ইতি মাধবীলতা পর্ব-০৯

0
1718

ইতি মাধবীলতা – ৯
আভা ইসলাম রাত্রি

জমিদার বাড়ির উঠোনে মাটিতে বসে আছে দুজন কান্নারত কৃষক। ময়লা, ধুলোবালিতে ডুবে আছে তাদের জীর্ণশীর্ণ দেহখানা। ক্ষণে ক্ষণে দু হাত দিয়ে কপালে আঘাত করছে। অথচ, কৃষকদ্বয়ের এরূপ মরণ কান্না জমিদার বাবুর মনে কিঞ্চিৎ দুঃখবোধ সৃষ্টি করলো না। তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন,
— কি রে কৃষকের বাচ্চা। ছেলে হারিয়ে গেছে, এতে এত কান্নার কি আছে? এমনিতেও তোর তো ছেলে পালার সাধ্যটি নেই। দুবেলা দুমুঠো খেতে দিতে পারিস না তাদের। আবার তাদের হারানোর খবর নিয়ে এসে আমার বাড়ি নোংরা করছিস। যা যা, বাড়ি যা, বাড়ি যা।

গ্রামের একচ্ছত্র অধিপতি জমিদার বাবুর থেকেও যখন কোনো ভরসা পেলো না কৃষক দুটো। অতি দুঃখে তারা এবার যেনো মূর্ছা যাবে। কৃষক দুটো জমিদার বাবুর পা আকড়ে ধরলো। পায়ে নিজেদের মাথা ঘষে বিলাপ করতে লাগলো,
— বাবু, আমার ছেলেকে খুঁজে দেন বাবু। আমার গিন্নি ওদের চিন্তায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছে, বাবু। বাবু, কিছু একটা করুন। আপনিই আমাদের আশা ভরসা বাবু। আপনি এমন কথা বললে আমরা কোথায় যাবো, বাবু?

অথচ, কৃষক দুজনের কান্না জমিদার বাবুর রুহ অব্দি পৌঁছাতে পারলো না। তিনি পা দিয়ে লাথি দিলেন কৃষকদের। লাথির আঘাতে কৃষক দুজন ছিটকে পড়লো মাটিতে। শক্ত মাঠির আঘাতে তাদের হাত, পায়ের ত্বক ছিলে গেলো। দু ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়লো তাদের কাঁটা স্থান হতে। জমিদার বাবু নিজ ধুতি সামলে চেয়ার ছাড়লেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের মেঝো ছেলে সত্যনারায়ণকে আদেশ দিলেন,
— এই নর্দমাগুলোকে বাড়ির বাইরে বের করে দে। খবরদার, এরা যেনো আর ভেতরে আসতে না পারে।

কৃষক দুটো কান্নায় ভেঙে পড়লো। কৃষ্ণবর্ণ মুখশ্রীতে কান্নার নোনা জলে এক লম্বাটে দাগ পড়ে গেলো। তাদের মাথা ক্রমাগত মাটি স্পর্শ করতে লাগলো। এক পুত্রহারা পিতা জানে পুত্রের কি মূল্য! তাদের কান্না সেথায় উপস্থিত সকল মানুষের চোখে জল এনে দিলেও, মন গললো না জমিদারের। তিনি হনহনিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। সত্যনারায়ণ বাবার আদেশ মতন কৃষক দুটোকে ধরেবেধে বাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে সদর দরজা আটকে দিলো। কৃষক দুটো সদর দরজার সামনে ঠাঁট মেরে বসে রইলো। তাদের বিলাপ করা দেখে রাস্তার মানুষজন একে একে স্বান্তনা দিতে লাগলো তাদের। কি আর করা যাবে! সবই জমিদার বাবুর দয়া!
এসব কিছুই দূর থেকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো নিলাংসু। নিজের বাবার এরূপ নির্মম আচরণ তার হৃদয়কে শক্ত করে তুললো। নিলাংসু বাবার পিঁছু পিঁছু বাড়ি অব্দি এগিয়ে এলো।

— বাবা, আপনার এ কাজটি করা মোটেও উচিৎ হয়নি।
নিলাংসুর কঠিন কথায় কোনোরূপ ভাবান্তর হলো না সমরেশ ভট্টের মনে। তিনি নিজমনে হুক্কায় সুখটান দিতে ব্যস্ত। নিলাংসু বাবাকে এরূপ নিরুত্তর লক্ষ্য করে পুনরায় বললো,
— কৃষক দুজন আপনার কাছে ভরসা পাওয়ার আশায় এসেছিল। কিন্তু আপনি কি করলেন? ওদের অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন? এ কি অন্যায় কাজ নয়?

জমিদার বাবু এবার মুখ খুললেন। খচখচ কণ্ঠে জানালেন,
— তবে কি তুমি আমার শেখাবে কোনটা অন্যায় আর কোনটা ন্যায়? ভুলে যেও না, আমি এ গ্রামের জমিদার! আমার একটা গর্জনে এই পুরো গ্রাম থরোথরো করে কাঁপে।

বাবার কথায় নিলাংসুর তরুণ রক্ত টগবগ করে উঠলো। এ সংসার নিজ হাতে ধ্বংস করে দেবার মনোবাসনা তৈরি হলো তার তরুণ মনে। নিলাংসু নিজের রাগকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টায় বললো,
— গ্রামের লোক আপনাকে সম্মান করে! তাই আপনার কি উচিৎ নয় তাদের এই সম্মানের মর্যাদা রাখা?

জমিদার বাবু সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভরাট কণ্ঠে বললেন,
— তোমার রক্ত এখন গরম। তাই এসব ভুলভাল বকছ। মনে রেখো, সবসময় উচিৎ অনুচিত ভেবে কাজ করতে নেই। মাঝেমধ্যে কড়া আচরন করা বাধ্যতামূলক। এতে আপনার সম্মান আরো সুদৃঢ় হয়।

নিলাংসুর ক্ষেপা মন চাইলো, বাবার বিরুদ্ধে কতক কটু কথা শুনিয়ে দিতে। তবে নিজের বাবাকে হেয় করার পাঠ সে পায়নি। তাই সে নম্র কণ্ঠে জানালো,
— এ আপনার ভুল ধারনা! আপনার এই অন্যায় কাজ সবার সামনে আপনার সম্মান উচুঁ করবে না। বরং সবাই আপনার জন্যে নিজ মনে ঘৃনা পোষণ করবে। আর মনে রাখবেন, গ্রামের লোক একবার বিদ্রোহ শুরু করলে, আপনার জমিদারি তখন ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। সেদিনের জন্যে প্রস্তুত হন।

নিলাংসু কথাটা বলে আর একটুও অপেক্ষা করলো না। বরং নিজের ধুতি সামলে হনহনিয়ে সে কক্ষ পরিত্যাগ করলো। জমিদার বাবু তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন। হুক্কার যন্ত্রটা থেকে ক্রমাগত ধোঁয়া বইছে। জমিদার বাবুর কপালের ভাজ ক্ষণে ক্ষণে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হচ্ছে। তিনি বুঝে গেছেন, তার বড় পুত্র হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব লাটাইটা নিজ দায়িত্বে নিতে হবে। এতে এ জমিদার বাড়ীর সবারই মঙ্গল সাধন হবে।
___________________________
— কাকামশাই?
কৃষকদুজন বটতলার নিচে বসে ক্রন্দন করছিল। নিলাংসুর কণ্ঠে শুনে তারা দুজনেই বেশ অবাক হয়ে তাকালো সামনে। জমিদারের বড় পুত্রের আগমন তাদের মনে আশার ক্ষীণ আলোর জোগান দিলো। তারা বট তলা ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। নিলাংসুর পায়ের কাছে মাথা লুটিয়ে আবারও চোখের জল ফেলতে লাগলো। বিলাপ করলো অবিরত,
— কত্তা বাবু, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন গো। আমার বুকের মানিককে আমার কোলে ফিরিয়ে দিন বাবু। ফিরিয়ে দিন!

নিলাংসু তাদের বাহু আকড়ে ধরে তাদের পাশে বসলো। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— মস্তিষ্কে চিন্তা নেবেন না। আমি খোঁজ লাগাচ্ছি আপনাদের ছেলের জন্য। ভগবানের কৃপায়, আপনারা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন আপনাদের পুত্রদের।

নিলাংসুর কথায় ভরসা খুঁজে পেলো কৃষক দুজন। তারা নিলাংসুর পায়ের কাছে মাথা ঠুকতে লাগলো ক্রমাগত। তবে নিলাংসুর মাথায় ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য এক চিন্তা। এই এক বছরে প্রায় পঞ্চাশজন কৃষক ছেলে নিখোঁজ হয়েছে। তাদের আজ পর্যন্ত কেউ খুঁজে পায়নি। কে বা কারা এ কাজ করছে, তাই এখন খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে