#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০৪
জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দূরের গাছপালার দিকে বেখেয়ালি দৃষ্টি মেলে মারিয়া তাকিয়ে আছে।সে গাছপালা দেখছে নাকি কি দেখছে তা ওর দৃষ্টি দেখে বোধগম্য হচ্ছে না,কেননা তার চোখের ভাষা যে বড়োই শূন্য।মুখে আকাশ পরিমান ব্যাথার ছাপ স্পষ্ট।না পাওয়ার হাহাকারে হৃদয় দগ্ধ।দুটো হলুদ পাখি একটা ডালে বসে আছে একটা পাখি আরেকটা পাখির কাছে ঠোঁট নিয়ে কিচিরমিচির করাতে পাখিটা উড়ে যায়,সাথের পাখিটাও পিছু পিছু যায়। এই দৃশ্যটা দেখে মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে।পাখিটাতো তার ডানার সাহায্যে উড়ে যেতে পারলো কিন্তু সে উড়বে কিভাবে?তার যে যোগাযোগের সব রাস্তাই বন্ধ।এই যে কোনো কথা না যোগাযোগ না একলা একা দিন কাটাচ্ছে তার কেমন লাগে তা কি নিষ্ঠুরমনের পুরুষ জানে?সবার কাছে শান্ত উপাধি পাওয়া মেয়েটা দরজা আটকে মুখে হাত চেপে কাঁদে এর অবসান কোথায় তা কি মাহমুদ জানে?মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাহমুদ!তার চাচার বড়ো ছেলে।বর্তমানে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। মারিয়া ছোটবেলায় মাহমুদকে আরফানের মতোই ভাই হিসেবে মানতো কিন্তু বড়ো হওয়ার পরে বুঝতে পারে সে মাহমুদকে ভাই হিসেবে মানতে পারছেনা,মাহমুদকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন মনের গোপন কুঠুরিতে ডানা ঝাপটায়। মাহমুদকে দেখলে ঘুমিয়ে থাকা মনের রঙ্গিন প্রজাপতির ঝাক উড়াউড়ি করে,আশেপাশে থাকলে অসহ্য সুখে পাগল পাগল লাগে। ভীষন ভ,য়ংকর , বেপরোয়া ইচ্ছায় হৃদয় ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠে।একসময় মারিয়া আবিষ্কার করে সে প্রেমে পরেছে, হাত পা ভেঙ্গে যাচ্ছেতাই ভাবে মাহমুদকে নিজের মনের সবটা দিয়ে ফেলেছে।মাহমুদকে ভেবে দিনরাত কাটাচ্ছে।
মাহমুদ বিচক্ষণ ছেলে,মারিয়ার তাকানো, কথা বার্তা,অতিরিক্ত খেয়াল রাখা, দেখলেই মুচকি হাসি তার কানে কানে বলে যায় ভিষণ ভুলের ইঙ্গিত।মাহমুদ মাথা নাড়ে,অবুজের মতো কাজ করা যাবে না,মারিয়া তার বোন।সে মারিয়াকে ডেকে পাঠায়।ঘন কালো মেঘের ঘুরুম ঘুরুম ডাকে মাঝে বিশাল ছাদের এক কোনায় মারিয়া মাহমুদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়া শতভাগ নিশ্চিত যে মাহামুদ তাকে জরুরী কিছু বলবে।মাহামুদ তাকে জরুরী কথাই বলেছে, এসব আবোলতাবোল চিন্তা মাথা থেকে সরাতে বলেছে,সে তার সবটা চেষ্টা কাজে লাগিয়ে মারিয়াকে বুঝাতে চেয়েছে। মারিয়া বুঝেছি কিনা কে জানে কিন্তু এর পর থেকে মাহমুদ বাড়ি আসলে সে সামনে যেতো না,গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন পা টিপে টিপে মাহমুদের রুমে হাজির হতো,ভিষণ যত্ন নিয়ে ছুঁয়ে দিত মাহমুদের চুল,মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো ঘুমেমগ্ন মানুষটার দিকে। আদর নিয়ে যত্ন নিয়ে মাহামুদের প্রতিটা জিনিস ছুঁয়ে দিতো।মাহামুদ বাড়ি গেলেই মারিয়া এমন করতো,যেনো তার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে কিন্তু একদিন মাহামুদের গেঞ্জি গালে লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো,তখন পেছন থেকে শুনতে পায় মাহামুদ বলছে,
“আর কখনো আমার রুমে আসবেনা মারিয়া।”
মারিয়া জমে যায়।রাগী মাহামুদের গমগমে কন্ঠে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।কাঁপা গলায় বললো,
“আমি তো আপনাকে জ্বালাই না। ”
মাহামুদ উঠে আসে,মারিয়ার থেকে যথেষ্ট দূরূত্ব রেখে দাঁড়ায়।
“আমি বলেছি আসবেনা,সুতরাং আসবেনা। ”
মারিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহামুদ চাপা হুংকার দিয়ে বললো,
“বেরিয়ে যাও,বেয়াদব মেয়ে।”
সেই যে বেরিয়ে গেলো আজ অবধি মারিয়া আর ওই রুমে যেতে পারেনি,যাবে কিভাবে মাহামুদ তো বাড়িই আসে না আর রুম সবসময় তালাবদ্ধ থাকে।মাহামুদ যে মারিয়ার কারণেই বাড়ি আসেনা তা সে জানে।
অতীতের স্মৃতি বিচরণ করে মারিয়ার চোখ বেয়ে পানির ধারা দূরন্ত গতীতে ছুটে যায়। আজকে সে নিজেকে একটুও আটকাতে পারছেনা, মোবাইল হাতে নিয়ে মাহামুদকে ফোন দেয়।এমন কোনো দিন নেই সে মাহামুদকে ফোন দেয়না কিন্তু সবসময় বন্ধ করেই রাখে আজকে ভাগ্য তার সহায় ছিলো বলেই হয়তো খুলা পেলো।
মাহামুদ গম্ভীর গলায় বললো,
“হ্যালো।”
মারিয়া মনযোগ দিয়ে মাহামুদের কন্ঠের কথাগুলো নিজের বুকপিঞ্জিরায় গেথে নিলো।উনার কন্ঠ শুনে তার গলায় কান্নারা দল বেধে ছুটে আসে। উনি তাকে আহ্লাদী কিছু বলেনি যে এতো আবেগী হয়ে মন খুলে কাঁদতে হবে কিন্তু মারিয়ার ভিষণ কান্না পেলো,বুকে জমিয়ে রাখা সবগুলো কষ্ট দলা পাকিয়ে বেরোতে লাগলো।মাহামুদ বিরক্ত হয়ে বললো,
“ফ্যাচফ্যাচ করছো কেনো?”
মারিয়া কান্নাভেজা গলায় বললো,
“আপনি বাড়ি আসেন না কেনো?”
“তা তুমি ভালো জানো।”
“প্লিজ বাড়ি আসেন।”
“তোমার মাথা থেকে ফালতু ভাবনাগুলো দূরে সরাও তখনই আসবো। ”
মারিয়া কান্নাভেজা গলায় ফিসফিস করে বললো,
“পারছি না তো। ভিষণ কষ্ট হয়।”
“পারবে,মানুষ পারেনা এমন কিছু এই পৃথিবীতে নেই।”
মারিয়া আগের মতোই ফিসফিস করে বললো,
“সম্ভব না,আপনাকে এতো ভালোবাসি যে…. ”
মারিয়ার কথা অসম্পূর্ণ থাকতেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার টুট টুট আওয়াজের সাথে মারিয়ার বুকটাও ভেঙ্গে যায়।
তিতির আজকাল খেয়াল করেছে,আরফান তাকে বেশ গুরুত্ব দেয়।পরিবারের সবার সামনে কোনো আবদার রাখলে কেউ যদি না মানে তো আরফান কিভাবে যেনো সবাইকে রাজী করায়,অথচ মুখে মুখে সারাক্ষন তিতিরের সাথে রাগ দেখায়।আজকাল আরফানের তাকানোটা তিতিরের বুকে লাগে, সব ছেলেই কি এমন করে তাকায়!নাকি একমাত্র আরফানই তার দিকে এমন মায়াভরা চোখে তাকায়?কলেজে যাওয়ার পরে বান্ধুবীরা আরফানের ফোন নাম্বারের জন্য ধরেছে,যেভাবেই হোক আরফানের সাথে কথা বলাতেই হবে। তিতির বললো,
“উনি এতো রাগী,উনার সাথে কথা বলে কি করবি?”
তিতিরের বান্ধুবী সায়মা বললো,
“রাগী!তাতে কি?তুই জানিস না রাগী ছেলেরাই বউদের বেশী ভালোবাসে। আমার সাথে সেট করাই দে দুস্ত আমি শুধু উনাকেই চাই । ”
সায়মায় কথাগুলো স্বাভাবিক হলেও কেনো জানি তিতিরের গায়ে আগুন ধরে যায় । রাগী গলায় বললো,
“তুই কেনো বউ হতে যাবি?সর সামনে থেকে।’
“আরে চেতস ক্যান?বউ হলে ক্ষতি কি?”
তিতির মাথা নেড়ে বললো,
“না না তুই বউ হতে পারবিনা। ”
“তাহলে কে বউ হবে ;তুই?”
তিতির থমকে যায়,মনের আকাশে কল্পনা করে নেয় সে তিতিরের বউ তারপর এক ঝটকায় মাথা নেড়ে বললো,
“অসম্ভব । ”
“সারাদিন তোর পিছনেই ঘুরে আমার মনে হয় চান্দু তোর জালেই ফাইসা গেছে। ”
তিতির কখনো এসব ভাবেনি,সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
“কি বলিস?”
“তুই খেয়াল করিস না?”
“সে আমার ভাই। ”
“,হ্যাঁ, চাচাতো ভাই।”
“কিন্তু ভাই তো।”
“সমস্যা নাই এই ভাই থেকে সাই বানানো যায়,নো প্রবলেম।”
তিতির আর কোনো কথা বলেনি,চুপচাপ কলেজ শেষ করে বাড়ি এসেছে। মারিয়া হাজরটা কথা বলেও মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারেনি।তিতির সারাক্ষণ এগলোই ভেবেছে,আর কেমন একটা অসস্তি কাটার মতো গলায় আটকে আছে। আজকে প্রায় বিশ দিন হতে চললো আরফান বাড়ি আসেনি আজকেই এসেছে, তিতিরের ভাবনার ডানায় রঙ লাগাতেই বুঝি আজকে মহারাজের বাড়িতে আসা। অতী সাহস নিয়ে তিতির আরফানের রুমের সামনে যায় কিন্তু আরফান রুমে নেই। রুমে না পেয়ে বাহিরে বাগানে যায়।সেখানে আরফান সবার সাথে বসে আছে।তিতিরকে দেখেই আরফান নড়েচড়ে বসে।তিতির অন্যদিনের মতো মোটেও হইচই করছেনা বরং শান্ত হয়ে বসে আছে,বার বার আরফানের দিকে তাকাচ্ছে। আরফানের চোখের দৃষ্টির মাঝে যেনো হাজারো কাব্য ফুটে আছে কিন্তু এসব তিতিরের বোধগম্য হচ্ছে না,সে সবার সাথে কথা বললেও চোখ কেবলমাত্র তিতিরের উপরেই নিবন্ধ।তিতির সবার দিকে তাকানোর পাশাপাশি আরফানের দিকেও তাকাচ্ছে, তারপর তিতিরের দম আটকে আসে, বুকের ভেতরে ফুসফুস তার শ্বাসকার্য থামিয়ে দিতে চায়, অজানা আতংকে ধরফর করে উঠে বুকের পাখি। সে যা ভাবছে আসলেই কি তাই?নাকি সবটাই ভ্রম!সে বেখেয়ালে মাথা নেড়ে বললো,
“অসম্ভব।”
চলবে……