ইতি মাধবীলতা পর্ব-৭

0
1901

ইতি মাধবীলতা – ৭ (ক)
আভা ইসলাম রাত্রি

খাবার ঘরের টেবিলে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার রাখা। চেয়ারে চেয়ারে বসা জমিদার বাড়ীর সকল পুরুষ। বাড়ীর স্ত্রীরা পুরুষদের খাবার বেড়ে দিতে ব্যস্ত। কিন্তু এত নারীর মধ্যে মাধবীলতার সুন্দর মুখখানা নিলাংসুর নজরে এলো না। খাবার চিবুতে চিবুতে একবার রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলো নিলাংসু। নাহ, সেখানেও তো নেই সে। কোথায় গেলো?
— বাবু, আরো একটা মাছের মাথা দেই তোকে?
রেখা দেবীর হাতে মাছের কৌটা। হাতে চামচ নিয়ে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন নিজের ছেলের দিকে। ছেলে একটা হ্যাঁ বলুক, মাছের বড় মাথাটা ছেলের পাতে তুলে দিতে একটুও বিলম্ব করবেন না তিনি। অথচ, নিলাংসু মাছের মাথার বদলে জিজ্ঞেস করে বসলো,
— মা, মাধবীলতা কোথায়? ওকে দেখছি না কেনো?

রেখা দেবী নিছক অসন্তুষ্ট হলেন বটে। চেহারাখানা থেকে থেকে থমথমে রূপ ধারণ করছে। ছেলে যে তার এত বউ পাগল হবে, সেটা তিনি কস্মিককালেও ভাবেন নি বাপু। না জানি, পাড়া-পরশি ছেলের এই বদল কি রূপে দেখে? বাইরে মুখ দেখাতেও আজকাল লজ্জা লাগে রেখা দেবীর। রেখা দেবী খচখচ কণ্ঠে জানালেন,
— সে তার ঘরেই বসে আছে। আমাকে সাঁধ দেওয়ার সময় কই তার?
নিলাংসুর বদন গম্ভীর হয়ে গেলো। সে নিছক স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— তাকে কাজ করার জন্যে সুযোগ দিলেই তো সে তোমায় সাঁধ দেবে, মা। তাকে ছোট জাত বলে অবহেলা না করে, একবার কাছে টেনে নিলেই পারো। তোমার কাছে সে অনন্য নারী রূপেই ঠেকবে।

রেখা দেবী উত্তর দিলেন না। মনে মনে সুধালেন, ‘ হুহ, ওই বেহায়া জাতের মেয়েকে আমি নাকি উনুন স্পর্শ করতে দেবো? এতটাও বাজে দিন আসে নি আমার! ‘ তবে ছেলের সামনে এ কথা ভুলেও মুখ ছিঁড়ে বের করেন নি। নাহলে ছেলে তার গৃহত্যাগ করতে দুবারও ভাববে না। কি জেদী ছেলে তার!

— বাবা, একটা কথা জানানোর ছিলো!
সমরেশ ভট্ট চোখ তুলে তাকালেন। ভরাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— কি কথা?
— আমি এ মাসের শেষে শহরে চলে যাবো। ওখানের অনেক কাজ পড়ে গেছে। তাই ভাবছি, বাড়িতে বসে আর সময় নষ্ট না করার চেয়ে শহরের কাজগুলো শেষ করে ফেলা উত্তম।
— ওহ, সে খুব ভালো কথা!
— আমি মাধবীলতাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই, বাবা!

নিলাংসুর কথা শুনে সমরেশ ভট্টের চেহারার রঙ পাল্টে গেলো। অদ্ভুত চোখে তাকালেন নিলাংসুর পানে। অথচ, নিলাংসু নির্বিকার। সে স্থির চিত্তে খাবার গলাধঃকরনে ব্যস্ত। রেখা দেবীও নিজ স্বামীর মুখে চাওয়া-চাওয়ী করছেন। সমরেশ ভট্ট স্ত্রীর দিকে ‘ খেয়ে ফেলা ‘ ধরনের ইশারা দিয়ে নিলাংসুর পানে তাকালেন। না চাইতেও বললেন,,
— তোমার স্ত্রীকে তুমি কোথায় রাখবে তা তুমিই ভালো জানো। আমাদের এখানে কি লেনা দেনা।

নিলাংসুর মন প্রসন্ন হলো। সে খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজ কক্ষে চলে এলো।
_______________________________
মাধবী বারান্দায় আরাম কেদারায় নির্বিঘ্নে বসে ছিলো। মাথার কেশ খোলা, হাওয়ার তালে দুলছে ইতি-ওতি। পায়ের রূপালি নূপুর ঝনঝনিয়ে শব্দ তুলে সম্মোহন করছে আশপাশ। এমন সময়ে সেথায় আগমন ঘটলো নিলাংসুর।

নিজের চুলের ভাঁজে কারো মুখশ্রীর উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো মাধবীর। মাধবী জানে, সে কে? মাধবীর রাগ হলো খুব। সে সরে যেতে চাইলো। তবে, পেটের উপর রাখা নিলাংসুর হাতের বন্ধনে আটকা পড়লো আকস্মিক। নিলাংসুর থুতনি মাধবীর ঘাড় স্পর্শ করলো। নিলাংসু চোখ বুজে ফিসফিসিয়ে বললো,
— মেয়েরা হলো পৃথ্বীর সবচেয়ে রহস্যময়ী। তাদের মুখের লাবণ্যতা হলো সে রহস্যের সর্বোচ্চ পর্যায়। যে একবার নারীর মুখের পানে তাকায়, সেই কবি হয়ে যায়, দেওলিয়া হয়ে যায়। উন্মাদতা তার রক্তে রক্তে মিশে যায়। যেমনটা হয়েছি, আমি স্বয়ং।

নিলাংসুর কণ্ঠে প্রেমপ্রেম বাক্য শুনে মাধবীর আত্মা যেনো কিছুক্ষণের জন্যে দেহ ত্যাগ করলো। সে নিসার হয়ে বসে রইলো নিজ স্থানে। পরক্ষণেই, নিজের রণমূর্তি রূপে ফিরে এসে এক ছিটকে সরে এলো নিলাংসুর থেকে। অথচ, নিলাংসু নির্বিকার হয়েই রয়।

রাগে মাধবীর ঠোঁট কেপে উঠলো। সে গা কাপিয়ে বললো,
— আপনি হলেন আস্ত এক কাপুরুষ। নাহলে আমার সম্মতি ছাড়া বিয়ে করে আমায় এ নরকে আমায় এনে ফেলতে পারতেন না। আমার ভালবাসা অর্জন করে আমায় যথাযথ সম্মান দিয়ে এ জমিদার বাড়িতে তোলার যোগ্যতাই আপনার নেই। কিসের জমিদার পুত্র আপনি?

মাধবীর কথা শুনে নির্বিকার নিলাংসুর মাথায় এবার যেনো আগুন চেপে উঠলো। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো মাধবীর পানে। মাধবীর নরম গাল দু আঙুলের সাথে চেপে ধরে গড়গড় কণ্ঠে বললো,
— তোমায় আমি আমাকে ভালবাসার অধিকার দিয়েছি। কিন্তু আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার আমি তোমায় একটুও দেইনি। আর কিসের যোগ্যতার কথা বলো তুমি? আমি তোমায় বলিনি,আমি তোমায় ভালোবাসি? বলেছি, হাজারবার বলেছি। বারবার তোমার মনের দরজায় কড়া নেড়েছি। কিন্তু তুমি কি করেছ? আমায় বারবার ফিরিয়ে দিয়েছ। যে ছেলের স্ত্রী হওয়ার জন্যে নারীর অভাব হবে না, সেই ছেলে বারবার এক সামান্য বেদের মেয়ে পেছনে ঘুরে বেড়িয়েছে। শুধুমাত্র তোমার একটুখানি ভালোবাসার জন্য! সমাজের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি শুধুমাত্র তোমায় বিয়ে করেছি। এ সব কিছুর মুলে আছে এইটাই কারণ! আমার তোমার প্রতি ভালোবাসা। অথচ, আফসোস! তুমি তা বুঝলে না!

মাধবীর গাল নিলাংসুর আঙ্গুলের চাপে পিষে যাচ্ছে। গালের হাড্ডি বোধহয় আজ ভেঙেই যাবে। নিলাংসু যা যা বলছে সবই সত্যি। সে মাধবী জানে। কিন্তু এতদিন যে ভয়ের জন্যে নিলাংসুকে বারবার অবহেলা করে এসেছে, আজ সেই ভয়টাই মাধবীর জন্যে মহাকাল ডেকে এনেছে। অথচ, আফসোস! নিলাংসু তা বুঝলো না!

#চলবে

ইতি মাধবীলতা – ৭ (খ)
আভা ইসলাম রাত্রি
নিচের নোটটা পড়বেন!

জমিদার বাড়ীর উঠোনে বিশাল এক বাগান। বাগানে কি যে সুন্দর সুন্দর ফুলের চারা! ফুলের সুবাসে চারপাশটা যেনো নদীর ঢেউ এর ন্যায় ভেসে যায়। বাগানের কারবারির জন্যে লোকও তো কম না। প্রায় তিনজন মালি দিনরাত এই বাগানের সৌন্দর্য বর্ধনে মত্ত! একটু আগে মেঝো কাকী মাধবীকে এসে বলেছেন, ‘ বাগানটায় নাকি পোকার উপদ্রব হয়েছে আজকাল। একটুখানি দেখে আসতে। ‘ বিষয়টা বেশ অবাক করা ছিলো। এমনিতে এ বাড়ির কেউ মাধবীকে কিছু ছুঁতে দেয়না। সেখানে এত শখের বাগান দেখতে যেতে বলছেন? তবে মাধবী দিরুক্ত করলো না। চুলের তেলটা আবারও জায়গায় রেখে পা বাড়ালো বাগানের দিকে।

মাধবী চোখে জমিদার বাড়ীর বাগানের সৌন্দর্য ভেসে উঠতেই মুখটা বিস্ময়ে ‘হ’ আকৃতির ধারণ করলো। এত সুন্দর বাগানও হয় বুঝি? যেনো সাক্ষাৎ মায়ের হাতে গড়া! মাধবী রিতা মাধবীলতা ফুল স্পর্শ করলো। ইশ, ফুলের নরম গা যেনো শরীরে কাঁটা দিচ্ছে! মাধবী মালিনী কে জিজ্ঞেস করে বসলো,
— এই চারাগুলো কে লাগিয়েছে গো?

মালিনী আগাছা কাটতে কাটতে নম্র কণ্ঠে উত্তর দিলো,
— বড় কত্তা, কত্তি! তেনার গাছের কি শখ! বিদেশ থেকে গাছ এনে একানে লাগান। দিনরাত নজর রাকেন গাছগুলোর উপ্রে। গাছের এত্তু অযত্ন হলে, আমাদের তো আবার বকতে গিয়ে নিস্তার ছাড়েন।

মাধবী মনে মনে বেশ খানিক অবাক হলো। মানুষটার কত শত অদ্ভুত শখ! সারাদিন বাইরে থেকে এসবের উপর নজর রাখার সময় পান বুঝি? মাধবী প্রশ্ন করলো,
— তোমাদের বড় কর্তার আর কি কি শখ আছে?
— তেনার তো শখের বিশাল কারবার গো, কত্তি! বড় কত্তার কুত্তা পালার শখ আছে। এ বাড়িতে তো ছিল দুটো কুত্তা। নাম কি যেনো….. ওহ হ্যাঁ, হেবন আর হিল! একটা বেটি কুত্তা, একটা ব্যাটা কুত্তা। ওরা একন বড় কত্তার লগে শহরে থাকে।

‘হেবন আর হিল’ এটা আবার কি ধরনের নাম? মাধবী কিছু একটা ভেবে শুধরে দেবার চেষ্টায় বললো,
— হ্যাভেন আর হেল?
মালিনী জিভে কামড় দিলো। মাথা চুলকে বললো,
— হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঐটাই। কুত্তার আবার নাম? কি আর কমু! সবই বড় কত্তার দয়া!

মাধবী হেসে ফেললো মালিনির কথার ছন্দে। কি সুন্দর করে কথা বলে মহিলাটা! হঠাৎ মাধবীর মনে পড়লো, নিলাংসুর ছোট ভাই কোথায়? তাকে তো আর দেখেনি এ বাড়িতে? মাধবী কৌতুহল বশত প্রশ্ন করলো,
— আচ্ছা, উনার ছোট ভাই কোথায়? তাকে তো দেখিনি এ বাড়িতে!
— তেনি তো বাড়িতে থাকেন না গো কত্তি। বিদেশ থাকে বিদেশ!
— বিদেশ কোথায়?
— ওই যে, কলিকত্তা আছে না? ওকানেই!
— কলকাতা?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই।
— উনার কোনো বোন নেই?
— আছে তো। ছোটমা তো শহরে থাকেন, বড় কত্তার শহরের বাড়িতে। জানো কত্তি, আমাদের ছোটমা দেখতে একদম ম্যাম সাহেবের মতন। বাড়ির সবচেয়ে ছোট কিনা, কত্তা বাবুর খুব আদুরের। তাই তো বাড়ির মেয়েকে অতদূর পড়তে পাঠালেন।

নিলাংসুর সম্পর্কে এতকিছু জানতে পেরে মাধবীর কেনো যেনো বেশ লাগলো। মনের মাঝে চিকন সুরের বাদ্য বাজলো ক্রমাগত, অবিরাম! মাধবী আর কিছুক্ষণ বাগানটা দেখেশুনে বাড়ির ভেতর চলে এলো। বাগানটা ঘুরে আজ মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।
_________________________________
রাতের খাবার পর্ব বেশ সুষ্টভাবেই সম্পন্ন হলো। নিলাংসু বাবার সাথে রাজনৈতিক বিষয়ে দরকারি কথাবার্তা সেরে মাত্রই নিজ কক্ষে প্রবেশ করলো। মাধবী তখন চুলের জট ছাড়ছিলো। নিলাংসু সেদিকে একপল চেয়ে আলমারীর দিকে পা বাড়ালো। জরুরি নতিপত্র ঘাঁটাঘাটি করতে করতে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
— ব্যাগ-পত্তর তৈরি করো। আমরা দুদিন পর শহরে যাচ্ছি।

নিলাংসুর কথায় মাধবী বেশ খানিকটা অবাক হলো। সে চুলের ভাঁজ যেমন তেমন রেখে ফিরলো নিলাংসুর পানে। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
— শহরে? কেনো?
— আমি শহরে কাজ করি। জানো তো তা? নাকি নিজের পতি কি কাজ করে সেটাও ভুলে বসে আছো?

মাধবী ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিলাংসুর পানে। এ বাড়িতে এসে জতদূর শুনেছে, নিলাংসু বাংলার এক নামিদামি নেতা। পাকিস্তানিদের কাছেও তার বেশ হাকডাক। নেতা দেখেই বুঝি শহরে থাকেন তিনি? মাধবী ত্যাড়া কণ্ঠে বললো,
— আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাইনা। আপনার যেতে হলে, আপনি যান। আমায় টানছেন কেনো এর মধ্যে? আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসুন, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

নিলাংসু কিঞ্চিৎ হাসলো। নতিপত্র পুনরায় যথা স্থানে রেখে আলমারির কপাট বন্ধ করে দিলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মাধবীর পানে। মাধবী কিছুটা পিছিয়ে গেলো তাতে। হুট করে নিলাংসু মাধবীর কপালে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করলো। মাধবীর মনে হলো, তার রক্ত হঠাৎ করেই উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে। তার সর্বাঙ্গ শিরশির করছে। মাধবী সরিয়ে দিতে চাইলো নিলাংসুকে। তবে নিলাংসুর এমন শক্ত ও ভারী দেহখানা একটুও সরাতে পারলো না। অতঃপর, নিলাংসু ঠোঁট মাধবীর কানের লতিতে স্থাপন করলো। ফিচেল কণ্ঠে বললো,
— যে একবার আমার খাঁচায় বন্ধি হয়ে যায়, তার নাম বাইরের দুনিয়া থেকে চিরতরে মুছে যায়। আমার খাঁচা থেকে তোমাকে একটা জিনিসই মুক্ত করতে পারে…মৃত্যু!

মাধবীর চোখ বড় হয়ে গেলো। সে খামচে ধরলো নিজের হাঁটুর কাছের শাড়ী। একটু আগে এ কি বললো নিলাংসু? নিলাংসু সরে এলো। হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গা থেকে পাঞ্জাবি ছাড়াতে ছাড়াতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
— চিন্তা করো না। এত সহজে মৃত্যু তোমায় পাকড়াও করতে পারবে না। আমি আছি তো! ভয় পেও না।

মাধবী তখনো শক্ত দেহে নিজ স্থানে স্থির! বুকের ভেতরটা দ্রিমদ্রিম শব্দ করছে। প্রাণ পাখি বোধহয় এখনি দেহ ত্যাগ করবে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে