❣#ইচ্ছে_ডানা
#ষোড়শ_পর্ব❣
সৌরিতা কখন থেকে একমনে বইটা পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা। মনের ভিতরের এত অস্থিরতা থাকলে কি আর মনোযোগ ধরে রাখা যায়! ওর জীবনে সামনে এতবড়ো একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হতে চলেছে …..এখনো কত কিছু ওঠাপড়া, মানসিক-কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া বাকি রয়ে গেছে। আর এমন সময়েই এরকম অস্থিরতা মনের। বইয়ের পৃষ্ঠাটা ভাঁজ করে, সেটা বন্ধ করে রাখল সৌরিতা। একটু আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে সে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর ফোনটা বেজে উঠল সশব্দে…..।
ও প্রথমে ভেবেছিল ধরবেনা, কিন্তু তারপর মত পরিবর্তন করে বিরক্ত মুখে ফোনটা হাতে নিয়েই হঠাৎ থমকে গেল সৌরিতা। রাজীবের নম্বরটা ফোন থেকে ডিলিট করে দিলেও, ওর সেই ভীষণ পরিচিত নম্বরটা তো চাইলেও কোনোদিন মন থেকে মুছতে পারবেনা সে। কিন্তু এতদিন আবার কেন রাজীব এমন সময়ে ফোন করছে সেটাই বোধগম্য হলনা সৌরিতার। যে অতীতটাকে সে মুছে ফেলতে চাইছে প্রাণপ্রণে, সেটাই বারবার কেন, ওর সামনে চলে আসছে ?? অনেকক্ষণ ধরে, বিভিন্ন রকম কথা ভাবনা চিন্তা করার পরে খানিকটা কৌতুহলের বশেই ফোনটা ধরল সৌরিতা। ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে রাজীবের উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। প্রচন্ড খুশি খুশি গলায় রাজীব বলে উঠল,
-” সৌরিতা প্লিজ আজ তুমি ফোন কেটোনা। আমার কয়েকটা কথা বলার আছে, প্লিজ। কথা গুলো শুনলে তুমি নিজেও খুশি হবে। আমাকে আর ভুল বুঝবে না তাহলে….”
আজ বোধহয় বহুদিন পরে রাজীবের সেই আগের মতো গলার আওয়াজটা শুনতে পেল সৌরিতা। বিয়ের আগে ঠিক এমনি করেই, কথা বলত ও। এতদিন পরে সেই পুরোনো অনুভূতিতে আবার যেন গলার কাছটায় কীরকম একটা কষ্ট চেপে বসে রইল। এরকম করে বলার পরে, নিশ্চয় আর না শুনে চুপ করে থাকা যায়না। কিন্তু এখন রাজীব যে কীসব কথা বলতে চাইছে সেটাই বা কী বিষয়ে?? কৌতুহলে বুকের ভিতরে অদ্ভুত এক অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল সৌরিতার। ও কোনোরকমে মনের ভেবে গোপন করে বলল,
-” হুম বলো কী বলবে?”
-” তুমি ফিরে কবে আসবে, আগে সেটা বলো ???”
-” কোথায় ফিরে যাব?”
-” কেন তোমার বাড়িতে, তোমার নিজের ঘরে। এভাবে কেন কথা বলছ তুমি সৌরিতা?”
-” কারণ ওটাকে আমি নিজের ঘর বলে মানিনা। আর তাছাড়া, আমি কি তোমার কেউ হই?? কেউ না তো?? ব্যস হয়ে গেল তাহলেই, তুমি আর তোমার ঐ ঘর আমার কেউ না, কেউনা ।”
-” সৌরিতা আমি জানি, তোমার মনে অনেক অনেক রাগ, অভিমান জমে আছে। সব আমার দোষ, আমি বলছি তো। কিন্তু আমাকে একবার বলার সুযোগ তো দাও। তারপর যা বলার বলবে। আমি এতদিন তোভার সাথে এরকম ব্যবহার কেন করেছি, জানতে চাইতে না?? আমি আজ তোমায় সবটা বলতে চাই, প্লিজ একটু শোনো আমার কথাটা”
ফোনটা কানে চেপে বিছানায় ফের বসে পড়ল সৌরিতা। কান্নায় ওর কন্ঠস্বর বুজে আসছে ক্রমশ। রাজীবের এত আকুতি ভরা কথা শুনে ওর মনের ভিতরে এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা দেওয়ালটা যেন একনিমেষে গুঁড়ো হয়ে যেতে লাগল। মাস ছয়েক আগে পর্যন্তও ঠিক এভাবেই সৌরিতা আকুতি-মিনতি করত রাজীবের পায়ের কাছে। নিজেদের তিলতিল করে গড়ে তোলা সম্পর্কটা জুড়ে নেওয়ার জন্য কম চেষ্টা তো সে করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ব্যর্থ হয়েছে, হেরে গেছে নিজের কাছে, আর বাকি সবার কাছেও…..
ঐদিকে তখন রাজীব ক্রমাগত বলে যাচ্ছে নিজের কথা। এতদিন ধরে ঘটে যাওয়া, সব কথা, মোহরের কথা,ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর প্রত্যেকটা কথা ভীষণ মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল সৌরিতা। তবে মোহরের কথাটা শোনামাত্রই যেন চমকে উঠল ও। মোহর????! সত্যি? ঐ মেয়েটাকেই তো বেশি ভরসা করে নিজের সব সমস্যার কথা খুলে বলেছিল সৌরিতা। আর সেই মোহর ই কিনা এসবের জন্য দায়ী?? এসব কি আদৌ সত্যি? নাকি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য রাজীব বানিয়ে বানিয়ে এসব বলে যাচ্ছে ! কিন্তু তা হলেও, এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে যখন কথাগুলো রাজীব বলছে তখন, কিছু তো সত্যি অবশ্যই আছে। কিন্তু এখন এইসব কথা কেন বলতে এসেছে ও??
রাজীবের কথা শুনতে শুনতে চোখটা একবার বন্ধ করতেই অন্ধকারে সৌরদীপের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল সৌরিতার। ভীষণ রকম একটা দোটানায় পড়ে গেল সে। ওর মনে পড়ে গেল, ঠিক আজ সকালেই সৌরদীপের সাথে হওয়া কথাগুলো। নতুন জীবন শুরু করার জন্য, সৌরিতার বাড়ির লোককে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কত রকম উপায়ের কথা বলছিল ছেলেটা। এরা যে বলা উচিত না, সৌরিতা নিজেও সায় দিয়েছিল সেইসব কথায়। মনে মনে বিভিন্ন রঙিন স্বপ্নের জাল ও নিজেও বুনেছিল। তাহলে, সৌরদীপের প্রতি একটা দুর্বলতা রাখা সত্ত্বেও এই মুহুর্তে রাজীবের কথা শুনে ওর বুকের ভিতরটা এরকম হচ্ছে কেন?? এ কোন সর্বনাশের খেলায় জড়িয়ে গেল সৌরিতা??
ব্যাপারটা কল্পনা করেই মনে মনে শিউরে উঠল সৌরিতা। এও কি সম্ভব? কখনো দু’জন মানুষকে একই সাথে ভালোবাসা সম্ভব? নাহ, অসম্ভব! কেউ তো মিথ্যে তার জীবনে, হয় সৌরদীপ নয়তো রাজীব। রাজীব তার এতদিনের ভালোবাসা, তার বিয়ে করা স্বামী। ওকে তো কোনোভাবেই জীবন থেকে বাদ দেওয়া যায়না। কিন্তু সৌরদীপ???
এই মুহূর্তে তো সৌরদীপ তার জীবনে বর্তমান। এখন সত্যি শুনতে অন্যরকম লাগলেও, রাজীবকে অতটা সবসময় মনে পড়েনা সৌরিতার। সৌরদীপ আর সে কেউ কাউকে মুখ ফুটে না বললেও, একে অপরের প্রতি যে ওরা দুর্বল তা তো কথাবার্তায় স্পষ্ট। যেহেতু দু’জনেই একটা কষ্টের জীবন থেকে, প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে, তাই ওদের কাছাকাছি আসতে খুব বেশী সময় লাগেনি। কিন্তু এখন এই পর্যায়ে এসে সৌরদীপকে জীবন থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া কি আদৌ সম্ভব?? ওর মতো একজন বন্ধু হিসেবে এর আগে সৌরিতাকে কখনো কেউ এতটা সামলে রাখেনি, এমনকি রাজীব ও না।
ওপাশ থেকে সৌরিতার কোনো উত্তর না পেয়ে রাজীব একটু গলার স্বরটা বাড়িয়ে, বলে উঠল,
-” কী হল? কথা বলছ না যে? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো???”
-‘হ্যাঁ? হুমম। পাচ্ছি। বলো”
-” তাহলে উত্তর দিচ্ছ না যে?? সবটাই তো বললাম তোমাকে, এবার বলো আমার দোষটা কি ক্ষমাযোগ্য নয়?? মানছি আমিও ভুল করেছি, তা হলেও, আমি বাধ্য ছিলাম সত্যি। তুমি বুঝতে পারছ?”
-” হ্যাঁ । প্লিজ রাজীব, আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছেনা। আমি তোমার সাথে পরে এই নিয়ে কথা বলছি। আমার ঘুম পাচ্ছে প্রচন্ড। রাখছি”
রাজীবকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হুট করে ফোনটা কেটে দিয়ে, বিছানায় উপুড় হয়ে সজোরে শুয়ে পড়ল সৌরিতা। এতদিনেও, এত কষ্টেও ওর যে কথাটা কখনো মনে আসেনি, সেটাই এই মুহুর্তে ভেবে বসল ও, মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। এত দোটানা, এত মানসিক চাপ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। আজ সকালেও অবধি রাজীবকে ডিভোর্স দেওয়ার সবরকম পরিকল্পনা করে রেখেছিল সৌরিতা।
ওর বিরুদ্ধে জমিয়ে রাখা সব ঘৃণা, অভিযোগ গুলো সেই ধারণা বদ্ধমূল করতে আরো সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন রাজীবের কথা গুলো শোনার পর তো ওর উপর, সেই আগের রাগ-ঘৃণাটা কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না তো আর! এরকম মনের দোটানা নিয়ে, কারোর সাথেই কি সংসার করা যায়? ভালো থাকা যায়?? এখন রাজীবের কাছে ফিরে গেলে, আজ না কাল হোক ও সৌরদীপের কথা জানতেই পারবে। ও যেরকম ছেলে, ঝামেলা অবশ্যই হবে এটা নিয়ে , স্বাভাবিক। আর সৌরদীপের কাছে চলে গেলে, সারা জীবন রাজীবের কথা ভেবে আফশোস করে যেতে হবে। তাহলে? নিজের উপরই নিজের প্রচন্ড রাগ হতে লাগল সৌরিতার….. একটা সিদ্ধান্ত তো ওকে নিতেই হবে, কালকে সকালের মধ্যেই। যেভাবেই হোক…….
(ক্রমশ)