#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৩]
দুদিন ধরে বাড়িতে নেই সাব্বির আহমেদ। বোনের বাড়ি গেছেন কী যেনো একটা কাজে। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো অবস্থা এখন উচ্ছ্বাসের। হাঁটু অবধি ঢাকা একটা হাফ প্যান্ট পরে উদোম গায়ে সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে টিভি দেখছে সে। বেশ কয়েকবার কলিং বেল বেজে ওঠার পরেও তার মধ্যে কোনো হেলদুল নেই। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন নেহার। সদর দরজার দিকে দিকে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন,”বয়রা হয়ে গেছিস নাকি? কলিং বেলের শব্দ কানে যায় না?”
মায়ের প্রশ্নের কোনোরূপ উত্তর দিলো না উচ্ছ্বাস। টিভির দিকে দৃষ্টি রেখেই হো হো করে হেসে উঠলো।কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল সুবর্ণা রহমান এবং সায়রী। উচ্ছ্বাসের দিকে দৃষ্টি যেতেই চোখমুখ কুঁচকে যায় মা-মেয়ের। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ভ্রু দ্বয় খানিক কুঁচকে সামনের দিকে তাকালো উচ্ছ্বাস। সায়রীর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের উন্মুক্ত দেহে চোখ বুলাতেই লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেলো মুহূর্তে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ভো দৌড় দিলো নিজ কক্ষে।
সোফায় তাদের বসতে দিলেন নেহার। হাঁক ছেড়ে কাজের মেয়ে জরিনার উদ্দেশ্যে বললেন,”তিন কাপ চা পাঠিয়ে দে তো জরিনা।”
সৌজন্য হাসলেন সুবর্ণা। বললেন,”চায়ের প্রয়োজন নেই ভাবী। এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না। আসলে আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল ভাবী। প্রায় প্রায়ই আমি উচ্ছ্বাসের কাছে আপনার কথা জিজ্ঞেস করি। আসবো আসবো বলে আর আশাও হয় না। পরে উচ্ছ্বাস বললো আপনিও নাকি আমাকে দেখতে চাইছেন তাই চলে এলাম। দেখেছেন ভাবী আমাদের মনের কত মিল।”
কৃত্রিম হাসেন নেহার। সুবর্ণা পুনরায় বলে ওঠেন,
“সংসারের ব্যস্ততায় এখন আর তেমন কোথাও যাওয়া হয় না। এই সংসারের পেছনে সময় দিতে দিতেই অর্ধেকটা জীবন শেষ আমার।”
মায়ের মুখে ডাহা মিথ্যে কথা শুনে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দুটো দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো সায়রী। নেহার বলেন,”তা অবশ্য ঠিক, তা উচ্ছ্বাস কী আপনাদের বাড়িতে যায় নাকি?”
“হ্যাঁ যায় তো, রোজ না হলেও সপ্তাহে নিয়ম করে দু তিনবার তো ঠিকই আমায় দেখে আসে। যে যাই বলুক আমাদের উচ্ছ্বাসের মতো ছেলেই হয় না। খুব ভালোবাসে আমায়। এতোটা ভালো আমাকে নিজের ছেলে-মেয়েরাও বাসে না। আপনার ভাগ্য খুবই ভালো ভাবী। রত্ন জন্ম দিয়েছেন একটা।”
সুবর্ণার কথায় হতবাক নেহার। মনে মনে ছেলেকে উড়াধুরা কয়েকটা গালি দিয়ে ঠোঁটের কার্নিশে হাসি ফুটিয়ে বললেন,”ছেলেটা এমনই ভাবী। একদম নরম মনের মানুষ। সবাইকেই সহজে আপন করে নেয়। যেমন বাপ দাদার র’ক্ত পেয়েছে তেমনি স্বভাব- চরিত্র, আচার ব্যবহারও একেবারে গোষ্ঠীর মতোই হয়েছে।”
শেষ কথাটা চিবিয়ে চিবিয়েই বললেন নেহার। সুবর্ণা আফসোসের সুর তুলে বললেন,”ওহ, এই জন্যই বলি ছেলে এতো নম্র ভদ্র হয়েছে কেন! আমার ছেলে- মেয়েদের তো আবার গোড়াতেই গন্ডগোল।”
মায়ের কথায় চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো সায়রীর। এখানে বসে থাকলে যে বাপের গোষ্ঠী নিয়ে মায়ের ননস্টপ নিন্দা শুনতে হবে তা খুব ভালো করেই জানা তার। এখানে আসারও তেমন কোনো ইচ্ছে ছিলো না শুধু দায়ে পড়ে এসেছে। মলিন হেসে নেহারের উদ্দেশ্যে বললো,”আপনারা কথা বলুন।আমি বরং উচ্ছ্বাসের ঘরে থেকে ঘুরে আসি আন্টি।”
“হ্যাঁ যাও যাও।”
নেহারের সম্মতি পেয়ে দ্রুত বসা থেকে উঠে উচ্ছ্বাসের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সায়রী। তখনি পেছন থেকে শুনলো নেহারের ফিসফিসিয়ে করা প্রশ্নটা,”আমাদের সায়রী তো সেই ছোটো বেলা থেকেই দেখতে মাশাআল্লাহ। তা ভাবী ওর এতো লম্বা চুলগুলো কেটে ফেললেন কেন? এতো বড়ো মেয়ের চুল গজাতে গজাতে তো অনেক সময় লাগবে।”
কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই গা পিত্তি জ্বলে উঠলো সায়রীর। বুঝতে আর বাকি নেই কথাটা কে ছড়িয়েছে। ঢুপঢাপ পা ফেলে উচ্ছ্বাসের ঘরে প্রবেশ করল। ধূসর রঙের টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে মোবাইল হাতে বিছানায় বসে আছে উচ্ছ্বাস। মেয়েলী কণ্ঠস্বর পেতেই দরজার দিকে মাথা তুলে তাকালো।
সায়রীকে দেখে মুচকি হেসে বললো,”বিয়ের আগেই জামাইয়ের ঘরে আসতে পারে কজন মেয়ে বলো তো? তোমার ভাগ্য খুব ভালো সায়রী সুন্দরী। ছোটো বেলা থেকেই জামাইয়ের ঘর দেখে বড়ো হয়েছো।”
সেসবে কর্ণপাত না করে দাঁতে দাঁত চেপে সায়রী প্রশ্ন করল,”আমি যে ন্যাড়া হয়েছি তা আপনার মাকে কে বলেছে? এতোটা খারাপ কেন আপনি? এখন কী পুরো এলাকা মাইকিং করবেন?”
“কথা নেই বার্তা নেই এতো বড়ো অপবাদটা মাথায় দিয়ে দিলে? তোমার সঙ্গে মজা করি বলে এই না যে সবাইকে গিয়ে জানাতে যাবো।”
“তাহলে আন্টি জানলেন কীভাবে?”
“আমি কীভাবে জানবো?”
“তাহলে কে জানে?”
উচ্ছ্বাস নিরব। আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে রাগের পরিমাণটা বৃদ্ধি পেলো সায়রীর। কিছু একটা ভেবে উচ্ছ্বাস বলে উঠলো,”মনে হয় জরিনা বলেছে।”
“জরিনা? সে জানবে কী করে?”
“তোমাদের বাড়ির বুয়ার সঙ্গে জরিনার অনেক ভাব। বুয়াই জরিনার কাছে তোমার ন্যাড়া হওয়ার খবর বলেছে আর জরিনা বলেছে আমার কাছে।”
হতবাক হয়ে গেলো সায়রী। মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িতে গেলে যে আজ একটা কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিছানায় বসতে বললো উচ্ছ্বাস। দ্বিমত না করে চুপচাপ বসে পড়ল সায়রী। প্রশ্ন করল,”আমার এসাইনমেন্ট কোথায়?”
ঘরের মধ্যে সিঙ্গেল সোফার উপর সায়রীর দেওয়া সেই শপিং ব্যাগটা রাখা। প্রশ্নের বিপরীতে আঙুল তাক করে তা দেখাতেই দ্রুত গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে এলো সায়রী। কড়া দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের পানে একবার তাকিয়ে ফাইলগুলোতে চোখ বুলালো। সাথে বেশ অবাকও হলো। প্রতিটি পৃষ্ঠায় কালো কালির লেখা এবং চিত্র জ্বলজ্বল করছে। বিষ্ময় নিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকালো কিন্তু তার দৃষ্টি হাতের মোবাইলে। মনোযোগ সহকারে গেম খেলছে সে।
সায়রী তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,”আপনি না বাড়ির বাইরে ছিলেন তাহলে লিখলেন কীভাবে?”
উচ্ছ্বাসের সোজাসাপ্টা উত্তর,”তোমার কী মনে হয় কষ্ট করে এক জায়গায় বসে থেকে আমি তোমার এসাইনমেন্ট লিখবো? আমি! এসব আমার দ্বারা সম্ভব নয়। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটের মেয়ে টুম্পাকে দিয়ে লিখিয়েছি।”
“আপনি বললেন আর লিখে দিলো?”
“কেন দিবে না? এতো সুন্দর, স্মার্ট একটা ছেলে আবদার করল আর সেই আবদার ফেলে দিবে? বুঝলে সায়রী, মেয়েটা মনে হয় আমায় খুব পছন্দ করে।”
“মেয়েটার রুচি খারাপ।”
“এভাবে বলো না সুন্দরী। ভুলে যেও না তুমিও কিন্তু কম ঘুরোনি এই উচ্ছ্বাস আনানের পেছনে।”
থতমত খেয়ে যায় সায়রী। আমতা আমতা করে বলে,”কৈশোরের ভুল ছিলো ওইটা। কৈশোর কালে তো কত মানুষ কত ভুলই করে।”
“হয়েছে হয়েছে। শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে হবে না। মাছটা অনেক বড়ো যতই উপরে শাক দাও না কেন মাছ কিন্তু ঠিকই দেখা যাচ্ছে।”
“ইতর ফাতরা।” কণ্ঠে রাগ ঢেলে কথাটা বলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সায়রী কিন্তু পারলো না। পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো উচ্ছ্বাস। ভ্রু যুগল কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালো সায়রী।শুধালো,”কী?”
একটানে সায়রীর হাত থেকে ব্যাগটা নিজের কাছে নিয়ে নিলো উচ্ছ্বাস। ভ্রু নাচিয়ে বললো,”এতো সহজে তো এগুলো দিচ্ছি না। আগে আমার ভিডিও ডিলেট করো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সায়রী। উচ্ছ্বাসকে দেখিয়ে ডিলেট করল সেই ভিডিও। সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো উচ্ছ্বাস। মুখ বাঁকিয়ে উচ্ছ্বাসের থেকে ব্যাগটা নিয়ে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ঘর থেকে চলে গেলো সায়রী। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উচ্ছ্বাস।
_____
বাড়িতে ফিরেই নিজের সামনে বুয়া রমেসাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সায়রী। রাগে গজগজ করছে। কিছুটা দূরে বসে আছেন তপন রেজা এবং সুবর্ণা। তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে ইকরা। এবার বিরক্তির সহিত ননদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,”ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে সায়রী। কী বলবে বলো না তাড়াতাড়ি।”
তেতে উঠলো সায়রী। কর্কশ কণ্ঠে বললো,”কী আর বলার আছে আমার? আমি কী সাধে বড়ো বড়ো চুল গুলো কেটে ন্যাড়া হয়েছি? তোমরা জানো না কেন এমনটা করেছি? মাথার মধ্যে জায়গায় জায়গায় ঘা ওঠেছিল। গোসল করে চুল শুকাতে কী এক ঝামেলা আর তীব্র যন্ত্রনা। তাই তো ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই কেটে ফেললাম।”
তপন রেজা শুধালেন,”এসব পুরোনো কথা এখন কেন আসছে? আমরা কী এ নিয়ে কিছু বলেছি তোকে? নাকি এসব কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা?”
“গুরুত্বপূর্ণ তো আমি বানাইনি বাবা। বানিয়েছে তোমাদের রমেসা। কুটনি মহিলা বাহিরের লোকদের কাছে ছড়িয়েছে বিয়ে করবো না বলে নাকি আমি ন্যাড়া হয়ে গেছি। বাড়ির বাহিরের লোকদের জানানোর মতো কোনো কথা এটা?”
ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো রমেসা। সবার দৃষ্টি এবার তার উপরে। সুবর্ণা রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহ তাহলে তুই আমার মেয়ের নামে কুটনামি করিস?”
দুদিকে মাথা নাড়ায় রমেসা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, “বিশ্বাস করেন চাচীজান আমি কেউর কাছে আপার নামে কিছু কই নাই।”
ধমকে উঠলো সায়রী,”একদম মিথ্যে কথা বলবে না। জরিনার কাছে বলোনি?”
“আসলে জরিনা আর আমি এক বস্তিতেই থাকি তাই কথার ফাঁকে শুধু ওরে কইছিলাম।”
“আবার মিথ্যা? নিচের ফ্ল্যাটের রূপার মাকেও তো বলেছো। বলোনি? উনিও হেসে হেসে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন।”
ধরা পড়ে গেলো রমেসা। বসে পড়ল সুবর্ণার পায়ের কাছে। মরা কান্না জুড়ে দিয়ে বললো,”চাচীজান গো আপারে কন না আমারে যাতে মাফ কইরা দেয়। এই ভুল আমি আর জীবনেও করতাম না।”
উঠে গেলো সায়রী। যেতে যেতে বললো,”একে কাজ থেকে তাড়িয়ে নতুন কাউকে ঠিক করো মা। এমন কুটনির মুখ আমি আর দেখতে চাই না।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই দরজায় জোরে শব্দ হলো। সজোরে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে সায়রী। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তপন রেজা। ঘরে যেতে যেতে বললেন,”জীবনে আর শান্তি পেলাম না। ভাবলাম রিটায়ার্ড করে না হয় একটা ভালো সময় কাটাবো কিন্তু তা আর হলো না।এখন এসে জুটেছে সংসারের যত ক্যাচাল।”
স্বামীর যাওয়ার পানে একবার তাকান সুবর্ণা। দৃষ্টি সরিয়ে এবার রমেসার উপর রাখলেন। বললেন,”তুই তো জানিস সায়রী কেমন তাহলে এমনটা কেন করতে গেলি? এখন আর কিছু করার নেই, অন্য কোথাও গিয়ে কাজ খুঁজে নে।”
“কী কন চাচী? কত বছর ধইরা আপনেগো এনে কাম করি। আপনেগো না দেখলে থাকমু কেমনে? আমি তো অতো কিছু ভাইব্বা হেগো কই নাই।”
“সায়রীর রাগ কমলে না হয় দেখা যাবে। আজকের দিনটা কাজ করে চলে যা।”
রমেসার মুখ জুড়ে ঘনিয়ে এলো আঁধার। ড্রয়িং রুমে থমথমে পরিবেশ। যে যার যার মতো চলে গেলো। সত্যিই রমেসা খারাপ মনে কিছু বলেনি। ব্যাপারটা এতদূর পর্যন্ত গড়াবে তাও হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি। অনেক বছর হলো এ বাড়িতে কাজ করছে সে। হয়ে উঠেছে বাড়ির একজন সদস্য। চাইলেই অন্য কোথাও হয়তো কাজ জোগাড় করে নিতে পারবে কিন্তু আদৌ কী এখানকার মতো এতো আপন হয়ে উঠতে পারবে? সেদিনের মতো কাজ করে সেই আঁধারে ঘেরা মুখ নিয়েই রেজা ভিলা ছাড়লো রমেসা।
_______
বাবার কথায় স্যুট ব্যুট পরে সকাল সকাল চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছে উচ্ছ্বাস। উদাস দৃষ্টি মেলে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে নিলো। হাতের ইশারায় দাঁড় করালো একটা রিক্সা। ভাড়া ঠিক করা শেষে রিক্সায় উঠতে যাবে তখনি কোত্থেকে যেনো দৌড়ে এলো সায়রী। উচ্ছ্বাসকে ধাক্কা দিয়েই উঠে পড়ল দাঁড় করানো রিক্সায়। তার এহেন কাণ্ডে ভ্রু কুঁচকায় উচ্ছ্বাস। কিছু বলার জন্য ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করতেই সায়রী বলে ওঠে,”আরে আপনি? তা সকাল সকাল মানুষ সেজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
তার কথায় আশ্চর্য হলো উচ্ছ্বাস। মানুষ আবার মানুষ সাজে কীভাবে? এতদিন কী সে মানুষ ছিলো না? তবে কী ছিলো? প্রশ্নগুলো গলাধঃকরণ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,”তোমার নাকি বেকার ছেলে পছন্দ নয় তাই চাকরিজীবী হতে যাচ্ছি।”
“গিয়ে লাভ নেই, এমন অপদার্থকে কে চাকরি দিবে? এবারের চাকরিটাও হবে না।”
হতাশ দৃষ্টিতে সায়রীকে পর্যবেক্ষণ করল উচ্ছ্বাস। উত্তর না দিয়েই আরেকটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ল তাতে। সায়রী স্বগোতক্তি কণ্ঠে শুধালো,”আপনার বাইক কোথায়?”
“বাড়িতে।”
“কেন?”
“বাইকে করে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বাবা।”
হাসলো সায়রী। আরো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই রিক্সা চালককে তাড়া দিয়ে চলে গেলো উচ্ছ্বাস। তার যাওয়ার পানে চেয়ে মনটা খারাপ হলো সায়রীর। এমন সময় বেফাঁস কথা বলা নিশ্চয়ই তার উচিত হয়নি। বরং সায়রীর উচিত ছিলো একটু সাহস দেওয়ার। কিন্তু এটাই তো আর প্রথম নয় এর আগেও অনেক চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে উচ্ছ্বাস। একটাতেও সিলেক্ট হয়নি।প্রতিবারই কোনো না কোনো গন্ডগোল বাঁধিয়ে এসেছে। দুইবার ভাইবা দিয়েও টিকলো না। টিকলো না নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে তা অজানা সকলের। এখন প্রাইভেট কোম্পানিতে চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে আর মাথা না ঘামিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সায়রী।
সময়ের একটু আগেই নির্ধারিত অফিসে পৌঁছে গেছে উচ্ছ্বাস। গত ইন্টারভিউতে আসতে দেরি হওয়ায় ইন্টারভিউ রুমে অসংখ্য খোঁচা মারা কথা শুনতে হয়েছিল তাকে যার কারণে চুপচাপ চলে এসেছিল সেখান থেকে। যা ঠিকই সাব্বির আহমেদের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছিল কারণ কোম্পানিটায় উনারই একজন পরিচিত চাকরি করতেন উচ্চ পদে। সেই পরিচিতের সাহায্যেই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন ইন্টারভিউয়ের জন্য কিন্তু যা অঘটন ঘটার তাতো ঘটেই গেছে। সেসব কথা মনে রেখে সকাল সকালই ছেলেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য বের করে দেন সাব্বির আহমেদ।
ওয়েটিং রুমে ভাবলেশহীন বসে আছে উচ্ছ্বাস। বাকি ক্যান্ডিডেটদেরকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত সে। সকলের মধ্যে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেউ দোয়া দরুদ পড়ছে, কেউ হাতে রাখা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বইটা রিভিশন দিচ্ছে। আবার কেউ বা বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছে। তাদের মধ্যেই একটা মেয়ে ইচ্ছেমতো ঠোঁটে ঘষছে লিপস্টিক। পাশে বসা ছেলেটি ফিসফিস করে উচ্ছ্বাসের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,”ভাই নার্ভাস লাগছে না আপনার?”
ছেলেটির দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো উচ্ছ্বাস। ছেলেটির বয়স এই মুহূর্তে অনুমান করা যাচ্ছে না। চোখের নিচে গভীর ডার্ক সার্কেল। অযত্নে বেড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো দাড়ি। চুলগুলো কদম ছাঁটা। উচ্ছ্বাসের থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে চুপ করে গেলো ছেলেটি। একজন একজন করে ডাক পড়ল ভেতরে।
ছয় জনের পর এবার ভেতরে প্রবেশ করল উচ্ছ্বাস। বিশাল এক টেবিলের অপরপাশে বসে আছেন চারজন। তাদের সামনে রাখা একটি চেয়ার। চারজনের মধ্যে একজন তাকে ইশারা করল চেয়ারে বসতে। ইন্টারভিউ নিচ্ছেই তো একজন একজন করে তাহলে চারজন এসে বসে থাকার কী দরকার ছিলো? অযথা কাজে ফাঁকি দেওয়া। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আনা ফাইলের মধ্যে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্র গুলো মনোযোগ সহকারে দেখে একজন বললেন, “শিক্ষা বোর্ডের রেজাল্ট গুলো তো দেখছি খুবই ভালো। ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলেন। তা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এমন অধঃপতন হলো কেন? ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে কিনা এমন সিজিপিএ নিয়ে বের হয়েছেন?”
কথাটা লজ্জাজনক হলেও উচ্ছ্বাসের চোখেমুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। স্বাভাবিক ভাবেই বললো,”যতটা বলছেন অতটাও খারাপ নয়। এই সিজিপিএ দিয়ে বাংলাদেশে ভালো একটা চাকরি পাওয়াই যায়।”
প্রশ্নকর্তা চুপসে গেলেন। আরেকজন বললেন,”কিছু প্রশ্ন করবো তার উত্তর সঠিক ভাবে দিতে পারলে আপনাকে নিয়ে আমরা ভেবে দেখবো।”
এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা না যাওয়ায় তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করা হলো,”বলুন তো মি. উচ্ছ্বাস আনান বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের কোন খেলোয়াড় সর্বপ্রথম সেঞ্চুরি করে?”
“কেন? আপনারা জানেন না?”
থতমত খেয়ে গেলেন লোকটি। আমতা আমতা করে বললেন,”জানবো না কেন? আমরা তো আপনার ইন্টারভিউ নিচ্ছি তাই যা প্রশ্ন করা হচ্ছে তার উত্তর দিন।”
“নেক্সট কোয়েশ্চন।”—উচ্ছ্বাসের গম্ভীর কণ্ঠ।
আরেকজন প্রশ্ন করলেন,”ইউরোপ মহাদেশে কয়টা দেশ?”
“থাকি এশিয়া মহাদেশে সেখানে ইউরোপে কয়টা দেশ আমি কী করে জানবো? আপনি জেনেই বা কী করবেন?”
তেতে উঠলেন উনারা। বললেন,”যা জিজ্ঞেস করছি পারলে তার উত্তর দিন নইলে চলে যান।”
“পড়লাম ব্যবস্থাপনা নিয়ে। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এলাম ব্যবস্থাপনা বিভাগীয় পদে আর প্রশ্ন করেন সেঞ্চুরি, ইউরোপ মহাদেশ নিয়ে? শালা গাঞ্জাখোরের দল। চাকরি না করলে আমার বা*ল ছেঁ*ড়া যাবে।”
ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাগুলো বলেই ফাইলটা নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। সজোরে চেয়ারে একটা লাথি মেরে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। উপস্থিত লোক চারজন চমকিত, বিষ্মিত, হতবাক।
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)