#ইলশে_গুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৪
নোমানের দিকে চোখ পড়তেই তিথি চোখ ফিরিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। এই ছেলের দিকে তাঁকালেই তাঁর কেন জানি মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আজব এক চিড়িয়া। দিন নেই রাত নেই বাড়ির এখানে ওখানে পরে থাকে। নেশা টেশা করে কি না কে জানে! সিগারেট ছাড়া তো একবারো চোখে পরে না। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। তিথি তাঁর জীবনে এতো সিগারেট খোর ছেলে জীবনে দেখিনি। কিছুক্ষণ পর পরই দেখা যাবে বাড়ির চিপায় চাপায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। বাড়ির সবাই যেন দেখেও দেখে না। এক মাএ ছেলে বলে কথা। এই ছেলে নাকি আবার অফিসেও যায়। কখন যায় কে জানে? প্রায় সময়ই তো দেখে হাত পা ছড়িয়ে সোফার উপর পরে আছে। মাঝে মাঝে দেখে তো তিথির সন্দেহ ই হয় বেঁচে আছে তো।
তিথি বসতেই হালিমা এগিয়ে আসলো। ভাত দিতেই তিথি হাত উঠিয়ে মানা করলো। আর যেন কিছু না দেয়। তাঁর এসব ভালো লাগে না। সে ছোট বেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করেই অভ্যস্ত। মা ছিলো স্কুলের টিচার। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুলেই থাকতে হতো। যখন থেকে পারে, সব কিছু সে নিজেই করতো। বিশেষ করে খাবারটা। সে তাঁর পছন্দ মতো নিয়ে খেতে পছন্দ করে।
রেহনুমা আড়চোখে তিথির দিকে তাঁকালো। তিথির প্লেটে অল্প কিছু ভাত আর ছোট মাছের তরকারি ।মেয়েটার খাবার ভঙ্গিমাও মাহবুবের মতো । এই বাসায় ছোট মাছ কেও খুব একটা পছন্দ করে না। সেই হিসেবে রান্নাও খুব একটা হয় না। আজ তিথির জন্যই হয়েছে। এমন না সে বলেছে। সে হয়তো জানেও না। সে এই বাসার আসার সাথে সাথে মাহবুব হালিমাকে হুকুম জারি করেছে। দু-জন কাজের লোক যেন সব সময় তিথির আশেপাশে থাকে। তাঁর কি লাগবে না লাগবে, কি খাবে না খাবে, সব যেন সেই হিসেব মতোই হয়। তবে তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না। সে থাকবে তাঁর মতো। হালিমা খুবই চালাক মেয়ে। কি ভাবে কি করতে হয় সে ভালো করেই জানে। সে গত কয়েকদিন ঠিকিই খেয়াল করছে। তিথি মাংস টাংস খুব একটা প্লেটে নেয় না। গতকাল রাতে খেয়েছে শুধু ডাল আর সালাদ দিয়ে।
রেহনুমা পানি খেতে খেতে সবার দিকে তাঁকালো। আজ শক্রবার। তাই সবাই এক সাথেই খেতে বসেছে। তা না হলে দুপুরে খুব একটা কেও বাসায় থাকে না। মাহবুব তো থাকতোই না। সেটা দুপুর কি আর রাতে। তবে গত কিছুদিন প্রায় সময়ই বাসায় থাকে। আর কেন থাকে সেটা সে বুঝতে পারছে। আর এটাই তাঁর ভয়। শুধু ভয় না জেদ। তাইয়্যেবার প্রতি জেদ। এই যে মাহবুব খেতে খেতে কিছুক্ষণ পর পর মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়ে ঠিকমতো খেতে পারছে কিনা দেখছে। এটা তাঁর সহ্য হচ্ছে না। কেন হবে? মাহবুব তো তাইয়্যেবাকে ভালোবাসতো না। তবে কেন তাইয়্যেবার মেয়ের জন্য এতো দরদ। এই দরদ সে থাকতে দিবে না। এতো কষ্টের সব, এতো সহজে নষ্ট হতে দেবে না। কোন দিনও না। কিছু করতে হবে। তবে করবে টা কি? এই মেয়েটাকে সে বুঝতে পারছে না। কেনই বা এতোদিন পরে এসেছে সেটাও বুঝতে পারছে না। টাকা পয়সা, সয়-সম্পত্তির জন্য। মনে হয় না। মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যটা ভিন্ন। কেননা, টাকা পয়সার উদ্দেশ্য থাকলে বাবাকে হাত করতে চাইতো। সেটা এই মেয়ে করছে না। যতো সম্ভব মাহবুব কে এড়িয়ে চলছে। শুধু মাহবুব কে না বাড়ির সবাইকেই এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। শুধু চলা না । রেহনুমা খেয়াল করেছে সে কাওকেই কোন সম্বোধন করে না। এমনকি তাঁর বাবাকেও না। কথা বলে সম্বোধন এড়িয়ে। যেন এই সম্পর্কেগুলোকে সে স্বীকার করে না। তবে কেন এসেছে সে?
— তো তিথি! এখন কিসে পড়ছো তুমি ?
রেহনুমার ধ্যান ভাঙল চৈতির কথার শব্দে। সে তিথিকে কিছু একটা বলছে। সে দাঁতে দাঁত চাপলো। তাঁর বিরক্ত লাগছে। এই মেয়েকে নিয়ে সবার এতো আদিখ্যেতা তাঁর অসহ্য লাগছে।
তিথি চোখ তুলে তাঁকালো। প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছে তাঁর ছোট চাচী। তাঁর নাম চৈতি। সে একটা ব্যাংকে চাকরি করে। সংসারের কোন জুট ঝামেলায় নেই। বড় জায়ের ঘারে সব ফেলে সে নিশ্চিন্তে বসবাস করে।
তিথি মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না । সে স্বাভাবিক ভাবে বললো— আমি আপাততো কোন কিছুতেই পড়ছি না।
চৈতি একটু অবাক হলো। শুধু সে না। মাহবুব বাদে সবাই এখন তাঁকিয়ে আছে তিথির দিকে।
—কেন?
— এমনিই!
চৈতি ভ্রু কুচকালো। আবার কিছু বলার আগেই তিথির বড় চাচা বললেন, — না পড়লে নাই। এতো কথা কিসের। এখন নতুন করে ভর্তি করাবো । তো কিসে ভর্তি হতে চাও মা বলতো?
—- কোন কিছুতেই না।
বলেই তিথি উঠে পড়লো। তাঁর খাওয়া শেষ। খাবার সময় এতো কথা তাঁর বিরক্ত লাগে। অথচো এই মানুষগুলো হয়তো পারিবারিক সব কথা খাবার টেবিলেই বলে। অথচো তাঁর মা! খাবার সময় কথা বললে বলতো, “খাবারও একটা ইবাদত, ইবাদতের সময় যেমন কথা বলা ঠিক না, তেমনি খাবারের সময়ও না। খাবার খেতে হবে শান্তি আর তৃপ্তি নিয়ে।
তিথি চলে গেলো। রেখে গেলো একদল স্তব্ধ মানুষকে।
তিথির বড় চাচা মাহবুব কে বললো, — কি বলে তোর মেয়ে?
মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,— ওকে ওর মতো থাকতে দাও।
—আমার একটা কথা ছিলো।
মাহবুব রেহনুমার দিকে তাঁকালো। তবে কিছু বললো না।
— আমি চাচ্ছি আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে একটা গেট টুগেদার করতে। যেহেতু তোমার মেয়ে এসেছে।সবাইকে তো জানানো দরকার। পরে সবাই তো আমাকেই কথা শুনাবে।
মাহবুব উঠে দাঁড়ালো। তাঁর খাওয়া অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তাঁর খাবার দাবার খুবই অল্প। শুধু তিথির জন্যই বসে ছিলো। মেয়েটাকে কি করে না করে দেখতে ভালো লাগে। কখনও তো সেভাবে কাছে পাইনি।
যেতে যেতে বললো, — তিথিকে জিজ্ঞেস করো! তাঁর যদি সমস্যা না থাকে। তবে করতে পারো।
রেহনুমার হাত থমকে গেছে। প্লেটে হাত রেখে সে চুপচাপ বসে আছে। তাঁর ভিতরে কি চলছে বোঝার উপায় নেই।
চৈতি রেহনুমার দিকে তাঁকিয়ে বিদ্রুপ ভাবে হাসলো। এবার উট এসেছে পাহাড়ের নিচে। সারাজীবন নিজের যা ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছে। কার কি সমস্যা হলো ধার ধরেছে সে। এখন পুচকে এক মেয়ের ইচ্ছেতে সব করো। হুহ্! বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে। বড় ভাবি যা বলবে, বড় ভাবি যা চাইবে। নিজের দেবরদের একেবারে হাতের মুঠোয় করে রেখেছে। বিশেষ করে মেজো ভাইকে। তাঁর সব ব্যাপারে সে খুবই কনসার্ন। প্রথম প্রথম তাঁর একটু চোখেই লাগতো। পরে যখন শুনেছে, এই বাড়ির বউ হওয়ার আগে থেকেই তাঁদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক, লেখা পড়াও করেছে একসাথে। তখন আর তেমন খুবটা মনে হয় নি। সে মেজো ভাবিকে দেখেনি। তাঁর বিয়ে হয়েছে অনেক পরে। তবে শুনেছে! ভাইয়ের সাথে খুব একটা নাকি বনাবনি ছিলোনা। ভাই নাকি মেজো ভাবিকে দেখতেই পারতো না। মেজো ভাবি ছিলো বাবার পছন্দের। তাঁর চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই নাকি বাবা মারা যান। অনেকে বলে সে নিজে থেকে চলে গেছে। আবার অনেকে বলে অন্য ছেলের সাথে ভেগে গেছে। সে সঠিক জানে না। তবে মেজো ভাইকে কখনও কোন মন্তব্য করতে শুনে নি। সে থাকতো নিজের মতো। তাঁর সামনে এই ব্যাপারে কেও তেমন একটা কথা বলে না। মা বিয়ের জন্যও অবশ্য অনেক চাপাচাপি ও করেছে। তবে তাঁর ‘না’ কে কেও ‘হ্যা’ করতে পারে নি।
চৈতি রেহনুমা দিকে আড়চোখে তাঁকালো ! আর মনে মনে বললো,— বাতাস সব সময় এক দিকে প্রবাহিত হয় না। এক সময় না এক সময় তাঁর পথ চেঞ্জ করবেই। শুধু সময়ের ব্যাপার। আজ তোমার দিকে, কাল অন্য কেওর দিকে।
—–
তিথি ছাদে এসে হতাশই হলো। এই বাড়ি দেখতে যতো সুন্দন ছাদ ততো না। তাঁর কাছে খা খা মরুভূমি মনে হচ্ছে। নিচে ফুলের বাগান থাকলেও, ছাদ পুরো ফাকা। সে বিশাল ছাদের এক সাইডে দাঁড়ালো। গত দু-দিন বৃষ্টি হয়েছে। তাই আজ আবহাওয়া ঠান্ডা। সে আকাশের দিকে তাঁকালো। মেঘ নেই তবে আকাশে কোন তারাও নেই। অন্ধকার ভরাছন্ন অকাশ। তিথি গুনগুন করে এক লাইন গাইলো,
“আজকের এই নিশী, ভালোবাসি ভালোবাসি। ”
বলেই তিথি থামলো। থামতেই ছাদের ও পাশ থেকে কেও একজন ভরাট গলায় বললো,–
“নিকষ মেঘে তোমার ওই চোখ, দেখেছি আজি আমি।”
তিথি চমকে গেলো। চমকে পেছনে ফিরতেই ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলে। ইয়া লম্বা একটা মানু্ষ, নাকি জ্বিন। তিথি বুঝতে পারলো না। শুধু বুঝলো তাঁর ভেতর থেকে কিছু একটা কেঁপে উঠছে। সেই কেঁপে উঠা থেকেই আধা আলো, আধা অন্ধকারে সে সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তির চোখ মুখ সে কিছুই দেখতে পেলো না। শুধু দেখলো ইয়া লম্বা লম্বা চুল আর দাঁড়ি। যে দাঁড়িয়ে আছে সাদা রঙের কিছু একটা পড়ে । তিথির আর কিছু ভাবতে পারলো না। সে ছাদে লুটিয়ে পড়লো।
চলবে……