ইচ্ছে ডানা পর্ব-১২

0
958

❤#ইচ্ছে_ডানা
#দ্বাদশ_পর্ব❤
সময়ের নিজের নিয়মে দিন পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে অনেককিছু। সৌরিতা এখন বাপেরবাড়িতে। এসেছে সে কয়েকদিনের জন্যই। তবে, এই কয়েকদিনটা যে শেষ অবধি কতদিনে গিয়ে পৌঁছাতে পারে তা সে নিজেও জানেনা। ঐ বাড়িতে থেকে রাজীবের সেই একইরকম আচরণ সহ্য করা ওর পক্ষে সত্যিই সম্ভব হচ্ছিলনা। হয় রাজীব মানসিক ভিবে অসুস্থ হয়ে গেছে, না হলে সৌরিতা নিজেই কয়েকদিন পরে ওরকম কিছু একটায় পরিণত হবে। বিয়ের পরে বেশিরভাগ সময়ই পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, কোনো জায়গা এমনকি নিজের সেই পুরোনো বাড়ি, বাপের বাড়ি যেতেও একটা অজুহাত লাগে, কারণ লাগে। মা বাবা কিছু তেমনটা বললেও, বেশিদিন সেখানে থাকলে প্রত্যেককে ধরে ধরে কৈফিয়ত দিতে হয়, যে ঠিক আর কতদিন সে এখানে থাকতে চলেছে! কেন! কীসের জন্য ….ইত্যাদি ইত্যাদি।

এবারেও তার অন্যথা হয়নি, এই সবে দুদিন হয়েছে তাই কেউ তেমন কিছু বলেনি। তবে সেই বলার যে আর খুব বেশীদিন বাকি নেই তা বেশ বুঝতে পারছে সৌরিতা। আসলে তার নিজের ইচ্ছাতে , সকলের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করার বিষয়টাকে কেউই সহজ ভাবে নেয়নি। এখন যদি ওরাই জানতে পারে ওদের সম্পর্কের এমন অবনতির কথা, তা হলে কারো সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতও অবস্থা থাকবে না সৌরিতার। সবাই হয়তো তার অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করবে, মুখ বাঁকিয়ে তার দোষ দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি, অথচ এদের মধ্যে কেউই একবারের জন্যও তার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করবেনা, কেউ তার হাত ধরে এতটুকু সান্ত্বনা দেবেনা, পাশে থাকবেনা। সৌরিতা খুব অবাক হয়ে যায় একটা কথা ভেবে, যে মানুষগুলোকে আনন্দের সময় এত কাছে পাওয়া যায়, সেই মানুষগুলোই কঠিন সময়ে এত দ্রুত হারিয়ে যায় কীভাবে?? আসলে,পৃথিবীর এই বুঝি নিয়ম, হাসতে হয় সবাই মিলে, আর কাঁদতে হয় একা….

হঠাৎ ফোনের টুং করে বেজে ওঠা যান্ত্রিক শব্দে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে চমকে উঠল সৌরিতা। চোখে চলে আসা অবাধ্য জলটাকে মুছে নিয়ে সে ফোনটা হাতে নিতেই আরো একবার চমকে উঠল সৌরিতা। ফেসবুকের ইনবক্সে একটা নতুন মেসেজ এসেছে, সৌরদীপ এর মেসেজ। একটা ছোট্ট “হাই” লেখা। সৌরিতা কিছু না ভেবেই টাইপ করল,

-” হ্যাঁ বলুন”

মেসেজ পাঠানোর সাথে সাথেই সেটা সিন হয়ে গেল। ওপাশ থেকে উত্তর এল,

-” আসলে সেদিন আমার গাড়িতে আপনি আপনার একটা মূল্যবান জিনিস ফেলে এসেছিলেন। হয়তো টওয়ালে হাত মোছার সময়, কোনো ভাবে ঘটনাটা ঘটে গেছে….। আমি..”

মেসেজের এটুকু অংশ দেখেই চকিতে একবার নিজের হাতের আঙুলের দিকে তাকালো সৌরিতা। যা ভেবেছিল তাই, ওদের বিয়ের সেই আংটিটা, সেটা আর নেই আঙুলে। আগে সৌরিতার আঙুলে এত হালকাভাবে আংটিটা থাকতনা, চেপে বসে থাকত পুরো। এখন বিভিন্নরকম ঝামেলা, দুঃশ্চিন্তায় চেহারা ভেঙে গিয়ে হাতের চুড়ি, শাঁখা, পলা, থেকে শুরু করে আঙুলের আংটি সবই কেমন যেন ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর, হাতটা মুছতে গিয়ে হয়তো কোনো ভাবে খুলে পড়ে গেছে আংটিটা। এই বরং ভালো,সম্পর্কের যা হাল, তাতে নামমাত্র আংটিটা পরে থেকেই কী লাভ!
আনমনে আবার মেসেজের বাকিটুকু পড়ার জন্য ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো সৌরিতা।

-” আমি সেদিন অতটা খেয়াল করিনি ,আজ ড্রাইভিং করার সময় হঠাৎই চোখে পড়ল। মনে হল আপনার হাতেই দেখেছি আংটিটা, তাই আর কি, বললাম”

মেসেজটা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সৌরিতা উত্তর দিল,

-“ওটা আমার আর কোনো প্রয়োজনেই লাগবেনা। আপনি বরং ওটা কোথাও ফেলে দেবেন, আমাকে দিতে হবে না আর”

সৌরদীপ প্রথমে খানিকটা অবাক হয়ে গেল, সৌরিতার মেসেজটা দেখে। ভীষণ খারাপ লাগল ওর, সে নিজে থেকে উপকারই তো করতে গেল, তাতে এরকম উত্তর দেওয়ার কী অর্থ! সৌরদীপ ব্যস্ত হাতে টাইপ করল,

-” সেকি , আপনার জিনিস আপনাকে অবশ্যই সেটা নিতে হবে। আপনি তারপর সেটা ফেলে দেবেন নাকি নিজের কাছে রেখে দেবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই না? আমার কর্তব্য সেটা আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া।”

-” আপনার কি আমার কথাটা শুনে খারাপ লাগল? যদি তাই হয় তাহলে রিয়েলি ভেরি সরি, আসলে আমি এমনি তেই একটু ডিস্টার্বড আছি, তাই একটু এভাবে বলে ফেলললাম। কিছু মনে করবেন না, প্লিজ ” -(সৌরিতা)

-” নো ইটস ওকে। আমি জানিনা আপনার কী হয়েছে, আর জিজ্ঞেস করাটাও আমার পক্ষে শোভনীয় নয়। আপনি বলুন আপনার কবে সময় হবে, আমি দিয়ে দেব আপনাকে এটা” ‘-(সৌরদীপ)

-” আপনি কালকে ফাঁকা আছেন? আমি একটু কলেজ স্ট্রিটের ওদিকে যাব, তখন তাহলে নিয়ে নেব, আপনার হবে কি সময়??” -(সৌরিতা)

-” হ্যাঁ। বেশ, তাই হবে। আপনি টাইমটা আমাকে মেসেজ করে দেবেন। ” (সৌরদীপ)

-“বেশ”

দুরুদুরু বুকে নেটটা অফ করে , জানালার দিকে তাকালো সৌরিতা। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? সৌরদীপ ছেলেটার সাথে কেন না চাইতেও এতবার দেখা হয়ে যাচ্ছে? নিজেকে নিজে এতবার প্রশ্ন করেও কোনো যথাযথ উত্তর পেলনা সৌরিতা।…..

************
বেলা এগারোটা বাজে, সৌরিতা একটা গাছের ছায়ার তলায় দাঁড়িয়ে বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মুখে শান্তভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, ভিতরে ভিতরে একটা চাপা দুশ্চিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ওকে। সৌরদীপের মুখোমুখি হতে হবে আবার এটা ভাবলেই কীরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। এটা তো স্বাভাবিক ভাবে নিলেই ঝামেলা মিটে যায়। তাহলেও কেন সবকিছু কে এত অন্যভাবে ভাবছে কেন! সৌরদীপের কথা মাথায় এলেই একটা অন্যায়বোধ, অপরাধবোধ ঘিরে ধরে……

প্রায় দশ মিনিট দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই সৌরিতা দেখল, সৌরদীপের গাড়িটা তার জায়গাটার দিকেই এগিয়ে এসে থামল। সৌরিতার বুকের ধুকপুকুনি যেন আরো জোরে হতে শুরু করে দিয়েছে ।
সৌরদীপ সানগ্লাসটা খুলে, গাড়ি থেকে নেমে সৌরিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সামান্য একটু রোদ এসে পড়েছে সৌরদীপের মুখে। একটা আকাশি রঙের শার্ট আর জিন্সে এই মুহূর্তে সৌরদীপকে যেরকম লাগছে, তা যে কোনো মেয়ের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সৌরিতার ও এইসব ব্যাপারগুলো নজর এড়ালোনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেকে সংযত রেখে, ও সৌরদীপের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল,

-” আমার জন্য আপনাকে আবার এতটা শুধু শুধু আসতে হল! আর কালকেও ওভাবে আপনাকে বলে ফেললাম কথাটা, সরি ফর দ্যাট ইনসিডেন্স। ”

সৌরদীপ যেন সৌরিতার বলা কথাটা শুনতেই পেলনা প্রথমে। ও একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, বড়ো অদ্ভুত চোখের চাহনি মেয়েটার…. এত অভিজ্ঞতার পর, সৌরদীপের কেন না জানি কেবলই মনে হয়, সৌরিতার মনের মধ্যে অনেক চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে, যেটা ও কাউকে বলতে চায়না, বা বলার মতোও নয় হয়তো। মুখের দিকে তাকাতে তাকাতেই হঠাৎ ওর চোখ পড়ে গেল সৌরিতার কপালের দিকে। সেদিকে নজর যেতেই যেন প্রচন্ডরকম চমকে উঠল সৌরদীপ। কপালের উপরিভাগে, আলতো করে জ্বলজ্বল করছে লাল সিঁদুরের রেখা। হাতে শাঁখা, চুড়ি। অর্থাৎ …..অর্থাৎ সৌরিতা বিবাহিতা??? কিন্তু আগের দিন তো কই, ওকে দেখে একবারও মনে হয়নি, যে ওর বিয়ে হয়ে গেছে? এমনকি ফেসবুক প্রোফাইলেও কোথাও এর চিহ্নটুকু নেই। তাহলে?
হঠাৎ করেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত কষ্ট চেপে বসল যেন সৌরদীপের। কেন এই কষ্টটা তার হচ্ছে সে জানেনা, কে এই সৌরিতা! সে বিবাহিতা হোক বা না হোক, তাতে ওর কী? মাত্র কয়েকদিনের পরিচিতই তো ওরা, এর থেকে তো বেশি কিছু না, কিচ্ছু না।

সৌরদীপের চোখের দৃষ্টিটা দেখে বোধহয় সৌরিতা খানিকটা কিছু আন্দাজ করতে পারল। এটারই আশঙ্কা করেছিল সে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ সিঁদুর, শাঁখা-পলা সবই পরে এসেছে সে। কোনো ভুল ধারণা নিয়ে কেউ বেঁচে থাকুক তা সে চায়না। তার থেকে এই কঠিন সত্যি অনেক ভালো, অনেক। সৌরদীপের কোনো কথা বলতে না দেখে, সৌরিতা আবার ধীরগলায় বলে উঠল,

-” কিছু বলছেন না যে!…..”

-” হ্যাঁ! কী ?? হুমম বলুন। আসলে একটু অন্য কথা ভাবছিলাম আমি”

-” কী ভাবছিলেন, আগের দিন আমাকে দেখে আপনার অবিবাহিতা মনে হয়েছিল, আর বিবাহিতা লাগছে হঠাৎ, এটাই তো??”

-” না-মানে , এরকম কিছু না। হ্যাঁ ভাবছিলাম অবশ্য, তবে সেটা তো আর আপনাকে জিজ্ঞেস করা যায়না। তাই আর কি”

-” আসলে আমাদের অনেকের জীবনেই অনেক গল্প থাকে, আমার আছে আপনি জানেননা। আপনারাও হয়তো আছে, আমি জানিনা। এই গল্পের ঘটনাতেই এমন কিছু পরিস্থিতি চলে আসে, যে ওরকম সেজে ফেলতে হয়। কী বুঝলেন?”

-” হুম। সেই, গল্প তো সবারই আছে। কারো গল্প শেষ, কারো চলছে, কেউ বা আবার শুরুর পথে”

কথাটা বলতে বলতেই পকেট থেকে সৌরিতার আংটিটা বের করল সৌরদীপ। সেটা সৌরিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ওর চোখের দিকে আবার তাকালো সে। অদ্ভুত তো, মেয়েটা বিবাহিতা তা জানা সত্ত্বেও, ওর চোখে বৈবাহিক জীবনের কোনো সুখ-শান্তির চিহ্ন টুকুও যেন দেখতে পাচ্ছেনা সৌরদীপ, কিন্তু কেন?? কী এমন ঘটনা আছে, ওর জীবনে?

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে