#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১০]
রোজকার মতো সকাল হতেই অফিসের উদ্দেশ্যে বাইক নিয়ে বের হয়েছে উচ্ছ্বাস। মেইন রাস্তায় আসতেই নজরে পড়ল অতি পরিচিত একটি মুখ। নিজের মনকে সায় দিয়েই ঠিক তার সামনে বাইকটা থামালো উচ্ছ্বাস। মাথা থেকে হেলমেট সরিয়ে মুচকি হাসলো। জিজ্ঞেস করল,”হেই সায়রী সুন্দরী! এখানে কী করছো?”
সবসময়কার মতোই গাম্ভীর্যটা চোখেমুখে অব্যাহত রাখলো সায়রী। দায়সারা উত্তরে বললো,”রিক্সা খুঁজছি।”
“কোথায় যাবে?”
“কোথায় আবার? ভার্সিটিতে যাবো, সঙ্গে ব্যাগ দেখছেন না?”
“আজ এতো জলদি যে? তোমার ক্লাসের তো এখনো অনেক দেরি।”
“তাতে আপনার কী?”
প্রত্যুত্তর করল না উচ্ছ্বাস। বুঝলো মেয়েটা যে তাকে দেখে বিরক্ত হচ্ছে। হেলমেট পরতে পরতে বললো, “না কিছু না।”
“মানুষ সেজে কোথায় যাচ্ছেন?”
“অফিসে।”
“তার মানে সত্যি সত্যিই আপনি চাকরি করছেন?”
“হুম, সেদিন বললাম না চাকরিটা হয়ে গেছে। বাবা যা শুরু করেছিল তাই না করে আর উপায় নেই।”
“ওহ।”
“আরো অপেক্ষা করবে?”
“তো কী করবো? রিক্সা না পেলে তো অপেক্ষাই করতে হবে। আমার তো আর গাড়ি নেই যে ফুরুৎ ফুরুৎ করে যেখানে সেখানে চলে যাবো।”
পুনরায় মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস। কিন্তু এবারের হাসিটা দৃষ্টিগোচর হলো না সায়রীর। মিহি স্বরে বললো, “তোমার আপত্তি না থাকলে আমার বাইকে উঠে বসতেই পারো। আমি না হয় ভার্সিটির গেইট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
এতক্ষণ যেনো এই প্রস্তাবের জন্যই ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছিল সায়রী। মনে মনে বেজায় খুশি হলো কিন্তু উচ্ছ্বাসের সামনে কিছুতেই তা প্রকাশ করল না। পূর্বের ন্যায় কণ্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বললো,”আপনার আবার দেরি হয়ে যাবে না তো?”
ঘড়ি দেখলো উচ্ছ্বাস। আশ্বস্ত করে বললো,”না দেরি হবে কেন? হাতে এখনো অনেক সময় আছে।”
“তাহলে চলুন কোথাও গিয়ে বসি। তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে চা না খেয়েই চলে এসেছি।”
অপ্রস্তুত হলো উচ্ছ্বাস। যে মেয়ে তাকে সহ্য-ই করতে পারে না সেই মেয়েই কিনা চা খাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে! উচ্ছ্বাসের নিরবতা দেখে সায়রী ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,”আপত্তি আছে?”
“না তো, কীসের আপত্তি? উঠে বসো।”
মনে মনে হাসলো সায়রী। মায়ের কাছে আর কোনো খবর না থাকলেও উচ্ছ্বাসের খবর ঠিকই থাকে। তাই গত রাতেই সুবর্ণা রহমানের থেকে গল্পের ছলে উচ্ছ্বাসের অফিস টাইমের কথা জেনে নিয়েছিল সায়রী। আজ তাড়াতাড়ি বের হওয়ার কারণও মূলত এই উচ্ছ্বাসই।
___
ভার্সিটির কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে এসে বসেছে দুজন। সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। বাইক থেকে নেমেই চায়ের প্ল্যান ক্যান্সেল করে কফি অর্ডার দিয়েছিল সায়রী। নির্বিঘ্নে তাতে চুমুক দিচ্ছে উচ্ছ্বাস। কিন্তু সায়রী তা পারছে না। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সেদিনকার সেই মেয়েটা কে ছিলো জানার কৌতূহল এখনো তার মস্তিষ্ক থেকে যায়নি। প্রশ্নটা কী করবে নাকি করবে না? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। তার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে নিরবতা ভেঙে উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,”তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
থতমত খেয়ে গেলো সায়রী। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে উত্তর দিলো,”হুম।”
“সেদিন রেস্টুরেন্টে যেই ছেলেটার সঙ্গে বসে ছিলে সেই কী তাহলে হবু বর?”
“হুম।”
“ওহ।”
বিষ্মিত হলো সায়রী। উচ্ছ্বাসের এই স্বাভাবিক ব্যবহারটা নিতে পারলো না সহজে। কণ্ঠে কাঠিন্যতা এনে জিজ্ঞেস করল,”তা আপনার সঙ্গে যেই মেয়েটা ছিলো সে কে? প্রেমিকা?”
“কোনো মেয়ের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গেলেই কী সে প্রেমিকা হয়ে যায়?”
“তো কে সে?”
“কলিগ।”
“বাবাহ্! অফিস যেতে না যেতেই একেবারে সুন্দরী মেয়ে কলিগের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে যাতায়াত! সাচ্ছা প্লে বয় তো আপনি।”
“কই সুন্দরী? তোমার থেকে তো অন্তত নয়। তবে তোমার জামাইয়ের ভাগ্য দেখে খুব হিংসে হচ্ছে আমার, কোনো কাঠ খড় না পুড়িয়েই একেবারে ফ্রিতে একটা সুন্দরী বউ পেয়ে যাচ্ছে!”
এবার খুব রাগ হলো সায়রীর। উচ্ছ্বাস কী তবে হতে দিচ্ছে এই বিয়েটা? রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,”এদিকে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অথচ আপনি কিনা এতো স্বাভাবিক? তার মানে আপনি মেনে নিচ্ছেন এই বিয়েটা?”
“আমার মানা না মানার কী আছে? তোমার লাইফ তুমি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছো। নিজে ছেলের সঙ্গে আলাদা সময় কাটিয়ে আবার তাকে পছন্দও করেছো এখানে আমার বলার আদৌ কী কিছু আছে? আগের বিয়ে গুলো অনেক কষ্টে ভেঙেছি কিন্তু এবারেরটা ভাঙা অসম্ভব। তোমার বাবা আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে, তোমরা দুজন দুজনকে পছন্দও করো এখানে আমি আর কী করতে পারি?”
রাগ গলে বিরহ ঘাঁটি গাড়লো সায়রীর মনে। আহত দৃষ্টিতে তাকালো উচ্ছ্বাসের মুখপানে।শুধালো,”কিছুই করার নেই?”
ভ্রু যুগল কুঁচকে সায়রীর চোখে চোখ রাখলো উচ্ছ্বাস। সন্দিহান কণ্ঠে শুধালো,”কী করার আছে? আমার তো কিছুই করার নেই। এর আগে অনেকবার বাবার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু বাবা বিষয়টা এড়িয়ে চলেছে। এবার খুব সিরিয়াস ভাবে বাবাকে তোমার কথা বললাম কিন্তু বাবা বিয়েতে রাজি নয়।”
“কেন? আঙ্কেলের কী আমাকে পছন্দ নয়?”
“পছন্দ হবে না কেন? তুমি তো ভালো একটা মেয়ে তোমাকে পছন্দ না করার কোনো কারণ তো নেই। তবে আমাকে তোমার বাবা মোটেও পছন্দ করেন না। এমনকি তুমিও তো বলে দিয়েছো আমায় নাকি পছন্দ করো না, ভালোবাসো না, আমায় সহ্য হয় না। তোমার বাবা নিজ মুখে আমার বাবাকে বলেছে তুমি নাকি ছেলেকে পছন্দ করেছো, অতি দ্রুত বিয়ে করতে রাজি হয়েছো তাই বাবা চান না আমি যেনো দ্বিতীয়বার তোমাকে বিয়ের কথা মুখে আনি। আমার আর কী করার আছে? অযথা পরিবার মানবে না, তুমি মানবে না তাহলে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করে আমি কী করবো? বাদ দাও পুরোনো প্রসঙ্গ নতুন জীবনের জন্য তোমায় শুভকামনা।”
কথাগুলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করল সায়রীর। ইচ্ছে করল সামনে বসা পুরুষটির দু গালে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বলতে,”তুই আবার অন্যের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম দেস কবে?” কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না সায়রী। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। সায়রীর উদ্দেশ্যে বললো,”সময় হয়ে গেছে এখন আমায় যেতে হবে। চলো গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দেই তোমায়।”
“আপনি যান আমি আরো কিছুক্ষণ এখানে বসবো।”
বিপরীতে তেমন কিছুই বললো না উচ্ছ্বাস। বিল পে করে বিদায় নিয়ে প্রস্থান করল।সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশটা হয়ে গেলো খুবই গম্ভীর এবং বিষণ্ণতায় ঘেরা। সায়রী উপলব্ধি করল এই মুহূর্তে তার মনটা হো হো করে কেঁদে উঠতে চাইছে। কেমন এক যন্ত্রনা হচ্ছে কিন্তু কীসের এই যন্ত্রনা?কষ্মিনকালেও সে ভাবতে পারেনি উচ্ছ্বাস নামক ছেলেটি যে এতো দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাবে। কেন জানি কিছুতেই আজ ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না সায়রীর। আরো একটা কফির অর্ডার দিয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। একে একে কল লাগালো সব বন্ধুদের নিকট। ঠিকানা জানিয়ে তাদের চলে আসতে বললো ক্যাফেতে। মন খারাপে না হয় চূড়ান্ত এক আড্ডা হোক।
_____
দুপুরে বাড়ি ফিরে গোসল নামাজ সেরে ঘুম দিয়েছে সায়রী। কড়া গলায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে,”কেউ আমায় ডাকাডাকি করে একটুও বিরক্ত করবে না বলে দিলাম। আমি এখন মনোযোগ সহকারে ঘুমাবো।”
হঠাৎ মেয়ের এমন আচরণে চমকান তপন রেজা কিন্তু সুবর্ণা রহমান তাতে বিশেষ কোনো পাত্তা দিলেন না। তিনটে বাজতেই সায়রীর কড়া ঘুম ভেঙে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে ধীরে ধীরে পেট ভরে খাবার খেলো। তপন রেজা তখন সোফায় বসে সকালের অর্ধ পড়া খবরের কাগজের বাকি অংশটুকু তে চোখ বুলাচ্ছেন। ততক্ষণে খাওয়া শেষ করে বাবার সামনে এসে উপস্থিত হলো সায়রী।
মেয়ের উপস্থিতি সহসাই টের পেলেন তপন রেজা। কাগজ থেকে চোখ না তুলেই শুধালেন,”কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“তা বল।”
“তোমার কী মনে হয় বাবা আমি এখনো আমার জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে শিখিনি? আমি কী এখনো ছোটো আছি?”
“প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছেই তার সন্তান সবসময় ছোটোই থাকে তবে আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে খুব বুদ্ধিমতি। সে নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে পারে।”
বাবার এহেন উত্তরে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো সায়রীর মন। নম্র কণ্ঠে বললো,”আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবা। সিদ্ধান্তটা অনেক ভেবেচিন্তে জেনেবুঝেই নিয়েছি। আশা করি তুমি আমার সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করবে না।”
এবার মাথা তুলে মেয়ের পানে তাকালেন তপন রেজা। বুঝতে পারলেন মেয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলবে। বাবার চোখেমুখে স্পষ্ট সায় দেখে সায়রীর মনে অবাধ সাহসের সঞ্চার হলো। নির্দ্বিধায় বললো,”আমি জানি ফুয়াদ খুবই ভালো একটা ছেলে কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করতে পারবো না বাবা। আমি শুরুতেই কথাটা বলেছিলাম তোমাদের কিন্তু তোমরা আমায় বিয়ে না করার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলে। আসলে কারণটা আমি নিজেই তখন জানতাম না, জানতাম না বললেও ভুল হবে আসলে জেনেও আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। তবে এবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর আমার মনের বিরুদ্ধে যাবো না। সংসার যেহেতু আমাকেই করতে হবে সেহেতু আমার জীবনে বিয়ে নামক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা আমি নিজেই নিতে চাই। এতে কী তোমার কোনো আপত্তি আছে বাবা?”
মেয়ের এমন আচরণের সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নন তপন রেজা। মেয়ে উনার উড়নচণ্ডী হলেও বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গেই সে সর্বদা একমত তবে মেয়েকে কোনো বিষয়ে কখনোই জোরজবরদস্তি করেননি তপন রেজা। আজও করবেন না কারণ মেয়ের চোখেমুখে আজ তিনি মারাত্মক গুরুতর এবং গম্ভীর ভাব দেখতে পাচ্ছেন। রয়েসয়ে বিপরীতে প্রশ্ন করলেন,”তা কী সেই কারণ? এবার কী বলা যাবে? তুই কী কাউকে পছন্দ করিস?”
সায়রীর সহজ স্বীকারোক্তি,”জ্বি বাবা।”
একটুও চমকালেন না তপন রেজা। মেয়ে উনার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।পছন্দ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রথমে কেন জানালো না সেসব বিষয় নিয়ে একটু আক্ষেপ হলো তবে তাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ভেবেই নিলেন হয়তো বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এমন একটি কথা বলতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল।
নিরবতার অবসান ঘটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”তা ছেলে কী করে? কোথায় থাকে? বাবা-মাকে নিয়ে আসতে বল।”
“ছেলে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তাছাড়া ছেলে তোমার পূর্ব পরিচিত।”
“পূর্ব পরিচিত! আমি চিনি ছেলেকে?”—বেশ আশ্চর্য হলেন তপন রেজা।
“হ্যাঁ বাবা।”
“নাম কী?”
“উচ্ছ্বাস। সাব্বির আঙ্কেলের ছেলে।”
এমন একটি নাম মেয়ের মুখ থেকে যে শুনতে হবে তা কষ্মিনকালেও ভাবতে পারেননি তপন রেজা। নিরবতা উনাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো। কয়েক মিনিট বাদে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালেন,
“উচ্ছ্বাস! উচ্ছ্বাসকে তোর পছন্দ?”
রান্নাঘরের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বাবা-মেয়ের প্রতিটি কথাই কর্ণপাত হয়েছে সুবর্ণা রহমানের। ‘উচ্ছ্বাস’ নামটা শুনতেই আনন্দিত, পুলকিত হয়ে উঠলো উনার মন। এগিয়ে এসে ঢপাস করে বসে পড়লেন সোফায়। চোখমুখ থেকে উপচে পড়তে লাগলো অধিক আনন্দ। আহ্লাদী সুরে বললেন,”কী বললি? উচ্ছ্বাসকে তোর পছন্দ? তাকে তুই বিয়ে করবি?”
একঝাঁক লজ্জা গ্ৰাস করল সায়রীকে। সে তো শুধু বলেছে উচ্ছ্বাসকে তার পছন্দ কিন্তু মা তো একেবারে বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছে। বাবা-মায়ের সম্মুখে এমন একটি কথা বলা যে নিতান্তই লজ্জাকর তা এতক্ষণে টের পেলো সায়রী। তপন রেজা হয়তো কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। উনাকে কিছু বলার সময় সুযোগ না দিয়েই সুবর্ণা রহমান বলে ফেললেন,”এই প্রথম তোকে নিজের মেয়ে ভাবতে আমার গর্ববোধ হচ্ছে। সঠিক একটা ছেলেকে বেছে নিয়েছিস তুই। আমার না মাঝেমধ্যে খুব আফসোস হতো ওই ছেলেটাকে কেন আমি পেটে ধরলাম না? তবে মেয়ে জামাই হিসেবে তো তাকে আমি পেতেই পারি। মেয়ে জামাই ছেলের থেকে কম কীসে?”
তৎক্ষণাৎ মাঝপথে স্ত্রীকে থামিয়ে দিলেন তপন রেজা। বললেন,”তুমি ভালো মন্দর কী বোঝো?”
“অবশ্যই বুঝি। তোমাদের গোষ্ঠীর থেকে হাজার গুনে উচ্ছ্বাস ভালো। তোমরা জীবনে নিজেদের বাড়ির বউদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পেরেছো? দাওনি। তোমার ছেলে-মেয়েরাও তা পারেনি অথচ ছেলেটা কী সুন্দর করে আমায় ডাকে ‘শুভ আন্টি’ আহা! বুকটা ভরে যায়। কত ভালোবাসে আমায়! এমন ছেলে যদি সত্যি সত্যি তোমার মেয়েকে বিয়ে করে তাহলে তোমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর ভাগ্য তা।”
স্ত্রীর এহেন কথায় অপমান বোধ করলেন তপন রেজা। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,”ওই ইডিয়টটাও কী তোকে পছন্দ করে?”
উপর নিচ মাথা নাড়ালো সায়রী।তপন রেজা পুনরায় বললেন,”ভালো করে আরেকবার ভেবে দেখ।”
“ভেবেছি বাবা। ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তপন রেজা। আহত কণ্ঠে বললেন,”তুই যেহেতু নিজ হাতেই নিজের জীবন ধ্বংস করতে চাইছিস তাহলে আমি আর কী বলবো? ওকে বলে দিস যাতে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে অতিদ্রুত এখানে চলে আসে।”
বামে মাথা এলিয়ে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ঘরে চলে গেলো সায়রী। তপন রেজার চোখেমুখে হতাশা আর সুবর্ণার চোখেমুখে তখন উপচে পড়া খুশি।
অফিস শেষে আজও মিশমি মেয়েটার সঙ্গে পথে দেখা উচ্ছ্বাসের। কেন জানি আজ অফিসে তার সঙ্গে তেমন একটা কথা বলেনি মেয়েটা। উচ্ছ্বাস যথেষ্ট তাকে এড়িয়ে গিয়ে তার সামনে দিয়েই বাইক নিয়ে চলে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিশমি। একটা সিএনজি থামিয়ে উঠে গেলো তাতে।
রাতে খাবার খেয়ে বিছানায় সবে শুয়েছে উচ্ছ্বাস। মোবাইল হাতে নিয়ে ডাটা অন করতেই বেশ চমকালো।সায়রীর একাউন্ট থেকে মেসেজ এসেছে। সময় না নিয়ে মেসেজ সিন করতেই চক্ষু চড়কগাছ। মেসেজে লেখা,”মেসেজটা চোখে পড়লেই দ্রুত আমায় কল দিবেন।”
সায়রী এখনো অনলাইনেই আছে। উচ্ছ্বাসও আর বিলম্ব না করে কল দিলো। রিসিভও হলো সঙ্গে সঙ্গে। কিছু বলার আগেই অপরপাশ থেকে সায়রী বলে উঠলো,”বিয়ে সাদী করার জন্য কী আপনি প্রস্তুত?”
বড়োসড়ো এক ঝটকা খেলো উচ্ছ্বাস। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে ভাবতে লাগলো, ঠিক শুনেছি তো? ভাবনার মধ্যেই পরিচিত কণ্ঠস্বর হতে পুনরায় প্রশ্ন এলো,”কী প্রস্তুত নন?”
“অবশ্যই প্রস্তুত। সঠিক সময়ে বিয়ে করলে এতদিনে আমার বাচ্চাকাচ্চা হাঁটাহাঁটি শিখে যেতো।”
“খুব ভালো, শুনে সন্তুষ্ট হলাম।”
“কেন বলো তো? হঠাৎ এমন প্রশ্ন? ননদ টনদ আছে নাকি? তুমি কী তোমার ননদকে আমার ঘাড়ে গছাতে চাচ্ছো ন্যাড়া সুন্দরী?”
“প্রথমত আমি ন্যাড়া নই, দ্বিতীয়ত আমার কোনো ননদ নেই আর যদি থাকতোও তাহলে সে সম্পর্কে আপনার বোন হতো।”
“আমার বোন?”
“হুম, এবার আসল কথায় আসি। আপনার জন্য একটা মেয়ে দেখেছি, মেয়েটা খুবই সুন্দর, সব দিক দিয়েই ভালো। এমন মেয়ে বউ হিসেবে পাওয়া আপনার এই জীবনের ভাগ্য।”
“ওহ আচ্ছা।”
“হুম তাই আগামীকালকের মধ্যেই আপনার বাবা-মাকে সঙ্গে করে রেজা ভিলায় চলে আসবেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”
“রেজা ভিলায় কেন?”
“মেয়েটা তো রেজা ভিলাতেই থাকে।”
“কী বলো? তোমার বর্ণনা অনুযায়ী রেজা ভিলায় এমন মেয়ে তো দিখিনি কোনোদিন।”
“দেখেছেন দেখেছেন। শুধু মনে করতে পারছেন না।”
“নাম কী মেয়ের?”
“মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের নামটাও অনেক সুন্দর। সায়রী রেজা, বাড়িওয়ালা তপন রেজার একমাত্র কন্যা। বিয়ের বয়স হয়েছে অনেক আগেই। লোকটা মেয়ের জন্য সৎ পাত্র খুঁজছিলেন তখনি আমি আপনার কথা বললাম উনাকে। প্রথমে রাজি না হলেও আপনার নামে এতো এতো প্রশংসা করলাম যে শেষমেশ সৎ পাত্র ছেড়ে অসৎ পাত্রেই কন্যা দান করতে রাজি হয়ে গেলেন।”
বেশ অবাক হলো উচ্ছ্বাস। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলো,”কিন্তু উনার মেয়ের তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”
“হুম তবে আপনার জন্য বড্ড মায়া হয় আমার। আপনার মতো অসৎ পুরুষকে তো আর কেউ ভালো মেয়ে দিবে না তাই বাধ্য হয়েই বিয়েটা ভেঙে দিয়ে আপনার কথা তুললাম। উনারা বললেন আপনাকে বাবা-মা সঙ্গে নিয়ে হাজির হতে।”
“মজা করছো আমার সঙ্গে? মাত্র অফিস থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘরে এলাম। তাই আমি ক্লান্ত, এখন এসব মজা করে রাতের ঘুম কেড়ে নিও না সায়রী সুন্দরী।”
সায়রীর রাগ হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,”আপনি কী আমার বেয়াই লাগেন উচ্ছ্বাস? আপনার সঙ্গে আমি কেন মজা করবো? যা বলেছি সত্যি বলেছি।”
টনক নড়লো উচ্ছ্বাসের। শোয়া থেকে উঠে বসলো। সায়রী যে মজা করছে না তা তার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট। জিজ্ঞেস করল,”হঠাৎ আমাকে বিয়ে করবে? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“আহা আমি কেন বিয়ে করবো? বিয়ে তো করবে তপন রেজার কন্যা সায়রী রেজা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো উচ্ছ্বাস। সায় দিয়ে বললো,”এটাই তো কেন করবে বিয়ে? আমার জানামতে তপনের মেয়ে তো আমায় সহ্য করতে পারে না।”
“হবু শ্বশুরের নাম ধরে বলছেন কেন বেয়াদব?”
“স্যরি, তপন শ্বশুর।”
“জীবনে একটু যদি এন্টারটেইনমেন্ট আর ভাইব না থাকে তাহলে কীভাবে চলবে বলুন তো? যা বুঝলাম ফুয়াদ নামক ছেলেটা অতি ভদ্র এবং মা ভক্ত পুরুষ। এমন পুরুষকে জীবনে বিয়ে করলে শুধু সুখই থাকবে তবে এন্টারটেইনমেন্ট আর ভাইব থাকবে না তাই ভেবেচিন্তে বিয়ের জন্য আপনাকে বেছে নিলাম। আপনার সঙ্গে বৈবাহিক জীবন বেশ জমবে আমার তাছাড়া নেহার আন্টিকেও শাশুড়ি হিসেবে আমার খুবই পছন্দ।”
কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা উচ্ছ্বাস। সায়রী এবার তাড়া দেখিয়ে বললো,”আচ্ছা সে কথাই রইলো তবে। কাল দেখা হবে আমাদের। আমি শাড়ি পরে তৈরি থাকবো হবু সোয়ামি।”
কথাটা শেষ করেই দ্রুত কল কেটে দিলো সায়রী। উচ্ছ্বাসের মনে হলো সে যেনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে। যার দরুন পূর্বের ন্যায় এখনো মোবাইল কানে ধরেই বসে আছে।
চলবে _________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)
#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১১]
সায়রীর সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর ওই রাতের বেলাতেই বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে তাদের সবটা ভালো করে বুঝিয়ে বলেছে উচ্ছ্বাস। কিন্তু সাব্বির আহমেদ কিছুতেই যেনো ছেলের কথা বিশ্বাস করলেন না। পরেরদিন সকাল হতেই তপন রেজা নিজে সাব্বির আহমেদকে ফোন করে পরিবারসহ বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। উনার ফোন পেয়েই পরবর্তীতে সবটা বিশ্বাস করেছেন সাব্বির আহমেদ।
ধরণীতে সন্ধ্যে নেমেছে ঘণ্টাখানেক পূর্বে। এই মুহূর্তে সাব্বির আহমেদ এবং নেহার বেগম বসে আছেন সায়রীদের ড্রয়িং রুমের সোফায়। উনাদের ঠিক সামনে বসে আছে তপন রেজা এবং সায়ান। রমেসাকে নিয়ে রাতের রান্নার আয়োজন করতে ব্যস্ত ইকরা। রমেসা এ বাড়ির খুবই পুরোনো লোক। যত যাই হোক না কেন এই শুভদিনেও তার উপর রেগে থাকাটা খুবই অন্যায় দেখায় যার কারণে সায়রী মাকে বলে আবারো তাকে কাজে ফিরিয়ে এনেছে। খুশিতে গদগদ হয়ে সকাল থেকে এ নিয়ে বেশ কয়েকবার সায়রীর নিকট ক্ষমাও চেয়েছে রমেসা।
সুবর্ণা রহমান এসেও এবার সোফায় বসলেন। তপন রেজা মুচকি হেসে এবার আসল প্রসঙ্গে এলেন। সাব্বির আহমেদের উদ্দেশ্যে বললেন,”দেখুন তো কী এক কাণ্ড? কখনো কী ভাবতে পেরেছি শেষে কিনা আমাদের ছেলে-মেয়ে একে অপরকে বিয়ে করতে চাইবে আর তাদের বিয়ে দিয়ে আমাদের বেয়াই হতে হবে?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাব্বির আহমেদ। অসহায় কণ্ঠে বললেন,”আমি তো আগেই আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম যে মেয়েকে একটু দেখেশুনে রাখুন। এলাকায় কিন্তু ইতর ফাতরা ছেলের অভাব নেই।”
উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন তপন রেজা। বললেন,”আমি কী আর জানতাম নাকি ইতর ফাতরা বলতে আপনি নিজের ছেলেকেই যে বুঝিয়েছেন?”
নেহার রূষ্ট হলেন।স্বামীর মুখে প্রাণপ্রিয় ছেলের এমন সম্বোধন কিছুতেই সহ্য হলো না উনার। তবে এর তীব্র প্রতিবাদ করলেন সুবর্ণা।উনাদের সাবধান করে দিয়ে বললেন,”একদম উচ্ছ্বাসকে নিয়ে কোনো ধরণের বাজে মন্তব্য করবেন না বলে দিলাম। আজকালকার দিনে এমন ভালো ছেলে কয়টাই বা পাওয়া যায়? কী সুন্দর তার আচার ব্যবহার। এমন আচার ব্যবহার আমার নিজের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও আমি এখনো খুঁজে পাইনি।”
ছেলের প্রশংসায় খুশি হলেন নেহার কিন্তু এই মুহূর্তে সবটাই সাব্বির আহমেদের নিকট খুব ভালো করেই পরিষ্কার। ছেলেটা যে আগে থেকেই হবু শাশুড়িকে পটিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করে রেখেছে তা বুঝতে অতো বেগ পেতে হলো না উনাকে। বিয়ের কথা পাকাপাকি হতেই স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেন সাব্বির আহমেদ কিন্তু রাতের খাবার না খাইয়ে তাদের বিদায় দিতে রাজি হলো না রেজা পরিবার। অগত্যা বাধ্য হয়েই স্ত্রীকে নিয়ে খেতে বসলেন তিনি।
বিছানায় মোবাইল নিয়ে বসে আছে সায়রী। বারবার কল দিচ্ছে উচ্ছ্বাসকে। খানিক বাদে কল ব্যাক হলো। রিসিভ করেই চাপা ধমকে সায়রী বলে উঠলো,”কী ব্যাপার? সমস্যা কী আপনার? এলেন না কেন?”
“বাবা-মা তো গিয়েছে।”
“কিন্তু আপনি কেন আসলেন না? পাত্র হিসেবে যে আপনার একটা দায়িত্ব আছে তা কী জানেন না?”
“আমি এসে কী করবো?”
“কথা বলবেন।”
“বলবো কথা বাসরঘরে।”—মজার ছলে কথাটা বলে উঠলো উচ্ছ্বাস।
তৎক্ষণাৎ মেজাজটা চূড়ান্ত খারাপ হলো সায়রীর। বিপরীতে কড়া কিছু বলে দেওয়ার ইচ্ছে জাগলো কিন্তু ইচ্ছেটাকে এই মুহূর্তে দমিয়ে রাখলো সে। সময় সুযোগ বুঝে না হয় সব উত্তর একসঙ্গে দেওয়া যাবে। তাই আর ফিরতি বাক্য বিনিময় না করে কল কেটে দিলো। বিড়বিড় করে বললো,”কথায় কথায় শুধু অপমান আর অশ্লীল কথাবার্তা তাই না? সব মনে রেখে দিলাম। বিয়ের পর একে একে সব উসুল করে ছাড়বো, হুহ।”
রাতে বাড়িতে ফিরতেই বাবা-মাকে চেপে ধরলো উচ্ছ্বাস। উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,”কী বললো সবাই?বিয়েতে রাজি হয়েছে তপন আঙ্কেল?”
ছেলের এতো উৎসাহী ভাব দেখে বিরক্তবোধ করলেন সাব্বির আহমেদ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,”হ্যাঁ রাজি হয়েছে। সামনের সপ্তাহের শেষেই তোদের বিয়ে।”
“সামনের সপ্তাহের শেষে? এতো তাড়াতাড়ি?”
“হ্যাঁ, তপনকে আমিই অনেক বুঝিয়ে একেবারে দিন তারিখ ঠিক করে এসেছি। যত তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে দেওয়া যায় ততোই আমার শান্তি। কানের কাছে এসে তো আর বিয়ে করবো বিয়ে করবো বলে ঘ্যানঘ্যান করতে পারবি না।”
এই মুহূর্তে কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিত বুঝতে পারলো না উচ্ছ্বাস। মনটা লাফিয়ে উঠলো খুশিতে। আহা মনের মানুষকে অবশেষে নিজের করে পাবে সে।
______
বিয়ের জন্য শুরু হয়ে গেলো মহা ব্যস্ততা। দিন তিনেক পার হতেই শুরু হলো বিয়ের কার্ড ছাপানো। সুবর্ণা, নেহার, ইকরা মিলে একযোগে শুরু করেছে বিয়ের কেনাকাটা। সাব্বির আহমেদ ইতোমধ্যেই ভাড়া করে ফেলেছেন কমিউনিটি সেন্টার। ধীরে ধীরে বাড়িতে আসা শুরু করেছে আত্মীয় স্বজনের দল।
অফিস থেকে এখনো ছুটি নেওয়া হয়নি উচ্ছ্বাসের। চাকরিতে জয়েন করতে না করতেই ছুটি? কেমন একটা লজ্জাকর ব্যাপার স্যাপার। অফিস থেকে ফিরে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক বদলেই বেচারা ছুটেছে নিচে। মিনিট দশেক আগে সায়রী ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের বাদ বাকি সব কেনাকাটা করতে যাবে তাই এসে নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। উচ্ছ্বাস হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো নিচে। তার উপস্থিতি টের পেতেই মুখ তুলে চাইলো সায়রী। শুধালো,”এতো দেরি হলো কেন?”
“মাত্র অফিস থেকে ফিরেছি আর তখনি তোমার কল। ফ্রেশ হতে হতে যা সময় লাগলো।”
“ওহ, তাহলে চলুন এবার।”
“ওয়েট, বাইক বের করে নেই।”
“বাইকের দরকার নেই। অনেক কেনাকাটা আছে, বাইক দিয়ে চলবে না।”
বিপরীতে দ্বিমত করল না উচ্ছ্বাস। সায়রীর কথাই নির্বিঘ্নে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললো। কয়েক গলি পার হতেই উঠে পড়ল সিএনজিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে পৌঁছেও গেলো শপিং মলে। সায়রী সর্বপ্রথম উচ্ছ্বাসকে নিয়ে প্রবেশ করল শাড়ির দোকানে। কয়েকটা শাড়ি ওলটপালট করে দেখে বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো। বললো,”না একটা শাড়িও পছন্দ হচ্ছে না।”
দোকানদার ছেলেটা বাইশ তেইশ বছরের টগবগে যুবক। দাঁত কেলিয়ে হেসে একটা গাঢ় লাল বেনারসী এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,”আপা এই শাড়িটা দেখেন। আপনে যেই সুন্দর শাড়িটায় কিন্তু আপনারে খুব মানাইবো।”
হাত বাড়িয়ে শাড়িটা ধরতে নিলো সায়রী কিন্তু ধরতে পারলো না। চটজলদি শাড়িটা দূরে সরিয়ে দিলো উচ্ছ্বাস। বললো,”এই শাড়িটা একদম সুন্দর না।তোমাকে ল্যাহেঙ্গাতেই মানাবে। চলো অন্য দোকানে যাই।”
দোকানির মুখটা যেনো মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। আর বিলম্ব না করে সায়রীকে নিয়ে এবার ল্যাহেঙ্গার দোকানে প্রবেশ করল উচ্ছ্বাস। অনেক খুঁজে বাছ বিচার করে তারপর নিজের পছন্দ মতো একটা ল্যাহেঙ্গা কিনলো। ল্যাহেঙ্গাটা সায়রীরও বেশ পছন্দ হয়েছে তাই আর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দ্বিমত করল না।
প্রয়োজনীয় সব কেনাকাটা শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে একেবারে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বের হয়েছে দুজনে। সায়রীর বাড়ির সামনে আসতেই নিজের হাতে থাকা ব্যাগ গুলো সায়রীর হাতে ধরিয়ে দিলো উচ্ছ্বাস। ব্যাগ গুলো নিজ হাতে নিয়ে তার থেকে বিদায় নিয়ে গেইটের ভেতরে পা বাড়ালো সায়রী। তখনি পেছন থেকে উচ্ছ্বাস বলে উঠলো, “কয়েক দিন আগেও যাকে সহ্য করতে পারতে না এখন কিনা তাকেই বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেছো? ধুমধাম করে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছো? ব্যাপার কী সায়রী? হুট করে তোমার মন এতোটা বদলে গেলো কেন?”
পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো সায়রী। পেছন ফিরে তাকালো।দৃষ্টিগোচর হলো উচ্ছ্বাসের প্রশ্নবিদ্ধ মুখশ্রী। কাঠ কাঠ গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল,”আমার মন বদলানোতে কী আপনি খুশি নন?”
“খুশি হবো না কেন?”
“তাহলে অযথা প্রশ্ন করছেন কেন? আচ্ছা শুনুন বিয়েতে কিন্তু আপনার কলিগদেরকেও দাওয়াত দিবেন, বুঝেছেন?”
“সব কলিগ নাকি শুধু ওই মেয়ে কলিগ?”—বলেই ভ্রু বাঁকালো উচ্ছ্বাস।
সায়রী ভেতরের দিকে হাঁটা ধরলো। যেতে যেতে বললো,”যা মনে করেন তাই।”
মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস। মেয়েটা যে ভেতরে ভেতরে ভীষণ জেলাস হয়েছে খুব বুঝতে পারছে সে। আর বিলম্ব না করে এবার নিজ বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো।
______
বাড়িতে আত্মীয় স্বজনে গাদাগাদি অবস্থা। পাশের ফ্ল্যাটটা খালি থাকায় সাব্বির আহমেদ সেখানেই সকলের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।রেজা ভিলার ছাদে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে। চারিদিকে ঝলমল করছে রঙ বেরঙের মরিচ বাতি। কাজিন শ্রেণীরা মেতে উঠেছে আনন্দে। দুই হাত ভর্তি মেহেদী লাগিয়ে প্যান্ডেলের ভেতরে নিজ আসনে বসে আছে সায়রী। নিরবে দেখে যাচ্ছে সকলের আনন্দ।
আফরিনের মুখটা আজ ভার। সবাই আনন্দ করছে অথচ সে একপাশে চুপচাপ বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করছে সায়রী। এবার এগিয়ে গিয়ে চাচাতো বোনের পাশে বসলো। প্রশ্ন করল,”কী রে কী হয়েছে তোর? খুব বড়াই করে তো বলতি আমার বিয়েতে নাকি খুব আনন্দ করবি তাহলে আজ এতো চুপচাপ কেন? মন খারাপ?”
ভড়কে গেলো আফরিন। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,”ককই কিছু হয়নি তো আপু।”
“একদম মিথ্যে বলবি না। আমি কিন্তু তোর সব কাহিনী জানি।”
আফরিনের চোখেমুখে আতঙ্ক। শুধালো,”তুমি কী জানো আপু?”
“তুই যা লুকাচ্ছিস তাই জানি।এবার নিজ মুখে সবটা স্বীকার করবি নাকি আমি সবাইকে ডেকে জানাবো তোর কুকীর্তি?”– কিছুটা ধমকের সুরেই কথাটা বলে উঠলো সায়রী।
মাথা নুইয়ে নিলো আফরিন। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,”তোমার তো বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছিল আপু তাহলে কেন ওই বিয়েটা ভেঙে উচ্ছ্বাস ভাইকে বিয়ে করছো? আমার জানামতে তুমি তো উচ্ছ্বাস ভাইকে সহ্যই করতে পারো না তাহলে? তুমি মোটেও এই কাজটা ঠিক করছো না আপু।”
বেশ আশ্চর্য হলো সায়রী। আফরিনের মুখ থেকে সত্যি কথা বের করার জন্যই সে এতক্ষণ মিথ্যে বলছিল। আসল কথা তো হচ্ছে সে কিছুই জানে না। জানে না আফরিনের মন খারাপ করে বসে থাকার কারণ। কৌতূহলী কণ্ঠে শুধালো,”তুই কী উচ্ছ্বাসকে পছন্দ করিস?”
মাথা নাড়ায় আফরিন। ফিসফিসিয়ে বলে,”শুধু পছন্দ নয় একেবারে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।”
“কবে থেকে?”
“সেই ক্লাস টেন থেকে। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়সই ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হতো, ভাইয়া আমার সঙ্গে মিষ্টি করে হেসে কথা বলতেন। চকলেটও খাওয়াতেন মাঝে মধ্যে। সেখান থেকেই উনার প্রতি আমার ভালোবাসার সৃষ্টি। তারপর স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে উঠলাম। একদিন কলেজে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে ভাড়া নিতে ভুলে গিয়েছিলাম ভাগ্য ভালো উনার সঙ্গে রাস্তায় দেখা তখন উনিই আমায় ভাড়া দিয়েছিলেন শুধু তাই নয় টিফিনের টাকাটাও দিয়েছিলেন। তুমি যেদিন এসাইনমেন্ট নিতে এলে সেদিনও উনি আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বারান্দা দিয়ে আমি নিজে উনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বারবার উপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি জানি উনিও আমায় খুব ভালোবাসেন কিন্তু পরিবারের চাপে তোমায় বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।”
সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেললো সায়রী। মনে মনে উচ্ছ্বাস নামক অসভ্য পুরুষটিকে অজস্র গালি দিলো। শেষমেশ তার চাচাতো বোনটিকেও কিনা ছাড়লো না লোকটি? কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে সায়রী বললো,”আর আমি উনাকে ভালোবাসতাম সেই ক্লাস নাইন থেকে।স্কুলে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গেও উনি হেসে হেসে কথা বলেছেন শুধু পরিচিত হিসেবে। তোর সঙ্গেও তাই। তোকে মাঝেমধ্যে চকলেট দিতো আর আমার জন্য রোজ রোজ চকলেট আনতেন। একদিন উনাদের বাসায় না গেলে নিজে এসে দিয়ে যেতেন। সেদিন তোর জন্য নয় বরং আমার জন্য তোদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি। ব্যাটা আমার কতগুলো বিয়ে ভেঙেছে জানিস?
বিষ্ময়ে হতবাক আফরিন। বিষ্ময় ধরে রেখেই শুধায়,
“কয়টা?”
“মোট আটখানা।”
“কিহ্!”
“হুম, এই যে বখাটেপনা ছেড়ে চাকরিতে গেছে না? এও আমার জন্য। মূলত আমাকে বিয়ে করার জন্য। আমার ভার্সিটির সামনে গিয়েও রোদের মধ্যে কত যে দাঁড়িয়ে থেকেছে আমার অপেক্ষায়। আমি বের হলে একেবারে আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আমার মায়ের সঙ্গেও ভাব করে নিয়েছিল শুধু আমাকে একটু দেখার জন্য আর তুই কিনা দুদিনের পিচ্চি বলিস তোকে ওই ছেলে ভালোবাসে? এসব ফ্যান্টাসি থেকে বের হ। তোর দুলাভাই হতে চলেছে উচ্ছ্বাস। তবে তোর জন্য দুলাভাই ডাকটা নিষিদ্ধ। শালী হিসেবে লুতুপুতু আমি একদম মেনে নেবো না। আজ থেকে তাকে তুই ভাইয়া বলে ডাকবি। ভাইয়ার আগে পরে কোনো নাম টাম চলবে না। একেবারে ভাইয়া মানে ভাইয়া। নিজের আপন ভাইয়া। মনে থাকবে?”
উপর নিচ মাথা নাড়ায় আফরিন। প্রেম হওয়ার আগেই দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে যায় তার মন। ভগ্ন হয় হৃদয়। এবার সন্তুষ্ট হলো সায়রী। হাতের মেহেদী প্রায় শুকিয়ে এসেছে তাই মোবাইলটা নিয়ে চলে গেলো কিছুটা দূরে, ফাঁকা স্থানে।
ছাদে বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে উচ্ছ্বাস। আহিল কলার ঠিক করে বলে উঠলো,”এদিকে আমি আর রাশেদ মিলে প্ল্যান করে রেখেছিলাম, বিয়ের দিন যখনি ভাবী পার্লারে সাজতে বের হবে তখনি আমরা ভাবীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো কাজী অফিসে তারপর মাথায় ভাড়া করা বন্দুক ঠেকিয়ে তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবো। এমনকি ভাবীর বাপের কাছ থেকে কৌশলে কিছু মুক্তিপণও দাবি করবো। সেই টাকা থেকে অর্ধেকটা তোদের হানিমুনের পেছনে খরচ করে বাকি অর্ধেকটা দিয়ে আমরা দুদিন ধরে পার্টি করবো। কিন্তু সব তো সেগুড়ে বালি হয়ে গেলো দোস্ত! ভাবী কিনা এতো সহজে সব ঠিকঠাক করে নিলো?”
বন্ধুদের আহাজারিতে হেসে উঠলো উচ্ছ্বাস। বাবা যতোই এদের অপছন্দ করুক না কেন, দিনশেষে এই বন্ধুরাও তো তার পরিবারের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সব পরিস্থিতিতেই এরা হাসায়, উৎসাহ দেয়, সাহস জোগায়। তাদের আশ্বস্ত করে উচ্ছ্বাস বললো,”চিন্তা নেই। বিয়েটা ঠিকভাবে হয়ে যাক তারপর আমি নিজেই তোদের বড়োসড়ো একটা ট্রিট দিবো। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথের পাহাড় থেকেও ঘুরে আসিস। সকল খরচ আমার।”
কথাটা শুনতেই সকলে সম্মিলিতভাবে হইচই করে উঠলো। কিন্তু এসব কিছুই রাশেদের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না। সে গভীর ভাবনায় মগ্ন। ভাবনার মধ্যেই বলে উঠলো,”ভাবীকে আমার কাছে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না রে মামা। বিয়ের পর চোখ কান হাত মুখ সব খোলা রেখে সংসার করিস। মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে কিন্তু একদম ভুলে যাস না। যেই জ্বালান জ্বালিয়েছিস ভাবীকে এরপরেও যে শোধ তুলবে না এমন কোনো গ্যারান্টি কিন্তু নেই।”
রাশেদের কথায় হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে গেলো উচ্ছ্বাসের। এমনিতেও যেই ধানি লঙ্কা সে বিয়ে করছে তাতে যে সারাজীবন ঝালে হা হুতাশ করতে হবে সে সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত উচ্ছ্বাস। তবে কিছুই করার নেই তার। ওই যে বলে না প্রেম হলো কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না। উচ্ছ্বাসের জীবনটাও ঠিক এমনি। যত চেষ্টা করেছে সায়রী নামক মেয়েটির থেকে দূরে যেতে ততোই যেনো অবাধ্য মন তাকে বেহায়া বানিয়ে টেনে হেঁচড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে সায়রীর সামনে।
তৎক্ষণাৎ ঝংকার তুলে মোবাইলটা বেজে উঠলো উচ্ছ্বাসের। স্ক্রীনে ভাসমান সায়রীর নাম্বার। এক সাইডে সটকে গিয়ে রিসিভ করল কল। অপরপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর,”কোনো ম্যানারস নেই আপনার? কল দিয়েছি বলেই কী রিসিভ করবেন?”
“তাহলে কী করবো?”
“অবশ্যই কল কেটে আবার ব্যাক দিবেন।”
তাই করল উচ্ছ্বাস। কল কেটে ব্যাক দিলো। শুধালো,
“এবার হয়েছে?”
তার উত্তর দিলো না সায়রী। বললো,”আপনাকে এতদিন আমি মজার ছলে প্লে বয় বলতাম উচ্ছ্বাস কিন্তু আপনি তো দেখছি সত্যি সত্যিই মারাত্মক লেভেলের প্লে বয়।”
“আমি আবার কী করলাম?”
“কী করেননি তাই বলুন। যেখানে যাবেন সেখানেই একটা করে মেয়ে পটিয়ে আসবেন?”
“আমি এমনিতেই যেই হ্যান্ডসাম আর হট তাতে আবার নিজ থেকে গিয়ে মেয়ে পটাতে হয়? মেয়ে তো এমনিতেই পটে যায় যেমন পটেছিল আমার নিব্বি সায়রী।”
কথায় হেরে গিয়ে রাগ দেখিয়ে দ্রুত কল কেটে দিলো সায়রী। স্ক্রীনে তাকিয়ে মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস।
চলবে _______
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)