উজান ঘাটের মাঝি পর্ব-০৬

0
694

#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০৬

দীর্ঘ পাঁচ মাস পরে মাহামুদ বাড়ি আসে।বাড়ি আসার প্রচন্ড ইচ্ছা থাকলেও সে একবারও বাড়িমুখো হয় না,সাধারণ সম্পর্ককে সে অন্যনাম দিতে রাজি না।তাছাড়া এটা কখনো সম্ভব না।এতোদিন পরে হঠাৎ করেই মনটা বাড়ির জন্য আনচান করে উঠে এদিকে পড়ালেখাও প্রায় শেষ।তাইতো কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের বাসে করে সকালে এসে বাড়িতে পৌছায়।মহিবুল্লাহ খান ছেলেকে পেয়ে খুব খুশী হয়ে যায়।শুধু মহিবুল্লাহ কেনো বাড়ির প্রত্যেকেই খুশী হয়।বাড়ির বড়ো সন্তান শাহাবুদ্দিন খান হলেও উনার ছেলে আরফান জন্ম নেয়ার আগেই মহিবুল্লাহর ছেলে মাহামুদ জন্মগ্রহণ করেছে সুতরাং প্রথম বাচ্চা হিসেবে মাহামুদ সবারই প্রিয়।তাছাড়া প্রিয় না হওয়ার কোনো কারনও অবশ্য নেই,মাহামুদ খুব শান্ত,নিবিড় প্রকৃতির মানুষ।কিছু মানুষ আছে না দেখলে প্রচন্ড ভালো লাগে মাহামুদ তেমন মানুষ।
এতোদিন পরে নিজের ছেলেকে পেয়ে তানিয়া আক্তার আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়,সেই যে আসার পরে ছেলেকে আঁকড়ে ধরেছেন এখনো এভাবেই আছেন,খুশীতে চোখে পানি চলে আসার উপক্রম।
তানিয়ার এমন আহ্লাদীপনায় উনার শাশুড়ী জয়তুন বেগম বি,রক্ত হন।কই উনিও তো মাহামুদকে ভালোবাসেন এমন তো করেন না।বিরক্তি গলায় রা রা করে বললো,
“তুমি তো এমন ভাবে জাপটাই ধরে রেখেছো মনে হচ্ছে ছেলে বিদেশ থেকে আসছে।যাও নাস্তা বানাও,ছেলেটা সারারাত জার্নি করে আসছে।”

তানিয়া আক্তার মাহামুদের দিকে তাকায়।উনি মাহামুদকে জন্ম দিয়েছেন অথচ ছেলেটা লম্বায় উনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।মায়াভরা হাতে মাহামুদের গালে হাত দিয়ে বললো,
“আপনি এসব বুঝবেন না আম্মা। ”

ছোট ছেলের বউয়ের কথাটা জয়তুন বেগমের ঠিক পছন্দ হলো না।উনি ভ্রু কুঁচকে বললো,
“না না আমি বুঝবো কেনো?আমি কি আর সন্তান জন্ম দিয়েছি।সন্তান তো শুধুমাত্র তোমরাই জন্ম দিয়েছো।যত্তোসব ঢং।”

শাশুড়ীর কথায় তানিয়া কিছুই মনে করে না,সে তার শাশুড়ির কটু কথায় অভস্থ।মাহামুদ দাদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“দাদী তুমি আমাকে মিস করোনি?”

মাহামুদের কথা শুনে জয়তুন বেগমের মুখে হাসি ফুঁটে উঠে।নরম স্বরে বললো,
“অনেক মিস করেছি ভাই । ”

মাহামুদ হেসে বললো,
“আমিও তোমাকে খুব মিস করেছি।”

তানিয়া আক্তার ছেলেকে কি দিয়ে নাস্তা করাবে সেই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।মাহামুদ ফ্রেস হতে রুমে চলে যায়।অনেকদিনের ময়লা রুমে এসেও তার এক অজানা শান্তি লাগে, মনের কুড়িতে প্রশান্তিময় বাতাস ছুঁয়ে যায়।নিজ হাতে ঝেড়ে ঝুড়ে রুমটা ঠিক করে গোসল করে রুম থেকে বের হয়।সোফায় বসে টেবিলের দিকে নজর যায়,মারিয়া চুপচাপ নিজের খাবার খাচ্ছে।সে এক দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।মারিয়া!এই নামটা সাধারণ হলেও এই নামের মানুষটার আচরণ অসাধারণ,মানুষটা ছোট হলেও নিজেকে নারী হিসেবে প্রকাধ করতে খুব ব্যস্ত ।তখনি মারিয়ার চোখের দৃষ্টি সোফার দিকে পরাতে সে স্তব্ধ হয়ে যায়,চোখের গোলক বড়ো হয়ে তাকিয়ে থাকে।মাহামুদের চোখের গরম দৃষ্টি দেখে মারিয়া মাথা নিচু করে নেয়,তারপর চো,রের মতো আবার তাকায়।
মারিয়ার তাকানোর ভঙ্গি দেখে মাহামুদ মুচকি হাসে,ভবিষ্যতে কি হবে ভেবে হাসির রেখা মুছে যায়।মারিয়া আর খেতে পারেনা খুশীতে নাচতে ইচ্ছে করলে কি আর খাবার পেটে যায়!সে উঠে বিড়ালের মতো পা ফেলে রুমের দিকে ছুটে,আর মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে, আল্লাহ এটা যেনো সত্যি হয়,মাহামুদ যেনো সত্যিই বাসায় আসে,এমন স্বপ্ন সে দেখতে চায় না।
মারিয়া রুমে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে,চেহারাটা দেখতে খুব মলিন আর রু,ক্ষ লাগছে,এতোদিন ছন্নছাড়া চলাফেরার কারনে চেহারার অবস্থা খুবই করুণ, তার নিজের উপর খুব রাগ হলো,আরেকটু সুন্দর হয়ে থাকলে তো এই ফকিন্নীর মতো চেহারা নিয়ে মাহামুদের সামনে পরতে হতো না। সে আলমারি খুলে নতুন জামা বের করে বাথরুমে যায়,আজকে খুব পরিপাটি হয়ে থাকা চাই।

সারারাত কেঁ,দে তিতিরের ফর্সা গাল লাল টকটকে হয়ে আছে,চোখের অবস্থা আরো করুন,অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে উঠেছে।কিন্তু সকাল হয়ে গিয়েছে যে এবার তো রুম থেকে বেরোতে হবে ইতোমধ্যেই তানিয়া আক্তার কয়েকবার ডেকে গিয়েছে।তিতির বাথরুমে গিয়ে মুখে বেশী করে পানির ঝাপটা দেয়।আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে চোখের পর্দায় ভেসে উঠে রাতের মূহুর্তটুকু।
ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক,হঠাৎ হয়ে যাওয়া কাজটায় দুজনেই বিব্রত হয়,আরফান তিতিরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই তিতির এক অভাবনীয় কাজ করে ফেলে। রা,গে দুঃ,খে ঠাস করে আরফানকে এক থা,প্পড় দিয়ে সরিয়ে দেয়।ভালোবাসার কথা না বলে এমন করে ছুঁয়ে দেয়ার সাহস হলো কি করে?অথচ ভুলে গেলো আরফানের স্পর্শে সে নিজেও সাড়া দিয়েছিলো তাইতো আরফান গভীর ভাবে ছুঁয়েছে।তিতিরের এমন কাজে আরফান হতভম্ব হয়ে গেছে,হাত দিয়ে গাল ছুঁয়ে ফ্যালফ্যাল করে তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে।তিতির হিসহিস করে বললো,
“আপনি খুব খা,রাপ। ”

আরফান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তুই খা,রাপ না?”

তিতিরের বিবেক প্রশ্নের উত্তর যানে কিন্তু মানতে নারাজ।সে কাঁ,দে,ফুপিয়ে উঠে।কা,ন্নার তোড়ে কেঁপে উঠে।মাথা নেড়ে বললো,
“অ,সভ্য লোক!”

আরফান হতবাক।কি বলবে মাথায় আসে না। সে অসহায় গলায় বললো,
“তুই ও তো ঝাপটে ধরলি তিতির।”

তিতির চোখ পাকিয়ে তাকায়,
“আপনি সুযোগ নিয়েছেন,আমাকে একা ছাদে ডেকে খুব খা,রাপ কাজ করে ফেলেছেন।আর কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না যদি কোনোরকম চেষ্টা করেন তো আমি বড়োআব্বুকে বলে দেবো।”

কা,ন্নারত অবস্থায়ই তিতির নিচে চলে যায়। ছাদের পরিবেশ ততক্ষণে থমথমে রূপ ধারন করেছে,ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাসে স্তব্ধ আরফানকে বিবেকের চরম দং,শনে রেখে তিতির পালিয়ে যায় রেখে যায় আরফানকে।
ফজরের আজানের পরে আরফান ব্যাগ হাতে রুম থেকে বেরোয়।মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদেশ্য নিয়ে বেরিয়ে পরে।এতো সকালে কেনো যাচ্ছে এই নিয়ে হাজারো প্রশ্ন করে সালমা বেগম, আরফান জানায় তার জরুরি কাজ পরে গিয়েছে না গেলে হবে না তাই এতো সকালে যাওয়া।সালমা বেগম আর এতো ঘাটালেন না,আরফান উ,ড়নচণ্ডী স্বভাবের তাই তার কাজে কোনো সন্দেহের লেশমাত্র রইলো না।সারা রাস্তা আরফানের মুখ থমথমে হয়ে ছিলো,কখন যানো চোখ জ্বালা করতে করতে লা,ল টকটকে হয়ে গিয়েছে।সে কি আসলেই সুযোগ নিয়েছে? আর তিতির যে তাকে আঁকড়ে ধরে আরো কাছে টানলো সেটা!

তিতির রুম থেকে বেরিয়ে সোফায় পুরুষভাবায়ব কাউকে বসে থাকতে দেখে ভাবলো এটা আরফান।মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে তখন সামনে বসা পুরুষ তাকে ডাকে।চিরপরিচিত ভাইয়ের কন্ঠ শুনে তিতির চমকে যায়,মাথা তুলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খুশীতে হাসে।
মাহামুদ হাত ধরে আদরের বোনকে পাশে বসায়।বোনের চেহারার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“কি খবর তিতির পাখির?”

তিতির হাসে। হেসে বললো,
“ভালো।তুমি এতোদিন আসোনি কেনো ভাইয়া?”

তিতিরের লাল চোখজোড়া মাহামুদের নজর এড়ায় না।সে সন্ধানী চোখে তাকিয়ে বললো,
“এখন আসলাম।”

তিতির হাসে। মাহামুদ বলে,
“কেঁদেছিস কেনো?”

“কাঁদিনি।”

মাহামুদ হাত ধরে বললো,
“প্রেমে পরেছিস?”

তিতির চমকে যায়,কথা বলার ভাষা হারায়।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে