ইতি মাধবীলতা পর্ব-১০

0
1737

ইতি মাধবীলতা – ১০(ক)
আভা ইসলাম রাত্রি

আগামীকাল নিলাংসু জমিদার বাড়ি ছেড়ে শহরের পথে রওনা হবে। নিলাংসুর মঙ্গলের উদ্দেশ্যে জমিদার বাড়িতে পূঁজোর আয়োজন করা হয়েছে। সে কারণেই সক্কাল সক্কাল বাড়ি যেনো আলোয় আলোয় পূর্ণ হয়েছে। জমিদার বাড়ীর পূঁজো ঘরটায় শ্রী কৃষ্ণের মূর্তির সামনে সাজানো হয়েছে ফুলের ঢালা, পূঁজোর লাড্ডু আর কতকি! এ যেনো এক
এলাহী কাণ্ড!
জমিদার বাড়ীর পূজো গ্রামে বেশ সমাদৃত! তাই তো ভোর হতেই পূঁজোর উদ্দেশ্যে এ বাড়িতে বহু লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। মাধবী নিজ কক্ষে বসে গীতা পাঠ করছিল। সেসময় রেখা দেবী প্রবেশ করলেন সে কক্ষে। তার হাতে বেতের এক সুন্দর ঢালা। মাধবী রেখা দেবীর আগমন উপলব্ধি করতে পেরে গীতা পাঠ বন্ধ করলো। সসম্মানের সহিত পবিত্র গীতাকে যথাস্থানে রেখে রেখা দেবীর মুখোমুখি হলো সে। নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু বলবেন?
রেখা দেবী মুখশ্রী কঠিন করে হাতের ঢালা মাধবীর দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন,
— এখানে আজ’গের পূঁজোর জন্যে শাড়ি আর কিছু গহনা আছে। তৈরি হয়ে নাও। আমি চাইনা, গ্রামের কেউ জমিদার বাড়ীর পুত্রবধূকে দেখে নাক কুঁচকাক।

মাধবী কিঞ্চিৎ হাসলো। অদ্ভুত ভাবে তার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাস! মনে মনে কয়েকবার আউড়ে নিল সে ‘মহিলাটা ভীষণ স্বার্থপর’ ..মাধবী হাত বাড়িয়ে ঢালা নিজের কাছে নিল। মৃদু হেসে বললো,
— মানুষের আর কি দোষ! নিজ বাড়ীর মানুষ যেমন, গ্রামের মানুষদের তেমনই হওয়া বাঞ্ছনীয়। বরং তারা তেমন না হলে তা বেশ সন্দেহজনক বটে।

রেখা দেবী মাধবীর নম্র কণ্ঠে বলা বজ্রধ্বনিতে বেশ অপমানিত হলেন। তিনি বেজায় রেগে বললেন,
— তোমার স্পর্ধা আমায় ক্রমশ অবাক করছে! ভুলে যেও না, তুমি এক সামান্য বেদের মেয়ে। এত অহংকার তোমার কণ্ঠে শোভা পায়না।
— আমি সত্য বলতে কুন্ঠিত হইনা! একে যদি আপনি অহংকার বলে আখ্যায়িত করতে চান, তবে আমার কোনো আফসোস নেই।

রেখা দেবী বড়ই আশ্চর্য্য হলেন। অপমানে তার গা রি রি করে উঠলো। মাথার রক্ত টগবগ-টগবগ করে ফুটতে লাগলো ক্রমাগত। সামান্য দু পয়সার মেয়ের মুখে এরূপ কঠিন কথা তার সহ্য হলো না। তিনি পড়ে যাওয়া আঁচল কাঁধে তুলে হনহনিয়ে মাধবীর কক্ষ পরিত্যাগ করলেন। মাধবী সেদিকে চেয়ে কুটিল হাসলো। জাত পাতের গর্ব এ বাড়ীর সবাইকে অন্ধ করে রেখেছে। চোখ থাকতেও চোখের কি নিদারুণ অপচয়, আফসোস!
___________________________
লাল পাড়ের সাদা শাড়ি! এ যেনো সাক্ষাৎ দেবী দূর্গার অন্য রূপ! কানে ঝুমকো, নাকে নথ! হাত-পায়ের লাল টকটকে আলতা! নখে লাল রঙের মেহেদী! এ এক অপরুপা নারী! মাধবীর এ রূপ আজ যেনো ঝলসে দেবে এ ভুবন। মাধবী এই রূপ দেখে জমিদার বাড়িতে আগত সবাই বিস্মিত! চোখে অপার মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে ধরণীতে নেমে আসা দূর্গা’মাকে! মাধবী জমিদার বাড়িতে আগত সব মহিলাদের সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠলো। সবার মুখে একটাই বাক্য, ‘এ কি নারী নাকি সাক্ষাৎ মা?’

— বড় কত্তি, বড় কত্তা ডাক’চেন আপনারে।
দাসীর কথা শুনে মাধবী বেশ বিরক্ত হলো। তবে মুখে হাসি স্থাপন করে বললো,
— আসছি আমি।
দাসী নতমুখে স্থান প্রস্থান করলো। মাধবী সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে বিদায় দিয়ে নিলাংসুর কক্ষের পানে পা বাড়ালো।

নিলাংসু কক্ষে থাকা বিশালাকার দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল। গায়ে তার জড়ানো ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি! ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এ পুরুষকে দেখে মাধবীর সুপ্ত মনে বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠলো। বিধাতার নিজ হাতে গড়া যেনো এ পুরুষ! কিছুক্ষণ আগ অব্দি মাধবীর মেজাজ বিশ্রী থাকলেও নিলাংসুর এহেন সুদর্শন দেহখানা দেখে তার মন প্রসন্ন হলো। সে ধীর পায়ে নিলাংসুর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ডেকেছিলেন?

এতদিন পর নিজ বধূর মুখে নরম কণ্ঠ শুনে একপ্রকার স্তব্ধই হলো নিলাংসু। সে চকিতে পেছন ফিরল। চক্ষু দ্বারা মাধবীকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করতেই মাধবী অস্বস্তিতে জমে উঠলো। নিলাংসু কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
— আজ আমার বাঘিনী এরূপ শীতল কেনো?

মাধবী বেশ অপ্রস্তুত হলো। নিলাংসুর বাক্য শুনে সে নিজেও বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। আসলেই কি সে আজ বাঘিনী থেকে শীতল রূপ ধারণ করেছে? কই, সে তো তা বুঝতে পারছে না! মাধবী কাঁধের আঁচল অদক্ষ হস্তে ঠিকঠাক করতে করতে উত্তর করলো,
— যে জন্যে ডেকেছিলেন তাই বলুন। অযথা কথা বাড়িয়ে আমার সময় অপচয় করবেন না।

নিলাংসুর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে ভারী হলো কক্ষের শীতল বায়ু। নিলাংসু স্বাভাবিক হয়ে বললো,
— আমরা কাল শহরে যাচ্ছি। তাই বলছিলাম, তুমি চাইলে তোমার বাবাকে দেখতে পারো। আমি তাকে খবর পাঠাবো আসার জন্যে।

মাধবীর সুন্দর মুখশ্রী এবার খানিকটা কঠিন হলো। সে বললো,
— তার কোনো প্রয়োজন নেই। এ বাড়িতে আমার বাবার দ্বিতীয়বার অপমান আমি সইতে পারবো না।

নিলাংসু মাধবীর পানে এগিয়ে এলো। মাধবীর কাঁধে দুহাত রেখে আশ্বস্ত করে বললো,
— চিন্তা নেই। আমি আছি তো। আমি থাকতে তোমার বাবার পুনরায় অপমান হবে না। ভরসা রাখো।

মাধবী চোখ তুলে তাকালো নিলাংসুর পানে। মন চাইছে, একটিবার মানুষটার উপর ভরসা রাখতে। মানুষটা কি তার ভরসার মূল্য রাখবে? মাধবী মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টানলো। অতঃপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রদান করলো। নিলাংসুর ঠোঁট যেন আপনা আপনি হেসে উঠলো। ‘এক সংসার জয় করার খুশি সে পেয়ে গেছে’ তার হাসি যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এ কথাই বলছে।

#চলবে

ইতি মাধবীলতা – ১০ (খ)
আভা ইসলাম রাত্রি

আর কিছুক্ষণ পর ঝলমলে জমিদার বাড়ি স্তব্ধ হয়ে যাবে। জমিদারের বড় পুত্র বাড়ি ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। রেখা দেবী আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে ক্রন্দন করছেন। শত-সহস্র অভিযোগ পুষে রাখছেন মনের অন্তঃস্থলে! পুত্র বিদায়ের শোক এ মাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলমান। জমিদার বাবুর বেলায় বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো! মাধবীকে সঙ্গে করে শহরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার একটুও ভালো লাগেনি। গ্রামে ছেড়ে চলে গেলে, তিনি নিলাংসুর আড়ালে এই বেদের মেয়ের কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু বড় পুত্রের রাগ এবং মেজাজ সম্পর্কে তিনি অবগত বিধায় এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলার জো হয়নি তার। তাই মুখটি বুজে শুরু থেকে সব সহ্য করছেন।

নিলাংসু নিজ কক্ষে বসে নতিপত্র ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। মাধবী একপাশে ঠাঁট মেরে দাড়িয়ে রয়েছে। শহরে যেতে তার একটুও মন মানছে না। এই পাষাণ লোকের সাথে একা থাকবে ভাবতেই মনটা রুক্ষতায় পূর্ণ হয়ে উঠছে। মাধবী নিলাংসুর সামনে বসল। কোনোরূপ ভণিতা না করে সোজাসাপ্টা বললো,
— আমি যেতে চাইনা আপনার সাথে। আপনি আমায় নিজ বাড়ি রেখে আসুন।

নিলাংসুর ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হলো। সে মাথা তুলে মাধবীর পানে চোখ রাখলো। সহসা গম্ভীর কণ্ঠে জানালো,
— নিজের পরিবারের ক্ষতি চাইলে এখানে থেকে যেতে পারো। আমার কোনো আপসোস হবে না। বরং আজ থেকে প্রতিটা মুহূর্ত নরক যন্ত্রণায় কাটানোর জন্যে প্রস্তুত হও।

মাধবী স্তব্দ হয়ে পড়ল। নিলাংসুর এহেন জঘন্য কথা তার শিরদাঁড়া অব্দি কম্পিত করে তুললো। মাধবী অবাক কণ্ঠে বললো,
— আমার-আপনার সম্পর্কে আমার পরিবারকে টানছেন কেনো?
— তোমার পরিবারকে আমি না, বরং তুমি টানছো। কোনোরূপ বাক্য ক্ষয় না করে আমার সাথে শহরে চলো, তোমার পরিবারকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার!

মাধবী কথা ভুলতে ভুলে গেলো। মানুষটা বাইরে যতটা সুন্দর ভেতরটা ঠিক ততটাই বিশ্রী! এরূপ প্রাণ কাঁপানো বাক্য বলতে তার কি একটুও দ্বিধাবোধ হলো না? মাধবীর চক্ষু থেকে দুফোঁটা জল বিসর্জন গেলো। মাধবীর গালে অশ্রুর উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই শশব্যস্ত হয়ে উঠলো নিলাংসু। মাধবীর সামনে বসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
— আরে, আরে! কাঁদছ নাকি?
মাধবী ঘৃণায় মুখ আড়াল করলো। নিলাংসু কিঞ্চিৎ হাসলো। মাধবীর মাখনের মত গাল নিজ হাতের আজলায় নিয়ে নিবিড়ভাবে চুমু খেল তার চোখের ঠিক নিচটায়। ওষ্ঠ দ্বারা শুষে নিল মাধবীর চোখের নোনা জল। মাধবীর রাগ হলো খুব। ধাক্কায় সরিয়ে দিতে চাইলো এ পাষাণ লোককে। তবুও নিজের থেকে এক চুলও সরাতে পারলো না নিলাংসুর ভারী দেহখানা। হার মেনে নখের ধারালো আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো নিলাংসুর হস্ত। তবুও পুরুষটা নির্বিকার। নিলাংসুর এমন অনুভূতিপূর্ণ স্পর্শে ঘৃনায় চোখ বুজে এলো মাধবীর। মাধবী বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
— পাষাণ, নিষ্ঠুর লোক! ঘৃনা করি আপনাকে।

নিলাংসু ঠোঁট টেনে হাসলো। মাধবীর ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
— চিন্তা নেই, তোমার ঘৃণায়ও ভালোবাসা খুঁজে নেবো আমি।
__________________________
জমিদার বাড়ির সামনে পালকি বসে আছে। রেখা দেবী বরণ ঢালা হাতে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন পুত্র এবং পুত্রবধূকে! মাধবীর মায়াবী চোখ টলমল করছে। এ নারীর দুচোখে কেউ যেনো আস্ত এক সাগর পুষে রেখেছে।

আশীর্বাদ সম্পন্ন হলে রেখা দেবী হাতের ঢালা দাসীর হাতে সোপর্দ করলেন। নিলাংসু মাথা নুইয়ে ফেললো মায়ের সামনে। রেখা দেবী মুচকি হেসে নিলাংসুর ললাটে চুম্বন আঁকলেন। বললেন,
— ভালো থাকিস, বাবু। তোর সকল কর্ম সফল হউক। ভগবান তোর মঙ্গল করুক।

নিলাংসু মৃদু হেসে মাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলল,
— ভালো থেকো। আমি খুব জলদি ফিরবো।

নিজ ক্ষোভের কারণে জমিদার বাবু সেসময় নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে এলেন। নিলাংসু চারপাশে পরখ করে নিজের বাবাকে দেখতে পেলো না। সে মাকে প্রশ্ন করলো,
— মা, বাবা কোথায়?
রেখা দেবী আঁচল দিয়ে ভিজে চোখ মুছলেন। ধরা কণ্ঠে বললেন,
— তোর বাবা পাশের গ্রামে গেছেন, কি একটা কাজে।
নিলাংসু মনেমনে বেশ ক্ষয় হলো। বাবা যে ইচ্ছে করেই তার থেকে দূরে থাকছেন, বিষয়টা নিলাংসুর সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক মুহূর্তেই বুঝে ফেলল। তবে সে কোনো দিরুক্তি করলো না। বাবার যা মন চেয়েছে তিনি তাই করেছেন। এখন নিলাংসুর যা মন চাইবে, সে তাই করবে। অতঃপর, নিলাংসু মাধবীর হাতখানা আকড়ে পা বাড়ালো বাড়ীর বাইরে।

পালকিতে মাধবীকে প্রবেশ করিয়ে পালকির পর্দা মেলে দিল নিলাংসু। মাধবীর শাড়ির আঁচল একপাশে বেরিয়ে ছিল। নিলাংসু অতি যত্নে সে আঁচলটুকু পালকির ভেতরে রেখে দরজা আটকে দিলো। যাওয়ার আগে পেছন ফিরে পুনরায় দেখে নিল জমিদার বাড়িকে। পূর্বে যা ঘটেছিল, তা চাপা দিতে মাধবীর এ বাড়ি পরিত্যাগ করা জরুরি ছিল। নিলাংসু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। মনেমনে কয়েকবার আওরালো, ‘ যা আমি আড়াল করতে চাই, এ সংসারে কেউ তা প্রকাশ করতে পারে না। আপসোস, কি নির্বোধ এ সংসার! ‘

আজ থেকে মাধবী এবং নিলাংসুর জীবন নতুনভাবে শুরু হবে। এই নতুন জীবনে আসবে নানা চড়াই-উৎরাই। বাঁধাদের হারিয়ে জয় হবে ভালোবাসার। এক নতুন গল্পের সূচনা হবে এবার!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে