উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত সায়রী পর্ব-১৪

0
805

#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৪]

ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে উচ্ছ্বাস কিন্তু কিছুতেই তার সেই ঘুমটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ঘুমের মধ্যেই সে অনুভব করল তার উপরে প্রবল বেগে বর্ষন হয়েছে। তৎক্ষণাৎ উচ্ছ্বাসের ঘুমটা ভেঙে গেলো। একপ্রকার লাফিয়েই শয়ন থেকে উঠে বসলো। নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই চমকালো। ট্রাউজারের উপরিভাগ পরিপূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সাথে ভিজেছে বিছানার অর্ধেকটা। সিলিংয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো উচ্ছ্বাস। না উপর থেকে তো কোনো পানি পড়েনি। তাছাড়া কীভাবেই বা পড়বে? বাড়িটি হচ্ছে পাঁচতলা কিন্তু তারা থাকে তিনতলায় সেক্ষেত্রে ছাঁদ ফুটো হওয়ারও তো কোনো চান্স নেই।

হুট করে পাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠস্বরের তীব্র হাসির ঝংকার শোনা গেলো। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে হেসে যাচ্ছে সায়রী। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। আজব তো মেয়েটা এভাবে হাসছে কেন? এবার বাধ্য হয়েই হাসি থামালো সায়রী। বিদ্রুপ করে বললো,”আয়হায়! এ কী করলেন উচ্ছ্বাস?”

চোখেমুখে বিষ্ময় খেলে গেলো উচ্ছ্বাসের। পাল্টা প্রশ্ন করল,”কী করলাম?”

“আরেহ! বিছানায় তো আপনি মুতু করে দিয়েছেন।”—কথাটা বলে আবারো হাসিতে ফেটে পড়ল সায়রী।

এই মুহূর্তে রাগবে নাকি কাঁদবে তা বুঝতে পারলো না উচ্ছ্বাস। তবে এই ধুরন্ধর বউকে যে এখনি থামাতে হবে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো। নইলে দেখা যাবে এসব কথাবার্তা আবার বাহিরেও চলে গেছে। বাহিরে গেলে আবার চরম সমস্যা, ওই বয়স্ক মহিলাগুলো সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই পুরো এলাকা রটিয়ে দিবে, ‘সাব্বির আহমেদের ছেলে উচ্ছ্বাস বিছানায় হিসু করে দিয়েছে।’

বিছানা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে সায়রীর মুখটা চেপে ধরলো উচ্ছ্বাস। রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,”এতো বড়ো হয়ে গেছো অথচ মুখে কিছু আটকায় না তোমার? সকাল সকাল ফাইজলামি করো আমার সঙ্গে?”

বিশালদেহী দানব আকৃতির লোকটার থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে লাগলো সায়রী কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠলো না তার সঙ্গে। উচ্ছ্বাস পুনরায় ধমক দিয়ে বলে উঠলো,”আবারো বেয়াদবি করছো? স্বামী ধরার পরেও ছটফটানি! না না এবার তো দেখছি তোমাকে ভদ্রতা শেখানোর ক্লাস করাতে হবে সায়রী। তার আগে চুপচাপ বিছানার চাদর, বালিশের কভার বদলে ফেলো তারপর টানা আধ ঘণ্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি। এটাই তোমার শাস্তি।”

খুব গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বলে সায়রীকে ছেড়ে সরে আসলো উচ্ছ্বাস। বিপরীতে কড়া কিছু বলার চেষ্টা করল সায়রী কিন্তু পারলো না। ততক্ষণে ধাপধুপ পা ফেলে বাথরুমে ঢুকে গেছে উচ্ছ্বাস।

উচ্ছ্বাসকে ফ্যাসাদে ফেলতে গিয়ে নিজেই এবার ফেঁসে গেলো সায়রী। ইতোমধ্যেই তার চোখেমুখে নেমে এসেছে রাজ্যের আঁধার। এখন কিনা সব পরিষ্কার করতে হবে? ভেবেই ক্লান্ত লাগছে সায়রীর। গোমড়া মুখে আলমারি থেকে নতুন বিছানার চাদর, বালিশের কভার বের করে নেমে পড়ল ভেজা বিছানা ঠিক করতে।

কিছু সময় অতিক্রম হতেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো উচ্ছ্বাস। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে স্ত্রীকে দেখে মুচকি হাসলো। ঠাট্টা করে বললো,”এই জন্যই বারবার বলি বড়দের একটু সম্মান করতে শিখো। সম্মান করতে শিখলে তো আর এতগুলো কাজ একা একা করতে হতো না।”

বাঁকা চোখে তাকায় সায়রী। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,”আসছে আমার বড়ো। লজ্জা করে না ছোটোদের দিয়ে কাজ করাতে?”

“সঠিক সময়ে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিলে এতদিনে ছানাপোনার হাতে টিফিন বক্স ধরিয়ে দিয়ে তাদের স্কুলে পাঠাতে হতো। ছোটো সাজে! তুমি বয়সে আমার থেকে ছোটো কিন্তু বাচ্চা নও।”

রাগে চোখমুখ কুঁচকে এসেছে সায়রীর। ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। কখন কী বলে, কী বোঝাতে চায় তা যেনো নিজেই জানে না।আধ ভেজা চাদর বাথরুমে গিয়ে বালতিতে ভিজিয়ে রেখে বাহিরে এলো সায়রী। ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই পেছন থেকে টান অনুভব করল ওড়নায়। কপাল কুঁচকে পেছন ফিরে শুধালো, “ওড়না ধরে টানাটানি করেন কেন?”

“দেখবো।”

“কী!”

“তোমার ন্যাড়া মাথা।”—বলেই স্লান হাসলো উচ্ছ্বাস।

পূর্বের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো সায়রীর। উচ্ছ্বাসের হাত থেকে ওড়নাটা ছাড়িয়ে নিয়ে খুব গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”সবসময় এসব মজা ভালো লাগে না উচ্ছ্বাস। আপনি কথায় কথায় এই বিষয়টা নিয়ে আমাকে অপমান করেন কেন?”

তৎক্ষণাৎ কয়েক পা এগিয়ে এসে সায়রীর কোমর জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস।মুহূর্তেই হকচকিয়ে ওঠে সায়রী।উচ্ছ্বাসের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে আঁচড়ে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। এতো কাছাকাছি আসায় ভেতরে শুরু হয়েছে তান্ডব। উচ্ছ্বাস তার মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,”ভালোবাসার কথা বললেও তোমার ভালো লাগে না। গতকাল রাত থেকে আদর করতে চাইছি অথচ তাও তোমার ভালো লাগছে না তাহলে ভালো লাগেটা কী?”

পুরো দেহখানা মুহূর্তেই শিথিল হয়ে ওঠে। কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারছে না সায়রী। গলা পর্যন্ত এসে বাক্যগুলো আটকে গেছে। এমন একটা সময় হুট করেই সে উপলব্ধি করল উচ্ছ্বাস নামক পুরুষটির কণ্ঠস্বর মারাত্মক সুন্দর। গভীর কিছু আছে তার ওই কণ্ঠস্বরে। তার স্থির চোখের মণিটায় মায়া দিয়ে ভর্তি। আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো উচ্ছ্বাস। ফিসফিস করে বললো,”আসলে আমি বাদে তোমার সবই ভালো লাগে তাই না? আমায় কেন ভালো লাগে না? আমি কী কখনো কোনো খারাপ আচরণ করেছি তোমার সঙ্গে? তাহলে কেন আমার সময়ই তোমার এতো বিরক্তি কাজ করে? বিয়েটা ঝোঁকের মাথায় করেছো তাই না?”

বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো সায়রীর। চমকায়িত দৃষ্টিতে পূর্বের ন্যায় নিষ্পল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বামীর পানে। কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই শুকনো ঢোক গিললো। বলতে চাইলো কিছু কিন্তু পারলো না বলতে।

স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক মিটার দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। এতক্ষণ মুখশ্রীতে যে অসহায়ত্ব ভাবটা ফোটে উঠেছিল তা যেনো সরে গিয়ে যোগ হলো গাম্ভীর্য। ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,”ব্যাপার কী সায়রী সুন্দরী? হঠাৎ করে স্ট্যাচু হয়ে গেলে যে? মতলব তো সুবিধার ঠেকছে না, ঝড় আসার পূর্বাভাস নাকি?”

ঘোর কেটে গেলো সায়রীর। কোনো কথা না বলে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ত্যাগ করল কক্ষ। হঠাৎ স্ত্রীর এতো স্বাভাবিক আচরণে বেশ চমকালো উচ্ছ্বাস। বলে ওঠল,”কী ব্যাপার? হুট করে আমার ধানি লঙ্কার ঝাঁঝ কমে এলো কেন?”
________

বৌ ভাতের অনুষ্ঠান শেষ হতেই বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন কমতে লাগলো। যে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে সায়রীকে নিয়ে রেজা ভিলায় এসে উপস্থিত হয়েছে উচ্ছ্বাস। বৌ ভাতের পরপরই তপন রেজা মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে সাব্বির আহমেদ। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনেরা এসেছিল শুধু বিয়ে উপলক্ষে। তাদের মধ্য থেকে ছেলে এবং ছেলের বউকে পাঠিয়ে দেওয়া কী ভালো দেখায়?

টেবিলে অসহায় মুখ করে বসে আছে উচ্ছ্বাস। পুরো টেবিল জুড়ে সাজানো বিভিন্ন পদের খাবার। সুবর্ণা রহমান হাস্যজ্জ্বল মুখে মেয়ে জামাইয়ের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে উচ্ছ্বাস। সুবর্ণা আহ্লাদী কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,”কী ব্যাপার বাবা খাচ্ছো না কেন? তুমি কী লজ্জা পাচ্ছো? লজ্জা পাওয়ার কী আছে? এটা তো তোমার নিজের বাড়ি। আগেও তো কতবার এসেছো তাই না?”

জোরপূর্বক হাসলো উচ্ছ্বাস। নম্র কণ্ঠে বললো,”না না শুভ আন্টি লজ্জা পাবো কেন?আসলে নিজের ভাগ্য দেখে খুব অবাক হচ্ছি আমি। এতো ভালো শাশুড়ি কিনা আমার কপালেই ছিলো? তাছাড়া আপনার হাতের রান্নার কথা আর কিই বা বলবো? মনে হচ্ছে অমৃত খাচ্ছি।”

এতগুলো মানুষের সামনে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জা পেলেন সুবর্ণা। ভিজে উঠলো চোখ জোড়া। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বললেন,”এমন করে পূর্বে কেউ কখনো আমার প্রশংসা করেনি। আমার মেয়েটার কপাল ভালো বলেই তোমার মতো একজন স্বামী পেয়েছে। ওকেও একটু নিজের শিক্ষায় শিক্ষিত করে দিও তো উচ্ছ্বাস।”

উচ্ছ্বাসের অভিনয় দক্ষতা দেখে চোয়াল ঝুলে গেছে সায়রীর। বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,”আমি নিশ্চিত উচ্ছ্বাস, আপনি চাইলেই ভবিষ্যতে খুব ভালো একজন অভিনেতা হতে পারবেন।”

মেয়ের কথা শুনতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো সুবর্ণার। ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,”এসব কী ধরণের কথা?স্বামীকে কোথায় কীভাবে সম্মান করতে হয় সেটাও জানো না? এখন কী তোমাকে ধরে ধরে সহবত শেখাতে হবে?”

সকলের সামনে মায়ের বকাঝকাটা নিতে পারলো না সায়রী তাই চুপসে গেলো। তপন রেজা বিদ্রুপ করে বললেন,”ওকে বকে লাভ কী? ওর কী দোষ?মেয়েরা তো এসব শিক্ষা মায়ের থেকেই পায়। যেখানে মা-ই নিজের স্বামীকে…।”

এতটুকু বলেই থেমে গেলেন তপন রেজা। স্ত্রীর রাগত চেহারায় দৃষ্টি যেতেই শুকনো ঢোক গিলে চুমুক বসালেন পানির গ্লাসে। তেতে উঠলেন সুবর্ণা। কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই উনাকে থামিয়ে দিলো উচ্ছ্বাস। পূর্বের ন্যায় নম্র স্বরে বললো,”এসব ছাড়ুন তো আন্টি। আমাকে দেখুন। এতো এতো অমৃত একসঙ্গে আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়। আমার পেট ভরে গেছে আমি বরং এখন উঠি?”

উচ্ছ্বাসের কথায় রাগ গলে পানি হয়ে গেলো সুবর্ণার। অভিমানী কণ্ঠে বললেন,”উঠবে? উঠো তাহলে। কিন্তু তুমি আমায় আর আন্টি বলে ডাকবে না। মা বলবে বুঝেছো?”

“শুভ মা সম্বোধনটা কেমন শোনায় না? এর থেকে শুভ আন্টি সম্বোধনটাই খুব সুন্দর তাই আরকি এখনো আপনাকে আমি আন্টি বলেই ডাকছি, শুভ আন্টি..। আপনার মুখটার মধ্যে না শুভ শুভ একটা ভাব আছে তাই এইভাবে ডেকেই আমি খুব তৃপ্তি পাই। তবে আপনি চাইলে না হয় এবার থেকে মা-ই ডাকবো।”—বলেই কিউট একটা হাসি দিলো উচ্ছ্বাস।

মোমের মতো গলে গেলো সুবর্ণার মন। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে বাম চোখের পানি মুছে মমতাময়ী কণ্ঠে বললেন,”তুমি আমায় যতটা ভালোবাসা নিয়ে ডাকো, কথা বলো আমার বাবাও মনে হয় না কখনো আমায় এতোটা ভালোবেসে ডেকেছিলেন। ওরে আমার ছেলে তোমার যা ইচ্ছে তুমি আমায় তাই বলেই ডেকো। তোমার কথা শুনলেই যে আমার মন ভালো হয়ে যায়।”

“তাহলে এখন আমি ঘরে যাই শুভ আন্টি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও বাবা।”

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে হাতটা ধুয়ে সায়রীর ঘরের দিকে পা বাড়ালো উচ্ছ্বাস। আজ খুব বাঁচা বেঁচে গেছে সে। কোনোমতে খেয়ে তপন রেজা উঠে গেলেন চেয়ার ছেড়ে। এতদিন স্ত্রীর থেকে উচ্ছ্বাসের এতশত প্রশংসা শুনে শুধু ভেবেছেন, ছেলেটার মধ্যে কী এমন দেখলো সুবর্ণা যে নিজের ছেলে-মেয়েদের থেকেও তার প্রতি এতো ভালোবাসা? আজ তা স্বচোক্ষে দেখে মারাত্মক অবাক হলেন তিনি। যেই স্ত্রীর সঙ্গে সারাজীবন সংসার করে একটুও বশে আনতে পারেননি অথচ দুদিনের ছোকরা কিনা তাকেই আঙুলের ডগায় নাচাচ্ছে?

খাওয়া দাওয়া শেষে ভাবী এবং কাজিন দের সঙ্গে গল্প গুজব করে ঘরে এলো সায়রী। দরজা আটকে পেছন ঘুরতেই স্বামীকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কুঞ্চিত হলো ভ্রু। এগিয়ে এসে শুধালো,”হাবলার মতো বসে আছেন কেন?”

“এই মুহূর্তে না নিজেকে আমার লজ্জাবতী জামাই মনে হচ্ছে সায়রী সুন্দরী। এই যে আমি বিছানায় বসে আছি তোমার অপেক্ষায় আর তুমি সবার সঙ্গে গল্প গুজব করে ধীর পায়ে ঘরে এসেছো।”

মুখ বাঁকিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো সায়রী। উচ্ছ্বাস কিছুটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,”এই সায়রী সুন্দরী! আলো নিভিয়েছো কেন? তোমার মতলব তো কিছুতেই ভালো ঠেকছে না। এই এই তুমি কী অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছো? প্লিজ এমন করো না, সকালে আমি সবার সামনে মুখ দেখাবো কী করে?”

বিষ্ময় নিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই উচ্ছ্বাসের পানে হা করে তাকিয়ে আছে সায়রী। খানিকক্ষণ নিরব থেকে বললো,”আপনি তো ভারি ড্রামাবাজ উচ্ছ্বাস! আপনাকে যত দেখি ততোই আমি অবাক হই।”

“অবাক হওয়ার দরকার নেই। এসব অবাক টবাক হওয়া বাদ দিয়ে বউয়ের দায়িত্ব পালন করো।”

“কী দায়িত্ব?”

“গুণে গুণে পাঁচটা চুমু দাও আমায়।”

“অসম্ভব।”

“কেন? চুমু দিলে কী তোমার মুখ খসে পড়বে?”

“ঘুমান তো।”

“স্বামীর কথা না শুনলে পাপ হবে দেখে নিও।”

“যেদিন সিগারেট ছাড়তে পারবেন সেদিনই চুমু খেতে আসবেন। কোনো সিগারেট খোরকে আমি চুমু টুমু খেতে পারবো না।”

“বিয়ের পর থেকে একটা সিগারেটও খাইনি সায়রী। বিশ্বাস করো।”

“আপনাকে বিশ্বাস করা অসম্ভব।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল উচ্ছ্বাস। সায়রীও আর কথা না বাড়িয়ে মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে পাশাপাশি শুয়ে পড়ল। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে তার। নরম বালিশে মাথা রাখতেই চোখে তন্দ্রা ভাবটা চলে এলো। ঘুমের মধ্যেই অনুভব করল পেছন থেকে কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে পড়ছে সায়রীর পিঠে ঘাড়ে। এই হাত আর নিঃশ্বাসের অধিকারী যে উচ্ছ্বাস তা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি সায়রীর তবে এই মুহূর্তে তাকে কিছুই বলতে ইচ্ছে করল না। কিছু বললেই ছেলেটার বিভিন্ন ভাঙাচোরা যুক্তি শুনে মেজাজ খারাপ হবে। যা করতে রাজি নয় সায়রী, তাই মনোযোগ দিলো ঘুমে।
________

ছেলের বিয়ে দিতে গিয়ে সাব্বির আহমেদের প্রেশারটা বেড়ে গেছে। গতকালই স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছেন তিনি। দুপুরের খাবার খেয়েই দিয়েছিলেন একটা ঘুম। অসুস্থ থাকায় আসর এবং মাগরিবের নামাজটা আজ ঘরেই পড়ে নিয়েছেন তিনি।

আজ বিকেলেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাবার বাড়ি থেকে এ বাড়িতে চলে এসেছে সায়রী।নিজের বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই এলাকা চষে বেড়াতে চলে গেছে উচ্ছ্বাস। বাড়িতে এখন শুধু মাত্র তিনজন ওরা।

নামাজ আদায় করেই সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে সায়রী। একটা ট্রেতে করে তিন কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে এসে দাঁড়ালো শ্বশুর শাশুড়ির ঘরের সামনে। মিহি স্বরে শুধালো,”ভেতরে আসবো?”

ভেতর থেকে ভেসে এলো নেহারের কণ্ঠস্বর,”এসো।”

ভেতরে প্রবেশ করল সায়রী। সাব্বির আহমেদ বিছানার একপাশে বসে আছেন একটা হিসাবের খাতা নিয়ে। অপরপাশে বসে শাড়ি ভাঁজ করছেন নেহার। এগিয়ে গিয়ে বিছানার মাঝখানে ট্রেটা রাখলো সায়রী। স্লান হেসে বললো,”সন্ধ্যায় আমার আবার চা খাওয়ার অভ্যাস।তাই চা বানাতে রান্নাঘরে চলে গেলাম সাথে আপনাদের জন্যও বানিয়ে নিয়ে এলাম। আচ্ছা আপনারা এ সময় চা খান তো?”

হিসাবের খাতা থেকে চোখ তুলে পুত্রবধূর পানে তাকালেন সাব্বির আহমেদ। চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হেসে বললেন,”অবশ্যই। আমার আবার সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা চা ছাড়া চলেই না।”

কাপড় গুলো সরিয়ে রেখে পুত্রবধূকে বসার জায়গা করে দিলেন নেহার। নিজেও আরেকটা কাপ তুলে নিলেন হাতে।বললেন,”দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”

শাশুড়ির বরাবর বসে পড়ল সায়রী। ট্রেতে থাকা অবশিষ্ট কাপটা তুলে নিলো নিজ হাতে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত কণ্ঠে সাব্বির আহমেদ বললেন,”চা টা তো দারুন বানাও তুমি।”

উনার সঙ্গে তাল মেলালেন নেহারও। বললেন,”ঠিক বলেছো। সত্যিই দারুন হয়েছে চা টা।”

প্রত্যুত্তরে হাসলো সায়রী। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো টুকটাক গল্প। একপর্যায়ে সাব্বির আহমেদ বলে উঠলেন,”আমার জানামতে তুমি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে অথচ তারপরেও আমার এই অকর্মা,ইতর ছেলেটাকে কেন বিয়ে করলে বলো তো? কেনই বা নিজের জীবনের বারোটা বাজানোর সিদ্ধান্ত নিলে সায়রী মা?”

প্রশ্নটায় থতমত খেয়ে গেলো সায়রী। যা সাব্বির আহমেদ খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন। মুচকি হেসে বললেন,”আহা ঘাবড়ানোর কী আছে? আমরা কী তোমার অপরিচিত?নাকি এ বাড়ি তোমার কাছে অপরিচিত? নির্দ্বিধায় তুমি সব বলতে পারো। আমার ছেলের দৌড় আমি খুব ভালো করেই জানি। ওই অকর্মাকে নিয়ে দুয়েকটা চড়া কথা বললেও আমি চোখ বন্ধ করে তা বিশ্বাস করে নিবো।”

জড়তা কাটিয়ে উঠলো সায়রী। হেসে বললো,”ভেবে দেখলাম জীবনে একটা অকর্মা আর ইতর না থাকলেই যেনো নয় তাই আরকি উনাকেই স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছি।”

“তা অবশ্য ভালোই করেছো। নইলে তোমাকে বিয়ে করতে না পারার শোকে কান্নাকাটি করে আমার কানটাই নষ্ট করে দিতো।”

রূষ্ট হলেন নেহার। মুখ বাঁকিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,”আমার ছেলেকে যে তুমি সহ্য করতে পারো না তা আমি খুব ভালো করেই জানি কিন্তু তাই বলে তার বউয়ের সামনে তারই মান সম্মান ডুবাবে?”

“ওর আবার মান সম্মানও আছে? ও যে কেমন তা তুমি না জানলেও আমি আর আমার বউমা খুব ভালো করেই জানি তাই না সায়রী মা?”

সশব্দে হেসে উঠলো সায়রী। তার হাসিতেই যেনো সাব্বির আহমেদের উত্তরটা লুকিয়ে আছে। লুকায়িত উত্তরটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না উনাকে। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না সাব্বির আহমেদ। হো হো করে হেসে উঠলেন। হার মেনে নিলেন নেহার। গাম্ভীর্যের ভাবধারাটা বেশিক্ষণ আর ধরে রাখতে পারলেন না। ঠোঁটের কার্নিশে বাকিদের মতো উনারও ফোটে উঠলো মিষ্টি হাসি।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে