❤#ইচ্ছে_ডানা
#সপ্তদশ_পর্ব❤
আজ সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছে সৌরিতা। অন্যদিন এত ভোরে ওঠার কথা ও মাথাতেও আনেনা, কিন্তু আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে ও। বা বলা ভালো কাল রাতে একফোঁটা ঘুমই হয়নি ওর। সিদ্ধান্তের দোটানায়, সংশয়ে দু’চোখের পাতা কোনোভাবেই এক করতে পারেনি সৌরিতা। ভোররাতের দিকে হালকা একটু ঘুমের আমেজ এসেছিল,ব্যস ঐটুকুই। স্থানটা করার পরে শরীর-মন আগের থেকে বেশ ঝরঝরে লাগছে। ছাদের র ধারের কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর শ্বাস নিল সে। আজকের বাইরের পরিবেশটাও বড়ো অদ্ভুত লাগছে, কীরকম একটা যেন মনখারাপ করা আবহাওয়া…..
এই মুহূর্তে বাড়ির লোক সবাইই প্রায় রাজীবের সাথে তার সম্পর্কের অবনতির কথা জেনে গেছে, আর এতে অস্বাভাবিকতারও কিছু নেই। এতদিন ধরে এখানে থাকার পরে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা উঠেছিল। আর কিছু লুকিয়েও রাখেনি সৌরিতা, যা ঢেকে রাখার নয় তা গোপন করে লোক হাসিয়ে লাভ নেই। এর থেকে সোজা-সাপ্টা সত্যি বলে দেওয়া অনেক সহজ, সরল।
গতকাল রাজীবের কথা মনে মনে অনেক ভেবেছে সৌরিতা, ওর ভালো দিক, খারাপ দিক সবটা ভেবে দেখেছে। ওর আকর্ষণ কি শুধুই অফিসে টাকা পয়সার প্রতি ছিল? নাকি মোহরের প্রতিও ছিল?? বিয়ের আগেও ওদের মধ্যে সম্পর্কে কম ঝামেলা- ঝগড়া হয়নি। প্রতিবারই সৌরিতাই এগিয়ে গেছে সবকিছু মানিয়ে নিতে। রাজীব আজ প্রথম বার নয়, সেই তখন থেকেই সম্পর্ক নিয়ে এরকম অযত্নশীল ছিল। ওর মনে সবসময় বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যে যাই হয়ে যাকনা কেন সৌরিতা কখনো ওকে ছেড়ে যাবেনা, প্রতিবার সেই এগিয়ে আসবে সব ঠিকঠাক করতে। কিন্তু ও বোধহয় ভুলে গিয়েছিল, যে মানুষের ধৈর্য্যের একটা সীমা থাকে। সৌরিতা প্রথম থেকে ভেবে এসেছে যে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন,কিন্তু নাহ্ কিছু ঠিক হয়নি কখনো। অন্য কোনো ছেলেকে নিয়ে সন্দেহ করা, একটুতেই রেগে যাওয়া এসব আজ নয়, সেই প্রথম থেকেই ছিল। শুধু তখন সেগুলোকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভাবেনি সৌরিতা। রাজীব তাকে ভালোবাসে,এই কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে সে, এতে কোনো কৃত্রিমতা নেই।কিন্তু কেবল কি ভালোবাসা দিয়ে সংসার টিকে যায়? ঐ ভালোলাগা-মুগ্ধতা, প্রেম নিয়ে ভালোবাসা হয়ে যায়, তবে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে, বিশেষ করে বিয়ের পরে….. যখন দু’টো মানুষ একে অপরের সাথে দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটায়….সেক্ষেত্রে ভালোবাসা, বিশ্বাসের পরেই একে অপরকে বোঝাটা খুব জরুরী হয়ে পড়ে। অপর দিকে মানুষটার শুধু ভালো দিক গুলোই বিয়ের আগে চোখে পড়ে, কিন্তু একসাথে থাকতে থাকতে বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি প্রকট হতে শুরু করে দেয়। আর ঠিক এই কারণেই হয়তো সেই অদৃশ্য খাঁচা থেকে বেরিয়ে আর সেখানে ফিরতে চাইছেনা সৌরিতা। রাজীবের কাছে ফিরে না যাওয়ার কারণটা যে কেবলই সৌরদীপই নয়, তার নিজেরই বহু সুপ্ত-অবদমিত ইচ্ছা সেটা বুঝতে পেরে যেন কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে সৌরিতার ……. সৌরদীপ বোধহয় শুধুই একজন অনুঘটক মাত্র, তার ইচ্ছেকে ইন্ধন দেওয়ার জন্য ….
নিজের মনকে শেষবারের মতো শক্ত করে, ছাদ থেকে একবার নীচের দিকে তাকিয়ে নিল সৌরিতা। এখনও রাস্তায় তেমন লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়নি। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা বের করে রাজীবের নম্বরটা বের করল ও। যা করতে যাচ্ছে তা কি সত্যিই ঠিক হবে?? নিজেকে শেষবারের মতো আরো একবার জিজ্ঞেস করে নিল সৌরিতা। গত রাতের মতো, আরেকবার অনেকক্ষণ চিন্তা করে সেই সিদ্ধান্তেই ফিরে এল সৌরিতা। এত ভোরে রাজীবের ওঠা অভ্যাস আছে এমনিতেই, তাই অসুবিধা হবেনা কিছু। রাজীবের নম্বরটি ডায়াল করে, উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল সে।
রাজীব বোধহয় জেগেই ছিল, আর ফোনের আশেপাশেই ছিল। একবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই ফোনটা ধরে নিল ও। সৌরিতা কিছু বলার আগেই উৎসাহিত গলায় রাজীব বলে উঠল,
-” আমি জানতাম সৌরিতা, তুমি ফোন করবেই। তুভি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেই না। ঠিক বললাম তো?”
-” রাজীব আমার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে। তুমি এখন ফাঁকা আছো?”
-” হ্যাঁ, আপাতত কিছু করার তো নেই। বলো, কী বলবে? তোমার গলার আওয়াজটা এরকম কেন লাগছে?? কী হয়েছে??”
-” আচ্ছা রাজীব, তুমি আমাকে ভালোবাসো তাই তো??”
-” হ্যাঁ বাসি। এটা জিজ্ঞেস করার কী আছে??”
-“তুমি বিয়ের আগে একটা কথা বলতে মনে আছে?? যে পৃথিবীর সব ওলোট পালট হয়ে গেলেও আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবনা, এমনকি তুমি বড়ো কোনো অপরাধ করলেও না। মনে আছে??”
-” হুম, বলেছিলাম তো, এখনো বলছি ওটা সত্যিই বলেছিলাম”
-” তো তোমার যদি আমার প্রতি এতটাই বিশ্বাস, মোহরের ব্যাপারে কথাগুলো আমাকে অন্তত কেন বলোনি? তুমি ওর সাথে নাহয় প্রমাণের খোঁজ না পাওয়া অবধি অপেক্ষা করে, অভিনয় করতে। কিন্তু সবটা আমি অন্তত জানতাম! আমাকে প্রথমে সব সত্যি এসে বললে তোমার উপর রাগ করতাম, কিন্তু ছেড়ে নিশ্চয় যেতাম না, তাই না??”
-” হ্যাঁ, আমি তো স্বীকার করছি আমার ভুল। সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারিনি যে কী করা উচিত, আর উচিত নয়।
-” বেশ বুঝলাম। ঠিক আছে, তোমার যেটা ভালো মনে হয়েছে তুমি করেছো। এই নিয়ে আমার আর কোনো কথা তোমাকে বলার নেই। তবে তোমাকে একটা কথা আমার জানানোর আছে, সেটা হল আমি তোমার সাথে আর কোনো রকম কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা। আমি ডিভোর্স চাই, এই সম্পর্কের শেষ চাই”
-” মানে???”
মাথার উপর বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা অবাক হতনা রাজীব, যতটা সে সৌরিতার কথা শুনে হয়ে গেল। সৌরিতা নিজের মুখে ডিভোর্সের কথা বলছে?? যে কিনা একসময় এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য চোখের জল ফেলে আকুতি মিনতি করেছে সবসময়!
অবাক হওয়া গলাতেই রাজীব জোর গলাতেই আবার বলল,
-” সৌরিতা কী বলছ এসব? তুমি আমার শুধু, আমি জানি আমি যাই করিনা কেন তুমি আমাকে ছাড়তে পারোই না। আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, বুঝেছ কী বললাম??”
-” কেন আমি কি কেনা তোমার সম্পত্তি রাজীব? আর তুমি আমাকে বিয়ে করোনি, আমাদের বিয়ে হয়েছে- কথাটা এভাবে বলতে শেখো। সম্পদ আর সম্পত্তি কথাটার মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আছে বুঝলে? সেটা বোধহয় তুমি জানোনা।”
-” তুমি কি আমাকে এইসব জ্ঞান দেওয়ার জন্য সকাল সকাল ফোন করেছো??”
-” না তোমাকে জ্ঞান কেন দেব, দোষ তো একার তোমার নয়। আমার নিজেরও অনেক দোষ ছিল, এখনো আছে।”
-” দোষ?? কী দোষ?”
-” আমার একজনকে ভালোলাগে, মানে আমি যেরকম একটা মানুষ চেয়েছিলাম, সে হয়তো সেরকমই। জানিনা কীরকম পুরোপুরি ধরনের মানুষ। তবু, তোমাকে বললাম, মনে হল বলা উচিত তাই।”
রাজীবের অবাক হওয়ার ধাপ যেন একটার পর বেড়েই চলেছে। সৌরিতা রাগের মাথায় ডিভোর্সের কথা বলছে, এটা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু অন্য কাউকে ভালো লাগে মানে ??? এটা কী করে সম্ভব??? সৌরিতা কি মজা করছে তার সাথে?? রাজীব এবার একটু কড়া সুরেই বলল,
-” কীসব কথা বলে যাচ্ছ??? অন্য কাউকে ভালো লাগে মানে?? তার মানে আমার সন্দেহই ঠিক?? আমাদের ফ্ল্যাটের ঐ ধীমান ?? সত্যি করে বলোতো”
-” বাহ্ এই তো, আবার আগের স্বভাবে ফিরে এসেছ দেখছি। তারমানে ঐ সন্দেহটা শুধু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য করতে না তুমি, তাই তো?? মন থেকেই কোথাও কোথাও সন্দেহটা ছিলই, তাই তো?”
-“দেখো সৌরিতা, এত হেঁয়ালি ভালো লাগেনা। যেটা বলার পরিস্কার করে বলো।”
-” যেটা বললাম সেটাই সত্যি। আমার একজন বন্ধু আছে, যাকে আমার ভালোলাগে। সেও আমাকে পছন্দ করে কিন্তু তা বলে এটা ভেবোনা যে তার সাথে নতুন জীবন শুরু করব বলে তোমার থেকে ডিভোর্স চাইছি।, তোমাকে সব সত্যি জানাব তাই বললাম ”
-” কে সে? কী নাম?”
-” থাক সেসব নাহয় থাক। আমার খোঁজ আর নিও না, আমি কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব সব, সই টুকু করে দিও, আমাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়নি এখনো, আশাকরি তাই বেশী সমস্যা হবেনা।”
-” সৌরিতা, তুমি এখনো একবার ভেবে দেখ। রাগের মাথায় এসব কথা বলোনা।”
-” আমি সম্পূর্ণ মাথা ঠান্ডা রেখেই কথা বলছি। আশাকরি বারবার তোমাকে একই কথা বলতে না। রাখছি আমি ফোনটা, টাটা”
রাজীবকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা মুখের উপর কেটে দিল সৌরিতা। মনটা অনেকটা হালকা লাগছে এবার, এই সিদ্ধান্তটা নিতে ওকে কম কষ্ট পেতে হয়নি। তা সত্ত্বেও যে পেরেছে এটাই অনেক হয়তো। এবার দ্বিতীয় ফোনটা করতে হবে সৌরদীপকে। তবেই সম্পূর্ণ হবে কাজ। চটজলদি সিদ্ধান্ত জীবনের কত বড়ো ক্ষতি করতে পারে, তা রাজীব আর তার বিয়েটাই প্রমাণ করে দেয়। সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়লেই, জীবনে যত সমস্যা। তাই এই সমস্যার সমাধান সৌরিতা নিজেই করবে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিটের পর, বাকি পড়াশোনা টুকু এবার শুরু করা যেতেই পারে, বা পরে ছোটোখাটো কোনো চাকরি জোগাড় করা কি খুব চাপের হয়ে যাবে, চেষ্টা তো করা যেতেই পারে। নিজের প্রতি এটুকু বিশ্বাস তার আছে, সে অবশ্যই পারবে ……
ক্রমশ….