#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৬]
মুখে কুলুপ এঁটে উচ্ছ্বাসের ঘরে বসে আছে সায়রী। ভাবখানা এমন যেনো এই মুহূর্তে কেউই তার আশেপাশে নেই। বিছানায় অর্ধ শোয়া উচ্ছ্বাস। দৃষ্টি সায়রীর পানে। টানা আধ ঘণ্টা ধরে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে সে। কিছুই বুঝতে না পেরে এবার প্রশ্ন করে বসলো,”কী ব্যাপার? কথা বলছো না কেন? হাতে কী ব্যথা করছে? এতো ঝাঁকা ঝাঁকি করছো কেন?”
এতক্ষণ যেনো এমন একটি প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিল সায়রী। হাতের নাড়াচাড়া থামিয়ে দিয়ে উপরের পাটির দাঁতগুলো বের করে নিঃশব্দে হাসলো। অনামিকা আঙুলটা দেখিয়ে বললো,”সুন্দর না আংটিটা? গোল্ডের আংটি বুঝলেন।”
“এখানে কী আংটি দেখাতে এসেছো?”
মুখ বাঁকালো সায়রী।উচ্ছ্বাস ঠাট্টা স্বরূপ বললো,”তা এই মান্ধাতার আমলের আংটি কে দিলো তোমায়? তোমার দাদির নাকি?”
চোখমুখ কুঁচকে নিলো সায়রী। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“পাত্রপক্ষ আমায় দেখতে এসেছিল।তাদের আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাই একেবারে বিয়ের পাকা কথা বলে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেছে।”
উচ্ছ্বাসের ললাটে ভাঁজ পড়ল। এমন ভান করল যেনো বেশ অবাক হয়েছে সে। মুখে হাত ছুঁইয়ে বলে ওঠে,”শেষে কিনা ন্যাড়া মেয়েকে বউ করে ঘরে তুলবে? নিশ্চয়ই ছেলের মধ্যে কোনো খুঁত আছে। চরিত্রের দোষও থাকতে পারে।”
“সবাইকে নিজের মতো ভাবেন কেন?”
“নিজের মতো ভাবি মানে? ওয়েট তুমি কী বলতে চাইছো আমার মধ্যেও কোনো খুঁত আছে? ঠিক আছে কাছে এসো এখনি প্রমাণ করে দিচ্ছি যে আমার সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গই পুরোপুরি ভাবে নিখুঁত।”
“ছিহ্! অশ্লীল।”
“এখানে অশ্লীলতার কী আছে? সে যাই হোক, ছেলে কী করে?”
“আপনার মতো বেকার নয়, বুঝলেন? একেবারে খাসা বিসিএস ক্যাডার।”
“ওহ বুইড়া ব্যাটা?”—বলেই শব্দ করে হাসলো উচ্ছ্বাস।
তার এহেন কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো সায়রী। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,”মোটেও না, ছেলে সম্ভবত আপনার বয়সী। কয়েক মাসের বড়োও হতে পারে। এবারই বিসিএস দিয়েছে এমনকি প্রথম চান্সেই টিকে গেছে তাছাড়া বাবারও পরিচিত, সবদিক দিয়ে একদম পারফেক্ট।”
“তোমার জন্য আমার বড্ড আফসোস হচ্ছে সায়রী। খাঁটি সোনা চিনলে না তুমি। হাতের কাছে খাঁটি সোনা রেখে কিনা সিটি গোল্ডের পেছনে ঝুঁকে আছো?”
“আসছে আমার খাঁটি সোনা।”
“সোনাই তো। আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে আমি এর থেকেও সুন্দর এবং আধুনিক ডিজাইনের আংটি দিতাম। আমার ছোটো মামা কাতারে থাকে, মামাকে বললেই নতুন ডিজাইনের আংটি পাঠিয়ে দিবে।”
“শেষে কিনা মামার টাকায় কেনা আংটি পরাবেন বউকে? ছিহ্ উচ্ছ্বাস ছিহ্।”
“মামার টাকায় কেনা পরাবো কেন? আমি মামাকে টাকা পাঠাবো আর মামা শুধু কিনে পাঠিয়ে দিবে।”
“বেকার মানুষ টাকা পাবেন কোথায়? সোনার দাম জানেন?”
“এই বাড়িটা কী তোমার চোখে পড়ে না সায়রী সুন্দরী? কতগুলো ফ্ল্যাট জানো? দুই থেকে তিনটা ফ্ল্যাটের ভাড়া মেরে দিলেই তো অনেক সুন্দর একটা আংটি বানানো যাবে।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সায়রী। এই ছেলের মধ্যে সত্যিই লাজ লজ্জার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। উচ্ছ্বাস শান্ত কণ্ঠে বললো,”আমার থেকে ভালো তোমায় আর কেউ রাখতে পারবে না ন্যাড়া সায়রী। ওইসব ক্যাডার ফ্যাডার বাদ দিয়ে আমায় বিয়ে করে নাও। অনেক সুযোগ সুবিধা পাবে, বিয়ের পর না হয় তোমার রূপের আলোয় পড়ে আমিও বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাবো।”
“যেই লোক বিদ্যুৎ এর আলোয়-ই কিছু করতে পারে না সে নাকি রূপের আলোয় কতকিছু ছিঁড়বে।”
“অশ্লীল রমণী।”
“তা কী কী সুবিধা পাবো আপনাকে বিয়ে করলে?”
“বলতে গেলে তো শেষই হবে না। তার থেকে আমি বরং কয়েকটা বলি। এই যেমন, একই এলাকায় বাড়ি হওয়ায় যখন তখন বাপের বাড়ি চলে যেতে পারবে। জা, ননদের কুটনামিরও কোনো ভয় নেই। যেহেতু আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সেহেতু একমাত্র পুত্রবধূ হিসেবে শাশুড়ির অনেক ভালোবাসা পাবে। শ্বশুরেরটা পাবে কিনা সেকথা আমি জানি না কারণ তোমার শ্বশুর হচ্ছে খুবই দজ্জাল একটা লোক। তাছাড়া তোমার জামাইটা খুবই নরম মনের একজন মানুষ অনেক আদর সোহাগ করবে তোমায়। তোমার আঙুলের ইশারায় নাচবেও।”
“যত সুবিধাই থাকুক না কেন আমি এসব বিড়িখোর লোককে বিয়ে করতে পারবো না। ঠোঁটের কী ছিঁড়ি! ওয়াক্ থু। বিড়িখোরদের মুখেও বিশ্রি দুর্গন্ধ থাকে।”
“আমার বাবা-মা আজ পর্যন্ত টেরই পায়নি আমি যে সিগারেট খাই। মুখে কোনো গন্ধও নেই চাইলে তুমি শুঁকতে পারো।”—বলেই ঠোঁট উল্টে নিলো উচ্ছ্বাস।
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো সায়রী। বললো,
“তারপরেও একটা বার বলবে না যে তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি বিড়ি ছাড়তেও রাজি আছি।”
“আপাতত নিকোটিন আমি ছাড়ছি না। তোমরা যখন আমায় যন্ত্রনা দাও তখন এই নিকোটিনের ধোঁয়াই সেই যন্ত্রনার উপশম হিসেবে কাজ করে। তবে সত্যি সত্যি যদি কখনো আমার হও তবে না হয় নিকোটিনকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবে দেখবো।”
চুপ করে রইলো সায়রী। বিপরীতে কী বলা উচিত ভেবে পেলো না। তবে এ ছেলেকে যে আর সোজা করা সম্ভব নয় তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। সায়রীর থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রশ্ন করল,”আমার অসুস্থতার কথা শুনে এখানে ছুটে এসেছো নাকি কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছো?”
“যেদিন বিয়ে করে বাসর ঘরে ঢুকতে পারবো সেদিনই তো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া হবে।”
“কিন্তু তোমার বাসর তো আমার সঙ্গেই হবে।”
উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়রী। উচ্ছ্বাসের মুখে এবার দুষ্টুমির ছাপ। লাজুক কণ্ঠে বললো,”বাসর রাত নিয়ে আমার না অনেক প্ল্যান আছে। তোমার সঙ্গে বাসর হবে ভাবতেই আমার মন প্রাঙ্গনে ঢেউ খেলে যায়। সেদিন তো লজ্জায় আমি আয়নার দিকে তাকাতেই পারবো না।”
এবার সায়রীর নিজেরই লজ্জা লাগছে। ভেবেছিল নিজের বিয়ের খবর উচ্ছ্বাসকে দিলে হয়তো বেচারা দেবদাস হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে কিন্তু সব এখন সেগুড়ে বালি। ব্যাটা তো উল্টো বাজিমাত করে দিচ্ছে। বিড়বিড় করল সায়রী, এখানে আসাটাই আমার মস্ত বড়ো ভুল হয়েছে। ধুপ ধাপ পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
রান্নাঘরে ব্যস্ত নেহার বেগম। ছেলের জন্য অতি যত্নে স্যুপ বানাচ্ছেন। বানানো শেষ হতেই তা পরিবেশন করলেন। সায়রী নিরবে রান্নাঘরে এসে উনার পেছনে দাঁড়ালো। তাকে দেখতেই মুচকি হাসলেন নেহার। আরেকটা বাটিতে স্যুপ বেড়ে বাড়িয়ে দিলেন সায়রীর দিকে। বললেন,”খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।”
তৎক্ষণাৎ মুখের উপর আর না করতে পারলো না সায়রী। বাটিটা নিজ হাতে নিয়ে নিলো। খানিক চুপ থেকে নেহার অভিমানী কণ্ঠে বলে ওঠেন,”ছোটো থাকতে তো সারাক্ষণ আন্টির কাছে এসে বসে থাকতে। আন্টির রান্না একদিন না খেলে যেনো দিনটাই কাটতো না আর এখন সহজে তোমায় দেখাই যায় না। সারাক্ষণ বাড়িতে থাকতে বিরক্ত লাগে না? রোজ না হোক, সপ্তাহে দুদিন তো আসাই যায় তাই না?”
“লেখাপড়ার অনেক চাপ আন্টি। সময় সুযোগ হয়ে ওঠে না।”
“ওহ, তা শুনলাম তোমাকে নাকি দেখতে এসে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ আন্টি।”
“তা ছেলে পছন্দ হয়েছে?”
সায়রীর হাস্যজ্জ্বল মুখখানায় এবার মলিনতা ভর করল। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,”বাবা-মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে, তাদের পছন্দই আমার পছন্দ।”
“সংসার করবে তুমি সেখানে বাবা-মায়ের পছন্দ আবার কী? ইসলামে বলা আছে ছেলে-মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গী নিজেকেই পছন্দ করতে হবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত বাবা-মা জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না। জোর করে কী বিয়ে হয়?”
“না আন্টি, আমার উপর কেউ কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না। আমার অনুমতি নিয়েই বিয়ে ঠিক করেছে।”
“ওহ তাহলে তো ছেলে তোমার পছন্দই হয়েছে। দোয়া করি যাতে সংসার জীবনে সুখী হও।”
জোরপূর্বক হাসলো সায়রী। তাড়া দেখিয়ে বললো, “আজ তবে আসি আন্টি।”
“চলে যাবে?”
“হ্যাঁ, মা একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছে।”
“আচ্ছা, আবার এসো কিন্তু।”
“জ্বি আন্টি আপনিও আসবেন।”
আর বিলম্ব না করে দ্রুত পা চালিয়ে উচ্ছ্বাসদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো সায়রী। কদিন ধরে নিজের মনের সঙ্গেই যেনো নিজেকে যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে। কী এক দুটানার মধ্যে পড়ল? মস্তিষ্কে নতুন এক প্রশ্নের উদয় হলো,”বিয়েতে রাজি হয়ে কী ঠিক করলাম আমি?”
ড্রয়িং রুমে বসে রাগে কাঁপছেন তপন রেজা। ফোনে কারো সঙ্গে উচ্চ বাক্যে কথা বলছেন। পাশেই বসে আছেন সুবর্ণা রহমান। উনার চোখেমুখেও রাগ স্পষ্ট। উচ্ছ্বাসদের বাড়ি থেকে সোজা চাচার বাড়িতে গিয়েছিল সায়রী। সেখান থেকে ফিরতেই বুঝতে পারলো বাড়িতে যে কিছু একটা ঘটেছে। বাবা- মায়ের মুখশ্রী দেখে বিষ্মিত হলো। তাদের মুখশ্রীতে রাগ বিদ্যমান।
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাগে গজগজ করতে লাগলেন তপন রেজা। মেয়েকে দেখতেই সুবর্ণা রহমান এগিয়ে আসেন। পাত্রপক্ষ থেকে দেওয়া আংটিটা দ্রুত পদে মেয়ের আঙুল থেকে খুলে নিলেন। মায়ের এমন কাজে সায়রীর চোখেমুখে বিষ্ময় খেলা করে। প্রশ্ন করে,”কী হলো মা? আংটিটা খুলে নিলে কেন?”
তপন রেজা ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, “আমাদেরকে ঠকানো? অমন একটা চরিত্রহীন ছেলেকে আমাদের মেয়ের জীবনে গছিয়ে দিতে চেয়েছে ওরা? কতবড় সাহস ওদের! সব সাহস বের করে দিবো। ওদের আমি পুলিশে দিবো। সবাইকে জেলের ভাত খাওয়াবো।”
সায়রী স্বগোতক্তি কণ্ঠে প্রশ্ন করল,”বুঝলাম না বাবা, কাকে কী বলছো? কে চরিত্রহীন?”
ইকরা এগিয়ে এলো ননদের কাছে। মোবাইলের গ্যালারি থেকে কয়েকটি ছবি বের করে সায়রীর মুখের দিকে তাক করে ধরলো। ছবিগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সায়রীর হবু স্বামী ইয়াছিন অন্য একটা নারীকে জড়িয়ে ধরে হাস্যজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার সঙ্গে বিভিন্ন পোশাকে বেশ কয়েকটি ঘনিষ্ঠ ছবি। সায়রী চমকিত নয়নে তাকিয়ে আছে মোবাইলের স্ক্রীনে। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয়ে ছুঁইছুঁই করছে কপালে। প্রশ্ন করল,”কোথায় পেলে ছবিগুলো?”
“বাবার হোয়াটসঅ্যাপে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কে যেনো পাঠিয়েছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা সেইভ করে রেখেছেন।”
সুবর্ণা রহমান রূষ্ট কণ্ঠে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমি তোর বাবাকে আগেই বলেছি মেয়ের বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করো না। ছেলে এবং ছেলের পরিবার সম্পর্কে আরেকটু খোঁজ খবর নাও। কিন্তু না তিনি তা করলেন না বরং আমায় বললেন ছেলে নাকি খুব ভালো। এই হচ্ছে ভালোর নমুনা। সব কুকীর্তি তো এখন সামনে চলে এসেছে। অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। আচ্ছা তুই বল,বিয়ের পর এসব জানাজানি হলে কী হতো?”
উত্তর দিলো না সায়রী। আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ ঘরে চলে গেলো। বিয়েটা ভাঙাতে মোটেও খারাপ লাগছে না তার বরং ভেতরে ভেতরে কেমন এক প্রশান্তি অনুভব করছে।
______
আহিল এবং রাশেদ হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে উচ্ছ্বাসের বিছানায়। দেখে মনে হচ্ছে উচ্ছ্বাস নয় বরং তারাই হচ্ছে রোগী এমনকি ঘরটাও যেনো তাদেরই। মোবাইল হাতে গেম খেলছে দুজনে। উচ্ছ্বাস তাদের পানে তাকিয়ে আছে। ব্যগ্ৰ কণ্ঠে বলছে,”এমন করছিস ক্যান ভাই? বল না কিছু।”
রাশেদ ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কী বলবো?”
“সায়রীর বিয়ে ভেঙেছে?”
“ভেঙেছে কিনা জানিনা তবে ফটো গুলো আঙ্কেলের হোয়াটসঅ্যাপে সঠিকভাবে পাঠিয়ে দিয়েছি।যেভাবে ইডিট করেছি বিশ্বাস না করে উপায় নেই। একেবারে সব আসল মনে হয়।”–আত্মবিশ্বাসের সহিত আহিল বলে উঠলো।
উচ্ছ্বাসের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। বিচলিত কণ্ঠে শুধালো,”শুধু ফটো গুলো দেখেই যে বিয়ে ভেঙে যাবে তার গ্যারান্টি কী?”
মোবাইল রেখে আহিল এবং রাশেদ দুজনেই গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো উচ্ছ্বাসের পানে। রাশেদ বললো, “শোন, যেভাবে ইডিট করে ফটো পাঠিয়েছি তাতে যে কেউই বুঝে যাবে দুজনের মধ্যে গভীর কোনো সম্পর্ক আছে। এছাড়া এসব ইডিট ফিডিটে আমরা আবার পিএইচডি করেছি। তুই চিন্তা মুক্ত থাক। বিয়ে ভাঙার খবর খুব শীঘ্রই আমরা নিয়ে আসবো। আর বিয়েটা যদি নাও ভাঙে তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। এটাকেও আগের গুলোর মতোই ভয় দেখিয়ে বিদেয় করবো নয়তো রামধুলাই দিবো।”
এবার কিছুটা শান্তি মিললো উচ্ছ্বাসের। এতক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা শব্দ করে ছেড়ে চোখ বুঁজলো। মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার আনন্দে সঙ্গে সঙ্গেই নেহারকে কল দিয়ে সবটা জানিয়েছিলেন সুবর্ণা। তাই মায়ের কাছ থেকে আগেই ঘটনাটা জানতে পেরেছিল উচ্ছ্বাস কিন্তু এবার আর নিজ থেকে বিয়েটা ভাঙতে পারলো না। কী একটা অঘটন ঘটলো? এতো বড়ো একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে এলো। তবে এতে কোনো আফসোস নেই উচ্ছ্বাসের। তার কাজগুলো তো বন্ধুরাই করে দিয়েছে।
এবারের বিয়েটাও ভেঙে গেলো সায়রীর। তবে এবার তপন রেজা খানিকটা খুশি। নিজ থেকে পাত্রপক্ষকে রিজেক্ট করতে পেরেছেন বলে কথা। এর মধ্যেই আবার নতুন পাত্রের সন্ধানে উঠে পড়েও লেগেছেন। যে করেই হোক মেয়ের জন্য এর থেকেও ভালো ছেলেকে খুঁজে বের করবেন তিনি তারপর সেই ছেলের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিবেন।
ক্লাস শেষে কিছু প্রয়োজনীয় বইয়ের জন্য লাইব্রেরিতে গিয়েছিল সায়রী। লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে পরিচিত এক মুখের সঙ্গে দেখা হলো। ছেলেটি এগিয়ে এলো তার দিকে। ইতস্তত কণ্ঠে বললো,”একটু কথা ছিলো সায়রী।”
সায়রী ভ্রু কুঁচকায়। শুধায়,”আপনি ইয়াছিন না?”
ইয়াছিন মাথা নাড়ায়। সায়রী পুনরায় প্রশ্ন করে,”তা আপনি এখানে?”
আহত দৃষ্টি মেলে তাকালো ইয়াছিন। অসহায় কণ্ঠে বললো,”বিশ্বাস করো সায়রী ওই ফটোর মেয়েটাকে আমি একদম চিনি না। ওই ফটোর ঘটনাটাও ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। জীবনে মাত্র একটা প্রেম করেছিলাম তাও আবার ক্লাস নাইনে থাকতে। সেই মেয়েটার অনেক বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে এমনকি এখন সে দুই বাচ্চার মা। তারপর আর কখনো প্রেম করিনি। লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম বাকিটা জীবন।”
“করলাম বিশ্বাস।”
চিকচিক করে উঠলো ইয়াছিনের চোখ জোড়া। বললো,”তাহলে তোমার বাবাকে একটু বোঝাও না। বিয়েটা ভেঙে দিতে নিষেধ করো।”
“বিয়েটা অলরেডি ভেঙেই গেছে মি. ইয়াছিন। ইতোমধ্যে বাবা নতুন ছেলেও খোঁজা শুরু করে দিয়েছে তাছাড়া আপনাকে আমার পছন্দ নয়।”
ইয়াছিনের মুখখানা মলিন হয়ে গেলো। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,”কেন পছন্দ নয়? আমার তো তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
বাম ভ্রুটা একটু উঁচু করল সায়রী। ছেলেটিকে যতটা বোকা ভেবেছিল আসলে সে ততটা বোকা নয়। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”কিছু করার নেই। আমি এ বিষয়ে আর বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না। আল্লাহ্ হাফেজ।”
কথা শেষ করে যাওয়ার জন্য সামনে পা বাড়ালো সায়রী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহত দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো ইয়াছিন। এর আগেও বিয়ের জন্য তিনখানা মেয়ে দেখেছিল ইয়াছিন কিন্তু তাদেরকে বিভিন্ন কারণে তার পছন্দ হয়নি। শেষমেশ সায়রীকে বড্ড মনে ধরেছিল। হতাশ হলো, কে এমন একটা অঘটন ঘটালো? আমার সঙ্গে কী এমন শত্রুতা আছে তার? প্রশ্নটা আওড়াতে আওড়াতে নিজের বাড়ির পথে রওনা দিলো ইয়াছিন।
চলবে _______
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)