#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_১১
গভীর রাত!সবাই ঘুমালেও মারিয়ার চোখের তারায় যেনো ঘুমের দেখা নেই।মাহমুদ তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।কি নিদারুণ ব্যথায় তাকে জড়িয়ে রেখেছে তা কি লোকটা জানে?উনি এতো নিষ্ঠুর এটা মারিয়ার জানা ছিলো না।আগে না হয় মারিয়া উনার কেউ ছিলো না কিন্তু এখন তো মারিয়া উনার স্ত্রী।আচ্ছা এটা মানা গেলো যে সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই মারিয়ার কথা মনে করার সময় পায় না কিন্তু রাতে!রাতেও কি কাজ করে।এমন একান্ত নিরিবিলি রাতে কি তার কথা মনে হয় না?মাহমুদের কথা ভাবতে ভাবতে মারিয়ার গাল ভিজে উঠে। কান্না করা যেনো তার নিয়মিত রুটিন হয়ে গিয়েছে।মাহমুদ বাড়ি আসেনা এটা এক রকম শাস্তি কিন্তু মোবাইলের নাম্বার ব্লাকলিস্টে রাখার মানে কি?মারিয়া যে যোগাযোগ করবে এমন একটা রাস্তাও সে খুলে রাখেনি।
মারিয়া হঠাৎ বুঝতে পারে তার মোবাইলটা মৃদু কেঁপে উঠছে।সে পানিভরা চোখে ঝাপসা দৃষ্টি মেলে মোবাইলের দিকে তাকায়,এতো রাতে কে ফোন দেবে?
মাহমুদের কল দেখে আনন্দে মারিয়ার দম বন্ধ হয়ে যায়।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করতে গেলেই তা কেঁটে যায়।মারিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে,ফোন রিসিভ করার আগেই কেটে গেলো?আফসোসে মারিয়ার ম,রে যেতে ইচ্ছে করলো।তখনি আবার ফোন এলো।মারিয়া সাথে সাথেই রিসিভ করে কিন্তু কথা বলতে পারে না।কোনো এক অজানা কারণে তার গলা দিয়ে কথা আসছে না।মাহমুদ বোধহয় তার কথার অপেক্ষায় ছিলো,সে চুপ দেখে মাহমুদ বললো,
“মারিয়া।”
মারিয়া কেঁপে উঠে।চোখ বন্ধ করে মাহমুদের গলার স্বর অনুভব করে।মাহমুদ আবার বললো,
“ঘুমিয়ে গিয়েছো?”
মারিয়া আস্তে করে বললো,
“না।”
“এতো রাত হলো ঘুমাওনি কেনো?”
মারিয়া মাহমুদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“আপনি বাড়ি আসেন না কেনো?”
মাহমুদ হাসে।
“বাড়ি আসবো কেনো?”
মাহমুদের প্রশ্নে মারিয়ার ভিষণ অভিমান হয়।সে বললো,
“কেনো আসবেন জানেন না?”
“না।”
“অহ!আচ্ছা।”
“কি আচ্ছা?”
“আসতে হবে না।”
“তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো?”
“না।”
মাহমুদ বললো,
“মারিয়া শোন। ”
“হুম।”
“তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ? ”
মাহমুদ আস্তে করে বললো,
“কালকে বাড়ি আসছি।”
মারিয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।তাকে একরাশ লজ্জা এসে জাপটে ধরে।সে কট করে ফোনটা কেটে দেয়,ইশ এতো লজ্জা লাগছে কেনো?
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরে তিতিরের ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি লেগে থাকে।খুশীমনে নাস্তা করতে যায়।খাবার টেবিলে এমন হাসোজ্জল চেহারার তিতিরকে দেখে সবাই অবাক হয়, কালকে সারাদিন বিয়ে করবেনা বলে কান্নাকাটি করেছে আর আজকে কিনা এতো খুশী!সবাইকে তার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিতির ভ্রু কুঁচকায়,ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি?
জয়তুন বেগম আরফানের মা সালমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখেছো সালমা?বিয়ের কথা শুনলে প্রথম প্রথম মেয়েরা একটু কাঁদেই তারপর ঠিক হয়ে যায়।”
জয়তুন বেগমের কথা শুনে তিতরের মুখের হাসি উবে যায়।সে যে আরফানের সানিধ্যে এসে এমন খুশী হয়েছে তা কি করে বুঝাবে?মুখ অন্ধকার করে বললো,
“এই জন্য কি হাসতেও পারবো না? আমি বলেই দিয়েছি বিয়ে করবোনা,তুমি বেশী বুঝো দাদী।”
মহীবুল্লাহ তার মায়ের প্রতি অগাধ সম্মান।তার মায়ের মুখের উপরে কথা বলা একদম পছন্দ করেন না।মেয়ের এমন চটাং চটাং কথায় উনি বিরক্ত হয়।রেগে বললো,
“তোমাকে জন্ম দিয়ে বড়ো করেছি এবার বিয়ে দেবো।একদম বেশী কথা বলবে না।আম্মা সবার থেকে ভালো বুঝে, উনি যেহেতু বলেছে বিয়ে দিতে তাহলে বিয়ে হলেই বরং মঙ্গলজনক হবে।”
তিতির স্তব্ধ হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে।মঙ্গল! আরফানকে ছাড়া তার কোনোকিছুই মঙ্গল হবে না।উনাদের সবার মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো মূহুর্তে বিয়ে হয়ে যেতে পারে।সে আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে আরফানকে খুঁজে কিন্তু কোথাও আরফান নেই।তিতির বিমর্ষ হয়,আরফান তাকে বলেছিলো সে সবাইকে বুঝিয়ে বলবে কিন্তু এখন এই মূহুর্তে মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না অথচ এখনি কথাটা বলার সুযোগ ছিলো।
তিতির খাবার রেখে উঠে তার রুমে চলে যায় তার পিছু পিছু আরশও যায়।সবাই যেনো ব্যপারটা দেখেও দেখলো না,উনাদের ধারনা দুজনের বিয়ে হবে, এখন একটু আলাদা কথা বলতেই পারে।আরশ গিয়ে তিতিরের খাটে বসে, তিতির আরশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার ভাইয়া?এখানে এসেছেন কেনো?”
আরশ স্থির চোখে তাকিয়ে বললো,
“হবু বউয়ের কাছে আসতে সমস্যা কি?”
“আপনার হবু বউ কে?”
“তুমি?”
“আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা, এই আশায় ঘুম নষ্ট করবেন না।”
আরশ হেসে বললো,
“না এখন তো মন ভরে ঘুমাচ্ছি,বিয়ের পরেই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবো।”
আরফান হাই তুলতে তুলতে রুমে ঢুকে তিতিরের বিছানায় শুয়ে আরশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবেন কেনো?সুখে না দুঃখে?”
তিতিরের বিছানায় আরফানকে এমন সহয-স্বাভাবিকভাবে শুয়ে পরতে দেখে আরশ বিরক্ত হয়।তার প্রশ্নে বললো,
“বিয়ের পর মানুষ নিশ্চয়ই সুখেই থাকে।এতো পড়ালেখা করে কি করলি;যদি এটাই না বুঝিস।”
আরফান হাসে।
“না মানে দুঃখেও তো ঘুম না আসতে পারে।”
আরশ দাঁড়িয়ে থাকা তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তিতির আমাকে কোনো দুঃখ দেবে না।তাই না তিতির? ”
তিতির ফোস ফোস করে বললো,
“আমি তো আপনাকে বিয়েই করবো না।”
তিতিরের কথায় আরফান হো হো করে হেসে উঠে।আরশ বললো,
“তা আজকে রাতেই দেখা যাবে?”
আরশের কথায় দুজনেই চমকে যায়।তিতির বললো,
“মানে?”
আরশ উঠে দাঁড়ায়।মুচকি হেসে বললো,
“বলা বারণ,সময়মতো জানতে পারবে।”
আরশ চলে গেলেও তিতির স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।আরফান হাতের ইশারায় তিতিরকে চুমু দিয়ে বললো,
“নো চাপ বেইবি।মে হু না!”
তিতির হাসে।আরফান উঠে বেরিয়ে যায়,যাওয়ার আগে তিতিরের কপালে পরে থাকা চুলগুলোতে ফু দিয়ে আরো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
“তুমি আমাকে বিয়ের প্রস্তুতি নাও,দেখা যাবে যেকোনো মূহুর্তে এসে বলবো কবুল বলো তিতির।”
আরফানের পাগলামিতে তিতির হাসে।আরশের পক্ষে যদি বাড়ির সবাই থাকে তাহলে আরফানের পক্ষে শুধুমাত্র সে থাকবে আর তার ধীর বিশ্বাস যে আরফান তাকে নিজের করে নিতে পারবে।
দুপুর হতে হতে আরফান আর তিতির এটা বুঝতে পারে যে আরশের সাথে আজকে বিয়ে হয়ে যাবে।আরফান হাসে।সন্ধ্যা নাগাদ সবার অগোচরে তিতিরকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ঘন্টা খানেক পরে দুজন ফিরে আসে।বাড়িতে ততোক্ষণে হট্টগোল পরে গিয়েছে।শাহাবুদ্দিন আরফানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলি?”
আরফান হাসিমুখে বললো,
“আমরা বিয়ে করেছি আব্বা।”
চলবে………