#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৭]
“এতোগুলো ঋতু থাকতে মানুষ কেন শীতকালকেই বিয়ের জন্য বেছে নিলো? বলতে পারবে ন্যাড়া সায়রী?”
প্রচন্ড বিরক্ত হলো সায়রী। সাথে হলো রাগ। ছেলেটা তার আশেপাশে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই সায়রীর বিরক্তিটা আকাশচুম্বী হয়ে থাকে। রূষ্ট কণ্ঠে বললো, “কথায় কথায় একদম ন্যাড়া সায়রী বলবেন না। নইলে আমিও কিন্তু আপনাকে বিড়িখোর উচ্ছ্বাস বলে ডাকবো।”
সেসবে মোটেও পাত্তা দিলো না উচ্ছ্বাস। পুনরায় প্রশ্ন করল,”বললে না তো মানুষ কেন শীতকালে বিয়ে করে?”
“আমি কী করে জানবো? যারা করে তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।”
“আরে বোকা মেয়ে এই ছোট্ট একটা প্রশ্নের উত্তর জানো না?”
“তা আপনি জানিয়ে দিন।”
গুরু গম্ভীর ভাব নিলো উচ্ছ্বাস। বললো,”শীতকালে মানুষ বিয়ে করে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। জামাই বউ পাশাপাশি থাকলে শীত লাগে না অঙ্গে। চলো না সায়রী আমরাও বিয়েটা সেরে ফেলি। আর কতকাল এই শীতে কষ্ট ভোগ করবে বলো তো?”
“অসভ্য একটা। এতো তাড়াতাড়ি আপনার পা ভালো হলো কেন বলুন তো? এতদিন তো বেশ শান্তিতেই ছিলাম। আমার শান্তি কী আপনার সহ্য হয় না? বেশি কথা বললে এবার কিন্তু ভার্সিটির পোলাপাইন দিয়ে আমিই আপনার পা ভেঙে আবারো বিছানায় বসিয়ে রাখবো।”
“হুমকি দাও আমায়?”
“মনে করুন তাই।”
“আমার অবর্তমানে এই এক মাস বড্ড বাড় বেড়েছো তুমি তাই না? শুধু বউয়ের চোখে দেখি বলে তোমায় কিছু বলতেও পারি না। এখন চুপচাপ ভার্সিটিতে যাও। বেশি কথা আমি আবার পছন্দ করি না।”
কথাটা বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরলো উচ্ছ্বাস। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সায়রী। বেশি কথা কে বলে? উচ্ছ্বাস কী ইনডিরেক্টলি অপমান করে গেলো? মস্তিষ্ক পর্যন্ত ভাবনাটা যেতেই শরীর জ্বলে উঠলো সায়রীর। রাগ নিয়েই উল্টো পথে ফিরতে যাবে তখনি ফের এগিয়ে এলো উচ্ছ্বাস। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সায়রী। মাথা চুলকিয়ে জোরপূর্বক হাসে উচ্ছ্বাস। বলে,”যে কথাটা বলতে এসেছিলাম সেটাই তো বলতে ভুলে গিয়েছি।”
প্রত্যুত্তর করল না সায়রী। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে অব্যক্ত কথাটা শোনার জন্য তাকিয়ে রইলো। উচ্ছ্বাস গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।”
কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হকচকিয়ে ওঠে সায়রী। আশেপাশে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে,”কী বললেন?”
“আমার চাকরিটা হয়ে গেছে সায়রী সুন্দরী।”
“সত্যিই?”
“হুম।”
“তা কোন গাধা আপনাকে চাকরিটা দিলো শুনি?”
চুপসে গেলো উচ্ছ্বাস। মিনমিনে স্বরে বললো,”গাধা চাকরি দিবে কেন? নিজ যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি।”
“তা এতদিন সেই যোগ্যতা কোথায় ছিলো? বারবার রিজেক্ট কেন হয়েছিলেন?”
“এমন ভাব করো যেনো পৃথিবীতে সব যোগ্যতা তোমার আর তোমার বাপ ভাইয়েরই আছে। আমরা সব মূর্খ। এতদিন ঠিকমতন ইন্টারভিউ দেইনি তাই চাকরি পাইনি। এবার দিয়েছি তাই চাকরি পেয়েছি। এখন আর আমি বেকার নই তাই আমায় বিয়ে করতে নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি নেই তোমার?”
“তাতে কী হয়েছে? চাকরি পেয়েছেন বলে কি বাংলাদেশ উদ্ধার হয়ে গেছে? চাকরি পান বা না পান আমি আপনাকে কখনোই বিয়ে করবো না।”
সন্দিহান দৃষ্টিতে সায়রীর মুখখানায় চোখ বুলায় উচ্ছ্বাস। প্রশ্ন করে,”কেন? বিয়ে করতে আবার আপত্তি কীসের? এই এই তুমি কী অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছো? এমন ভুল যদি করে থাকো তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। দরকার হলে খুনোখুনি করবো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সায়রী। বিরক্তির সহিত বললো,
“দয়া করে অভিনয়টা বন্ধ করুন। সারাক্ষণই তো স্পাইয়ের মতো পিছুপিছু ঘুরে আমার সব খবরাখবর রাখেন তারপরেও এসব কথা বলছেন কেন?”
“তাহলে আমায় বিয়ে করবে না কেন?”
“এই ক্ষণিকের দুনিয়ায় মানুষ একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী খুঁজে। যাকে নিয়ে দুনিয়া নয় বরং আখিরাতেও একসঙ্গে থাকতে পারবে। আপনি কী আদৌ আদর্শ জীবনসঙ্গী? আমি তো এই উচ্ছ্বাসকে ভালোবাসিনি। আমি আমার কৈশোর জীবনে এমন একজন ছেলেকে ভালোবেসেছিলাম যে ছিলো খুবই গোছালো, ভদ্র একজন ছেলে। অথচ সেই ছেলেটাই বলিষ্ঠ পুরুষ হওয়ার পর বদলে গেলো। অগোছালো হয়ে গেলো। একসময় আজান দিলে যে মসজিদে ছুটতো এখন সেই সময়টায় নাক ডেকে ঘুমায় সে। চিপা চাপা গলিতে সিগারেট টানে। এমন ছেলেকে বিয়ে করে কী হবে? ভবিষ্যৎ কী? দেখুন উচ্ছ্বাস আমি আপনাকে পইপই করে শেষ বারের মতো বলে দিচ্ছি যদি নিজেকে বদলাতে পারেন, আবারো পুরোনো উচ্ছ্বাসে পরিণত হতে পারেন তাহলেই ভালোবাসা নিয়ে আমার সামনে আসবেন। না বদলাতে পারলে আসবেন না। বাবা অলরেডি নতুন পাত্র খোঁজা শুরু করে দিয়েছে হয়তো পেয়েও গেছে। আর কত বিয়ে ভাঙবেন আমার? বিয়ে না ভেঙে নিজে বিয়ে করার জন্য যোগ্যতা অর্জন করুন। রাস্তা ঘাটে আর পথ আটকাবেন না। লোকে মন্দ বলবে।”
কথাগুলো শেষ করে দম ছাড়লো সায়রী। ডানে বামে কোথাও না তাকিয়ে নিজের পথে হাঁটা ধরলো। কড়া কড়া বাক্যগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই থমকে গেছে উচ্ছ্বাস। কণ্ঠনালী দিয়ে এই মুহূর্তে কোনো বাক্য বের হচ্ছে না। কী বলবে? কী বলা উচিত? দৌড়ে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াবে? কিন্তু কেন তাকে আটকাবে? কথাগুলো উচ্ছ্বাসের মস্তিষ্কে ঝড় তুলেছে। চঞ্চল মনে এনে দিয়েছে নিরবতা।
সাব্বির আহমেদ আজ অত্যধিক আনন্দিত। কিছুক্ষণ আগেই কেয়ার টেকারকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে সব ভাড়াটিয়াকে মিষ্টি বিতরণ করে এসেছেন। এই মুহূর্তে সোফায় আয়েশ করে বসে তিনি টিভি দেখছেন। হঠাৎ স্বামীর এতো আনন্দ দেখে বিষ্মিত নেহার। কিছুক্ষণ নিখুঁত দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্বামীকে পর্যবেক্ষণ করে এবার প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “ছেলের চাকরি হয়েছে বলেই কী তুমি এতোটা খুশি হয়েছো নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?”
“অন্য কারণ? কী কারণ? ছেলের এতো ভালো একটা সংবাদে কী আমার খুশি হওয়া নিষেধ?”
“না, নিষেধ হবে কেন?”
“তাহলে?”
নেহার চুপ হয়ে গেলেন। স্বামীর মতিগতি তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। ছেলে একটা চাকরি পাওয়ায় এতোটা খুশি হয়েছে লোকটা? কিন্তু কেন?
কোমরে শাড়ি গুঁজে রান্না করছে ইকরা। বউ হয়ে সে এ বাড়িতে পা রেখেছে এই তো মাস ছয়েক আগে। তখন থেকেই পুরো রান্নাঘরের দায়িত্বটা একা হাতে তুলে নিয়েছে মেয়েটা তারপরেও যেনো পুরোপুরি ভাবে এখনো শাশুড়ির মনে জায়গা করে নিতে পারেনি। বিয়ের আগে সায়ানের সঙ্গে তার সাড়ে তিন বছরের প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো। লেখাপড়ার জন্য সেই খুলনা থেকে ইকরা ঢাকা এসেছিল বছর চারেক আগে। সায়ান ছিলো তারই ভার্সিটির সিনিয়র। প্রণয়ের শুরুটাও ছিলো সায়ানের তরফ থেকেই। শেষে অনেক কষ্টে ইকরা নিজের পরিবারকে রাজি করাতে পারলেও বেঁকে বসেছিল সায়ানের বাবা-মা। কিছুতেই অতদূরে উনারা আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে রাজি নন। কিন্তু সায়ান হচ্ছে নাছোড়বান্দা, ভালো যখন বেসেছে বিয়েও সে করেই ছাড়বে তাই বাবা- মায়ের বিরুদ্ধে গিয়েই একসময় ইকরাকে বিয়ে করে আনে। এ নিয়ে বাড়িতে কী একটা ঝামেলাই না হয়েছিল। তপন রেজা তো ছেলেকে একেবারে বাড়ি থেকেই বের করে দিয়েছিলেন। একটা মাস ভাড়া বাড়িতে কতো কষ্ট করেই না বউ নিয়ে থাকতে হয়েছে সায়ানকে।
বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে সায়রীর সম্পর্কটা ছিলো একেবারে বন্ধুত্বময় যার দরুন ভাই ভাবীর মধ্যকার সম্পর্কটা আগে থেকেই জানতো সে। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতেই বাবাকে নানা ভাবে বুঝিয়ে আবারো তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে সায়রী।
সুবর্ণা চুপচাপ রান্নাঘরে এসে খালি চুলাটায় গরম পানি বসালেন। শাশুড়ির উপস্থিতি টের পেতেই নড়েচড়ে উঠলো ইকরা। নম্র কণ্ঠে বললো,”আপনি আবার আসতে গেলেন কেন মা? আমাকে বললেই তো আমি পানি গরম করে দিতাম।”
“গরম পানি দিয়ে আমি আবার কী করবো? আমি তো চা বানাতে এসেছি।”
“এ সময় চা?”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুত্রবধূর পানে তাকালেন সুবর্ণা রহমান। শাশুড়ির এমন চাহনিতে চুপসে যায় ইকরা। সুবর্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,”মাথাটা খুব ধরেছে। একটু আদা চা খেলে হয়তো ভালো লাগতে পারে।”
“দিন তাহলে আমি করে দেই।”
“দরকার নেই, সকাল থেকে অনেক কাজকর্ম করেছো এখন যাও গোসল করে এসো।”
শাশুড়ির কথা মেনে নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো ইকরা। ভদ্র মহিলা যতই রাগ দেখাক না কেন একদিক দিয়ে ভালো আছেন। ধমকের সঙ্গে সঙ্গে বেশ যত্নও করেন।
__________
ভর দুপুরে ছাদে বসে লাটাই হাতে ঘুড়ি উড়াচ্ছে উচ্ছ্বাস। ধরণীতে আজ রোদ ওঠেনি। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। টুম্পা এগিয়ে এসে তার ঠিক পাশে দাঁড়ালো। খানিকক্ষণ নিরবতার পর জিজ্ঞেস করল,”এই দুপুর বেলা ঘুড়ি উড়াচ্ছো কেন উচ্ছ্বাস ভাই?”
“ইচ্ছে হয়েছে তাই।”
“তোমার কী মন খারাপ?”
“মন খারাপ হবে কেন?”
“জানি না তবে মনে হলো।”
আবারো পিনপতন নিরবতা। উচ্ছ্বাসের এই নিরবতা দেখে বিরক্ত হলো টুম্পা। পুনরায় প্রশ্ন করল,”হঠাৎ এ সময় ঘুড়ি উড়াচ্ছো যে?”
“যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করা উচিত। তার জন্য আবার সময় অসময় আছে নাকি?”
“তা অবশ্য ঠিক।”
“তা তুমি এ সময় এখানে কেন? বিকেল না হলে তো ছাদে আসো না তাহলে?”
“আসলে আন্টিকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন তুমি নাকি ছাদে আছো তাই চলে এলাম।”
“ওহ, কোনো প্রয়োজন?”
কিছুটা ঘাবড়ে গেলো টুম্পা। জোরপূর্বক হেসে বললো,”না এমনি।”
ফিরতি কোনো প্রশ্নই করল না উচ্ছ্বাস। তার সকল ধ্যান যেনো আকাশে উড়ে বেড়ানো রঙিন ঘুড়িটির দিকে। ঘুড়িটি খুব উঁচুতে উড়ছে। লাটাই দিয়ে অভিজ্ঞদের মতন ডানে বামে ঘুড়ি উড়াচ্ছে উচ্ছ্বাস। ক্লাস টেনে ওঠার পর থেকেই ঘুড়ি ওড়ানোটা যেনো নেশায় পরিণত হয় উচ্ছ্বাসের। রোজ বিকেলে নিয়ম করে ছাদে এসে ঘুড়ি ওড়াতো সে। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা তার সঙ্গ দিতো কিন্তু ভার্সিটি যেতেই এই অভ্যাসটার পরিবর্তন হয়ে গেলো। ঘুড়ি ওড়ানোর সময়টা কাটাতো নতুন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কত পরিবর্তনই না হয়। তিলতিল করে গড়ে তোলা অভ্যাস গুলোও হয় পরিবর্তিত।
_______
আবারো পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে সায়রীকে। তপন রেজা এবার আর পূর্বের ভুলগুলো করেননি বরং শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে ছেলে এবং ছেলের পরিবারের পেছনে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে সব খবরাখবর উদঘাটন করে নিয়ে এসেছেন। নাহ! এই ছেলের আবার আজেবাজে কোনো স্বভাব নেই। ছেলে যথেষ্ট ভালো, সংস্কারী এবং চরিত্রবান। বিশেষ করে এবারের পাত্র হচ্ছে একটা কোম্পানির সিইও। তাই তপন রেজা আর দেরি না করে সবার মত নিয়েই বিয়েটা একেবারে পাকাপোক্ত করে রেখেছেন।
পরনের শাড়িটা এখনো খুলেনি সায়রী। মাথার হিজাবটা বিছানার একপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ দৃষ্টিতে সায়রী তাকিয়ে আছে অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করা আংটির পানে। এবারের বিয়েটা যে উচ্ছ্বাস ভাঙতে পারবে না তা পুরোপুরি নিশ্চিত সে। পূর্বের বিয়েগুলো যে উচ্ছ্বাসই ভেঙেছে তাও তার অজানা নয়।
ননদকে এভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো ইকরা। প্রশ্ন করল,”মুখ গোমড়া কেন ননদিনী? ছেলে কী পছন্দ হয়নি?”
আহত দৃষ্টি মেলে ভাবীর পানে তাকালো সায়রী। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সরিয়ে নিলো সেই দৃষ্টি। ইকরা এসে বসলো তার পাশে। বললো,”ছেলে দেখতে শুনতে সবদিক দিয়েই তো ভালো তাছাড়া বাবা এবার আঁটঘাট বেঁধে নেমেছেন। তাহলে পছন্দ না হওয়ার কারণ কী?”
এবারো নিরুত্তর সায়রী। সায়রীর সঙ্গে ইকরার সম্পর্কটা বন্ধুর থেকে কোনো অংশে কম নয় তাই মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখেই সবকিছু টের পেয়ে যায় ইকরা। আশ্বস্ত করে বললো,”দেখো, তোমার বাবা-মা তো আর তোমার উপর জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় না। তাই তোমার যদি বিয়েতে আপত্তি থাকে তাহলে তার কারণটা বলো উনাদের। আচ্ছা তোমার কী কাউকে পছন্দ?”
এই কারণটা, ঠিক এই কারণটার জন্যই তো বাবাকে সরাসরি না করতে পারে না সায়রী। কী বলবে বাবাকে গিয়ে? বাবা যখন জিজ্ঞেস করবে,কেন বিয়ে করবে না? তখন কী উত্তর দিবে সে? মনে চলা কথাটা যে সে মুখে আনতেই এখন ইতস্তত বোধ করে। সন্তর্পণে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”তোমাদের ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা শুনলেই আমার কষ্ট হয় ভাবী। সেখানে বিয়ের পর আরেক বাড়িতে গিয়ে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে গুছিয়ে থাকবো আমি?”
মুহুর্তেই হেসে উঠলো ইকরা। এই তাহলে ননদের গোমড়া মুখে বসে থাকার কারণ? বললো,”এটাই নিয়ম বাবু। এই যে আমাকে দেখো, আমিও তো অপরিচিত জায়গায় এসেই মানিয়ে নিয়েছি। আপন করে নিয়েছি তোমাদের। চিন্তা করো না তুমিও ঠিক পারবে। তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।”
“ভাইয়াকে বলো না বাবার সঙ্গে কথা বলে যেনো বিয়েটা আরো পিছিয়ে দেয়। এই ঘাড় পর্যন্ত ছোটো ছোটো চুল নিয়ে কীভাবে সংসার করবো আমি? জামাইয়ের সামনে যেতেই তো আমার লজ্জা করবে।”
ননদের কথায় হেসে উঠলো ইকরা। তখনি সুবর্ণা রহমানের হিনহিনে কণ্ঠস্বর পাওয়া গেলো,”ঘাড় পর্যন্ত চুল এতে আবার লজ্জা কীসের? বর্তমানে কত মেয়েকে দেখি এরকম কাট দিয়ে রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। কই তাদের তো লজ্জা করে না। ছেলে যথেষ্ট স্মার্ট। ছেলের মা তো তোকে দেখেছেন। দেখেই তো বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করলেন তাহলে লজ্জা কেন পাবি? একটু স্মার্ট হ।”
বিপরীতে যুক্তি সম্মত কোনো কথাই খুঁজে পেলো না সায়রী। চুল কেটেছে প্রায় আট মাস হতে চললো। এতদিনে ঘাড়ে পড়ে গেছে সেই চুল। তবে এই লুকটায় যেনো তাকে আগের থেকেও দেখতে বেশ সুন্দর লাগে।
মাগরিবের নামাজের সময় পুত্রকে মসজিদে জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়তে দেখে বেশ আশ্চর্য হলেন সাব্বির আহমেদ। স্কুল কলেজে থাকাকালীন ছেলেটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। সবার আগে আগে মসজিদে এসে বসে থাকতো। তারপর ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলো নামাজ পড়া। কতবার তাকে নামাজ পড়তে ডেকেছেন সাব্বির আহমেদ তার হিসেব নেই। কিন্তু বরাবরই ছেলে উনার বিভিন্ন ভাবে এড়িয়ে গেছে উনাকে। বিষ্ময় চাপিয়ে রেখে নামাজে দাঁড়ালেন সাব্বির আহমেদ। নামাজ শেষে রবের নিকট চোখের পানি ফেলে ছেলের জন্য দোয়াও করলেন।
নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে জুতা পরছে উচ্ছ্বাস। তখনি কেউ তার কাঁধে হাত রাখলো। ঘাড় ঘুরাতেই কিছুটা ভড়কে গেলো উচ্ছ্বাস। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা। সাব্বির আহমেদ পুত্রের উদ্দেশ্যে শুধালেন,”তা হেদায়েত অবশেষে এসেছে?”
“হেদায়েত কে বাবা?”—বাম ভ্রুটা উঁচিয়ে প্রশ্ন করল উচ্ছ্বাস।
হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে গেলো সাব্বির আহমেদের। গলা ঝেড়ে বললেন,”মূর্খ মানব হেদায়েত মানে বুঝিস না? যাক গে তা বাবা আজ মসজিদে পা দিলেন যে? কেউ জোর করে এনেছে? আপনাকে তো জোর করে কিছু করানো সম্ভব নয়।”
“জোর করে কেউ আনবে কেন? আমি তো নিজ ইচ্ছায় এখানে এসেছি। এবার থেকে রোজ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটাই তো ইবাদতের সময়। যুবক বয়সে বেশি বেশি করে ইবাদত করতে হবে আর তারপর।”-বলেই থেমে গেলো উচ্ছ্বাস।
অধরে পুনরায় হাসি ফোটে উঠলো সাব্বির আহমেদের। আনন্দিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর কী?”
“বিয়ে করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো ততোই সওয়াব পাবো তাছাড়া জ্বিনার হাত থেকে বাঁচার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে বিয়ে। তুমি বললে কালই আহিলকে বলে মিষ্টি কিনিয়ে আনি?”
“মিষ্টি দিয়ে কী হবে? তোর মা এবং আমার দুজনেরই তো ডায়াবেটিস।”
“আহা তোমাদের জন্য না তো। আমার জন্য যে মেয়ে দেখতে যাবে সাথে মিষ্টি নিতে হবে না?”
রেগে গেলেন সাব্বির আহমেদ। চোখ দিয়েই যেনো ঝলসে দিবেন ছেলেকে। নিচের দিকে তাকিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলেন। উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,”কী খুঁজছো?”
“আমার জুতাটা খুবই নরম। তোর ওই গণ্ডারের চামড়ায় আমার জুতা বসালে আমার দামি জুতোটাই ছিঁড়ে যাবে এর থেকে কোনো শক্তপোক্ত জুতা পাওয়া যায় কিনা দেখ তো।”
সাব্বির আহমেদের কথা শেষ হতে দেরি কিন্তু উচ্ছ্বাসের দৌড় দিতে একটুও দেরি হয়নি। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সে দৌড়াচ্ছে। পেছন থেকে চিৎকার করে সাব্বির আহমেদ বলছেন,”থাম হতচ্ছাড়া। থামতে বলছি তোকে থাম।”
চলবে ________