উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত সায়রী পর্ব-০৮

0
766

#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৮]

রাতের অন্ধকার বিলীন হয়ে দিনের আলো ফোটছে ধরণীতে। পা টিপে টিপে চোরের মতো বাড়িতে প্রবেশ করছে উচ্ছ্বাস। সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে আরেকবার লক্ষ্য করে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কেউ তার কাঁধে হাত রাখলো। পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। মুহুর্তেই ভিতরটা ধক করে উঠলো। হাতের মালিক কে হতে পারে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সে। পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠের প্রশ্ন এলো,”কী ব্যাপার চোরের মতো বাড়ি ঢুকছিস কেন?”

শুকনো ঢোক গিলে পেছন ফিরলো উচ্ছ্বাস। জোরপূর্বক হেসে বললো,”চোরের মতো ঢুকবো কেন? নিজের বাড়িতে কেউ কী চুরি করতে আসে? আসলে তোমাদের যদি ঘুম ভেঙে যায়? সে জন্যই তো সতর্কতা অবলম্বন করে প্রবেশ করলাম। ঠিক করেছি না বাবা?”

“তা কীভাবে ঢুকলি? তোর মা তো ঘুমাচ্ছে, দরজাও তো লক করা।”

“আমার কাছে এক্সট্রা চাবি ছিলো।”

“ওহ, গত রাতে কোথায় ছিলি?”

“মসজিদে। ইমামের সঙ্গে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”

উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলেন সাব্বির আহমেদ। কথাটা সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। গতকাল সন্ধ্যায় বাবার সামনে যা বলেছে তারপরেও বাড়ি ফেরার সাহস পায়নি উচ্ছ্বাস। অগত্যা বাধ্য হয়ে মসজিদেই রাতটা কাটিয়েছে সে। প্রসঙ্গ বদলে সাব্বির আহমেদ ছেলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,”আজ তো চাকরির প্রথমদিন তাই না?”

উপর নিচ মাথা নাড়ালো উচ্ছ্বাস।ব্যাপারটা পুরোপুরি ভাবেই মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাবাকে তা আর বুঝতে দিলো না। সাব্বির আহমেদ পুনরায় বললেন,”বাকি সময়টুকু ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে। আলমারিতে নতুন পোশাক রাখা আছে তা পরে পরিপাটি হয়ে অফিস যাবি। আর হ্যাঁ কোনো গণ্ডগোল কিন্তু করবি না। চাকরি যদি যায় তাহলে তোর মাথার উপরের এই ছাদটাও এবার সত্যি সত্যি কেড়ে নিবো বলে দিলাম।”

মুখখানা চুপসে গেলো উচ্ছ্বাসের। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বড়ো বড়ো কদম ফেলে চলে গেলো নিজ কক্ষে। যাই হোক গতকালের কথাটা যে বাবা ভুলে গেছে এই ভেবে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে সে। বাবার কথামতো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো উচ্ছ্বাস তারপর নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে বাইক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো অফিসের উদ্দেশ্যে।

অফিসে এসেই মনটা ভার হলো উচ্ছ্বাসের। খুব তো ভাব নিয়ে অফিসে এসেছিল কিন্তু সারাটা দিন এখানে সে কাটাবে কী করে? ভেবেই অস্বস্তি লাগছে। একজন টাক মাথার লোক উচ্ছ্বাসকে তার কাজগুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। মনের ছটফট ভাবটা মনের কুটিরেই লুকিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে লোকটির কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। খানিক বাদে বাদে মাথা নাড়িয়ে বুঝাচ্ছে যে সে বুঝতে পারছে সবকিছু।

নতুন জায়গা নতুন কাজের সঙ্গে পরিচিত হতে হতেই দিনটা কেটে গেলো উচ্ছ্বাসের। রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। নেহার উঁকি দিলেন ছেলের ঘরে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,”কী রে তুই এখনো বাহিরের পোশাক বদলাসনি? আবার এই পোশাক পরেই শুয়ে আছিস? যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”

“খুব ক্লান্ত লাগছে মা। একটু পরে যাই।”

“তোর বাবা এসে যদি তোকে এমন অবস্থায় দেখে কী হবে ভাবতে পারছিস?”

বাবার কথা শুনতেই সব ক্লান্তি এক নিমিষে উধাও হয়ে গেলো উচ্ছ্বাসের। ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে গেলো। আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে চলে গেলো বাথরুমে।

পড়ার টেবিলে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে সায়রী। মনটা তার ভালো নেই কিন্তু কেন ভালো নেই তার কারণটাই সম্পূর্ণ অজানা। সুবর্ণা রহমান মেয়ের পেছনে এসে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সায়রীর যেনো কোনোদিকেই খেয়াল নেই। গালে হাত দিয়ে উদাস ভঙিতে বসে আছে সে। সুবর্ণা এবার মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। তৎক্ষণাৎ কিছুটা লাফিয়ে উঠলো সায়রী। কিছুটা তোতলিয়ে শুধালো,”মা তুমি?”

“হুম, সেই কখন ধরে দাঁড়িয়ে আছি অথচ তুই টেরই পেলি না। কী হয়েছে তোর?”

“কই কিছু না তো।”

“ওহ।”

“কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ, কয়েক মাস পরেই তো তোর বিয়ে তাই ফুয়াদ তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, যার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাবি তার সঙ্গে যদি চেনা জানাই না থাকে তাহলে কেমন হয়? ফুয়াদই তোর বাবার কাছে প্রস্তাবটা রেখেছে। তৎক্ষণাৎ তোর বাবা ছেলেটার মুখের উপর আর না করতে পারেনি তাই রাজি হয়ে গেছে।”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো সায়রীর। প্রশ্ন করল,
“ফুয়াদ কে?”

বিষ্মিত হলেন সুবর্ণা। কণ্ঠে বিষ্ময় রেখেই বললেন,
“সে কি? নিজের হবু স্বামীর নামই জানিস না? ফুয়াদের সঙ্গেই তো তোর বিয়ে ঠিক হলো ওই যে সেদিন এলো।”

“ওহ, তা তোমাদের কী মনে হচ্ছে না মা তোমরা একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলছো?”

“তাড়াহুড়োর কী আছে? মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে তাই বিয়ে দিতে চাইছি। তাছাড়া তোকে তো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পছন্দের কেউ আছে কিনা কিন্তু তুই তো বললি তেমন কেউ নেই তাহলে আপত্তি কীসের?”

“আমি তা বলছি না মা।”

“তাহলে কী বলছিস? ফুয়াদ ছেলেটা যথেষ্ট ভালো। তোর বাবা এবং মামা মিলে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছে। ছেলে এবং ছেলের পরিবারের সকলে তোকে খুব পছন্দ করেছে।”

নিরব হয়ে গেলো সায়রী। বলার মতো যুক্তিসংগত কিছুই খুঁজে পেলো না এই মুহূর্তে। মেয়েকে নিরব হয়ে যেতে দেখে সুবর্ণা পুনরায় বললেন,”কালই তবে দেখা কর। ফুয়াদ তোকে ফোন করে ঠিকানা জানিয়ে দিবে। আর হ্যাঁ কোনো উল্টোপাল্টা কথা আবার বলিস না যেনো।”

“কালই মা?”

“হ্যাঁ।”— বলেই মেয়ের কক্ষ ত্যাগ করলেন সুবর্ণা।

সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপের পরিমাণটা বৃদ্ধি পেলো সায়রীর।
_____

বাইকটা পার্ক করে অফিসের লিফটে প্রবেশ করল উচ্ছ্বাস। অষ্টম ফ্লোরে তার ডিপার্টমেন্ট। লিফটটা পুরোপুরি ফাঁকা। রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে আজ অফিসে আসতে উচ্ছ্বাসের একটু দেরি হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ হন্তদন্ত হয়ে একটা মেয়ে ছুটে এসে প্রবেশ করল ভেতরে। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আড়চোখে একবার মেয়েটির দিকে তাকালো উচ্ছ্বাস তারপর নিরবে বাটনে প্রেস করল।

পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলো মেয়েটি। গাঢ় দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”রাস্তায় এতো যানজট যে কী বলবো? তার উপর মাঝপথে এসে রিক্সা থেমে গেলো। পুলিশের ভয়ে আর সামনেই এগোতে চাইলো না তাই বাধ্য হয়েই বাকি পথটা আমাকে হেঁটেই আসতে হলো।”

এবার ভালো করে মেয়েটির পানে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায় উচ্ছ্বাস। সম্ভবত মেয়েটি তার সমবয়সী হবে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অনেকটা পথ যে সে হেঁটে হেঁটে এসেছে তা তার ঘর্মাক্ত মুখখানা দেখেই সুস্পষ্ট। এই ক্লান্তির মধ্যেও মেয়েটির মুখে একফালি হাসি ঝলমল করছে। এই হাসিটাই যেনো তার সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণ। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো উচ্ছ্বাস। তার থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মেয়েটি এবারো আগ বাড়িয়েই বললো,”আমি মিশমি। আপনার ডিপার্টমেন্টেই কাজ করি।গতকাল দেখলাম জামান ভাই আপনাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাহলে এখন থেকে তো আমরা সহকর্মী তাই না?”

উচ্ছ্বাস গম্ভীর কণ্ঠে উত্তরে বললো,”হুম গতকালই জয়েন করেছি।”

“আপনি কী খুব গম্ভীর, কথা কম বলা টাইপ লোক নাকি?”

“না তো।”

“দেখে মনে হচ্ছে আরকি।”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উচ্ছ্বাস। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এই কথাটা যদি বাবা কিংবা সায়রীর কানে পৌঁছাতো তাহলে হয়তো এতক্ষণে তারা বেশ মজা পেতো। হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতেও দ্বিতীয়বার ভাবতো না। লিফটের দরজা খুলে যেতেই ভাবনার ইতি ঘটলো উচ্ছ্বাসের।কোনো বাক্য বিনিময় না করে নিরবে স্থান ত্যাগ করল। তার যাওয়ার পথে এক ঝাঁক বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো মিশমি। মনে মনে আওড়ালো, ছেলেটা তো ভারি অভদ্র! একটা মেয়ে যে আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে পরিচিত হলো অথচ তাকেই কিনা সম্পূর্ণ অগ্ৰাহ্য করে চলে গেলো?

নিজের আসনে এসে বসলো উচ্ছ্বাস। এতদিন এ সময়টায় সে পথে ঘাটে সায়রীকে বিরক্ত করে কাটিয়েছে অথচ আজ কিনা বসে থাকতে হচ্ছে সামনে একগাদা ফাইল নিয়ে। খুব মনোযোগ সহকারে কাজ করতে লাগলো উচ্ছ্বাস। নিজের বাবার এতো বড়ো একটা বাড়ি থাকার পরেও কিনা মাথার উপরের ছাদটা ধরে রাখার জন্য তাকে চাকরি করতে হচ্ছে। ভাগ্যটা সত্যিই খারাপ নইলে কী আর এতো নিষ্ঠুর একটা বাবা জোটে কপালে?

কাজের মধ্যেই টেবিলের সামনে এসে উপস্থিত হলো মিশমি। চোখেমুখে তার খুশির ঝলক। উচ্ছ্বাস ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,”কী চাই?”

“আর কিছুক্ষণ পরেই লাঞ্চ টাইম।আজ আমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে কী আপনার কোনো আপত্তি আছে? ডিপার্টমেন্টের সকলেই আমরা একটা পরিবারের মতো, একে অপরের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক আমাদের। তাই নতুনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাও একটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।”

“আমার জানামতে এখানে আরো দুজন নতুন ইমপ্লয়ী এসেছে, তাদের রেখে আমার সঙ্গেই কেন লাঞ্চ করতে চাইছেন?”

মুখখানিতে মলিনতা ভর করল মিশমির। শাণিত কণ্ঠে বললো,”বুঝেছি ইনডিরেক্টলি আমার প্রস্তাব আপনি নাকোচ করে দিচ্ছেন। থাক যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে হয়তো আপনার পছন্দ হয়নি।”

কিছু একটা বুঝে আসতেই জিভে কামড় দিয়ে উঠলো উচ্ছ্বাস। আহা!শেষমেশ কিনা মেয়ে মানুষকে সে অবজ্ঞা করছে? এটা তো তার স্বভাবের সঙ্গে একদম যায় না। নিজেকে ধাতস্থ করে মুখের মধ্যে এক কৃত্রিম হাসি ঝুলালো উচ্ছ্বাস। বললো,”আসলে এটা আমার জীবনের প্রথম চাকরি তো তাই এসবে আমি তেমন একটা অভ্যস্ত নই যার কারণে মেজাজটা একটু খারাপ। আপনি কিছু মনে করবেন না। লাঞ্চ টাইম হলে আপনি নিজ দায়িত্বে এখানে চলে আসবেন, আজ আমি আপনাকে ট্রিট দিবো।”

মিশমির ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলো নিজ আসনে।
_________

দুপুর একটা বেজে আট মিনিট। মাঘ মাস প্রায় শেষের পথে। আজ সকালেই ফুয়াদ নামক পুরুষটি সায়রীকে কল করে দেখা করার জন্য ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে যার কারণে বাধ্য হয়েই দুটো ক্লাস করে ভার্সিটি থেকে বের হয়েছে সে। ছোটো ছোটো কদম ফেলে সামনের দিকে অগ্ৰসর হচ্ছে সায়রী। একটা বাজার পরেও তার মধ্যে দ্রুত যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। ইতোমধ্যেই পাশ দিয়ে দু দুটো খালি রিক্সা চলে গেছে অথচ তাতেও কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না সায়রীর মধ্যে। মিনিট পনের পার হতেই মোবাইলটা ঝংকার তুলে বেজে উঠলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে স্ক্রীনে তাকাতেই বিরক্ত হলো সায়রী। ফুয়াদের নাম্বার থেকে কল আসছে। কল আসার কারণটা ভালো করেই জানে সায়রী। এবার নিজ সিদ্ধান্ত বদলে একটা রিক্সা ডেকে তাতে উঠে পড়ল।

রেস্টুরেন্টের ভেতরে একটা টেবিলে বসে আছে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ। এসি চলার পরেও সে ঘামছে। খানিক বাদে বাদে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নিচ্ছে শুভ্র রঙের রুমাল দিয়ে। বাম হাত দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে মাথার ঘন কালো চুলগুলো। হুট করেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো একজন যুবতী মেয়ে। মেয়েটিকে দেখতেই চোখেমুখে চিকচিক করে উঠলো আনন্দ। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে বললো,”মিস সায়রী যে! বসুন বসুন।”

সায়রী চেয়ার টেনে বসলো। স্লান হেসে বললো,
“আপনাকে নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে? তার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আমি আবার এইসব ধরাবাঁধা সময় মেইনটেইন করে চলতে পারি না।”

হাসিটা চওড়া হলো ফুয়াদের। বললো,”সমস্যা নেই। আমিও এই কিছুক্ষণ হলো এসেছি।”

প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো সায়রী। কী বলে কথা আরো এগোনো যায় তাই ভাবছে ফুয়াদ।চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে সায়রী। রেস্টুরেন্টের ভেতরটায় খুবই সুন্দর ডেকোরেশন করা। নিরবতা ভেঙে মেন্যু কার্ডটা সায়রীর দিকে এগিয়ে দিলো ফুয়াদ। বিনম্র কণ্ঠে বললো,”তা কী খাবেন? অর্ডার দিন।”

“বাহিরের খাবার আমার তেমন পছন্দ নয়। আপনি অর্ডার দিন।”

“তা বললে তো হবে না। আজ আপনাকে আমার সঙ্গেই লাঞ্চ করতে হবে।”—বলেই নিজের পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দিলো ফুয়াদ।

খাবার আসতে কিছুটা সময় লাগবে। এতক্ষণ তো আর চুপ থাকা যায় না। অপরিচিত একটা লোকের সামনে বসে থাকতে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে সায়রী। ফুয়াদ বলে উঠলো,”আপনি কী নার্ভাস ফিল করছেন?”

জোরপূর্বক হাসলো সায়রী। বললো,”না না তেমন কিছু না।”

“তাহলে ঠিক আছে। তা আপনি যেনো কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছেন?”

“ফিজিক্স।”

“বেশ ভালো। রান্নাবান্না জানেন?”

“না।”

“ওহ।”

“এবার কী বিয়ে করবেন না?”

প্রশ্নটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হকচকিয়ে উঠলো ফুয়াদ। অস্থির চিত্তে বললো,”কেন? বিয়ে করবো না কেন?”

“এই যে আমি রান্নাবান্না জানি না। ঘর দোরের কাজও তেমন একটা পারি না। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মা এসবে জড়াননি। এখন আবার বাড়িতে ভাবী আছে যে কিনা আমাকে রান্নাঘরের ধারে কাছেও যেতে দেয় না।”

মুখের আদল বদলে গেলো ফুয়াদের। পূর্বের ন্যায় হেসে উঠলো শব্দহীন। বললো,”সমস্যা নেই। সবাইকে যে সব পারতে হবে এমন কী কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম আছে? বিয়ের পর না হয় আস্তে আস্তে শিখে নিবেন। আমার মা আবার বেশ ভালো রান্না জানেন। আপনাকেও শিখিয়ে দিবে।”

প্রত্যুত্তর করল না সায়রী। মুচকি হাসলো। ফুয়াদ পুনরায় জিজ্ঞেস করল,”আমাকে কী আপনার পছন্দ? বিয়েতে রাজি আপনি?”

হাস্যজ্জ্বল মুখখানায় আঁধার নেমে এলো সায়রীর। কী উত্তর দিবে সে? ছেলেটিকে অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই আবার পছন্দ হলেই যে বিয়ে করতে হবে এমনও কোনো কথা নেই। বিয়েতে যে সে রাজি না তা অনেক আগেই পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছে কিন্তু এর বিপরীতে কোনো গুরুতর কারণ দেখাতে না পারায় তার কথাকেও কেউ গুরুত্ব দেয়নি। ভাবতে ভাবতেই খাবার নিয়ে চলে এলো ওয়েটার। ফুয়াদের প্রশ্নের উত্তরটা আর পাওয়া হলো না।

খাবার খেতে খেতে হঠাৎ সায়রীর দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো কয়েক টেবিল দূরে বসা পরিচিত মুখটির পানে। চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সায়রী। কয়েক সেকেন্ড পর আবারো সেদিকে তাকালো। না ভুল কিছু দেখছে না সে। সত্যি সত্যিই টেবিলটায় ঠিক তার দিকে মুখ করেই বসে আছে উচ্ছ্বাস। তার সামনের চেয়ারে বসা শাড়ি পরিহিত এক রমণী। চোখ দুটো জ্বলে উঠলো সায়রীর। বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো দাবানল। মনে মনে ক্রোধ নিয়ে বললো,”কে ওই মেয়েটা? ডেট করছে উচ্ছ্বাস! ওই মেয়েটার সঙ্গে ডেট করছে? তাই তো মনে হচ্ছে। এতো সুন্দর করে সেজেগুজে তো কখনো আমার সামনে আসেনি। কখনো তো রেস্টুরেন্টে আসার জন্যও অফার করেনি তাহলে আজ? মেয়েটার সঙ্গে কী ফ্লার্ট করছে নাকি সিরিয়াস সে? না না দেখে তো সিরিয়াসই মনে হচ্ছে নইলে এতো হাসি আসছে কোত্থেকে?”

হাতের কাঁটা চামচটা শক্ত করে প্লেটের সঙ্গে ধরে রেখেছে সায়রী। দৃষ্টি আঠার মতো লেগে আছে উচ্ছ্বাসের উপর অথচ ছেলেটা এখনো খেয়ালই করেনি আশপাশ। হেসে হেসে কথা বলছে মিশমির সঙ্গে। অফিস থেকে রেস্টুরেন্টটা খুবই কাছাকাছি হওয়ায় মিশমি একপ্রকার জোর করেই এখানে নিয়ে এসেছে উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাসও আর দ্বিমত করতে পারেনি।

ফুয়াদ নিজের হাতটা কয়েকবার সায়রীর মুখের সামনে নাড়ালো। তৎক্ষণাৎ ধ্যান ভঙ্গ হলো সায়রীর। অতি দ্রুত সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করল। ফুয়াদ প্রশ্ন করল,”কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন? কখন ধরে ডাকছি আপনাকে।”

“কী যেনো বলছিলেন?”

“থাক সেসব বাদ দেই। আচ্ছা আজ বাকি সময়টা কী আপনি ফ্রি?”

“কেন?”

“না এমনি, আমিও আজ ফ্রি। সব কাজ অন্যদের বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি তাই আজ আমার ছুটি।”

সায়রীর দৃষ্টি এখনো উচ্ছ্বাসের পানে। হাত মুছে বিল পেমেন্ট করে সামনে তাকাতেই ললাটে ভাঁজ পড়ল উচ্ছ্বাসের।সায়রীকে দেখে বিষ্মিত হলো। চোখাচোখি হলো দুজনের। ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফোটে উঠলো উচ্ছ্বাসের। চেয়ার ছেড়ে সামনে এগোতে নিলেই টান অনুভব করল হাতে। চমকিত নয়নে পিছু ফিরলো। মিশমি তার হাত ধরেছে। তাড়া দিয়ে বললো,”এবার অফিসে চলুন। দেরি হয়ে গেলে বকা খেতে হবে।”

ঘড়ির দিকে তাকালো উচ্ছ্বাস। সত্যিই হাতে আর বেশি সময় নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার সায়রীর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ মিশমির সঙ্গেই বেরিয়ে গেলো। তার এহেন কাণ্ডে চরম ক্ষীপ্ত হলো সায়রী। ছেলেটার সাহস দেখে রীতিমতো অবাক হলো, যেই ছেলে যেখানে সেখানে তাকে দেখলেই কিছু না ভেবে এগিয়ে এসে কথা বলে সেই ছেলেই কিনা আজ তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলো? মনে মনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলো সায়রী। এরপর যদি উচ্ছ্বাস তার ওই মুখটা নিয়ে আরেকবার সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলে তার ওই মুখ ভেঙে দিবে সায়রী। এমন ভাবে ভাঙবে যাতে জীবনেও আর কোনো মেয়ের সঙ্গে হেসে লুটোপুটি খেতে না পারে।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে