উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত সায়রী পর্ব-৪+৫

0
792

#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৪]

ফজরের নামাজ শেষ করেই নিয়ম করে রোজ হাঁটতে বের হন সাব্বির আহমেদ। নিয়মটা চালু হয়েছে এই তো বছর দশেক আগে তাও আবার ডাক্তারের কড়া নির্দেশে। পেশায় একজন ব্যাংকার থাকায় বেশিরভাগ সময়ই এক জায়গায় বসে বসে কাজ করতে হয়েছে উনাকে যার কারণে একটা সময় ডায়াবেটিসের তীব্র রোষানলে আক্রান্ত হতে হয়। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ডাক্তার চোখের চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে এনে গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন,”দেখুন মি. সাব্বির আহমেদ আপনার অবস্থা কিন্তু খুবই সূচনীয়। এই সূচনীয় অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রতিদিন বেশি বেশি করে পানি পান করতে হবে। খাবারের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে এবং মাইলের পর মাইল হাঁটাহাঁটি করতে হবে।”

“হাঁটাহাঁটি করার সময় কোথায় ডাক্তার? সকাল সকালই তো অফিসে ছুটতে হয় আর ফিরতে ফিরতে হয় রাত।”

“হেঁটে হেঁটে অফিসে যাবেন আবার হেঁটে হেঁটে ফিরবেন। স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে অর্থও বেঁচে যাবে।”

ডাক্তারের পরামর্শটা ছিলো চমৎকার যা সঙ্গে সঙ্গে মনে ধরেছিল সাব্বির আহমেদের। কিপ্টামি স্বভাবটা তিনি বংশ পরম্পরায় বাপ দাদার নিকট থেকে পেয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন নিজের ছেলেও হয়তো বংশের ধারাই অব্যাহত রাখবে। কিন্তু উনাকে পরিপূর্ণ ভাবে নিরাশ করে দিয়ে ছেলে হয় উনার ঠিক বিপরীত স্বভাবের।কীভাবে, কোথায় টাকা খরচ করবে সেই চিন্তাতেই যেনো সারাক্ষণ মশগুল থাকে উচ্ছ্বাস। ছোটো বেলায় বাপের পকেট মারতো আর এখন মেরে দেয় বিল্ডিংয়ের দুয়েকটা ফ্ল্যাটের ভাড়া।

আজ সকালেও হাঁটতে বের হয়েছেন সাব্বির আহমেদ। পথিমধ্যে তপন রেজার সঙ্গে দেখা হতেই চায়ের টংয়ে গিয়ে জুড়ে দিয়েছেন গল্প। দুজনেই আবার এক নাউয়ের মাঝি কিনা। একই অফিসে একই পদে চাকরি করতেন দুজনে। সেখান থেকেই উনাদের বন্ধুত্বময় সম্পর্কের শুরু। একসময় বন্ধুত্বটা নিজেদের ব্যক্তি জীবন থেকে একেবারে পরিবারের মধ্যেও চলে আসে।

চা খেতে খেতে তপন রেজা বলে উঠলেন,”আপনার ছেলেকে দেখলাম পরিপাটি হয়ে কোথায় যেনো যাচ্ছে। সহজে তো তাকে অমন পোশাক আশাকে দেখা যায় না।”

“চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে।”—সাব্বির আহমেদের সোজাসাপ্টা উত্তর।

“বাহ্! এটা তো ভালো খবর।ইদানিং খারাপ সঙ্গ নিয়ে চলাফেরা করতে দেখি। শিক্ষিত ভালো পরিবারের ছেলের কী এসব মানায়?”

মনে মনে ছেলের প্রতি ভীষণ ক্ষীপ্ত হলেন সাব্বির আহমেদ। এই ছেলেটাই উনার সব মান সম্মান ডুবাচ্ছে কিন্তু অন্যের সামনে তো আর নিজের সম্মান খোয়ালে চলে না। কৃত্রিম হেসে বললেন,”যাদের সঙ্গে চলে তারাও উচ্চ পরিবারের ছেলে। লেখাপড়া শেষে চাকরি বাকরি না পেয়ে আর কি ঘুরে বেড়ায়। উচ্ছ্বাসেরও চাকরি করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আমার যা আছে সব তো ওরই। একমাত্র ছেলে আমার। বাড়ি ভাড়া যা আসে তা দিয়েই পায়ের উপর পা তুলে বউ বাচ্চা নিয়ে আরামছে দিন চলে যাবে। তবুও জোর করেই ইন্টারভিউতে পাঠাই। লেখাপড়া করেছে, এখন একটা চাকরি না করলেই নয়। লোকে মন্দ বলবে। তাছাড়া কথায় আছে না অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।”

“তা অবশ্য ঠিক। আমার ছেলেটার কথা আর কী বলবো? সব তো জানেনই, মান সম্মান ডুবিয়ে মেয়ে নিয়ে ভেগে এসেছে সেদিক দিয়ে উচ্ছ্বাস এখনো ঠিকই আছে। কোনো মেয়ের চক্করে নেই।”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাব্বির আহমেদ। অপ্রস্তুত হাসলেন। ফিসফিস করে বললেন,”দিনকাল ভালো না তপন ভাই। সায়রী মাকে একটু দেখেশুনে রাখবেন। ইতর ফাতরা ছেলের পাল্লায় পড়লে আবার সমস্যা।”

“মেয়েকে নিয়ে আমার তেমন চিন্তা নেই ভাই। নিজের ভালোটা মেয়ে আমার খুব ভালো করেই বোঝে। বাবার পছন্দের উপর তার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। বাবা যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করে নিবে।”—বলে হাসলেন তপন রেজা।

লোকটার জন্য বড্ড কষ্ট হলো সাব্বির আহমেদের।মেয়ের যে বাবার পছন্দের উপর কতটা ভরসা আছে তা উনি বাবা হয়ে না জানলেও সাব্বির আহমেদ খুব ভালো করেই জানেন।

অফিস থেকে বের হয়েই একটা সিগারেট ধরালো উচ্ছ্বাস। মুখভঙ্গি দেখে ভেতরে কী চলছে ঠাহর করা দায়। সিগারেট শেষ করে শার্টের ইন খুলে ফেললো। সাথে খুললো শার্টের উপরের দিকের কয়েকটা বোতাম। ফুটপাত ধরে হাঁটছে সে। বাইকটাকে বড্ড মিস করছে। সঙ্গে থাকলে হয়তো সারা শহর ইচ্ছেমতো ঘুরে ফিরে আসা যেতো। এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না তার। বাড়ি ফিরলেই শুনতে হবে বাবার অসংখ্য বকাবকি।

ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টা খানেক আড্ডা দিয়ে ভার্সিটি গেইট দিয়ে বের হলো সায়রী। গেইটের পাশটা পুরোপুরি ফাঁকা। এখনো অনেক শিক্ষার্থীই মাঠের ভেতরে বসে আড্ডা দিচ্ছে আবার কেউ কেউ চলে গেছে বাড়ি। কুয়াশা কেটে প্রচন্ড রোদ উঠেছে। গা ঝলসানো রোদ। রোদ থেকে বাঁচার জন্য ছাতা আনতে ভুলে গেছে সায়রী। এ সময় রিক্সা পেতেও পোহাতে হয় অনেক ঝামেলা। ভাগ্যের জোরে দুয়েকটা পেলেও চালক ভাড়া চায় বেশি। ডান হাত দিয়ে কপাল ঢেকে আশেপাশে তাকাতেই আপনা আপনি ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো উচ্ছ্বাস। এগিয়ে গেলো সায়রী।

কোনো প্রশ্ন করার আগেই দাঁড় করানো রিক্সাটায় উঠে গেলো উচ্ছ্বাস। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”উঠে এসো।”

চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতোই উচ্ছ্বাসের বাড়ানো হাতটা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে রিক্সায় উঠলো সায়রী। নিজ হাতটা গুটিয়ে নিলো উচ্ছ্বাস। রিক্সা চালকের উদ্দেশ্যে তাড়া দিয়ে বললো,”চলুন মামা।”

রিক্সা চলতে লাগলো। সায়রী শাণিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,”ব্যাপার কী? হঠাৎ আমার ভার্সিটির সামনে? আবার আমায় লিফটও দিচ্ছেন যে?”

“এদিক দিয়েই বাড়ি ফিরতে হতো তাই ভাবলাম তোমাকে একেবারে সঙ্গে করেই নিয়ে যাই।”

“চাকরি হলো?”

“না।”

“নিশ্চয়ই আবার কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছেন?”

উত্তর দিলো না উচ্ছ্বাস। প্রসঙ্গ বদলে বললো,”ব্যস্ত তুমি?”

“না, কেন?”

“চলো ঘুরি।”

“বাড়ি যাবেন না?”

“রাতের আগে ফেরা যাবে না।”

“কেন?”

“বাবা বকবে।”

ফিক করে হেসে উঠলো সায়রী। তার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো উচ্ছ্বাস। থমথমে কণ্ঠে শুধালো,”হাসছো কেন?”

“এতো বড়ো ছেলে কিনা বাবাকে ভয় পায়?”

“ওইসব ভয় ডর উচ্ছ্বাসের নেই। শুধু শুধু চেঁচামেচি হবে বলে যাওয়া ক্যান্সেল।”

বিপরীতে কী বলা যায় খুঁজে পেলো না সায়রী তাই চুপ রইলো।আশেপাশে ব্যস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। নিরবতা ভেঙে উচ্ছ্বাস শুধালো, “ক্লাস তো অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা তাহলে বের হতে এতো দেরি হলো যে?”

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সায়রী। খুব সিরিয়াস ভঙিতে বললো,”বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করছিলাম। রোজ ক্লাস শেষে তাকে সময় না দিলে সে আবার রাগ করে বসে থাকে। তার রাগ ভাঙানো খুবই কঠিন একটি কাজ তাই এই আবদারটা পূরণ করি যথাযথ ভাবে।”

মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস। সায়রী খেয়াল করল ছেলেটার হাসি ঠিক আগের মতোই সুন্দর। সায়রীর স্পষ্ট মনে আছে তখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে আর উচ্ছ্বাস পড়ে দ্বাদশে। উচ্ছ্বাসের প্রতি সেই ছোটো বেলা থেকেই বেশ বড়োসরো এক দুর্বলতা ছিলো তার মধ্যে। উচ্ছ্বাসের সবকিছুই তার কাছে খুব ভালো লাগতো। বেশি ভালো লাগতো এই হাসিটা কিন্তু ছেলেটা যেখানে সেখানে হাসতো না বিশেষ করে সায়রীর সামনে তো একদমই নয়। যারপনায় খুব সাহস জুগিয়ে সুযোগ বুঝে উচ্ছ্বাসকে হাসানোর জন্য কাতুকুতু দিতো সায়রী। তবে সেসব ভেবে মুগ্ধ হওয়ার মতো ভুল কাজ আজ আর করল না সে। রাগ হলো। চরম রাগ। উচ্ছ্বাস তার কথা বিশ্বাস করল না সে জন্য রাগ। যদিও কথাটা মিথ্যে তবুও উচ্ছ্বাসকে বিশ্বাস করতে হবেই।

কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বললো,”আপনাকে একটা পরামর্শ দেই উচ্ছ্বাস। আমার পিছুপিছু ঘুরঘুর করা বন্ধ করুন। এ জীবনে আমাকে আর আপনি পাচ্ছেন না। আমি হবো না আপনার। চাকরি বাকরিতে প্রবেশ করুন। বিয়ে করে আমাকে দাওয়াত দিন। ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক প্ল্যান ছিলো কিন্তু ভাইয়া তো পালিয়ে বিয়ে করল তাই এখন আমার এই ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব আপনার। আপনার বিয়েতে আমি অনেক ছেলে পটাবো।”

“এতো ছেলে দিয়ে কী করবে? তোমার না বয়ফ্রেন্ড আছে?”

“আছে তো কী হয়েছে? বয়ফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের জায়গায় আছে। আপনার বিয়েতে যে ছেলেকে পটাবো তাকে তো আর বয়ফ্রেন্ড বানাবো না তাকে একেবারে জামাই বানাবো।”

“এতো কষ্ট করার কী দরকার? আমাকেই বানিয়ে নাও। আমার অনেক ইচ্ছে বউয়ের কথায় উঠবো আর বসবো।”

“উহু, আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”

“কেন?”

“আপনাকে আমার পছন্দ নয়।”

“আগে তো ঠিকই পছন্দ ছিলো। উচ্ছ্বাস ভাই উচ্ছ্বাস ভাই বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলতে।”

“তাতে আপনার কী? আপনি আমার অনুভূতি নিয়ে মজা করেছেন। পঁচা পঁচা কথা বলে আমার প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছিলেন। ওহ হ্যাঁ আপনার না লম্বা এবং বিদেশিদের মতো সাদা চামড়ার মেয়ে পছন্দ?তাহলে তার কাছেই যান।”

“সেই রাগ জেদ নিয়েই বসে আছো এখনো? যেটাকে আত্মসম্মান ভাবছো সেটা কিন্তু আদৌ আত্মসম্মান নয়। সেটা হচ্ছে ইগো। ইগো বড্ড খারাপ জিনিস সায়রী সুন্দরী।”

উত্তর দিলো না সায়রী। মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ছোটো থেকেই বাড়িতে দেখে এসেছে উচ্ছ্বাসদের যাতায়াত। মায়ের সঙ্গে নেহার আন্টির তখন গলায় গলায় ভাব। বিকেলে মায়ের হাত ধরে চলে যেতো উচ্ছ্বাসদের বাড়ি। সেখান থেকেই ছেলেটার ন্যাওটা হয়ে যায় সায়রী। উচ্ছ্বাসও তার জন্য ড্রয়ারে রেখে দিতো কত রকমের চকলেট। পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়ার মেয়ে রোজি আপু পছন্দ করতো উচ্ছ্বাসকে। ক্লাসমেট ছিলো দুজনে। রোজ রোজ চকলেটের লোভ দেখিয়ে তার হাত দিয়েই উচ্ছ্বাসের জন্য লিখে পাঠাতো চিঠি। মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে এঁটে দিতো গোলাপ ফুল। রোজির ঘরের বারান্দার টবে গোলাপ গাছ। সেই গাছে ফুল ফুটলেই যত্ন সহকারে তা পাঠিয়ে দিতো উচ্ছ্বাসের জন্য কিন্তু সেই ফুলের টিকিটিও উচ্ছ্বাস কখনো দেখেনি আর জানেওনি ফুলের কথা। ফুল নিজের কাছে রেখে দিয়ে সায়রী শুধু চিঠিটাই দিয়ে যেতো। তখন সবে সে ক্লাস সিক্সে পড়া বাচ্চা মেয়ে। অতশত বোঝে না।

বড়ো হতে হতে কিশোরী মনে উথাল পাতাল সৃষ্টি করে প্রেম-ভালোবাসা। এইটে উঠেই চরম পাকা হয়ে গেছিল মেয়েটি। অর্ধেক পেকেছিল দুষ্টু বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে আর বাকি অর্ধেক পাকিয়েছে রোজি আপা। উচ্ছ্বাস তার জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। সে যে প্রেমে পড়েছে যখন তা নিশ্চিত হলো তখনি রোজি আপার চিঠি উচ্ছ্বাস পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া বন্ধ করে দিলো। বেচারি রোজি আপা শেষে বুক ভর্তি বিরহ নিয়েই বাবার জোরাজুরিতে এক ভুঁড়ি উঁচু লোককে বিয়ে করতে বাধ্য হলো। তাতেও যখন উচ্ছ্বাসের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো না তখনি সায়রী বুঝে গেলো এতদিনকার চিঠি গুলো পড়েইনি ছেলেটা। তাতে কী খুশিই না হয়েছিল সায়রী।

সায়রীর সব ভাবনার অবসান ঘটিয়ে গমগমে স্বরে উচ্ছ্বাস বললো,”তখন তুমি কিশোরী ছিলে। ওই বয়সটা ছেলেমানুষীর বয়স। ছেলে-মেয়েরা আবেগে পড়ে কত ভুলই না করে। তুমিও করেছিলে আর আমি তোমায় বুঝিয়েছিলাম‌। কিন্তু তুমি ছিলে নাছোড়বান্দা। বাচ্চারা নাছোড়বান্দাই হয়, সেদিন ওসব কড়া কথা না বললে এতদূর এগোতে পারতে না। লেখাপড়ায় ইম্প্রুভ হতো না। সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরে ফেইল করে বসে থাকতে হতো। প্রি টেস্ট পরীক্ষায়ও ফেইল করেছিলে মূলত এসব পাগলামোর জন্যই। তাই সেই ব্যবহারের জন্য আমি তোমায় স্যরি বলছি না। যা করেছি ঠিক করেছি।”

ছেলেটার মধ্যে সত্যিই কোনো অনুশোচনা নেই! আবার তা জোর গলায় বলছে? বেয়াদব কোথাকার! কাঠ কাঠ গলায় সায়রী বললো,”হুম সব আমার আবেগ। সেই আবেগ চলে গেছে কিন্তু আপনারটা কী? পড়ে আছেন কেন আমার পিছনে? আপনার ভালোবাসাও আবেগ।”

“ভালোবাসা! আমি আবার কবে বললাম তোমায় ভালোবাসি?”

অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সায়রী। অনুভূতি শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকালো উচ্ছ্বাসের মুখশ্রীতে। উচ্ছ্বাস ভ্রু নাচালো। সায়রী প্রশ্ন করল,”ভালোবাসেন না? তাহলে এই পিছু নেওয়া, বিরক্ত করা এতকিছু?”

দায়সারা ভাবে কলার ঠিক করল উচ্ছ্বাস। বললো,”উহু আমি তোমায় ভালোবাসি না। একটুও ভালোবাসি না তবে তোমার প্রতি আমি মারাত্মকভাবে দুর্বল। তোমাকে না দেখলে, না জ্বালালে আমার ভালো লাগে না। আমার এসব অভ্যাস তো তুমিই গড়ে তুলেছিলে সায়রী। তাই তোমাকে আমার চাই। যেকোনো মূল্যে তোমাকে আমার চাই। কেন চাই জানি না তবে শুধুই জানি তোমাকে আমার চায়ই চাই। তোমাকে পাওয়ার অধিকার শুধুই আমার।”

হা করে তাকিয়ে রইলো সায়রী। বোধগম্য হলো না কিছুই। যাকে ভালোবাসে না আবার তাকেই লাগবে এ কেমন কথা? ছেলেটার মাথার কী ব্যামো ট্যামো আছে নাকি? কই এতদিন তো তেমন কিছু চোখে পড়েনি, তাহলে? আর ভাবতে পারলো না সায়রী। থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই জেদ ধরে বলে উঠলো,”আমি বাড়ি যাবো।”

“আমাদের তো ঘুরার কথা ছিলো।”

“কখন বলেছি আপনার সঙ্গে ঘুরবো? রিক্সা থামাতে বলুন আমি বাড়ি যাবো।”

কিছু একটা ভেবে রিক্সা থামিয়ে লাফিয়ে নেমে গেলো উচ্ছ্বাস। রিক্সা চালকের ভাড়া মিটিয়ে ঠিকানা জানিয়ে সায়রীর পানে তাকালো। বললো,”যাও তাহলে।”

“আপনি কোথায় যাবেন?”

“যেদিকে দু চোখ যায়।”— স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাটা বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরলো উচ্ছ্বাস।

তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে সায়রী। ততক্ষণে রিক্সা চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো মানুষটা।
______

বাড়িতে রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে। সুবর্ণা এবং ইকরা ছোটাছুটি করছে চারিদিকে। শাড়ি পরে মাথায় হিজাব বেঁধে গোমড়া মুখে বিছানায় বসে আছে সায়রী। গভীর মনোযোগ সহকারে নখ খুঁটছে। বাবার এক পরিচিত লোক নিজ ছেলের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ পাঠিয়েছে। তারাই আজ দেখতে আসবে সায়রীকে। তপন রেজা মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলেন। বাবাকে দেখতেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো সায়রী। বলে উঠলো,”এটা কোনো কাজ বাবা? ধরো তাদের যদি আমাকে পছন্দ হয়। ছেলের মা ঘরে এসে যদি আমার চুল দেখতে চায় তখন কী হবে? লজ্জায় তো নাক কাটা যাবে আমার।”

তপন রেজা আশ্বস্ত করে বললেন,”তেমন কিছুই করবে না উনারা। উনাদের মন মানসিকতা এমন নয়।”

“তুমি এতোটা নিশ্চিত কীভাবে?”

“আমার পরিচিত। খুব ভালো সম্পর্ক তাদের সঙ্গে। তোমাকেও চেনে উনারা।”

“চুল বড়ো না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করছি না আমি।”

“এখন শুধু দেখে যাবে। পছন্দ হলে দিন তারিখ ঠিক করে রাখবো তারপর অনার্স শেষ হলে না হয় বিয়ে হবে।”

চিন্তাটা মাথা থেকে আপাতত দূর হলো। লজ্জার সম্মুখীন যে হতে হবে না তা নিশ্চিত হওয়া গেলো। কিছু একটা ভেবে পুনরায় মুখটা গোমড়া করে নিলো সায়রী। তপন রেজা হয়তো মেয়ের মনোভাব বুঝতে পারলেন। সজাগ গলায় বললেন,”ছেলে এবার বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছে। পরিবার ভালো। দুই ভাই দুই বোন। ভাই-বোনেরা বিয়ে করে নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত এখন শুধু সেই বাকি আছে তাই বাবা-মা ভালো মেয়ে খুঁজছেন। নিজেরাই আমার কাছে সম্বন্ধ পাঠালেন।এতো ভালো সম্বন্ধ হাত ছাড়া করা ভালো নয়। সব কথাবার্তাও আগেই বলে নিয়েছি তাই কোনো চিন্তা নেই তোর।”

বিপরীতে বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না সায়রী। সাড়ে সাতটা নাগাদ কাঙ্ক্ষিত মানুষগুলো চলে এলো। পাত্রের বাবা-মা ভাই ভাবীর ব্যবহারে সকলেই মুগ্ধ। বোনেরা সঙ্গে আসেনি। বিয়ে পাকা হলে একসময় এসে ভাইয়ের হবু বউকে দেখে যাবে।

সোফায় বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলেটিকে দেখতে ব্যস্ত সায়রী। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেচারা অনেক লেখাপড়া করেছে জীবনে। লেখাপড়া করেই চোখটা অসময়ে খুইয়েছে। লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে রেখেছে মাথা। পুরুষ মানুষ কেন এতো লজ্জাবতী হবে? পুরুষ মানুষ হবে গম্ভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ। সাথে হবে ঠোঁটকাটা স্বভাবের। এ ব্যাটা কী আদৌ ঠোঁটকাটা? এখনি যে পরিমাণ লজ্জায় নুইয়ে রেখেছে মাথা তাতে বিয়ের পরে কী অবস্থা হবে কে জানে?

ভবিষ্যৎ ভাবতে ব্যস্ত সায়রী। ইকরা কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”কী ভাবছো? উনারা কিছু জিজ্ঞেস করছে তোমায়, তার উত্তর দাও।”

নড়েচড়ে উঠলো সায়রী। ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়ে আশেপাশের কথাবার্তার শব্দ যেনো তার কান পর্যন্তই পৌঁছায়নি। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসলো।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৫]

“এ বাড়িতে বসে বসে খাওয়া আর চলবে না। বড়ো করার দায়িত্ব ছিলো, লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব ছিলো করেছি এখন আর কারো দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। এতো দামড়া ছেলে এখনো বাপের ঘাড়ে বসে খায়। লজ্জা করে না?”

চিৎকার করে কথাগুলো বলে থামলেন সাব্বির আহমেদ। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে সোফায় বসে আছে উচ্ছ্বাস। তার বেপরোয়া স্বভাবটাই রাগ বাড়িয়ে দেয় সাব্বির আহমেদের। নেহার ছেলেকে ইশারায় ঘরে যেতে বললেন। মায়ের কথা বেশি একটা অমান্য করে না উচ্ছ্বাস তাই চলে গেলো ঘরে। নেহার নরম কণ্ঠে ধীরে সুস্থে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,”এমন ব্যবহার করো কেন ছেলেটার সঙ্গে? একমাত্র ছেলে আমাদের। তোমার কী কোনো কিছুর অভাব আছে? নেই তো তাহলে খাওয়ার খোঁটা দিতে হবে কেন?”

স্ত্রীর দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাব্বির আহমেদ কিন্তু দমলেন না নেহার। কণ্ঠের তেজ কমে এলো সাব্বির আহমেদের। পুত্রের ঘরের দিকে তাকালেন একবার। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”বাবার অর্থ আছে বলেই কী বেকার হয়ে বসে থাকতে হবে? অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা জানো না? কখনো খবর রেখেছো ছেলে কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে? জানো কিছু? একসময় ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলো। ঢাবির মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী আর এমনি এমনি চান্স পেয়েছিল? এরপর! এরপর কী হলো? অসৎ সঙ্গে চলাফেরা করে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ল। খারাপ সিজিপিএ নিয়ে গ্ৰ্যাজুয়েশন শেষ করল। ওর সাথে অমন সিজিপিএ যায়? ঠোঁট দুটো দেখেছো? দিনেদিনে কালো হয়ে যাচ্ছে। সেদিন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে দেখলাম। বাইক কিনে দিয়েছিলাম ভার্সিটিতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। লেখাপড়া শেষে এখন সেই বাইক নিয়েই পুরো শহর চষে বেড়ায়। টাকা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে সে কী করছে। বাইরে বের হলে কত মানুষ কত কথা জিজ্ঞেস করে তখন আমার অবস্থাটা কেমন হয় বোঝো? দিনকাল ভালো যাচ্ছে না, বয়স দিনদিন বাড়ছে, রোগ বালাই লেগেই থাকে। কখন কী হয় আল্লাহ্ ভালো জানেন। এমন বেকার ছেলের কাছে তো কেউ মেয়ে বিয়েও দিবে না। একটামাত্র ছেলে, বেঁচে থাকতেই যদি ভালো একটা ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়ে যেতে না পারি তাহলে মরার পর কী হবে? আমি মরলে তো তোমার ছেলের অধঃপতন আরো বাড়বে।”

স্বামীর কথায় দমে গেলেন নেহার। ভুল কিছু বলেননি তিনি। ভার্সিটির হাওয়া গায়ে লাগতেই যেনো শান্তশিষ্ট, পড়াকু ছেলেটা কেমন বদলে গেলো। বাবার ভয়ে যে ছেলে তটস্থ থাকতো, একটা ধমকে কেঁপে উঠতো তার মধ্যেই ভয়ডর বলে এখন আর কিছু নেই। কোনো কথাতেই যেনো কিছু যায় আসে না তার।

ইন্টারভিউ শেষে আর সারাদিন বাড়ি ফেরেনি উচ্ছ্বাস। ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা ছুঁইছুঁই। এলাকায় ঢুকতেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারাই আটকে রেখেছিল এতক্ষণ। বাহিরের ঘর্মাক্ত পোশাক ছেড়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়েছে সবে। পেটে এখনো ভারি কোনো খাবার পড়েনি। বাহির থেকে আজ আর খেয়ে আসেনি। ইচ্ছে করেনি। এদিকে বাড়িতে এসে শুনতে হলো বাবার ধারালো সব কথা। বিরক্ত লাগছে। যাকে বলে চরম বিরক্ত। এবার যেনো একটা চাকরি জোগাড় না করলেই নয়।

ব্যালকনিতে রাখা বেতের চেয়ারটাতে বসে আছে সায়রী। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ডান হাতের অনামিকা আঙুলে। জ্বলজ্বল করছে পুরোনো ধাঁচের সোনার আংটিটা। পাত্রপক্ষের বেশ পছন্দ হয়েছে তাকে। পাত্রের মা আর দেরি করতে চান না তাই একেবারে আংটি পরিয়ে বিয়ে পাকা করে গেছেন। খোলা অন্তরীক্ষে অজস্র তাঁরার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ একটি চাঁদ। তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সায়রী। জেদের বর্শবর্তী হয়ে যদি বিয়েটা সে করেও ফেলে তারপর! তারপর কী হবে? পারবে কী সুখী হতে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। আড়াই বছর ধরে লুকিয়ে চুপিয়ে উচ্ছ্বাস নামক পুরুষটির গভীর প্রেমে কী হাবুডুবুটাই না খেয়েছিল সায়রী। ওই শ্যামবর্ণের পুরুষটির জন্য মায়ের অজস্র বকা খেয়েও লুকিয়ে লুকিয়ে ভর দুপুরে বেরিয়ে যেতো বাড়ি থেকে। নেহারের চোখে ধূলো দিয়ে বসে থাকতো উচ্ছ্বাসের ঘরে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো তার মুখশ্রীতে। মনে মনে কতশত ঝল্পনা কল্পনা। পড়ার ফাঁকেই একদিন আচমকা উচ্ছ্বাস তার দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই ভড়কে যায় সায়রী। হয়তো কিছু একটা টের পেয়েছিল উচ্ছ্বাস। পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে পাশে বসে সায়রীর। শুধায়,”সবসময় এমন করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো কেন সায়রী সুন্দরী?”

ঘাবড়ে যায় সায়রী। ধরা পড়া কিশোরী মনে শুরু হয় এক ভয়ংকর তান্ডব। সম্মুখে বসে থাকা পুরুষটির দিকে তাকাতে পারে না লজ্জায়। প্রসঙ্গ বদলে ফেলে উচ্ছ্বাস। জিজ্ঞেস করে,”তোমার লেখাপড়া নেই? কোচিং করো না?”

“করি তো।”

“কখন?”

“সকালে কোচিং করে তারপর স্কুলে যাই। সন্ধ্যায় আবার একজন টিচার আসেন পড়াতে কিন্তু এখন স্কুল বন্ধ। দুদিন আগেই তো প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাই।”

“ওহ।”

বিপরীতে কিছু বলে না, চুপ থাকে সায়রী। তাকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে উচ্ছ্বাস। জিজ্ঞেস করে,”আমি দেখতে কী খুব সুন্দর?”

এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সায়রী। মুখ তুলে তাকায়। তার দিকে ঝুঁকে আছে উচ্ছ্বাস। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। হাসিটা মুগ্ধ হয়ে দেখে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে ওঠে সায়রী,”হুম অনেক সুন্দর।”

“আমায় ভালো লাগে?”

“হু।”—অকপটে স্বীকারোক্তিতে হাসিটা চওড়া হয় উচ্ছ্বাসের। নিজের এমন কাজে লজ্জা পায় সায়রী। শুকনো ঢোক গিলে দৌড়ে বেরিয়ে যায় তার ঘর থেকে।

পরপর দুদিন সে আর উচ্ছ্বাসের মুখোমুখিই হয়নি লজ্জায়। তৃতীয় দিন উচ্ছ্বাস নিজেই চলে আসে তাদের বাড়িতে।সেদিন কী খুশিই না হয়েছিল সায়রী। তাকে দেখতে না পেয়ে উচ্ছ্বাসেরও হয়তো কষ্ট হচ্ছে এটাই ভেবে নিয়েছিল তখন। এই বারান্দাতেই তো সেদিন বসে ছিলো দুজনে। আগে যত সহজেই উচ্ছ্বাস ভাই উচ্ছ্বাস ভাই বলে কথা বলতে পারতো সেদিন আর পারলো না। লজ্জা কাজ করছিল সায়রীর কিশোরী মনে। নিরবতা ভেঙে উচ্ছ্বাস বলে ওঠে,”এই দুদিন ধরে তুমি আমাদের বাড়িতে যাওনি কেন? অসুস্থ ছিলে?”

“না তো।”

“তাহলে যাওনি কেন? গতকাল মেলায় গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সঙ্গে করে তোমায়ও নিয়ে যাবো। কিন্তু তোমায় তো পেলামই না। যারপনায় বন্ধুদের সঙ্গে একাই গিয়েছিলাম মেলা ঘুরতে।”

জড়তা কাটিয়ে মুখ তুলে তাকালো সায়রী। গোমড়া মুখে বললো,”বাড়িতে এসে আমাকে আপনার নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো উচ্ছ্বাস ভাই।”

“সে কথা তো মনে ছিলো না।”

“তাহলে চলুন কাল যাই।”

“আজই তো মেলার শেষ দিন ছিলো।”

মনটা খারাপ হয়ে গেলো সায়রীর। অভিমানী স্বরে বললো,”তাহলে এতদিন কেন নিয়ে যাননি?”

“তোমার না পরীক্ষা গেলো তাহলে কীভাবে নিয়ে যেতাম বলো? সেসব বাদ দাও তোমার জন্য উপহার এনেছিলাম। একটা নয় তিন তিনটে উপহার।”

অভিমান ভুল গিয়ে আনন্দিত, পুলকিত হয়ে উঠলো সায়রীর মন। শুধালো,”কী উপহার?”

“সেটা তো বলা যাবে না।”

সায়রী হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”দিন তাহলে।”

“সঙ্গে আনিনি। নিজ দায়িত্বে বাড়িতে গিয়ে নিজের উপহার নিজে নিয়ে আসবে।”

মাথা নাড়লো সায়রী।তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল,”আপনার সঙ্গে পরশু একটা মেয়েকে দেখেছি কে ছিলো মেয়েটা?”

“তোমার ভাবী।”

চমকায় সায়রী। প্রশ্ন করে,”আমার ভাবী? ভাইয়া বিয়ে করেছে? কিন্তু কবে?”

“তোমার ভাইয়া বিয়ে করলেই কী ভাবী পাবে তাছাড়া পাবে না? এই যে আমাকে সারাক্ষণ ভাই ভাই বলে ডাকো আমার বউও তো তাহলে তোমার ভাবীই হবে তাই না?”

“আপনার বউ?”

“উহু, আমার গার্লফ্রেন্ড।”

কিশোরী মনে উথাল পাতাল সৃষ্টি হয়। বিধ্বংসী দৃষ্টি মেলে শুধায়,”আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”

“হু, কেন থাকার কথা ছিলো না বুঝি?”

“না।”

“কেন কেন?”

উত্তর দেয় না সায়রী। কোনো উত্তর না পেয়ে উচ্ছ্বাস বলে ওঠে,”তুমি আমায় পছন্দ করো তাই না?”

মাথা নুইয়ে নেয় সায়রী। মৌন সম্মতির মাধ্যমে প্রকাশ করে ‘হ্যাঁ’। উচ্ছ্বাস শীতল কণ্ঠে বলে,”আমার তো গার্লফ্রেন্ড হিসেবে তোমাকে মোটেও পছন্দ নয়।”

“তার মানে আপনি আমায় পছন্দ করেন না?”

“করি তো তবে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে নয়।”

“কেন?”

“তুমি ছোটো।”

“সবসময় কী আর ছোটো থাকবো নাকি?”

“এই বয়সে এতো পেকেছো কীভাবে?”

“আমি ক্লাস টেনে পড়ি উচ্ছ্বাস ভাই। তাছাড়া আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট।”

“আয়হায়! তাহলে তুমি দেখছি অনেকটাই পেকে গেছো! বিয়ে দিয়ে দিলে তো সংসারও করতে পারবে।”

“আমার ক্লাসমেট আফসানার তো সেই ক্লাস নাইনে থাকতেই বিয়ে হয়ে গেছে। আপনি করবেন আমায় বিয়ে?”

“না।”

“কেন?”

“হাইটে আমার লম্বা বউ চাই একেবারে আমার থেকেও লম্বা। আমি যেহেতু শ্যামলা সেহেতু আমার বউকে হতে হবে একেবারে বিদেশীদের মতো ধবধবে সাদা। বউকে অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টও হতে হবে, এদিকে তুমি তো অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায় রসায়নে ফেইল করেছো। প্রি-টেস্টেও যে করবে তা পরিপূর্ণ ভাবে নিশ্চিত আমি। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তো শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়াও। তাছাড়া তুমি তো আমায় ভাই বলে সম্বোধন করো। সেহেতু বোনের সঙ্গে প্রেম ব্যাপারটা কেমন শোনায় না?বাবা জানলে রীতিমতো আমায় ধরে পেটাবে।”

টলমল চোখে ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো সায়রী। তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাস্যজ্জ্বল মুখে বাহিরে তাকিয়ে রইলো উচ্ছ্বাস। সায়রী ফিসফিসিয়ে বললো,”আমি আপনাকে ভালোবাসি উচ্ছ্বাস ভাই।”

“এই বয়সে এমন একটু হয়। মনে হয় তাকে ছাড়া যেনো বাঁচা মুশকিল, সারাজীবন খুব ভালোবাসবে কিন্তু সত্যি বলতে এসব আবেগ। এই আবেগ একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবে। আসলে ভালোবাসা টালোবাসা বলতে কিছু হয় না।”

“এটা আবেগ নয় উচ্ছ্বাস ভাই।”

“তুমি আগেই খুব ভালো ছিলে কিন্তু এখন খুব পঁচা হয়ে গেছো। শোনো সায়রী সুন্দরী এরপর থেকে আর কখনো আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে না। নজর লেগে কালো হয়ে যাবো তো আমি। ভালোবাসা টালোবাসা সাইডে রেখে বাড়িতে এসে নিজ দায়িত্বে নিজের উপহার নিয়ে যাবে।”

কথাগুলো শেষ করে বের হয়ে যায় উচ্ছ্বাস। কিন্তু তার এই হাসিমুখের কঠিন কঠিন কথাগুলো যে এক কিশোরী মনে অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি করেছে তা হয়তো সে টেরও পায়নি। তারপর আর উচ্ছ্বাসের কাছে নিজ থেকে যায়নি সায়রী। ভালো করে কথাও বলেনি কখনো। ঘাপটি মেরে থাকতো ঘরে। কখনো রাস্তায় উচ্ছ্বাসকে দেখলে লুকিয়ে থাকতো নিজ দায়িত্বে। তার ছোট্ট মনে জেগে ওঠেছিল এক প্রবল আত্মসম্মানবোধ যা এখনো নদীর স্রোতের মতো প্রবাহমান। কথাগুলো মনে পড়লেই চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। আজও তার ব্যতীক্রম ঘটলো না। যার পিছন পিছন একসময় নিজে ঘুরে বেড়িয়েছে এখন সে তার পিছুপিছু ঘুরে বেড়ায়, ভাবা যায় এসব? কয়েক বছরেই যেনো ছেলেটা একেবারে বদলে গেছে।

ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল সায়রী। মোবাইল হাতে নিয়ে সোজা ঢুকলো ফেসবুকে। আজ উচ্ছ্বাস অনলাইনে নেই। শেষ কখন এসেছে তাও দেখা যাচ্ছে না। আচ্ছা এক্টিভিটি অফ করে চালাচ্ছে না তো? এই ছেলে তো এমন নয়। চট করে মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো, আগ্ৰহও বলা চলে। ‘তখন উচ্ছ্বাস কী উপহার এনেছিল আমার জন্য?’ মনে মনে প্রশ্নটা আওড়ালো সায়রী। এই মুহূর্তে খুব আফসোস হচ্ছে। অবশ্যই সেদিন তার যাওয়া উচিত ছিলো। উপহারটা আনার জন্য হলেও যাওয়া উচিত ছিলো। ওটাই তো সায়রীর জন্য আনা উচ্ছ্বাসের প্রথম উপহার ছিলো।
________

দুদিন কাটলো। বাড়ির পরিবেশ এখন ঠান্ডা। সাব্বির আহমেদ একেবারে নিশ্চুপ। ছেলের এক্সিডেন্টের খবর শুনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। সফেদ বিছানায় শুয়ে আছে উচ্ছ্বাস। হাত, পা, কপালে ব্যান্ডেজ লাগানো। পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখেই সকালে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল উচ্ছ্বাস। হঠাৎ চাকরির প্রতি ছেলের আগ্ৰহ দেখে যেনো অবাক হলেন নেহার। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথেই করল বাইক এক্সিডেন্ট। বন্ধু আহিল গম্ভীর কণ্ঠে সেই বর্ণনাই দিচ্ছে নেহারকে।

“কী বলবো চাচী? বিশাল বড়ো এক বাসের সঙ্গে সজোরে একটা ধাক্কা লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত বাইক থেকে ছিটকে পড়ল আমাদের উচ্ছ্বাস। মৃ’ত্যুর হাত থেকে একটুর জন্য বেঁচে গেছে বেচারা। এতে কিন্তু উচ্ছ্বাসের কোনো দোষ ছিলো না। ও সুন্দর মতন রাস্তার সাইড দিয়ে বাইক চালাচ্ছিল তাও আবার কম স্পিডে। সব দোষ বাস চালকের। শালায় নিশ্চয়ই নেশা করে রাস্তায় নেমেছিল।”

ফুঁপিয়ে কাঁদছেন নেহার। ইতোমধ্যে আহিলের কাছ থেকে শুনে পুরো ঘটনাটা কল্পনা পর্যন্ত করে ফেলেছেন উনি। সাব্বির আহমেদ মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে রেখেছেন। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “তোমাদের বন্ধুত্ব কত বছরের?”

এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আহিল। আমতা আমতা করে বললো,”ছয় বছরের আঙ্কেল। একই ভার্সিটিতে পড়েছি আমরা।”

“ছয় বছর ধরে ওকে চেনো তাই তো? আর এই বজ্জাত ইতরকে আমরা ছাব্বিশ বছর ধরে চিনি তাই ওর হয়ে সাফাই গেয়ে লাভ নেই। কার দোষ ছিলো কার দোষ ছিলো না তা আমি খুব ভালো করেই জানি।”

বিপরীতে বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না আহিল। নেহার কান্না থামিয়ে বললেন,”আমি ওকে সাতাশ বছর ধরে চিনি। ওই যে এক বছর পেটে রেখেছিলাম না? কী লাথি গুলোই না আমায় মেরেছিল।”

হতাশ দৃষ্টিতে সিলিংয়ের পানে তাকিয়ে রইলো উচ্ছ্বাস। বাইক এক্সিডেন্ট এর আগেও সে দুই দুইবার করেছিল। এবারেরটা নিয়ে তিনবার হলো তবে এবার চোটটা একটু বেশিই লেগেছে। ক্ষতগুলোও খুব গভীর। মাসখানেক ডাক্তার তাকে বেড রেস্ট নিতে বলেছেন। সব ফর্মালিটি শেষ করে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন সাব্বির আহমেদ। উচ্ছ্বাসকে তার বন্ধুরাই নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দিতে এসেছে বাড়িতে।

হাত গলায় ঝুলছে, আগামী এক দুই সপ্তাহেও যে বিছানা থেকে উঠতে পারবে না তা পুরোপুরি নিশ্চিত উচ্ছ্বাস। আহিল, রাশেদ এখনো উচ্ছ্বাসের ঘরেই বসে আছে। তার নিরবতা দেখে ফিসফিস করে রাশেদ বললো,”কষ্ট পাইস না দোস্ত। ভাবীরে আমি খবর পাঠাইয়া দিছি।”

ভ্রু যুগল কিয়ৎ কুঁচকে বন্ধুর পানে তাকালো উচ্ছ্বাস। রাশেদের চোখ দুটো চিকচিক করছে যেনো বিশাল বড়ো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে সে। উচ্ছ্বাস প্রশ্ন করল,”তোর ভাবী আমার এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে কী করবে? আমিই বা তাকে দিয়ে করবো? ভাবীকে নিজের ভাইয়ের কাছে পাঠা।”

আহিল ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,”মামা ওর নিজস্ব ভাবীর কথা বলেনি বলেছে আমাদের ভাবীর কথা। সায়রী ভাবীকে খবর দিয়েছে।”

বিষয়টা পরিষ্কার হলো উচ্ছ্বাসের নিকট। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধালো,”সায়রীকে কেন খবর দিতে হবে? বেশি বাড়াবাড়ি করিস তোরা।”

“দেওয়ার প্রয়োজন বলেই দিয়েছি। তোর যা অবস্থা হয়েছে মনে হয় না এই মাসে আর নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে ভাবীর পিছুপিছু ঘুরতে পারবি এর থেকে বরং ভাবীই আসুক।”– রাশেদের ভাবলেশহীন উত্তর।

“আসবে না। আমি মরে গেলেও আসার প্রয়োজন মনে করবে না। অযথা খবর দিলি। সস্তা সিমপ্যাথির প্রয়োজন নেই।”

উচ্ছ্বাসের এতো জোর দিয়ে বলা কথায় ঘাবড়ায় দুজন। বাম ভ্রু উঁচিয়ে আহিল প্রশ্ন করে,”কী বলিস? ভাবী না তোকে ভালোবাসে?”

“আগে বাসতো এখন আর বাসে না। ইগোতে ঠ্যালা লেগেছে।”

রাশেদ কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো,”কী কস মামা!”

তখনি ঘরে প্রবেশ করলেন নেহার। উনাকে দেখতেই কৃত্রিম হাসলো রাশেদ। প্রসঙ্গ বদলে বললো,”এই যে আন্টি এসে গেছে।”

নেহার বিরক্তির সহিত বললেন,”আন্টি ডাকছো কেন? এখন না আমার ছেলেকে তুমি মামা বলে ডাকলে? ও মামা হলে আমি আন্টি হই কী করে? যদিও আমার কোনো মেয়ে নেই তবুও তুমি আমায় নানী বলে ডাকতেই পারো। আমি কিছু মনে করবো না।”

নেহারের কথায় সশব্দে হেসে ওঠে আহিল। আর রাশেদ ঘোর লজ্জায় নুইয়ে নেয় মাথা।

চলবে _______

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে