#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০২]
“টুম্পা সোনা চুম্মা খাবা?”
কথাটা বলা শেষ করেই সঙ্গে সঙ্গে নিজ জিভে কামড় বসালো উচ্ছ্বাস। ছাদের অপরপাশে দাঁড়ানো ভাড়াটের মেয়ে টুম্পা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার পানে। মেয়েটির চাহনি দেখে অপ্রস্তত হয় উচ্ছ্বাস। দাঁত কপাটি বের করে হাসে। হাতে থাকা চানাচুরের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”বলতে চেয়েছিলাম টুম্পা সোনা চানাচুর খাবা? কিন্তু মুখ ফসকে চুম্মা বের হয়ে গেছে। ডোন্ট মাইন্ড মাই টুম্পা সুন্দরী।”
টুম্পা এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসের পাশ ঘেঁষে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালো। বাড়িয়ে দিলো হাত। তার হাত বাড়ানো দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয় উচ্ছ্বাস। তার কুঁচকে যাওয়া ভ্রু দেখে মৃদু হাসলো টুম্পা। বললো,”এখন না জিজ্ঞেস করলে চানাচুর খাবো কিনা? কই দাও।”
বিপরীতে মেকি হাসে উচ্ছ্বাস। এগিয়ে দেয় প্যাকেট। মুঠো ভর্তি চানাচুর নিয়ে বিশাল একটা হা করে তা মুখে পুরে নেয় টুম্পা। হৃদয় খানা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় উচ্ছ্বাসের। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আহা আমার প্রিয় চানাচুর! কয়েক মিনিট পার হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিনম্র কণ্ঠে বলে ওঠে,”আমায় একটা উপকার করবে টুম্পা সুন্দরী?”
আগ্ৰহ ভরা লোচনে ঘাড় উঁচিয়ে তাকায় টুম্পা। শুধায়,”কী কাজ উচ্ছ্বাস ভাই?”
“শুনেছি তোমার হাতের লেখা নাকি তোমার মতোই খুব সুন্দর। লেখাপড়ায় নাকি তোমার মস্তিষ্ক বড্ড ভালো।”
প্রশংসায় লজ্জা রাঙা হয়ে উঠলো টুম্পার মুখখানা। নুইয়ে নিলো মাথা। তার মুখখানা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো উচ্ছ্বাসের মন। হেরফের না করে আসল কথাটা বলেই বসলো,”তিনটে এসাইনমেন্ট করে দিবে গো সুন্দরীইইই? দাও না করে। সামনের সপ্তাহে যে জমা দিতে হবে।”
পুনরায় চোখ তুলে তাকালো টুম্পা। চোখ জোড়ায় বিষ্ময়।শুধালো,”এসাইনমেন্ট? কীসের এসাইনমেন্ট? তোমার তো লেখাপড়ার পাট সেই কবেই চুকে গেছে উচ্ছ্বাস ভাই।”
“আমার না গো টুম্পা সুন্দরী, অন্য কারোর। করে দিবে?”
“এ সম্ভব নয়। দুদিন পর আমার ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা। দিনকাল খুব ব্যস্ততায় কাটছে।”
“কই পলাশের সঙ্গে যে ফুচকা খেতে যাও তখন তো কোনো ব্যস্ততা থাকে না?”
বিষ্মিত দৃষ্টিতে এবার যোগ হয় ভয়। শীতের মধ্যেই কপালে যে ঘাম জমছে তা উপলব্ধি করে টুম্পা। তার এমন হাবভাব দেখে মেকি হাসে উচ্ছ্বাস। অভিমানী কণ্ঠে বলে,”বয়ফ্রেন্ডকে দেওয়ার মতো সময় আছে অথচ আমার এসাইনমেন্ট করে দেওয়ার মতো সময় নেই? আচ্ছা সমস্যা নেই তুমি তোমার ওই বলদা বয়ফ্রেন্ডকে নিয়েই ব্যস্ত থাকো। আমি চললাম। সুন্দরী রমণীর কী অভাব পড়েছে দেশে?”
“আমাকে ভুল বুঝছো উচ্ছ্বাস ভাই, পলাশ আমার বান্ধবীর ভাই, আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছিলাম তখনি পথে দেখা হলো উনার সঙ্গে।”
“উনি! তা কত দেখলাম। প্রথমে বান্ধবীর ভাই বলে পরিচয় দেয় তারপর দেখি সেই বান্ধবীর ভাই জামাই হয়ে যায়।বড্ড আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম কিন্তু সেই আশা তুমি রড দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিলে। যাই আমি, তুমি বরং নতুন মানুষকে নিয়েই ভালো থেকো।”
দুঃখী দুঃখী মুখ করে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা বাড়ায় উচ্ছ্বাস। তৎক্ষণাৎ পিছু ডাকে টুম্পা। গোমড়া মুখে বলে ওঠে,”সমস্যা নেই উচ্ছ্বাস ভাই। দিয়ে যান আপনার এসাইনমেন্ট আমি এই সপ্তাহেই করে দিবো।”
“দিবে বলছো?”
“হুম।”
“তোমার চেহারার মতো তোমার মনটাও অনেক সুন্দর টুম্পা। এই জন্যই তোমায় আমার এতোটা ভালো লাগে।”
“সত্যিই ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অনেক।”
বেজায় খুশি হলো টুম্পা। গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। দম ছাড়লো উচ্ছ্বাস। খোলা অন্তরীক্ষে চেয়ে বিড়বিড় করল,”এই মিথ্যে প্রশংসায় সব মেয়ে পটে যায় এমনকি আমার হবু শাশুড়িও পটে গেছে শুধু তুমিই পটলে না ন্যাড়া সায়রী।”
সন্ধ্যায় স্ত্রী ইকরাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে সায়ান। কোনোমতে বাহিরের পোশাক ছেড়ে হাতমুখ ধুয়েই ননদের ঘরে পা বাড়ালো ইকরা। মাগরিবের নামাজ শেষে সবে বইটা নিয়ে বসেছে সায়রী। ভাবীকে দেখতেই চোখেমুখে ফোটে উঠলো আনন্দ। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,”তোমাদের না সপ্তাহ খানেক থাকার কথা ছিলো? তাহলে এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?”
“ভালো লাগছিল না।”
হাসিটা চওড়া হলো সায়রীর। ইকরা সঙ্গে আনা ব্যাগটা খুলতে খুলতে বললো,”দেখো তোমার জন্য মা কী কী পাঠিয়েছে।”
কথাটা শেষ করেই বেশ কয়েকটা টিফিন বক্স বের করল ইকরা। একটা একটা করে বক্স খুলতেই চোখ জোড়া চিকচিক করে ওঠে সায়রীর। নারকেল দিয়ে ময়দার ক্ষীর, তালের পিঠা, লাল লাল করে হাঁস ভুনা, গরুর কালা ভুনা। সায়রী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,”আন্টির হাতের কালা ভুনাটা যে কী মজা লাগে গো ভাবী! এই কালা ভুনা খেলে যে কেউই বুঝে যাবে আন্টি যে খুলনার মানুষ।”
প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো ইকরা। জিজ্ঞেস করল, “এখনি খাবার বাড়বো?”
“তোমাকে বাড়তে হবে না। এতটা পথ এসেছো যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও। এগুলো আমি গুছিয়ে রাখছি। আপাতত ক্ষীর আর তালের পিঠাটা খাচ্ছি। মেইন কোর্সে না হয় রাতে সবাই একসঙ্গে প্রবেশ করবো।”
ননদের কথায় সায় দিলো ইকরা। সত্যিই একটু বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন তার।
____
“বউয়ের শাসনে বিসিএস ক্যাডার হলেন মুদি দোকানির ছেলে কাশেম। এক বাচ্চার বাপ কুদ্দুস দ্বিতীয় বার বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অল্প বয়সে বিয়ে করে পেয়েছেন সফলতা। চা বিক্রেতা মুদি বিয়ের পরই প্রধানমন্ত্রী পদ লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর _”
এতটুকু পড়েই থেমে যেতে বাধ্য হয় উচ্ছ্বাস। সামনে রাগান্বিত দৃষ্টি মেলে পুত্রের পানে তাকিয়ে আছেন সাব্বির আহমেদ। সোফায় এসে বসেছেন মা নেহার বেগম। উচ্ছ্বাসের মুখশ্রীতে লেপ্টে আছে গাম্ভীর্যতা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”এই জন্যই তো বলি আমার জীবনটা এতো অসফলতায় ভরা কেন? বিয়ে! হ্যাঁ বিয়ে। এই বিয়ে না করার কারণেই আজ আমার সিজিপিএ এতো লো, চাকরিও হচ্ছে না।”
“উচ্ছ্বাস!”–হুঙ্কার ছাড়লেন সাব্বির আহমেদ।
আচমকা পিতার এহেন হুঙ্কারে একটুও ঘাবড়ালো না উচ্ছ্বাস। কণ্ঠে পূর্বের ন্যায় গম্ভীরতা এঁটেই বললো, “ঘটককে খবর দিয়ে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। মেয়ে আমার আগে থেকেই পছন্দ আছে। তুমি বরং মাকে নিয়ে কাল ওদের বাড়ি গিয়ে বিয়েটা একেবারে পাকা করে এসো।”
বলেই থামলো। গলা ঝেড়ে পুনরায় বললো,”আবার ভেবো না আমি বিয়ে পাগলা হয়ে গেছি। আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে সফলতা, সফলতা পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি। দরকার হলে সারাদিন ঘুমিয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিতেও পারি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে ঘুম নয় বরং প্রকৃত সফলতা আসবে বিয়ের মাধ্যমে।”
সাব্বির আহমেদ নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তেজী কণ্ঠে বিদ্রুপ করে বললেন,”তা বউকে খাওয়াবে কী? পরাবে কী? নিজেই তো এখনো বাপের হোটেলে বসে তিন বেলা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছো।”
“এটাকে হোটেল বলে নাকি? খাওয়ার পর একটু কোক পাওয়া যায় না সিগারেট পাওয়া যায় না।”
কথাটা বলেই বোকা হাসলো উচ্ছ্বাস। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। ছেলের অধঃপতন দেখে হতবাক হয়ে গেলেন সাব্বির আহমেদ। কথাটা ঘুরিয়ে উচ্ছ্বাস বলে উঠলো,”কাশেমের বাপ যদি মুদি দোকানি হয়ে বেকার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বিসিএস ক্যাডার বানাতে পারে তাহলে তুমি কেন পারবে না? ঘুষের টাকা দিয়ে এই যে এতো বড়ো একটা বাড়ি বানিয়েছো, জমি কিনেছো, মাস শেষে তো কম টাকা পাও না। আমার নাতি নাতনি পর্যন্ত পায়ের উপর পা তুলে খেয়ে যেতে পারবে।”
তেতে উঠলেন সাব্বির আহমেদ। এবার আর রাগটাকে দমন করা যেনো কিছুতেই সম্ভবপর নয়। সারাজীবন ঘুষ থেকে তিনি দশ হাত দূরে থেকে এসেছেন অথচ আজ কিনা ছেলে এসব উল্টো পাল্টা অপবাদ মাথায় দিচ্ছে? ঝাঁঝালো কণ্ঠে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,”এই অসভ্য ছেলেকে এখনি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলো নইলে আমি কিন্তু সোফা তুলে ওর মাথায় মারবো।”
“একটা চেয়ার তুলতেই হাত কাঁপে আবার উনি নাকি তুলবেন সোফা? হুদাই ফাপর।”—ঠাট্টা করেই কথাটা বলে উচ্ছ্বাস।
রাগে কাঁপছেন সাব্বির আহমেদ। দ্রুত গিয়ে সোফার পাশের ফুলদানিটা তুলে নিলেন হাতে। এগিয়ে আসতে লাগলেন পুত্রের নিকটে। ঠাট্টাশ্লেষ দৃষ্টিতে মুহূর্তেই জমা হলো ভয়। তার মানে বাবা এতক্ষণ সিরিয়াস ছিলো? নেহার বেগম চিৎকার করে বললেন,”পালা উচ্ছ্বাস।”
মায়ের চিৎকার করতে দেরি কিন্তু উচ্ছ্বাসের পালাতে দেরি হলো না। একদৌড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। নেহার বেগম তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বামীর রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন সাব্বির আহমেদ। ভারি কণ্ঠে বললেন,”তোমার ছেলে বখে গেছে নেহা। ফাজিল ছেলে, অসভ্য ছেলে। ওকে আমার সামনে পেলেই মাথা ফাটিয়ে ফেলবো।”
থামলেন সাব্বির আহমেদ। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে দ্রুত পদে নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নিয়ে বললেন,”মাথা ফাটালে তো সেই আমার টাকাগুলোই অপচয় হবে। থাক মাথা ফাটানোর সিদ্ধান্ত বাদ। আগামী চার দিন ওর খাওয়া বন্ধ।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটছে উচ্ছ্বাস। হাতে ধরানো জলন্ত সিগারেট। খানিক বাদে বাদে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। জ্যাকেটটা সঙ্গে আনতে ভুলে গেছে যারপনায় প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল রাতের খাবারটা খাওয়া হয়নি। তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে মোবাইল বের করে মায়ের নাম্বারে কল লাগালো। রিসিভ হতেই বললো,”ও মা গোওওও ক্ষুধা লেগেছে।”
বিরক্ত হলেন নেহার। ঝাঁঝ নিয়েই বললেন,”উল্টা পাল্টা বলার সময় খেয়াল ছিলো না? বাহিরে খেয়ে নে। রাতটাও বন্ধুর বাড়িতে ম্যানেজ করে নে। আপাতত বাপের সামনে আসিস না অনেক রেগে আছে তোর উপর।”
“শোনো।”
“বল।”
“পাঙ্গাশ মাছের ডিম, ফুলুরি যে ভেজে রেখেছিলে না? ওগুলো ফ্রিজে রেখে দিও। যেদিন আসবো সেদিন না হয় খেয়ে নিবো।”
“বাবার সাথে তাল মিলিয়ে না পাঙ্গাশ দেখলে নাক ছিটকাস?”
“পাঙ্গাশ ভালো লাগে না কিন্তু ওইগুলা খুব টেস্টি।”
নিঃশব্দে হাসলেন নেহার। বললেন,”সমস্যা নেই। আবার না হয় পাঙ্গাশ আনিয়ে নতুন করে তোকে বেজে খাওয়াবো ফুলুরি আর ডিম।”
“আচ্ছা।”
“সঙ্গে টাকা আছে? যেই দৌড় দিলি মনে তো হয় না টাকা পয়সা আছে সঙ্গে।”
“পকেট হাতড়ে ত্রিশ টাকা পেয়েছিলাম তারমধ্যে এখন মাত্র দশ টাকা অবশিষ্ট আছে।”
“আচ্ছা, তোর বাবার বিকাশ থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“মাদার বাংলাদেশী অ্যাওয়ার্ডটা তোমাকেই দেওয়া উচিত মা। বাবার কপাল দেখে মাঝেমধ্যে আমি খুব অবাক হই। কতটা ভাগ্য করে তোমায় পেয়েছে বলো তো? সত্যি বলতে তুমি আরো ভালো একটা জামাই ডিজার্ভ করো মা। নানার জায়গায় আমি হলে বাবার হাতে কিছুতেই তোমায় তুলে দিতাম না।”
“এই জন্যই তুই আমার বাপের জায়গায় ছিলি না। শয়তান বাবার নামে কিসব বলে? তোর বাবা শুনলে এতক্ষণে তোর গর্দান কেটে নিতো।”
শব্দ করে নিঃশ্বাস টেনে নিলো উচ্ছ্বাস। কল কেটে আবারো মোবাইলটা পকেটে ভরে হাঁটতে লাগলো। কিছু মিনিট অতিক্রম হতেই মোবাইলে টুংটাং শব্দ হলো। মোবাইল চেক করতেই ঠোঁটের কার্নিশে ফোটে উঠলো হাসি। মা টাকা পাঠিয়েছে।
শহুরে এলাকায় অলি গলি পার হলেই চোখে পড়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ। তার মধ্য থেকে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ল উচ্ছ্বাস। পেট ভরে খেয়ে বিল দিয়ে বেরিয়ে এলো। খাওয়ার আগে একটা এবং খাওয়ার পরে আরেকটা সিগারেট না খেলে তার আবার চলে না। সিগারেট ফুঁকা শেষ হতেই মোবাইল হাতে নিয়ে বন্ধুকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো আজ রাতটা তাদের বাড়িতেই থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে ফেসবুক একাউন্ট লগ ইন করতেই চোখ দুটো কপালে ওঠার উপক্রম। সেই নয় মাস আগে সায়রীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল উচ্ছ্বাস যা আজ এক্সেপ্ট হয়েছে। একেবারে বাচ্চা পয়দা করার মতো অবস্থা।
ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো। সায়রী ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। আগ্ৰহ নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করতেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো উচ্ছ্বাস। ম্যাসেজে লেখা,”কী করছেন? এসাইনমেন্ট লেখা কতদূর? কয়টা পৃষ্ঠা লিখেছেন?”
সায়রী কেন যে রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে তা এবার পুরোপুরি ভাবে উচ্ছ্বাসের কাছে সুস্পষ্ট। উচ্ছ্বাস চটপট রিপ্লাই দিলো,”এসাইনমেন্ট? ওহ মনে পড়েছে। এখনো ব্যাগ থেকে বের করা হয়নি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি আর গাইছি, ও সায়রী গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে? আমি অহন ঘোরাঘুরি করি ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে।”
সাথে যুক্ত করল একটা স্যাড ইমোজি। সঙ্গে সঙ্গে সিন হলো ম্যাসেজ। মনে হচ্ছে এতক্ষণ যেনো রিপ্লাইয়ের আশায় অপরপাশে বসে অপেক্ষা করছিল সায়রী। এবার সরাসরি কল এলো। রিসিভ করল না উচ্ছ্বাস। ম্যাসেজ এলো,”না ধরলে ভিডিও ভাইরাল করে দিবো।”
তমিস্রায় নিমজ্জিত অম্বরে চোখ তুলে সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস। আবারো কল আসে। রিসিভ করে কানে ধরে। ব্লুটুথটা সঙ্গে আনা হয়নি। ব্লুটুথ ছাড়া ম্যাসেঞ্জার কলে কী আর ঠিকমতো কথা বলা যায়? অপরপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠের ঝাঁঝালো বাক্য,”গতকাল বিকেলে আপনাকে এসাইনমেন্টের খাতা দিলাম আর আপনি কিনা এখনো খুলে দেখেননি? সামনের সপ্তাহেই কিন্তু আমার এসাইনমেন্ট চাই।”
“এসাইনমেন্ট না করলে কী হবে?”
“কী হবে মানে? আমার মার্ক কমবে, মার্ক কমলে মেইন পরীক্ষাতেই তো সমস্যা হবে।”
“সমস্যা হলে আর কী হবে? তোমার বাবা বিয়ে দিয়ে দিবে। চিন্তা নেই আমি তো আছিই। তোমায় বউ বানিয়ে ঘরে তুলবো ন্যাড়া সায়রী।”
“সেই আশায় বসে বসে বুইড়া হন, বেকার ছেলের কাছে আমার বাবা মেয়ে বিয়ে দিবে না।”
“সারাজীবন কী আর বেকার থাকবো নাকি? বউয়ের রূপের আগুনে ঠিক বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাবো। তাছাড়া তুমি তো এখন ন্যাড়া। শুনেছি ন্যাড়া মাথা অনেক উজ্জ্বল থাকে।”
“আর একবার ন্যাড়া ন্যাড়া করলে ব্লক মারবো।”
চুপসে গেলো উচ্ছ্বাস। সায়রী গম্ভীর কণ্ঠে আদেশের সুরে বললো,”দ্রুত বাসায় গিয়ে লেখা শুরু করুন। অনেক লেখা, পাঁচদিনে কুলাতে পারবেন না।”
“বাসায় যাওয়া যাবে না।”
“কেন?”
“বাবা বের করে দিয়েছে বাসা থেকে আর বলে দিয়েছে আগামী চারদিন যাতে বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখে।”
“কী করেছিলেন যে বের করে দিলো?”
“কিছুই করিনি।”
সায়রীর মাথায় হাত। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। নিজেই নিজের মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কেন এই ইতর প্রাণীটিকে এসাইনমেন্ট করতে দিয়েছিল সে? এখন তাহলে কী হবে? ভাবতেই কান্না পেলো সায়রীর। অপরপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করছে উচ্ছ্বাস। আচমকাই কেটে গেলো কল। এসবে আর মাথা না ঘামিয়ে বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো উচ্ছ্বাস। বাড়ি বেশি দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়।
সিলিংয়ের পানে হতাশ দৃষ্টি মেলে এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে সায়রী। এই শীতের মধ্যেই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় ঘেমেনেয়ে অবস্থা তার করুণ।কী হবে এবার?
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)