#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৯]
রাগ, জেদ, ক্ষোভ শব্দগুলোর বিস্তার মানবজীবনে ক্ষণস্থায়ী। তেমনি সায়রীর সব রাগও এখন রূপান্তরিত হয়েছে অভিমানে। উচ্ছ্বাসের উপর তার মারাত্মক অভিমান জমেছে। আজ তিনদিন ধরে উচ্ছ্বাস নামক অসভ্য পুরুষটির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় না। সেই যে রেস্টুরেন্টে কিছু সময়ের জন্য দুজনের চোখাচোখি হলো তারপর আর কেউই কারো মুখোমুখি হয়নি। রাগের মাথায় খুব গুরুতর একটা অঘটনও ঘটিয়ে ফেলেছে সায়রী। ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করে আসার পরপরই বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন,”তা ফুয়াদকে কেমন লেগেছে সায়রী মা?”
সায়রী দাঁতে দাঁত চেপে উত্তরে বলেছে,”খুব ভালো লেগেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করো বাবা।”
এই মুহূর্তে নিজেকে নিজের কাছেই অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে সায়রীর। মন কী চাইছে বুঝতে পারছে না সে। আচ্ছা উচ্ছ্বাসকে এখনো কী সে ভালোবাসে? হয়তো বাসে, ভালোবাসা কী এতো ঠুনকো শব্দ নাকি যে সহজেই তা মানব জীবনে আসবে আবার চলেও যাবে? যারা সত্যিকারের ভালোবাসে তাদের ভালোবাসা কী আদৌ নিঃশেষ হতে পারে? না পারে না। একটা সময় উচ্ছ্বাস নামক পুরুষটির জন্য কত পাগলামিই না করেছে সায়রী, তবে এখন? এখনো কী সায়রী ভালোবাসে উচ্ছ্বাসকে? হয়তো বাসে কিন্তু নিজের কাছে এই সত্যটা স্বীকার করতে কেমন যেনো এক কুণ্ঠাবোধ হয়। উচ্ছ্বাসের ভাবনা মন মস্তিষ্কে আসলে বারবার সেই ভাবনাকে বিতাড়িত করেছে সায়রী। জোরপূর্বক নতুন ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে। উচ্ছ্বাস স্ব-ইচ্ছায় সামনে এলে প্রকাশ করেছে বিরক্তি এবং রাগ। কিন্তু এই মুহূর্তে সায়রী অনুভব করল তার ভীষণ কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। উচ্ছ্বাসের অমন আচরণে মনের গহীনে চাপা পড়ে আছে ভারি এক দুঃখ। ভাবনার মধ্যেই খেয়াল করল ইতোমধ্যে তার চোখ জোড়ায় হানা দিয়েছে অশ্রু।
চারিদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। মাগরিবের আজান পড়তেই সায়রীর টনক নড়ল। সকল দুঃখ, কষ্ট, ভাবনার অবসান ঘটিয়ে নিচে নেমে এলো সায়রী।ঘরে গিয়ে অযু করে নামাজ পড়ে নিলো।
_________
অফিস থেকে সবে বাইক নিয়ে বের হয়েছে উচ্ছ্বাস। পথিমধ্যেই দেখা হয়ে গেলো মিশমির সঙ্গে। মেয়েটি হাতের ইশারায় তাকে থামতে বললো। অনিচ্ছাসত্বেও বাইক থামালো উচ্ছ্বাস। চেয়েও মেয়েটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে যেতে পারলো না। এক অফিসে কাজ করায় ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু দেখায়। মিশমি এগিয়ে এলো। ইতস্তত কণ্ঠে বললো,”আমাকে একটু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবেন? আজ একটু দ্রুত বাড়িতে যেতে হবে সেই জন্যই তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়েছিলাম অথচ দেখুন গাড়ি পাচ্ছি না। যা দুয়েকটা সিএনজি আসছে তাও আবার অধিক ভাড়া চাইছে। তার উপর একা একটা মেয়ে আমি। একা একটা সিএনজিতে করে কীভাবে বাড়ি পৌঁছাই বলুন তো? দিনকাল ভালো নয়, কার মনে কি আছে কে জানে?”
উচ্ছ্বাসের সোজাসাপ্টা উত্তর,”তো রিক্সায় করে চলে যান। আপনি তো বললেন অফিস থেকে আপনার বাড়ির দূরত্ব বেশি একটা নয়।”
মিশমি চোখেমুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললো,”আহা আপনি বুঝতে পারছেন না, এই রাত বিরেতে একা যাওয়া আমার উচিত হবে না। তাছাড়া রিক্সা করে তো আরো অনুচিত। আপনি যদি আপনার বাইকে আমায় লিফট দিতেন খুব উপকৃত হতাম।”
উচ্ছ্বাসের এই মুহূর্তে খুব করে ইচ্ছে জাগলো মুখের উপর বলে দিতে, এতদিন তাহলে বাড়ি ফিরেছেন কীভাবে? যত্তসব ঢং। এতদিন যেভাবে ফিরেছেন আজও সেভাবেই ফিরুন। খুব ইচ্ছে হলেও কথাটা বলতে পারলো না উচ্ছ্বাস। গলা পর্যন্ত এসে বাক্যগুলো আটকে গেলো। নিজের পরিচিতি কাছের মানুষদের সঙ্গে উচ্ছ্বাস যেমন আচরণই করুক না কেন অপরিচিত বাহিরের মানুষদের সামনে তার আচরণ নিতান্তই ভিন্নরকম।
উত্তরের আশায় উচ্ছ্বাসের মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে আছে মিশমি। বাইক থেকে নেমে গেলো উচ্ছ্বাস। কয়েক মিনিট খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে একটা রিক্সা ঠিক করল। মিশমির দিকে এগিয়ে এসে বললো,”নিন এবার উঠে পড়ুন।”
মুখশ্রী মলিন হয়ে গেলো মিশমির। অভিমানী কণ্ঠে বললো,”আমাকে একটু লিফট দিলে কী আপনার বাইক জ্বলে যেতো? নেহাৎ আজ একটু তাড়া ছিলো আর মনমতো গাড়িও পাচ্ছিলাম না তাই লিফট চাইতে বাধ্য হয়েছি। আচ্ছা বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।”
যথেষ্ট নম্র কণ্ঠে উচ্ছ্বাস প্রত্যুত্তরে বললো,”ভুল বুঝবেন না আমায়। আপনার আর আমার বাড়ির রাস্তা দুটো দুদিকে। এখন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার আমি বাড়ি ফিরবো যা অনেক সময়ের ব্যাপার। তাছাড়া এই মুহূর্তে আমি খুব ক্লান্ত।”
কথাটা বলেই দ্রুত গিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো উচ্ছ্বাস।
ননদের জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে ইকরা। ভাবীকে দেখতেই তাকে টেনে এনে বিছানায় বসালো সায়রী। বিব্রত কণ্ঠে বললো,”কিছু কথা ছিলো ভাবী।”
ইকরা বসলো ননদের সম্মুখে। বললো,”বলো।”
“আচ্ছা ভাবী, ধরো মন চাইছে একজনকে কিন্তু পরিবার বিয়ে ঠিক করেছে আরেকজনের সঙ্গে তো এখন কী করা উচিত? কার কথা শোনা উচিত? মনের নাকি পরিবারের?”
ননদের কথায় অবাক হলো ইকরা। জিজ্ঞেস করল,”তার মানে তোমার মনে অন্য কেউ আছে? এই জন্যই বিয়ে করতে চাইছো না তাই তো?”
ঘাবড়ে গেলো সায়রী। জোর গলায় বললো,”না না ভাবী। আমার কেউ থাকলে তো অবশ্যই তোমায় সব জানাতাম। আসলে আমার এক বান্ধবী আমায় এই প্রশ্নটা করেছিল কিন্তু উত্তরটা আমার জানা নেই বলে তোমায় জিজ্ঞেস করলাম।”
“মন যাকে চায় তাকে যদি তুমি ভালো করে চেনো জানো, সে যদি তোমার জন্য ভালো হয় তাহলে তোমার উচিত মনের কথা শোনা। অনেক সময় মানুষ ভুল মানুষকে ভালোবেসে ভুল মানুষের সঙ্গেই সংসার বাঁধে। আবার বাবা-মাও যে সবসময় সঠিক হয় এমনও কিন্তু নয়। অনেক সময় বাবা-মাও মানুষ চিনতে ভুল করে তাই বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে বাঁধা পড়ার আগে ভালো করে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সংসার যেহেতু তোমাকেই করতে হবে তাই তোমার মতামত তোমার পছন্দটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
“বাবা-মা যাকে ঠিক করেছে তাকেও তো আমার খারাপ মনে হয়নি।”
“ফুয়াদ ভাই যেমন খারাপ নয় তেমনি উচ্ছ্বাস ভাইও কিন্তু খারাপ নয়। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় ছোটো থেকে, উনি তোমাকে যতটা বোঝেন মনে হয় না অন্য কেউ তোমায় অতটা বুঝতে পারবে। উনার বাবা-মাও তোমাকে খুব স্নেহ করে। কখনো তোমাদের মধ্যে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে সহজেই তা মিটিয়ে ফেলা যাবে তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে তুমি তাকে ভালোবাসো।”
অস্থির নেত্রে ভাবীর পানে তাকালো সায়রী। ঘন পল্লব ঝাপটে চঞ্চল কণ্ঠে বললো,”না ভাবী আমি উনাকে।”
কথার মধ্যিখানেই তাকে থামিয়ে দিলো ইকরা। বললো,”তুমি উনাকে ভালোবাসো। ভালো না বাসলে অন্য পুরুষকে বিয়ে করা নিয়ে এতো আপত্তি কীসের? আসলে তোমার মনের ভেতরে উনার প্রতি অভিমান জমা হয়েছে যার কারণে তুমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছো।”
হার মেনে নিলো সায়রী। চোখেমুখে ফোটে উঠলো অসহায়ত্ব। ভরাট কণ্ঠে বললো,”উচ্ছ্বাস আমার অনুভূতি নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছিল ভাবী। সবই তো তোমার জানা। আচ্ছা সব বাদ, আমি যখন উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আমায় ভালোবাসে কিনা, উত্তরে উনি কী বলেছে জানো?”
“কী বলেছে?”
“বলেছে আমি তোমায় একটুও ভালোবাসি না সায়রী কিন্তু আমার তোমাকে লাগবে। তোমাকেই আমি বিয়ে করবো। অথচ আজ এক সপ্তাহ হতে চললো আমার সঙ্গে উনি নিজ থেকে দেখা করেননি। সেদিন রেস্টুরেন্টে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে দেখে এলাম উনাকে। উনিও আমায় দেখেছেন অথচ এমন ভাব নিলেন যেনো চিনেই না আমায়। সেই ঘটনার তিনদিন পার হলো তারপরেও কোনো যোগাযোগ করল না।”
মুচকি হাসলো ইকরা। বললো,”তুমি ভাইয়ার সঙ্গে যেমন আচরণ করো তারপরেও তো উনি তোমায় কিছুই বলেন না আর তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আমার রিলেশন চলাকালীন একটা ধমকও আমি তাকে দিতে পারিনি। আমাকে তোমার ভাই জীবনে প্রপোজ পর্যন্তও করেনি। সিনিয়র হওয়ার দরুন র্যাগিং এর ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন ফায় ফরমায়েশ খাটাতেন। এই যেমন, ‘তেষ্টা পেয়েছে একটু পানি খাওয়াও তো জুনিয়র। ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার আগে রোজ আমায় লম্বা করে একটা সালাম দিয়ে যাবে। ক্ষুধা লেগেছে ক্যান্টিন থেকে সিঙ্গারা কিনে এনে দাও তো।’ এসব যেমন সহ্যও করতে পারতাম না তেমন মুখের উপর না ও করতে পারতাম না। তাদের ছিলো বিশাল এক গ্যাং। সেই তুলনায় আমার মোটে দুটো সাদাসিধে বান্ধবী। সবার মুখে শুনে এসেছি সিনিয়ররা খুব খারাপ হয়, উনাদের কথা না শুনলে নাকি ক্যাম্পাসে টিকে থাকা মুশকিল। এভাবেই একটা বছর কাটলো। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই হঠাৎ একদিন তোমার ভাই আমার সামনে এসে বললো, ‘আমার সঙ্গে প্রেম করবে ইকরা?’ আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না করলাম অথচ সেসবে সে পাত্তাই দিলো না। উল্টো ধমক দিয়ে বললো, ‘তোমার হ্যাঁ না তে আমার কিছু যায় আসে না। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করবো। আজ থেকে তুমি আমার প্রেমিকা।’ তারপর আমার মতামত ছাড়াই শুরু হয়ে গেলো আমাদের নাম মাত্র প্রেম। অতি দ্রুত ক্যাম্পাসের সবাইও তা জেনে গেলো। রাতারাতি আমি বনে গেলাম ক্যাম্পাসের ভাবী।”
শব্দ করে হেসে উঠলো সায়রী। তার সঙ্গে তাল মেলালো ইকরাও। হাসি থামিয়ে পুনরায় বললো,
“একটা সময় আমিও এই মানুষটার প্রতি খুব বাজে ভাবে দুর্বল হয়ে গেলাম। লেখাপড়া শেষ হতে না হতেই তোমার ভাইয়ের মাথায় বিয়ের ভূত চাপলো। তাই পরিবারকে মানাতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়ল কিন্তু তোমাদের পরিবার তো কিছুতেই মানবে না এই সম্পর্ক। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম সমস্যা নেই, আমার লেখাপড়াটা আপাতত শেষ হোক আর তুমিও বরং বাবা-মাকে মানানোর চেষ্টা করে যাও। একসময় না একসময় তো মানবেনই কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। কিছুতেই যেনো কিছু হলো না। একটা সময় আমার বিবিএ শেষ হলো। ওদিকে আমার পরিবারও আমার বিয়ে ঠিক করল। তোমার ভাইকে জানানোর পর সে কিছুই বললো না। কদিন পর হুট করে তোমার ভাই খুলনায় এসে আমায় ফোন দিয়ে জানালো, আমি তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি ইকরা।পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে এসো। এখনি আমরা বিয়ে করবো। যদি একটুও দেরি হয় তাহলে আমি কিন্তু সুইসাইড করবো বলে দিলাম। এই কথা শুনে যেমন আমি অবাক হয়েছি তার থেকেও বেশি ভয় পেয়েছিলাম। শেষে আমার বাপ ভাইরা জোর করে বাড়ির ভেতরে এনে অনেক বোঝালো তাকে কিন্তু তার এক জেদ আমায় নাকি এই মুহূর্তেই সে বিয়ে করবে। এমনকি বলে দিলো, আপনাদের মেয়ে যেহেতু আমার সঙ্গে প্রেম করেছে সেহেতু বিয়েও তার আমাকেই করতে হবে আর তা এখনি। যেখানে সাইন করতে হবে করবো তবুও বউ ছাড়া আমি কোথাও যাচ্ছি না। সেদিক থেকে উচ্ছ্বাস ভাই তো এমন কিছুই করেনি।”
এই গল্পগুলো আগেও শুনেছে সায়রী তবে এই মুহূর্তে সে কিছুটা মিইয়ে গেলো। ইকরা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ননদের কাঁধে হাত রেখে বললো,”এইতো কিছুদিন হলো উচ্ছ্বাস ভাই নতুন চাকরিতে জয়েন হয়েছে তাই হয়তো কাজের চাপ একটু বেশি। তোমার উচিত উনার সঙ্গে গিয়ে কথা বলা। দেরি হয়ে গেলে আবার যেনো তোমাকেই না আফসোস করতে হয়।”
ব্যথায় জর্জরিত দৃষ্টি নিয়ে ভাবীর পানে তাকায় সায়রী কিন্তু সেই দৃষ্টি অগ্ৰাহ্য করে কক্ষ ত্যাগ করে ইকরা।
______
রাতে খাবার টেবিলে আসতেই বাবাকে খাবার সম্মুখে নিয়ে বসে থাকতে দেখে চমকায় উচ্ছ্বাস। চেয়ার টেনে বসে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,”ব্যাপার কী মা? তোমার সোয়ামি আজ এ সময় খাবার টেবিলে যে?”
ছেলের কথায় কেশে উঠলেন সাব্বির আহমেদ। নেহার চোখ রাঙানি দিতেই থেমে গেলো উচ্ছ্বাস। চুপ করে খাবার খেতে লাগলো। সাব্বির আহমেদ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,”তা তোর অফিসের কী খবর? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”
“খুব ভালো।”
“ভালো হলেই ভালো।”
খানিক নিরবতার পর মুখ তুলে চাইলো উচ্ছ্বাস। বাবার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে বিস্তর হেসে শুধালো,”তোমার মন মেজাজ কী আজ ভালো বাবা?”
“কবে আবার খারাপ ছিলো?”
“তার মানে ভালো?”
“হ্যাঁ।”
“কতটুকু ভালো? একটুখানি নাকি অনেকখানি?”
খাবার রেখে ছেলের পানে এবার গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাব্বির আহমেদ। বাবার চাহনিতে হাসিটা চওড়া হলো উচ্ছ্বাসের। লাজুক কণ্ঠে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,”দেখো বাবা আমি এবার খুবই সিরিয়াস। চাকরিতেও জয়েন করেছি আর এই চাকরি যাওয়ার কোনো চান্সও নেই।”
“আসল কথায় আয়।”—সাব্বির আহমেদের সোজাসাপ্টা জবাব।
“অলরেডি আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে বাবা। এদিকে মাও বাড়িতে একা, সারাদিন একা একা থাকতে কী একটা মানুষের ভালো লাগে বলো? তাছাড়া মায়ের নাকি একটা মেয়ের অনেক শখ ছিলো কিন্তু তুমি তো আর সরাসরি সেই শখ পূরণ করতে পারোনি তাই যদি আমার বিয়েটা দিয়ে দিতে। দেখো এতে কিন্তু সবারই লাভ।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো উচ্ছ্বাস। ছেলের কথায় স্তব্ধ নেহার।সাব্বির আহমেদ এতক্ষণে খাওয়া থামিয়ে দিয়েছেন তবে এবার আর রাগলেন না। ছেলে যে নির্লজ্জ তা এতদিনে উনার বোধগম্য তাই বললেন,”ঘটক ঠিক কর।”
আনন্দিত, পুলকিত হয়ে উঠলো উচ্ছ্বাসের মন। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,”আহা ঘটকের পিছনে টাকা খরচ করে লাভ কী? পরিচিতদের মধ্য থেকেই কাউকে ঠিক করো না।”
“পরিচিত? এমন কেউ আছে বলে তো আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”
“আহা মনে করে দেখো না।”
এবার গভীর ভাবে ভাবতে লাগলেন সাব্বির আহমেদ। কিছুক্ষণ ভাবার পর বললেন,”তোর ফুফাতো বোনদের তো সেই কবেই বিয়ে হয়ে গেছে, তাহলে? চাচাতো বোন অবশ্য আছে তবে তাদের কথা কিন্তু একদম মাথায় আনবি না ওরা আমাদের বংশের মেয়ে অর্থাৎ ওদের সঙ্গে কোনোমতেই আমি তোর বিয়ে দিবো না। আর তোর নানার বংশের দিকে অন্তত ফিরেও তাকাস না। ওই বংশের একটা মেয়ে এনে আমার অর্ধেক জীবন যায় যায় অবস্থা হয়ে গেছে তাই আমি চাই না তোর জীবনও এমন হোক।”
স্বামীর কথায় ফুঁসে উঠলেন নেহার। কটাক্ষ করে বললেন,”তোমার বংশ বুঝি খুব ভালো? আমি বলে তোমার মতো হার কিপটের সংসার করছি।”
কথায় কথা বাড়ে তেমনি সাব্বির আহমেদও পাল্টা জবাবের জন্য প্রস্তুত হলেন কিন্তু পারলেন না। উনাকে থামিয়ে দিয়ে উচ্ছ্বাস বলে উঠলো,”এসব ঝগড়া ঝাটি আমি এখন মানবো না। আগে বিয়ের কথা তারপর অন্য কথা।”
ছেলের এহেন কথায় দুজনেই থেমে গেলেন। উচ্ছ্বাস আগ্ৰহ নিয়ে বললো,”বাবা তোমার বন্ধুর মেয়ের কথা তো বললে না?”
“বন্ধুর মেয়ে?”
উচ্ছ্বাস উৎসাহিত কণ্ঠে বলে উঠলো,”হ্যাঁ হ্যাঁ।”
আবারো ভাবনায় পড়লেন সাব্বির আহমেদ। ভেবে চিন্তে বললেন,”আজাদের তো কোনো মেয়ে নেই বরং তিনটে ছেলে ছিলো। শাহীনের দুটো মেয়ে অবশ্য ছিলো তারমধ্যে একটা তোর থেকে বয়সে বড়ো। তার বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চাও হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টার বিয়ে তো এ বছরই খেয়ে এলাম। আর কেউ আছে বলে তো মনে পড়ছে না।”
“তাহলে তোমার কলিগ?”
“ওরা এখন নাতি নাতনিদের সঙ্গে খেলা করে। বিয়ের বয়সী মেয়ে পাবে কোথায়?”
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো উচ্ছ্বাস। সব কথায় আসছে কিন্তু আসল কথাতেই বাবা আসছে না। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না উচ্ছ্বাস। চটজলদি বলে উঠলো,”সব বললে অথচ রেজা আঙ্কেলের মেয়ে সায়রীর কথা তো একবারও বললে না? সেও তো তোমার কলিগ হয়, বন্ধুও বলা চলে তাহলে? হাতের নাগালে এতো সুন্দরী মেয়ে থাকতে অতো দূর দূরান্তে চলে যাচ্ছো কেন?”
“সায়রী! তোর সায়রীকে পছন্দ?”—চমকায়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন নেহার।
সাব্বির আহমেদ কটাক্ষ করে বললেন,”সবে জানলে ছেলের কুকীর্তি? তোমার ছেলে সেই কবে থেকে এই মেয়েকে রাস্তা ঘাটে উত্যক্ত করে যাচ্ছে।”
বাপ-ছেলের কথায় একের পর এক শক খাচ্ছেন নেহার। সাব্বির আহমেদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “সায়রীর বিয়ে এবার পুরোপুরি পাকা। চাইলেও তুই আর এই বিয়েতে ভাংচি দিতে পারবি না।”
উচ্ছ্বাস নিজেই এবার বিষ্মিত। বাবা তারমানে সব জানে? অথচ জেনেও কী সুন্দর না জানার ভান ধরে ছিলো এতদিন। নেহার পুনরায় বলে উঠলেন, “বিয়েতে ভাংচি?”
“হ্যাঁ, এই পর্যন্ত মেয়েটার ঠিক হওয়া প্রতিটা বিয়েতেই তোমার ছেলে ভাংচি দিয়েছে। কদিন আগে আংটি পরিয়ে গেলো না? সেই বিয়েটাও তোমার ছেলেই ভেঙেছে। সব খবরই কিন্তু আসে আমার কানে।” এবার উচ্ছ্বাসের পানে তাকালেন সাব্বির আহমেদ। বললেন,”আগেই বলেছিলাম ওইসব বন্ধু বান্ধব বখাটে পনা বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মন দে। ভালো একটা চাকরি কর কিন্তু না বাবার কথা শুনলি না এখন বসে বসে তার বিয়ে দেখ। কদিন পর এমনিতেই বিয়ের কার্ড বাড়ি পর্যন্ত চলে আসবে চিন্তা করিস না।”
উচ্ছ্বাস অসহায় মুখ করে বললো,”এমন করো না বাবা। বিয়ে তো আর এখনো হয়নি। যে করেই হোক এই বিয়েটাও আমি না হয় ভেঙে দিয়ে আসবো তারপর তোমরা গিয়ে আমার সঙ্গে সায়রীর বিয়ে পাকা করে আসবে।”
“লাভ নেই। মেয়ে জামাই হিসেবে তপনের তোকে পছন্দ নয়।”
“কীভাবে বুঝলে?”
“হাবভাব দেখে বুঝলাম। তোকে নিয়ে অনেক কথাই বলেছে সে, আফসোস করেছে। তাছাড়া মেয়েরও তো তোকে পছন্দ নয়।”
“কে বলেছে তোমায়? আমি নিশ্চিত সায়রী এখনো আমায় ভালোবাসে শুধু প্রকাশ করে না।”
বিদ্রুপ হাসলেন সাব্বির আহমেদ। বললেন,”তাই যদি হতো তাহলে বারবার পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসে থাকতো না। মেয়েকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে তপন। বিয়ে ঠিক করার সময়ও মেয়ের অনুমতি চেয়েছে। সে নিজে আমায় বলেছে তার মেয়ের নাকি ছেলে পছন্দ হয়েছে এবং বিয়েতেও রাজি হয়েছে। তোকে পছন্দ করলে কী আর রাজি হতো?”
বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল উচ্ছ্বাস। বাবার কথা ভুল নয়। এর আগেও বিয়েতে রাজি হয়েছিল সায়রী তবে তখন অতকিছু ভাবেনি উচ্ছ্বাস। শুধু নিজের কথাই ভেবে এসেছে কিন্তু এই মুহূর্তে বাবার কথাগুলো তাকে ভাবাচ্ছে। সত্যিই কী সায়রী এখন আর তাকে পছন্দ করে না? রেস্টুরেন্টের সেই ছেলেটাই কী তার হবু বর? অফিসের জন্য টাইম মিলিয়ে সায়রীর সঙ্গে দেখা করার জো টুকুও নেই। কতদিন দুজনে মুখোমুখি হয় না। কই সায়রী তো একবারও খোঁজ নিলো না। একবারও কী তার চিন্তা হলো না তাকে বিরক্ত করা ছেলেটা কেন হুট করে উধাও হয়ে গেলো? ভাবনার মধ্যেই সাব্বির আহমেদের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। হাত ধুয়ে তিনি খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। যেতে যেতে বললেন,”মরীচিকার পেছনে ছুটে লাভ কী? তার পেছনে কম ছোটাছুটি তো আর করিসনি। এখন এসব বন্ধ কর। যা হচ্ছে হতে দে। নিজের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”
কথাটা শেষ হতেই নিজ কক্ষে প্রবেশ করলেন সাব্বির আহমেদ। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো উচ্ছ্বাসের থেকে। নেহার রয়েসয়ে বললেন,”কখন এসব হলো? তোদের মধ্যে যে কিছু চলছে আমি কেন বুঝতে পারিনি? তুই-ই বা আগে কেন আমায় বললি না এ বিষয়ে? তাহলে আমি অন্তত কিছু একটা করতে পারতাম। এখন তো আর কিছুই করার নেই। সব হাতের বাহিরে চলে গেছে। আচ্ছা আগে যে সারাক্ষণ সায়রী এ বাড়িতে এসে বসে থাকতো তা কী তোর জন্য?”
উপর নিচ মাথা নাড়ালো উচ্ছ্বাস। নেহার প্রশ্ন করলেন,”তুই কী ওর প্রতি খুবই সিরিয়াস?”
“হুম।”
নেহারও এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙিতে বললেন,”তখন মেয়েটা ছোটো ছিলো তাই হয়তো অমন পাগলামি করেছে। ওসব ধরে বসে থেকে লাভ নেই। সায়রীর সঙ্গে আমারও অনেকবার কথা হয়েছিল যা বুঝলাম বিয়েতে সত্যিই সে রাজি তাই তোর আর ওদিকে পা না বাড়ানোই উচিত হবে। ব্যাপারটা বাহিরে জানাজানি হলে অযথা পারিবারিক সম্পর্কগুলো নষ্ট হবে। আশেপাশের মানুষের তো আবার মুখে কোনো লাগাম নেই। তিল থেকে তাল বানিয়ে ছাড়বে। তোর বাবা যা বলেছে তোর ভালোর জন্যই বলেছে। জীবনে তো কোনো কথাই শুনলি না এবার অন্তত বাবার কথামতো চল।”
উত্তর দিলো না উচ্ছ্বাস। খাওয়াটা অসম্পূর্ণ রেখেই হাত ধুয়ে চলে গেলো ঘরে। ভেতর পুড়ছে তার। আজকের রাতটা হয়তো নিদ্রাহীনতায়ই কাটাতে হবে।
চলবে __________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)