সময় বেলাল হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার হাত ধরে চি‍ৎকার করে বলতে লাগলো “সাদিয়া তোমার কি হয়েছে? সাদিয়া ঠিক আছতো?” আরিশার বাবার আমার হাত ধরে ছলছল চোখে বারবার করা এই জিজ্ঞেসটাতে আমি নিশ্চিত হলাম, বেলাল আসলে কারো সাথে কোন প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কে নেই। অন‍্য কারো সাথে সম্পর্কে ভাসা কোন প্রেমিকপ্রবর তার স্ত্রীর অসুস্থতায় এভাবে জেনুইন রিএক্ট দিতে পারে না। আর তার চাইতেও বড় কথা বেলালকে আমি বাইশ বছর ধরে চিনি। ওর চোখ দুটো বলছে আমার প্রতি ওর ভালোবাসা এখনো প্রশ্নাতীত, আমাকে হারানোর ভয়ে সে ভীষণ ভীত। ও আমাকে ভালোবাসে ঠিক প্রথমদিনের মতোই কিংবা তার চাইতেও আরো বেশি।

আমার হঠাৎ এই অসুস্থ হয়ে যাওয়ার খবরটা সম্ভবত বেলালের বাসায় ঢোকার মুখেই পাওয়া। এরপরই ওর অপ্রকৃতিস্হের মতো ছুটে আসা, আমার কাছে কিন্তু এটা অনেক কিছু মিন করে। চকিতেই বুঝে নিলাম সময় নিয়ে বুঝতে হবে, সত‍্যটা কি? তাইতো মাথা গরম না করে পুরো পরিস্হিতিকে ট‍্যাকেল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বেলালকে দেখেই সম্ভবত শরীরের জোর ফিরে পেলাম, নিজে থেকেই উঠে দাড়ালাম। এরপর আগত প্রতিবেশীদের ধন‍্যবাদ ও আশ্বস্ত করে সোফায় বসে পড়লাম, স্বস্তির একটা অনুভব নিয়েই। এই অল্পক্ষণেই আমি নিশ্চিত পুরো বিষয়টি একটা মিস আন্ডারস্ট‍্যান্ডিং। যেভাবেই হউক ক্লিয়ার হতে হবে, বেলালের কাছ থেকেই।

এরপর বাসায় যা ছিল তা দিয়েই আজ সবাই একসাথে বসে ফ‍্যামিলি ডিনার করলাম। পুরো সময়টাতে সবাই একেবারে চুপচাপ,বাসায় হঠাৎই এ ধরনের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায়। বেলাল বুদ্ধিমান ছেলে, আমি ওর কার্যকলাপ জেনে ফেলেছি বা আমাকে ও আগেভাগে এসব জানায়নি, এর প্রতিক্রিয়াই আজকের এই ঘটনা, এটা বুঝে যায়। তবে কারণ যেটাই হউক, ওর চোখেমুখে অনুশোচনার ছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আমি চাইলাম বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলেই ওর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে। ততোক্ষণে আমার জোর ধারণা বেলাল হয়তো কোন গোপন সমস্যায় আছে যা আমাকে বলতে চায়নি বা চাইছে না।

“আমাকে মাফ করে দিও সাদিয়া। এখন বুঝতে পারছি, মা গুরুতর অসুস্থ এই কথাটা তোমাকে না জানানোটা ভীষণ অন‍্যায় হয়ে গেছে। সত‍্যি করে বলছি, আমার পরিবারের লোকেরা তোমার বা আমাদের বাচ্চাদের প্রতি প্রথম থেকেই এতোটা অন‍্যায় করেছে যে তোমাকে ওদের বিষয়ে বলতে লজ্জাই পেয়েছি। আমার ধারণা পরিবারকে সাহায্য করছি কথাটা শুনলে তুমি মেনে নিবে না, রাগ করবে। কিন্তু সাদিয়া বিশ্বাস করো, মা এখন ক‍্যান্সারের থার্ড স্টেজের রোগী। অভাব অনটনের জন‍্য তার ভালো চিকিৎসা হয়নি। বড় আপাই আমার অফিসে এসে কথাটা জানায়। মাস দুয়েক আগে ক‍্যান্সারের কথাটা জানতে পেরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। আপার মাধ‍্যমে যথাসম্ভব আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছি, তোমাদেরকে না জানিয়ে হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছেও ছুটোছুটি করি। শত হলে মা তো আমার মা ই – জন্মদাত্রী, তার জন‍্যইতো আমার এই পৃথিবীতে আসা।” কোন রকম ভূমিকা ছাড়া কথাগুলো একটানা বলেই বেলাল শিশুদের মতো কাঁদতে শুরু করে দিল। শক্ত মনের অধিকারী বেলালকে আজ আমি প্রথমবারের মতো কাঁদতে দেখে নিজেকেও ধরে রাখতে পারলাম না। আপার সাথে লাঞ্চে বা রিকশায় দেখেই ওর কোন কলিগের ঐ উড়ো ফোন করা, আন্দাজ করে নিলাম। কথা আর বাড়াইনি অন্ততপক্ষে পরকীয়ার মতো নোংরা বিষয়ে বেলাল ইনভলভড না, এটা নিশ্চিত হওয়ার স্বস্তি।

বেলাল ফুপিয়ে ফুপিয় কাঁদছে। ওকে বাধা দিলাম না। মা হারানোর কষ্টটা আমার খুব ভালো করেই জানা। ক্লাস নাইনে থাকতে হঠাৎ করেই একদিন আমার নিজের মা মারা গিয়েছিল। তখন আমাদের মনিরামপুরে কোন হাসপাতাল ছিল না, মাকে যশোর সদর হাসপাতালে নিতে নিতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। মা সম্ভবত পথেই মারা গিয়েছিলেন।

ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। মায়ের মৃত্যুর পর আমি সাদিয়া সম্পূর্ণ পরিবর্তিত একজন। প্রাণখুলে হাসতে ভুলে গেলাম, শূন‍্যতা আর কখনো গেলোই না। আমার জীবনের সব চাওয়া আবদার অভিমান ছিল আমার মাকে ঘিরেই। জীবনে সত‍্যিকারের ভালোবাসা সম্ভবত মায়ের চাইতে বেশি আর কেউই দিতে পারেনি। মায়ের মারা যাওয়ার অল্পকিছুদিন পর কেশবপুর থেকে আমার নতুন মা চলে আসলো, আর সব পুরুষের মতো আমার বাবাও শূন‍্যস্হান পূরণে দেরি করেনি। তবে আমার জীবনে ভালোবাসা অভিমান আর আবদারের জায়গাটা যে অপূর্ণই থেকে গেল।

এরপর থেকেই আমার নিজ পরিবার থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে আসা। যশোর গার্লস হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বলতে গেলে মা হীন সংসারে ওরকম টান অনুভব করতাম না। আর এরপরতো বেলালের মধ‍্যেই হারানো মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। সংসার করা আর এরপর বাচ্চাদের পৃথিবীতে আসা। এদের মধ‍্যে মায়ের সেই ভালোবাসাটাকে খুঁজে নেওয়া। জানেন, আমার প্রায়ই মনে হয়। যদি কোটি টাকার বিনিময়েও আমার মৃত মা কে একদিনের জন‍্য হলেও জীবিত পেতাম! তাহলে ঐ অল্প সময়ের মধ‍্যেই মায়ের দেওয়া ভালোবাসাটার সামান্য হলেও প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিংবা সারাদিন মায়ের হাত ধরে বসে থেকে বলে রেতাম “মা, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

“সাদিয়া, গত দুই মাস ধরেই আমি মায়ের চিকিৎসার বিষয়টি দেখছি। প্রায় লাখ চারেক টাকাও ইতোমধ্যে খরচ করে ফেলেছি। তোমাকে এ কথা না জানানোর কোন এক্সকিউজ আমার কাছে নেই। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।” বেলালের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমার দেওয়া উত্তরটা শোনার জন‍্য সম্ভবত বেলালও রেডি ছিল না।

“মায়ের চিকিৎসার জন‍্য যতো টাকা লাগে খরচ কর, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। যদি দরকার হয় আমার গয়নাগুলোও বিক্রি করে দাও। তবে দয়া করে ভবিষ্যতে আমাকে না জানিয়ে কিছু করবে না। দুঃখ, বাইশ বছরেও তুমি আমাকে এখনো চিনতে পারোনি বেলাল। মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের জন‍্য সন্তানের শেষ মুহূর্ত পযর্ন্ত সর্বস্ব দিয়ে করে যাওয়ার বিরোধীতা করার মতো মেয়ে অন্ততপক্ষে আমি নই। জীবনে টাকা সম্পদ যাবে আসবে কিন্তু মা চলে গেলে আর তা কখনোই ফেরত আসবে না।” কথাগুলো বলতে বলতে কেন জানি বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া অল্প বয়সী আমার মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো। অনেকদিন পর আমিও জোর কান্নায় ভাসলাম, বেলালের সাথে।

পরদিন সাত সকালে উত্তরার আহসানিয়া মিশন ক‍্যান্সার হাসপাতালে আমার দুই ছেলে মেয়ে প্রথমবারের মতো তাদের দাদীকে সামনা সামনি দেখলো। এর আগে ছবিতে দেখলেও আজই কংকালসার জাত‍্যাভিমানী দাদীকে দেখে আমার মতোও ওরা একেবারেই চুপ। আমার শাশুড়ি ইশারায় দুই নাতি নাতনীকে কাছে ডেকে দোয়া করে দিলেন। আর এরপর আমার হাতটা ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন, শব্দ করে কান্নার শক্তিটুকুও সম্ভবত তার আর অবশিষ্ট নেই। আর এরপর শ্বশুরবাড়ির প্রতি আমার জমে থাকা সব অভিমান আর কষ্ট যেন এক মুহূর্তেই নিঃশেষ। আমার মৃত মায়ের ভালোবাসার রূপটা যেন এখন শাশুড়ির মধ‍্যেই দেখতে পাচ্ছি, স্বর্গীয় এক অনুভূতি নিয়ে।

(শেষ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে