#ইলশে_গুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৭
রেহনুমা বিরক্ত নিয়ে নিশির দিকে তাঁকালো। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কে বলবে এটা তাঁর মেয়ে। সে বিরক্তমাখা কন্ঠে বললো,— থামবে নিশি! এতো রিয়াক্ট করার মতো কিছু হয়নি। আমি সোহেলের সাথে কথা বলছি। এতো সোজা না রেহনুমার মেয়েকে ছুড়ে ফেলা।
নিশি নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাঁর মায়ের দিকে তাঁকালো। কেন তাঁর মাকে সে বুঝাতে পারছে না। ফিরে গিয়ে কি হবে। জোড় করে কি সংসার হয়। সোহেল আর তাঁর মধ্যে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কেন এতো পায়ে ধরতে হবে সে কি এতই ফেলনা।
সে আর কিছু বললো না। কিই বা হবে বলে! সে উঠে ধীরে ধীরে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো,— মেয়েদের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচা খুবই কষ্ট। তাঁর সব আছে তবুও সে বেড়িয়ে আসতে পারছে না। আর মেজো চাচী সে কিভাবে পেরেছিলো। তার তো কেওই ছিলো না। নিজের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে অনেক সাহসের প্রয়োজন। অনেক!
তখনি দৌঁড়ে দিসা আসলো। দরজায় টোকা দিয়ে বললো, — বড় চাচী আসবো?
রেহনুমা বিরক্ত মুখেই বললেন, — এসো! কি হয়েছে? এভাবে দৌঁড়াচ্ছো কেন? ঘরের ভিতরে এভাবে দৌঁড়া দৌঁড়ি আমি পছন্দ করি না। তুমি জানো না।
দিসার মুখ ভাঁড় হলো। সে তো তাঁদের জন্যই এসেছিলো।
— কি হলো! কথা বলছো না কেন?
দিসা মুখ ভাঁড় করেই বললো,— তিথি আপু হাবিব ভাইকে পাখি গুলোকে ছেড়ে দিতে বলেছে।
—- সে বললেই হবে , কে সে?
দিসা আর কিছু বললো না। ধূর! এখানে আসাই তাঁর ভুল হয়েছে।
রেহনুমা বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো! তাঁর মেজাজ অনেক খারাপ! একদিকে তাঁর ছেলে মেয়ে।কোন টাকেই সে বাগে আনতে পারছে না। আরেক দিকে মাহবুব। তাঁর কোন কাজই মাহবুবকে টলাতে পারছে না। তিথির সব ব্যাপারে সে নির্বাক।আর ঐ দিকে এই মেয়ে যা খুঁশি তাই করছে । সে উঠে দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে বললো,— চল আমার সাথে। এই মেয়ের আসল জায়গা তাঁর দেখাতেই হবে। দিনকে দিন মাথায় উঠছে।
রেহনুমা ঘরের পিছনে এসে দেখলো তিথি খাঁচার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর আশে পাশে পাখিগুলো উড়াউড়ি করছে। তাঁর মেজাজ খারাপ হলো। কোন সাহসে মেয়েটা এটার ভিতরে গেছে। এটা তাঁর মেয়ের। আর তাঁর, মেয়ের, ছেলের কিংবা সংসারে কোন কিছুতে তাঁর অনুমতি ছাড়া কেও কিছু করলে তাঁর সহ্য হয় না। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, — তিথি বাইরে আসো।
তিথির কোন ভাবান্তর হলো না। কিছুই হয় নি এমন ভাবে সে শুধু ফিরে তাঁকালো।
রেহনুমার শরীরে আগুন ধরে গেলো। অনেক দিন হলো সে রাগেনা। চারিদিকের ঝামেলায় সে নিজের কন্ট্রোল হারালো। সে চেঁচিয়ে বললো,– বাইরে এসো অসভ্য মেয়ে। এখন এই মুর্হুত্বে তুমি বাইরে আসবে
আর যদি না আসো তাহলে আজ এই মূর্হুত্বে তোমাকে ঘার ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করবো।
—- কি হয়েছে?
রেহনুমা চমকে চোখ তুলে তাঁকালো। দোতলার তাঁর রুমের বারান্দায় মাহবুব দাঁড়ানো। সে আজ এই সময় বাসায়? কই সে তো জানে না। তাঁর কন্ঠ নামলো, তবে সে দমলো না। মাহবুবের দিকে তাঁকিয়ে বললো,– দেখেছো মাহবুব! তোমার মেয়ে কতো অসভ্য। এতোবার করে বলছি এই মেয়ে কথা কানেই নিচ্ছে না।
মাহবুব নির্বকার ভাবে বললো,— কি বলেছো তুমি?
—- আমি তো বলিনি! বলছে তো তোমার মেয়ে। এই পাখিগুলো ছেড়ে দিতে। কতো বড় স্পর্ধা। আমার মেয়ের…
রেহনুমা কথা পুরো করতে পারলো না। তাঁর আগেই মাহবুব বললো, — হাবিব।
— জ্বি স্যার।
—- পাখিগুলো ছেড়ে দাও। বলেই মাহবুব ভিতরে চলে গেলো।
রেহনুমা স্তব্ধ! শুধু সে না বাকি সবাইও স্তব্ধ!
তিথি শীতল চোখে রেহনুমা দিকে তাঁকালো তাঁর মুখে বাঁকা হাসি।
রেহনুমা আগুন চোখে তিথিকে কিছুক্ষণ দেখলো। তাঁর শরীর রাগে কাঁপছে। মে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে এলো।
___-
রেহনুমা রাগে দরজায় নক না করেই সোজা ভেতরে ঢুকলো। রাগে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। তাঁর হিতাহিত জ্ঞান নেই। সে খেয়ালও করলো না তাঁর পেছন পেছন সবাই চলে এসেছে।
মাহবুব শান্ত ভাবে রেহনুমা দিকে তাঁকালো। তাঁকিয়ে বললো,— ভদ্রতা ভুলে গেছো? কেওর রুমে আসার আগে নক করতে হয়।
রেহনুমা দাঁত চিবিয়ে বললো—- আমি কেওর রুমে আসিনি মাহবুব।
মাহবুব হাসলো! হেসে বললো,— তো! কার রুমে এসেছো? বন্ধু,প্রেমিক, দেবর নাকি নিজের বড় একটা অস্ত্র। যাকে দিয়ে চালের পর চাল দিচ্ছো।
রেহনুমা অবাক হয়ে তাঁকালো। এ কোন মাহবুবকে দেখছে সে। এতো তাঁর সেই চিরচেনা মাহবুব না। সে কেঁদে ফেলে বললো,— এতো দিন পরে এসে তোমার এই মনে হচ্ছে মাহবুব ? কি না করেছি আমি তোমাদের জন্য। নিজের সব বিলিয়ে দিয়েছি আর আজ ঐ তাইয়্যেবার মেয়ের জন্য আমাকে কথা শুনাচ্ছো। যে কিনা তোমাকে ফেলে চলে গেছে।
মাহবুব গর্জে উঠলো! আর বললো, —
তিথি আমারও মেয়ে রেহনুমা । আমার! সে আমার আর তাইয়্যেবার মেয়ে। আর তাইয়্যেবা আমাকে ফেলে যায়নি। তুমি বাধ্য করেছিলে তাঁকে ।
রেহনুমা থমকে গেলো। মাহবুব তাঁর সাথে চিৎকার করে কথা বলছে। এ কোন মাহবুবকে দেখছে সে?
মাহবুব রেহনুমার দিকে তাঁকিয়ে বললো,— তুমি কেওর জন্যই কিছু করোনি। যা করেছো তা হলো নিজের জন্য। প্রথমে বড় লোক বাপের ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করেছো। বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে এ বাড়িতে এসেছো,থেকেছো। সবার মন জয় করেছো। আরাম, আয়েশ টাকা দেখে আমার প্রেমিকা হয়েছো। কিন্তু যখন দেখেছো আমার বউ হয়ে সেই সম্মান, সেই ক্ষমতা কখনও পাবে না তখন আমার বড় ভাইকে ধরেছো। তাঁরাতো আর জানতো না আমার সাথে তোমার কি সম্পর্ক। তাঁরা ভাবতো আমরা শুধু বন্ধু। তাই বড় ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখে। আর তুমি সব কিছু এমন ভাবে সাজিয়েছো যেন মা, বাবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছো। না করলে তাঁরা খুবই কষ্ট পাবে। আর আমিও ছিলাম বোকা চোখ বন্ধ করে তোমার সব কথা বিশ্বাস করেছি। তুমি তোমার জীবন, তোমার স্বামী, তোমার সংসার নিয়ে সুখে থেকেছো। কই তখন আমার কথা তো চিন্তা করোনি। চিন্তা তো করতে শুরু করলে তখন থেকে যখন দেখলে, তোমার স্বামী শুধু নামেই এই বাড়ির বড় ছেলে। কাজের ক্ষেএে তো এই মাহবুব। তখন তোমার হিসেব আবার এলোমেলো হলো। তুমি আমাকে ভালো করেই জানতে। যতই ভালোবাসিনা কেন? বড় ভাইয়ের বউকে আমি কখনও অন্য চোখে দেখবো না। তাই প্লান অন্য ভাবে সাজালে। স্বামী, সংসার, দেবর দের এমন ভাবে আগলে ধরলে। তাঁরা তোমাকে ছাড়া যেন কিছুই না বোঝে। হলোও তাই। সব ক্ষমতা তোমার হাতে মুঠোয় । কিন্তু সমস্যা হলো মা যখন আমাকে বিয়ে করাতে চাইলেন। তুমি ভালো করেই জানতে বিয়ে হলেই তোমার এই ক্ষমতা থাকবে না। কারণ! যার স্বামীর ক্ষমতা বেশি তাঁর জোড়ও বেশি। তাই এমন একজন কে দরকার যে তোমার কথায় উঠবে আর বসবে। তাইয়্যেবা এতিম ছিলো। মামার বাড়িতে থাকতো। বাবার বন্ধুর মেয়ে হিসেবে বাবা খোঁজ খবর নিতো। তবে কখনও ছেলের বউ করার কথা চিন্তা করেনি। তবে তুমি তাঁকে ভাবতে বাধ্য করেছে। রগচটা, ঘাড়ত্যারা ছেলে তাঁর। এর জন্য এরকম মেয়েই ভালো। মাটি কামড়ে পরে থাকবে। এক দিকে বাবার ব্রেইন ওয়াস করেছো। আরেক দিকে আমাকে বুঝিয়েছো।
তোমাকে ছাড়া আমিতো আর কাওকে ভালোবাসতে পাড়বো না। তাই এরকম মেয়েই ভালো। সব জেনে শুনেই মুখ বুঝে থাকবে। এতো আরাম আয়েশ, টাকা, এরকম মেয়েদের এর চেয়ে বেশি কি চাই।
বাস আর যাবে কোথায়? তোমার মায়ায় থেকে বাঁচতে পারার ক্ষমতাতো আমাদের ছিলো না। বাস হয়ে গেলো বিয়ে। বিয়ের এক বছর পর্যন্ত তেমন কোন সমস্যা হলো না। সরল, সোজা মেয়ে তাইয়্যেবা। কোন চাওয়া পাওয়া নেই। বড় বোনের মতো মানে তোমায়। যেভাবে নাচাচ্ছো সেভাবেই নাচছে। সমস্যাতো শুরু হলো তো অন্য দিক দিয়ে। আমি তাইয়্যেবার প্রেমে পড়ে গেলাম। তাঁর সরলতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আর কেও না বুঝলেও তুমি বুঝে গেলে। আর তা তোমার সহ্য হলো না। যে তোমার জন্য পাগল ছিলো। সে সাধারণ একটা মেয়েকে ভালোবাসে এটা তুমি মানতে পারলে না। ব্যাস শুরু হলো নতুন করে চাল। আমিও বোকা সেই চালে পা দিলাম অনায়াসেই । তাইয়্যেবা কনসিভ করলো। তুমি ছলে বলে কৌশলে আমাকে বুঝাতে লাগলে এই বাচ্চা আমার না। আমি দু মাস কাজের জন্য মালেশিয়াতে ছিলাম সেটারি সুযোগ নিলে। তাঁর নাকি তাঁর মামাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। জানতাম কতোটা নিষ্পাপ, কতোটা পবিএ ছিলো আমার তাইয়্যেবা। তবুও তোমার কথা বিশ্বাস করে ফেললাম। দশটা মাস সে একা একা সাফার করলো। একই ছাদের নিচে থাকি আমি অথচো তাঁর দিকে ফিরেও তাকাই না। আমার মেয়ে প্রথম বার পৃথিবীর আলো দেখলো। আমি সেখানে নেই। তাইয়্যেবা মেয়েকে নিয়ে আমার অপেক্ষায় বসে থাকতো। তবুও আমি নেই। তবুও তাঁর আফসোস নেই, আক্ষেপ নেই, বুকে তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে সে পড়ে রইলো, ইট, পাথরের আমার এই মহলে।
মাহবুবের কন্ঠ নেমে এলো। তারপর ধীরে ধীরে বলল,— তবুও তাঁর প্রতি তোমার একটুও দয়া হলো না । এতোটুকুও না।
শেষ চালটা বড় কঠিন ভাবেই চাললে। বলে না সহ্যের ও একটা সীমা আছে। সে সব সহ্য করেছে, স্বামী অবেহেলা, স্বামীর ঘৃনা, তাঁর সন্তানের প্রতি অনাদর। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা! সে সহ্য করতে পারে নি। সেই দিন আমি স্টাডি রুমে ছিলাম। তুমি জানতে তাইয়্যেবা কিছুক্ষণ পরে এই দিক দিয়েই যাবে। দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলে। আর আমাদের পেছনের সব কথা একে একে বলতে লাগলে । আমি অবাক হয়ে গেলাম। এতোদিন পরে তুমি এসব কেন বলছো? বুঝতে পারলাম না। তাইয়্যেবা যেতেই তুমি স্বাভাবিক হয়ে আমাকে করুন ভাবে বললে,— “হঠাৎ করেই সব মনে পড়ে গেলো। আবেগের বসে জড়িয়ে ধরে ফেলেছো। আমি যেন তোমাকে ক্ষমা করে দেই”।আমি তখন বুঝতেই পারিনি কি করেছো তুমি।
সে সব মেনে আমাকে চেয়েছিলো কিন্তু বড় ভাবির সাথে সম্পর্ক সে মানতে পারেনি। সরল, সোজা তাইয়্যেবার মনে কতোখানি ঘৃণা তৈরি করেছিলে জানো তুমি? সেদিন থেকেই তাইয়্যেবা বদলে গেলো। হয়ে গেলো একদম চুপ। সেই চুপ হতে হতে হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে । আমি জানতেও পারলাম না। আর হারিয়ে যাওয়ার আগে সে আমাকে কি দিয়ে গেছে জানো রেহনুমা?
–“ডিভোর্স পেপার!
নাম মাএরও সম্পর্ক রাখতে চায় না সে। আর কি দিয়েছে জানো? প্রমাণ! তাঁর সম্মান আর সন্তানের প্রমাণ! ডিএনএ টেষ্ট পেপার।
কতো কষ্ট হয় জানো যখন নিজের সম্মানের আর সন্তানের পরিচয়ের প্রমাণ দিতে হয়। তুমি জানো রেহনুমা? জানোনা!
রেহনুমা ঢোক গিললো! গিলে মাহবুবের দিকে তাঁকালো। অনেক দিন পর আজ সেই পুরোনো মাহবুবকে দেখলো। সেই রাগ,সেই তেজ। যা যেতে যেতে তাইয়্যেবা নিয়ে গিয়েছিলো।
মাহবুব বড় একটা শ্বাস ফেললো। ফেলে আবার বললো,—” দাঁত থাকতে আমি দাঁতের মর্যাদা বুঝিনি। পাগলের মতো খুঁজেছি, এক বার পায়ে পরে ক্ষমা চাইতে চেয়েছি। আমার মেয়েকে একবার বুকে জড়াতে চেয়েছি। পাইনি! কোথাও পায়নি। সেই খবর কি তুমি রেখেছিলে। রাখোনি!
তখন তুমি আনন্দে উল্লাসে ব্যাস্ত। তুমি কি করেছো? কেন করেছো? কিভাবে করেছো? সেটা আমি ধীরে ধীরে বুঝেছি। তবুও আমি তোমাকে কিছুই বলিনি। এক ভালোবাসার অপরাধে তুমি আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছো, আমি কিছুই বলিনি। কেন জানো? আমি শেষ হয়ে গেছি, আমি আমার পরিবারকে শেষ করতে চাইনি। কারণ! তারা তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। আর যতোটুকু দোষ তোমার ছিলো তাঁর চেয়ে হাজার গুন বেশি আমার ছিলো। কেন আমি আমার ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখতে পারিনি। কেন আমি সরল, সোজা, নিষ্পাপ মেয়েটার দিকে একবারও তাঁকাইনি। কেন একবারও তাঁর দিকটা জানতে চাইনি।
চলবে…..