উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত সায়রী পর্ব-০১

0
1364

#সূচনা_পর্ব
#উচ্ছ্বাসে_উচ্ছ্বসিত_সায়রী
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই

“বিয়ে করবে না বলে শেষমেশ কিনা ন্যাড়া হয়ে গেলে সায়রী?”

কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হকচকিয়ে ওঠে সায়রী। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পুরোনো এবং অতি গোপনীয় কথা বাহিরের মানুষের মুখ থেকে শুনে সর্বাঙ্গ ঘিরে ধরে লজ্জায়। জড়তা নিয়ে শুধায়,”কে বলেছে আপনাকে?”

“সে যেই বলুক না কেন, কথাটা তো সত্যি তাই না? ছিঃ ছিঃ শেষে কিনা ন্যাড়া বউ ছিলো এই পোড়া কপালে?”

ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয় সায়রী। সন্দিহান দৃষ্টি মেলে তাকায়। প্রশ্ন করে,”ন্যাড়া বউ মানে? কার কপালে ন্যাড়া বউ আছে?”

ভড়কে যায় উচ্ছ্বাস। আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
“কেন? তোমার ভবিষ্যৎ স্বামীর কপালে।”

“চুল কেটেছি প্রায় আট মাস হতে চললো, ন্যাড়া মাথায় অলরেডি বিশাল বিশাল চুল গজিয়েছে। তাছাড়া ভবিষ্যৎ স্বামীর দেখা পেতে পেতেও সেই চুল আরো লম্বা হয়ে যাবে তাই আপনাকে আর আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না।”

“ভাবতে হবে না বললেই হলো? অবশ্যই ভাবতে হবে। সিনিয়র হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না? ইদানিং তোমার বাপ যা শুরু করেছে তা তো আর হতে দেওয়া যায় না। দুদিন পরপর কোত্থেকে না কোত্থেকে নতুন নতুন পাত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে। আর এদিকে আমার হয়েছে যত জ্বালা।”

চট করে মেজাজটা বিগড়ে গেলো সায়রীর।বিপরীতে কড়া কিছু বলে দেওয়ার জন্য অধর জোড়া প্রসারিত করতেই ভেতর ঘর থেকে ভেসে এলো মায়ের কৌতূহলী কণ্ঠস্বর,”কে এসেছে সায়রী? কার সঙ্গে কথা বলিস?”

মায়ের মতোই উঁচু কণ্ঠে সায়রী বলে উঠলো,”উচ্ছ্বাস এসেছে মা। তোমার সঙ্গে নাকি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

মুহুর্তেই চোখেমুখে আঁধার এবং বিরক্তি নেমে আসে উচ্ছ্বাসের। মুখ বাঁকিয়ে বলে,”এখনো বড়োদের ঠিকমতো সম্মান করতেই শিখলে না সায়রী?দিনদিন তুমি আস্ত একটা বেয়াদবে পরিণত হচ্ছো। কতবার বলেছি নাম ধরে ডাকবে না। ভাই বলবে ভাই।”

“আপনি আমার কোথাকার কোন ভাই লাগেন যে ভাই ডাকবো?”

“তাই বলে নাম ধরে ডাকবে? আমি বয়সে তোমার থেকে গুণে গুণে চার বছরের বড়ো, ভুলে যেও না সে কথা।”

“নাম ধরেই তো ডেকেছি, তুই তুকারি তো আর করিনি।”

কথার মধ্যিখানেই চলে আসেন সায়রীর মা সুবর্ণা রহমান। তাকে দেখতেই উচ্ছ্বাস চটপট প্রশ্ন করে বসে,”এত বড়ো ডিঙি একটি মেয়ে ন্যাড়া হলো আর আপনি তাকে আটকালেন না শুভ আন্টি? লোকে জানলে বলবে কী?”

“আপনি জানালেই লোকে জানবে। আপনি যেই কুইটনার কুইটনা, দেখা যাবে একটু পরই মসজিদের মাইকে গিয়ে বেসুরা কণ্ঠস্বরে হাঁক ছেড়ে বলবেন, ভাই সাব আপনারা কে কোথায় আছেন? এদিকে তপন রেজার কন্যা সায়রী রেজা তো ন্যাড়া হয়ে গেছে। শুনুন উচ্ছ্বাস, সত্যি সত্যি যদি এ কথা আপনি কাউকে বলেন তাহলে আপনাকে আমি আর এ বাড়িতে কখনোই ডুকতে দিবো না।”—রাগান্বিত স্বরে কথাটি বলে স্থান ত্যাগ করে সায়রী।

তার কথায় দমে না উচ্ছ্বাস। পেছন থেকে বিদ্রুপ করে বলে ওঠে,”তোমাদের বাড়িতে ঢুকতে না দিলে যেনো পুকুরে ঝাপ দিয়ে মরে যাবো আমি? নেহাৎ শুভ আন্টিকে আমি আমার মায়ের চোখে দেখি তাই ভালোবাসার টানে, উনাকে এক পলক দেখার জন্যে ছুটে আসি তাতেই কত অপমানের শিকার হতে হয়।”

কথাটা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস। আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওঠেন সুবর্ণা রহমান। এই একটা মাত্র ছেলে কী ভালোটাই না বাসে উনাকে। সারা জীবন সবাই শুধু সুবর্ণা নামেই সম্বোধন করে এসেছে। স্বামীও এর ব্যতীক্রম নন। সন্তান হওয়ার আগে ডাকতেন সুবর্ণা বলে আর সন্তান হওয়ার পর ডাকেন সায়ানের মা বলে। অথচ এই ছেলেটা! কী সুন্দর করেই না সম্বোধন করে ‘শুভ আন্টি’। শুনলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় সুবর্ণার।

আহ্লাদে গদগদ হয়ে উচ্ছ্বাসের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব রাখলেন,”কাচ্চি রান্না করেছিলাম বাবা একটু যদি টেস্ট করে বলতে কেমন হয়েছে?”

“দুপুরের খাবার খেয়েই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি শুভ আন্টি। পেটে একটু জায়গাও খালি নেই।”

অধরের হাসিটা এক নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেলো সুবর্ণা রহমানের। হাসি মিলিয়ে যাওয়ার কারণ খুব সহজেই ধরে ফেললো উচ্ছ্বাস। সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুত হাসলো। বললো,”আপনি যেহেতু রান্না করেছেন নিশ্চয়ই খাবারটা অনেক সুস্বাদু হয়েছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে পেটে এখনো একটু জায়গা আছে, দিন তবে একটু খেয়ে দেখি।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই পূর্বের হাসিটা আবারো স্থান পেলো সুবর্ণার মুখে। বললেন,”চলো তবে খাবার টেবিলে।”

“না না আন্টি ভেতরে আর যাবো না, এখানেই আনুন।”

“আচ্ছা তবে বসো।”

দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন সুবর্ণা। কয়েক মিনিট বাদে কাঁচের প্লেটে করে নিয়ে এলেন কাচ্চি। তার মধ্যে বিশাল সাইজের দুটো গোশত এবং আলু উঁকি দিচ্ছে। হাস্যজ্জ্বল মুখে এক লোকমা কাচ্চী মুখে তুলতেই কুঁচকে গেলো উচ্ছ্বাসের চোখমুখ।

সুবর্ণা রহমান আগ্ৰহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। পল্লব ঝাপটে শুধালেন,”কেমন হয়েছে খেতে?”

মুখের খাবারটুকু জোরপূর্বক গিলে ফেললো উচ্ছ্বাস। নরম চিত্তে বললো,”খুব ভালো হয়েছে শুভ আন্টি। আপনার হাতে সত্যিই জাদু আছে। তবে ইদানিং ধরে লবণ খাওয়াটা না আমি ছেড়ে দিয়েছি তাই হয়তো লবণ একটু বেশি মনে হলো। লবণ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকারক কিনা।”

তৎক্ষণাৎ কাচ্চি একটু চেখে দেখলেন সুবর্ণা রহমান। জিভে কামড় দিয়ে বলে উঠলেন,”দেখেছো কাণ্ড? ভুল করে কতগুলো লবণ দিয়ে ফেলেছি! এখন সবাই খাবে কী করে?”

“আহা আন্টি এত বছর ধরে রান্না করে আসছেন সবসময় কী আর এক রকম হয় নাকি? মাঝেমধ্যে একটু ভুল করতে হয়। এক কাজ করবেন, দই দিয়ে সালাদ তৈরি করে বিরিয়ানির সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে নিবেন আর নুনতা লাগবে না।”

চোখ জোড়া পানিতে চিকচিক করে উঠলো সুবর্ণা রহমানের। কী ভালো ছেলে! সহজেই কী সুন্দর একটা বুদ্ধি দিয়ে দিলো। উপস্থিত বুদ্ধির তারিফও করলেন মনে মনে। সুবর্ণাকে ভাবনার মধ্যে ডুব দিতে দেখেই সুযোগ বুঝে সেন্টার টেবিলটায় প্লেটটা রেখে হাত ধুয়ে এলো উচ্ছ্বাস। বিনয়ী সুরে বললো,”আজ তাহলে আসি শুভ আন্টি? সায়রীকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবেন কিন্তু। মা অনেকদিন ধরে আপনাদের স্মরণ করছেন, দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।”

“আসলে সংসারের ব্যস্ততায় সময়ই পাই না তবে ঠিক যাবো একদিন।”

আর বিলম্ব না করে বিদায় নিয়ে রেজা ভিলা থেকে বের হলো উচ্ছ্বাস। নিচে নেমেই পাশের মুদি দোকান থেকে দশ টাকা দামের একটি আইসক্রিম কিনে দ্রুত মুখে পুরে নিলো। আক্রোশে ভরা মন নিয়ে বললো,”অখাদ্য খেয়ে মুখটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এর থেকে আমার মায়ের রান্না হাজার গুণে ভালো।”

এবার কণ্ঠে জমা হলো আফসোস। আফসোস নিয়েই কথাটা শেষ করল,”হায় সায়রী! শুধুমাত্র তোমার জন্য তোমার মায়ের হাতের ওই অখাদ্য খাবার খেয়ে আজ মুখ নষ্ট করলাম আমি, সাথে নষ্ট হয়েছে মুডটাও। অথচ তুমি বুঝলে না আমার এই আত্মত্যাগ। কে বলেছিল? মেয়ে নয় বরং মেয়ের মাকে পটাও তাহলেই রাস্তা হবে ক্লিয়ার। তাকে যদি আজ সামনে পেতাম তাহলে এলাকার পোলাপাইন সঙ্গে নিয়ে রামধুলাই দিতাম।”

বিড়বিড় করতে করতেই উচ্ছ্বাসের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো উপরের দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই কিছুটা ঘাবড়ে গেলো সে।বারান্দার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সায়রী। দৃষ্টি তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্ছ্বাসের পানে। মুখ থেকে আইসক্রিমটা বের করে শূন্যে তা তুলে ধরলো উচ্ছ্বাস। দাঁত কেলিয়ে হেসে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,”খাবে?”

তৎক্ষণাৎ মুখ বাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেলো সায়রী। আর দাঁড়ালো না উচ্ছ্বাস। সামনে হাঁটা ধরলো সে। বিড়বিড় করে বললো,”মেয়ের ভাবখানা দেখে মনে হয় আমি যেনো তার জামাই লাগি। কত্তবড়ো সাহস! আমায় মুখ বাঁকায়?”

বাড়িতে ফিরতেই ড্রয়িং রুমে বাবার মুখোমুখি হতে হলো উচ্ছ্বাসকে। সাব্বির আহমেদ সোফায় বসে দুপুরের খবর দেখছেন টিভিতে। ছেলেকে দেখতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো উনার। আড়চোখে পিতার দিকে তাকিয়ে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালো উচ্ছ্বাস।

সাব্বির আহমেদ সুউচ্চ কণ্ঠে বলে ওঠেন,”ভর দুপুরে টইটই করে কোথায় ঘুরাফেরা হচ্ছিল? কতদিন বাবার ঘাড়ে বসে খাবে? বয়স তো কম হলো না। চাকরি বাকরির খোঁজ খবর কী রাখো?”

ভেতর থেকে ছুটে এলেন মা নেহার বেগম। স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,”আহা আবার কী হয়েছে? চেঁচামেচি করছো কেন ওর উপর? ছেলেটার বয়সই বা কত যে এখনি চাকরি বাকরি করতে হবে?”

“এসব বলে বলেই লাই দিয়ে মাথায় তুলো ছেলেকে। কম সিজিপিএ নিয়ে গ্ৰ্যাজুয়েশন কমপ্লিট করল। দেড় বছর ধরে বাড়িতে বসে আছে। কাজ বলতে খায়দায় আর টো টো করে সারা এলাকা চষে বেড়ায়। মেলামেশাও করে নিজের মতো ভাদাইম্মাদের সঙ্গে। অথচ ওর সঙ্গেই গ্ৰ্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মিনহাজুলের ছেলেটা ভালো চাকরি করছে। কদিন পর বিয়ে করবে। বাপের আশায় বসে নেই ওরা।”

নিরবে স্থান ত্যাগ করল উচ্ছ্বাস। পুত্রের এমন খাপছাড়া আচরণে অপমানিতবোধ করলেন সাব্বির আহমেদ। স্ত্রীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,”ছেলের সাহস দেখেছো? এখনি বাবাকে এড়িয়ে চলা শিখে গেছে! শুধু তোমার জন্য এখনো বাড়িতে ওকে রেখে দিয়েছি নইলে কবে ঘাড় ধরে বের করে দিতাম।”

নেহার বেগমও আর দাঁড়ালেন না। প্রস্থান করলেন দ্রুত পায়ে। এসব বাক্যের সঙ্গে পূর্ব পরিচিত তিনি তাই গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।

দুপুরের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে তপন রেজা এবং সায়রী। বড়ো ভাই সায়ান গিয়েছে বউয়ের সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি। ক’দিন ওখানেই থাকবে। সুবর্ণা খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও চেয়ার টেনে বসলেন। উচ্ছ্বাসের কথামতো ঘরে থাকা টকদই এবং শসা দিয়ে সালাদ বানিয়েছেন ইউটিউব দেখে। মুখে এক লোকমা তুলতেই তপন রেজা কুঁচকে নিলেন চোখমুখ।বলে উঠলেন,”বাজার থেকে আনা সব লবণ কী একসঙ্গে ঢেলে দিয়েছো কাচ্চিতে? রান্নার সময় মন থাকে কোথায়? মানুষ একটু চেখেও তো দেখে নাকি? লবণ কম হলেও না হয় মানা যেতো কিন্তু এখন কী করবো? এখন তো লবণ বেশি।”

“সালাদ দিয়ে মেখে খাও আর নুনতা লাগবে না।”

“এসব আজাইরা বুদ্ধি পাও কোথায়?”

বাবার মতোই সায়রীও কুঁচকে নেয় চোখমুখ। বলে ওঠে,”তুমি তো জানো মা আমি এই সালাদটা মোটেও পছন্দ করি না। তাহলে আমি খাবো কীভাবে?”

বিরক্ত হলেন সুবর্ণা। তেজীয়ান কণ্ঠে বললেন,”এই একই কাচ্চি উচ্ছ্বাসও তো টেস্ট করল কই তোমাদের মতো করে তো অপমান করে কিছু বললো না। বরং সুন্দর করে ভুল ধরিয়ে দিলো আবার এই সালাদের বুদ্ধিটাও সেই দিলো। এই মুহূর্তে খুব আফসোস হচ্ছে আমার। তুমি না হয় আমার স্বামী। স্বামীদের স্বভাবই বউদের ভুল পেলে লাফিয়ে ওঠা কিন্তু ও আমার মেয়ে হয়ে কীভাবে এ কথা বলে? কীভাবে পারে আমার ভুল ধরতে?”

অভিমান করে ঘরে চলে গেলেন সুবর্ণা। সায়রী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বিড়বিড় করে বললো,”এই উচ্ছ্বাস দিনদিন আমার জীবনের সব উচ্ছ্বাস কেড়ে নিচ্ছে একদম।”
________

ক্যালেন্ডারে অগ্ৰহায়ণ শেষ হয়ে পৌষের আগমন। বেলা পর্যন্ত চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা থাকে। দুপুরে যা একটু রোদ ওঠে আবার বিকেলের আগেই চলে যায় তা। শীতের পোশাক পরে তার উপর আবার একটা চাদর মুড়িয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে সায়রী। তিনটে বিল্ডিং পার হয়ে পাশের গলিতে মোড় নিলেই দ্বিতীয় যেই বাড়িটি পড়ে তা হচ্ছে তপন রেজার আপন ছোটো ভাই মশিউরের বাড়ি। মোড়ে ঘুরতেই ভ্রু দ্বয় কুঁচকে গেলো সায়রীর।

রাস্তার বিপরীতে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে উচ্ছ্বাস। ধরানো শেষ হতেই দেহের সর্বশক্তি দিয়ে টান দিলো তাতে, তারপর আকাশের দিকে মুখ করে ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে চুমুক মারলো ডান হাতে থাকা কোকের বোতলে। তার এহেন কাণ্ডে চমকায় সায়রী। উপস্থিত মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি চাপে। দ্রুত মোবাইল বের করে ভিডিও অন করে। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে উচ্ছ্বাসের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো দাঁড়িয়ে থাকা সায়রীর পানে। অর্ধ খাওয়া সিগারেটটা দ্রুত নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। গাঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। একপ্রকার ছুটে আসা ধরলো এদিকে যা বুঝতে পেরেই এক দৌড় মারলো সায়রী। তার পেছন পেছন বড়ো বড়ো কদম ফেলে হাঁটছে উচ্ছ্বাস।লোক লজ্জায় বেচারা দৌড়াতে পারছে না। যদি বাবার কাছে নালিশ চলে যায়, রাস্তা ঘাটে মেয়েদের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করে সে? তখন কী হবে? আর কিছু হোক বা না হোক মাথার উপরের ছাদটা যে নির্ঘাত যাবে।

চিৎকার করে ডাকলো,”এই সায়রী দৌড়াচ্ছো কেন? দাঁড়াও একটু।”

দৌড়ে চাচার বাড়ির গেইটের ভেতরে ঢুকে গেলো সায়রী। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো চাচাতো বোন আফরিন। হাঁফাতে হাঁফাতে সোফায় গিয়ে বসলো সায়রী। বললো,”একটু পানি দে।”

আফরিন চটজলদি পানি নিয়ে এলো। এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের অর্ধেকটা পানি শেষ করে গ্লাসটা সেন্টার টেবিলে রেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সায়রী। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন চাচী রেবেকা। শুধালেন,”হাঁফাচ্ছিস কেন? নিশ্চয়ই দৌড়ে এসেছিস?”

“আর বলো না চাচী, আসার সময় পাগলা কু’কুরে তাড়া করেছিল। কু’কুর দেখলে তো এমনিতেই আমি ভয় পাই তার উপর পাগলা কু’কুর!”

আফরিন চমকিত কণ্ঠে শুধালো,”পাগলা কু’কুর! এখানে পাগলা কু’কুর কোত্থেকে আসবে আপু?”

“সেসব ছাড়, আমার এসাইনমেন্টের কী খবর? কমপ্লিট হয়েছে সব? কাল কিন্তু জমা দিতে হবে।”

“হুম সব কমপ্লিট, ঘরে এসো।”

আফরিনের পিছুপিছু তার ঘরে এলো সায়রী। বসে পড়ল নরম বিছানায়। পড়ার টেবিল থেকে তিনটে ফাইল এনে সায়রীর পাশে তা রাখলো আফরিন। বিলম্ব না করে ফাইল গুলো নিজ হাতে নিয়ে সফেদ পৃষ্ঠা গুলো উল্টে পাল্টে দেখে স্লান হাসলো সায়রী। চাচাতো বোনের দিকে বাড়িয়ে দিলো একটা লিপস্টিকের বক্স।মুহুর্তেই অধরে হাসি ফোটে উঠলো আফরিনের। নিজ হাতে বক্সটা নিয়ে খুলতেই চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠলো,”বারোটা লিপস্টিক!”

“হুম, তিনটে এসাইনমেন্ট তৈরি করে দেওয়ার জন্য ছয়টা লিপস্টিক।”

“আর বাকি ছয়টা?”

বোকা হাসলো সায়রী। হাতে থাকা শপিং ব্যাগ থেকে আরো তিনটে ফাইল বের করে এগিয়ে দিলো। বললো,”সামনের সপ্তাহে এই তিনটা জমা দিতে হবে। একটু করে দিস প্লিজ। বাকি ছয়টা লিপস্টিক তোর জন্য অগ্ৰীম উপহার।”

মুখখানা চুপসে গেলো আফরিনের। অসহায় মুখ করে বললো,”ফাইল তিনটে হলে কী হবে আপু? পেইজ সংখ্যা অনেক। লিখতে লিখতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে তার উপর আর কদিন পর আমার এইচএসসি পরীক্ষা।”

তার পরিস্থিতি বুঝতে পারলো সায়রী। মৃদু হেসে বললো,”ওহ, আচ্ছা সমস্যা নেই। এগুলো আমি না হয় ম্যানেজ করে নিবো। আজ আসি তাহলে।”

“এলেই তো এখন।”

“এগুলো নিতে এসেছিলাম। মন দিয়ে লেখাপড়া কর তাহলে।”

সবার থেকে বিদায় নিয়ে গেইট দিয়ে বের হতেই পা দুটো থমকে দাঁড়ায় সায়রীর। ভেতরে গিয়ে উচ্ছ্বাসের কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল সে। গেইটের পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। সায়রীকে দেখতেই হাস্যজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এলো। ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে নিলো সায়রী। শুধালো,”হাবলার মতো পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

“ফটো তুলেছো নাকি ভিডিও করেছো? সে যাই করো না কেন ডিলেট করো।”

“কীসের কথা বলছেন বুঝলাম না।”

উচ্ছ্বাস চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,”সিগারেট খাওয়ার সময় যে মোবাইল তাক করে ভিডিও করলে সেটা ডিলেট করো।”

“আপনার ভিডিও করতে আমার বয়েই গেছে। দরকার হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনি গাঁজা খান তাতে আমার কী? সরুন বাড়ি যাবো।”

আচমকা সায়রীর হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিলো উচ্ছ্বাস। তৎক্ষণাৎ চটে গেলো সায়রী।রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,”এগুলো কী ধরণের অসভ্যতামি?”

তার কোনো কথাতেই কর্ণপাত করল না উচ্ছ্বাস। মোবাইল অন করতেই দেখতে পেলো পাসওয়ার্ড চাইছে। সায়রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “পাসওয়ার্ড কী?”

“জানি না।”

“প্লিজ ডিলেট করে দাও না সায়রী সুন্দরী।”-আকুতি ভরা কণ্ঠে বলে উঠলো উচ্ছ্বাস।

মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে মুখ বাঁকালো সায়রী। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো,”আমার মায়ের সামনে ভালো সাজা? এবার সবার হোয়াটসঅ্যাপে এই ভিডিওটা আমি পাঠিয়ে দিবো। শ্লা সিগারেট খোর।”

“শ্লা বললে আমায়?”

উত্তর দিলো না সায়রী। তার সামনে এসে এবার কংক্রিটের রাস্তায় বসে পড়ে উচ্ছ্বাস। আহত দৃষ্টি মেলে তাকায়। মিনমিনে স্বরে বলে,”এটা দেখার পর বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে সায়রী। বেকার মানুষ আমি, কোথায় যাবো তখন? কী খাবো?”

“সিগারেট খাওয়ার সময় মনে ছিলো না?”

“প্লিজ সায়রী, আমার এতো বড়ো একটা ক্ষতি করো না।”

সায়রীর মাথায় নতুন আরেকটি বুদ্ধির উৎপত্তি হলো। বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”আচ্ছা উঠুন। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ডিলেট করা তো যাবে না। তবে আপনি চাইলে ভিডিওটা না হয় আমি কাউকে দেখাবো না কিন্তু এর জন্য একটা শর্ত আছে।”

উঠে দাঁড়ালো উচ্ছ্বাস। ললাটে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। বললো,”তুমিও তো একটা ন্যাড়া মেয়ে কই আমি তো কখনো কাউকে বলিনি যে সায়রী বিয়ে করবে না বলে ন্যাড়া হয়েছে।”

“বিয়ের সঙ্গে ন্যাড়া হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মাথায় ঘা হয়েছিল, ব্যথার জ্বালায় কেটে ফেলেছি সব চুল।”

“কই দেখি, হিজাব খুলো তো।”

“ইতর,অসভ্য কোথাকার! এখনো কী সেগুলো আছে নাকি?”

একসঙ্গে কথাগুলো বলে সামনে হাঁটা ধরলো সায়রী। বোকা বনে গেলো উচ্ছ্বাস।খারাপ কোনো ইঙ্গিত করে তো কথাটা বলেনি সে।তাহলে কী সায়রী ভুল বুঝলো তাকে? বুঝলে বুঝুক গিয়ে। দৌড়ে এসে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,”সব শর্তে রাজি আছি। তবুও কাউকে দেখিও না।”

দাঁড়িয়ে গেলো সায়রী। শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিলো উচ্ছ্বাসের দিকে। তার হাত থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো উচ্ছ্বাস। স্লান হেসে শুধালো,”আমার জন্য শপিং করেছো?”

“উহু, এতে আমার এসাইনমেন্টের কিছু খাতা আছে। সামনের সপ্তাহে জমা দিতে হবে। এসাইনমেন্ট গুলো করে রাখবেন। পাঁচদিন পর এসে নিয়ে যাবো আমি।”

হতবিহ্বল হয়ে গেলো উচ্ছ্বাস। যে ছেলে নিজের এসাইনমেন্টই নিজ হাতে কখনো করেনি বরং গার্লফ্রেন্ডদের দিয়ে করিয়েছে আজ সে কিনা আরেকজনের এসাইনমেন্ট করে দিবে? এত সময় কোথায়? চেঁচিয়ে বলে উঠলো,”নাআআআ এ হতে পারে না! আমার এসব এসাইনমেন্ট করার সময় কোথায় বলো? আমি একটা ব্যস্ত মানুষ সায়রী। খাওয়ার সময়টাও ঠিকমতো পাই না।”

“ব্যস্ত! আপনি ব্যস্ত? কাজের মধ্যে তো ওই চিপায় চাপায় সিগারেট টানা, বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করা আর মেয়েদের সঙ্গে ফ্লাটিং করা। শুনুন উচ্ছ্বাস, এসাইনমেন্ট না করে দিলে কিন্তু এই ভিডিও আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিবো। আমার এক বন্ধুর পেইজে পঞ্চাশ হাজার ফলোয়ার। তার পেইজে যদি ভিডিওটা ছাড়ি তাহলে রাতারাতি আপনি ভাইরাল হয়ে যাবেন। একবার ভাইরাল হলে কী হবে ভাবতে পারছেন? রাতারাতি তো সেলিব্রিটি বনে যাবেন! আঙ্কেলের হোয়াটসঅ্যাপেও পাঠাবো। এবার ভেবে দেখুন কী করবেন আপনি।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো উচ্ছ্বাস। কী এক মুসিবতে পড়তে হলো তাকে? মাথার উপরের ছাদটা টিকিয়ে রাখার জন্য এতগুলো এসাইনমেন্ট করতে হবে এখন? শপিং ব্যাগটা নিয়ে নিজের রাস্তায় হাঁটা ধরলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,”ফ্লাটিং তো সেই ছোটো বেলায় করেছিলাম এখন আর এসব করি না। অসহায় একটা ছেলেকে পেয়ে এমন করলে তাই না ন্যাড়া সায়রী? দোয়া করি তোমার কপালে যেনো একটা দজ্জাল শাশুড়ি জুটে।” বলেই দ্রুত জিভে কামড় বসালো উচ্ছ্বাস। নিজের গালে নিজেই চাটি মারলো আলতো করে। বললো,”উফ! ভুল বলে ফেললাম। আমার মা তো দজ্জাল নয়। শাশুড়ির জায়গায় শ্বশুর হবে। তোমার ভাগ্যে দজ্জাল শ্বশুর জুটবে।”

শেষের কথাটা উচ্ছ্বাস একেবারে বিড়বিড় করে বললো। এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সায়রী। যাই হোক এসাইনমেন্টের ব্যবস্থাটা তো হয়ে গেছে। এই সপ্তাহটা না হয় একটু শান্তিতেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

চলবে _______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে