#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৩]
তপ্ত দুপুরের শেষাংশে পরপর তিনবার কবুল বলার মাধ্যমে উচ্ছ্বাস এবং সায়রীর বিয়েটা তবে হয়েই গেলো। বিদায়বেলা বাবা-মাকে ছেড়ে আসার পথে কী কান্নাটাই না করেছিল মেয়েটা।
উচ্ছ্বাসদের ফ্ল্যাটটা এখন সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছে একঝাঁক নারী। তাদের মধ্যকার সকলেই বিভিন্ন বয়সী। সোফায় নববধূ সাজে বসে আছে সায়রী। গা ভর্তি গহনা এবং ভারি ল্যাহেঙ্গা পরিহিত থাকায় শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে তার। কান্নাকাটির ফলে চোখের গাঢ় কাজল লেপ্টে গেছে। বেশ কিছু চোখ গভীর দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। পাশে বসেই বয়স্ক কিছু মহিলা মিলে জুড়ে দিয়েছে ঘর সংসার প্রতিবেশী নিয়ে রাজ্যের গল্প। অস্বস্তিতে ভেতরটা ফেটে পড়ছে সায়রীর। এতো এতো মানুষ, ভারি সাজ আর এমন পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত সে।ড্রয়িং রুমে এসির ঠান্ডা হাওয়ার নিচে বসে থাকার পরেও ললাট বেয়ে কপোলে এসে পড়ছে সরু ঘাম। শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার পর থেকে শাশুড়ি কিংবা স্বামী কারোর সঙ্গেই ফের দেখা মেলেনি সায়রীর।
প্রায় আধ ঘণ্টা পার হতেই একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর সকলের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলে উঠলেন,”আপনাদের কী আক্কেল জ্ঞান বলে কিছুই নেই? এই গরমের মধ্যে ভারি পোশাক, গহনা পরিহিত একটা মেয়েকে ঘিরে এভাবে বসে আছেন কেন? জায়গাটা ওর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। ওর নিশ্চয়ই অস্বস্তি হচ্ছে, ক্লান্ত লাগছে। দেখি ছাড়ুন তো। ওকে আমি ঘরে নিয়ে যাবো।”
মহিলাটির কথাটা যেনো মোটেও পছন্দ হলো না উপস্থিত সকলের। একজন বয়স্ক মহিলা মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলেন,”এমন কইরা কইতাছো যে হেয়ই প্রথম বিয়া বইয়া শ্বশুর বাড়ি আইছে। হুনো আমরাও কিন্তু এইসব পার কইরা আইছি। জিড়ানের সময়ডাও পাই নাই।”
মহিলাটির সোজাসাপ্টা জবাব,”অতীত ঘেঁটে লাভ নেই চাচী। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের ভাব ধারাও বদলে গেছে। বর্তমান যুগের সঙ্গে অতীতের তুলনা করলে মানুষ ঠাট্টা করবে।”
সঙ্গে সঙ্গে সকলে থেমে গেলো। সায়রীকে নিয়ে তাদের মধ্য থেকে উঠে এলেন মহিলাটি। নিয়ে গেলেন উচ্ছ্বাসের রুমটায়। বিছানায় বসিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,”আমি সম্পর্কে তোমার খালা শাশুড়ি হই। নেহারের আপন বড়ো বোন।”
প্রত্যুত্তরে কী বলবে ভাবতে লাগলো সায়রী কিন্তু তাকে বেশি একটা ভাবার সময় দিলেন না নাদিয়া। বললেন,”তোমার শাশুড়ি একটু ব্যস্ত তাই তোমার কাছে আসতে পারছে না। বোঝোই তো একমাত্র ছেলের বিয়ে তার উপর এতো এতো আত্মীয় স্বজন তাই আর কি আমায় পাঠালো। তুমি বরং এখানে বসো আমি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
কথাটা শেষ করে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ঘরের বাহিরে চলে গেলেন নাদিয়া। এই মুহূর্তে মহিলাটিকে খুবই ভালো এবং গম্ভীর টাইপের মানুষ মনে হলো সায়রী নিকট। বিছানার মাঝখানে পা ভাঁজ করে বসে ঘরটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল সায়রী কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভ্রু জোড়া তার কুঁচকে গেলো। উচ্ছ্বাসের ঘরটা আজ অন্যরকম ঠেকছে তার কাছে। কী পরিবর্তন হয়েছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেই বুঝতে পারলো আসবাবপত্র গুলো একটু এদিক ওদিক করা হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলটা বদলানো হয়েছে সাথে বদলানো হয়েছে খাটটাও।
শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে এলেন নেহার। মুচকি হেসে সায়রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“একটামাত্র ছেলে আমার। একা হাতে সব সামলাতে গিয়ে দিক বেদিক একেবারে ভুলে বসেছি। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন। ঠিকঠাক আপ্যায়ন না করলে কী আর হয়? সন্তানের বিয়ে দিতে গিয়ে যে কত দায়িত্ব পালন করতে হয় আজ হারে হারে তার প্রমাণ পাচ্ছি। সব দিক সামলাতে গিয়ে তোমার কাছে আসাই হয়ে ওঠেনি। রাগ করো না শাশুড়ির উপর।”
স্লান হাসলো সায়রী। উত্তরে বললো,”রাগ করবো কেন আন্টি? আপনার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি।”
কথাটা যেনো মোটেও পছন্দ হলো না নেহারের। কপোট রাগ দেখিয়ে বললেন,”আন্টি কী হ্যাঁ? ওইসব আন্টি ফান্টি ডাক আর চলবে না। সুন্দর করে মা বলে ডাকো।”
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো সায়রী। যাকে এতদিন ধরে আন্টি বলে সম্বোধন করে এসেছে এখন কিনা তাকে মা বলে ডাকবে? তার নিরবতা দেখে সম্মুখে বসে পড়লেন নেহার। আফসোসের সুর তুলে বললেন,”জীবনে একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো আমার কিন্তু আল্লাহ্ আমায় কোনো মেয়েই দিলেন না। ইচ্ছেটা মনের ভেতরে চেপে রেখেই ছেলেটাকে সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে বড়ো করলাম কিন্তু ছেলে বড়ো হওয়ার পরপরই পুরোনো ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তোমার শ্বশুর সারাদিন অফিসে থাকতেন। ফিরতে ফিরতে রাত হতো। উচ্ছ্বাসটাও কলেজ, ভার্সিটি, বন্ধু বান্ধব নিয়ে পড়ে থাকতো বাহিরে। এদিকে বাড়িতে আমি একা একটা মানুষ। কতক্ষণই বা টিভি দেখে সময় কাটানো যায় বলো তো? কিছু ভাড়াটিয়াদের মেয়ে ছিলো। মেয়েরা দেখতাম মায়ের কাজে হাতে হাতে সাহায্যে করে, মাকে সঙ্গ দেয় আবার গল্প করতে করতে ঝংকার তুলে হেসে ওঠে। ওইসব দেখলে আমারও একটা মেয়ের জন্য আফসোস হতো। আফসোস করে আর কী লাভ? মেয়ের মা হওয়া তো আর সম্ভব নয়। পরে মনকে এ বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, এখন মেয়ে নেই তো কী হয়েছে? ছেলেকে বিয়ে করিয়ে তো একটা মেয়ে বাড়িতে আনাই যাবে তখন না হয় শোধে আসলে সব শখ পূরণ করে নিবো। কিন্তু মাঝেমধ্যে আবার ভয় হতো, বর্তমানের মেয়েরা তো খুব স্বাধীনচেতা স্বভাবের। আদৌ কী তারা আমায় নিজের মায়ের স্থান দিতে পারবে? আমিও কী পারবো আদর্শ শাশুড়ি হতে? পূরণ হবে কী আমার সব স্বপ্ন?”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নেহার। চোখ জোড়ায় পানি চিকচিক করছে উনার। পুত্রবধূর পানে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালেন। আদুরে কণ্ঠে বললেন,”তোমাকে যে উচ্ছ্বাস পছন্দ করে তা আবার ওর বাবা আগে থেকেই জেনে বসে আছেন। ছেলের পেছনে উনার যত রকমের গোয়েন্দাগিরি। তবুও একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেননি। এমন ভাব যেনো কিছুই জানেন না। এদিকে আমিই শুধু কিছু জানতে পারিনি। যখন জানতে পারলাম ততদিনে তোমার বিয়ে ফাইনাল। তখন কিছুটা আফসোস হয়েছিল বটে তবে এখন আর আফসোস নেই। ছেলেটা তো ভালোবাসার মানুষকে পেলো। সেসব কথা ছাড়ি এবার বলো আমার ইচ্ছেটাকে কী পূরণ করতে পারবে? বেশি কিছু চাই না শুধু আমার মেয়ে হয়ে থেকো।”
সাধারণ কিছু কথাই যেনো খুব অসাধারণ ঠেকলো সায়রীর নিকট। শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী রমণীর চক্ষুদ্বয় ভিজে উঠলো অশ্রুতে।এই নারীটিকে সেই ছোটো বেলা থেকেই চেনে সায়রী। উচ্ছ্বাসের মা হওয়ার দরুন উনার সঙ্গে এককালে বেশ সখ্যতাও ছিলো সায়রীর। আচমকা দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো নেহারকে। ভারি কণ্ঠে বললো,”হুম থাকবো।”
সারাদেহ শীতলতায় ছেয়ে গেলো নেহারের। পরম মমতায় পুত্রবধূর মাথায় হাত রাখলেন। কিছু মুহূর্ত পার হতেই তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,”এই যাহ্! এখনো তোমাকে এসব ভারি পোশাক, গহনা পরিয়ে বসিয়ে রেখেছি। তুমি তো এসবে তেমন অভ্যস্ত নও তাই না? তোমার জন্য না অনেকগুলো শাড়ি কিনে রেখেছি। সুবর্ণা ভাবীর থেকে মাপ জেনে থ্রী পিছও বানিয়ে রেখেছি। যতবার তোমাকে দেখেছি ততবারই তো দেখলাম থ্রী পিছ পরতে। ওইসব পোশাকেই তো তুমি অভ্যস্ত। গতকালই উচ্ছ্বাসের আলমারিতে আমি সব গুছিয়ে রেখেছি। যেটা ভালো লাগে পরে নাও। আমি বরং তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো সায়রী। নেহার দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করলেন। বসা থেকে উঠে আলমারির কাছে গেলো সায়রী। সত্যি সত্যিই উচ্ছ্বাসের কাপড়ের পাশেই তার জন্য বরাদ্দকৃত জামা কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখা। সেখান থেকেই এক সেট থ্রী পিছ বের করল পরিধান করার জন্য।
________
রাত গভীর হচ্ছে, সারাদিনের মতো এখন আর অতো হট্টগোল নেই বাড়িতে। বন্ধুদের আড্ডার মজলিস থেকে অবশেষে নিস্তার পেয়েছে উচ্ছ্বাস। বউ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে না করতেই বন্ধু এবং ছেলে কাজিনরা তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেছিল পাশের ফ্ল্যাটটায়। তারপর রাত হতেই ছাদে।
সকলের অভয়ে বাসর রাত নিয়ে অধিক রোমাঞ্চিত মন নিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল উচ্ছ্বাস। বুকের ভেতর কয়েকবার থুতু ফেলে পেছন ফিরতেই ললাটে তার ভাঁজ পড়ল। পূর্বের সব রোমাঞ্চিত অনুভূতি মুহুর্তেই ফুরুৎ হয়ে গেলো। চোখেমুখে এখন শুধু আশ্চর্যের ছাপ।
পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে ছোটো ছোটো কদম ফেলে উদাস মনে বিছানার এককোণে গিয়ে বসলো উচ্ছ্বাস। কত আশা নিয়েই না ঘরে এসেছিল সে অথচ সব আশা এক লহমায় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো। গত রাতেও কল্পনা দেখেছিল, বিছানার মাঝখানে লজ্জায় রাঙা লাল টুকটুকে একটা বউ ঘোমটা টেনে বসে থাকবে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সম্মুখে বসে তার ঘোমটা সরাবে উচ্ছ্বাস। তৎক্ষণাৎ ভেসে উঠবে আদুরে একখানা মুখ কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। সব স্বপ্নে পানি ঢেলে দিয়ে সাদামাটা থ্রী পিছ পরিধান করে বিছানার অর্ধেকটা জায়গা দখল করে শুয়ে আছে সায়রী।
হতাশ দৃষ্টিতে সিলিংয়ের পানে তাকালো উচ্ছ্বাস।মনে করার চেষ্টা করল,”বিয়েটা কী আদৌ সত্যি সত্যিই হয়েছে নাকি এতক্ষণ যাবত আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? এতো বাস্তবিক স্বপ্ন কী আদৌতে দেখা সম্ভব? স্বপ্ন যদি নাই দেখি তাহলে আমার বউ বাসরঘরে আমায় রেখে ঘুমাচ্ছে কেন?” কথাগুলো আনমনে বলে ভাবনা বাদ দিলো উচ্ছ্বাস। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরনের পোশাক বদলাতে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ বাদে পোশাক বদলে শব্দ করে বাথরুমের দরজা খুলে বের হয়ে এলো উচ্ছ্বাস। চোখেমুখে আবারো ফোটে উঠলো বিরক্তির ছাপ। সেই পূর্বের ন্যায় এখনো সায়রী উল্টো পাশ ফিরেই শুয়ে আছে। মেয়েটা কী কুম্ভকর্ণ নাকি? একটা মানুষ যে ঘরের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে, শব্দ করে বাথরুমের দরজা আটকালো-খুললো এমনকি বিছানায়ও বসলো অথচ সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই? আদৌ কী সে ঘুমিয়েছে নাকি ঘুমের ভান ধরে আছে?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে স্ত্রীর মুখের দিকে ঝুঁকলো উচ্ছ্বাস। গভীর দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তাকে। মেয়েটাকে পূর্বে কখনো অতো গভীর ভাবে দেখা হয়নি উচ্ছ্বাসের। মুহুর্তেই এক ঘোরের ভেতরে ডুবে গেলো সে। আলতো করে কামড় বসালো সায়রীর চিবুকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালো সায়রী। উচ্ছ্বাসের এমন একটি কাজে চমকালো। চমকের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো রাগ। যাকে বলে চরম রাগ। কঠিন গলায় বললো,”লুচ্চামি শুরু হয়ে গেছে হ্যাঁ?”
থতমত খেয়ে গেলো উচ্ছ্বাস। নম্র কণ্ঠে বললো, “লুচ্চাচির কী আছে? আমার বিয়ে করা বউ তুমি তাই যখন যা ইচ্ছে করতেই পারি। বাই দ্য ওয়ে তুমি ঘুমাওনি?”
“আপনাকে বলবো কেন? সরুন সামনে থেকে। আমার ধারের কাছেও ঘেঁষবেন না বলে দিলাম।”
“বললেই হলো? বাসর রাতে তুমি ঘুমাবে?”
“তো কী করবো?”
“বাসর রাতে মানুষ কী করে? অন্তত গল্প গুজব তো করে।”
“আপনার সঙ্গে গল্প গুজব করার কোনো ইচ্ছেই আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। মানুষ গল্প গুজব করে অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য কিন্তু আমরা তো পূর্ব পরিচিত তাই গল্প গুজব ক্যান্সেল।”
দুষ্টু হাসলো উচ্ছ্বাস। চোখ টিপ দিয়ে বললো,”তাহলে এই সময়টা অন্য কিছু করলে কেমন হয়? একেবারে মেইন কোর্স!”
রাগ সরে চোখেমুখে ছাপিয়ে ওঠে বিষ্ময়। কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর মুখশ্রীতে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে ওঠে সায়রী। ধমকে বলে ওঠে,”ছিহ্! আজেবাজে কথা বলতে মুখে বাঁধে না?”
দুই হাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরে উচ্ছ্বাস। ফিসফিস করে বলে,”এভাবে চিৎকার করছো কেন? বাড়ি ভর্তি মানুষ তার উপর সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী আমরা। এসব চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মানুষ তো ব্যাপারটাকে নেগেটিভলি নিবে।”
মাথা ভনভন করছে সায়রীর। এই ছেলের সঙ্গে তো কিছুতেই কথায় পারা যাচ্ছে না। এতদিন জানতো ছেলেটা শুধুই প্লে বয় কিন্তু এখন তো দেখছে পাশাপাশি খুবই অভদ্র এবং অশ্লীল। কিছুতেই নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলো না সায়রী। এই মুহূর্তে এই লোকটাকে থামানো উচিত। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”ইতর, ফাতরা, অসভ্য কী আর স্বাদে বলি আপনাকে? রাত বিরেতে অশ্লীল কথাবার্তা যত্তসব। চুপ করে ঘুমান গিয়ে। এমনিতেই কিন্তু আমার মন মেজাজ ভালো নেই।”
“বড়োদের সম্মান করতে শিখো সায়রী। আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়ো তাছাড়া এখন থেকে প্রাণ প্রিয় স্বামীও বটে। স্বামীকে সম্মান দিয়ে কথা বলা স্ত্রীদের কঠিন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
দম ছাড়লো সায়রী। কৃত্রিম হেসে নরম স্বরে বললো,
“সম্মানীয় প্রাণপ্রিয় অসভ্য স্বামী আমার, দয়া করে বিছানায় শয়ন করুন। নিজে তন্দ্রায় মগ্ন হোন এবং আমাকেও তন্দ্রায় মগ্ন হতে দিন। আসসালামু আলাইকুম। শুভ রাত্রি।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো উচ্ছ্বাস। মেয়েটা তো ভারি বেয়াদব! তার সঙ্গে চালাকও বটে। সম্মানও দিলো আবার অসম্মানও করল! ততক্ষণে পূর্বের ন্যায় চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে সায়রী। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে আজ ভীষণ ক্লান্ত। ঘুম ছাড়া আজ রাতে যেনো তার আর কোনো কাজই নেই।
উচ্ছ্বাস দুঃখ করে বললো,”আচ্ছা সায়রী আমি কী কখনো তোমার কোনো ক্ষতি করেছি? কই এমন কিছু করেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না। তাহলে কেন আমার সঙ্গে এতো ছলনা করছো সায়রী সুন্দরী? বলতে পারবে?রোমান্স যখন করবেই না তাহলে এই অবলা পুরুষকে এন্টারটেইনমেন্টের প্রলোভন দেখিয়ে কেন বিয়ে করলে? আজ তোমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।”
সায়রী চোখ বন্ধ করেই রিনরিনে কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল,”বিদায়ের সময় আমি যখন আবেগে কেঁদে দিয়েছিলাম তখন আপনি হাসলেন কেন? আমার আবেগ, আমার কান্না দেখে আপনার হাসি পেয়েছে উচ্ছ্বাস? ছিহ্!”
ভড়কে গেলো উচ্ছ্বাস। ভুলবশত না হয় একটু হেসেই ফেলেছিল তাও আবার মুখ চেপে সবার আড়ালে। সেই দৃশ্যটাও এই ধুরন্ধর বউ কিনা দেখে ফেললো? আচ্ছা এই মেয়ের কয়টা চোখ? বাহ্যিক ভাবে তো দেখা যাচ্ছে দুটোই। তাহলে? উচ্ছ্বাসের নিরবতায় চোখ জোড়া খুলে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সায়রী। স্ত্রীর এমন চাহনিতে কৃত্রিম হাসলো উচ্ছ্বাস। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চঞ্চল কণ্ঠে বললো,”আহারে আমার বউটা কত্ত ক্লান্ত! নাও বউ এখন একটু চোখটা বুজে ঘুমাও। ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো…”
উচ্ছ্বাসের হাতটা ঝামটা মেরে নিজ মাথা থেকে সরিয়ে দিলো সায়রী। যার কারণে মাঝপথেই অসমাপ্ত হয়ে থেমে গেলো কবিতাটি। বিপরীতে আর কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টো পাশে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল উচ্ছ্বাস। কতগুলো মেয়ের হৃদয় ভেঙে সায়রীকে বিয়ে করেছিল ছেলেটা অথচ আজ বাসর ঘরে কিনা এতো অপমান? না এ যেনো কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
চলবে _________