ইচ্ছে ডানা পর্ব-১৩

0
912

❤ #ইচ্ছে_ডানা
#ত্রয়োদশ_পর্ব❤
আংটিটা নেওয়ার সময় সৌরিতার হাতের সামান্য অংশ খুব আলতো ভাবে সৌরদীপের হাত ছুঁয়ে গেল, অনিচ্ছাকৃতভাবেই। সৌরদীপ সেটা বুঝতে পেরেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ওর চোখের দৃষ্টি সেই তখন থেকে না চাইতেও বারবার চলে যাচ্ছে সৌরিতার কপালের ঐ লাল চিহ্ন টুকু দিকে। অনেক প্রশ্ন ভিড় করছে এই মুহূর্তে মনের মধ্যে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সেগুলো কোনোটাই জিজ্ঞেস করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে একা সৌরদীপই না, সৌরিতাও বহুক্ষণ আগেই এই প্রশ্নগুলোর আঁচ পেয়ে গেছে ওর চোখের চাহনি দেখেই। কেন না জানি হঠাৎ করেই সৌরিতার ইচ্ছে করছে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে তার মনে চেপে রাখা সব কথা বলে ফেলা যায় নির্দ্বিধায়, কোনোকিছু গোপন না রেখেই। অচেনা অজানা একটা মানুষকে দেখে কেন এরকম মনে হচ্ছে তার ? এটা কি শুধুই অসহ্য নিঃসঙ্গতার জন্য? কাউকে বলতে না পারা কথাগুলো বলে মন হালকা করার জন্য? নাকি আরো অনেক গভীর কিছু? কই আর কাউকে দেখে তো তার এমন ভরসা জাগেনি মনের মধ্যে? তাহলে, সৌরদীপই কেন?….
দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর, অনেক দোনোমোনো করে সৌরিতা খুব ধীরকন্ঠে হঠাৎই বলে উঠল,

-” সৌরদীপবাবু, আপনার মনে বোধহয় আমাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগছে তাই না??”

ওর কথাটা শুনে প্রথমে খানিকটা চমকে উঠল সৌরদীপ। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে অনেকটা ভাবনার গভীরে চলে গিয়েছিল….নিজের অজান্তেই।
সৌরিতার কথার উত্তরে ও একটু ভেবে বলল,

-” মিথ্যা বলবনা, হ্যাঁ কৌতূহল খানিকটা হয়েছে ঠিকই, তবে সেসব ব্যাপার নিয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করাটা হয়তো ঠিক কাজ হবেনা, তাই আর কী…..”

-” হুমম। বুঝতে পারছি। আসলে আপনার কৌতূহলী হওয়াটাই স্বাভাবিক, হ্যাঁ আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আর তারপরেই এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছি যে, আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি জানিনা এত কথা কেন আপনাকে বলছি, বা আপনিই শুনছেন। তবু ইচ্ছে করছে, তাই….”

কথাটা বলতে বলতেই আচমকা থেমে গেল সৌরিতা। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে, ও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। সৌরদীপ প্রচন্ড কৌতূহলী চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, যেন ওর প্রতিটা কথা ও বুঝতে পারছে বা বুঝতে চাইছে….

-” কী হল, থামলেন যে??” সৌরদীপ বলল।

-” নাহ্ কিছু না, ঐ আর কি। ওটাই, একটু অসুবিধার জন্যই এই আংটিটা নিতে চাইছিলাম না আমি। তাই বারণ করেছিলাম আপনাকে। ”

-” এটা কি আপনার হাসবেন্ডের দেওয়া?”

-” হুমম”

-” আচ্ছা এবার বুঝলাম। আসলে কী জানেন তো সৌরিতা, আমি জানি আপনার কাছে আমি অচেনা, আমার কাছেও আপনি তাই। তবে, যদি এই কয়েকদিনে পরিচয় হয়ে আমার প্রতি আপনার এতটুকু বিশ্বাস হয়ে থাকে, তাহলে আপনি আমাকে বলতে পারেন আপনার সমস্যার কথা। হয়তো আমি পারলেও কোনো সাহায্য করতে পারি ”

-” বিশ্বাস করব বলছেন?? হ্যাঁ সেই! রাজীবকে আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসতাম, আর ও তার কী প্রতিদান দিল? আচ্ছা চেনা মানুষকে বিশ্বাস করার পর সে অচেনা হয়ে যায়, আর অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করলে সে কি চেনা হয়ে যায়?”

-” জানিনা, এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, এটার উত্তর সময়ের কাছেই একমাত্র। তবে এটুকু বলতে পারি যে, সমস্যা চেপে রাখার থেকে সমাধানের চেষ্টা করা অন্তত ভালো। এবার বাকিটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা, কারণ এটা আমি বুঝি, বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট আমিও পেয়েছি।”

-” আপনার গার্লেফ্রন্ড? বিশ্বাস ভেঙেছে?”

-” হুমম”

-” কী হয়েছিল? মানে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে…”

-“না। ও এই পৃথিবীতেই আর নেই”

সৌরিতার কথার মাঝখানেই কথা থামিয়ে বলে উঠল সৌরদীপ। অর্পিতার কথা মনে আসতেই ওর মুখটা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠল সহজ থেকে। সত্যি কথা বলতে কী, সৌরিতা একদম আশাই করেনি, হঠাৎ এরকম একটা কথা শুনতে হবে। ও নিজের মতো করে ভেবেছিল যে, হয়তো রাজীবের মতোই সেই মেয়েটিও ওকে ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু মৃত্যু! নাহ্ এইটা একদমই ছিল অপ্রত্যাশিত……
প্রায় সাথে সাথেই সৌরিতা, নীচু গলায় সৌরদীপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

-” সরি, রিয়েলি ভেরি সরি। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আসলে ভেবেছিলাম যে আপনি বললেন বিশ্বাস ভাঙার কথা…..”

-” না না, আপনি এত সংকোচ বোধ করবেননা প্লিজ, আপনার কোনো দোষ নেই, আমি হলে হয়তো প্রথমে এটাই ভাবতাম। আসলে ও আমাকে কথা দিয়েছিল, সারাজীবন আমার পাশে থাকবে, সাথে থাকবে। বরং আমি জোরে বাইক চালালে , বা বিপজ্জনক কিছু করার কথা ভাবলেই ও আমাকে ধমক দিত, হারানোর ভয় পেত। আর আজ! প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে ভয় পেতে বাধ্য করেছে ও, ওকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমি দিনের পর দিন কাটিয়েছি। আর তারপর যখন সেই ভয়টাই একদিন শেষ হয়ে গেল চিরদিনের মত, ব্যস সেদিনের পর থেকে বাবা মা ছাড়া আর কাউকে হারানোর ভয় পাইনি”

-” আর নিজেকে হারানোর ভয় পান না ???”

-” মানে? ঠিক বুঝলাম না” সৌরিতার আচমকা প্রশ্নে একটু যেন ঘাবড়ে গেল সৌরদীপ।

-” মানে কখনো মনে হয়নি, অনেক চেষ্টা করেও আপনি নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না কোথাও, হারিয়ে ফেলেছেন পুরোপুরি ??”

-” হুমম, নিজেকে তখন হারিয়েছিলাম, যখন অর্পিতা আমার সাথে ছিল, ওর মধ্যেই নিজেকে খুঁজে নিয়েছিলাম। কিন্তু …..থাক, বাদ দিন, এসব মনখারাপের কথাবার্তা। ”

-” হুমমম সেই”

কথায় কথায় ওরা কেউই খেয়াল করেনি যে এর মধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সৌরিতা। ব্যস্ত গলায় ও সৌরদীপের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” অনেকটা দেরী হয়ে গেল, এবার কিন্তু আমাকে আসতে হবে। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।”

-” সৌরিতা একটু দাঁড়ান। আপনাকে দেখে ভারী আশ্চর্য হচ্ছি আমি, জানেন? আজ এতগুলো যে কথা আপনাকে বললাম, এই ব্যাপারে এত গভীর ভাবে কোনো কথা আমি আমার কোনো কাছের বন্ধুকেও বলিনি, অথচ না জানি কেন আপনাকে কথাগুলো বলতে তেমন কোনো সংকোচই হলনা আমার”

-” একদমই তাই, এটা আমার ক্ষেত্রেও। জানিনা কেন, যাই হোক, আমি একটু সমস্যার জন্যই এভাবে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি, কিছু মনে করবেন না। কেমন ? আপনার কিছু বলার থাকলে আমাকে মেসেজ করতে পারেন, আমি দেখে নেব”

শেষের কথাটা বলে নিজেই চমকে উঠল সৌরিতা। ক্রমশ যেন এই মানুষটার সাথে তার কথা বলার আগ্রহটা বেড়েই চলেছে তার, কিন্তু কেন? কেন এই অন্যায় চাহিদা তার মনের মধ্যে আসছে? আর সবথেকে বড়ো কথা হল, আদৌ এটা কি অন্যায়? যেটাকে সে ভুল বলে ভাবছে? যার পাশে একটা কোনো মানুষও দাঁড়ায়নি, যে লজ্জায়, অপমানিত হওয়ার ভয়ে নিজের চেনা কাউকে কোনো কথা খুলে বলতে পারেনি,সেখানে একটা স্বল্প চেনা মানুষকে শুধু মনের ভিতরের কয়েকটা কথা খুলে বলা, তার বন্ধু হয়ে ওঠাটা কি খুব অন্যায় ? পৃথিবীর সবার কথা একমুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়ে, নিজেকে ভালোবাসা বা নিজের ভালোলাগাটাকে অনুভব করাটাও খুব অপরাধের?………

বরাবরের মতোই এবারও এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলনা সৌরিতা। প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও পিছনে ফিরে একবারও না তাকিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। ওর দূরত্ব ক্রমশ বাড়তেই লাগল পিছনে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকা সৌরদীপের সঙ্গে। হয়তো নিয়তি জানে যে একজাল ছিঁড়ে বেরোতে গিয়ে আরো নতুন করে, আরো কোনো জটিল জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ওরা।

***********

সৌরিতা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল কয়েকদিন তখন প্রথমে কিছু মনে হয়নি রাজীবের। বরং কিছুটা স্বস্তিই হয়েছিল। নিজেকে গুছিয়ে, বুঝিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পাওয়া যাবে এই ভেবে। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ততই সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ঘরটা এত পরিমাণে ফাঁকা ফাঁকা এর আগে কখনো লাগেনি, আসলে পরিবারের সাথে মতবিরোধের জন্য সৌরিতা বাপেরবাড়িতে প্রায় যেতনা বললেই চলে, বিয়ের পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্ত, সবসময় যখনই রাজীব এই ঘরে পা ফেলেছে, ঐ মানুষটার অস্তিত্ব পেয়ে এসেছে। সৌরিতাকে এতদিন ধরে করা প্রতিটা অবহেলা, প্রতিটা আঘাত যেন দ্বিগুণ হয়ে আছড়ে পড়তে লাগল রাজীবের মনে। মেয়েটা মুখবুজে শুধু সহ্যই করে গেছে, ওর মিথ্যে, ওর সন্দেহ সবকিছু। তারপরেও বিনিময়ে কী পেল ? দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুইনা।

তবে এসব আর বেশি দিন চলবেনা। এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। মোহরের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ অনবরত খুঁজে চলেছে রাজীব। মোহরের একটা দুর্বলতা খুঁজে বের করতে পারলেই, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দোষ তো ও করেছেই, তবে আর করতে চায়না। দরকার পড়লে নিজের সব অন্যায় সৌরিতার কাছে স্বীকার করে নেবে সে, পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে। সৌরিতা তো তাকে ভালোবাসে, সবটা জানার পর, ও কি সব কিছু ভুলে ক্ষমা করে দেবেনা? নিশ্চয়ই করবে। সেদিন নিজের সমস্ত দোষ-ভুল স্বীকার করে সৌরিতাকে আবার আগের মতো করে নিজের করে নেবে রাজীব। একা ঘরে, সোফার উপর বসে বসে নিজের মনে মনেই প্রতিজ্ঞা করল সে। সৌরিতার ব্যবহৃত কয়েকটা জিনিসপত্র ঘরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষ যতনা বেশি কষ্ট দেয়, তার থেকেও বেশি কষ্ট দেয় তার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো। তার উপস্থিতির মুহূর্তগুলো বড্ড বেশি করে ভাবায় তার অনুপস্থিতিতে।….. কিন্তু সম্পর্কের মাঝখানে জমে থাকা ভুল বোঝাবুঝির বরফ গলতে চায়না কিছুতেই। ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাগ- অভিমানের চাদরে ঢাকা পড়ে যায় কতশত সম্পর্ক…..

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে