উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত সায়রী পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

1
1089

#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
#উপসংহার

বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে আছে সায়রী। ঘুমের ঘোরে কখন যে ওড়নাটা মাথা থেকে সরে গেছে সেসবে তার খেয়াল নেই। গভীর ঘুমে বিভোর সে। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে থুতনিটা নিজ হাতে ঠেকিয়ে এক ধ্যানে বসে আছে উচ্ছ্বাস। গাঢ় দৃষ্টিটা স্থির করে রেখেছে স্ত্রীর মুখশ্রীতে। সিল্কি চুলে কপাল ঢেকে আছে সায়রীর। চুলগুলোর সঙ্গে তৈলাক্ত মুখটা দারুন মানিয়েছে। স্ত্রীর এমন রূপ দেখে মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস।বিড়বিড় করে বললো,”আহা আমার বউটা কত সুন্দর!”

এতক্ষণে অসংখ্য চুমুতে স্ত্রীর মুখশ্রী ভরিয়ে দিয়েছে উচ্ছ্বাস। এবার হাত রাখলো সায়রীর মাথায়। চুলের ভাঁজে আঙুল চালাতে লাগলো যত্ন সহকারে। একটু নড়েচড়ে উঠলো সায়রী তারপর আবারো মগ্ন হলো গভীর ঘুমে। চুলে বিলি কাটায় তার ঘুমটা যেনো ধীরে ধীরে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পার হতেই টনক নড়ল সায়রীর। মস্তিষ্ক জানান দিলো কেউ তাকে দেখছে। গভীর দৃষ্টিতে দেখছে। সজাগ হতেই উপলব্ধি করল চুলের গহীনে কারো হাতের স্পর্শ। পিটপিট করে সামনে তাকালো। উচ্ছ্বাসকে দেখতেই চমকে উঠলো সে। তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসলো।

সায়রীকে উঠতে দেখে চরম ক্ষীপ্ত হলো উচ্ছ্বাস। রূষ্ট কণ্ঠে বললো,”ঘুমন্ত অবস্থাতেই তো তোমাকে ভালো লাগছিল তাহলে অযথা জাগলে কেন? জাগার আগে কী আমার পারমিশন নিয়েছো?”

ছেলেটার কিছু কিছু কথা শুনলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় সায়রীর। মাঝেমধ্যে মনে হয় ছেলেটার জন্মই হয়েছে কেবল তাকে জ্বালানোর জন্য। কড়া কিছু বলার উদ্দেশ্যে ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করতেই সায়রীর দৃষ্টি গেলো বিছানার একপাশে গড়াগড়ি খাওয়া নিজের ওড়নার পানে। আতঙ্কে সংকিত হলো তার মুখশ্রী। আপনাআপনি হাত চলে গেলো নিজ মাথায়। আর বিলম্ব না করে ওড়নায় টান বসালো কিন্তু আয়ত্তে আনতে পারলো না। সায়রীর হাবভাব বুঝতে পেরেই ওড়নার অর্ধেকটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে উচ্ছ্বাস। মৃদু হেসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,”ঘরে থাকাকালীন মাথায় একদম ওড়না দিবে না। এভাবেই তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে বউ। মাশাআল্লাহ!”

লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে চুপসে গেলো সায়রী। মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস। সায়রীর সামনে শরীরের ভারসাম্য ফেলে বসে পড়ল বিছানায়। নেশাতুর কণ্ঠে বলে উঠলো,”এতো কিউট কেন তুমি? জানো আমি না খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“কী?”

“তোমার চুলগুলো আর বড়ো হতে দিবো না। চুল কাটার জন্য সেলুনের সিরিয়ালে বসে থাকতে থাকতে আমিও চুল কাটতে শিখে গেছি। এবার থেকে সুন্দর করে আমি তোমার চুল কেটে দিবো।”

লজ্জা এবার পরিণত হলো রাগে। গর্জে উঠলো সায়রী। শুধালো,”সমস্যা কী আপনার? সবসময় আমায় অপমান করে কথা বলেন কেন?”

“অপমান কোথায় করলাম? সত্যিই তোমায় ভীষণ সুন্দর লাগছে। বেবি বেবি হেয়ারে বড়ো বড়ো মেয়েদের যে এতো কিউট লাগে তোমাকে দেখার আগে তো জানতামই না।”

রাগ গলে গিয়ে আবারো তাতে জড়ো হলো লজ্জা। যা উচ্ছ্বাস খুব ভালো করেই উপভোগ করছে।মেয়েটা এই রেগে যাচ্ছে তো এই আবার লজ্জায় নত করছে মাথা। উচ্ছ্বাসকে নিজের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নেয় সায়রী। শুধায়,”কী দেখছেন?”

“তোমাকে।”

“আশ্চর্য! এতো দেখার কী আছে?”

“তোমার মাথায় কী কোনো সমস্যা আছে? না মানে এই রেগে যাও তো এই আবার লজ্জায় লাল হয়ে যাও। এতো তাড়াতাড়ি তো গিরগিটিও রূপ বদলাতে পারে না সায়রী সুন্দরী।”

কথা বললেই কথা বাড়বে তাই আর একটা শব্দও প্রয়োগ করল না সায়রী। সকাল সকাল মুড খারাপ করার ইচ্ছে নেই। একটানে উচ্ছ্বাসের হাত থেকে ওড়নাটা নিয়ে মাথায় ভালো করে মুড়ি দিলো। বিছানা থেকে উঠে চলে গেলো বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই পূর্বের ন্যায় এখনো উচ্ছ্বাসকে বসে থাকতে দেখলো বিছানায়। বিরক্ত হলো সায়রী। নিরবে সোজা চলে গেলো বারান্দায়। এই মুহূর্তে কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সায়রী। আজ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সে একটাও বাক্য বিনিময় করবে না।

বারান্দায় আসতেই বিষ্ময়ে চক্ষু চড়কগাছ সায়রীর। বারান্দার গ্ৰিলে একটা খাঁচা ঝুলছে যার ভিতরে অপরূপ সুন্দর একটি পাখি। যে সে পাখি নয় বরং ময়না পাখি। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে সায়রী চেঁচিয়ে বলে উঠলো,”উচ্ছ্বাস দেখে যান এখানে একটা ময়না পাখি!”

সায়রীর চিৎকারে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো উচ্ছ্বাস। কুঞ্চিত হলো তার ভ্রু দ্বয়। শুধালো,”কী হয়েছে? চিৎকার করলে কেন?”

“ময়না পাখি! এখানে ময়না পাখি কোত্থেকে এলো উচ্ছ্বাস?”

সায়রীর দৃষ্টি লক্ষ্য করে খাঁচার পানে তাকায় উচ্ছ্বাস। গম্ভীর মুখখানায় ফোটে ওঠে এক চিলতে হাসি। দুয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে চিকন কণ্ঠে বলে,”সায়রী সুন্দরী।”

তৎক্ষণাৎ ময়না পাখি কথা বলে উঠলো। একনাগাড়ে বলতে লাগলো,”সায়রী সুন্দরী। সায়রী সুন্দরী।”

পূর্বের থেকেও বেশি আশ্চর্য হলো সায়রী। শুধালো, “ও কথা বলতে পারে?”

“পারবে না কেন? ময়না পাখি যে কথা বলতে পারে জানতে না তুমি?”

খানিকটা লজ্জা পেলো সায়রী। আচমকা পাখিটির সম্মুখীন হওয়ায় কিছু না ভেবেই ভুলবশত প্রশ্নটা করে ফেলেছে বেচারী। মিনমিনে স্বরে বললো, “জানতাম তো। এটা কার পাখি? কোত্থেকে এলো?”

“তোমার পাখি।”—উচ্ছ্বাসের সোজাসাপ্টা জবাব।

“আমার পাখি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস। বলে,”হুম। সাড়ে চার বছর ধরে এটাকে আমি খাইয়ে পড়িয়ে লালন পালন করছি। এবার তুমি এসে গেছো তাই তোমার পাখি তুমি কী করবে বুঝে নাও।”

“আমার পাখি! তাহলে এতদিন কেন চোখে পড়ল না?”

“এক্সিডেন্টের পর মা খাঁচা নিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় রেখে দিয়েছিল তারপর আর এ ঘরে আনা হয়নি তাই দেখোনি। বিয়ের সময় আবার বাড়িতে মানুষের পদচারণ বেড়েছিল তাই তখন টুম্পার কাছে রাখতে দিয়েছিলাম। আজ সকালেই গিয়ে নিয়ে এসেছি।”

“ওহ তাহলে সাড়ে চার বছর ধরে আপনার কাছে মানে? এই কথাটা তো বুঝলাম না।”

“মনে আছে একবার বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় গিয়েছিলাম? ফেরার পথে তোমার জন্য উপহারও তো এনেছিলাম। তার মধ্যে এই ময়না পাখিটাও ছিলো একটা উপহার। মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক বন্ধুর সঙ্গে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। সে আবার তার ভাইয়ের ছেলের জন্য খরগোশ ছানা কিনতে গিয়েছিল সেখানে। তখনি আমার চোখে পড়ে পাখিটা। সঙ্গে সঙ্গে ভালোও লেগে যায় তাই তোমার জন্য কিনে এনেছিলাম কিন্তু তুমি তো তখন আর নিতেই এলে না।”

এই মুহূর্তে কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত বুঝতে পারলো না সায়রী।তবে উচ্ছ্বাসের উপর থেকে সকল রাগ অভিমান তার এক নিমিষেই যেনো অদৃশ্য হয়ে গেলো। স্বামীর হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,”এত্ত সুন্দর একটা উপহার এনেছিলেন আমার জন্য! আগে যদি জানতাম তাহলে কখনোই এমনটা করতাম না। উপহারটা নিয়ে যাওয়ার জন্য হলেও ঠিক আসতাম। জানেন এই মুহূর্তে না আমার খুব আফসোস হচ্ছে। তবে এতো সুন্দর উপহারের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ উচ্ছ্বাস।”

প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস। তাকে ছেড়ে এবার খাঁচায় বন্দি পাখিটির পানে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে রইলো সায়রী। শুধালো,”ও কী সারাক্ষণ খাঁচায় বন্দি থাকে?”

“না তো। ওকে অলরেডি পোষ মানানো হয়ে গেছে। বেশিরভাগ সময় খাঁচার বাহিরেই থাকে কিন্তু বিয়ে উপলক্ষে বন্দি করে রেখেছিলাম।”

“খুলে দেই?”

“তোমার ইচ্ছে, তবে ও কিন্তু খুব জ্বালাতন করে।”

সঙ্গে সঙ্গে খাঁচা থেকে পাখিটিকে মুক্ত করল সায়রী। মুক্তি পেয়ে কিছুক্ষণ উড়ে বেড়ালো পাখিটি তারপর উড়ে এসে বসে পড়ল উচ্ছ্বাসের কাঁধে। একনাগাড়ে বলতে লাগলো,”ইতর উচ্ছ্বাস! বদমাইশ উচ্ছ্বাস!”

পাখির মুখ থেকে এমন কথা শুনতেই চমকে গেলো সায়রী। সঙ্গে সঙ্গে দম ফাটা হাসিতে ফেটে পড়ল। চোখমুখ কুঁচকে নিলো উচ্ছ্বাস। রাগান্বিত কণ্ঠে পাখিটিকে ধমক দিলো,”চুপ থাক ময়না।”

হাসতে হাসতেই সায়রী প্রশ্ন করল,”একটা পাখিও এতদিনে আপনার আসল নাম, চরিত্র সম্পর্কে জেনে গেছে?সত্যি করে বলুন তো কী করেছেন ওর সঙ্গে?”

“পাখির সঙ্গে আবার কী করবো? সব দোষ হচ্ছে বাবার। বাবা-ই ওকে এসব আজেবাজে কথা শিখিয়েছে।”

“একদম ঠিক শিক্ষাই দিয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি আমার বাকি দুটো উপহার দিয়ে দিন।”

“বাকি উপহার?”

“হু, আপনি আমার জন্য তিনটে উপহার এনেছিলেন তারমধ্যে একটা পেয়ে গেছি এবার বাকি দুটো দিন।”

কাঁধ থেকে পাখিটিকে সরিয়ে খাঁচায় বন্দি করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো উচ্ছ্বাস। বললো,”বাকি দুটো নেই। নেহাৎ এটা জীবন্ত উপহার তাই এতো বছর বাদেও পেয়েছো।”

তার পিছুপিছু সায়রীও ঘরের দিকে যাওয়া ধরলো।বাচ্চাদের মতো বায়না করে বললো,”আমি কিচ্ছু জানি না উচ্ছ্বাস। আমার উপহার আমায় ফেরত দিন বলছি।”

“বললাম তো সেগুলো নেই।”

“কেন থাকবে না? কাকে দিয়েছেন সেগুলো? ওই মেয়েটাকে?”

পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে প্রশ্ন করল,”কোন মেয়ে?”

“ওই যে সেই মেয়েটা যাকে নিজের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।”

“এখনো সে কথা মনে আছে তোমার?”

“কথাটা কী ভুলে যাওয়ার মতো? আপনি এ কথাটা বলেই আমার কিশোরী মন টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়েছিলেন। পইপই করে আমি সবকিছুর হিসেব রেখে দিয়েছি। এখন আমার উপহার আমার ফেরত চাই। দরকার হলে সেই প্রেমিকার কাছ থেকে নিয়ে এসে দিন। উপহার না পেলে এই ঘরে আপনার কোনো জায়গা হবে না।”

“আমার ঘর থেকে আমায় তাড়িয়ে দিবে?”

“এখানে আপনার আর কোনো ঘরটর নেই।”

“কবে থেকে?”

“বিয়ের পর থেকে।”

“ওহ, বাড়ি বাবার এখন আবার ঘর বাবার বউমার? বাহ্! আমার তো দেখছি আর কিছুই রইলো না।”

“প্রেমিকার থেকে উপহার এনে দিন তাহলে ঘরও আপনার থাকবে সাথে বউও থাকবে।”

“কে প্রেমিকা? কীসের প্রেমিকা?”

“যাকে গার্লফ্রেন্ড বলেছিলেন তাকে। জীবনে কতগুলো প্রেম করেছিলেন বলুন তো? সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে যান।”

“গার্ল অর্থ কী?”

হঠাৎ এহেন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সায়রী। শাণিত কণ্ঠে উত্তর দেয়,”মেয়ে কিন্তু কেন?”

“ফ্রেন্ড অর্থ কী?”

“বন্ধু।”

“তাহলে গার্লফ্রেন্ড অর্থ কী?”

“মেয়ে বন্ধু।”

“তো তুমি তাকে প্রেমিকা বানাচ্ছো কেন?”

“সে আপনার প্রেমিকা নয় বলছেন?”

“বলবো কেন? আলবাদ সে আমার প্রেমিকা নয়। মানুষের কী বন্ধু থাকে না? সেও আমার বন্ধু, একই কলেজে পড়েছি দুজনে। পাশের সেক্টরেই পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতো ওরা। কী একটা কাজে যেনো এদিকে এসেছিল কিন্তু পথে দেখা হওয়ায় সে নিজ থেকেই কথা বলতে আসে। ওর বিয়েও হয়ে গেছে দুই বছর আগে। বিয়েতে আমায় দাওয়াতও দিয়েছিল। তবে ইচ্ছে করেই সেদিন তোমার সঙ্গে একটু মজা করেছিলাম। তুমি যে সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে নিবে কে জানতো? আহা কি বোকাই না ছিলে তুমি।”

ভেতরে ফুলে ফেঁপে ওঠা রোষানল নিভে গেলো সায়রীর। ইচ্ছে করল নিজের দুই গালে ঠাস ঠাস করে পরপর দুটো চড় মেরে বসতে। সত্যিই সে আস্ত একটা বোকা নইলে অযথাই কীসব আবোল তাবোল ভেবেচিন্তে কেউ কী এতদিন ধরে এমন বোকামি করে? উচ্ছ্বাস এতক্ষণে বিছানায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসেছে। মুখ ফুলিয়ে সায়রীও তার পাশাপাশি বসে পড়ল। কিছুক্ষণ কাটলো পিনপতন নিরবতায়। স্ত্রীর ফুলো ফুলো গাল দুটোকে টেনে দিতে ইচ্ছে করল উচ্ছ্বাসের কিন্তু তৎক্ষণাৎ দমিয়ে রাখলো সেই ইচ্ছে। এতে মেয়েটা আরো রেগে যেতে পারে। বাবা বাড়িতে আছে। পুত্রবধূর চেঁচামেচি শুনলে দেখা যাবে ছেলেকেই না আবার বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

কিছুক্ষণ সায়রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। ছোটো ছোটো কদম ফেলে চলে গেলো আলমারির কাছে। অতি গোপনীয় একটি ড্রয়ার থেকে বের করল মাঝারি আকারের একটি বক্স। বক্স হাতে এগিয়ে এসে বসলো পূর্বের স্থানে।

উদাস দৃষ্টি মেলে উচ্ছ্বাসের কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে সায়রী। বক্সটা খুলতেই রঙ বেরঙের কয়েক ডজন রেশমী চুড়ির দেখা মিললো। উচ্ছ্বাস ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,”মেলা মানেই বাচ্চাদের খেলনা, মেয়েদের সাজসজ্জার জিনিসপত্র এবং মুখরোচক খাবার দাবারের দোকান। মেলায় ঢুকতেই পাশাপাশি সারি বেঁধে কয়েকটা চুড়ির দোকান চোখে পড়ে। বিভিন্ন বয়সী নারীদের কী ভিড় সেখানে!আমার বন্ধু আবার সেই ভিড়ের মধ্যেই তার নিব্বি গার্লফ্রেন্ডের জন্য চুড়ি কিনতে ঢুকে পড়েছিল। তার পিছুপিছু আমরা বাকিরাও দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। মাকে আমি আবার কখনো এসব চুড়ি টুড়ি পরতে দেখিনি। মা সবসময় গোল্ড পরতেই পছন্দ করতেন তাই চুড়িগুলো দেখতেই কেন যেনো আমার নিব্বি সায়রীর কথা মনে পড়ে গেছিল। ঝোঁকের মাথায়ই নিজের পছন্দ মতো বেশ কয়েক ডজন কিনে এনেছিলাম কিন্তু তুমি তো আর নিলেই না তাই বাক্স বন্দি করে ড্রয়ারে লক করে রেখে দিয়েছিলাম। তারপর আর কখনো বের করা হয়নি।আদৌ তোমার হাতে লাগবে নাকি নিশ্চিত না তার উপর এখন তো তুমি অনেক বড়ো হয়ে গেছো।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্ছ্বাসের পানে তাকিয়ে আছে সায়রী। তার এহেন দৃষ্টি দেখেও না দেখার ভান করল উচ্ছ্বাস। বললো,”তৃতীয় উপহারটা ছিলো একটা অপরিচিত খাবার। ওইটার নামটা আমার ঠিক মনে নেই। সেদিনই মেলায় প্রথম দেখেছিলাম। মা আর তোমার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। যদিও ওইটা বিশেষ কোনো উপহার ছিলো না তবে আমার ধারণা ছিলো তুমিও ওই খাবারটার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নও তাই উপহার বলেই সম্বোধন করেছিলাম।”

বিপরীতে কিছু বললো না সায়রী। চুড়িগুলো নিয়ে হাতে পড়ার চেষ্টা করল। রোগা পাতলা হাত হওয়ায় সহজেই চুড়ি গুলো সায়রীর হাতে হয়ে গেলো। উচ্ছ্বাস দম ছেড়ে বললো,”এ মা চুড়ি গুলোর মাপ তো দেখি ঠিকই আছে। ছিহ্ সায়রী! এতো বছরেও একটু মোটা হতে পারলে না? তোমার বাবা কী তোমায় ঠিকমতো খেতে দেয়নি এতদিন?”

শেষের কথাটায় যদিও খুব রেগে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সায়রী রাগলো না। ছেলেটা যে সত্যি সত্যিই তাকে ভালোবাসে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সায়রী। আর এও বুঝতে পেরেছে, নিজের অনুভূতিকে যে সুস্পষ্ট ভাবে ভালোবাসা বলে তাও ছেলেটা নিশ্চিতভাবে জানে না। নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিজেই অবগত নয় উচ্ছ্বাস। দুই হাত ঝাঁকিয়ে সায়রী শুধালো,”কেমন লাগছে?”

“সুন্দর।”

“শুধুই সুন্দর?”

“ওইসব কাব্যিক শব্দ দিয়ে সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা আমি করতে জানি না তবে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। সত্যি বলছি।”

সন্তুষ্ট হলো সায়রী। আচমকা জড়িয়ে ধরলো স্বামীকে। বক্ষস্থলে মাথা রেখে মিহি স্বরে বললো, “হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাহলে আমি কোনো ভুল করিনি। বাকি জীবনটা উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়েই সায়রীর কেটে যাবে।”

কোনো কথাই যেনো উচ্ছ্বাসের শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। হঠাৎ সায়রী এতোটা কাছে আসায় রীতিমতো তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রোবটের ন্যায় বসে আছে। স্বামীর নড়চড় বিহীন অবস্থা দেখে মাথা তুলে চাইলো সায়রী। শুধালো,”কী হয়েছে? কিছু বলছেন না কেন?”

“আমার উপর থেকে কী তোমার সব রাগ ক্ষোভ চলে গেছে?”

“উহু, অভিমান চলে গেছে।”

নিজেকে যথাসম্ভব ধাতস্থ করে নিলো উচ্ছ্বাস। ঠাট্টা করে বললো,”তাহলে এই আনন্দে এবার আমার দু গালে দুটো চুমু খাও তো দেখি।”

সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাসকে ছেড়ে দিলো সায়রী। একটু জোরেই কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো উচ্ছ্বাসের পেটে। তৎক্ষণাৎ পেটে হাত রেখে আহ্ সূচক শব্দ করে উঠলো উচ্ছ্বাস। আহত কণ্ঠে বললো,”পাষণ্ড নারী এভাবে স্বামীকে আঘাত করো! ছিহ্।”

“বেশ করেছি।”

“তোমাকে আর কখনো কোনো উপহারই দিবো না যাও। স্বামীকে যে একটু আদর যত্ন করতে হয় তাও জানো না।”

“এমন বাঁদর স্বামীকে মেরে ধমকেই সোজা করতে হবে নইলে দেখা যাবে আদরে আরো বড়ো বাঁদর হয়ে গেছে।”

“কে বলেছে এসব?”

“আমার শ্বশুর মশাই।”

হতভম্ব হয়ে গেলো উচ্ছ্বাস। অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো,”এখানেও বাবা! এখন আবার আমার সংসারেও আগুন লাগাতে চাইছে?”

মুচকি হাসলো সায়রী। যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে বললো,”আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।”

যাওয়া ধরলেও আর যেতে পারলো না সায়রী। পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো উচ্ছ্বাস। একটানে নিয়ে এলো নিজের অতি নিকটে। তার এহেন কাণ্ডে ভ্রু কুঁচকে নেয় সায়রী। শুধায়,”সমস্যা কী?”

উত্তর দেয় না উচ্ছ্বাস। একহাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের ঠোঁট জোড়া এগিয়ে নেয় সায়রীর ঠোঁটের নিকটে। তার মতিগতি বুঝতে পেরেই তাকে এক ধাক্কায় নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয় সায়রী। বলে ওঠে,”একদম ওই বিড়ি খাওয়া ঠোঁট দিয়ে আমায় চুমু দিতে আসবেন না বলে দিলাম। যেদিন পুরোপুরি ভাবে বিড়ি খাওয়া ছাড়তে পারবেন সেদিনই আসবেন তার আগে নয়।”

“বিশ্বাস করো সত্যিই বিয়ের পর থেকে একটা সিগারেটও আমি খাইনি।”

“বিশ্বাস তাও আবার আপনাকে? কখনোই না।”

“অবশ্যই করতে হবে। বিশ্বাস করতে তুমি বাধ্য।”

“কেন? আমায় পেলে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবেন এমন কথা কী কখনো বলেছেন? বলেননি তো। তাহলে কেন বিশ্বাস করবো?”

মুচকি হাসলো উচ্ছ্বাস। সায়রীর কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,”বলেছিলাম তো। তোমার হয়তো মনে নেই তবে তাতে কোনো সমস্যাও নেই। আমি না হয় আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি।”

বলেই থামলো উচ্ছ্বাস। পুনরায় বললো,”যেদিন আমায় নিজের বিয়ের সংবাদ দিতে এসেছিলে সেদিন বলেছিলাম, সত্যি সত্যি কখনো যদি আমার হও তবে না হয় নিকোটিনকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবে দেখবো। আজ সত্যিই তুমি আমার হলে, শুধুই আমার। যেখানে জলজ্যান্ত এক সায়রীকে নিজের করে পেয়ে গেলাম সেখানে তার জন্য এই নিকোটিন ছাড়তে পারবো না?”

কম্পিত হলো সায়রীর ভগ্ন হৃদয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো উচ্ছ্বাসকে। মৃদু আওয়াজে ফিসফিসিয়ে বললো,”আমি এই অসভ্য উচ্ছ্বাসকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। আমার অহেতুক বিরক্তি এবং রাগের কারণ এই উচ্ছ্বাস নামক অসভ্য পুরুষ হলেও আমি তাকে ভালোবাসি। সারাজীবন এই উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত সায়রী হয়েই আমি থাকতে চাই।”

তৃপ্তির হাসি হাসলো উচ্ছ্বাস। গাঢ় করে সায়রীর ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে নেশাতুর কণ্ঠে বললো,”আমিও এই অতি রাগী সায়রী সুন্দরীকে ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে প্রকাশ করা যায় না ঠিক ততোটাই ভালোবাসি সায়রী সুন্দরী।”

পুরো দেহ শীতলতায় ছেয়ে গেলো সায়রীর। এতগুলো বছর, মাস, দিন সে শুধু অপেক্ষা করে গেছে এই পুরুষালী কণ্ঠস্বর হতে একবার ভালোবাসি শব্দটা শোনার জন্য। অবশেষে আজ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটলো। পরিশেষে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছে উচ্ছ্বাস। একত্রিত হয়েছে দুজন মানব মানবীর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হৃদয়।

(~সমাপ্ত~)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে