ইচ্ছে ডানা পর্ব-১৫

0
969

❣#ইচ্ছে_ডানা
#পঞ্চদশ_পর্ব ❣
সৌরিতা কথার উত্তরে ঠিক কী বলবে ভেবে পেলনা। মাথার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর যেন কিলবিল করতে লাগল। সেই উত্তরের ভিড় থেকে কোন উত্তরটা বেছে নেবে, তা ঠিক করতে পারলনা সে। তবে মনের এত দোনোমোনার ভাবটা মুখে প্রকাশ করল না সৌরিতা। সৌরদীপকে প্রায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করানোর পরে সে ধীরগলায় বলে উঠল,

-” তবু জীবনের এতবড়ো সিদ্ধান্ত এভাবে দ্রুত মাথায় নেওয়া কি উচিত??”

-” এটা আমার মাথাতেও যে আসেনি তা না। কিন্তু সৌরিতা, আর কত ধীর-শান্ত মাথায় চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলে জীবনে সেটা কার্যকর হবে বলতে পারো??
আমি ঠিক করেছি, কোনো সিদ্ধান্তে আর ভাববনা। যা কিছু ভালো, তা এখনই পেতে চাই, এই মুহূর্তে। পরে, অন্যদিন, আরেক সময়- এসব আর না। তবে তুমি না চাইলে আমি একপাও এগোতে চাইনা, পারবওনা। বলো তুমি এবারে, তুমি চাও তোমার আগের জীবনে ফিরে যেতে??”

-” আচ্ছা সৌরদীপ আমাকে একটা কথার উত্তর দিতে পারো??”

-” কী কথা বলো”

-” মানুষ কি একা বাঁচতে পারেনা?? কাউকে না কাউকে কি চাই-ই?? আমি যদি এখন এই মুহূর্তে চাই যে সারা জীবনের মতো একা থাকতে, তা কি সম্ভব হবে?? বলবে প্লিজ? ”

-” তুমি কি এই মুহূর্তে একা থাকতে চাও?? আগে সেটা বলো?? মন থেকে ভেবে বলো ”

-” না চাইনা।এই মুহূর্তে আমার পাশে সত্যিই কাউকে একটা চাই, আমি একা থাকলে হয়তো পাগলই হয়ে যাব এবার। কিন্তু পরে যদি কখনো, মনে হয়?? কখনো যদি আমি নিজেই পাল্টে যাই? কখনো যদি এরকম মনে হয়, যে আমি তোমার সাথে আর থাকতে পারছিনা, তখন???”

-” বেশ তখন একা থাকবে। জীবনে একা থাকারও তো দরকার আছে। তোমার যদি মনে হবে আর থাকতে পারছনা , তুমি সরে যেতে পারো, আমি বাধা দেবনা”

-” বেশ। আমি ভেবে তোমাকে জানাবো। এখন ফোন রাখি তাহলে??”

-” হুমমম ভাবো। আমি অপেক্ষা করব, তোমার উত্তরের। যদি এজন্য তোভার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে হয়, তাও বলতে রাজি আছি। এটা মাথায় রেখো, কেমন?”

-” হুমমম”

ফোনটা রেখে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল সৌরিতা। কিছু সময় পরে, আবার একটা নতুন সকাল হবে। আবার সবকিছু নতুনভাবে শুরু হবে। শুধু ওর জীবনে হয়তো সমস্ত জিনিস সেই আগের মতই থাকবে। বা হয়তো কিছু পরিবর্তন ঘটতেও পারে। ভাগ্য জিনিসটা বাদ দিয়ে এখন আর কিছুর উপর ওর ভরসা, আশা বা বিশ্বাস নেই।

************

কয়েকদিন পর…
রাজীব প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পকেট থেকে ফোন টা বের করল। আজ এতদিন, এতদিন পর, ওর একটা ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। নিজের মাথার উপর জমে থাকা বোঝাটা হালকা করতে পেরেছে আজ সে একটু হলেও। অফিসের বাইরে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় একটা গভীর শ্বাস নিল রাজীব। স্বাধীনভাবে, মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে তা এই কয়েকমাসে যেন ভুলতেই বসেছিল সে। আজ মোহরের সাথে মুখোমুখি সব কথা গুলো মিটিয়ে নেওয়ার পর সেই আফশোসের ভারটা আবারও খানিকটা বেড়ে গেল রাজীবের।

দুইমাসের ও বেশি হয়ে গেল সৌরিতার সাথে কথা হয়না। মাঝে সে নিজেই একবার ফোন করেছিল সৌরিতাকে। কিন্তু মেয়েটা বড্ড অদ্ভুতভাবে কথা বলে ফোন রেখে দিল সেদিন। তবে বেশি কথা বাড়ায়নি আর রাজীব, ওর অভিমান-রাগ সবকিছুর কথা মাথায় রেখেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। কিন্তু আজ তো সেসব কোনো বাধাই নেই, আজ তো রাজীব সবকিছুর মুক্ত হয়েছে। কথাটা মাথায় আসতেই রাজীবের মনে পড়ে গেল, কয়েকঘন্টা আগে মোহরের সাথে হওয়া কথাগুলো। মোহর হয়তো কখনো ভাবতেও পারেনি যে রাজীব এরকম কথার উত্তর দেবে কোনো না কোনো একদিন। রাজীব যখন মুখের সামনে গিয়ে আজ সকালে ওর সামনে গিয়ে বলল কথাটা…….

মোহর প্রতিদিনের মতই টেবিলে বসে নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে সে দেখছিল, ঠিক এমন সময়ে হঠাৎই রাজীব ঝড়ের বেগে ঘরে এসে ঢুকল, কোনোরকম পারমিশন ছাড়াই। মোহর চমকে অবাক চোখে ওর দিকে তকিয়ে বলল,

-‘ কী ব্যাপার? কী হয়েছে?”

-” মোহর আমার তোমার সাথে কথা আছে, এক্ষুণি।”

-” ডিভোর্স এর ব্যাপারটা ভেবে দেখলে নাকি??? ”
উজ্জ্বল চোখমুখ নিয়ে বলে উঠল কথাটা মোহর।

-” জাস্ট শাট আপ। আমি তোমাকে অন্য কথা বলতে এসেছি। খুবই দরকারি কথা।”

-” মানে?”

-” মানেটা হল, যে তুমি আমাকে এতদিন যেই ব্যাপারটা নিয়ে ভয় দেখিয়েছ, সেই ব্যাপারটা নিয়ে তোমার ভয় পাওয়ার সময় চলে এসেছে,রেডি থাকো কেমন??”

-” মানে ?? কী বলতে চাইছ টা কী??”

মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মোহরের। রাগে টেবিলের উপর চাপড় মেরে ও উঠে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল। যদিও রাজীব মোহরের রাগে তেমন পাত্তা দিলনা। নিজের মতই ও আত্মবিশ্বাসের সাথে ফোনের কয়েকটা ছবি বের করে টেবিলের উপর রাখল। তারপর বলল,

-” আমি তো দোষ করেইছি, সেটা আমি স্বীকার করছি। মেনে নিচ্ছি। তবে আমার প্রথমেই এই সন্দেহটা হয়েছিল যে, আমার টাকা কারচুপির ব্যাপারটা তুমি এত সহজে ধরলে কীভাবে! আমি খোঁজ নিতে শুরু করলাম,তুমিও নিজের অজান্তেই অনেক তথ্য দিয়ে দিলে আমাকে। তারপর ছিল শুধু অপেক্ষা, কবে তোমার মুখোশটা খুলে দিতে পারব সবার সামনে। কিন্তু মুখোশ খুলতে গিয়ে তো আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম, কয়েকদিন আগে কী বলেছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসো?? হাঃ হাঃ হাঃ! রিয়েলি??? ভালোবাসার মানে তুমি বোঝো?? যে উন্নতির শিখরে যাওয়ার জন্য নিজের সম্মান কে অন্যের বিছানায় বিলিয়ে দেয়, তার মুখে ভালোবাসা কথাটা কি মানায়??……..”

-” রাজীব! আমি কিন্তু এবার ভুলে যাব যে, তুমি আমার থেকে সিনিয়র হও। মুখ সামলে কথা বলো। নিজে এত বড়ো পদে এলে কী করে?? আমার দয়াতেই তো?”

-” হ্যাঁ তোমার দয়া আছে, কিন্তু আমি বাধ্য হয়েছি এই দয়া নিতে,চাইনি নিতে এটা। প্রতি পদে পদে আফশোস করেছি নিজের ভুলের জন্য। কিন্তু তুমি? আমার থেকেও বেশি লোকসান করেছো কোম্পানির। আমি যা কিছু ক্ষতি করেছিলাম, তা এই কয়েক মাসের মধ্যে নিজের এক্সট্রা সময় দিয়ে খেটেছি, সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করেছি। আর তুমি প্রতিদিন একটু একটু করে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছ তাই না???”

-” তুমি এই ছবি গুলো কোথায় পেলে?? এটা আমাকে বলো”

-” পেয়েছি। কারণ, এসব কখনো চাপা থাকেনা তাই। আমার এই কোম্পানির সাথে কোনো লেনদেন নেই, কারণ অন্য আরো ভালো জায়গায় জয়েন করতে চলেছি। তবে হ্যাঁ যেটুকু দয়া তুমি আমাকে করেছিলে, সেটুকুর বদলে একটা দয়া আমি তোমাকে করে যেতে পারি যাওয়ার আগে। ”

-” কী দয়া?”

-” আমি আমার স্ত্রী সৌরিতাকেই ভালোবাসি, অ্যান্ড ইটস ইমপসিবল টু লিভ হার…..ওকে?? আমি ওকে নিজের দোষের কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নেবে, আর সারা জীবনের মতো তোমার সাথে দূরত্ব তৈরী করব। তুমি যেমন কাউকে কিছু বলোনি, আমিও বলবনা। এটুকুই বলব, পারলে এসব বন্ধ করো। কিন্তু হ্যাঁ তার বদলে তুমি আর কোনোরকম কোনো সম্পর্ক রাখবেনা আর আমার সাথে, সেটা কথা দিতে হবে। বলো রাজি???”

-” তুমি ভেতরে ভেতরে এত কিছু করে ফেলেছ??? এতোদিন আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে এখন নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়েছে?? বাহ্, বিশাল সাধুপুরুষ তো দেখছি’

-” আমার প্রশ্নের উত্তর তুমি দেবে??”

-” সত্যি আমি তোমার শর্তে রাজী হলে আর কাউকে কিছু বলবে না??”

-” নাহ্ বলবনা”

-” বেশ,আমি রাজি।
অনেকক্ষণ ভাবার পর উত্তর দিল মোহর।

-” ওকে, ধন্যবাদ ফর ইওর কো-অপারেশন”

-” রাজীব, তুমি কিন্তু এটা ভালো করলে না, এভাবে ভুলভাবে আমাকে ঠকিয়ে চলে গিয়ে তুমি সুখী হবে?”

-” না আমি সুখী হয়তো হবোনা, কারণ পাপ আমিও করেছি, তবে তোমাকে ঠকানোর থেকেও বড়ো পাপ হল, সৌরিতাকে ঠকানো, সেটা আমি আর করতে পারছিনা। কোনো মতেই……”

এই কথাটাই শেষবারের মতো বলে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল রাজীব। তারপর থেকে বারবার শুধু এটাই ভেবে গেছে যে, ফোন করে সৌরিতাকে ঠিক কোনো কথাটা আগে বলবে? নিজের দোষের কথা, নাকি, ক্ষমা চাইবে! পকেটের ফোনটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সৌরিতার নম্বর ডায়াল করল রাজীব, ওর মনে তখন হাজারো প্রত্যাশা…….। সৌরিতাকে ও যতই যা বলুক, ঐ মেয়েটা তাকে সত্যিই ভালোবাসে, ও কখনো ওকে ছেড়ে যেতেই পারেনা, ভুল বুঝে থাকতেই পারেনা……..

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে