ইলশে গুঁড়ি পর্ব-০৬

0
4129

#ইলশে_গুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৬

তিথির ঘুম ভাঙলো অনেক সকালে। এখনও ভালো ভাবে আলো ফোটেনি। সে কালকে ঘুমিয়েছে তারাতারি। তাই তাঁর ঘুম ভেঙেছেও তারাতারি। সে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। পুরো বাড়ি স্তব্ধ। কালকে সবাই অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। তাই আজকে মনে হয় না কেও দশটার আগে ঘুম থেকে উঠবে। সে হেঁটে হেঁটে ছাদের দিকে গেলো। সেই দিনের পরে আর ছাদে যাওয়া হয় নি। আর লোকটার সাথে দেখাও হয়নি। না হয়েই ভালো হয়েছে। সেই দিন লোকটা নাকি তাঁকে কোলে করে ছাদ থেকে নেমেছে। ছিঃ ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। সে এসে প্রথমেই পুরো ছাদ একবার চক্কর খেলো। বলা তো যায় না কোথা খেকে হঠাৎ করে আবার বেড়িয়ে আসে। না! আজকে কেও নেই। সে স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলে ছাদের পেছন সাইডে এসে দাঁড়ালো। এখান থেকে পাখির খাঁচা পুরোটা দেখা যায়। পাখিগুলো ঝাপটা ঝাপটি করছে। তিথির দেখতে ভালো লাগছে।
— কফি?
তিথি ভয়ংকর ভাবে চমকে উঠলো।
তাঁর চমতে উঠা দেখে শোয়েব হেসে উঠলো। হেসে বললো,— রিল্যাক্স। আমি! ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
তিথি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারলো না এই লোকটা ছাদে কখন আসলো।
শোয়েব তাঁর চেহেরা দেখে হয়তো বুঝতে পারলো। তাই সে নিজে থেকেই বললো,— আমার দরজা সব সময়ই খোলা থাকে। রুম থেকেই দেখলাম আপনি ছাদের দিকে যাচ্ছেন। তাই ভাবলাম কফি নিয়ে যাই। প্রথম দেখাটা আমাদের ভালো হয় নি। দ্বিতীয়টায় শুধরাতে চাইছিলাম। তবে বুঝতে পারিনি এটাও এমন হবে।
তিথি কিছু বললো না। সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে ব্যাস্ত ।
— স্যরি!
তিথি ভ্রু কুচকে তাঁকালো। তাঁকিয়ে বললো, — কেন?
— এই যে দু- দুবার আমার জন্য ভয় পেলেন।
— এখানে তো আপনার কোন ফল্ট নেই। আপনি আপনার মতো ছিলেন। আপনাকে দেখে কেও ভয় পেলে সেই দায় তাঁর, আপনার না।

— কিছুটা দায় অবশ্যই আছে।

— তা আছে! যে হালে আছেন সে হালে কোন স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারে না।

শোয়েব হাসলো! হেসে কফি বাড়িয়ে বললো,– আপনার জন্যই এনেছিলাম। ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।

তিথি স্বাভাবিক ভাবেই কফি নিলো। অল্প করে কফিতে ঠোঁটও ছোয়ালো। ঘুম থেকে ওঠার কারনে তাঁর চোখ ফুলে আছে। এলোমেলো চুলে খোঁপা করার জন্য দুই সাইডে চুল বেড়িয়ে আছে। তেলচিটচিতে মুখ! শোয়েব সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।

— আপনার এই অবস্থা কেন?

শোয়েব হাসলো! হেসে বললো,— পালিয়ে আছি তো তাই।

— আমিও সে রকমই ভেবেছিলাম।

— কি রকম ভেবেছিলেন?

তিথি সোজাসুজি শোয়েবের চোখের দিকে তাঁকালো। তাঁর একটা বদ অভ্যাস আছে। সিরিয়াস কোন কথা সে অন্য দিকে তাঁকিয়ে বলতে পারে না। যা বলবে সোজাসুজি তাঁর দিকে তাঁকিয়েই বলবে। তিথি তাঁকিয়ে বলতে শুরু করলো আর খেয়াল করলো লোকাটার পুরো মুখ জঙ্গল হয়ে থাকলেও চোখ দুটি খুবই সচ্ছ। টলটলে পানির মতো।

— আপনি ফেমাস একজন মানুষ। আপনাকে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনেছি। আমি প্রচুর গল্পের বই পড়ি। সেখানে আপনারও কিছু বই আছে। আর তাছাড়া আপনার বাবা নামকরা একজন বিজনেসম্যান। তাঁর ছেলে এভাবে অন্যের বাড়িতে পরে থাকবে কেন? এর পিছনে একটাই কারণ হতে পারে। লুকিয়ে রাখা । বড়লোক বাপের ছেলেমেয়েরা কোন অন্যায় করলে। তাঁদের ধরে বেঁধে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আপনাকে দেয়নি। তাঁর কারণ! যেটা আপনি করেছেন, কারণটা সম্ভাবতো বড়, অনেক বড়। দেশ ছাড়তে গেলে ধরা পড়ার চাঞ্চ আছে। তাই আপনাকে দেশেই রেখেছেন। তবে এমন জায়গায় রেখেছেন। যেখানে পুলিশ চাইলেই ঝট করে আসতে পারবে না। নামিদামি লোকের বসতবাড়ি। সেখানে আসতে গেলেও অনেক প্রসেসিংয়ের ব্যাপার আছে। আর সেসব করতে করতে আপনাকে অনায়াসেই অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যাবে।

শোয়েব মুগ্ধ হয়ে তিথির কথা শুনলো। মেয়েটা হয়তো জানে না। সে যখন কথা বলে তাঁর ঠোঁটের নিচের তিলের ওঠানামা যে কোন পুরুষের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট । শোয়ের নিজের জন্য আনা কফিতে চমুক দিলো। দিয়ে বললো,–

— আপনার ধারণা ঠিক।

তিথি চুপচাপ কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থাকলো। তাঁরপরে বললো,— কি করেছেন আপনি?

শোয়েব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো —- মার্ডার।

তিথি আবারো চমকে উঠলো। সে এরকই কিছু একটা আন্দাজ করে ছিলো। তবুও তাঁর গলা শুকিয়ে আসলো। সে ঢোক গিলে বললো,— এই কথা কি এই বাড়ির সবাই জানে?

—- না! কেও জিজ্ঞেস করেনি! করলে অবশ্যই জানতো।
তিথির বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,— জানলেও অবশ্য কিছু আসতো যেতো না। আর আসে যায় না বলেই কেও জিজ্ঞেস করেনি। বড় লোক বাপের ছেলে মেয়েদের বড় বড় অপরাধ ছোট ছোট ভুলের মতো মনে হয়।
—- তা হয়।
— আপনার ভয় করছে না। আমাকে বললেন? আমিতো এই বাড়ির মানুষদের মতো না।

শোয়েব উচ্চস্বরে হেসে উঠলো, হেসে বললো,— আমি সত্য বলতে কখনই ভয় পাই না। সে যেই হোক! এটা আমার বাবা জানেন। জানেন বলেই তিনি আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন। আমি চাইলেও এ বাড়ির বাইরে যেতে পারবো না। যে পর্যন্ত তিনি না চাইবেন। তিনি তাঁর ছেলেকে বাঁচার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তবে বেশি দিন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আর রইলেন আপনি? যে নিজেই এসেছে কিছুদিনের জন্য, সে কেন অযথা ঝামেলা বাড়াতে চাইবে । আর তাছাড়া আপনি খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে আর সময়ও তো খুব একটা নেই তাই আপনি যার জন্য এসেছেন, তাই করবেন এর বাইরে এক সেকেন্ডও সময় ব্যায় করবেন না। আমি সেটা জানি।

তিথি বলতে ইচ্ছা করলো এতো সত্যবাদী হয়ে মার্ডারের মতো জঘন্য অপরাধ কেন করলেন। তবে বললো না। সে পাখির খাঁচার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাঁকিয়ে চুপচাপ বাকি কফি শেষ করলো। যেন শেষের কথাগুলো সে শুনতেই পাই নি।

___
নিশি এই বাড়িতে এসেছে আজ দুদিন। তাঁকে নিয়ে কেওর মাথাব্যাথা আছে কিনা সে বুঝতে পারছে না। মা আছে মার মতো। কি নিয়ে সে এতো ব্যাস্ত সে বুঝতে পারছে না। ইদানিং তাঁর মেজাজও থাকে গরম। কথা বলাই যায় না। বাবা আগের মতোই কোন হেলদোল নেই। নিধিকেতো চোখের দেখাও দেখা যায় না। বাড়িতে আসে অনেক রাতে।আর নোমান সে ঘর থেকে বেরোই না। কেমন পরিবার তাঁর। কার কাছে যাবে সে। তাঁর মাঝে মাঝে মনে হয় তারা সবাই কোন এক পাপের শাস্তি পাচ্ছে । তা না হলে সব থাকতেও সব কিছু এমন ছন্ন ছাড়া কেন?
এই যে সে নিজেই,সংসার করার জন্য কি না করলো। তাও তো কিছুই হচ্ছে না! মাকে সে এর আগেও কতবার বললো। সোহেল চেঞ্জ হচ্ছে। তাঁকে খুব একটা দেখতে পারে না। মা শুনে বলেছে,”মেয়েদের এতো নরম হলে চলে না। শক্ত হতে হয়। আর তাছারা পুরুষ মানুষরা টাকা হলে বাহিরে একটু আরেকটু ওরকম করেই। বাইরে যতো যাই করুক ঘরের বউ থাকে একটাই । আর ওই একটা বউর কাছেই শেষ মেষ ফিরে আসে। শুধু ফিরিয়ে আনার কৌশল জানতে হয়। ”

কৌশল! মায়ের কথা মতো কমতো করলো না সে। সত্যিই কি ফিরে এসেছে? সোহেল তাঁকে সোজাভাবে বলে দিয়েছে। “তাঁর সাথে আর থাকবে না। সে নাকি অন্য কাওকে ভালোবাসে।” ভালোবাসা! কি আশ্চর্যের একটা শব্দ। এতোদিন সংসার করে নাকি তাঁকে নাকি ভালোবাসে না। অথচো তাঁকেও সোহেল পছন্দ করেই বিয়ে করেছিলো।
নিশি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে দেখলো সে নোমানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তার সাগরে ডুবে হাঁটতে হাঁটতে কখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। সে দরজায় টোকা দিলো। এই ছেলেটা পুরো ঘর টো টো করে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু নিজের ঘরে কাওকে ঢুকতে দেবে না।
নোমান দরজা একটু ফাক করে মাথা বের করে বললো,— কি চাই আপা ?
নিশি বিরক্তি নিয়ে বললো,— তোর কাছে কি চাইবো আমি। সর ভিতরে যেতে দে।
—- যা বলার এখান থেকেই বলো। ভিতরে আসার কি দরকার।
— তুই সরবি?
নোমান অনিচ্ছা নিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।
নিশির ভিতরে আসতেই দম বন্ধ হওয়ার যোগার। সিগারেটের ধোয়ায় পুরো ঘর ভরে আছে। এখানে সেখানে রং তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নিশি আঁচল দিয়ে মুখ চেপে তারাতারি জানালা খুলে দিলো। খুলে নোমানের দিকে আগুন চোখে তাঁকিয়ে বললো,— কি অবস্থা তোর, এভাবে মানুষ থাকে।
নোমান হেসে খাঁটে বসলো। বসে বললো,— যখন একটা সত্যিকারে ঘর পাবো তখন গুছিয়ে রাখবো । সুন্দন করে থাকবো।
— তো এটা সত্যিকারের ঘর না?
— না! এটা হচ্ছে দাবার বোর্ড। ছলে বলে কৌশলে জিততেই হবে।
নিশি তাঁকিয়ে রইলো। সবাই বলে তাঁর ভাইটা খামখেয়ালী। দিন দুনিয়ার কোন হুশ নেই। সত্যিই কি নেই। নিশির চোখ পড়লো দরজার সাইডে ।অন্ধকারের জন্য এসে দেখতে পাইনি। সে এগিয়ে গেলো। একটা মেয়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁকিয়ে আছে। তাঁর মাথায় লম্বা বেনুণী। সামনে বাগান বিলাস ফুল। ছবিটা এতো সুন্দর। যেন কথা বলছে। নিশির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এই মেয়েটা তিথি।তাঁর সাথে এখনো কথা হয়নি। তবে সেদিনের গেট টুগেদারে মেয়েটাকে অনেক অপমান করা হয়েছে। দাদু এতো হইচইয়ের মধ্যে থাকে না। চাচ্চু ছিল উপরে আর ছোট চাচী সে তো শুধু মজা নেবে।ব্যাপার যার ই হোক। আর এই সুযোগটাই মা নিয়েছিলো। বাকি যারা আছে কেওই মার উপরে যাবে না। সবাই কে মা হাত করে রেখেছে। অথচো দেখো তাঁর নিজের ছেলেমেয়ের কোন খোঁজ খবর নেই। যাকে সে তাঁড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তাঁকে পাকাপোক্ত ভাবে রাখার ব্যবস্থা তাঁর ছেলে করছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে