উজান ঘাটের মাঝি পর্ব-০৭

0
708

#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০৭

তানিয়া আক্তার নাস্তার প্লেট নিয়ে দুই ভাইবোনের দিকে এগিয়ে আসে।উনি আসাতে তিতির ছাড়া পায় আসন্ন বি,পদ থেকে যেনো স্বয়ং আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে দিলো।উনি এসে মাহামুদকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে।তিতির আস্তে করে কেটে পরে,বড়োমার কাছে জানতে পারে যে আরফান ভোরে ঢাকা চলে গিয়েছে,মাহামুদ এসেছে অথচ আরফান চলে গেলো দুই ভাইয়ের দেখা হলোনা তাই উনার খারাপ লাগছে।আরফান চলে গিয়েছে এই কথাটা জানার পর থেকে তিতিরের মন খারাপের ওজন যেনো আরো বেড়ে যায়।দোষ তো আরফানের একার ছিলো না দোষ তিতিরেরও ছিলো কিন্তু সে কিনা সবটা দোষ আরফানকে দিয়ে এতো পরিমান দোষী বানিয়ে দিলো যে ছেলেটা বাড়ি থেকেই চলে গেলো।তিতিরের দম বন্ধ হয়ে আসে।কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে উঠে,কান্না লুকাতে সবার অগোচরে সে রুমে চলে আসে, তারপর বাধ ভাঙ্গে কান্নারা, ছুটে চলে অভিরাম গতীতে।

রাত বারোটা।গ্রামের পরিবেশ; এইটুকু রাতেই চারদিক নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মাহামুদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইল দেখছে।তার চোখের দৃষ্টি বারবার দরজার দিকে চলে যাচ্ছে, সে জানে মেয়েটা আসবে।কেনো এমন ধারণা হচ্ছে সেটা জানা নেই কিন্তু সেই ধারনার উপর ভিত্তি করে সে দরজা লাগায়নি,হালকা করে ভেজিয়ে রেখেছে।
চোখের দৃষ্টি মোবাইলের উপর নিবদ্ধ হলেও মনের চোখ বারংবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
তখনি দরজা খুলে গেলো।হলুদরঙা থ্রী পিছ পরে মারিয়া রুমে প্রবেশ করে।মাহামুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে দরজা আটকে দেয়।মারিয়ার সাহস দেখে মাহামুদ অবাক হয়,এতোদিনে দরজা লাগানোর সাহসও সঞ্চয় করে ফেলেছে,বাহ!
উন্নতি হয়েছে তো।দরজা লাগিয়ে মারিয়া এক পা ও এগিয়ে আসে না,দরজার সামনে থেকেই মাহামুদের দিকে তাকিয়ে আছে।মাহামুদ হাতের মোবাইল বিছানায় রেখে মারিয়াকে বিব্রত করতেই কিনা এক দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।কিন্তু মারিয়া বিব্রত হয় না বরং দু-কদম এগিয়ে আসে।মাহামুদ বললো,
“কি সমস্যা? ”

মারিয়া আজকে এক বুক সাহস নিয়ে এসেছে।সে বললো,
“সেটা তো আপনি বলবেন।”

“কি বলবো?”

“আপনার কি সমস্যা?”

“আমার তো কোনো সমস্যা নেই। ”

“যদি সমস্যা নাই থাকে তাহলে সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন অথচ সারাদিনে একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করলেন না আমি কেমন আছি। ”

মাহামুদ মনে মনে হাসে।
“তোকে দেখে মনে হয় তুই খুবই ভালো আছিস এটা আর জিজ্ঞেস করবো কি?”

মারিয়া ব্যর্থিত হয়।কেমন গলায় বললো,
“আমাকে দেখে আপনার ভালো আছি বলে মনে হলো?”

“হ্যাঁ।”

মারিয়া কিছুক্ষণ মাহামুদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“অথচ আমি একটুও ভালো নেই।”

“কেনো?”

মারিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।মাহামুদ বিছানা থেকে নেমে আসে।মারিয়ার কাছাকাছি দাঁড়াতে মারিয়া বললো,
“আপনি সব বুঝে না বুঝার ভান করেন কেনো?”

“কারণ এই বেশী বুঝাটা ভালো কোনো কিছু বয়ে আনবে না তাই।”

“ভালো কিছুও তো হতে পারে।”

“পারে না। ”

মারিয়ার চোখের কোনে পানি টলমল করে উঠে।বুকে ব্যা,থা হয়।ফিসফিস করে বললো,
“মাহামুদ ভাই….”

মারিয়ার কথা শেষ করার আগেই তাকে থামিয়ে মাহামুদ বললো,
“এতো রাতে আমার রুমে এসেছিস কেনো?কেউ দেখলে তখন!কেলেঙ্গকারী হয়ে যাবে ।”

মারিয়ার হঠাৎ এক অপ্রীতিকর কাজ করে বসে।হাটুমুড়ে মাহামুদের পা আঁকড়ে ধরে বললো,
“আপনি আমাকে এতো অবহেলা করবেন না প্লিজ। আমার মনে হয় আমি ম,রে যাবো।”

মারিয়ার কাছে মাহামুদ বিব্রত হয়,হাত দিয়ে মারিয়াকে উঠাতে চায়।মারিয়া কান্নাভেজা গলায় বললো,
“এতো ভালোবাসা আপনার চোখে পড়ছেনা!কথা দিচ্ছি আমার মতো করে দুনিয়ার আর কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না। ”

মাহামুদের বুকটা কেমন খা খা করে উঠে।মারিয়ার কান্না তার একদম ভালো লাগে না। সে মারিয়াকে টেনে তুলে,এই প্রথমবারের জন্য মারিয়ার চোখের পানি পরম যত্নে মুছে দেয়।আস্তে করে বলে,
“আবার কান্নাকাটি কেনো?”

মারিয়া কোনো কথা বলে না। মাহামুদ খুব কাছে থেকে মারিয়াকে দেখে উপলব্ধি করে সে হারিয়ে গেছে।কবে হারিয়েছে সেটা না জানা থাকলেও এইটুকু বুঝতে পারছে অনেক আগেই গোপন কুঠিরিতে এই নারী জায়গা করে নিয়েছে।
সে আস্তে করে বললো,
“এখন রুমে যা।”

মারিয়া আর বেহায়া হওয়ার সাহস করে না।চুপচাপ রুমে চলে যায়।

সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই উপস্থিত।শাহাবুদ্দিন খান মাহামুদকে ছোটবেলা থেকেই খুব আদর করে।নিজের কাধে করে কতো হেটেছেন তার কোনো হিসাব নেই।মাহামুদকে কখনো ভাইয়ের ছেলে মনে করেননি।মাহামুদও তার বড়োআব্বুর সব কথা খুব শুনে।দুজনের সম্পর্ক খুবই সহয।শাহাবুদ্দিন খান বললো,
“পড়ালেখা তো শেষ করে নিচ্ছিস,এবার আমাদের একটু খুশীটুশী এনে দে।”

মাহামুদ শাহাবুদ্দিন খানের দিকে তাকিয়ে কথাটা বুঝার চেষ্টা করে।সবার মুখের মিটিমিটি হাসি দেখে বড়োআব্বুর কথাটা বোধগম্য হয়।কথাটা বুঝেই মাহামুদ হেসে উঠে।ওর হাসি দেখে জয়তুন বেগম বললো,
“হাসলে হবে না,এবার বিয়ে করে আমাদেরও একটু হাসা।”

মাহামুদ পাত্তা না দিয়ে বললো,
“এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো কেনো?”

তানিয়া আক্তার বললো,
“কেনো তোর বিয়ের বয়স হয়নি?”

“না।”

শাহাবুদ্দিন খান মাহামুদের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তোর কোনো পছন্দ আছে?”

মাহামুদের চোখের তারায় মারিয়ার কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠে কিন্তু সে মাথা নেড়ে বললো,
“না আমার কোনো পছন্দ নেই।”

“তাহলে আমরা দেখবো?”

“দেখুন।”

শাহাবুদ্দিন খান বললো,
“গ্রামের আকবর আলীর নাতনীকে দেখলাম বেশ ভালো লাগলো।আজকে বিকালেই মেয়েটাকে দেখতে যাবো।”

মাহামুদ আস্তে করে বললো,
“আচ্ছা। ”

এতোসব কথাগুলো সবাই হাসিমুখে শুনলেও মারিয়ার মুখের ভাব হাসিহাসি রইলো না সে আস্তে করে উঠে গেলো।চুপচাপ দরজা আটকে দিলো।এতো হাসি খুশীর মাঝে মারিয়াকে কেউ লক্ষ করলো না।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো।শাহাবুদ্দিন খান, মহিবুল্লাহ আর জয়তুন বেগম আকবর আলীর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এর মাঝে মারিয়ার আম্মা সালমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। কান্নাজড়িত গলায় বলে,
“সেই সকাল থেকে মারিয়ার রুমের দরজা আটকে আছে।দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো এখনো তো দরজা খুলছে না। এই পর্যন্ত হাজারবার ডাকা হয়ে গেছে।”

শাহাবুদ্দিন এতো ঘাবড়ালেন না।
“ঘুমাচ্ছে হয়তো।”

“মারিয়ার ঘুম খুব পাতলা,একবার ডাকলেই উঠে যায়।”

এবার সবাই চিন্তিত্ব হয়।কোনো উপায় না দেখে কাঠের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে।ভেতরে ঢুকে মারিয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়,তাকে জাগানোর চেষ্টা করলেও সে জাগে না।অবস্থা খারাপ দেখে মারিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হয়।হাসপালে নেয়ার পর ডাক্তার তার চিকিৎসা করে জানায় ঘুমের ওষুধের কারনে এমন হয়েছে।এতো ছোট মানুষের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কি দরকার তা কারো বোধগম্য হলো না।গভীর রাতে মারিয়াকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।
শাহাবুদ্দিন খান চিন্তিত্ব ভঙ্গিতে বসে আছে। এই এতোকিছু ঘটে গেছে অথচ মাহামুদ একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি,কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।সে তার বড়োআব্বুর কাছে এগিয়ে আসে।বুকে সাহস নিয়ে পাশে বসে।হাত ধরে বললো,
“বড়ো আব্বু,একটা কথা বলি?”

“বল।”

“তোমার রাজকন্যাটা আমাকে দিয়ে দাও, আমি তাকে রানীর মতো করে রাখবো।”

শাহাবুদ্দিন খানের চেহারার রঙ বদলায়।গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস?”

মাহামুদ কথা বলেনা কিন্তু শাহাবুদ্দিন খান শিক্ষিত,বিচক্ষণ মানুষ উনি যা বুঝার বুঝে নেয়।সেদিন রাতেই মাহামুদ আর মারিয়ার বিয়ের দিন ঠিক করা হয়।সবাই অবাক হলেও কোনো বিরোধিতা করেনি।

তিতির খুশী হয়।তখনি হাতের মোবাইলে টুং করে মেসেজ আসে।মেসেজ খুলে তার ভ্রু কুঁচকে যায়।আরফান একটা মেয়ের গালে চুমু দিচ্ছে।আরেকটা ছবিতে জড়িয়ে রেখেছে।তিতিরের খুব রাগ হলো,রাগে হাতের মোবাইল হাত থেকে ফেলে ভেঙ্গে ফেললো।হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট পাগলের মতো ঘষে আরফানের সবটা স্পর্শ মুছতে চাইলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে