উজান ঘাটের মাঝি পর্ব-০৩

0
696

#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০৩

আরফানের আব্বা শাহাবুদ্দিন খান বৈঠক ঘরে বসে আছেন।সারাজীবন উনি গ্রামের সবার সাহায্যই করে গিয়েছেন কখনো কারো খারাপ করেননি,মানুষজন উনাকে দেখলে ভক্তিভরে তাকায়, সম্মানের সহিত কথা বলে এটাই উনাকে অনেক শান্তি দেয়।উনার মনে হয় মানুষের সাহায্য করার মাঝে যে সুখ নিহিত আছে তা অন্য কোনো কাজে নেই,তাইতো ব্যবসা বানিজ্য সামলানোর পাশাপাশি সমানভাবে গ্রামের সবার ভালো মন্দ দেখেন,সাহায্য করা উনাদের র,ক্তে মিশে আছে।
আরফান ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে।প্রত্যেক সাপ্তাহে বাড়িতে গিয়ে তার পড়ায় আসলেই সমস্যা হয়,রাত জেগে পড়া শেষ করা লাগে কিন্তু সেই’বা কি করবে?মনকে তো বুঝাতে পারে না,মনটা আজকাল এতো বেপরোয়া হয়ে গেছে যে আটকানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।আরফান বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে কিন্তু কোথাও তিতিরের দেখা নেই,মেয়েটাকে না দেখেই চলে যাবে?আরফানের বুক পিঞ্জিরায় কেমনতর ব্যাথা ব্যাথা অনুভূতি হয়।সবার থেকে বিদায় নেয়ার পরেও সে বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে,সেই তাকানোতে ছিলো মরিয়া হয়ে কাউকে খুঁজে নেওয়া। শাহাবুদ্দিন খান বৈঠক ঘর থেকে ছেলেকে লক্ষ করেন,বারবার পেছনে ফিরে তাকানোটা উনার চোখে লাগে,ছেলে এমন করে বারবার তাকাচ্ছে কেনো?উনি গলায় জোর লাগিয়ে আরফানকে ডাকলেন,বাবার ডাক শুনে আরফান সেদিকে এগিয়ে যায়।
শাহাবুদ্দিন খান ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছেলেটা যেনো হঠাৎ করেই বড়ো হয়ে গেলো,এইতো বছর কয়েক আগেও কাধে নিয়ে হেটেছেন অথচ এখন বসে দু কথাও বলা হয় না। ছেলে মেয়ে বড়ো হবার সাথে সাথে কি বাবা মায়ের সাথে দুরূত্ব বেড়ে যায়?শাহাবুদ্দিন অবশ্য ছেলের সাথে মিশার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।আরফান কাছে আসলে উনি বললো,
“তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে আব্বু?”

আরফান পেতে রাখা বড়ো বেঞ্চে বসে বললো,
“ভালো।”

“প্রতি সাপ্তাহে বাড়িতে আসার কারণ কি?”

বাবার থেকে পাওয়া এমন প্রশ্নে আরফান থমকে যায়,যুৎসই উত্তর দিতে ভুলে যায়।মিথ্যা সাজিয়ে বললো,
“বাড়িতে আসলে ভালো লাগে,মন ফ্রেশ থাকে। ”

“বাড়িতে আসার চেয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়া বেশী জরুরি না?”

আরফান হেসে বললো,
“জ্বী । ”

শাহাবুদ্দিন খান ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আমি চাই তুমি ভালো ডাক্তার হও আর আমাদের গ্রামের হসপিটালে বসো। ”

“জ্বী বাবা। ”

“আচ্ছা;যাও,বাড়িতে কম আসলেই ভালো হবে। ”

আরফান হেটে বাগান পেরিয়ে যায়। গেইটের কাছে গিয়ে চোখ পাকিয়ে নিনিয়ার দিকে তাকায়।সে আসলে এই মেয়েকে বুঝতে পারে না,আজব মেয়ে,এতো ছোট অথচ আরফানের ধারনা এই মেয়ের হাড়ে হাড়ে শয়তানী।এই যে এখন পথে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে এসব কেনো করে?আরফান বেশ বুঝে,নিজে যেমন আরেকজনের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকে,তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয় নিনিয়ার মাঝে সে এসব দেখতে পায়।আরফান বিরক্ত,দাদীর আদরের নাতনি বলে কিছু বলতেও পারে না। সে হেটে চলে যায়,নিনিয়াও তার পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাটে । আরফান না বুঝার ভান করে বললো,
“কই যাবি?”

নিনিয়া সামনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
“কোথাও না। ”

“বাড়ি যা। ”

নিনিয়া হেসে চলে যায়। মনেমনে ভাবে ভবিষ্যতে আরফানই তার হাজবেন্ড হবে, এখন পাত্তা না দিয়ে লাভ নাই।

সুফিয়া খানম সারাজীবন আরাম আয়েশ করেই দিন পার করে দিয়েছেন । বিয়ের পরে কখনো স্বামীর বাড়িতে গিয়ে থাকেননি। বাবার বাড়িতে রাজরানীর মতো জীবন কাটিয়েছে । তার মায়ের উপর কথা বলার সাধ্যি কারো নেই,উনি যেমন বলবে তেমনি হবে।দুই ভাইয়ের বউ কখনো শাশুড়ির উপরে কথা বলেন না,বড়ো বোন হিসেবে দুই ভাই আর ভাইয়ের বউয়েরা বেশ মান্য করেই চলে।আজকাল উনার মনে এক সুপ্ত বাসনা জন্মেছে।মেয়েকে দূরে বিয়ে দেয়ার চেয়ে আপন মানুষের কাছে বিয়ে দিয়ে এই বাড়িতে রাখতে পারলে মন্দ হয় না । সুফিয়া খানম নিজের মতো পরিকল্পনা করে রেখেছেন,সময় মতো তা বাস্তবায়ন করতে পিছুপা হবেন না।

তিতির প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিলো।আনমনে গুনগুন করে গান গাইছে,হঠাৎ রাকিব নামের ছেলেটা তার পথ আটকে দাঁড়ায়। তিতির থমথমে মুখে বললো,
“পথ আটকিয়েছিস কেনো?”

“তোকে কিছু বলার আছে। ”

তিতির আন্দাজ করে নেয় রাকিব নামের ছেলেটা কি বলতে চায় । ক্লাসমেট হিসেবে এতোদিন তিতির এইটুকু বুঝতে পেরেছে যে রাকিব আসলে তাকে পছন্দ করে কিন্তু সাহস করে আঘাতে পারছেনা। তিতির কিছু কটু কথা বলার জন্য মুখ খুলবে তখনি দেখে আরফান সিএনজি তে করে যাচ্ছে। রাস্তায় তিতিরকে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে তার ভ্রু কুঁচকে যায় । আরফানকে দেখে তিতির তার মুখের কথা টুপ করে গিলে নেয়।কটু কথা বলার পরিবর্তে মুখে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি,চোখের তারায় খেলে যায় এক আকাশ পরিমান উৎসাহ ।
আরফানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়।চলন্ত গাড়ি থেকে তিতিরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তিতিরের পাশে দিয়ে শো শো গতিতে গাড়িটা চলে যাওয়ার পরে তিতির রাকিবকে বললো,
“শোন,তুই যা ভাবিস তা ভুলে যা,আমার ভাইয়া শুনলে তো হাত পা ভেঙ্গে দেবে । ”

রাকিব নাছোড়বান্দা।সে বললো,
“হাত পা ভাঙ্গবে কেনো?আমরা কি ফালানো নাকি?তোদের সাথে আত্মীয়তা করার অহম আমাদের আছে। ”

“তা হয়তো আছে কিন্তু আরফান ভাইকে চিনিস?উনার মা’র সামলানোর ক্ষমতা নেই।”

“তুই উনার ভয়ে প্রেম করবিনা? ”

তিতির অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে, তাইতো উনি কে যে উনাকে ভয় করে চলতে হবে?তার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই চলবো কিন্তু পরক্ষনেই মনে পরে আরফান ভাই জানতে পারলে তাকে ভ,য়ানক সব শাস্তি দেবে।কিছুক্ষণ আগে যেটুকু দেখেছে তাতেই তো অবস্থা বেগতিক হবে।তিতির আর কিছু না বলে হনহন করে বাড়ির উদেশ্যে চলে যায় ।

বাড়িতে যাওয়ার পরে তিতির ঘুমিয়ে যায়। আরফান বাড়িতে নেই মানে বিন্দাস জীবন।এই সন্ধায় কুম্ভকর্ণর মতো ঘুমায়,আরামে ঘুমানোর এক ফাঁকে তার মনে হলো,কেউ তার রুমে ঢুকেছে,বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিতির চোখ খুলে তাকায়। বিছানার পাশে আরফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে লাফিয়ে উঠে।ঝটপট বললো,
“আপনি যাননি?”

আরফান শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।দু’হাত বুকে মুড়ে রেখেছে।সে বললো,
“না।”

তিতির ভেবেছে আরফান আজকে যা দেখেছে আবার ঢাকা থেকে বাড়ি আসতে আসতে সব ভুলে যাবে কিন্তু এই বান্দা যে আজকেই ফিরে এসেছে কিন্তু কেনো?তিতির ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কেনো?”

আরফান নিচে রাখা কাপড়গুলো তিতিরের বিছানায় রেখে বললো,
“এই কাপড়গুলো ধুয়ে দে। ”

তিতির স্তব্ধ হয়ে এতোগুলো কাপড়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে দিয়ে কাপড় ধোয়ানোর জন্য আপনি ফিরে এসেছেন?”

আরফান ক্যাটকেটে গলায় বললো,
“ধুয়ে দিবি কিনা বল।”

“না। জীবনেও না। আমি কি আপনার চাকর নাকি? ”

আরফান বিছানায় বসে বললো,
“না তুই আমার চাকর না কিন্তু না ধুলে চাচ্চুর কাছে এমন প্যাচ লাগাবো যে বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে যাবে। রাস্তায় ছেলেদের সাথে কথা বলা না!”

তিতির থমথমে মুখে উনার দিকে তাকিয়ে আছে। আরফান যে এমন হু,মকি দেবে তা জানা ছিলো না। এতোগুলা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে তিতির বললো,
“কাপড় ধুয়ে দিলে?”

“কিছু বলবোনা। ”

তিতির থমথমে মুখে কাপড় হাতে তুলে নেয়।জীবনে অশান্তি আনার জন্য এই একজনই যথেষ্ট।আরফানের দিকে র,ক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে চলে যায়।

আরফান তিতিরের বিছানায় শুয়ে পরে। ছাদের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে বলে,
“আমাকে ছাড়া অন্যকারো সাথে কথা বলতে দেখলেও আমার সহ্য হয়না মেয়ে।আর তুমি কিনা হেসে হেসে কথা বলার সাহস করো?তুমি নিজেও জানো না আমি কতো উন্মাদ হতে পারি,এতোবছর ধরে সযত্নে লালন করা ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি কার জন্য?আমি যেমন পাগল হয়েছি তোমাকেও এমন পাগল বানাবো।আরফান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজকাল ঢাকায় গেলে এতো চিন্তা হয়। অথচ তার এই চিন্তার কারন মেয়েটা বুঝেই না। ইশ তার তিতিরটা এতো বোকা!একটুও বুঝে না।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে